ভারতীয় উপমহাদেশের ৮০০ বছরের মুসলিম শাসনের পড়েও ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ হিন্দু ধর্মাবলম্বী। আমি মনে করি এর পিছনে রয়েছে ৩টি কারন। রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কারণ।
রাজনৈতিক কারণ: প্রথমেই বলে রাখি মুসলিম শাসকদের ভারতবর্ষে আগমনের মূল লক্ষ্য ছিল ভারতবর্ষের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। তার মানে এই নয় সকল মুসলিম শাসকেরা এসেছে শুধুমাত্র ভারতবর্ষ শাসন করতে। কেউ কেউ ভারত বর্ষ থেকে সম্পদ লুণ্ঠন করে ফিরে গিয়েছে।এর মধ্যে: তৈমুর লং,নাদির শাহ উল্লেখ যোগ্য। তবে বেশিরভাগ মুসলিম শাসকই চেয়েছে ভারতবর্ষে তাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে। মুসলিম শাসকদের উচ্চাভিলাস ছিল আরব ভূখণ্ডের বাইরে ভারতের মতো একটি সমৃদ্ধ দেশকে শাসন করা। সে কারণেই খিলজি, তুঘলক,লোধী,সুরী কিনবা মোগলরা ভারত আক্রমণ করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ভারতবর্ষকে শাসন করে গিয়েছেন। তারা চাইলেই ভারতবর্ষের সম্পদ লুঠ করে নিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু তারা সেটা করেননি। বরং ভারতবর্ষকে শাসন করে পৃথিবীর বুকে ভারতকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন। তাদের লক্ষ্য ছিল শুধুমাত্র ভারতবর্ষ শাসন করা। ভারতবর্ষের মানুষের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করার তারা কোন চেষ্টা করেনি। যদিও অনেক হিন্দুত্ববাদী লেখক বলে থাকেন- ‘ভারতবর্ষ নাকি মুসলিমদের তলোয়ারের জোরে শাসিত হয়েছে।’ কিন্তু এ দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কারণ ভারত বর্ষ মুসলিম সম্রাটরা শাসন করলেও রাজসভার মন্ত্রী থেকে গুরুত্বপূর্ণ উচ্চপদস্থ বেশিরভাগ রাজকর্মচারীরা ছিলেন হিন্দু। মজার ব্যাপার ভারতের সবচেয়ে হিন্দুবিদ্বেষী যে সম্রাট আওরঙ্গজেবের নাম বলা হয় সেই আওরঙ্গজেবের রাজদরবারেই সব থেকে বেশি হিন্দু রাজ সভাসদ ছিল। যেটা মুঘল সম্রাট আকবরের রাজসভাতেও ছিল না। তিনি এতটা হিন্দু বিদ্বেষী হলে কি তার রাজসভাতে এত বেশি হিন্দু নিয়োগ দিতেন?? মোটেই না।
**সামাজিক কারণ: ভারতবর্ষে মুসলিম শাসকরা জনগণের উপরে ধর্মের বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেননি। এ কারণে সেই যুগে শ্রীচৈতন্যদেব বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করার সুযোগ পেয়েছেন, গুরু নানক শিখ ধর্মের প্রসার ঘটানোর সুযোগ পেয়েছেন। মুসলিমরা যদি তলোয়ারের জোরে পুরো ভারতবর্ষ শাসন করতো তাহলে ভারতবর্ষে অন্য কোন ধর্মের মানুষ ধর্ম পালন করতে পারত না। মধ্য যুগে যে সব ধর্মের বিকাশ ঘটেছিল (বৈষ্ণব, শিখ) সে সমস্ত ধর্মের বিকাশ তো দূরের কথা সে সমস্ত ধর্মের কোন অস্তিত্ব পাওয়া যেত না। মুসলিম শাসকরা তৎকালীন সমাজকে কুসংস্কার এবং কুপ্রথার হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। বেশির ভাগ মুসলিম শাসকদের আমলে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগন শান্তিতে ছিলো। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যদি মুসলিম শাসনে সন্তুষ্ট না থাকতো তাহলে মুসলমানদের পক্ষে ভারতবর্ষে ৮০০ বছর তো দূরের কথা ৮ বছরও শাসন করা সম্ভব হতো না।
**সাংস্কৃতিক কারণ: মুসলিমরা ভারতবর্ষে এসেছিল আরব, তুরস্ক, আফগানিস্তান ও ইরান থেকে। তাদের পোশাক পরিচ্ছদ, খাবারদাবার ভারতীয় জনগণের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। আজকের মুখরোচক খাবার হিসেবে মোগলাই পরোটা, বিরিয়ানি, তেহারি, কাবাব সবইতো মুসলিমদের অবদান। পাশাপাশি মুসলিম শাসকরা ভারতীয় সংস্কৃতির অনেক কিছু গ্রাহণ করেছিলেন। সম্রাট আকবর রাজপুতদের সংস্কৃতিতে অত্যন্ত আকৃষ্ট হন। তিনি বিবাহ করেছিলেন রাজপুত রাজকুমারীকে। এভাবে মুসলিম শাসকরা যুগ যুগ ধরে ভারতের সংস্কৃতির সাথে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছিলেন। তারা ভিনদেশের সংস্কৃতিকে জোর করে এখানকার জনগণের উপরে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেননি। আর সে কারণেই যুগ যুগ ধরে এখানকার অধিবাসীদের ধর্ম পালনে বা সংস্কৃতিতে কোন ধরনের বাধাও আসেনি। সে কারণে ভারতবর্ষ এতদিন মুসলিমরা শাসন করার পরও হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবেই এখনো টিকে রয়েছে।