জাজিরাতুল আরবের প্রদেশ সমূহঃ-
বর্তমান এই যুগে আরব বলতে আমরা উপলব্ধি করতে পারি মুসলিম জাহানের ঐতিহাসিক স্থান ও ইসলামের প্রাণকেন্দ্র মক্কাতুল মুয়াজ্জামা,এটি পূর্বে বাক্কা নামে প্রসিদ্ধ ছিল। মহান আল্লাহ তা’লা তার ঐশীগ্রন্থ কুরআনে পাকে ঐ স্থানকে “উম্মুল কুরা” তথা “আদি নগর” হিসেবে অবহিত করেছেন, এই মক্কা নগরীকে কেন্দ্র করেই ইসলামের প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় এবং এর অন্তর্নিহিত ইতিহাস ইসলাম ও মুসলিম বিশ্বের এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হয়।
১৮৮০ সালের পূর্বে আরব ইতিহাসের যে পরিচয় পাওয়া যায়,সে সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে গেলে ইতিহাস বলে,সে সময়ের আরবীয়দের মধ্যে ছিল সত্যের উজ্জীবিত আদর্শ, নিয়মনীতি, সাম্য,মৈত্রীর এক আভিনব কানুন শৃংখলার বিশ্ময়কর পরিবেশ। আরবীয়দের আদর্শের জাগরণের সৌরভে সুশোভিত হয় সারা বিশ্ব। ততকালীন সময়ে তাদের জীবনাচার ও শিষ্টাচার এমনিভাবে প্রভাবিত করে ছিল যে অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলো আরবীয়দের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থেকে শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে তাদের রীতি-নীতি অনুস্বরন করত। তারাই ছিল সমগ্র মুসলিম বিশ্বের পরিচালক ও সংস্কারক।কেননা,তাদের রাষ্ট্র পরিচালনার সংবিধান রচনা হয়েছিল বিশ্ব জাহানের মুক্তির দিশারী মানবতার পথ প্রদর্শক বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ (দ.) এর আলোকিত সত্যের আদর্শ থেকে এবং তিনি কুরআন-সুন্নাহের আলোকে তাহার উম্মতগণকে ইসলামী গণতন্ত্র-এর যে শিক্ষা দিয়েছেন,তার বিস্তার লাভ করেছিল আরব ভূ-খন্ড থেকেই।
সেক্ষেত্রে তখনকার আরবীয়দের আদর্শ ছিল শিক্ষনীয় এবং তাদের শাসন ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়া ছিল দৃষ্টান্তমূলক। সে আমলে আরবে বসবাসরত অন্যান্য ধর্মের অনুসারিগণ তাদের একতা, ভ্রাতৃত্ব ও আদর্শে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে দলে দলে ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে থাকে এবং মুসলমানদের দিনে দিনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়। এই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রভাব দেখে আরবে অবস্থানরত অন্যান্য কাফির, ইয়াহুদি,নাসারারা ভীষণভাবে ব্যাথিত ও আতংকিত হতে থাকে। তারা তাদের ঐতিহ্য,সংস্কৃতি,রীতি-নীতি হারানোর ভয়ে মুসলমাদের বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্র করতে থাকে।তারা তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী মুসলিম ছদ্মবেশে মুসলমানদের আদর্শ দুর্বল ও ধ্বংস করার নিমিত্তে সর্বদা চেষ্টা চালাতে থাকে। শত চেষ্টার পরেও তারা খুব কমই সফল হয়। কারণ,মুসলমানদের অন্তরে ছিল আল্লাহ ও তার হাবিবের একনিষ্ঠ ভালবাসা এবং কুরআন-সুন্নাহের আদর্শে গড়া প্রবিত্র ঈমান। তারা তখন আরবের মুখোশদারী কিছু মুসলমান তথা মুনাফিকদের সহযোগীতায় তাদের প্রক্রিয়াকে বেগবান করে। যেমন মুসলমানগণ যখন ইবাদতে মাশগুল থাকতেন,তখন তারা মুসলমানদের ন্যায় রূপধারণ করে মুসলমানদের ইবাদাত ও ধর্ম-কর্ম নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করত। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা’লা তাঁহার প্রবিত্র কুরআনুল কারীমে “সূরা মায়েদা”এর ৫৭ নং আয়াত থেকে ৬০ আয়াত পর্যন্ত মুনাফিকদের কার্যক্রম সম্পর্কে ঈমানদারগণকে সাবধান করেছেন।
ওসমানীয় সম্রাজ্য (১৯১৪ সাল)ঃ-
কিন্তু আল্লাহ ও রাসুলের দুশমনের দল তথা ইয়াহুদি, নাসারা, কাফের,মুনাফিকরা অন্যান্য সকল ইবাদত বন্দেগিতে ক্ষতিসাধন করলেও কিন্তু তাদের দ্বারা নবী কারীম (দ.)-এর গুণগাণ,দরুদ ও সালাম পড়া তাদের নিকট আসম্ভব হয়ে পড়ত। ফলে তাদের কার্যক্রম ব্যহত হতো। পরে তারা সম্মিলিতভাবে চিন্তা করতে লাগল যে,মুসলমাদের অন্তর থেকে কিভাবে নবীর প্রেম তথা দরুদ সালাম বের করা যায়। তারা উপলব্ধি করতে পারল যে,নবীর প্রতি ভালবাসাই হচ্ছে মুসলমানের ঈমান ও আদর্শ মজবুত থাকার প্রধান ভিত্তি। আর তা ধ্বংস করতে পারলেই তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে। ফলে মুসলমানদের একতা ও ভ্রাতৃত্ব বিনষ্ট হলে তাদের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ দেখা দিলে অন্য ধরমের অনুসারীরা মুসলমানদেরকে ঘৃনা অবজ্ঞা করতে থাকবে। আর তা যদি বাস্তবায়ন করতে হয়,তাহলে মুসলমানদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। তখনই তাদের দৃষ্টি পড়ল মুসলিম বিশ্বের বৃহত্তর শক্তিশালী দেশ তুরস্কের দিকে। ১৮৮০ সালের দিকে তুরস্কবাসী ছিল অন্যান্য মুসলিম দেশের চেয়ে অধিক নবী প্রেমে উজ্জীবিত। তারা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হিসেবে মিলাদুন্নাবী (দ.) এবং কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ইসলামের মাহাত্ম্য ও মূলমন্ত্রকে প্রচার প্রসার করতেন। তুরস্কবাসীর এই ধরণের অনুষ্ঠান তাদের সহ্য হত না। ফলে তারা তুরস্ক প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে থাকে। তখন তৎকালীন তুরস্কের শাসক গোষ্ঠীর নাম ছিল সুলতানাতুল ওসমানিয়া এবং বাদশা ছিলেন মুস্তফা কামাল পাশা এবং রাজধানী ছিল ইস্তাম্বুল। তখন প্রশাসনের নেত্রীত্বে অধিকাংশ আরব ভূমিকে শাসন করা হত। তার মধ্যে তুরস্কের বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে অন্যতম প্রদেশ হলো ‘নজদ’,যা এখন সৌদ আরবের রাজধানী রিয়াদ নামে খ্যাত।
মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাব নজদীঃ-
তৎকালীন আমলে নজদের গভর্নর ছিলেন রশিদ। আর গভর্নর রশিদ কর্তৃক গঠিত গোত্র শাখার নাম ছিল রশিদীয়া গোত্র এবং রশিদীয়া গোত্রের মাধ্যমে নজদের সকল প্রকার কার্যক্রম সম্পাদন করা হতো। তখন রশিদীয়া গোত্রের আদর্শ ছিল সুন্নি মতাদর্শ ভিত্তিক। কিন্তু নজদের কিছু সংখ্যক লোক এবং তাদের শীর্ষ নেতা সৌদ ও তার পুত্র আব্দুল আজিজ ছিল খারেজী মতাদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ইসলামের ইতিহাসে কথিত আছে যে,৬৬১ খ্রি: বিদ্রোহী খারেজীগণ হযরত আলী (রা:)কে ইসলামের শান্তি-শৃংখলা কারণ বলে দায়ী করে। পরে খারেজী গোত্রের একজন সদস্য যার নাম ছিল আব্দুর রহমান ইবনে মূলজিম হযরত আলী (রা:)কে নামায থেকে ফেরার পথে বিষাক্ত ছুরির অব্যর্থ আঘাতে ৬৬১ খ্রি: ২৭ জানুয়ারি ২১ রমজান হযরত আলী (রা:) কে শহীদ করে দেয়। সেই খারেজী মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা ও প্রচার প্রসারের লক্ষে সৌদ এবং তার পুত্র আব্দুল আজিজ একনিষ্ঠভাবে কাজ করতে থাকে এবং তাদের গঠিত গোত্র পতিদের নিয়ে ধীরে ধীরে সুন্নি মতাদর্শের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও মতানৈক্য করতে থাকে। এখানে উল্লেখ্য যে, ওহাবীদের গোঁমর ফাঁস নামক গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, প্রখ্যাত ভন্ড নবী মুসাইলামাতুল কাজ্জাবের একজন বংশধর, সে নজদ প্রদেশের আল উয়ানীয়া নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন, যার নাম ছিল “মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাব নজদী, সে ছিল সৌদের শ্বশুর। সে বাল্যকাল থাকে ধর্ম বিরোধী ছিল এবং খারেজী মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষে সর্বদা জামাতা সৌদকে সহযোগীতা করত। শেষ পর্যন্ত সৌদের গোত্র খারেজী আদর্শে উদ্ভুদ্ধ হয়ে দূর্বার আন্দোলন গড়ে তুলে। একথা অবশ্যই নবী কারীম (দ:) এর হাদীসে বর্ণিত আছে যে, মসজিদে নববীতে নবী কারীম (দ:) আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে ফরিয়াদ কালে তিনি বিভিন্ন প্রদেশের নাম ধরে এবং সমস্ত উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য দোয়া করা অবস্থায় একজন নজদের অধিবাসী সাহাবী,তাঁর নাম ছিল আবুল মুকাররাম, তিনি নবী কারীম (দ:) এর প্রতি আরজ করলেন,ইয়া রাসূলুল্লাহ (দ:)! আমি নজদ থেকে এসেছি, আমার মাতা-পিতা ও আমার নজদ প্রদেশের জন্য একটু দোয়া করুন। এভাবে ক্রমান্বয়ে তিন তিনবার বলা সত্বেও নবী কারীম (দ:) তার নজদ প্রদেশের জন্য দোয়া করেননি। নবী কারীম (দ:) আবুল মুকাররাম (রা:)কে ডেকে বল্লেন- হে আবুল মুকাররাম! আমি এই কারণে নজদের জন্য দোয়া করিনি যে,কেননা ঐ নজদ থেকে শয়তানের শিং বের হবে(আমার কুরআন সুন্নাহ ও সালাতুস সালামের বিপক্ষে প্রচার আরম্ভ হবে এবং ঐ নজদী শাসকগোষ্ঠী আমার আহলে বাইতকে ভালবাসে না)। সমগ্র বিশ্বের মুসলিম উম্মাহকে তারা নির্যাতিত করবে। আবুল মুকাররাম নবী কারীম (দ.) এর এইরূপ বর্ননা শ্রবণ করার পর কান্নাকাটি করতে লাগলেন এবং পরে নবী কারীম (দ.) তাহার পিতা-মাতার জন্য দোয়া করলেন । রাসূলুল্লাহ (দ:) এক বাক্যে বুঝিয়েছেন যে,ঐ নজদ থেকে ইসলামের ক্ষতি সাধনকারী শত্রু নির্গত হবে। নবী কারীম (দ:) এর দেড় হাজার বছর আগের বাণী,যা আজ প্রমাণিত। নবী কারীম (দ:) এবং তাঁর খলিফাগণ যেভাবে ইসলামি গণতন্ত্রের মাধ্যমে মুসলিম সম্রাজ্যকে বৃদ্ধি করেছিলেন, তা বর্তমান আরবে বিলুপ্ত। কেননা, বর্তমান আরব দেশগুলোতে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত। যা নবী কারীম(দ:) এর আদর্শের বিপরীত। ফলে আজ সমস্ত মুসলিম বিশ্ব অস্থিতিশীলতায় নিমজ্জিত ও পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ।
আরামকু কোম্পানি লোগোঃ-
অতঃপর আল্লাহর রাসূলের দেওয়া সুন্নি মতাদর্শ বিরোধীদের নেতা সৌদ ও তার পুত্র আব্দুল আজিজ এবং তার গোত্রের সকল কর্মীদেরকে নজদের গভর্নর রশিদ নজদ প্রদেশ থেকে বিতাড়িত করেন। তখন তারা কুয়েত চলে যায় এবং সেখানে বসবাস শুরু করে। কুয়েতে অবস্থানরত অবস্থায় সেখানে এক মার্কিন কোম্পানি তাদের সাথে সাক্ষাৎ করে। কোম্পানিটির নাম ছিল “আরামকু কোম্পানি “। তারা তাদের সাথে সহযোগীতার আলোচনা করে।ঐ আলোচনায় আরামকু কোম্পানি সৌদ গোত্রকে বলেছিল যে,’তোমরা একটি কমিটি গঠন কর। আমরা তোমাদের প্রতি মাসে পাঁচ হাজার পাউন্ড স্বর্ণ দিয়ে সাহায্য করব। এবং তোমাদেরকে আমরা উন্নত প্রশিক্ষনের মাধ্যমে এমনভাবে গড়ে তুলব,যাতে তোমরা তোমাদের দেশে ফিরে যেতে পার। তোমাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করে দেব।’ তারা মার্কিন আরামকু কোম্পানির সহযোগীতার প্রস্তাবিত কথাবার্তা শুনে অত্যন্ত আনন্দিত হল।অতএব সৌদ গোত্র আরামকু কোম্পানির সিদ্ধান্তানুযায়ী ১৮৮০ সালে কমিটি গঠন করল। কমিটির নাম ছিল “ইখওয়ানুল মুসলিমিন” অর্থাৎ মুসলমানগন ভাই ভাই। অত:পর আরামকু কোম্পানি তাদের পাঁচ হাজার পাউন্ড সাহায্য দেয়া আরম্ভ করল এবং উন্নত অস্ত্রশস্ত্রের কৌশলের মধ্যমে তাদের প্রশিক্ষণও দেয়। অথচ ইতিপূর্বে সৌদ গোত্র পেশায় ছিল জেলে। আর এমনিভাবে মার্কিন আরামকু কোম্পানি সৌদ গোত্রের দূরবলতার সুযোগে সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র তুরুস্কে মুসলমানে-মুসলমানে ফেতনা ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে। অপরদিকে ঠিক এভাবেই ভারতবর্ষের ইতিহাসে ইহুদী নাছারার একটি ব্রিটিশ চক্র ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামের বেশ নিয়ে ভারত উপমহাদেশে প্রবেশ করে। তারা ভারতে প্রবেশ করার পর ঐতিহ্যবাহী মুসলিম সম্রাজ্যের মহান সম্রাট নবাব সিরাজুদ্দৌলার সাথে বন্ধুত্বপুর্ণ সম্পর্কের কথা বলে এবং তারা তাঁহার সাথে একটি সন্ধি চুক্তি করে। সে সন্ধির নাম ছিল “আলিগড়ের সন্ধি”। এই সন্ধির নাম দিয়ে ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষের মুসলিম নওয়াব শাসকদের থেকে মীর জাফরের সহায়তায় ১৭৫৭ সালে ভারতবর্ষে মুসলিম নওয়াবদের ক্ষমতা কেড়ে নেয়। ফলে ভারত উপমহাদেশে চিরতরে মুসলিম সম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যায়। তদ্রূপ মার্কিন আরামকু কোম্পানি সৌদ গোত্রের সৈন্যদেরকে সংগে নিয়ে নবী করীম(দ.) এর জীবনাদর্শ ও শানে-রেসালাত ক্ষুন্ন করতে থাকে।
এমনিভাবে সৌদ গোত্রের সৈন্যরা বিশ বছর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হওয়ার পর ১৯০১ সালে তারা নজদে হামলা করে। তখন তারা সর্বপ্রথম নজদের গভর্নর রশিদকে সুবহে সাদিকের সময় নামায পড়া অবস্থায় ধরে ফেলে এবং তারা রশিদের বুকের উপর বসে তার ঘাড় কেটে শরীর থেকে মাথাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। পরে তারা সেখানে আশিকে রাসূলদের অবস্থানস্থল চিহ্নিত করে এবং তার মধ্য হতে জ্ঞানীগুণী ও গন্যমান্য ব্যক্তিদের উপর হঠাৎ অতর্কিতভাবে হামলা চালায়। এমনকি তারা সুন্নী মতাদর্শের অনুসারী আশেকে রাসূল ও আওলাদে রাসূলগণের ৩/৪ দিনের নিষ্পাপ ছোট ছোট শিশুদেরকে পর্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করে। ঘরে যা পেত সব লুটপাট করে নিত । ঘরে কারপেট থাকলে তা বের করে টুকরো টুকরো করে ফেলত ও তাদের মাঝে তা ভাগাভাগি করে নিত।এবং যেখানে মাটির স্থান দেখা যেত, সেখানে পানি দ্বারা ভিজিয়ে ফেলত। পানি দিয়ে ভিজিয়ে ফেলার কারণ ছিল মাটির নীচে নজদবাসীগণ তাদের মুল্যবান দ্রব্যসামগ্রী, যেমন:স্বরণ,রৌপ্য চুরি-ডাকাতির ভয়ে নিরাপদ হিসেবে মাটির নীচে পুতে রাখত। আর যেখানে মূল্যবান সামগ্রী থাকত, সেখানে পানি তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যেত ।
এভাবেই সৌদ সৈন্যরা মার্কিন “আরামকু কোম্পানির” পরিকল্পনা অনুযায়ী ধারাবাহিকভাবে নজদের নিরীহ সুন্নি মুসলমানদের উপর নির্মমভাবে অত্যাচার নিপীড়ন করে। নবী করীম (দ:) এর বাণী:- তিনি ইরশাদ করেন-‘সকল মুসলমান পরস্পর ঈমানী ভাই। সে হিসেবে প্রত্যেক ঈমানদার মুসলমানদের রক্ত,ধন-সম্পদ ভক্ষণ করা অপর মুসলমানের জন্য হারাম। ‘তিনি আরো ইরশাদ করেন:-
একজন মুসলমান যদি অন্য মুসলমানের হাত ও মুখ দ্বারা সংগঠিত অত্যাচার ও অনিষ্টতা থেকে নিরাপদ না থাকে, তবে সে প্রকৃত ঈমানদার মুসলমান নয়। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না।
মানবজাতির মহান সংবিধান মহাগ্রন্থ প্রবিত্র কুরআনে পাকের ২৫তম পারার সূরা আশশূ’রা এর ২২-২৩নং আয়াতে কারীমাগুলোতে আল্লাহ তা’লা ইরশাদ করেন
হে রাসূল(দ:)! আপনি বলে দিন, তোমাদের কাছে আমার আহলে বাইত তথা নবী পরিবারের ভালবাসা ছাড়া কোনো প্রতিদান চাই না।
হে আমার মুসলমান ভাইগণ! আপনাদের কাছে কুরআন-হাদীসের আলোকে প্রশ্ন রাখলাম, তারা কোন ধরণের মুসলমান ?
অতঃপর সৌদ গোত্রের সৈন্যরা পরিকল্পনা করতে থাকে কিভাবে মক্কা শরীফের জান্নাতুল মুয়াল্লা এবং মদীনা শরীফের জান্নাতুল বাকীতে হামলা করা যায়। তৎকালীন আমলে মক্কা শরীফের গভর্নর ছিলেন হুসাইন শরীফ। তাঁর শাসনামলে তারা মক্কা শরীফে আক্রমণ করে ও সাথে সাথে মক্কা শরীফের গভর্নর হুসাইন শরীফকে আটক করে। অবশেষে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম উম্মাহের ঐতিহাসিক স্থান মক্কা ও মদীনা শরীফের জান্নাতুল মুয়াল্লা এবং জান্নাতুল বাকী শরীফের পবিত্র মাটিতে দাফনকৃত প্রত্যেক সাহাবায়ে কেরাম ও আনসার, মুহাজির এবং আশেকে রাসূলগণের কবর ও রাওযা শরীফকে বিভিন্ন ধারালো ট্রাক্টর তথা মাটি কাটার গাড়ি বিশেষ দ্বারা উল্টিয়ে দেয় এবং তাতে কোনো প্রকার চিহ্ন পর্যন্ত রাখেনি । এমনকি তারা ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান (রা.) এর রাওযা শরীফ ভেঙে ফেলে । পরে রাসূল (দ.) এর রাওযা শরীফের দিকে অগ্রসর হয়। ওহাবীদের গোঁমর ফাঁক নামক গ্রন্থে লেখক উল্লেখ করেছেন যে, ওয়াহাবী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা আআব্দুল ওহাব নজদী এবং অন্যদিকে সে আবার সৌদের শ্বশুরও হয় । অতএব সৌদের শ্বশুর আব্দুল ওহাব নজদীর নেতৃত্বে এই হামলা পরিচালনা করা হয় এবং সে এমন ব্যক্তি,যে সর্বপ্রথম রাসুলে কারীম (দ.)এর রাওযা শরীফের দিকে গেল । তখন আল্লাহ তা’লার হুকুমে আকস্মিকভাবে দুটি সাপ এসে তাদেরকে নবীজীর রাওযার দিকে পৌছার পথে তৎক্ষণাৎ বাধাগ্রস্ত করল । ফলে তারা ব্যর্থ হয়ে সেখান থেকে বিতাড়িত হলো এবং পরে তা আর সম্ভবপর হয়নি । তাই আজ পর্যন্ত নবী কারীম (দ.)এর রাওযা ব্যতীত অন্য কোন সাহাবীর রাওযা শরীফের চিহ্ন বা নিশান দেখা যায় না। এই কারণে বিশ্বের মুসলিম উম্মাহ ও হাজীগণ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় না যে, এখানে পূর্বে পৃথক পৃথক মাজার শরীফ অবস্থিত ছিল। মক্কা শরীফের জান্নাতুল মুয়াল্লা ও মদীনা শরীফের জান্নাতুল বাকীর পূর্বের অবস্থার চিত্র এবং সেখানে সাহাবায়ে কেরামের রাওযা শরীফের পূর্বের দৃশ্য ও নবী করীম (দ.)এর বিভিন্ন মু’জিযার দর্শনীয় স্থানসমূহের বর্তমান ধ্বংসাবশেষ চিত্র নিয়ে লিখিত “আল মুকাদ্দেস” নামক গ্রন্থে চিত্রসহ স্ববিস্তারে মক্কা ও মদীনা শরীফের পূর্বের অবস্থা এবং বর্তমান অবস্থা তুলে ধরেছেন। এই গ্রন্থখানা আপনাকে দলিল স্বরূপ সহায়তা করবে । অতঃপর এভাবেই সৌদের গোত্র মার্কিন “আরামকু কোম্পানি”-র সহযোগীতায় আরবের বুকে সুন্নি মতাদর্শকে ধ্বংস করতে সমর্থ হলো এবং খারেজী মতাদর্শ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছিল।
পরবর্তীতে সে সময়ের মদীনাবাসীরা তাদের কঠোর নির্যাতন নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে মদিনা ছেড়ে পাহাড়ে-পর্বতে চলে যায় এবং সেখানেই বসবাস শুরু করেন । তার প্রমাণ হলো মদীনার অদূরে পাহাড়-পর্বতে অবস্থানরত বর্তমান অধিবাসী । এমনকি আওলাদে রাসূল ও আশেকে রাসূল (দ.) বণিকগণ আপন জন্মভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। ফলে নিজ বাসস্থান ছেড়ে জানমাল রক্ষার্থে বিভিন্ন দেশে চলে গিয়েছিলেন । যারা যেখানে গিয়েছিলেন, সেখানে সুন্নি মতাদর্শ ও সালাতুস সালাম এবং তৌহিদ এবং রিসালাত প্রতিষ্ঠা করেন। তাই আজ পর্যন্ত সেই সালাতুস সালামের ঝান্ডা সারা বিশ্বে উড়ছে । খারেজীরা এখনও কাফের মুনাফিকদের সহযোগীতায় বিভিন্ন দেশে ও জেলায় এবং গ্রামে-গঞ্জে বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। যাতে নবী প্রেমিকগণ জেগে উঠতে না পারে। কেননা তাদের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে নবীর প্রেম যাতে মুসলমানদের অন্তর থেকে চিরতরে মুছে যায়। আর নবীর প্রেম ও আদর্শ ধ্বংস করতে পারলেই মুসলমানদের ঈমান, আমলও নষ্ট হয়ে যাবে। ফলে মুসলমান মুসলমানে লড়াই চলতে থাকবে। এটাই হলো খারেজী -ওয়াহাবীদের মূল প্রচেষ্টা। অতএব পরবর্তী পর্যায়ে যখন ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে নির্যাতিত আওলাদে রাসূল ও আশেকে রাসূলগণ হেজাজুল আরব থেকে চলে যান। তখন সৌদের গোত্র ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে তুরস্ক থেকে নজদ ও মক্কা -মদীনা শরীফ দখল করে শাসনভার তাদের অধীনে নিয়ে আসে এবং সাথে সাথে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ২৩ শে সেপ্টেম্বর হেজাজুল আরবের নাম পাল্টিয়ে দেয় এবং নিজ নামানুসারে “সৌদ আরব ” রাখে,নজদ প্রদেশের নাম পরিবর্তন করে “রিয়াদ” নামকরণ করে। উল্লেখ্য যে,এখানে তুরস্কের বাদশাহ মুস্তফা কামাল পাশার কিছুই করার ছিল না। কারণ, মার্কিন আরামকু কোম্পানি সৌদ গোত্রকে সবদিক থেকে এমনিভাবে গড়ে তুলে ছিল যে,তাদের দমন করা তুরস্কের বাদশার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে ।
পরিশেষে এইভাবেই তারা আরবের মূল ভূ-খন্ডে খারেজী এবং ওয়াহাবী মতবাদ ও তাদের ধ্বংসাত্মক শাসন ক্ষমতা যুগে যুগে প্রতিষ্ঠিত রাখে।
তথ্যসূত্রঃ-
- ঊর্দূ এলবাম “তাশকিলে জাদীদ” (ভাষ্যকার রাশেদ আশরাফ, তার পিতার নাম আবদুল্লাহ।)
- দেওবন্দি মাযহাব:-সৈয়দ পীর গোলাম মুহাম্মদ মেহের আলী (র.)
- তারিখ ও নাজদে হেজাজ:- হযরত মুফতি মুহাম্মদ আব্দুল কাইয়ুম কাদেরী
- খুনকা আঁসুও:-আল্লামা হযরত মুহাম্মদ মুশতাক নেজামী (র.)
- ওহাবী মাযহাব কা হাকীকাত:-হযরত মাওলানা মুহাম্মদ আবুল হামিদ জিয়াউল্লাহ আল কাদেরী
- আল মুকাদ্দেস (মক্কা ও মদীনা শরীফের বিভিন্ন স্থানের অতীত ও বর্তমান চিত্র সংবলিত):-শাহ মুহাম্মদ আব্দুল হালিম আল মাদানী
- ওহাবীদের গোমর ফাঁস:-হযরত মুহাম্মদ রতন মিয়া চিশতী (র.)
- হক্ব বাতিলের পরিচয় :-মাওলানা মুহাম্মদ ইকবাল হোছাইন আল কাদেরী
- ওহাবী মাযহাবের নেপত্য কাহিনী :-(মূল) এইম.এম.গুমুজ।(অনুবাদ)হাফেয মাওলানা রুহুল আমিন
- ইসলামের মূলধারা ও বাতিল ফিরকা:-লেখক মাওলানা কাযী মুহাম্মদ মুঈনউদ্দিন আশরাফী