প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারক (র.)।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারক (র.) ছিলেন একজন উঁচু মাপের আলেম। জ্ঞান পিপাসু অসংখ্য তালিবে ইলম হাজির হতো তাঁর দরবারে। সাধারণ জনগণও তাঁর নিকট আসত বিভিন্ন মাসায়েলের সমাধানের জন্য। যুবক, বৃদ্ধ ছেলে-বুড়ো সকলেই ভীড় জমাত তাঁর দরসগাহে।
আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারক (র.) যেখানে থাকতেন তারই অদূরবর্তী স্থানে বসবাস করত এক যুবক। সে প্রায়ই হযরতের দরবারে আসত। জিজ্ঞেস করত হরেক রকম মাসআলা মাসায়েল। হঠাৎ যুবকের আনা গোনা বন্ধ হয়ে গেল । বেশ কিছুদিন যাবত সে আর আসছে না। আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারক (র.) তার জন্য চিন্তিত হলেন। লোকদের জিজ্ঞেস করলেন, ঐ যুবকটি কোথায় যে আমার নিকট প্রায়ই আসা যাওয়া করত? লোকজন বলল, এক ব্যক্তি তার কাছে কিছু পাওনা ছিল । উক্ত পাওনা পরিশোধ করতে না পারায় ঋণ দাতা তাকে পাকড়াও করে জেলে পাঠিয়েছে । বর্তমানে সে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে অবরুদ্ধ রয়েছে।
যুবকের এই করুণ অবস্থা আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারক (র.) কে চরম মর্মাহত করে। তিনি মনে মনে ভাবেন, হায়! কিছু টাকার জন্য একটি যুবকের স্বাধীন জীবন বন্দীত্বের জীবনে পরিণত হবে? বঞ্চিত হবে জ্ঞান অন্বেষণের সুবর্ণ সুযোগ থেকে?
না, এ হতে পারে না। এমনটি হতে দেয়া যায় না। তাই তিনি লোকদের নিকট জানতে চাইলেন, আচ্ছা তার ঋণের পরিমাণ কত? লোকজন বলল- দশ হাজার দিনার (স্বর্ণমুদ্রা)।
একটু পর তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন তোমরা করয দাতা লোকটিকে চিনো কি?
তারা বলল, হ্যাঁ, অমুক ব্যক্তি যুবকের করয দাতা ।
ঋণের পরিমাণ ও করযদাতার সন্ধান পেয়ে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারক (র.) খুব বেশী বিলম্ব করলেন না। বরং সামান্য সময় পরে কাউকে না জানিয়ে ১০ হাজার দিনার নিয়ে কর দাতার বাড়িতে উপস্থিত হলেন। অতঃপর তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ভাই! আমার এক বন্ধু তোমার কাছ থেকে ১০ হাজার দিনার করয নিয়েছিল। সেই টাকা পরিশোধ করতে না পারায় তুমি নাকি তাকে জেলে পাঠিয়েছো?
লোকটি বলল, হ্যাঁ, সে এখন কয়েদখানার অন্ধকার কক্ষে বন্দী জীবন যাপন করছে। আমার সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত তাকে সেখানেই থাকতে হবে।
ইবনে মোবারক (র.) বললেন, আমি তার পক্ষ থেকে তোমার সকল পাওনা পরিশোধ করব। তবে শর্ত হলো, তোমাকে এ মর্মে ওয়াদা করতে হবে যে, আমি জীবিত থাকতে তার নিকট কোন দিন একথা বলতে পারবে না। লোকটি বলল, ঠিক আছে, আমি আপনার শর্ত মেনে নিলাম ।
আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারক (র.) তৎক্ষণাৎ দশহাজার দিনারের একটি থলে করযদাতার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, এবার তাকে মুক্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করো। পরিশেষে যুবক মুক্তি লাভ করল। কিন্তু সে ঘুর্ণাক্ষরেও জানতে পারেনি যে, আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারক (র.) নিজের পকেট থেকে ঋণ পরিশোধ করে তাকে জেল থেকে মুক্ত করে এনেছেন।
কিছুদিন পর ইবনে মোবারক (র.) এর সাথে যুবকের সাক্ষাত হলো যুবককে দেখেই ইবনে মোবারক (র.) প্রশ্ন করলেন, তুমি না কারাগারে বন্দী ছিলে? যুবক উত্তর করল, হ্যাঁ, আমি কারাগারের নির্জন কক্ষে মানবেতর জীবন যাপন করছিলাম। কিন্তু কয়দিন আগে আল্লাহপাক আমাকে তা থেকে মুক্ত করেছেন।
ইবনে মোবারক (র.) পুনরায় প্রশ্ন করলেন, কিভাবে মুক্তি লাভ করলে? করয দাতা কি ঋণ মাফ করে দিয়েছে?
যুবক বলল, না, মাফ করেনি। তবে আমার মনে হয় আল্লাহ তাআলা গায়েব হতে আমার কর পরিশোধ করার জন্য কোন ফিরিশতা পাঠিয়েছেন।
ইবনে মোবারক (র.) বললেন, তবে তোমাকে এর জন্য আল্লাহর শোকর আদায় করতে হবে। আমি তোমার মুক্তির জন্য প্রভুর দরবারে কতইনা দুআ করেছিলাম, তাই তোমার মুক্তির সংবাদে আমি সীমাহীন আনন্দিত, ভীষণ পুলকিত।
জেল থেকে মুক্তির পর আগের মতোই আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারক (র.) এর দরবারে যুবকের যাতায়াত অব্যাহত থাকে। এভাবে দীর্ঘকাল অতিবাহিত হয়। এরপর একদিন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারক (র.) এর ইন্তেকাল হলে করযদাতা এসে যুবককে বলল, হে যুবক? তুমি কি জান, কে তোমার করয পরিশোধ করে তোমার বন্দী জীবনের অবসান ঘটিয়েছিল?
যুবক উত্তরে বলল, না, তা তো কোন দিন আপনি আমাকে বলেন নি। আমি জানতে চাইলেও আপনি একথা সেকথা বলে তা এড়িয়ে গেছেন। এখন বলুন, কোন্ সেই মহান ব্যক্তি যিনি আমার এতবড় উপকার করেছেন।