মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার
নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম শত শত বছর ধরে উদযাপিত হয়ে আসছে বিশ্বব্যাপী। আজ থেকে সাতশত বছর আগের বিশ্বপরিব্রাজক ইবনে বতুতার ভ্রমণ কাহিনীতেও মুসলমানদের দেশে দেশে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পালন তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন বলে উল্লেখ করে গেছেন। এ উপলক্ষে গাজী সালাহউদ্দিন আইউবীর ভগ্নিপতি সুলতান আবু মুজাফফর কুকবুরী ইরাকের ইরবিলে রাষ্ট্রীয়ভাবে যে মহা আয়োজন করতেন তা আজো ইতিহাসে আলো ছড়াচ্ছে। আজ থেকে অন্তত সাড়ে বারশত বছর আগের লেখক আজরকি (ওফাত ২০০ হি.) তাঁর ‘আখবারে মক্কা’ তে সেই সময়ের আরবে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উপলক্ষে নানা আয়োজনের কথা বর্ণনা করে গেছেন। আরবলীগের অন্তর্ভুক্ত বাইশটি দেশের মধ্যে বিশটি দেশেই রাষ্ট্র কর্তৃক এ উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে আসছে আবহমানকাল ধরে। সমগ্র মুসলিম বিশ্বের অপরাপর দেশেও রয়েছে অনুরূপ বৈচিত্র্যময় কর্মসূচি। তবে এ উপলক্ষে যত সব আয়োজন এ যাবত বিশ্বময় হয়ে আসছে এরমধ্যে ‘জশনে জুলুস’ হলো সর্বাধিক জনপ্রিয় ও তাৎপর্যপূর্ণ।
আরবসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামতে দিন দিন শামিল হচ্ছে অসংখ্য ধর্মপ্রাণ মানুষ। দিন দিন এই জুলুস সেজে আসছে বর্ণাঢ্য আয়োজনে। বাংলাদেশে এমন একটি পরিশীলিত এবং আকর্ষণীয় ইসলামি সংস্কৃতির যাত্রা শুরু হয়েছে রাসুল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ৩৯তম অধঃস্তন বংশের এক উজ্জ্বল তারকা, গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশসহ শতাধিক দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের জনক, কাদেরিয়া ত্বরিকার মহান দিকপাল, গাউসে জামান, আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রহমাতুল্লাহি আলায়হি নির্দেশনা ও রূপরেখা অনুসারে। হিজরি ১৩৯৪, (১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দ) হতে, সর্বপ্রথম চট্টগ্রামের কোরবানিগঞ্জ বলুয়ারদীঘি পাড়ের খানকাহ এ কাদেরিয়া সৈয়্যদিয়া তৈয়্যবিয়া হতে সর্বপ্রথম জশনে জুলুস আত্মপ্রকাশ করে। এ বছর ১৪৪৪ হিজরি সনের জশনে জুলুস হবে ৫০ তম আয়োজন।
আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনায় দেশের প্রথম জশনে জুলুসে নেতৃত্ব দেন আনজুমান ট্রাস্টের তৎকালীন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আলহাজ্ব নুর মোহাম্মদ আল কাদেরী রহমাতুল্লাহি আলায়হি। আর ১৯৭৬ (১৩৯৬ হি.) সনে এর প্রতিষ্ঠাতা হুজুর কেবলা তৈয়্যব শাহ্ রহমাতুল্লাহি আলায়হি এ উপলক্ষে বাংলাদেশ সফরে আসেন এবং তিনি নিজেই এই জুলুসে নেতৃত্ব দেন যা ১৯৮৬ সন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। তিনি প্রতিবছর ৯ রবিউল আউয়াল ঢাকা, এবং ১২ রবিউল আউয়াল চট্টগ্রামে আয়োজিত জশনে জুলুসে নেতৃত্ব দেন। তাঁর নেতৃত্বে এদেশে ‘জশ্নে জুলুস’ লাভ করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। ১৯৮৬ সনেই এতে লাখো মানুষকে যোগ দিতে দেখা যায়।
আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট আয়োজিত এই জশনে জুলুস অনুসরণেই বাংলাদেশে বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, মাদ্রাসা, খানকাহ, দরবার, সংগঠন রবিউল আউয়াল মাসে বের করে আসছে দেশব্যাপী শত শত জশনে জুলুস, যা ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আয়োজনকে করেছে বর্ণাঢ্য এবং জনপ্রিয়, যা সরকারকেও প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমান সরকার এ উপলক্ষে ১২ রবিউল আউয়ালকে জাতীয় দিবস ঘোষণা করে সরকারি বেসরকারি ভবন এবং বিদেশের কুটনৈতিক মিশনগুলোতে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের আদেশ জারি করে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম অনুষ্ঠানকে আরো বেশি তাৎপর্যম-িত এবং ব্যাপকতা দান করেছে। এ জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি। যা হোক, যখন এ দেশে একটি উগ্রবাদী গোষ্ঠী কোরআন সুন্নাহর অপব্যাখ্যা দিয়ে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পালনের বৈধতার প্রশ্ন তুলে দেশব্যাপী মুসলমানদের মধ্যে হানাহানি সৃষ্টি করে জঙ্গিবাদ কায়েমের বীজ বপনের চক্রান্তে লিপ্ত ছিল, ঠিক সেই সময়ে ইসলামের মহান সংস্কারক আল্লামা তৈয়্যব শাহ্ হুজুরের ‘জশনে জুলুস’ সাধারণ সহজ সরল মুসলমান এবং আলেম-ওলামার দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফেলে। বিরোধিরা শেষতক পিছুটান দিতে বাধ্য হয় এবং ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ‘জশনে জুলুস’র ওসিলায় দেশব্যাপী জনপ্রিয় হতে থাকে।
আজ জশনে জুলুসের রূপকার আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ হুজুর এই দৃশ্যমান হায়াতে নেই বটে, কিন্তু তাঁর সুযোগ্য সাজ্জাদানশীন, মুর্শিদে বরহক্ব আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ হুজুরের হাতে ‘জশ্নে জুলুস’ নামক বীজটি বটবৃক্ষ হয়ে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। ১৯৮৭ থেকে এ পর্যন্ত (মাঝে কয়েকবছর ছাড়া) প্রায় সবকটি জুলুসে নেতৃত্ব দিয়েছেন হুজুর কেবলা আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ (মা. জি. আ.)। তাঁর নেতৃত্বে আনজুমান ট্রাস্টের এই ১২ রবিউল আউয়াল, চট্টগ্রাম শহরে আয়োজিত জশ্নে জুলুসে বিগত বছরগুলোতে আনুমানিক প্রায় অর্ধকোটির কাছাকাছি মানুষের অংশগ্রহন হয়েছে বলে মিডিয়াগুলোতে প্রচারিত হয়েছে।
বর্তমানে সচেতন মহল চট্টগ্রামের এই জশনে জুলুসকে বিশ্বের সেরা জশনে জুলুস হিসেবে আখ্যায়িত করছে এবং এই জুলুসকে বিশ্ব ঐতিহ্য আখ্যা দিয়ে জাতিসংঘের গিনেজ বুকে স্থান দেওয়ার দাবি ওঠছে কয়েক বছর ধরে। এ দাবি বাস্তবায়ন হলে শুধু ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ব্যাপ্তি হবে না বরং চট্টগ্রামও হবে বিশেষভাবে সম্মানিত এবং আলোচিত। আসুন, আলমগীর খানকা-এ কাদেরিয়া সৈয়্যদিয়া তৈয়্যবিয়া ষোলশহর, চট্টগ্রাম হতে ১২ রবিউল আউয়াল এবং ঢাকা- মুহাম্মদপুর কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া কামিল মাদরাসা হতে ৯ রবিউল আউয়াল অনুষ্ঠিতব্য, এবারের ৫০ তম জশ্নে জুলুসে ঈদে মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এ দলে দলে যোগদান করি।
লেখক: যুগ্ম মহাসচিব, গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ।