হায়দার
🖋আসিফুল ইসলাম সৈকত
—————-
গভীর রাত। খায়বার প্রান্তরে বইছে শীতল বাতাস । শত্রুরা ছাড়া পুরো আরবেও হয়তো এখন কেউ জেগে নেই। শত্রুদের ঘুমতো তখনই হারাম হয়ে গেছে, যেদিন মুস্তফা করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধ করতে খায়বার এসেছিলেন। অন্য আরেকটি স্থানেও আজ ঘুম নেই। সেটা হল, খায়বার দূর্গের বাইরে তাবু টাঙিয়ে অবস্থান করা মুসলিম শিবিরে। খায়বারের দূর্গে লুকিয়ে থাকা গাদ্দারদের সাথে আজ যুদ্ধ ছিল। তাই সবাই ভীষণ ক্লান্ত। কালও যুদ্ধ হবে। যুদ্ধের জন্য হলেও বিশ্রাম প্রয়োজন। তবুও ঘুম নেই মুসলিম বীরদের চোখে। ইবাদতে মশগুল। সবারই কেবল একটাই ফরিয়াদ- ইয়া আল্লাহ! আগামীকাল ঝাণ্ডা যেন আমার হাতে হয়। একটা ঝাণ্ডার জন্য এত ফরিয়াদ! কী রয়েছে এই ঝাণ্ডায় যার জন্য নির্ঘুম থেকে ইবাদত করতে হচ্ছে?
দুইদিন হল, খায়বার দূর্গে দুষমনরা লুকিয়ে আছে। আক্রমণ করছে ভেতর থেকে। আহত করছে মুসলিম বীরদের। সু-উচ্চ এবং সুদৃঢ় লোহার বিশাল দরজাটাই দূর্গের সবচেয়ে শক্তিশালী অংশ। এই দরজায় দূর্গে প্রবেশের একমাত্র পথ। আবার, এই শক্তিশালী দরজা ভাঙ্গারও উপায় নেই। আজসহ দুইদিন চেষ্টা করলেন সবাই মিলে। দরজা তবুও ভাঙ্গা গেলো না। চিন্তায় পড়ে গেলেন মুসলিম বীরগণ। সমস্যার কথা জানালেন হুজুর করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র কাছে। সংবাদ শুনে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবাইকে হতাশ হতে নিষেধ করলেন এবং আজকের মত বিশ্রামে যাওয়ার আদেশ দিলেন। সাথে সাথে এও জানিয়ে দিলেন, আগামীকাল যুদ্ধের ঝাণ্ডা এমন একজনের হাতে দেওয়া হবে, যিনি এই দূর্গ ভেদ করে বিজয় ছিনিয়ে আনবে। এই সংবাদই মূলত মুসলিম বীরদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। আগামীকালের ঝাণ্ডা যে কোন সাধারণ ঝাণ্ডা নয়। এটাতো যেন ঝাণ্ডাও না, এটাতো সম্মান, এটাতো বীরত্বের প্রকাশ্য সনদ।
সকাল হলো। এক রাশ আশা নিয়ে জেগে উঠলো সূর্য। সূর্যের আলো পৃথিবীকে জানিয়ে দেয় যে, জেগে উঠার সময় হয়েছে। কিন্তু এই বার্তা মুসলিম বীরদের কাছে নিরর্থক। তাঁরা যে প্রতি দিনিই সূর্যের আগে জেগে বসে। আজো অপেক্ষা করছে। প্রতিক্ষার প্রোহর গুনছেন। সূর্য কখন জাগবে? সময় মত সাহাবা আলাইহিমুর রিদুয়ান গেলেন রাসুলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র কাছে। সবাই আশায় বুক বেঁধে আছে। আজকের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, সবচেয়ে বড় কৌতুহল, ঝাণ্ডা কার হাতে যাচ্ছে? নিজে না হয় এই ঝাণ্ডা নাই পেলো। কিন্তু কে পাচ্ছে? সেই ভাগ্যবান পুরুষকে দেখাও তো অনেক বড় ব্যাপার।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসলেন। চারিদিকে তাকালেন। দরাজ কণ্ঠে জিজ্ঞাস করলেন- তোমরা কি সবাই উপস্থিত হয়েছো? সবাই একযোগে লাব্বাইক বলে বললেন- জ্বি, ইয়া রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আমরা সবাই এসেছি। চারিদিকে আবার ভালো করে তাকিয়ে আল্লাহর হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাস করলেন- তাহলে আমার ভাই, আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) কোথায়? একজন কাছে এসে জানালেন, আলি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র চোখে অসুখ হয়েছে। তাই, তিনি আসেননি। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদেশ দিলেন- আলিকে(রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’) আমার কাছে নিয়ে আসো। তাঁকে ধরে ধরে নিয়ে আসা হল। স্তব্ধ পুরো মুসলিম শিবির৷ কি হতে যাচ্ছে। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হঠাৎ হযরত আলিকে(রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) কে ডেকে পাঠালেন?
দূর্বল কদমে অসুস্থ চোখ নিয়ে সবার মাঝে উপস্থিত হলেন হযরত আলি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। গেলেন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র কাছে। হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’কে দেখালেন চোখের সমস্যা, অসুস্থতা। এতো সেই চোখ জন্মের পরে প্রথম খুলতেই যা দেখেছিলো মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র উজ্জ্বল নূরানী চেহারা মুবারক। মক্কার বড় বড় জ্ঞানীরা যখন হুজুর আলাইহিস সালাতু ওয়াস সাল্লাম’র মুজিযা দেখেও নবুয়ত চিনতে পারেনি, তখন ছোট্ট বয়সেই নবুয়্যত চিনে ফেলেছিলো, এইতো সেই চোখ। আজ সেই পবিত্র চোখের অসুস্থতা দূর্বল করে ফেললো বীর হযরত আলি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’কে। আলি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র চোখের অবস্থা দেখে মুস্তফা কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাতে নিলেন নিজের থুথু মুবারক। লাগিয়ে দিলেন হযরত আলি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র অসুস্থ চোখে। হঠাৎ যেন কি হয়ে গেল! অসুখের কারণে এক মুহূর্ত আগে যেই হযরত আলি (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) দাঁড়াতেই পারছিলেন না, তিনি এখন সটান দাড়িয়ে গেলেন। যেন কখনো দূর্বলই ছিলেন না। অসুস্থতা সেটা আবার কী? রসুল করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাস করলেন- আলি (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)! এখন কেমন লাগছে চোখে। হযরত আলি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু খুশির অস্থিরতা নিয়ে বললেন- ইয়া রাসুলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! এমন মনে হচ্ছে যেন চোখে কখনো অসুখ ছিলোই না। বরং আমি তো আগের চেয়ে আরো ভালো দেখতে পাচ্ছি। মুখে একরাশ স্নিগ্ধ হাসিয়ে মুস্তফা করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফিরে তাকালেন পাশে। নিজ হাতে নিলেন ঝাণ্ডা। উপস্থিত সাহাবা আলাইহিমুর রিদুয়ান এতক্ষণে বুঝে গিয়েছেন যে, আজ বিরত্বের সনদ কে পেতে যাচ্ছেন। অতঃপর, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঝাণ্ডা তুলে দিলেন হযরত আলি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র হাতে। আল্লাহ সুবাহানুহু ওয়াতায়ালার ফজল ও কারামে আজ বিজয় কার হাত ধরে আসতে যাচ্ছে, তা জানা হয়ে গেলো। ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার’ বজ্র ধ্বনিতে মেতে উঠলেন সাহাবা আলাইহিমুর রিদুয়ান। বীরত্বের সনদ হাতে নিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনতে খায়বার দূর্গের দিকে তুফান বেগে বেরিয়ে পড়লেন হযরত আলি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। সামনে পতাকা হাতে আসাদুল্লাহ(আল্লাহ’র সিংহ) আর পেছনে ঘোড়ায় শত শত আসহাবে রাসুলিল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
সাহাবা আলাইহিমুর রিদুয়ান’দের নিয়ে দূর্গের সামনে উপস্থিত হলেন হযরত আলি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। ভেতরে তো আজ যেতেই হবে। বিজয় আজ ছিনিয়ে আনতেই হবে। এই দরজা আজ ভাঙ্গতেই হবে। বীর হযরত আলি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এগিয়ে গেলেন দরজার কাছে। ভালো করে দেখতে লাগলেন শক্ত এবং বিশাল লোহার দরজাটাকে। খপ করে ধরলেন দরজা। সবাই অবাক হয়ে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আর ভাবছে, হযরত আলি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু করতে চাইছেনটা কী? আল্লাহু আকবার বলে দিতে লাগলেন ডাক। এক চিৎকারেই যেন কেঁপে উঠলো খায়বার। একে কোন সাধারণ ডাক বলা যায় না, একে বলতে হয় হায়দারি হাঁক৷ বাহুতে যেন চলে এলো খোদায়ি বল। এমন গর্জন কাফেররা হয়তোই আগে কখনো শুনেছিলো। খায়বার দূর্গের দেয়াল কাঁপতে শুরু করলো। জমিও নড়চড়া করতে লাগলো৷ ভুমিকম্প হচ্ছে! না না, তাহলে হচ্ছেটা কি! হয়তো কেউ যেন তখন বলে উঠলো- আরে আরে দেখো, হযরত আলি(রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) খায়বারের দরজা উপড়ে ফেলছে। আরো জোরে গর্জন করে উঠলো আসাদুল্লাহ(আল্লাহ’র সিংহ)। হায়দার কাররার আলিয়ুল মুর্তাজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ‘আল্লাহু আকবার’ গর্জন দিয়ে সাথে সাথেই উপড়ে ফেললেন খায়বারের সেই শক্তিশালী দরজা। সবাই অবাক চোখে চেয়েই রইলো। মুসলিম বীরদের মাঝে পড়ে গেলো আনন্দের রোল। কাফেররা ভয়ে হয়ে পড়লো আতংকিত। বিশাল লোহার দরজা শূন্যে উঠে আছে। উঠিয়ে রেখেছেন একলা হযরত আলি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। তাকবির দিতে দিতে সাহাবাগণ প্রবেশ করলেন একেরপর এক। করে ফেললেন দূর্গ জয়। গতকাল যেখানে প্রবেশের উপায় ছিলো না, আজ সেই দূর্গে মুসলিমদের জয়জয়কার।
যুদ্ধের পরে সবাই গেলেন দরজার তুলতে। হায়দারি হাঁক দিয়ে উপড়ে ফেলা সেই দরজাটি সরিয়ে রাখতে হবে। প্রথমে গেলেন দুই একজন। পারলেন না। এভাবে গেলেন একের পর এক ৭০জন। অনেক কষ্টে সরানো সম্ভব হলো৷ সেদিন সবাই সচক্ষে দেখলেন হযরত আলি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র হাদারি(সিংহ) কুউয়োত। এরপর থেকেই বিরত্বের সর্বশ্রেষ্ট উদাহরণ, আলি। যুগে যুগে মুসলিম যোদ্ধাদের শক্তির অন্যত উৎসও, নামে আলি। যুদ্ধের ময়দানে অনুপ্রেরণার অন্যতম নাম, আলি। তাই তো যুগে যুগে কবিদের কবিতায় বিরত্বেরই নাম, আলি। আর এগুলো কেনই বা হবে না, মুস্তফা করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে নিজ হাতেই সেদিন বিরত্বের সনদ তুলে দিয়েছিলেন। তাহলে বলুন, সেদিনের সনদ প্রাপ্ত বীর কে ছিলেন? একমাত্র আলি এবং আলিই রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। সেজন্যই তো যুগে যুগে মুসলিমদের মুখে উচ্চারিত হয়েছে-
লা ফাতাহ ইল্লা আলি
লা সাইফা ইল্লা যুলফিকার।
(আলি রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু’র মত কোন বিজয়ী নেই,আর নেই জুলফিকারের মত কোন তলোয়ার)।