♥বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম♥
আমির আবু তুফাইল বিন ওয়াসিলা। শেষ সাহাবি। মানে, সাহাবাদের মধ্যে সবশেষে চোখের আড়াল হন; ইন্তেকাল করেন। ১১০ হিজরি, ৭১৮ সালের আশপাশে। ইমাম বুখারি ৮১০ সালে জন্ম নেন। হাদিস সংগ্রহ শেষ করেন ৮৪৬ সালে। ৩৬ বছর বয়সে।
৮৪৬ থেকে ৭১৮ বিয়োগ করি। ১২৮ বছর। এখন প্রশ্ন, এই ১২৮ বছর কি লোকে হাদিস জানত না? উত্তর- অবশ্যই জানত। ১২৮ বছরে চার প্রজন্ম। তাঁরা না জানলে ইমাম বুখারি হাদিস পেলেন কই? এলিয়েন কে নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করেননি! আর সাহাবাদের কাছাকাছি প্রজন্ম বেশী হাদিস জানবে এটাই স্বাভাবিক। বাবা আপনার দাদা সম্পর্কে বেশী জানেন। দাদা তার বাবার সম্পর্কে। বিষয়টা এমনই ধারাবাহিক।
ইমামে আযম ৬৯৯ সালে জন্মান। ইমাম বুখারির ১১১ বছর আগে। বলে রাখি, ইমাম আবু হানিফার উপাধি ‘ইমামে আযম’। ইমামে আযম ৭৬৭ সালে চোখের আড়াল হন। সে হিসাবে ইমাম বুখারি ৪৩ বছর পর জন্মেছিলেন। যৌক্তিকভাবেই ইমামে আযম বেশী হাদিস জানবেন ইমাম বুখারির চেয়ে। এখন বলবেন- তখন হাদিস সংগৃহীত ছিল না; একজনে কয়েকটা হাদিস জানত। ইমাম বুখারি সেসব সংগ্রহ, সংকলন করেছেন পরে।
তাহলে আসুন ইতিহাস জানি। মোল্লা আলী ক্বারী। তাঁকে কেউ অস্বীকার করে না। তিনি বলেন- ইমামে আযম ৯ লক্ষ মাসয়ালার সমাধান দিয়েছেন। বিভিন্ন সমস্যাকেন্দ্রিক উত্থাপিত প্রশ্নকে মাসয়ালা বলে। মাসয়ালার সমাধান আসে কোর’আন ও সুন্নাহ থেকে। ক্ষেত্রবিশেষে ইজমা, কিয়াস থেকে। হাদিস দিয়েই সুন্নাহ হয়। কিন্তু সব হাদিস সুন্নাহ না। যেমন- মদিনা-মুনিব (দ) ১৩ টি বিয়ে করেছেন। উম্মত পারবে চারটি। তাই সব হাদিস সুন্নাহ না। সুন্নাহ মানে যা পালনীয়। তাই সহিহ হাদিস মানেই পালনীয় না।
যাহোক, এই লক্ষ লক্ষ সমাধান কি শুধু কোর’আন দিয়েই সম্ভব? সম্ভব না। হাদিস লাগবেই লাগবে। অতএব, ইমামে আযম হাদিস জানতেন। বিশাল পরিমাণেই জানতেন। অনেকে বলতে পারেন- মোল্লা আলী ক্বারী ছিলেন হানাফি, তাই এমন বলেছেন। আর হাদিস জানলেও কত হাদিস? আসুন, দুটোর উত্তর একসাথে দেখি।
আল্লামা হাফিজ ইবনে আব্দুল বার মালেকি। মালেকি মাযহাবের মানুষ। তিনি ১০ খণ্ডে একটি বই লিখেন; যা শুধুই ইমামে আযমের প্রশংসায়। সেখানে বলেন- ইমাম আযম মৃত্যুশয্যায়। তাঁর ছেলেকে ডাকলেন। বললেন, বাবা আমি পাঁচ লক্ষ হাদিস জানি। এর মধ্যে শুধু পাঁচটি শুনাচ্ছি। যা তোমার জীবনের পাথেয় হবে।
লক্ষ্য করুন। ইমামে আযম নিজেই বলেছেন “পাঁচ লক্ষ” হাদিসের কথা। আবার লেখক হচ্ছেন একজন মালেকি। ভিন্ন মাযহাবের। বাকিটা বুঝা আপনাদের কাজ। এবার অবাক তথ্য দেই। ইমামে আযমের সুবিশাল হাদিসগ্রন্থ আছে। তিনিই প্রথম হাদিস সংকলক। ইমাম বুখারিরও আগে।
বইটির নাম- কিতাবুল আছার। তিনি ৪০ হাজার হাদিস সংগ্রহ করেন। পরে বাছাই করে কিতাবুল আছার লিখেন। ৭৪৩ সালের দিকে। যা প্রথম সহিহ হাদিসের কিতাব হিসেবে বিবেচিত। এমনকি মুআত্তায়ে মালেকেরও আগে। মুআত্তায়ে মালেক একটি হাদিস গ্রন্থ। মালেকি মাযহাবের প্রবক্তা ইমাম মালেকের লিখা। এটা সুপরিচিত। কিন্তু কালের কালিতে কিতাবুল আছার অপরিচিত প্রায়। বিশ বছর বয়সে ইমামে আযম হাদিস সংগ্রহ শুরু করেন। এই সংগ্রহের কাহিনী এক মহাকাব্যিক ইতিহাস। আরেকদিন লিখব।
ফিকহুল আকবর। আরেকটি গ্রন্থের নাম। ইতিহাসশ্রেষ্ঠ ফিকাহগ্রন্থ। ফিকাহ মানে আইনশাস্ত্র। যার মাধমে দৈনন্দিন সকল বিষয়ে শরিয়তের বিধান জানা যায়। কুরআন ও সুন্নাহর মৌলিক আইনের প্রায়োগিক রূপই ফিকহশাস্ত্র। এটি ইমামে আযমের লিখা। এ গ্রন্থের পুরোটা পাওয়া যায় না। শুধু আকাইদের অংশটুকু পাওয়া যায়।
কুতুবে আবু হানিফা। এটি হারিয়ে যাওয়া গ্রন্থ। জানা যায় পাঁচ লক্ষ মাসয়ালা ছিল এখানে। এ বইটি থাকলে আজকে অন্য কোনো ফিকাহগ্রন্থ দরকার হত না। এছাড়াও তিনি আরো চৌদ্দ-পনেরোটি গ্রন্থ লিখেন। আফসোস, হারিয়ে গেছে অধিকাংশই; ইতিহাসের রুদ্রস্রোতে। কেন, কীভাবে হারিয়েছে পরে জানাচ্ছি।
ইমামে আযমের ছাত্ররাও ফিকহগ্রন্থ লিখেন। তাঁর তদারকিতে। ইমাম মুহাম্মাদ বিন হাসান শায়বানী এমনই একজন ছাত্র। ১৩২-১৮৯ হিজরি তাঁর আয়ুষ্কাল। তিনি ছয়টি ফিকাহ গ্রন্থ সংকলন করেন। এক- জামে কবির, দুই- জামে সগির, তিন- সিয়ারে কবির, চার- সিয়ারে সগির, পাঁচ- মাবসুদ, ছয়- জিয়াদ্দাত। একেকটি গ্রন্থ আট-দশ খণ্ডের। ছয়টিকে একত্রে জাওয়াহেরুর রেওয়ায়েত বলে। এছাড়াও হানাফি ফিকহে হাজার হাজার গ্রন্থ রচিত হয়েছে যুগে যুগে। যাহোক, একটু চিন্তা করুন। যিনি ও যাঁরা কোর’আন-সুন্নাহ দিয়ে আইন লিখেছেন- হাদিসে তাঁদের দখল কতোটুকু! বিবেচনা আপনাদের।
অনেকেই বলবেন- আবু হানিফা এত হাদিস জানলে ইমাম বুখারি কেন তাঁর সূত্রে হাদিস বর্ণনা করেননি? তাদের আমিও দুটি প্রশ্ন করব। এক- ইমাম মুসলিমকে তো চিনেন। সহিহ মুসলিমের সংকলক। যা সিহা সিত্তার অন্যতম গ্রন্থ। তিনি ইমাম বুখারির ছাত্র ছিলেন। সরাসরি ছাত্র। কিন্তু ইমাম মুসলিম কোনো হাদিস কেন ইমাম বুখারির সূত্রে বর্ণনা করেন নি? দুই- ইমাম বুখারি শাফেয়ি মাযহাবের ছিলেন। কই তিনি তো ইমাম শাফেয়ি থেকেও হাদিস নেন নি। কেন, এমন কেন? উত্তর আছে?
ইমামে আযমের সূত্রে ইমাম বুখারি হাদিস আনেননি সত্য। কেন আনেননি- এর উত্তর ইমাম বুখারি নিজেই দিয়েছেন তাঁর ‘আত-তারিখুল কবির’ গ্রন্থে। তিনি বলেন- আমি শুধু তাঁদের হাদিস এনেছি- যাঁরা মানতো ঈমান হচ্ছে মৌখিক স্বীকৃতি ও কর্মের বাস্তবতা। কিন্তু ইমামে আযম বলতেন- ঈমানের জন্য মুখ ও হৃদয়ের স্বীকৃতি যথেষ্ট। কর্মের বাস্তবায়ন ঈমানের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এটা মৌলিক ঈমান না। আচ্ছা, ভাবুন তো- আমাদের সমাজে সবাই কি নামায পড়ে? না, পড়ে না। তাই বলে কি তারা মুসলিম না? হ্যাঁ, মুসলিম; দুর্বল ঈমানের মুসলিম। ঈমান দুর্বল হলেই তো অমুসলিম হয় না। রোগ হলেই তো মানুষ মৃত না। ইমামে আযম সেটাই বুঝিয়েছেন।
ইমামে আযমের সাথে ইমাম বুখারির এটাই ছিল মতপার্থক্য। মনে রাখবেন, মতপার্থক্য মানেই বিরোধিতা না। এটা বৈচিত্র্য। গোলাপ লাল হয়, আবার সাদাও হয়। দুটোই গোলাপ। আলোচিত ইমাম দুজনের পার্থক্য ছিল দর্শনকেন্দ্রিক; কিন্তু আকাইদ, মৌলিকত্ব এক। এটা ইলমে কালামের বি-শা-ল উচ্চতার বিষয়। সেই জ্ঞানের উচ্চতায় আপনি আমি কেউই পৌঁছিনি। তাঁদের বিষয় তাঁদের মধ্যেই বিস্তৃত। তাই আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজের খবর নেবেন না।
নিজের সীমাবদ্ধতা জানুন। বাংলাদেশের সুপ্রিমকোর্ট নিশ্চয়ই আপনার কথা মানবে না। আপনার–আমার যোগ্যতা সুপ্রিমকোর্ট থেকে যোজন-যোজন দূরত্বের। সবকিছুই মন্টু-ঝন্টুর নাক গলানোর বিষয় না। আল্লাহ আমাদের বুঝার ক্ষমতা দিক।
শেষ করছি। মনে আছে বই হারানোর কথা? ইমামে আযমের বইগুলো হারিয়েছে। কেন হারিয়েছে জানিয়ে দেই।
ইমামে আযমের শেষ সময়ে মুতাজিলা মতবাদ বাড়ছিল। আজকের যুগের ওহাবি-সালাফি-জামাতি-ইখওয়ানি মতবাদের মত বাতিল ফিরকা (সম্প্রদায়) হচ্ছে মুতাজিলা। এটা আগেও লিখেছি। যা হোক, আব্বাসি শাসক মানসুর মুতাজিলা ছিল। সে ইমামে আযমকে শহীদ করে। মুতাজিলাদের সময় হানাফিয়াতের বিকাশ থমকে যায়। হানাফিদের ওপর জুলুম-নিপীড়ন চলতে থাকে। ফলে হানাফিদের গ্রন্থগুলোর সঠিক পরিচর্যা হয়নি।
এরপর আসে হালাকু খান। পুরো বাগদাদ জ্বালিয়ে খাক করে। নগর পুড়লে দেবালয় এড়ায় না। হালাকুর আগুনে পুড়ে বাগদাদের সমস্ত বই, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড লাইব্রেরি। জানা যায়, বাগদাদে গণহত্যার লালস্রোতে, বইয়ের ছাইয়ের কালিতে আটকে গিয়েছিল প্রবাহমান ফোরাত। এত বই ছিল! ফোরাত বাগদাদের পাশে বওয়া প্রমত্তা নদী।
সেখানেই, সেসময় মুসলিমদের সমস্ত গ্রন্থ বিলীন হয়। ইতিহাস থেকে হারায়। সেখানে ছিল হানাফিদের অসংখ্য বইও। এরপর সভ্যতার বক্রপথে আসে নানান উত্থান-পতন। তখন এত প্রযুক্তি ছিল না। তাই সব পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়নি।
অন্যদিকে ইমাম মালেক ছিলেন মদিনাবাসী। হালাকু সেদিকে ধ্বংসযজ্ঞ চালায় নি। তাই ইমাম মালেকের বইগুলো রক্ষা পায়। যেমন মুআত্তায়ে মালিক ইত্যাদি। উল্লেখ্য যে, ইমামে আযম ইরাক-কুফা বা বাগাদাদ এলাকার ছিলেন। তাই তাঁর কর্মগুলো নিষ্পেষিত হয় বেশী।
যুগযুগ ধরে বিরোধী বুদ্ধিবৃত্তিক, পাশবিক অপচেষ্টায় হানাফিদের নিপীড়নের চেষ্টা চলেছে। এখনো হচ্ছে। একজন আবু হানিফাকে এত শতাব্দীর চেষ্টার পরেও কেউ দমাতে পারেনি। অমাবস্যার রাতে মিটমিটে ধ্রুবতারা হয়ে জ্বলেছে সে আকাশে। আবার হাজির হয়েছে পূর্ণিমা রাতের জোছনা নিয়ে। পথ দেখাচ্ছে বিভ্রান্ত পথিককে।
তাই আজও বুক ফুলিয়ে গরিব গালিবেরা বলে- আমি হানাফি! হ্যাঁ আমি হানাফি! এরই সাথে নত চোখের ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু নিবেদন করে সেই নুমান নামের মহাত্মা- আবু হানিফার পবিত্র চরণে।