৭. হাকীকী শহীদী মৃত্যু হল এমন একটি মৃত্যু-যার সাথে অন্য কোন মৃত্যুর তুলনা হয় না।তা হচ্ছে আল্লাহর যমিনে আল্লাহর দ্বীন কায়েম ও পৃথিবীতে আল্লাহর কালিমা বুলন্দ করার জন্য কাফির-বেদ্বীনদের মুকাবিলায় সশস্ত্র জিহাদে অংশগ্রহণ করে প্রত্যক্ষ লড়াইয়ে মৃত্যুবরণ করা।এটাই হচ্ছে হাকীকী বা প্রকৃত শহীদী মৃত্যু-যার ফজীলত অপরিসীম।
❏ এ শহীদগণ দুনিয়ার দিক দিয়ে মৃত্যুবরণ করলেও প্রকৃতপক্ষে তারা কবরে বা আলমে বরযখে বিশেষ সম্মানিত হায়াতের সাথে জীবিত থাকেন এবং তারা মহান আল্লাহর তরফ থেকে বিশেষ রিযিক প্রা্প্ত হন।এ শহীদগণের মর্যাদা সম্পর্কে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন-
وَلَا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتًا بَلْ أَحْيَاءٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ * فَرِحِينَ بِمَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ وَيَسْتَبْشِرُونَ بِالَّذِينَ لَمْ يَلْحَقُوا بِهِمْ مِنْ خَلْفِهِمْ أَلَّا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ * يَسْتَبْشِرُونَ بِنِعْمَةٍ مِنَ اللَّهِ وَفَضْلٍ وَأَنَّ اللَّهَ لَا يُضِيعُ أَجْرَ الْمُؤْمِنِينَ
“যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে, অবশ্যই তাদেরকে মৃত ধারণা করো না। বরং তারা তাদের পালনকর্তার নিকট জীবিত। তারা জীবিকাপ্রাপ্ত হয়। আল্লাহ তাদের প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন তা পেয়ে তারা উৎফুল্ল। আর যারা এখনও তাদের পিছনে তাদের কাছে এসে পৌঁছেনি তারা তাদের সম্পর্কে সুসংবাদ গ্রহণ করে যে, তাদের উপর কোন ভয়-ভীতি নেই এবং তারা কোন চিন্তা-পেরেশানী করে না। তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত নেয়ামত ও অনুগ্রহের ব্যাপারে সুসংবাদ গ্রহণ করে এবং তা এভাবে যে, আল্লাহ ঈমানদারদের কর্মফল বিনষ্ট করেন না।”
[সূরা আলে ইমরান,আয়াত নং ১৬৯-১৭১]
❏ বস্তুত শহীদগণ মরেও অমর হন।তারা দুনিয়ার মৃত্যুর পর কবরের যিন্দেগী বা আলমে বরযখে অনন্য হায়াতে জীবিত থাকেন।উক্ত আয়াতে সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।তবে তা আমরা উপলব্ধি করতে পারি না।এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা ঘোষনা করেছেন:
وَلاَ تَقُولُواْ لِمَنْ يُقْتَلُ فِي سَبيلِ اللَّهِ أَمْوَاتٌ بَلْ أَحْيَاء وَلَكِن لاَّ تَشْعُرُونَ
“আল্লাহর রাস্তায় যারা শহীদ হয় তাদের তোমরা মৃত বল না। বরং তারা জীবিত। তবে তা তোমরা উপলব্ধি করতে পারো না।”
[সূরা বাকারা,আয়াত নং ১৫৪]
অথবা এভাবে এবারত করলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়। “অর্থাৎ “এবং বলিও না যারা যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত (শহীদ/মারা) হয়েছেন তারা মারা গেছে ।” না, কখনোই নয় বরং তারা জীবিত।”
❏ আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন:
ﻭﻻ ﺗﺤﺴﺒﻦ ﺍﻟﺬﻳﻦ ﻗﺘﻠﻮﺍ ﻓﻲ ﺳﺒﻴﻞ ﺍﻟﻠﻪ
ﺍﻣﻮﺍﺕ ﺑﻞ ﺍﺣﻴﺎﺀ ﻋﻨﺪ ﺭﺑﻬﻢ ﻳﺮﺯﻗﻮﻥ_
অর্থ:- “এবং না, চিন্তাও করো না, যারা আল্লাহর রাস্তায় কতল বা শহীদ হয়েছে তারা মৃত; না কখনোই নয় বরং তারা জীবন্ত। তারা তাদের রবের নিকট হতে রিজিক পাইতেছে বা রিজিক প্রাপ্ত।”
[সুরা আলইমরান,আয়াত নং ১৬৯]
লক্ষ্য করুন: নিহত বা কতল হলেই হবে না, নিহত হবার সঙ্গে সূক্ষ্ণ একটি শর্ত জুড়ে দেওয়া হল “ফিসাবিলিল্লাহে অর্থাৎ আল্লাহর রাস্তায় যুক্ত করা হয়েছে।”
*আর এ শর্তটি জুড়ে না দিলে নিহত বা কতল হবার বিষয় একেবারেই মূল্যহীন ও অর্থহীন হয়ে যেত। সুতরাং নিহত হলেই চলবে না বরং একমাত্র আল্লাহর রাস্তায় হতে হবে।
*আবার নিষেধ করা হয়েছে ঐ কথাটি না বলতে।সেই কথাটি হল “যারা আল্লাহর রাস্তায় বা আল্লাহর জন্য কতল বা নিহত/ মারা গিয়েছেন তাদেরকে ভুলেও একবার মারা গেছে বলতে পারবে না।
“তারা মারা গেছে” এই কথাটি প্রথমে না বলে বরং প্রথমেই চমকিয়ে যাওয়া বা অবাক হওয়ার কথা বলা হল যে,
ওয়ালা তাকুলু ” তথা এবং বলিও না। কি বলিও না? # তারা মারা গেছে” এই কথাটি বলিওনা। এই আদেশটি সুস্পষ্ঠ করে বলা হয়েছে। কোনরুপ ঈংগিত না করে একদম সোজা ভাষায় বলে দেওয়া হয়েছে।
পরের বাক্যটিতে ধমক দিয়ে সাবধান করা হয়েছে, যেন সতর্কতা অবলম্বন করা হয়।কোন প্রকার চিন্তা-ভাবনা মনের ভিতর আসতে নিষেধ করা হয়েছে এই বলে যে, না কখনোই নয় ”
সুতরাং দুটি আদেশ বা হুকুম সরাসরিভাবে আল্লাহ কর্তৃক এখানে অত্যান্ত পরিষ্কারভাবে পরিলক্ষিত হয় “যারা আল্লাহর রাস্তায়/ পথে বা আল্লাহর জন্য কতল/নিহত হয়েছে তাদেরকে মৃত বলতে নিষেধ করা হয়েছে।
*অপর আদেশটি তথা হুকুমটি হলো, তাঁদেরকে মৃত বলে চিন্তা করতেও নিষেধ তথা বারন বা মানা করা হয়েছে।”তারা মৃত নয়” একথাটি বলার সাথে সাথে বিপরীত কথাটিও বলে দিয়েছে “বাল_আহইয়া ” বরং তারা জীবিত অর্থাৎ “তারা অমর।” এই অমরতা দুনিয়ায় প্রচলিত এবং কথিত বা সাধারন অমরতা নয়।
❏ যিনি জীবিত তার জন্যই রিজিকের প্রয়োজন আর মৃতের জন্য রিজিকের প্রয়োজন হয় না। এই চির অমরত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তিদের জন্য আল্লাহর ঘোষনা “ইনদা রাব্বিহিম ইউরঝাকুন” অর্থাৎ তারা তাদের রবের নিকট হতে রিজিক পাইতেছে বা রিজিক প্রাপ্ত।”
*আর তাদের এ জীবন-অনুভূতির বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণেই তাদের বিশেষ ধরনের জীবনের কিছু লক্ষণ পৃথিবীতেই তাদের দেহে প্রকাশ পায় যে, তাদের দেহ মাটিতে খায় না; তাদের লাশ বরাবর অবিকৃত থাকে। এ ধরনের বহু ঘটনা পৃথিবীতে প্রত্যক্ষিত হয়েছে।
[তাফসীরে কুরতবী,৩য় খণ্ড, ২১৩ পৃষ্ঠা/ তাফসীরে ইবনে কাসীর [ইফাবা], ৪র্থ খণ্ড, ২২০ পৃষ্ঠা/ তাফসীরে মা‘আরিফুল কুরআন [ইফাবা], ২য় খণ্ড, ৩১৯ পৃষ্ঠা]
❏ এ আয়াতসমূহে আল্লাহর পথে শহীদগণের ব্যাপারে বলা হয়েছে যে, তাদেরকে মৃত বলা যাবে না। বরং তারা জীবিত। আবার উক্ত আয়াতসমূহেই রয়েছে যে,যারা নিহত হয়েছেন অর্থাৎ মারা গিয়েছেন।অর্থাৎ তারা দুনিয়াবী হিসেবে মারা গিয়েছেন,তা সত্ত্বেও তাদেরকে বরযখে বিশেষ সম্মানজনক হায়াতের সাথে জীবিত বলে বিশ্বাস করতে হবে এবং বলা যাবে না যে,তারা সাধারণ মানুষের মতো মৃত।একে ‘হায়াতুশ শুহাদা’ বলে।
❏ সূরা আল-বাকারার আয়াত নং ১৫৪ ও সূরা আল ইমরানের ১৬৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফতী মুহাম্মদ শফী,তাফসীর মা’আরেফুল কুরআন-১/৩৯৬ পৃষ্ঠায় বলেন “এই দুটি আয়াতেই মহান আল্লাহ তা’লা শহীদদেরকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। দুনিয়ার জীবিত মানুষের চর্মচক্ষে তাদেরকে প্রাণহীন মৃত লাশ মনে হলোও আসলে মহান আল্লাহর নিকট তারা জীবীত,তাদেরকে মৃত মনে করতে ও মৃত বলতে নিষেধ করা হয়েছে।শহীদদের মৃত্যুকে অন্যদের মৃত্যুর সমপর্যায়ভুক্ত মনে করতে নিষেধ করা হয়েছে।কেননা শহীদদেরকে অন্যান্য মৃতের তুলনায় একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মর্যাদা দান করা হয়েছে।এ কারণেই অনেক সময় দেখা যায়,শহীদদের রক্ত-গোস্তের দেহ পর্যন্ত মাটিতে বিনষ্ট হয় না।জীবিত মানুষের দেহের মতোই অবিকৃত থাকতে দেখা যায়।”
আবার হয়ত কেউ কোরআনের অন্য আয়াত দিয়ে বলবেন সকল জীবকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহন করতে হবে।হ্যাঁ তাও ঠিক আছে।তবে জগতের অন্যদের বা সাধারনদের মত নয়।এখানে বাহ্যিকভাবে মৃত্যুটা হল তাদের জন্য একটা ধাপ মাত্র যা শুধু দুনিয়াবি হায়াতে জিন্দেগী থেকে পর্দা নেওয়া ছাড়া মাত্র আর কিছু না।
❏ এই আয়াত দুটো দ্বারা বুজা যায় শহীদগণ ইন্তেকালের পরেও জিন্দা। আর এ কথা সকলেই জানেন যে,প্রিয় নবীজি খায়বারের যুদ্ধের সময় বিষ পানের কারণে ইন্তেকালের (দুনিয়াবি হায়াতে জিন্দেগী থেকে পর্দা নেওয়ার) সময় ঐ বিষ ক্রিয়ার ফলে প্রিয় নবীজি (ﷺ) এঁর শহিদী দরজাও লাভ করেছেন।এই কারনে আমাদের নবী (ﷺ) জিন্দা।যেমন হাদিস শরীফে ইরশাদ হয়েছে
. حَدَّثَنَا أَبُو مُعَاوِيَةَ ، حَدَّثَنَا الْأَعْمَشُ ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مُرَّةَ ، عَنْ أَبِي الْأَحْوَصِ ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ ، قَالَ : ” لَأَنْ أَحْلِفَ بِاللَّهِ تِسْعًا ، إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قُتِلَ قَتْلًا ، أَحَبُّ إِلَيَّ مِنْ أَنْ أَحْلِفَ وَاحِدَةً ، وَذَلِك بِأَنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ اتَّخَذَهُ نَبِيًّا ، وَجَعَلَهُ شَهِيدًا
“হজরতে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ হইতে বর্ণিত,তিনি বলেন নবী করিম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শহীদ করা হয়েছে এই মর্মে আমার নিকট নয়বার শপথ করা অধিক প্রীয়,তাকে শহীদ করা হয়নি একবার শপথ করার থেকেও…. কারণ আল্লাহ তাআলা যেমন তাকে নবী হিসাবে গ্রহন করেছেন তেমন শহীদ হিসাবেও… গ্রহন করেছেন…
****দলিল******
*(ক.) মুসনাদে আহমাদ,হাদীস নং-৩৪৮৫, ৩৭৪২, ৩৯৯৪,
*(খ.) হাকিম আল মুস্তাদরাক,৩য় খন্ড, হাদীস নং-৪৩৩৯
*(গ.) মুসনাদে আব ইয়ালা,হাদীস নং- ৫১৫১
*(ঘ.) ইমাম বাইহাকি,দালায়েলু নবুয়াহ, হাদীস নং-৩১০৩
*(ঙ.) ইবনে সাআদ,তাবকাতুল কুবরা, হাদীস নং-১৯৮১
সুতরাং শহীদগণের বরযখী জগতে যে হায়াত লাভ হয়,সেটা সাধারণ মৃতদের হায়াত থেকে অনেক বেশী শক্তিশালী। তাদের হায়াত তাদের দেহের সাথে এমনিভাবে সম্পৃক্ত হয় যে,গোশত-হাড়ের দেহ হওয়া সত্ত্বেও মাটি তাকে নিঃশেষ করতে পারে না।বরং তা জীবিত ব্যক্তির দেহের ন্যায় অবিকৃত থাকে।
আর এ বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য করেই তাদেরকে জীবিত আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং অন্যান্য মৃতদের ন্যায় মৃত বলতে নিষেধ করা হয়েছে কিন্তু বাহ্যিক হুকুম- আহকামের দিক থেকে তারা অন্যান্য মৃতদের মতই।যেমন,মীরাছ বণ্টন হওয়া,তাদের স্ত্রীদেরকে অন্যরা বিবাহ করতে পারা ইত্যাদি হুকুম যথারীতিই বলবৎ হয়।
তবে নবী-রাসূলগণের বরযখী হায়াত শহীদগণের বরযখী হায়াতের চেয়েও শক্তিশালী।যার কারণে একে তো তাঁদের মৃত্যুর পর তাদের দেহ কবরে মাটিতে খেতে পারে না বা তা খাওয়া মাটির জন্য হারাম করা হয়েছে,তেমনি তারা কবরে রিযিক প্রাপ্ত হন,আবার তারা কবরে নামায ইত্যাদি বন্দেগী করারও অনন্য মর্যাদা লাভ করেন।অপরদিকে দুনিয়াতেও তাদের সম্পদের মীরাছ বণ্টন হয় না এবং তাঁদের স্ত্রীদেরকেও অন্যরা বিবাহ করতে পারে না।ওফাতের পর নবীগণের কবরে এ দুনিয়ার ন্যায় অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মর্যাদাশীল জীবনধারাকে “হায়াতুল আম্বিয়া” বলে এবং এ হিসেবে রাসূলূল্লাহ ﷺ-এঁর সেই বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বরযখী জীবনকে “হায়াতুন নবী” বলা হয়।