হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী (রা:) এর জীবনী
পরিচিতি: হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী জন্মস্থান তুরস্ক ৬৭১ হিজরী ইন্তেকাল বাংলাদেশ ৭৪০ হিজরী। হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ছিলেন উপমহাদেশের একজন বিখ্যাত আধ্যাত্মিক সাধক (পীরও মুর্শিদ)। সিলেট অঞ্চলে তার মাধ্যমেই ইসলামের প্রসার ঘটে। সিলেটের প্রথম মুসলমান শেখ বোরহান উদ্দিনের ওপর রাজা গৌর গোবিন্দের অত্যাচার এর প্রেক্ষিতে হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও তাঁর সফরসঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার সিলেট আগমন ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ কারণে সিলেটকে ৩৬০ আউলিয়ার দেশ বলা হয়।
আরব ভূমি ও সিলেট ভূমির মিল: কথিত আছে, প্রাচ্য দেশে আসার পূর্বে শাহজালাল ইয়েমেনী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর মামা এবং তাঁর স্বীয় মুর্শিদ সৈয়দ আহমদ কবীর রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাকে এক মুঠো মাটি দিয়ে বলেন, ‘স্বাদে বর্ণে গন্ধে এই মাটির মতো মাটি যেখানে পাবে সেখানে বসতি স্থাপন করে ইসলাম প্রচার করবে।’
হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বিশিষ্ট শিষ্য ও সফরসঙ্গী শেখ আলীকে এই মাটির দায়িত্বে নিয়োগ করেন এবং নির্দেশ দেন যে, যাত্রা পথে বিভিন্ন জনপদের মাটির সাথে যেন এই জনপদের মাটির তুলনা করে তিনি দেখেন। অত:পর এই শিষ্যের উপাধি হয় চাষণী পীর। সিলেট শহরের গোয়াইপাড়ায় তার মাজার শরীফ অবস্থিত। সিলেটের মাটির সাথে আরবের মাটির মিল পাওয়ায় হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সিলেটে বসতি স্থাপন করে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। বর্তমানে সিলেট জেলাতে আরব দেশের মত তৈল ও গ্যাসের খনি পাওয়া যায়।
গজার মাছ: হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর মাজার চত্বরের উত্তর দিকে একটি পুকুর রয়েছে। এ পুকুরে রয়েছে অসংখ্য গজার মাছ। এসব মাছকে পবিত্র মনে করে দর্শনার্থীরা ছোট ছোট মাছ খেতে দেয়। পুকুরের পশ্চিম কোণে ছোট মাছ বিক্রির ব্যবস্থা রয়েছে। ২০০৩ সালে ৪ ডিসেম্বর বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে পুকুরের প্রায় সাত শত’র বেশী গজার মাছ হত্যা করা হয়।
ফলে পুকুরটি গজার মাছ শুন্য হয়ে পড়ে। মরে যাওয়া মাছগুলোকে মসজিদের পশ্চিম দিকের গোরস্থানে পুঁতে ফেলা হয়। পুকুরটি মাছ শুন্য হয়ে যাওয়ার পর হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর অপর সফরসঙ্গী মৌলভীবাজারে অবস্থিত হযরত শাহ মোস্তফা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর মাজার থেকে ২০০৪ সালের ১১ জানুয়ারি ২৪ টি গজার মাছ নিয়ে পুকুরে ছাড়া হয়। বর্তমানে পুকুরের গজার মাছের সংখ্যা কয়েক শত রয়েছে।
জালালী কবুতর ও হযরত নিজাম উদ্দিন আউলিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু: হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর আধ্যাত্মিক শক্তির পরিচয় পেয়ে হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাকে সাদরে গ্রহন করেন। স্মৃতির নিদর্শন স্বরূপ তিনি তাকে এক জোড়া সুরমা রঙের কবুতর অর্থাৎ জালালী কবুতর উপহার দেন।
সিলেট ও এর আশপাশের অঞ্চলে বর্তমানে যে সুরমা রঙের কবুতর দেখা যায় তাহলো এক জোড়া কবুতরের বংশধর। সিলেটে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে কেউই এ কবুতরকে আঘাত করে না এবং খাদ্য হিসিবে গ্রহন করে না। বরং অধিবাসীরা এদের খাদ্য ও আশ্রয় দিয়ে থাকে। হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু মাজার এলাকায় প্রতিদিন ঝাঁকে ঝাঁকে কবুতর উড়তে দেখা যায়।
রাজস্বমুক্ত সিলেট: হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ছিলেন কামনা বাসনামুক্ত নির্লোভ সূফি সাধক। কথিত আছে, দিল্লীর সম্রাট তাকে নবাবী প্রদান করে একটি সনদ পাঠান। হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তা প্রত্যাখ্যান করেন এই বলে যে, তিনি সংসারত্যাগী ফকির, তার নবাব-বাদশাহ হওয়ার প্রয়োজন নেই।
এক পর্যায়ে সম্রাট তাকে সিলেটকে রাজ্য গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন। হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাতেও রাজি হলেন না। শেষে সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজি হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনার্থে সিলেট শহরকে রাজস্বমুক্ত ঘোষণা দেন। এর ধারবাহিকতায় আজও সিলেট শহর ভূমি রাজস্ব থেকে মুক্ত।
জমজমের কূপ ও ঝরণা: তাঁরা যে পুকুরের পানি ব্যবহার করেন তা হিন্দুরাও ব্যবহার করুক-এটা হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু পছন্দ করতেন না। তাই তিনি একটি কূপ খনন করার আদেশ দিলেন এবং প্রার্থনা করলেন আল্লাহ যেন এই কূপটিকে জমজমের কূপটির সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দেন। এরপর তিনি লাঠি দিয়ে মাটির ওপর আঘাত করলেন আর সঙ্গে সঙ্গে এই কূপটির সাথে জমজমের কূপের মিলন ঘটে গেল।
আল্লাহর ক্ষমতার বদৌলতে এই কূপে সোনা ও রুপার রঙের মাছের জন্ম হলো যা আজও এই কূপের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। তারপর এর চারপাশ পাকা করে দেওয়া হলো এবং উত্তর পার্শ্বে দুটি পাথর বসিয়ে দেওয়া হলো-যা থেকে দিনরাত পানি প্রবাহিত হয়। রোগীরা এই পানি পান করে আরোগ্য লাভ করে। রোজাদারেরা এই পানি দ্বারা ইফতার করে। হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর মাজারের পশ্চিম দিকে গেলে ঝরনাটি পাওয়া যায়। যদিও ঝরণার পানি এখন আর প্রবাহিত হয় না, তবুও বাংলাদেশ সরকার স্থানটিকে সংরক্ষণ করে রেখেছে।
রান্নার হাঁড়ি: মাজারের পূর্ব দিকে একতলা ঘরের ভেতরে বড় তিনটি হাঁড়ি (ডেকচি) রয়েছে। এগুলো ঢাকা জেলার একজন সম্মানীত ব্যক্তি (মীর মুরাদ) দান করেছেন। যদিও হাঁড়িগুলোতে রান্না-বান্না হয় না, তবুও কথিত আছে প্রত্যেকটিতে সাতটি গরুর গোশত ও সাত মণ চাল এক সাথে রান্না করা যায়। পূণ্যের উদ্দেশ্যে প্রতিদিন দর্শনার্থীরা হাঁড়িগুলোতে টাকা পয়সা দান করেন।
চিল্লাখানা (ইবাদতখানা): মাজারের দক্ষিণ দিকে গ্রীলঘেরা তারকা খচিত ছোট্ট যে ঘরটি রয়েছে, এটি হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর চিল্লাখানা। স্থানটি মাত্র দু’ফুট চওড়া। কথিত আছে যে, হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এই চিল্লাখানায় জীবনের ২৩ টি বছর ইবাদত সাধনায় কাটিয়েছেন।
হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ব্যবহৃত দ্রব্যাদি: হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু কেবল একজন পীরও মুর্শিদ ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন বীর মোজাহিদ (যোদ্ধা)। তার ব্যবহৃত তলোয়ার, খড়ম, প্লেট এবং বাটি দর্শনার্থীদের দেখার ব্যবস্থা রয়েছে। দরগাহ’র দক্ষিণ দিকে দরগাহ মাদ্রাসা বিল্ডিংয়ের মধ্য দিয়ে একটি প্রবেশ পথ রয়েছে। মুফতি নাজিমুদ্দিন আহমদ এর বাড়িতে হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তলোয়ার ও খড়ম সংরক্ষিত আছে। দরগাহ শরীফের কর্তৃপক্ষের প্লেট ও বাটি সংরক্ষিত আছে। এগুলো দেখতে প্রতিদিন উৎসুক মানুষের জমায়েত হয়।
দরগাহ মসজিদ: বাংলার সুলতান আবু মুজাফ্ফর ইউসুফ শাহের মন্ত্রী মজলিশে আতার আমলে ১৪০০ খ্রিস্টাব্দে দরগাহ চত্বরে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। ১৭৪৪ খ্রিস্টাব্দে বাহরাম খাঁ ফৌজদারের সময় এটি পুননির্মিত হয়। বর্তমানে এটি সিলেট শহরের একটি অন্যতম মসজিদ।
হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সিলেট আগমন: হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আরবের ইয়েমেনের অধিবাসী ছিলেন। তাঁর পিতা মাহমুদ বিন মোহাম্মদ ছিলেন কুরাইশ বংশের একজন সম্মানিত ব্যক্তি। তাকে পীরদের পীর হিসাবে অভিহিত করা হতো। তিনি বিধর্মীদের সাথে যুদ্ধ করে শহীদ হন। তাঁর মা ছিলেন সৈয়দ বংশের এক মহীয়সী নারী। হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর বয়স তিন বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তিনি মারা যান।
মায়ের মৃত্যুর পর মামা সৈয়দ আহমদ কবির সোহরাওয়ার্দী তাঁকে নিজের কাছে নিয়ে লালন পালন করেন। তিনি ভাগ্নেকে এমনভাবে বড় করতে চাইলেন যাতে তিনি ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত ও আধ্যাত্মিক সাধনার উচ্চস্তরে গিয়ে পৌঁছে যেতে পারেন। ধীরে ধীরে তার অলৌকিক ক্ষমতা প্রকাশ পেতে থাকে। কথিত রয়েছে-একদিন সৈয়দ আহমদ কবির তার নিজ গৃহের ভেতর থেকে এক মুঠো মাটি নিয়ে এসে হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হাতে দিয়ে বললেন, ভারতবর্ষে দিকে বেড়িয়ে পড়ো এবং যে মাটির সাথে এ মাটির রূপ-রস-ঘ্রাণের সাদৃশ্য খুঁজে পাবে সেখানে এই মাটি ছড়িয়ে দিয়ে বসতি স্থাপন করবে।
হযরত শাহজালাল রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাঁর পীরের কথা অনুযায়ী হাজী ইউসুফ ও হাজী খলিলসহ আরো কিছু শিষ্য ও সফরসঙ্গী নিয়ে ভারতবর্ষে দিকে যাত্রা শুরু করলেন। প্রথমে তিনি নিজ বাসভ’মি ইয়েমেন এসে পৌঁছেন। এসময় ইয়েমেনে এক অত্যাচারী রাজা ছিল। তিনি বিষপানে হযরত শাহজালাল রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-কে হত্যা করার চেষ্টা করলো। কিন্তু হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু’র কৌশলের কাছে রাজার দুরভিসন্ধি পরাজিত হল। রাজার মৃত্যুর পর তার পুত্র শেখ আলি ক্ষমতায় অভিষিক্ত হন।
শেখ আলি হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু’র গুন ও কোমলমতির পরিচয় পেয়ে তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন এবং তাঁর কাছে বায়াত ও শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তিনিও হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সফরসঙ্গী হলেন। হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাঁর পীরের দেওয়া মাটি শেখ আলির হাতে দিয়ে বললেন, আমরা যখন যেখানে গিয়ে পৌঁছবো, সেখানকার মাটির সঙ্গে এ মাটির রূপ-রস-গন্ধ তোমাকে মিলিয়ে দেখতে হবে-এটাই হল তোমার কাজ।
শেখ আলিকে জিহ্বা দিয়ে চুষে মাটি নিরীক্ষণ করতে হতো। সে কারণে আজও তাকে চাষণির পীর হিসাবে অভিহিত করা হয়। হযরত শাহজালাল রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যখন দিল্লীতে পৌঁছেন, তখন সেখানকার বিখ্যাত পীর ছিলেন নিজাম উদ্দিন আউলিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। তিনি প্রকৃত অর্থেই অনুধাবন করতে পারলেন হযরত শাহজালাল রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু একজন দরবেশ ও সূফি সাধক। তিনি ছাই রঙের এক জোড়া কবুতর উপহার হিসাবে পাঠিয়ে তাঁকে তার দরবারে নিমন্ত্রণ জানালেন। হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু’র মাজারে এখন যে কবুতর উড়তে দেখা যায়- তা ওই এক জোড়া কবুতরেরই বংশধর-যা জালালি কবুতর নামে পরিচিত।
হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যখন সিলেটে আসেন-তখন এখানে গোবিন্দ নামক এক রাজার রাজত্ব ছিল। এটি কুসংস্কার ঘেরা রাজ্য জড়িবটি ও জাদুটোনার জন্য বিখ্যাত ছিল। রাজা গোবিন্দের জন্মস্থান গৌড়ে থাকায় তাকে গৌড় গোবিন্দ নামে ডাকা হতো। হযরত শাহজালাল রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও তার সঙ্গীরা যখন গৌড় রাজ্য অধিকার করেন-তখন রাজা গৌড় ছেড়ে সিলেটে আশ্রয় নেয় এবং নিজেকে রাজা বলে দাবী করতে থাকে।
তৎকালীন সময় সিলেট শহরের পূর্ব দিকে অবস্থিত টুলটিকর নামক স্থানে শেখ বুরহান উদ্দিন নামক একজন মুসলমান বসবাস করতেন। হযরত বুরহান উদ্দিন ছিলেন নিঃসন্তান। আল্লাহর কাছে অনেক প্রার্থণার পর তিনি একটি পুত্র সন্তান লাভ করলেন। তার সন্তানের আকিকা উপলক্ষে তিনি একটি গাভী কুরবানী করেন। এসময় একটি কাক অথবা একটি চিল এক টুকরো গোশত তুলে নিয়ে গৌড় গোবিন্দের ঘরে ফেলে দিল। তখন হিন্দুরা গাভীর রক্তকে ব্রাহ্মণের রক্তের সদৃশ্য মনে করত। এতে রাজা ভীষণ রাগান্বিত হলেন।
তিনি হযরত বুরহান উদ্দিনকে ডেকে নিয়ে তার হাতের কব্জি কেটে দিলেন এবং তার নিষ্পাপ শিশুকে জবাই করে হত্যা করলেন। এতে বুরহান উদ্দিন নিরূপায় হয়ে পড়লেন। তার মনে প্রতিশোধের আগুন জ্বলতে থাকে। একদিন বুরহান উদ্দিন গোপনে শহর ছেড়ে দিল্লীর সুলতান আলাউদ্দিন ইবনে মুহম্মদ শাহের দরবারে গিয়ে হাজির হলেন। তিনি সুলতানের কাছে তার ওপর ঘটে যাওয়া অত্যাচারের কাহিনী বর্ণনা করলেন। সুলতান এ মর্ম পীড়াদায়ক কাহিনী শুনে ভীষণ আঘাত পেলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বুরহান উদ্দিনের উপর অত্যাচারের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তার ভাতিজা সিকান্দর শাহকে স্বসৈন্যে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন।
সিকান্দর গাজী যখন ব্রহ্মপুত্র পাড় হয়ে সোনারগাঁয়ে অবস্থান নিলেন। খবর পেয়ে গৌড় গোবিন্দ তার জাদুকরদের ভৌতিক শক্তির সাহায্যে সিকান্দর গাজীর সৈন্যদের ওপর জাদুমিশ্রিত অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করতে থাকল। এতে সিকান্দর গাজীর সৈন্যরা পরাজয় বরণ করেন। এরপর ঘটনাক্রমে হযরত শাহজালাল রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু’র সাথে দেখা হয় সিকান্দর গাজীর। তখন তাদের সৈন্য সংখ্যা তিন শত ষাট-এ গিয়ে দাঁড়াল। সিকান্দর গাজী তার সকল কথা হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-কে স্ববিস্তারে জানালেন। তিনি তার কথা শুনে বললেন, ‘আমিও এসেছি সকল বাতিল শক্তি ধ্বংস করে ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য, তাই তুমি যদি সিলেট-বিজয় করতে চাও তাহলে আমার সঙ্গে আসতে পারো।
হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যোদ্ধাগণকে সঙ্গে নিয়ে সিলেটের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন। ব্রহ্মপুত্রের তীরে পৌঁছে দেখলেন এখানে কোন নৌকা নেই। তিনি তাঁর মুসাল্লা (জায়নামাজ) বিছিয়ে সকলকে নিয়ে পার হলেন। তারা যখন সিলেটের চৌকি পরগনায় পৌঁছলেন-তখন গৌড় গোবিন্দের সৈন্যরা তার প্রতি অগ্নিবাণ ছুঁড়তে লাগল। কিন্তু হযরত শাহজালাল রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাঁর অলৌকিক ক্ষমতায় তা প্রতিহত করলেন, যা ফিরে গিয়ে গৌড় গোবিন্দের আস্তানায় অন্ধকার জালের ন্যায় সৃষ্টি হলো। এ দৃশ্য দেখে সৈন্যরা ভয় পেয়ে গেল। এ খবর শুনে বিচলিত হলো গৌড় গোবিন্দ নিজেও।
এ অবস্থায় হযরত শাহজালাল রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বরাক নদীর তীরে এসে পৌঁছলেন। কিন্তু এখানেও পারাপারের কোন ব্যবস্থা নেই। আবারও তিনি জায়নামাজ বিছিয়ে সঙ্গীদের নিয়ে নদী পার হয়ে সিলেট শহরের দক্ষিণ দিকে জালালপুর পরগণায় এসে পৌঁছলেন। এসময় গৌড় গোবিন্দ একটি বিশাল লোহার কামান হাতির ওপর সওয়ার করে হযরত শাহজালাল রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু কাছে পাঠালেন। রাজার দূতরা জানালো, তিনি যদি ধনুতে শরযোজনা করতে পারেন, তাহলে তিনি তার জাদুটোনা থেকে বিরত থাকবেন এবং বিনা যুদ্ধে রাজ্যভার ছেড়ে দেবেন।
হযরত শাহজালাল রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তার শর্ত মেনে নিলেন। এরপর হযরত শাহজালাল রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তার সফরসঙ্গী হযরত নাসির উদ্দিনকে ধনুতে শরযোজনা করতে বললেন। কিন্তু তা এতই কষ্টকর ছিল যে, শক্তি প্রয়োগ করতে করতে তার শরীরের রোমকূপ থেকে রক্ত বের হওয়ার উপক্রম হলো। হযরত নাসির উদ্দিনের এ অবস্থা দেখে হযরত শাহজালাল রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার দ্বারা তাকে সহযোগিতা করলেন। সঙ্গে সঙ্গে নাসির উদ্দিন বিসমিল্লাহ বলে ধনুতে শরযোজনা করতে সক্ষম হলেন।
এই অসাধ্য সাধন করা দেখে চারদিক থেকে হর্ষ ধ্বনি উঠল এবং আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হল। এরপর কামানটি যখন গৌড় গোবিন্দের দিকে এগিয়ে আসছিল, তখন গৌড় গোবিন্দের চোখ অশ্রু ভারাক্রান্ত। রাজা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলতে লাগলেন,‘আমার রাজ্য চলে গেল।’ রাজা পলায়নের উদ্দেশ্যে কাছাড়ের পথ ধরলেন। এরপর থেকে তার আর কোন হদিস মেলেনি।
তিনি এখানে রাজ্য জয় করে দেখেন তাঁর পীর সৈয়দ আহমদ কবিরের দেওয়া এক মুঠো মাটির সাথে এখানকার মাটির অদ্ভূত মিল রয়েছে। তিনি সিলেট শহরের দরগাহ মহল্লায় একটি ছোট্ট টিলায় তাঁর বসতি স্থান করলেন। এখানে বসেই ইবাদত বন্দেগি করতে থাকেন। তিনি তাঁর সঙ্গীদেরকে শহরের বিভিন্ন স্থানে,পরগণায় ইসলাম প্রচারের জন্য পাঠিয়ে দিলেন।
শুধু ইয়েমেনের রাজপুত্র, হাজী ইউসুফ ও হাজী খলিলসহ আরো কয়েকজন খাদেমকে তার কাছাকাছি রাখলেন। এখান থেকে তিনি ইসলামের দাওয়াত দিতে লাগলেন এবং নিজের আস্তানাকে ধ্যান ও সাধনার এক অনুপম লীলাক্ষেত্রে পরিণত করলেন। হযরত শাহজালাল রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ছিলেন কিংবদন্তি সাধক। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের আধ্যাত্মিক শক্তি যোগাচ্ছেন এই মহা সাধক পুরুষ।
ওফাত: বাংলা ভাষায় লেখা সিলেট অঞ্চলের প্রথম ইতিহাস গ্রন্থ ‘শ্রীহট্ট দর্পণ’-এ বলা হয়েছে-হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যে ছোট্ট টিলায় বাস করতেন, ইন্তেকালের পর সেখানেই তাকে দাফন ও সমাধি তৈরী করা হয়। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক পুরুষ হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে সিলেটে আগমন করেন। তিনি ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দে ৬৯ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তিনি অবিবাহিত জীবন অতিবাহিত করেন।
ইসলামী গবেষণা বিভাগ
বাগদাদী ফাউন্ডেশন, কুমিল্লা- ৩৫০০, বাংলাদেশ।