সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আয্হারী
///////
খতিব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ, নন্দনকানন, চট্টগ্রাম। সহকারী অধ্যাপক, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
————–
ছাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু তাআ’লা আনহুম হেদায়াতের নক্ষত্র, তাকওয়ার পূর্ণচন্দ্র, দীপ্তিমান তারকা, সুদীপ্ত পূর্ণিমা; রাতের দরবেশ, দিনের অশ্বারোহী; যাঁরা আপন আঁখি যুগলকে সজ্জিত করেছেন মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নূরের সুরমায়; ইসলাম নিয়ে যাঁরা ছুটে গেছেন পূর্বে ও পশ্চিমে, যার বদৌলতে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছে ভূভাগের প্রতিটি দেশে এবং প্রতিটি প্রান্তে। তাঁরা ছিলেন আনসার, যাঁরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে করেছেন নুসরাত ও সাহায্য। তাঁরা ছিলেন মুহাজির, যাঁরা কেবলই আল্লাহ তাআলার জন্য করেছেন হিজরত, বিসর্জন দিয়েছেন নিজেদের দেশ ও সহায়-সম্পদ।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু কত সুন্দরই না বলেছেন। তিনি বলেন,
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعِودٍ رَضِيَ اللَّهُ تَعَالَى عَنْهُ، قَالَ : ” إِنَّ اللَّهَ نَظَرَ فِي قُلُوبِ الْعِبَادِ، فَوَجَدَ قَلْبَ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَيْرَ قُلُوبِ الْعِبَادِ، فَاصْطَفَاهُ لِنَفْسِهِ، وَابْتَعَثَهُ بِرِسَالَتِهِ، ثُمَّ نَظَرَ فِي قُلُوبِ الْعِبَادِ بَعْدَ قَلْبِهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَوَجَدَ قُلُوبَ أَصْحَابِهِ خَيْرَ قُلُوبِ الْعِبَادِ بَعْدَهُ، فَجَعَلَهُمْ وُزَرَاءَ نَبِيِّهِ، يُقَاتِلُونَ عَلَى دِينِهِ، فَمَا رَآهُ الْمُسْلِمُونَ حَسَنًا فَهُوَ عِنْدَ اللَّهِ حَسَنٌ، وَمَا رَآهُ الْمُسْلِمُونَ سَيِّئًا فَهُوَ عِنْدَ اللَّهِ سَيِّئٌ “
“আল্লাহ তাআলা স্বীয় বান্দাদের অন্তরের প্রতি কুদরতের দৃষ্টি প্রদান করলে হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্তরকে সর্বোত্তম অন্তর হিসেবে দেখতে পান। ফলে তিনি তাঁকে নিজের (বিশেষ ভালোবাসা ও অনুগ্রহের) জন্য নির্বাচন করে নেন। তাঁকে তাঁর রিসালাত সমেত প্রেরণ করেন। হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্তরের পর তিনি নযর দেন বান্দাদের অন্তরের দিকে। এ দফায় তিনি হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছাহাবীগণের অন্তরকেই সকল বান্দার অন্তরের মধ্যে সর্বোত্তম দেখতে পান। ফলে তিনি তাঁদেরকে তাঁর নবীর সাহায্যকারী হিসাবে নির্বাচন করে নেন। যারা তাঁর দীনের জন্য লড়াই করেন। অতএব মুসলিমরা (সাহাবীগণ) যে জিনিসকে সুন্দর ও ভালো মনে করে, তা আল্লাহ তাআলার কাছেও পছন্দনীয় বিবেচিত হয়। আর যা তাঁদের কাছে মন্দ বিবেচিত হয় তা তাঁর কাছেও মন্দ হিসেবে গৃহীত হয়।’ [মুসনাদ আহমদ : ৩৬০০; মুসনাদ বাযযার : ১৮১৬]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর তাঁরাই বহন করেছেন ইসলামের ঝাণ্ডা। উড্ডীন করেছেন ইসলামের পতাকা পৃথিবীর নানা প্রান্তে। আল্লাহ তাঁদের মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলিমকে সম্মানিত করেছেন। এ কারণেই আমরা বিচারের দিন পর্যন্ত তাঁদের নিকট ঋণী। কবি বলেন, ‘ইসলামের সম্মান তো তাঁদের ছায়াতেই; আর মর্যাদা তো তাই, যা তাঁরা নির্মাণ করে সুদৃঢ় করেছেন!’
তাঁরাই সুন্নাহ সম্পর্কে বেশি জানতেন, কুরআনও সবচেয়ে ভালো বুঝতেন তাঁরাই। কারণ, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের কাছে কুরআনের অর্থ ব্যাখ্যা করেছেন, এর অস্পষ্ট বিষয় তাঁদের সামনে স্পষ্ট করেছেন এবং এর কঠিন বিষয় তাঁদের জন্য সহজ করে বলেছেন। তাঁরাই এ কুরআনের তাফসীর সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জ্ঞাত। কারণ, তাঁরা কুরআন নাযিলের প্রেক্ষাপট তথা সময় ও অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছেন। [ড. মুহাম্মদ আবূ শাহবা, আল-ইসরাঈলিয়্যাত ওয়াল মাওযূআত ফী কুতুবিত তাফসীর, পৃষ্ঠা : ৫২]
ইমাম শাফেয়ী রহ. তাঁর ‘আর -রিসালা’ গ্রন্থে ছাহাবীগণের আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “তাঁরা ইলম, ইজতিহাদ, তাকওয়া ও জ্ঞান-বুদ্ধিতে আমাদের ওপরে। তাঁরা আমাদের চেয়ে উত্তম এমন বিষয়ে যে ব্যাপারে ইলম জানা গেছে কিংবা যা ইস্তিমবাত বা উদ্ভাবন করা হয়েছে। তাঁদের রায়গুলো আমাদের কাছে প্রশংসনীয়। আমাদের নিজেদের ব্যাপারেই আমাদের সিদ্ধান্তের চেয়ে তাঁরাই অগ্রাধিকার পাবার হকদার।’ [মুকাদ্দাম ইবনু সালাহ, ড. নূরুদ্দীন ‘ঈতর সম্পাদনা, বৈরুত, প্রকাশকাল : ২০০০ ইং, পৃষ্ঠা : ২৯৭]
আমাদের উপর তাঁদের বহু অনুগ্রহ রয়েছে। আমাদের পূর্বেই তাঁরা ইসলামের এ নিয়ামত প্রাপ্ত হয়েছেন এবং আমাদের কাছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি প্রেরিত বাণী পৌঁছিয়ে দিয়েছেন ও তন্মধ্যে যা অস্পষ্ট ছিল তা স্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন এবং তাদেরকে সন্তুষ্ট করুন।
খলিফাতুর রাসুল হযরত আবু বকর সিদ্দীক্ব রাদিয়াল্লাহু আনহু:
চারিত্রিক মাধুর্য, ব্যক্তিত্বের বলিষ্ঠতা, জ্ঞানের গভীরতা, আদর্শিক একনিষ্ঠতা, নীতি-জ্ঞানে পরিপক্বতা, কর্তব্য-নিষ্ঠা, ত্যাগের মহিমা আর নিঃস্বার্থ প্রজা পালনে পৃথিবীর ইতিহাসে যেসব বিরল ব্যক্তিত্বরা সুখ্যাতি অর্জন করেছেন তাঁদের মধ্যে সর্বপ্রথম যাঁর নামটি উচ্চারণ করতে হয় তিনি হলেন খোলাফায়ে রাশেদিনের প্রথম খলিফা, খলিফাতুর রাসুল হযরত আবু বকর সিদ্দীক্ব রাদিয়াল্লাহু আনহু । হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব ইসলাম জগতে এক নজিরবিহীন বিরল ব্যক্তিত্ব।
পরিচিতি: তিনি আরবের ঐতিহ্যবাহী কুরাইশ বংশের বনু তাইম গোত্রে ৫৭২ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিলাদত শরীফের দুই বছরেরও কিছু বেশি সময় পরে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং ইন্তেকাল করেছিলেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের পর একই ব্যবধানে। হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসুলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমান আয়ুষ্কাল লাভ করেছিলেন। তাঁর বংশপরম্পরা ষষ্ঠ পুরুষে গিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বংশধারায় মিলিত হয়।
মহান এ খলিফার নাম ছিল ‘আবদুল্লাহ’ ও ডাকনাম বা কুনিয়াত আবু বকর। ‘সিদ্দীক্ব’ ও ‘আতিক’ তাঁর উপাধী। পিতার নাম ওসমান, কুনিয়াত আবু কুহাফা, তিনি(আবু কুহাফা) মক্কা বিজয়ের দিন রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে হাজির হয়ে ইসলামের ঘোষনা দেন। হিজরী ১৪ সনে একশ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। হযরত আবু বকরের মাতার নাম সালমা এবং কুনিয়াত উম্মুল খায়ের। মা ’উম্মুল খায়ের’ স্বামীর বহু পুর্বে মক্কায় ইসলামের প্রথম পর্যায়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। মক্কার ‘দারুল আরকামে’ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে তিনি অন্যতম। স্বামীর মত তিনিও দীর্ঘ জীবন লাভ করেন। প্রায় ৯০ বছর বয়সে পুত্রকে খেলাফতের পদে অধিষ্টিত রেখে তিনি ইন্তেকাল করেন।
হযরত আবু বকর সিদ্দীক্ব রাদিয়াল্লাহু আনহু মহানবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন। তিনি সব সময়ই রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ছায়ার মতো অনুসরণ করতেন। তিনিই পুরুষদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি যিনি হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাবীর সত্যতাকে নিশ্চিত বলে গ্রহণ করেন। মহানবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার নির্দেশে মক্কা থেকে মদীনা হিজরতের সময় আল্লাহ তাআলার রাসুল একমাত্র সহযাত্রী ও সঙ্গী হিসাবে তাঁকেই বেছে নিয়েছিলেন। তিনিই হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একমাত্র সাহাবী, যিনি তাঁর সাথে সেই সফরে ‘সাওর’গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। হিজরতের পর সকল অভিযানেই তিনি রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে অংশগ্রহণ করেন, কোন একটি অভিযানেও অংশগ্রহণ হতে বঞ্চিত হননি।
মক্কা বিজয়ের পর নবম হিজরীতে প্রথম ইসলামি হজ্জ আদায় উপলক্ষে রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বকরকে রাদিয়াল্লাহু আনহু “আমিরুল হাজ্ব” নিয়োগ করেন। রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্তিম রোগ শয্যায় তাঁরই নির্দেশে মসজিদে নববীর ইমামতীর দায়িত্ব পালন করেন। মোট কথা রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় আবু বকর তাঁর উজির ও উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার ওফাতের পর আবু বকর তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। “খলিফাতু রাসুলিল্লাহ”- এ উপাধিটি কেবল তাঁকেই দেয়া হয়। পরবর্তী খলিফাদের ‘আমিরুল মোমেনীন’ উপাধি দেয়া হয়েছে।
আফদালুন নাস বা’দাল আম্বিয়া হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব রাদিয়াল্লাহু আনহুর বুযূর্গী ও ফযীলত বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না। কুরআন শরীফ-এ স্বয়ং মহান আল্লাহ পাক একাধিক স্থানে তাঁর ছানা-ছিফত বর্ণনা করেছেন। তাঁর প্রশংসায় অসংখ্য হাদীছ শরীফ বর্ণিত হয়েছে। হযরত নবী ও রসূল আলাইহিমুস সালামদের পরে যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী তিনিই সিদ্দীক্বে আকবর এবং এই “সিদ্দীক্বে আকবর” লক্বব মুবারক তাঁর একক বৈশিষ্ট্য। এমন কোনো ভাষা নেই, যে ভাষায় তাঁর জীবনীগ্রন্থ রচিত হয়নি। তিনি ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি প্রথম কুরআন শরীফ সংগ্রহকারী অর্থাৎ জামিউল কুরআন এবং তাঁকেই প্রথম ‘খলীফাতু রসূলিল্লাহ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।‘সিদ্দীক্বে আকবর’ই একমাত্র সেই সাহাবী, যাঁর সাহাবীত্ব পবিত্র কুরআনে ঘোষিত বলে সেটার অস্বীকারকারী কাফির হিসেবে গণ্য হবে।
ঐতিহ্যবাহী কুরাইশ দলপতির একমাত্র পুত্র সন্তান হিসেবে হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর কৈশোর ও শৈশব কেটেছে পারিবারিক স্বাচ্ছন্দ্য ও মর্যাদাপূর্ণভাবে। বিলাসিতার মধ্যে প্রতিপালিত হলেও হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর জীবনে জাহেলি যুগেও নীতিহীনতা ও বর্বতার কোনো স্পর্শ লাগেনি। শৈশব থেকে উন্নত চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। তিনি কোনোদিন শিরক করেননি এবং মূর্তির জন্য অর্চনা দেননি ও মূর্তির সামনে মাথা নত করেননি। তিনি ছিলেন হানিফ ঘরানার প্রথম সারির ব্যক্তি। ইসলাম গ্রহণের পূর্বেও কখনো শরাব পান করেননি।
ইসলাম গ্রহণ: হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামর রেসালাতের দাওয়াতের দ্বিতীয় দিনে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনিই হলেন বয়স্ক ও পুরুষদের মধ্যে এবং কুরাইশ বংশের ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম ব্যক্তি। তিনি এ দিক দিয়েও সৌভাগ্যবান যে তাঁর মা-বাবা দুজনই ইসলাম কবুল করেছিলেন এবং তাঁর পরিবারের সবাই ছিলেন মুসলমান। এক হাদিসে রাসুলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
أَنّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : ” مَا دَعَوْتُ أَحَدًا إِلَى الإِسْلامِ إِلا كَانَتْ عَنْهُ كَبْوَةٌ وَتَرَدُّدٌ وَنَظَرٌ إِلا أَبَا بَكْرٍ مَا عَتَّمَ مِنْهُ حِينَ ذَكَرْتُهُ وَمَا تَرَدَّدَ فِيهِ “
“আমি যাকেই ইসলামের দাওয়াত দিয়েছি, একমাত্র আবু বকর ছাড়া সবার মধ্যে কিছু না কিছু দ্বিধা-দ্বন্দ্ব লক্ষ করেছি।”
বাল্যকাল থেকেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। রেসালাতের পর সে সম্পর্ক আরো গভীর হয়।
তাছাড়া মানুষের দুঃখ-দুর্দশায়, সহায়-সম্বলহীনতায় এবং দুস্থদের সাহায্যার্থে তিনি ছিলেন আত্মনিবেদিত। ইসলাম কবুল করার সময় হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে প্রায় ৪০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা জমা ছিল এবং তিনি সমকালীন ব্যবসায়ী বিত্তবানদের অন্যতম ছিলেন। ইসলাম গ্রহণ করার পর সঞ্চয়কৃত সমুদয় অর্থ ইসলামের কল্যাণে তিনি ওয়াকফ করে দেন। কুরাইশদের যেসব দাস-দাসী ইসলাম গ্রহনের কারনে নিগৃহীত ও নির্যাতিত হচ্ছিল, এ অর্থ দ্বারা তিনি সেই সব দাস-দাসী খরিদ করে আযাদ করেন। তেরো বছর পর যখন রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তিনি মদীনায় হিজরাত করেন তাঁর কাছে এ অর্থের মাত্র আড়াই হাজার দেরহাম অবশিষ্ট ছিল। অল্পদিনের মধ্যে অবশিষ্ট দিরহাম গুলিও ইসলামের জন্য ব্যয়িত হয়। হযরত বিলাল, খাব্বাব, আম্মার, আম্মারের মা সুমাইয়্যা, সুহাইব, আবু ফুকাইহ প্রমুখ দাস-দাসী তাঁরই অর্থের বিনিময়ে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি লাভ করেন।
তাবুকের যুদ্ধে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হলে যেখানে অন্য সাহাবিরা মোটা অঙ্ক দান করলেন, সেখানে হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে দান করার তেমন কিছুই ছিল না। তাই তিনি ব্যাকুল চিত্তে ঘরে গিয়ে প্রয়োজনীয় আসবাব, কাপড়চোপড় থেকে শুরু করে চুলার ছাই পর্যন্ত (যুদ্ধে আহত যোদ্ধাদের ক্ষতস্থানে ছাই উপকারী) রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামর দরবারে প্রদান করেন। রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর এ ত্যাগ দেখে তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন,” مَا أَبْقَيْتَ لأَهْلِكَ؟ ” قَالَ: أَبْقَيْتُ لَهُمُ اللَّهَ وَرَسُولَهُ، ” . ‘তুমি তোমার পরিবার-পরিজনের জন্য কী রেখে এসেছ?’ তদুত্তরে তিনি বলেছিলেন, “আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে।”
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : “أَرْحَمُ أُمَّتِي بِأُمَّتِي أَبُو بَكْرٍ ‘আমার উম্মতের মাঝে আবু বকরই বেশি দয়ালু।’
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো এরশাদ করেন, قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ” إِنَّ أَمنِّ النَّاسِ عَلَيَّ فِي صُحْبَتِهِ وَمَالِهِ أَبُو بَكْرٍ, وَلَوْ كُنْتُ مُتَّخِذًا خَلِيلا مِنَ النَّاسِ لاتَّخَذْتُ أَبَا بَكْرٍ خَلِيلا, وَلَكِنْ خُلَّةُ الإِسْلامِ وَمَوَدَّتُهُ لا يَبْقَيَّنَ فِي الْمَسْجِدِ بَابٌ إِلا سُدَّ إِلا بَابُ أَبِي بَكْرٍ ” “বন্ধুত্ব ও সাহায্য আবু বকরই আমাকে বেশি করেছিলেন। ইহজগতে যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতাম তাহলে আবু বকরকেই করতাম।আবু বকরের দরজা ছাড়া মসজিদের বাকী সব দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে”
‘ইসলামের ত্রাণকর্তা’: ইসলামের প্রতি হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর অপরিসীম অবদানের জন্য তাঁকে ‘ইসলামের ত্রাণকর্তা’ বলা হয়। এ অবদানের স্বীকৃতির ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ, قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ” مَا لأَحَدٍ عِنْدَنَا يَدٌ إِلا وَقَدْ كَافَأْنَاهُ مَا خَلا أَبَا بَكْرٍ فَإِنَّ لَهُ عِنْدَنَا يَدًا يُكَافِئُهُ اللَّهُ بِهَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ, وَمَا نَفَعَنِي مَالُ أَحَدٍ قَطُّ مَا نَفَعَنِي مَالُ أَبِي بَكْرٍ, لَوْ كُنْتُ مُتَّخِذًا خَلِيلا لاتَّخَذْتُ أَبَا بَكْرٍ خَلِيلا, أَلا إِنَّ صَاحِبَكُمْ خَلِيلُ اللَّهِ “
‘দুনিয়াতে আমি প্রত্যেক মানুষের এহসানের পরিপূর্ণ বদলা আদায় করেছি কিন্তু সিদ্দিকে আকবরের ত্যাগের প্রতিদান আদায় করিনি। হাশরের ময়দানে স্বয়ং রাব্বুল আলামিন তাঁকে ওই প্রতিদান দান করবেন। তাঁর অর্থ আমার উপকারে যেমন এসেছে, অন্য কারো অর্থ তেমন আসেনি।”
রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুয়তের ঘোষনায় মক্কায় হৈ চৈ পরে গেল। মক্কার প্রভাবশালী ধনি নেতৃবৃন্দ তাঁর বিরোধিতায় কোমর বেঁধে লেগে যায়। কুরাইশদের ধনবান ও সম্মানী ব্যক্তিদের মধ্যে এক মাত্র আবু বকর রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গ দেন, তাঁকে সাহস দেন এবং বিনা দ্বিধায় তাঁর নবুয়তের প্রতি ঈমান আনেন। তাঁর ইসলামের দাওয়াত,ব্যক্তিগত প্রভাব ও চেষ্টায় তৎকালীন কুরাইশ বংশের বিশিষ্ট যুবক উসমান, যুবায়ের, আব্দুর রহমান, সা’দ ও তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহুমের মত ব্যক্তিরা সহ আরো অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেন।
হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামইরশাদ করেন: ” لَوْ كُنْتُ مُتَّخِذًا خَلِيلا غَيْرَ رَبِّي لاتَّخَذْتُ أَبَا بَكْرِ خَلِيلا ““আমি মহান আল্লাহ পাককে ব্যতীত যদি অন্য কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করতাম তাহলে হযরত আবু বকর সিদ্দীক্ব কেই বন্ধুরূপে গ্রহণ করতাম।”(বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, ইবনে মাযাহ)
হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا، قَالَتْ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ” لَا يَنْبَغِي لِقَوْمٍ فِيهِمْ أَبُو بَكْرٍ أَنْ يَؤُمَّهُمْ غَيْرُهُ ” . قَالَ أَبُو عِيسَى : هَذَا حَسَنٌ غَرِيبٌ.“যেই জামায়াতে হযরত আবু বকর সিদ্দীক্ব উপস্থিত থাকবেন সেখানে তিনি ব্যতীত অন্য কারো ইমামতি করা উচিত হবে না।” (‘তিরমিযী শরীফ)
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আবু বকর সিদ্দীক্বকে উদ্দেশ্য করে ইরশাদ করেন: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لأَبِي بَكْرٍ : ” أَنْتَ صَاحِبِي فِي الْغَارِ, وَصَاحِبِي عَلَى الْحَوْضِ ” . “তুমি আমার (ছওর) গুহার সঙ্গী এবং হাউযে কাউছারেও আমার সাথী।(তিরমিযী, মিশকাত শরীফ)
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বসা ছিলাম। ইতিমধ্যে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ও ওমার রাদিয়াল্লাহু আনহু এলেন। তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: عَنْ عَلِيٍّ، قَالَ : بَيْنَا أنا جَالِسٌ عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذْ أَقْبَلَ أَبُو بَكْرٍ وَعُمَرُ، فَقَالَ : ” هَذَانِ سَيِّدَا كُهُولِ أَهْلِ الْجَنَّةِ، إِلا مَا كَانَ مِنَ الأَنْبِيَاءِ، وَلا تُخْبِرْهُمَا ” .‘হে আলী! এ দু’জন হলেন নবীগণের পর জান্নাতের মধ্যবয়সী মানুষের নেতা। তবে তাদেরকে একথা বলো না। (মুসনাদে আহমদ ১/৮০)
মহান আল্লাহ পাক কালামুল্লাহ শরীফ-এ ইরশাদ করেন:
إِلَّا تَنْصُرُوهُ فَقَدْ نَصَرَهُ اللَّهُ إِذْ أَخْرَجَهُ الَّذِينَ كَفَرُوا ثَانِيَ اثْنَيْنِ إِذْ هُمَا فِي الْغَارِ إِذْ يَقُولُ لِصَاحِبِهِ لَا تَحْزَنْ إِنَّ اللَّهَ مَعَنَا فَأَنْزَلَ اللَّهُ سَكِينَتَهُ عَلَيْهِ وَأَيَّدَهُ بِجُنُودٍ لَمْ تَرَوْهَا وَجَعَلَ كَلِمَةَ الَّذِينَ كَفَرُوا السُّفْلَى وَكَلِمَةُ اللَّهِ هِيَ الْعُلْيَا وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ ) التوبة(৪০.
“তিনি ছিলেন দু’জনের একজন। যখন উনারা গুহায় অবস্থান করছিলেন তখন তিনি আপন সঙ্গীকে বললেন, ‘চিন্তা করবে না। নিঃসন্দেহে মহান আল্লাহ পাক আমাদের সাথে রয়েছেন।” (সূরা তওবাহ: আয়াত: ৪০)
হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে:قَالَ رَسُولُ اللَّه صلى الله عليه وسلم: حُبُّ أَبِي بَكْرٍ وَعُمَرَ إِيمَانٌ، وَبُغْضُهُمَا كُفْرٌ ““হযরত সিদ্দীক্বে আকবর এবং হযরত ফারূকে আযম রাদিয়াল্লাহু আনহুমার মুহব্বত ঈমানের অন্তর্ভুক্ত। আর উনাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা কুফরী।” (ইবনু আসাকের-তারিখু দেমশ্ক ৩০/১৪৪)
ফারূকে আ’যম হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
عَنْ عُمَرَ – رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ – ذُكِرَ عِنْدَهُ أَبُو بَكْرٍ فَبَكَى وَقَالَ : وَدِدْتُ أَنَّ عَمَلِي كُلَّهُ مِثْلُ عَمَلِهِ يَوْمًا وَاحِدًا مِنْ أَيَّامِهِ ، وَلَيْلَةً وَاحِدَةً مِنْ لَيَالِيهِ ، أَمَّا لَيْلَتُهُ فَلَيْلَةٌ سَارَ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ – إِلَى الْغَارِ “আমি আন্তরিকভাবে এই আকাঙ্খা পোষণ করি যে, আমার গোটা জীবনের আমল যদি হযরত সিদ্দীক্বে আকবর’র এক রাত্রির আমলের সমান হতো। তা সেই রাত্রি, যেই রাত্রিতে তিনি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র সাথে হিজরতের সফরে সওর গুহার দিকে রওনা হন।” (মিশকাত-৬০৩৪)
মিশকাত শরীফে হাদীসটি এভাবে এসেছে:
عَنْ عُمَرَ – رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ – ذُكِرَ عِنْدَهُ أَبُو بَكْرٍ فَبَكَى وَقَالَ : وَدِدْتُ أَنَّ عَمَلِي كُلَّهُ مِثْلُ عَمَلِهِ يَوْمًا وَاحِدًا مِنْ أَيَّامِهِ ، وَلَيْلَةً وَاحِدَةً مِنْ لَيَالِيهِ ، أَمَّا لَيْلَتُهُ فَلَيْلَةٌ سَارَ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ – إِلَى الْغَارِ فَلَمَّا انْتَهَيَا إِلَيْهِ قَالَ : وَاللَّهِ لَا تَدْخُلُهُ حَتَّى أَدْخُلَ قَبْلَكَ ، فَإِنْ كَانَ فِيهِ شَيْءٌ أَصَابَنِي دُونَكَ ، فَدَخَلَ فَكَسَحَهُ ، وَوَجَدَ فِي جَانِبِهِ ثُقْبًا ، فَشَقَّ إِزَارَهُ ، وَسَدَّهَا لَهُ ، وَبَقِيَ مِنْهَا اثْنَانِ فَأَلْقَمَهُمَا رِجْلَيْهِ ، ثُمَّ قَالَ لِرَسُولِ اللَّهِ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ – : ادْخُلْ ، فَدَخَلَ رَسُولُ اللَّهِ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ – وَوَضَعَ رَأَسَهُ فِي حِجْرِهِ وَنَامَ فَلُدِغَ أَبُو بَكْرٍ فِي رِجْلِهِ مِنَ الْجُحْرِ وَلَمْ يَتَحَرَّكْ مَخَافَةَ أَنْ يُشْبِهَ رَسُولَ اللَّهِ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ – فَسَقَطَتْ دُمُوعُهُ عَلَى وَجْهِ رَسُولِ اللَّهِ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ – فَقَالَ : ( مَالَكَ يَا أَبَا بَكْرٍ ؟ ) قَالَ : لُدِغْتُ ، فِدَاكَ أَبِي وَأُمِّي ، فَتَفِلَ رَسُولُ اللَّهِ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ – فَذَهَبَ مَا يَجِدُهُ ، ثُمَّ انْتَقَضَ عَلَيْهِ ، وَكَانَ سَبَبَ مَوْتِهِ وَأَمَّا يَوْمُهُ ، فَلَمَّا قُبِضَ رَسُولُ اللَّهِ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ – ارْتَدَّتِ الْعَرَبُ وَقَالُوا : لَا نُؤَدِّي زَكَاةً فَقَالَ : لَوْ مَنَعُونِي عِقَالًا لَجَاهَدْتُهُمْ عَلَيْهِ فَقُلْتُ : يَا خَلِيفَةَ رَسُولِ اللَّهِ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ – ! تَأَلَّفِ النَّاسَ وَارْفُقْ بِهِمْ فَقَالَ لِي : أَجَبَّارٌ فِي الْجَاهِلِيَّةِ وَخَوَّارٌ فِي الْإِسْلَامِ ؟ إِنَّهُ قَدِ انْقَطَعَ الْوَحْيُ وَتَمَّ الدِّينُ أَيَنْقُصُ وَأَنَا حَيٌّ ؟ رَوَاهُ رَزِينٌ . (মিশকাত-৬০৩৪)
জগতে এমন কোন উত্তম কাজ নেই, যা হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু সর্বাগ্রে সুসম্পন্ন করেন নাই:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رضي الله عنه قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم : مَنْ أَصْبَحَ مِنْكُمْ الْيَوْمَ صَائِمًا؟ قَالَ أَبُو بَكْرٍ رضي الله عنه :أَنَا. قَالَ: فَمَنْ تَبِعَ مِنْكُمْ الْيَوْمَ جَنَازَةً؟ قَالَ أَبُو بَكْرٍ رضي الله عنه :أَنَا. قَالَ: فَمَنْ أَطْعَمَ مِنْكُمْ الْيَوْمَ مِسْكِينًا؟ قَالَ أَبُو بَكْرٍ رضي الله عنه :أَنَا. قَالَ: فَمَنْ عَادَ مِنْكُمْ الْيَوْمَ مَرِيضًا؟ قَالَ أَبُو بَكْرٍ رضي الله عنه :أَنَا. فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم : مَا اجْتَمَعْنَ فِي امْرِئٍ إِلَّا دَخَلَ الْجَنَّةَ .
একদিন মহানবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সামনে উপস্থিত সাহাবাদের লক্ষ্য করে বললেন, “তোমাদের মধ্যে এমন কে আছ যে আজ রোযা রেখেছ?” হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, “ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমি রোযা রেখেছি।” নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার বললেন, “এমন কে আছ যে, আজ কোন শবাধারের সাথে গমন করে জানাযার নামায পড়েছ?” আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, “এই মাত্র আমি এ কাজ সমাধা করে এখানে এসেছি।” মহানবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কন্ঠ থেকে আবার ঘোষিত হল, “আচ্ছা এমন ব্যক্তি কে আছ যে আজ কোন পীড়িতের সেবা করেছ?” হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, “আজ আমি এক পীড়িত ব্যক্তির সেবা করেছি।” মহানবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবারও বললেন, “আজ কিছু দান করেছ, এমন ব্যক্তি কেউ এই মজলিসে আছ?” সলজ্জভাবে হযরত আবু বকর উত্তরে বললেন, “এক অতিথিকে সামান্য কিছু অর্থ আমি সাহায্য করতে পেরেছি”। অবশেষে বিশ্বনবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: “একদিনে যিনি এতগুলো সৎকাজ করেছেন নিশ্চয়ই তিনি জান্নাতে প্রবেশ করবেন”।{বুখারী হা/৩৬৬১)
এই হাদীস শুনানোর পরবর্তীকালে হযরত উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছিলেন, “সত্যই জগতে এমন কোন উত্তম কাজ নেই, যা আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু সর্বাগ্রে সুসম্পন্ন করেননি।
আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে কখনও কষ্ট দেয়া হয়নি: আবূদ্দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,
عَنْ أَبِي الدَّرْدَاءِ، رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ : كُنْتُ عِنْدَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، إِذْ أَقْبَلَ أَبُو بَكْرٍ آخِذًا بِطَرَفِ ثَوْبِهِ حَتَّى أَبْدَى عَنْ رُكْبَتَيْهِ، فَقَالَ : ” أَمَّا صَاحِبُكُمْ هَذَا فَقَدْ غَامَرَ ” . فَسَلَّمَ فَقَالَ : إِنَّهُ كَانَ بَيْنِي وَبَيْنَ ابْنِ الْخَطَّابِ شَيْءٌ فَأَسْرَفْتُ عَلَيْهِ ثُمَّ نَدِمْتُ فَسَأَلْتُهُ أَنْ يَغْفِرَ لِي فَأَبَى عَلَيَّ وَتَحَرَّزَ مِنِّي بِدَارِهِ فَأَقْبَلْتُ إِلَيْكَ فَقَالَ : يَغْفِرُ اللَّهُ لَكَ يَا أَبَا بَكْرٍ، ثَلاثًا، ثُمَّ إِنَّ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ نَدِمَ فَأَتَى مَنْزِلَ أَبِي بَكْرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ فَسَأَلَ، أَثَمَّ أَبُو بَكْرٍ قَالُوا : لا، فَأَقْبَلَ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَجَعَلَ وَجْهُ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَتَمَعَّرُ حَتَّى أَشْفَقَ أَبُو بَكْرٍ، فَجَثَا عَلَى رُكْبَتَيْهِ، فَقَالَ أَبُو بَكْرٍ لِرَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : أَنَا وَاللَّهِ كُنْتُ أَظْلَمَ مَرَّتَيْنِ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ” أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ اللَّهَ بَعَثَنِي إِلَيْكُمْ فَقُلْتُمْ : كَذَبْتَ، وَقَالَ أَبُو بَكْرٍ : صَدَقْتَ، وَوَاسَانِي بِنَفْسِهِ وَمَالِهِ، فَهَلْ أَنْتُمْ تَارِكُونَ لِي صَاحِبِي ” . مَرَّتَيْنِ، فَمَا أُوذِيَ بَعْدَهَا .
আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উপবিষ্ট ছিলাম। এমন সময় আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু পরনের কাপড়ের একপাশ এমনভাবে ধরে আসলেন যে, তার দু’হাঁটু বেরিয়ে পড়ছিল। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমাদের এ সাথী এই মাত্র কারো সঙ্গে ঝগড়া করে আসছে। তিনি সালাম করলেন এবং বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার এবং ওমর ইবনুল খাত্ত্বাবের মাঝে একটি বিষয়ে কিছু কথা কাটাকাটি হয়ে গেছে। আমিই প্রথমে কটু কথা বলেছি। অতঃপর লজ্জিত হয়ে তার কাছে মাফ চেয়েছি। কিন্তু তিনি আমাকে মাফ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এখন আমি আপনার নিকট হাযির হয়েছি। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহ্ তোমাকে মাফ করবেন, হে আবূ বকর! এ কথাটি তিনি তিনবার বললেন। অতঃপর ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর বাড়িতে এসে জিজ্ঞেস করলেন, আবূ বকর কি বাড়িতে আছেন? তারা বলল, না। তখন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে চলে এসে সালাম দিলেন। (তাকে দেখে) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ভীত হয়ে নতজানু হয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমিই প্রথমে অন্যায় করেছি। এ কথাটি তিনি দু’বার বললেন। তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন, আল্লাহ্ যখন আমাকে তোমাদের নিকট রাসূলরূপে প্রেরণ করেছেন তখন তোমরা সবাই বলেছ, তুমি মিথ্যা বলছ আর আবূ বকর বলেছে, আপনি সত্য বলছেন। তার জান-মাল সবকিছু দিয়ে আমাকে সহানুভূতি জানিয়েছে। তোমরা কি আমার সম্মানে আমার সাথীকে অব্যাহতি দিবে? একথাটি তিনি দু’বার বললেন। অতঃপর আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে আর কখনও কষ্ট দেয়া হয়নি। {বুখারী হা/৩৬৬১ ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছাহাবীদের ফযীলত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৫}
এরূপ আরো বহু হাদীছ শরীফ-এ নূরে মুজাসসাম, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আফদ্বালুন নাস বা’দাল আম্বিয়া হযরত সিদ্দীক্বে আকবর (র)’র ফাযায়িল-ফযীলত বর্ণনা করেছেন।