আল্লাহ তায়ালা শুধু হযরত আদম আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন
এই ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
আর-রহমান ৫৫:১৪
خَلَقَ ٱلْإِنسَٰنَ مِن صَلْصَٰلٍ كَٱلْفَخَّارِ
মানুষকে (আদমকে) তিনি সৃষ্টি করেছেন পোড়া মাটির মত শুষ্ক মাটি থেকে। [১]
[১] صَلْصَالٍ শুকনো মাটি যাতে শব্দ হয়। فَخَّارٌ আগুনে পোড়ানো মাটি যাকে খোলামকুচি বলে। এখানে মানুষ বলতে আদম (আঃ)-কে বুঝানো হয়েছে। যাঁর প্রথমে মাটি থেকে (মানুষের) আকার তৈরী করা হয়। অতঃপর আল্লাহ তাতে ‘রূহ’ ফুঁকেন (আত্মাদান করেন)। তারপর আদম (আঃ)-এর বাম পাঁজরের হাড় থেকে হাওয়াকে সৃষ্টি করেন এবং এর পর থেকে তাঁদের উভয়ের মাধ্যমে মানুষ সৃষ্টির ধারাবাহিকতা চলতে থাকে।
আস-সিজদাহ ৩২:৭
ٱلَّذِىٓ أَحْسَنَ كُلَّ شَىْءٍ خَلَقَهُۥۖ وَبَدَأَ خَلْقَ ٱلْإِنسَٰنِ مِن طِينٍ
যিনি তাঁর প্রত্যেকটি সৃষ্টিকে উত্তমরূপে সৃজন করেছেন[১] এবং মাটি হতে মানব-সৃষ্টির সূচনা করেছেন।[২]
[১] অর্থাৎ, যা কিছু আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন, তা যেহেতু আল্লাহর হিকমত ও ইচ্ছা অনুযায়ী সেহেতু প্রতিটি বস্তুতেই এক বিশেষ সৌন্দর্য ও উৎকৃষ্টতা আছে। বলা বাহুল্য, তাঁর সৃষ্টির সকল জিনিসই সুন্দর। অনেকে أَحسَنَ শব্দটিকে أَتقَنَ ও أحكَمَ এর অর্থে ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ তিনি যাবতীয় বস্তুকে সুনিপুণ ও মজবুত করে সৃষ্টি করেছেন। অনেকে তাকে أَلهَمَ এর অর্থে মনে করেছেন। অর্থাৎ যাবতীয় সৃষ্টিকে তার প্রয়োজনীয় জিনিসের ইলহাম (জ্ঞানসঞ্চার) করেছেন।
[২] অর্থাৎ, সর্বপ্রথম মানুষ আদম (আঃ)-কে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন যাঁর নিকট থেকে মানব জন্মের সূচনা হয়েছে এবং তাঁর স্ত্রী হাওয়াকে তাঁর বাম পার্শেবর অস্থি থেকে সৃষ্টি করেছেন; তা হাদীস দ্বারা বুঝা যায়।
আল-হিজ্র ১৫:২৬
وَلَقَدْ خَلَقْنَا ٱلْإِنسَٰنَ مِن صَلْصَٰلٍ مِّنْ حَمَإٍ مَّسْنُونٍ
নিশ্চয় আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি কালো পচা শুষ্ক ঠনঠনে মাটি হতে।[১]
[১] মাটির বিভিন্ন অবস্থার কারণে বিভিন্ন নামে নামকরণ হয়ে থাকে। শুকনো মাটিকে تراب, ভিজে মাটিকে طين, দুর্গন্ধযুক্ত পচা কাদা মাটিকে حمأ مسنون বলা হয়। যেমন তা শুকিয়ে গিয়ে তা থেকে ঠনঠন্ শব্দ বের হলে তাকে صلصال এবং আগুনে পোড়ালে فخَّار বলা হয়। এখানে মহান আল্লাহ মানুষের সৃষ্টির কথা যেভাবে বর্ণনা করেছেন তাতে মনে হয় যে, আদমের দেহ প্রথমে দুর্গন্ধযুক্ত কাদামাটি দিয়ে তৈরী করেছিলেন এবং যখন তা শুকিয়ে তা থেকে ঠনঠন্ শব্দ বের হতে শুরু করল, তখন তার মধ্যে জীবন দান করেছিলেন। এই صلصال কে কুরআনের অন্যত্র كالفخّار বলা হয়েছে।<> (সূরা রাহমান ৫৫:১৪ আয়াত)
আস-সাফফাত ৩৭:১১
فَٱسْتَفْتِهِمْ أَهُمْ أَشَدُّ خَلْقًا أَم مَّنْ خَلَقْنَآۚ إِنَّا خَلَقْنَٰهُم مِّن طِينٍ لَّازِبٍۭ
অবিশ্বাসীদেরকে জিজ্ঞাসা কর, ওদেরকে সৃষ্টি করা কঠিনতর, নাকি আমি অবশিষ্ট যা কিছু সৃষ্টি করেছি তা সৃষ্টি করা কঠিনতর? [১] ওদেরকে আমি আঠাল মাটি হতে সৃষ্টি করেছি। [২]
[১] অর্থাৎ, আমি যে পৃথিবী, ফিরিশতা এবং আকাশের মত বস্তু সৃষ্টি করেছি যা আকার ও আয়তনের দিক দিয়ে একেবারে অসাধারণ। সুতরাং মানুষ সৃষ্টি করা এবং মৃত্যুর পর তাদেরকে পুনর্জীবিত করা, সেই সকল বস্তু সৃষ্টি করার চাইতেও বেশী শক্ত ও কষ্টকর? কক্ষনই না।
[২] অর্থাৎ, তাদের আদি পিতা আদম (আঃ)-কে তো আমি মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি। উদ্দেশ্য এই যে মানুষ পরকালের জীবনকে এত অসম্ভব ভাবছে কেন অথচ তারা একটি অতি নগণ্য ও দুর্বল বস্তু থেকে সৃষ্টি হয়েছে? অথচ সৃষ্টির দিক দিয়ে তাদের থেকে সবল, বিশাল ও মজবুত বস্তুর সৃষ্টি হওয়ার কথা তারা অস্বীকার করে না। <>(ফাতহুল ক্বাদীর)
সাদ ৩৮:৭৬
قَالَ أَنَا۠ خَيْرٌ مِّنْهُۖ خَلَقْتَنِى مِن نَّارٍ وَخَلَقْتَهُۥ مِن طِينٍ
সে বলল, ‘আমি আদম হতে শ্রেষ্ঠ। তুমি আমাকে আগুন হতে সৃষ্টি করেছ, আর ওকে সৃষ্টি করেছ কাদামাটি হতে।’ [১]
[১] অর্থাৎ, শয়তান তার বিকৃত মস্তিষ্কে এই ধারণা করেছিল যে, তার সৃষ্টির মূল উপাদান আগুন আদমের সৃষ্টির মূল উপাদান মাটির চেয়ে শ্রেষ্ঠ। অথচ আগুন, মাটি ইত্যাদি সব একই শ্রেণীর উপাদান ও কাছাকাছি প্রায় সমপর্যায়ের বস্তু। এই সব বস্তুকে এক অপরের উপর তখনই প্রাধান্য দেওয়া যাবে, যখন বহিরাগত কোন অতিরিক্ত কারণ পাওয়া যাবে। আর এই বহিরাগত কারণ আগুনের পরিবর্তে মাটিই অর্জন করেছে। তা এইভাবে যে, আল্লাহ তাআলা মাটি থেকেই আদম (আঃ)-কে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন এবং তাতে আপন রূহ ফুঁকেছেন। এই দিক দিয়ে মাটিই আগুনের চেয়ে বেশি সম্মান ও মর্যাদা অর্জন করেছে। এ ছাড়াও আগুনের কাজ হল পুড়িয়ে নষ্ট করে দেওয়া, আর মাটি হল তার বিপরীত; বিভিন্ন বস্তুর উৎপাদন ক্ষেত্র।
আল-হাজ্জ ২২:৫
يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِن كُنتُمْ فِى رَيْبٍ مِّنَ ٱلْبَعْثِ فَإِنَّا خَلَقْنَٰكُم مِّن تُرَابٍ ثُمَّ مِن نُّطْفَةٍ ثُمَّ مِنْ عَلَقَةٍ ثُمَّ مِن مُّضْغَةٍ مُّخَلَّقَةٍ وَغَيْرِ مُخَلَّقَةٍ لِّنُبَيِّنَ لَكُمْۚ وَنُقِرُّ فِى ٱلْأَرْحَامِ مَا نَشَآءُ إِلَىٰٓ أَجَلٍ مُّسَمًّى ثُمَّ نُخْرِجُكُمْ طِفْلًا ثُمَّ لِتَبْلُغُوٓا۟ أَشُدَّكُمْۖ وَمِنكُم مَّن يُتَوَفَّىٰ وَمِنكُم مَّن يُرَدُّ إِلَىٰٓ أَرْذَلِ ٱلْعُمُرِ لِكَيْلَا يَعْلَمَ مِنۢ بَعْدِ عِلْمٍ شَيْـًٔاۚ وَتَرَى ٱلْأَرْضَ هَامِدَةً فَإِذَآ أَنزَلْنَا عَلَيْهَا ٱلْمَآءَ ٱهْتَزَّتْ وَرَبَتْ وَأَنۢبَتَتْ مِن كُلِّ زَوْجٍۭ بَهِيجٍ
হে মানুষ! পুনরুত্থান সম্পর্কে যদি তোমরা সন্দেহে থাক তবে অনুধাবন কর—আমরা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি [১] মাটি হতে [২] , তারপর শুক্র [৩] হতে , তারপর ‘আলাকাহ’ [৪] হতে, তারপর পূর্ণাকৃতি অথবা অপূর্ণাকৃতি গোশতপিণ্ড হতে [৫]— যাতে আমরা বিষয়টি তোমাদের কাছে সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ করি। আর আমরা যা ইচ্ছে তা এক নির্দিষ্ট কালের জন্য মাতৃগর্ভ স্থিত রাখি , তারপর আমরা তোমাদেরকে শিশুরূপে বের করি [৬], পরে যাতে তোমরা পরিণত বয়সে উপনীত হও [৭]। তোমাদের মধ্যে কারো কারো মৃত্যু ঘটান হয় এবং তোমাদের মধ্যে কাউকে কাউকে হিন্তম বয়সে [৮] প্রত্যাবৃত্ত করা হয় যার ফলে সে জানার পরেও যেন কিছুই (আর) জানে না। আর আপনি ভূমিকে দেখুন শুস্ক, অতঃপর তাতে আমরা পানি বর্ষণ করলে তা আন্দোলিত ও স্ফীত হয় এবং উদগত করে সব ধরনের সুদৃশ্য উদ্ভিদ [৯];
[১] আয়াতটিকে আল্লাহ তা’আলা পুনরুত্থানের উপর প্রথম প্রমাণ হিসেবে পেশ করেছেন। প্রথম সৃষ্টি যার পক্ষে করা সম্ভব তাঁর পক্ষে দ্বিতীয় সৃষ্টি কিভাবে কঠিন হবে? প্রথম সৃষ্টিই প্রমাণ করছে যে, তিনি দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করতে সক্ষম। [ইবন কাসীর] আয়াতে মাতৃগর্ভে মানব সৃষ্টির বিভিন্ন স্তর বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ বলেনঃ মানুষের বীর্য চল্লিশ দিন পর্যন্ত গর্ভাশয়ে সঞ্চিত থাকে। চল্লিশ দিন পর তা জমাট রক্তে পরিণত হয়। এরপর আরো চল্লিশ দিন অতিবাহিত হলে তা মাংসপিণ্ড হয়ে যায়। অতঃপর আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে একজন ফিরিশতা প্রেরিত হয়। সে তাতে রূহ ফুঁকে দেয়। এ সময়েই তার সম্পর্কে চারটি বিষয় লিখে দেয়া হয়ঃ [১] তার বয়স কত হবে, [২] সে কি পরিমাণ রিযিক পাবে, [৩] সে কি কি কাজ করবে এবং [৪] পরিণামে সে ভাগ্যবান হবে, না হতভাগা হবে। [বুখারীঃ ২৯৬৯, মুসলিমঃ ২৬৪৩]
[২] এর অর্থ হচ্ছে মানুষ নামের প্রজাতির সূচনা হয়েছে আদম আলাইহিস সালাম থেকে। তাঁকে সরাসরি মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং তারপর পরবর্তী পর্যায়ে শুক্র থেকেই মানব বংশের ধারাবাহিকতা চলতে থাকে। যেমন অন্যত্র বলা হয়েছেঃ “মানুষের সৃষ্টি শুরু করেন মাটি থেকে তারপর তার বংশ-ধারা চালান একটি নির্যাস থেকে যা বের হয় তুচ্ছ পানির আকারে।” [সূরা আস সাজদাহ, ৭-৮]