আদম (আঃ) এর সৃষ্টি কাহিনী
আল্লাহ তা’আলা আদম (আঃ) এর সৃষ্টির ঘোষণা দেন এভাবে : “আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করব। তখন তারা (ফিরিস্তাগণ) বললো ঃ আপনি কি জমিনে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন, যারা সেখানে অশান্তি এবং রক্তপাত করে বেড়াবে? এবং আমরাইতো আপনার প্রশংসা করে বেড়াচ্ছি। আর আপনার পবিত্রতারই ঘোষণা দিয়ে চলেছি। আল্লাহ বললেন : তোমরা যা কিছু জাননা, সেসব কিছু আমি অবশ্যই জানি।” (সূরাঃ বাকারা-৩০)
আল্লাহ তা’আলা উপরিউক্ত ঘোষণা দান করে আদম (আঃ) কে সৃষ্টি করার আয়োজন করলেন। আয়োজন দেখে ফিরিস্তাগণ ভাবলেন, তাদের মত উন্নত সৃষ্টি সম্ভব নয়। এ সম্পর্কে ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ “তখন ফিরিস্তাগণ বলেছিলেনঃ আমাদের চাইতে বেশি মর্যাদাপূর্ণ ও জ্ঞানবান মাখলূক সৃষ্ট হওয়া অসম্ভব।”
সূরা বাকারার ৩৪নং আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় : কিন্তু আল্লাহ তাঁর নিজ সিদ্ধান্তে আদম (আঃ) কে সৃষ্টি করার জন্য মাটি আনতে প্রথমে জিবরাঈল (আঃ) কে পাঠালেন। জিবরাঈল (আঃ) মাটি আনার জন্য পৃথিবীতে এলে পৃথিবীর মাটি বললঃ “আপনি আমার কিছু অংশ নিয়ে কমিয়ে দেবেন-এটা থেকে আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই।” একথা শুনে জিবরাঈল (আঃ) ফিরে আসলেন । আল্লাহ তা’আলা তখন মরণের ফিরিস্তা আজরাঈল (আঃ) কে পাঠালেন। আজরাঈল (আঃ) এসে মাটি চাইলে জমিন ঐ একই কথা বলল। আজরাঈল বললেনঃ “আল্লাহর আদেশ পালন না করে ফিরে যাব; এটা থেকে আমি আল্লাহর আশ্রয় চাই।”
একথা বলে আজরাঈল (আঃ) জমিন থেকে এক মুট মাটি নিয়ে গেলেন। সে মাটির রং ছিল কিছু লাল কিছু সাদা আর কিছু কালো । একারণে মানুষের রংও বিভিন্ন হয়েছে। কেউ সাদা, কেউ কালো, কেউ লাল । (ইবনু কাসীর হাদীসটি বর্ণনা করে বলেন যে, এ হাদীসে বাণী ইসরাঈলীদের কথা মিশেছে। সুতরাং প্রকৃত সত্য সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা ভাল জানেন ।)
আদম (আঃ) কে সৃষ্টি করার জন্য পৃথিবী থেকে মাটি তুলে আনা হল। সে মাটির ছিল খুবই নরম আর মসৃণ। সে মাটি ছিল অত্যন্ত উন্নত মানের। মাটির খামির করা হয়। আল্লাহ তা’আলা তাঁর পবিত্র হাতে আদম (আঃ)-এর দেহ মুবারাক গড়ে তুললেন। আদমকে (আঃ) দেহ গড়ার পর ৪০ দিন পর্যন্ত রেখে দেয়া হয়েছিল। এ সময় ইবলীস এসে আদম (আঃ) এর দেহে লাথি মেরে দেখতো আর ভাবতো দেহটা ফাঁপা এবং বাজে জিনিস ।
এমনকি সে অন্যদেরকে বলতো যে, এটা কোন কাজের জিনিস না। সে আদম (আঃ)-এর দেহের ভেতর ঢুকে দেখতো এবং বেরিয়ে আসতো। তারপর আদম (আঃ)-এর দেহের ভেতর ঢুকে দেখতো এবং বেরিয়ে আসতো। তারপর আদম (আঃ) সম্পর্কে খুব বিশ্রী মন্তব্য করত। সে বলতোঃ “আমি এর উপর বিজয়ী হলে একে ধ্বংস করে দেব। এর শাসন পরিচালনার দায়িত্ব আমার উপর দিতে চাইলে আমি সে দায়িত্ব নেব না।”
৪০ দিন পর আল্লাহ তা’আলা আদম (আঃ)-এর দেহে রূপ ভরে দিলেন। রূহ তার দেহে ঢুকবার পর এগোতে লাগল । যত দূর এগিয়ে গেল ততদূর রক্ত-মাংসে ভরে যেতে থাকলো । রূহ নাভী পর্যন্ত পৌঁছার পর আদম (আঃ) তার নিজের শরীর দেখলেন এবং খুশী হলেন। খুশী হয়েই তিনি উঠে বসার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তখনো দেহের নিম্নাংশে রূহ পৌঁছেনি বলে তিনি বসতে পারলনে না।
আদম (আঃ)-এর তাড়াহুড়া সম্পর্কে আল্লাহ বললেন : “মানুষকে অধৈর্য ও তাড়াহুড়া থেকে বানানো হয়েছে।” অর্থাৎ মানুষের স্বভাবে আগ পিছ না ভেবে আকাংঙ্খা পূরণের চেষ্টা করার একটা প্রবণতা রয়েছে। এ কারণে খুশী বা দুঃখ, কোন একটি অবস্থাতেই মানুষ পুরোপুরি ধৈর্যশীল নয় । একটু পরেই আদম (আঃ)-এর দেহের সব অংশ রূপ পৌঁছে গিয়ে রক্ত মাংস গড়ে উঠল। সাথে সাথে তিনি হাঁচি দিলেন। হাঁচি দিয়েই বললেন : “আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন,” আল্লাহ তা’আলা তাঁর এর জবাবে বললেন : “ইয়ারহামুকাল্লাহ।” অর্থাৎ আল্লাহ তোমার প্রতি সদয় থাকুন । (ইবনু কাসীর)
সূরা বাকারার ৩০নং আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় : এরপর আল্লাহ তা’আলা আদম (আঃ) কে যাবতীয় কিছুর নাম শিক্ষা দেন। এর ফলে ফিরিস্তাগণের ধারণার চাইতে উত্তম মাখলুক হিসাবে আদম (আঃ)-এর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। তাফসীরকারকগণ বলেন : আদম (আঃ) এর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয় এমন বিদ্যা দ্বারা যার জ্ঞান ফিরিস্তাগণের ছিলনা । আল্লাহ তাঁকে আল্লাহর সকল সৃষ্টির নাম শিক্ষা দেন।
এমনকি তিনি তাঁকে ঘোড়া গাধার নাম, ব্যবহার্য জিনিষের নাম আর ফিরিস্তাগণের নামও আলাদা আলাদা করে শিক্ষা দেন। এর ফলে আদম (আঃ) কে যখন সকল সৃষ্টির নাম বলার আদেশ দেয়া হ’ল তখন তিনি সবই বলতে পারলেন; এমনকি তিনি ফিরিস্তাগণকে এভাবে বলতে পারলেন, আপনি জিবরাঈল, আপনি মীকাঈল, আপনি ইসরাফীল, আপনি আজরাঈল….। অর্থাৎ আল্লাহ তাঁকে নাম জানানোর সাথে সাথে নামধারীর পরিচয়ও জানান । এভাবে তাঁর শিক্ষা পুরোপুরিভাবে সম্পন্ন হয়েছিল । একটি হাদীসে এরকম বর্ণিত আছে যে, সকল দিনের মধ্যে শুক্রবার দিনটি উত্তম ।
আদম (আঃ)-কে শুক্রবার দিন সৃষ্টি করা হয়েছিল। শুক্রবারে তাকে জান্নাতে নেওয়া হয়েছিল এবং শুক্রবারেই তাঁকে জান্নাত থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। আদম (আঃ) কে সৃষ্টি করার আগে আল্লাহ তা’আলা ফিরিস্তাগণকে বলেনঃ “আমি মানুষকে ঠনঠনে-শুকনো মাটি দিয়ে সৃষ্টি করবো।” (ইবনু কাসীর) এরপর আল্লাহ মানবজাতিকে এ প্রসঙ্গটি কুরআনে এভাবে বলছেন ঃ “আমি যখন আদমকে তৈরি করলাম তখন আমি আদমের দেহের মধ্যে রূহ ফুঁকে দিলাম। (রূহ আদমের দেহে প্রবেশ করার) ফলে আদমের দেহ (রক্ত-মাংসে) জীবন্ত দেহ হয়ে গেল। তখন আমার এই ক্ষমতা দেখেই ফিরিস্তাগণ আদমের সিজদায় পড়ে গেল।” আল্লাহ এরকম করেন এজন্যে যে, এর মাধ্যমে তিনি ফিরিস্তাগণের দ্বারা কুদরতে ইলাহীর স্বীকৃতি আদায় করেন। সিজদা করার আদেশ দ্বারা সৃষ্ট আখলূককে সিজদা করানো হয়নি। বরং প্রকৃত সিজদা আল্লাহকেই করা হয়েছিল।
কেননা, আল্লাহ তাঁর কুদরাতি হাতের দ্বারা চটচটে অস্বচ্ছ মসৃণ মাটিতে তৈরি সৃষ্টির প্রতি সিজদা করার আদেশ দান করেছিলেন যার রূপাকৃতি ছিল মানুষের। আর ঐ দেহাকৃতির স্রষ্টা ছিলেন আল্লাহ নিজেই । তাই আদম (আঃ)-এর দেহকে সিজদা করার তাৎপর্য-আল্লাহর কুদরাতের প্রতি সিজদারত হওয়াই বুঝিয়েছিল। আল্লাহর নির্দেশ পাওয়া মাত্র ফিরিস্তাগণ আদমকে সিজদা করল । শুধু ইবলীস সিজদা করা থেকে বাদ থাকলো । আল্লাহ তাঁর নিজ হাতে আদম (আঃ)-এর দেহের আকৃতিটা বানিয়ে ৪০ দিন রেখে দেন। সূরা মুমিনূন-এ বলা হয়েছে : “ওয়া লাকাদ খালাকনাল ইনসানা মিন সুলালাতিম মিন জ্বীন।” “আমি তো মানুষকে মাটির উপাদান থেকেই সৃষ্টি করেছি।” (সূরাঃ মুমিনূন-১২)
সূরা আ’রাফ এর ১১নং আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় : এতে আদম (আঃ)-এর কথাই বলা হয়েছে। মানুষের মানুষের মূল আদম (আঃ) থেকে। আর আদম (আঃ)-এর মূল মাটি থেকে। এ কারণেই এই আয়াতে মানুষকে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে বলা হ’ল।
আদম (আঃ)-এর সন্তানদেরকে কিন্তু সরাসরি মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়নি। তাঁর সকল সন্তানকে নুৎফা (বীর্য) থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তবে তাদের দেহের উপাদান আদম (আঃ)-এর মতই মাটির। মানুষকে মাটির মানুষ বা মাটির তৈরী মানুষ বলার কারণ-মানুষের আদি পিতা আদম (আঃ)-এর মাটি থেকে সৃষ্টি হওয়া। সেই মূল বা আদিমতম মানুষটি মাধ্যমে বীর্য বা নুৎফা দ্বারা মানুষ সৃষ্টি হওয়ার নিয়মই পৃথিবীতে চালু করা হয়েছে। আর এ নিয়মই রয়েছে। আল্লাহই ভাল জানেন।
পবিত্র কুরআনের সূরা : হামীম সিজদাহ এর ১২ ও ১৩ নং আয়াতে আল্লাহ আদম (আঃ)-এর প্রাথমিক সৃষ্টির খবর দিচ্ছেন যে, তিনি আদম (আঃ) কে যে মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেন সে মাটি কাদা ও বেজে ওঠা মাটি ছিল। তারপর আদম (আঃ)-এর শুক্র হতে তাঁর সন্তানদের সৃষ্টি করা হয়।
সূরাঃ মুমিনূন এর ১২ এবং পরবর্তী আয়াতগুলো থেকে প্রমাণিত হয় : আবু মূসা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তা’আ আদম (আঃ) কে এক মুঠো মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেন ৷ সে মাটি তিনি তাঁর নিজ কুদরাতি হাত দিয়ে জমিন থেকে তুলে নেন। এ কারণে আদম (আঃ)-এর সন্তানদের গায়ের বর্ণ বহু রকম হচ্ছে। তাদের মধ্যে কেউ কালো, কেউ লাল, কেউ সাদা । তাদের মধ্যে পবিত্র চরিত্র এবং অশ্লীলতা মুখী মানুষ রয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় আদম (আঃ)-এর সৃষ্টি মাটি থেকে, অতঃপর তাঁর সন্তানদের সৃষ্টি শুক্র বা বীর্য থেকে। আল্লাহ বলেন : “আমি কি তোমাদেরকে নগণ্য তুচ্ছ পানি (বীর্য) থেকে সৃষ্টি করিনি? তারপর তোমাদেরকে রাখিনি কি একটি নিরাপদ স্থানে? (মাতৃগর্ভে)”
এ কারণেই মানুষের জন্যে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মাতৃগর্ভই বাসস্থান হয়ে থাকে। সেখানে মানুষ বেড়ে উঠতে থাকে এবং শরীর গঠনের পর্যায়গুলো অতিক্রান্ত হতে থাকে। মায়ের গর্ভে পিতার শুক্র এবং মায়ের ডিম্বানু দ্বারা মানুষের সৃষ্টি চলতে থাকে। শুক্র আসে পিতার পীঠের দিক থেকে এবং মায়ের বুকের দিক থেকে। মায়ের গর্ভে সন্তানের জন্ম হওয়ার জন্য উভয়টি মিলিত হয়ে লাল পিণ্ডে পরিণত হয়। লাল পিণ্ডটি একসময় গোশতপিণ্ডে পরিণত হয় । তখন তাতে কোন আকার বা কোন রেখা থাকেনা। তারপর তাতে হাড় তৈরী করে দেয়া হয় । আল্লাহ তা’আলার হুকুমে এসময় এভাবেই মাথা, হাত, পা শিরা, এভৃতি পয়দা লাভ করে। আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত। মানুষের সারা দেহ পঁচে গলে যায়। কেবল মেরুদণ্ডের হাড় অবশিষ্ট থাকে। সে হাড় থেকেই তাকে পুনরায় সৃষ্টি করা হবে।
আল্লাহ এ সম্পর্কে বলেন : “অতঃপর (মায়ের গর্ভে বেড়ে উঠা মানব দেহকে) আমি পাঁজরের হাড় দিয়ে ঢেকে দেই, যাতে তার দেহ গোপন এবং নিরাপদ থাকে। এরপর আল্লাহ দেহে রূহ ফুঁকে দেন। এর ফলে যোগ্যতা আসতে থাকে। তারপর সে জীবন্ত মানুষ হয়ে ওঠে। তার মধ্যে দেখার, শুনার, বোঝার এবং স্থির থাকার শক্তি গড়ে ওঠে। আল্লাহ আদমকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেন। আবার আদমের শুক্র থেকে তাঁরা সন্তাদের সৃষ্টি করেন। এরপর থেকে আদম সন্তানদেরকে শুক্র থেকে সৃষ্টি করার নিয়ম চালু করেছেন। আল্লাহ কতইনা মহান স্রষ্টা!
মায়ের পেটে বিভিন্ন অবস্থা অতিক্রম করে আদম সন্তান অবুঝ ও অক্ষম অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে। তারপর সে ধীরে ধীরে যৌবনে আসে। তারপর সে প্রৌঢ় হয়, বুড়ো হয়। আল্লাহ তার মধ্যে যে রূহ ফুঁকে দেন সেটাকে কেন্দ্র করে সে বেড়ে ওঠে এবং এক সময় বুড়ো হয়। অর্থাৎ আল্লাহর দেয়া রূহকে কেন্দ্র করেই মানুষের যাবতীয় রূপান্তর ঘটে থাকে। আদম (আঃ)-এর সৃষ্টি সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও হাদীসে বহু বর্ণনা আছে। বহু বর্ণনা আদম সন্তানদের জন্ম সম্পর্কেও রয়েছে। ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন : “শুক্র বা বীর্য গর্ভাশয়ে পড়ার পর তা প্রত্যেক চুল ও নখের স্থানে পৌঁছে যায়। এরপর ৪০ দিন কেটে যায়। তখন শুক্র জমাট রক্তের আকার নেয়। ” (ইবনু আবীহাতিম) : তাফসীর ইবনু কাসীর থেকে প্রমাণিত হয় :
আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদের সাথে কথা বলছিলেন। এমনি সময় একজন ইয়াহুদী আসে। তখন কুরাইশ কাফিররা (রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাকে দেখিয়ে) বললঃ এ লোকটি নাবুয়াতের দাবী করছে। তখন ইয়াহুদী লোকটি তাদেরকে বলল : “আমি এ লোকটিকে এমন একটা প্রশ্ন করব, এর উত্তর নাবী ছাড়া কেউ দিতে পারবে না।” একথা বলে লোকটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করল, আচ্ছা বলুন তো, মানুষের জন্ম কি জিনিস থেকে হয়? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : “স্ত্রী ও পুরুষের মিলিত শুক্রের মাধমে। পুরুষের শুক্র মোটা ও গাঢ় হয়। তার থেকে অস্থি ও নিতম্ব গঠিত হয়। স্ত্রীর শুক্র হয় তরল ও পাতলা। তা থেকে গঠিত হয় রক্ত ও গোশত।”
তাঁর এই জবাব শুনে ইয়াহুদী বললো : “আপনি সত্য বলেছেন। পূর্ববর্তী নাবীরাও এটাই বলেছেন।” (মুসনাদ আহমাদ) হুযাইফা ইবনু উসাইদ আল গিফারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, বীর্য মায়ের পেটে ৪০ দিন থাকার পর সেখানে একজন ফিরিস্তা এসে (আল্লাহর নিকট) জানতে চায়, হে আমার প্রতিপালক সে ভাল হবে না মন্দ হবে? নারী হবে, না পুরুষ হবে। তারপর তার সম্পর্কে যা বলা হয়, তা লিখে নেন। এভাবে জিজ্ঞেস করে তার রিযিক, হায়াত, আমাল, বিপদাপদ সব লিখে নেন । তারপর ঐ খাতাপত্র জড়িয়ে নেয়া হয়। ঐ খাতায় কম বেশি করার কোন সুযোগ থাকে না।
হাওয়া (আঃ)-এর সৃষ্টি কাহিনী
সূরা বাকারার ৩০ ও ৩৬নং আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় : মুহাম্মদ ইবনু ইসহাক (রঃ) বলেন, ইবনু আব্বাস (রাঃ)-এর বর্ণনা এই যে, ইবলীসকে ধমক দেয়া হ’ল। তারপর ইবলীসকে যথেষ্ট ভয়ও দেখানো হ’ল । অপর দিকে ইবলীসের চাইতে আদম (আঃ)-এর জ্ঞান ও মর্যাদার বড়ত্বও প্রকাশ করা হয়ে গেল । এই পর্যায়ে আদম (আঃ) এর উপর তন্ত্রা চাপিয়ে দেয়া হ’ল । তার তন্দ্রা অবস্থায় তাঁর বাম পাঁজর থেকে হাওয়া (আঃ) কে সৃষ্টি করা হ’ল । তন্দ্রা কেটে গিয়ে আদম (আঃ) জেগে উঠলেন। জেগেই হাওয়া (আঃ) কে দেখতে পেলেন। তিনি দেখতে পেলেন যে, তারই মত রক্ত মাংসের মানুষ হাওয়া (আঃ) তাই হাওয়ার (আঃ) জন্য তাঁর অন্তরের মমতা জেগে উঠল। এটাই ছিল আদম (আঃ) তথা মানবজাতির অন্তরের জাগানো প্রথম প্রেম-ভালোবাসা।
ইবনু আব্বাস (রাঃ) এ সম্পর্কে বলেন : আদম (আঃ)-এর সিজদা না করে অবাধ্যতা প্রকাশ করায় ইবলীসকে জান্নাত থেকে তাড়িয়ে দেয়া হ’ল এবং আদম (আঃ) কে জান্নাতে থাকতে দেয়া হ’ল। কিন্তু সে সময় তিনি একাকী ছিলেন। তিনি একাকী ছিলেন বলে তার ঘুমের সময় তাঁর পাঁজর থেকে পাওয়া (আঃ) কে সৃষ্টি করা হয়। ঘুম থেকে জেগেই তিনি হাওয়া (আঃ) কে দেখতে পেলেন। তিনি হাওয়া (আঃ) কে প্রশ্ন করলেন, তুমি কে? হাওয়া (আঃ) বললেন, আমি হাওয়া। আমি একজন নারী। আপনার শান্তির সহায়ক হওয়ার জন্যে আমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তখন ফিরিস্তাগণ আদম (আঃ এর নিকট এসে জিজ্ঞাসা করলেন, বলুন, এর নাম কি?
আদম (আঃ) বললেন, এর নাম হাওয়া।
-এই নামের কারণ কি?
একে জীবিত মানুষ থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে বলেই এর নাম হাওয়া হয়েছে। সে সময় আল্লাহ তা’আলা আদম (আঃ) ও হাওয়া (আঃ)-এর বিবাহ বন্ধন করে দেন। আদম ও হাওয়া (আঃ) তখন জান্নাতে ছিলেন। আল্লাহ তাদেরকে ডেকে বললেন ঃ “হে আদম! তুমি আর তোমার স্ত্রী জান্নাতেই বসবাস করতে থাক। জান্নাতের যে জিনিস তোমাদের মন চায় খাও। তোমাদের মন যা চায় পান কর। কিন্তু ঐ গাছের কাছেও যেওনা।” এই বিশেষ গাছটি আদম ও হাওয়া (আঃ) এর জন্যে একটি পরীক্ষা ছিল।
হাওয়া (আঃ) কে সৃষ্টি করা হয়েছিল আদম (আঃ)-এর শান্তি সুখের সহযোগী হিসেবে। ইহা আল্লাহ তা’আলার বিশেষ মেহেরবাণীগুলোরই একটি। কেননা, আল্লাহ তাঁর বান্দা আদম (আঃ) কে সঙ্গীহীন এবং অসুখী দেখতে চাননি। তিনি আদম (আঃ) কে তাঁর নিজের মধ্যে থেকে তাঁরই মত মানব স্বভাবের একজন সঙ্গীনী দান করার ইচ্ছা করেন । সে সঙ্গী যাতে আদম (আঃ)-এর সুখ শান্তি আরাম আনন্দ ও স্বস্তি প্রশান্তির সহায়ক হতে পারে। ঠিক এই দিকগুলোই তাঁর দ্বারা রক্ষা করা হবে। এই বিশেষ উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনীয়তার দিক চিন্তা করেই হাওয়া (আঃ) কে মানুষ বানিয়েও নারী বৈশিষ্ট্য দান করা হয়েছিল।
আদম (আঃ)-এর সৃষ্টি নিয়ে ফেরেস্তাগণের আলোচনা
সূরা বাকারার ৩০নং আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় : আল্লাহ তা’আলা পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধি সৃষ্টি করার কথা বললে ফিরিস্তাগণ আপত্তি করেছিলেন। ফিরিস্তাগণের আপত্তির কারণ ছিল জ্বিন জাতির আচরণ। মানুষের আগে জ্বিনেরা এ পৃথিবীর বাসিন্দা ছিল। তারা মারামারি-কাটাকাটি ও রক্তপাত এত বেশি লিপ্ত ছিল যে, শেষ পর্যন্ত তাদেরকে দমন করার জন্য তাদের সর্দার ইবলীসকে পাঠাতে হয়েছিল। মূলতঃ এ বিষয়টি জানতেন বলেই ফিরিস্তাগণ পৃথিবীর খলীফা প্রসঙ্গে আপত্তি করেছিলেন। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : ঐ সময় ফিরিস্তাগণ আদম (আঃ) এর মানব যোগ্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। তারা বলছিলেন, আমাদের চাইতে বেশি জ্ঞান, আদর্শ ও মর্যাদা সম্পন্ন সৃষ্টি হওয়া সম্ভবপর নয়। তাদের এ কথা শুনে আল্লাহ তাদেরকে পরীক্ষা করেন। এরূপে সকলের উপরই বিভিন্ন রকম পরীক্ষা আপতিত হয়। ইবনু কাসীরে সূরা বাকারার ৩৪নং আয়াতের তাফসীর থেকে প্রমাণিত হয়ঃ সে সময় ফিরিস্তাগণের গোপন কথা ছিল এই যে, আল্লাহ তা’আলা যে মাখলুকই সৃষ্টি করুন না কেন, সে মাখলুক থেকে আমরা বেশি জ্ঞানী এবং মর্যাদাবান হব, এতে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। কিন্তু এরপর প্রমাণিত হল যে, জ্ঞান ও মর্যাদায় আদম (আঃ) তাদের চাইতে অনেক উপরে।
আল্লাহ যখন বললেন ঃ ‘আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি সৃষ্টি করতে চাই” ফিরিস্তাগণ তখন বললেন : “তারা কি পৃথিবীতে অশান্তি মারামারি ও রক্তপাত করবে না?” ফিরিস্তাগণ জ্বিনদের আচরণ দেখেছেন বলেই এমন প্রশ্ন উত্থাপন করেন। অন্যদিকে ফিরিস্তাগণের ধারণা ছিল, তাদের চাইতে উত্তম মাখলুক হতে পারে না। তাই তারা তাদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলেন, আমাদের চাইতে বেশি জ্ঞানবান ও মর্যাদাবান মাখলুক সৃষ্টি করা অসম্ভব । আল্লাহ ফিরিস্তাগণের আপত্তির জবাবে বলেছিলেন : “আমি সেসব কিছুই জানি, যা তোমরা জাননা।” ফিরিস্তিাগণের পক্ষে ‘আল্লাহু আলীমুল’- ‘-এর এই জবাবকে অস্বীকার করার উপায় তো নেই। তাই ফিরিস্তাগণ নিজেদের ভুল স্বীকার করে নিলেন। সর্বশেষে তারা বলতে বাধ্য হলেন : “পবিত্রতা আপনারই, (হে আমাদের রব)। আমরা ঐটুকু ছাড়া কোন কিছুই জানিনা, একমাত্র আপনি যা আমাদের শিখিয়ে দেন।”