নাম ও বংশ পরিচয়ঃ
নাম মুয়াবিয়া। উপনাম আবু আবদুর রহমান। রাসূল (ﷺ) এর স্ত্রী উম্মুল মোমিনিন উম্মে হাবিবা (رضي الله عنه) এর ভাই। পিতা আবু সুফিয়ান। মাতা হিন্দা বিনতে উতবাহ। (আল উমাবিয়ুন বায়নাশ-শিরকে ওয়াল গরাব, ১/ ২৩)।
তাঁর পিতা-মাতা পরবর্তীতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর নিকট ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
জন্মঃ
বিশুদ্ধ মতানুসারে রাসূল (ﷺ) এর জন্মের পাঁচ বছর আগে জন্মলাভ করেন। তার জন্ম হয়েছিল আরবের অভিজাততম গোত্র কোরাইশ বংশের বনু উমাইয়া শাখার একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে। (প্রাগুক্ত, ১/ ২৩)।
শৈশবে তার মধ্যে দুর্জয় সাহস, দৃঢ় মনোবল ও চারিত্রিক আভিজাত্যের আলামত প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছিল। একদিন কিশোর মুয়াবিয়াকে লক্ষ্য করে পিতা আবু সুফিয়ান বলেছিলেন ‘আমার এ ছেলে তার গোত্রের নেতা না হয়েই যায় না। ‘ এটা শুনে মাতা হিন্দা প্রতিবাদ করে বলছিলেন, শুধু কি নিজ গোত্রের? সে যদি গোটা আরবের নেতৃত্ব না দেয়; তাহলে বৃথাই আমার স্তন্যদান। (ইবনে কাসির, ৮/ ১১৮)।
ইসলাম গ্রহণঃ
ইমাম সুয়ুতি (رحمة الله) সহ অনেক ঐতিহাসিকের মতে, মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) ও তার পিতা আবু সুফিয়ান মক্কা বিজয়ের বছর ইসলাম গ্রহণ করেন। (তারিখুল খুলাফাঃ ১৯৪)।
ওয়াকেদি বলেন, হুদায়াবিয়ার সন্ধির পর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তবে বিষয়টি গোপন রেখেছিলেন। পরবর্তী সময়ে মক্কা বিজয়ের সময় প্রকাশ করেছিলেন। (ফাতহুল বারীঃ ৩/ ৪৩৩)।
রাসূল (ﷺ) এর সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণঃ
ইসলাম গ্রহণের পর রাসূলের (ﷺ) সঙ্গে হুনাইন ও তায়েফের যুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধ শেষে রাসূল (ﷺ) তাকে গনিমতের মাল থেকে ১০০ উট ও ৪০ উকিয়া (আউন্স) রুপা দিয়েছিলেন। (মাহমুদ শাকের, আত-তারিখুল ইসলামীঃ ৪/ ৬৯)।
মদিনায় হিজরতঃ
ইসলাম গ্রহণের পর মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) পরিবারের সঙ্গে মদিনায় হিজরত করেন। মুয়াবিয়া ও হুতাত ইবনে ইয়াজিদের (رضي الله عنه) মাঝে রাসূল (ﷺ) ভ্রাতৃত্ব করে দেন। (সিরাতে ইবনে হিশামঃ ২/ ৫৬০)।
হাদিস বর্ণনাঃ তিনি রাসূল (ﷺ) এর ১৬৩ হাদিস বর্ণনা করেছেন। (আল উমাবিয়ুনঃ ৬৮)।
মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) এর সিরিয়ার আমির পদলাভঃ
১৮ হিজরি। এ বছর ‘আমওয়াস’ নামক প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। এতে বহু মুসলিম ব্যক্তিত্ব মৃত্যুবরণ করেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, আবু উবাইদাহ ইবনুল জাররাহ ও ইয়াজিদ ইবনে আবু সুফিয়ান (رضي الله عنه)। এদিকে ইয়াজিদ (رضي الله عنه) অসুস্থতাকালীন স্বীয় ভাই মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) কে দামেস্কে স্থলাভিষিক্ত করেন। অবশেষে ইয়াজিদ (رضي الله عنه) মৃত্যুবরণ করলে খলিফা ওমর (رضي الله عنه) রাষ্ট্রীয়ভাবে মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) কে দামেস্কের ‘আমির’ বানিয়ে দেন। পরবর্তী সময়ে খলিফা ওমর জর্ডান, ফিলিস্তিন ও হিমস অঞ্চলও মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) এর অধীন করে দেন। এভাবে সিরিয়া অঞ্চলের শহরগুলো মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) এর নেতৃত্বাধীন হয়ে যায়। (প্রাগুক্তঃ ৪/ ৬৯)।
⛔ Note : এখানে যে ইয়াজিদের কথা বলা হয়েছে তিনি মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) এর পুত্র ইয়াজিদ নয় মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) এর ভাই। ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া হল পথভ্রষ্ট, বাতিল, অভিশপ্ত। যার সম্পৃক্ততায় ইমাম হোসাইন (আ.) এর বিরোদ্ধে যুদ্ধ হয়েছিল।
দুনিয়া বিমুখতাঃ
মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) দুনিয়াবিমুখ জাহেদ সাহাবিদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। হাম্বলী মাযহাবের ইমাম, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله) স্বীয় সনদে আবু হামালাহ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন, ‘আমি দামেস্ক শহরে মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) কে দেখেছি তালিযুক্ত কাপড় পরে মিম্বরে দাঁড়িয়ে জনসম্মুখে ভাষণ দিচ্ছেন। ‘ (ইমাম আহমদ, আজ-জুহুদঃ ১৭২)।
সহনশীলতাঃ
সহনশীলতা ও ক্ষমার ক্ষেত্রে এক অনুপম উদাহরণ ছিলেন মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)। এক ব্যক্তি হজরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) কে তীব্র নিন্দাকর কিছু কথা শ্রবণ করাল। (তিনি লোকটিকে কিছুই বলেননি)। মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) কে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি তো লোকটিকে পরাভূত করতে পারতেন? তিনি বলেন, আমি কোনো অধীনস্থ লোকের অন্যায়ের কাছে আমার সহনশীলতা সঙ্কীর্ণ হয়ে যাওয়ার বিষয়ে আল্লাহর কাছে লজ্জাবোধ করি। (আল বিদায়া ওয়ান নেহায়াঃ ৮/ ১৪৫)।
মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) এর মর্যাদাঃ
বিভিন্ন হাদিসে রাসূল (ﷺ) মুয়াবিয়ার (رضي الله عنه) জন্য দোয়া করেছেন। প্রশংসা করছেন। বহু সাহাবি, তাবেয়ি তার সুমহান মর্যাদার কথা বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله) তার প্রসিদ্ধ ‘মুসনাদ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘এরবাদ ইবনে সারিয়া (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, আমি রাসূল (ﷺ) কে বলতে শুনেছি, হে আল্লাহ! তুমি মুয়াবিয়াকে কিতাব ও হিসাব শিক্ষা দাও। তুমি তাকে আজাব থেকে রক্ষা করো। (মুসনাদে আহমদঃ ৩৫/ ১৪)।
উম্মে হারাম (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, তিনি রাসূল (ﷺ) কে বলতে শুনেছেন, ‘আমার উম্মতের মধ্যে যে সৈন্য দলটি সর্বপ্রথম নৌ অভিযানে অংশ নেবে তারা নিজেদের জন্য জান্নাত ওয়াজিব করে নিয়েছে। ‘ (ফতহুল বারীঃ ৬/ ১২১৭)।
এটা মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) এর জন্য এক সুমহান মর্যাদার স্বীকৃতি। কেননা, মুসলমানের সর্বপ্রথম নৌ অভিযানটি মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) এর নেতৃত্বে হয়েছিল। (ফতহুল বারিঃ ৬/ ১২০)।
বিখ্যাত সাহাবি আবু দারদা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, ‘আমি কাউকে তোমাদের আমির মুয়াবিয়ার (رضي الله عنه) তুলনায় রাসূল (ﷺ) এর নামাজের অধিকতর সাদৃশ্যপূর্ণ দেখিনি। ‘ (মুসনাদুশ শ্যামেয়িনঃ ২৮৩)।
বর্ণিত আছে, ‘একদা প্রখ্যাত তাবেয়ি আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক (رحمة الله) কে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি মুয়াবিয়া সম্পর্কে কী বলেন? আপনার কাছে কে উত্তম? মুয়াবিয়া নাকি ওমর ইবনে আবদুল আজিজ? তিনি বলেন, নিশ্চয়ই রাসূল (ﷺ) এর সাহাবি মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) এর নাকের ছিদ্রের ধুলা ওমর ইবনে আবদুল আজিজের পুরো জীবনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। (তারিখে দামেস্কঃ ৫৯/ ২১১)।
আল্লামা জালালউদ্দীন রুমী (رحمة الله) বলেন, আমীরে মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) সমস্ত মুমিনগণের মামা…(মসনবী)
স্বয়ং মাওলা আলী শেরে খোদা (رضي الله عنه) বলেন, তোমরা মুয়াবিয়ার শাসনকে ঘৃনা করো না, তোমরা যদি তাকে হারাতে তাহলে দেখতে পেতে মাথাসমূহ ঘাড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঝড়ে পড়ছে। ( আল বিদায়া ওয়ান নেহায়া:৮/ ২৫২).
মৃত্যুর প্রাক্কালে মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) এর অসিয়তঃ
মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) দীর্ঘ ৪০ বছর শাসন পরিচালনায় কাটিয়েছেন। ২০ বছর সিরিয়ার ‘আমির’ হিসেবে (৬৪১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬৬১ পর্যন্ত)। ইমাম হাসান (رضي الله عنه) এর সঙ্গে সন্ধির পর সমগ্র মুসলিম জাহানের ‘খলিফা’ হয়েছিলেন। তা ছিল হিজরি ৪১ সাল থেকে ৬০ পর্যন্ত। ৬৬১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। তিনি তার খিলাফতের শেষ বছরে মৃত্যুবরণ করেন। (প্রাগুক্তঃ ৪২-৪৩; হাশিয়াতুল ইসাবাহঃ ৩/ ৩৯৯)।
মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) সর্বশেষ খুতবায় বলেছিলেন, ‘যে ব্যক্তি চাষ করে, সে ফসল কাটতে পারে। আমি তোমাদের শাসন করেছিলাম। আমার পর আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ কেউ শাসন করবে না। আমার চেয়ে খারাপ ব্যক্তিরা তোমাদের শাসন করবে। যেমনিভাবে আমার পূর্ববর্তী শাসক সিদ্দিকে আকবর, ফারুকে আজম, উসমান গণি, মাওলা আলী আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। ‘
তারপর ইয়াজিদকে সম্বোধন করে বলেন, ইয়াজিদ! আমার সময় যখন ফুরিয়ে যাবে তখন আমাকে গোসল করানোর দায়িত্ব ন্যস্ত করবে কোনো একজন বিজ্ঞ (আলেম) ব্যক্তির ওপর। কেননা, আল্লাহর কাছে আলেমের মর্যাদা রয়েছে। সে যেন আমাকে ভালো করে গোসল দেয় এবং জোরে জোরে তাকবির ধ্বনি দেয়। তারপর তুমি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যাবে। সেখানে আমার রাসূল (ﷺ) এর একখানা জামা মোবারক রয়েছে এবং একটি কাপড়ের বিশেষ টুকরো আছে যাতে আমার রাসূল (ﷺ) এর চুল ও নখ মোবারক আছে। তুমি কাপড়ের টুকরোটির মোবারক বস্তুগুলোকে আমার নাক, মুখ, কান ও চোখে রেখে দেবে এবং জামা মোবারকটি আমার শরীরের সঙ্গে লাগিয়ে দেবে। হে ইয়াজিদ! মাতা-পিতার বিষয়ে আল্লাহর অসিয়ত পূর্ণ করবে। তোমরা যখন আমাকে খেজুর গাছের পালঙ্কে ওঠাবে এবং কবরে রেখে দেবে, তখন সবচেয়ে বড় দয়ালু আল্লাহ তায়ালার কাছে তোমরা আমাকে রেখে দেবে। (ইবনে কাসিরঃ ৮/ ১৪১)।
মৃত্যুঃ
অবশেষে এ মহান সাহাবি ৬০ হিজরির ২২ রজব (মতান্তরে ১৫ রজব) এ নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে পরকালীন পথে যাত্রা করেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। সাহাবী জাহ্হাক ইবনে কায়েস (رضي الله عنه) তার সালাতে জানাজার ইমামতি করেন। তাকে সিরিয়ার ‘বাবুস সগির’ নামক গোরস্তানে সমাহিত করা হয়।
সাহবী সমালোচনা হারাম হারাম। (তিরমিজী-৪২৩৬)
এখন যারা আমীরে মোয়াবিয়া (رضي الله عنه) কে কাফের বলে তাদের কাছে প্রশ্ন:
১/ পুত্র ইয়াজিদের কারণে যদি পিতা মোয়াবিয়া (رضي الله عنه) কাফের হয় তাহলে পুত্র কেনানের কারণে নবী নুহ (আ) কে কি বলবেন?
২/ মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) যদি কাফের হয়, তাহলে ওনার বোন উম্মে হাবিবা (رضي الله عنه) কে নবী (ﷺ) বিয়ে করলেন কেন?
৩/ মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) যদি কাফের হয়, তাহলে কিভাবে ওনি ওহী লেখক হলেন?
৪/ কোন সাহাবী, তাবেয়ী বা ৪ মাজহাবের ইমাম, ৪ তরীকতের ইমাম ওনাকে কাফের ফতোয়া দিয়েছেন?
৫/ মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) যদি কাফের হয়, তবে নবী (ﷺ) ওনার জন্য দোয়া করলেন কেন?
৬/ মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) যদি কাফের হয়, তবে মাওলা আলী (رضي الله عنه) ক্ষমতা নিয়ে কেন ওনার সাথে চুক্তি করলেন?
৭/ মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) যদি কাফের হয়, তাহলে ওনার শাসনামলে আহলে বাইয়াতের পরিবারকে বছরে খরচ বাবদ ৪০ লক্ষ দিরহাম দিতেন কেন? (আল বিদায়া ওয়ান নেহায়া ৮/ ৪০)
৮/ মাওলা আলী (رضي الله عنه)’র বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মোয়াবিয়া যদি কাফের হয় তাহলে উষ্টির যুদ্ধে মা আয়েশা সিদ্দিকা (رضي الله عنه) এবং বেহেশতের ঠিকেট পাওয়া হযরত জোবায়ের মাওলা আলীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, তাদের ব্যাপারে কি ফতোয়া দিবেন?
৯/ মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) যদি কাফের হয়, তাহলে হযরত উমর (رضي الله عنه) কিভাবে ওনাকে সিরিয়ার ওয়ালি বানালেন..?..কোন কাফের কি মুসলমানের ওয়ালি হতে পারে..?..নাকি হযরত উমর (رضي الله عنه) কাছে কোরআনের জ্ঞান কম ছিল..?
১০/ ইমামে আযম আবু হানিফা (رحمة الله), বড়পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (رحمة الله), দাতা গঞ্জেবখ্শ লাহোরী (رحمة الله), আল্লামা জালালউদ্দীন রুমী (رحمة الله), মোজাদ্দেদ আলফে সানী (رحمة الله) কেন আমীরে মুয়াবিয়াকে সাহাবী হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন? ওনারা আপনাদের চেয়ে কোরআন-হাদীস কম বুঝেছিলেন নাকি আপনারা ওনাদের চেয়ে বেশি বুঝেন?..