স্রষ্টা ও সৃষ্টির সম্পর্ক

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

অতিশয় জড়বাদীরা স্রষ্টাকে নিয়ে কল্পনা করাকে মহাপাপ ও অন্যায় বলে মনে করে। তাদের মতে স্রষ্টা স্রষ্টাই, আর সৃষ্টি সৃষ্টিই। স্রষ্টা আর সৃষ্টির দূরত্ব হাজার হাজার কোটি কোটি বছরের পথ। সুতরাং তাঁকে নিয়ে ভাবা বা তাঁকে পাওয়ার কল্পনা করা তাদের কাছে মহাপাপ বলে বিবেচিত। তাদের মতে, স্রষ্টা মহাশাসক ও বিচারক। তাই তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব, কর্তৃত্ব ও আধিপত্য বিস্তারে তিনি ব্যাপৃত। এ উদ্দেশ্যেই তাঁর জারি করা আদেশগুলো ও আনুগত্যের স্বীকৃতিদানের জন্য ইবাদতের বাধ্যবাধকতা দিয়েছেন মানব জাতিকে এবং শুভ-অশুভ কর্মের ফলাফলের শেষ পরিণতি ও গন্তব্য সম্বন্ধে নির্ধারণ করেছেন স্বর্গ-নরককে।
কিন্তু আত্মবাদী দার্শনিক ও মহামনীষীগণের দৃষ্টিতে বিষয়টা ভিন্নতর। তাঁদের মতে, স্রষ্টা সৃষ্টির প্রাণ। মানবদেহের সঙ্গে প্রাণের যে সম্পর্ক, স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির সে সম্পর্ক। মহান স্রষ্টা দাম্ভিক বা স্বৈরাচার নন, বরং প্রেমিক। তিনি মানবজাতির নাম দিয়েছেন ইনসান বা উনসুন। যার অর্থ প্রেম, সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধন। দৈব বাণীতে বলা হয়েছে_’মানুষ আমার রহস্য, আর আমার রহস্যাবৃত করে মানব সৃষ্টি করেছি।’ তাই তাঁর উদ্দেশ্য সৃষ্টিকে নিয়ে প্রেম খেলা খেলতে ও ভাবের আদান-প্রদান করতে। আর এ ইবাদত-বন্দেগি নিছক দরকষাকষি নয়, বরং এর মধ্য দিয়ে আল্লাহর সঙ্গে যোগসূত্র ও ভাবের আদান-প্রদানের পথ অবমুক্ত করা। মূলত স্রষ্টা ও সৃষ্টির সম্পর্ক গভীরতম, মা-বাবা, ছেলে-সন্তানদের চেয়েও নিকটতম। সন্তানদের কাছ থেকে মা-বাবা ডাক যেমন তাদের প্রাণের দাবি ও জন্মসূত্রের অধিকার, মহান স্রষ্টা হিসেবে সৃষ্টির ডাক-হাঁক তেমনি তাঁর প্রাণের দাবি ও সৃষ্টিসূত্রের অধিকার। মা-বাবার সঙ্গে সন্তানদের সম্পর্ক রক্ত-মাংসের, আর স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির সম্পর্ক আ@ি@@@ক বা পরমা@ি@@@ক। আর এর বাস্তবতা উপলব্ধি করার জন্যই মানুষের প্রতি আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগির আদেশ। তবে হে লোকসকল, তোমরা নিজেকে নিয়ে ভেবে দেখেছো কি কোনো দিন কিংবা স্রষ্টাকে নিয়ে? কে তুমি, আর স্রষ্টা কে? তিনি তো বলেছিলেন, ‘তোমরা তোমাদের সত্তাকে চিনলে চিনতে পারবে আমাকে। একসময় তিনি ছাড়া আর কোনো সৃষ্টির অস্তিত্ব ছিল না। সুতরাং সৃষ্টিলীলা তো স্রষ্টারই অস্তিত্ববিশেষ। মহান আল্লাহ তাঁর প্রেমলীলা দিয়ে জগৎ সৃষ্টি করে মায়া-মমতা, সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ।
তা ছাড়া মানুষ তো শ্রেষ্ঠ সবার। তার মধ্যে দেওয়া হয়েছে আল্লাহর আদেশ। তিনি বলেন, ‘আমার আদেশ ও জ্ঞান তোমাদের মধ্যে ফুৎকার করে দিলাম।’ এ জন্যই মানুষ তাঁর প্রতিনিধি। মানুষ অশরীরী ও ফেরেশতাদের চেয়েও ওপরে। কারণ মানুষের মধ্যে আছে আল্লাহর শক্তি, গুণ-গরিমা, সৃজনশীলতা, নবতর আবিষ্কার ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা; কিন্তু (অশরীরী) ফেরেশতাদের তা নেই। তাঁরা শুধু আল্লাহর হুকুমবরদার ও অনুদাস। আর মানুষের জন্য রয়েছে নভোমণ্ডল-ভূমণ্ডল, পাহাড়, সাগর ও অন্তরীক্ষের ব্যাপক প্রভাব। কিন্তু অশরীরী রয়েছেন মানব কল্যাণের নিমিত্তে অতন্দ্র প্রহরীরূপে। এবার ভেবে দেখেছো কি তুমি কে? অতএব হে লোকসকল, আবেগঘন উল্লাসের উন্মাদনায় জাগতিক মোহজালে আটকে সময় কাটিও না। সময় পেরিয়ে যায় নিজেকে নিয়ে ভাবার, কে তুমি? আর তোমার পরমাত্মা ও পরম স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্ক কী? তোমাকে তো জ্ঞানালোক দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে নিজেকে চেনার, পরম স্রষ্টাকে জানার ও বিশ্বজগৎকে উপলব্ধি করার শক্তি দিয়ে। অতঃপর আল্লাহর একক সত্তা, বিশালত্ব শক্তি ও গুণ-গরিমার সম্বন্ধে অবগত হয়ে তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হওয়ার মধ্যেই রয়েছে তোমার আত্মসত্তার স্বীকৃতি দান। কারণ তুমি তো ঘুণেধরা কেউ নও, তাঁরই সত্তায় সত্তাবান এক শ্রেষ্ঠ প্রজাতি। হে মানুষ, তুমি যদি আল্লাহর প্রশংসা করতে পারো, তবে সে প্রশংসা ধেয়ে আসবে তোমার দিকে। জ্ঞানের চক্ষু খুলে দেখো_যে পুত্র পিতার প্রশংসা করে, সে প্রশংসায় প্রশংসিত হয় একসময় পুত্র নিজেই। কারণ পুত্র তো পিতারই অংশবিশেষ। তেমনি কোনো মানুষ যদি আত্মার পরমাত্মীয়ের প্রশংসা করে, তবে সে প্রশংসায় প্রশংসিত হয় সে নিজেই। অতএব আল্লাহকে স্বৈরাচারী, দাম্ভিক, নিষ্ঠুর কিংবা কঠোর ভেবো না। নিষ্ঠুরতা ও কঠোরতার ঘরে প্রেম নেই, প্রেম জমে বিশ্বাস, ভক্তি, উদারতা ও ভালোবাসা দিয়ে। নিষ্ঠুরতা ও দাম্ভিকতা দিয়ে দূরত্ব বাড়ে। উদার ভালোবাসা দিয়ে প্রেমের মিনার গড়ে।
আগেই বলেছি, স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির সম্পর্ক দেহের সঙ্গে প্রাণের যে সম্পর্ক_স্রষ্টা ও সৃষ্টির সম্পর্কটা তেমনি। অর্থাৎ মানবদেহের প্রাণের সত্তাটাই স্রষ্টার অস্তিত্ব। এ জন্য মানবদেহের কোথাও আঘাত বা আঁচড় লাগলে মনে ব্যথা পায়। আর একটু এগিয়ে বললে_মহান স্রষ্টা যেমন অমর-অবিনশ্বর, মানবাত্মাটাও তেমনি অমর-অবিনশ্বর। সে আল্লাহর সত্তা বলে লয় বা ধ্বংস নেই। শুধু পটপরিবর্তন ও স্থানান্তরিত হয় মাত্র। এভাবে স্থানান্তরিত হয়ে একসময় পেঁৗছে যাবে অনির্বাণ ও মুক্তির পথে। এ জগৎ পরম সুখ ও শান্তির জগৎ, যে জগৎ স্বর্গীয় সুখকে হার মানায়।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment