স্মরণ….মুসলিম উম্মাহ যাঁর কাছে ঋণী : উম্মুল মুমিনিন হযরত সাইয়্যিদা খাদিজাতুল কুবরা (র.)

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

ড. এ. এস. এম. ইউসুফ জিলানী

……………………………………………

উম্মুল মুমিনিন হযরত খাদিজা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) প্রিয় নবী রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর প্রথম স্ত্রী। তিনিই ছিলেন সর্বপ্রথম ইমান আনয়নকারী মুসলমান। তার আগে কোনো পুরুষ বা কোনো মহিলা ইমান আনেন নি। তিনি কুরাইশের শ্রেষ্ঠ গোত্র বনু আসাদ বিন আবদিল ইজ্জা বিন কুসাঈয়ের সাথে সম্পৃক্ত। কুসাঈ পর্যন্ত গিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের বংশধারা এবং হযরত খদিজা (রাদিয়াল্লাহু আনহা)’র বংশধারা এক হয়ে যায়। ফলে বংশধারার দিক থেকেও তিনি ছিলেন একজন অভিজাত মহিলা। শুধু ইসলামি যুগে নয়, জাহেলিয়া যুগেও তিনি তাহিরা উপাধিতে ভূষিত ছিলেন। তাঁর মর্যাদা ও আভিজাত্যের কারণে মক্কাবাসীরা তাঁকে سيدة نساء قريش (কুরাইশের রমণিশ্রেষ্ঠা উপাধি দিয়েছেন)। [তারিখে দামিশ্ক, ৬৬: ১৪, ১: ৩২৭। আল ইসাবা, ৪: ২৮১।]

প্রিয় নবীর বিবাহধীনে আসার পর কুরআন করিমে তাকে উম্মুল মুমিনিন উপাধি দেয়া হয়। [আল আহযাব, ৩৩: ৬।]

প্রিয় নবী রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এক হাদিসে তাঁকে জান্নাতের রমনিকুল শ্রেষ্ঠা উপাধি দিয়েছেন। [আহমদ, আল মুসনাদ, ১: ২৯৩।]

উম্মুল মুমিনিন সাইয়্যিদা খদিজা (র.)’র জন্ম আবরাহা বাদশার বায়তুল্লাহ আক্রমনের পনেরো বছর আগে। অন্যান্য পরিবারের তুলনায় এ পরিবারটি সবদিক বিবেচনায় সম্মানি ও পবিত্র ছিলো। [ইবনে সাদ, আত তাবকাত, ৮: ১৭।]

তাঁর পিতা খুয়ায়লিদ ছিলেন মক্কার একজন প্রসিদ্ধ ও সম্পদশালী ব্যবসায়ী। হস্তিবর্ষের দুই বছর আগে আরব গোত্রীয় সাইফ বিন ইয়াজান ইয়ামানের বাদশাহ আহবাশকে পরাজিত করে ইয়ামেন দখল করেন। তার এ জয়ে আরবরা খুবই খুশি হলো। আর তাকে অভিনন্দন জানানোর জন্য কুরায়েশ থেকে একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করা হয়েছিলো। তাতে প্রিয়নবীর পিতামহ আবদুল মুত্তালিব বিন হাশিমসহ অন্যান্য নেতার সাথে হযরত খাদিজার পিতা খুয়াইলিদ বিন আসাদও ছিলেন। [আল ওয়াফা বেতারিফে ফাযায়েলে মুস্তাফা, ১: ৭৭।]

তার মাতার নাম ফাতিমা বিনতে যায়েদা। তিনিও ছিলেন কুরাইশি। আরবে বংশমর্যাদাকে খুবই গুরুত্ব দেয়া হয়। কুরাইশের বংশ পরম্পরার বিশুদ্ধ ধারাবাহিকতার একবিংশতম পুরুষ হলেন নাযার মাদ বা আদনান। হযরত খাদিজার বংশপরম্পরার একটি অনন্য বৈশিষ্ট হলো-তত পুরুষ পর্যন্ত তাঁর দাদিদের নামও রক্ষিত রয়েছে এবং তার নানীদের নামও।

হযরত খাদিজা ছিলেন জাহেলি যুগের সব ধরণের কুপ্রথা ও নোংরামি থেকে পূত পবিত্র। তাই নবীজির আতœপ্রকাশের পূর্বে খাদিজা তাহিরা (পূতÑপবিত্র) নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন। হযরত খাদিজার নাম তাহিরা ছিলো না বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে এ ব্যবস্থা কার্যকর হয়েছিলো যে, লোকজন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তাঁর নাম তাহিরা রেখে দিয়েছিলো। তারা তাঁকে তাহিরা নামে ডাকতে শুরু করে যেমন রাসূল-এর নাম লোক মুখে আল আমিন প্রচারিত ও বহুল ব্যবহৃত হতে থাকে, যেন নবীজির আমানতদারি ও বিশ্বস্ততার বিষয়টি সর্বমহলে ব্যপ্তি লাভ করে। তাতে কারো কোনো আপত্তির আর অবকাশ না থাকে। এ রকম পরিস্তিতির জন্যই বলা হয়ে থাকে সকলের মুখের ভাষা আল্লাহরই অমোঘ ঘোষণা। যেহেতু হযরত খাদিজা ছিলেন, সে যুগের মরিয়ম। তাই মরিয়ম কে যেমন বলা হয়েছিলো- وطهرك واصطفاك علي نساء العالمين-

তোমাকে পূত পবিত্র অবস্থায় রাখা হয়েছে এবং জগতের নারী সমাজের মাঝে তোমাকে মনোনীত করা হয়েছে। [সূরা আলে ইমরান, ৪২] তেমনি হযরত খাদিজাকেও এ ঘোষণার উল্লেখযোগ্য অংশ আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদান করা হয়েছে।তাই তিনি তাহিরা নামে খ্যাতি লাভ করেছেন। যিনি এমনি পূত-পবিত্র যাকে আল্লাহর পক্ষ হতে পূত-পবিত্র রাখা হয়েছে তাহিরা নামে যিনি খ্যাত হয়েছেন তিনি এমন কোনো ব্যক্তির প্রতিই অনুরক্ত হবেন যিনি তার মতোই তাহিরা তথা পূত-পবিত্র, যাবতীয় অন্যায় ও পাপাচার থেকে বিমুক্ত ও সর্বজনখ্যাত। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন-

والطيبات للطيبين والطيبون للطيبات-

পাকপবিত্র পুরুষ পাক পবিত্র মহিলাদের জন্য, পাক পবিত্র মহিলারা পাক পবিত্র পুরুষদের জন্য। [সূরা নূর, ২৬।]

নাফিসা বিনতে উনাইসা বর্ণনা করেন, হযরত খাদিজা যেমনি ছিলেন সম্ভ্রান্ত বংশীয়া, চরিত্রবান, পূত-পবিত্র ও সুন্দরি তেমনি প্রচুর সম্পদের মালিক। তাই তিনি যখন বিধবা হয়ে গেলেন তখন কুরাইশের প্রত্যেক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি তাঁকে বিবাহ করতে আগ্রহী ছিলো। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম যখন হযরত খাদিজার ব্যবসায়ী পণ্য নিয়ে সফরে গেলেন এবং আশাতীত বিপুল লাভ করে মক্কায় ফিরে আসলেন, তখন হযরত খাদিজা তার প্রতি অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে উঠলেন। তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন, উদ্দেশ্য রাসূলের মনোভাব সম্পর্কে অবগতি লাভ করা। আমি নবীজির কাছে এলাম, তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার বিয়ে করতে আপত্তি কিসের? তিনি বললেন, আমার হাতে তো কিছু নেই। আমি বললাম, যদি আপনার এ আর্থিক দিকটির কোনো ব্যবস্থা হয়ে যায়, সম্পদ ও সৌন্দর্যের অধিকারী সমগোত্রের কারো পক্ষ থেকে যদি প্রস্তাব আসে তাহলে কোনো আপত্তি নেই তো? তিনি বললেন, সে কে? আমি জানালাম খাদিজা। শুনে তিনি তা কবুল করলেন। [আল ইসাবা, ৪: ২৮২।]

বিবাহের সময় হযরত খাদিজার বয়স ছিলো চল্লিশ বছর এবং নবীজির বয়স ছিলো পঁচিশ বছর। বিবাহ অনুষ্ঠানে ওয়ারাকা ইবনে নাওফেলও উপস্থিত ছিলেন। আবু তালেব বিয়ের খুতবা পাঠের পর ওয়ারাকা সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। [যুরকানি, ৩: ২২২।]

বিবাহের ইজাব কবুলের পর হযরত খাদিজা (র.) একটি গরু জবাই করে মেহমানদের আপ্যায়ন করেন। [যুরকানি, ৩: ২২২।]

মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব

বুখারি ও মুসলিমে হযরত আবু হুরায়রা হতে বর্ণিত। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম কাছে জিবরাইল (আ.) এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! খাদিজা আপনার নিকট খাবার নিয়ে আসছেন। যখন আপনার সামনে চলে আসবেন তখন তাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে এবং এরপর আমার পক্ষ থেকে সালাম জানাবেন। সেই সাথে এ সুসংবাদ জানাবেন যে, জান্নাতে মুক্তা দিয়ে তৈরি একটি প্রাসাদ তাকে দান করা হবে। সে প্রাসাদে কোনো শোরগোল হবে না, কোন ধরণের বিপদাপদ ও কষ্ট হবে না।

নাসাই শরিফের বর্ণনায় রয়েছে, হযরত খাদিজা খাবার নিয়ে উপস্থিত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাকে সালাম ও শুভবার্তা পৌছিয়ে দিলেন, হযরত খাদিজা তার জবাবে বলেন,

ان الله هو السلام وعلي جبريل السلام وعليك يا رسول الله ورحمة الله وبركاته-

আল্লাহ তো স্বয়ং সালাম (তাই আল্লাহর উপর আর কি সালাম পাঠানো হবে?) তবে জিবরাইল কে সালাম সে সাথে হে আল্লাহর রাসূল আপনার প্রতিও সালাম এবং আল্লাহর রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক। (যার বদৌলতে আমার প্রতি সালাম ও রহমত বরকত বর্ষিত হয়েছে)। ইবনে সুন্নীর বর্ণনায় রয়েছে। এরপর হযরত খাদিজা বলেন, যারা শুনছে তাদের প্রতিও সালাম কেবল শয়তান ব্যতীত। যুরকানি, শরহে মাওয়াহিব, ৩: ২২২।

ইবনে কাইয়্যেম বলেন, আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক কারো উদ্দেশ্যে সালাম পাঠানো- এটা এমন এক মর্যাদা ও সম্মান যার একক অধিকারী হয়েছেন হযরত খাদিজা, তাতে এ সৃষ্টির কেউ তার সাথে অংশীদার হন নি, হতে পারেন নি।

উম্মতের সকল ওলামা এ কথার উপর একমত যে, মহিলাদের মাঝে হযরত খাদিজা (র.) হযরত আয়েশা (র.) ও হযরত ফাতিমা (র.) এ তিন মহিলাই সর্বোত্তম ও সর্বাধিক মর্যাদার অধিকারী। হাফেজ আবদুল বার বলেন, হযরত ইবনে আব্বাস কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:

سيدة نساء العالمين مريم ثم فاطمة ثم خديجة ثم اسية-

জগতের সকল মহিলার মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ মারইয়াম, তারপর ফাতিমা, তারপর খাদিজা তারপর আসিয়া। যুরকানি, ৩: ২২৩।

সন্তানাদি

হযরত খাদিজা (র.)র গর্ভে নবীজির চার কন্যা হযরত যয়নাব, হযরত রুকাইয়া, হযরত উম্মে কুলসূম ও হযরত ফাতিমা (র.) এবং দুই পুত্র হযরত কাসিম ও আবদুল্লাহ (র.) জন্মগ্রহণ করেন। উভয় পুত্রই শৈশবে ইনতিকাল করেন। আর কন্যারা সকলে বয়প্রাপ্ত হন এবং পাত্রস্থও হন। তাদের সন্তান সন্তুতিও হয়।

মৃত্যু

তিনি নবুয়তের দশম বর্ষে/প্রিয় নবীর জন্মের ৫০ তম বর্ষে হিজরতের তিন বছর পূর্বে ১০ রমজান, অথবা ২২ এপ্রিল ৬২০ ইং মক্কানগরীতে ইনতিকাল করেন। [ইবনুল জাওযি, আল-ওয়াফা বিআহওয়ালিল মুস্তাফা, পৃ. ৬৪৬।] কুহে হাজুন নামক স্থানে(-এর অন্তর্গত মক্কার কবরস্থান জান্নাতুল মুআল্লায়) তাঁকে দাফন করা হয়। লাশ শোয়ানোর সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজেই তার কবর শরীফে নামেন। তখনও পর্যন্ত জানাযার নামাযের বিধান প্রবর্তিত হয় নি। পঁচিশ বছর নবীজির স্ত্রী হিসাবে জীবন যাপন করে ৬৫ বছর বয়সে তিনি ইনতিকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজেউন। যুরকানি, ৩: ২২৬।

আম্মাজানের কদমে পাকে জানাই লাখো সালাম। আল্লাহ তাঁর উসিলায় আমাদের ক্ষমা করুন।

*বিস্তারিত দেখুন আমার লিখিত “আহলে বায়তে রাসূল (দ.)”

২১/০৩/ ২০২৪ ইং

পুনঃ প্রকাশ

০১/ ০৪/ ২০২৩ ইং

(পুন: প্রকাশ)

……………

পূর্বে প্রকাশিত

২২ এপ্রিল, ২০২১ইং।

…………

ড. এ. এস. এম. ইউসুফ জিলানী, ঢাকা।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment