তাবীর শব্দের অর্থ হচ্ছে তাফসীর বা ব্যাখ্যা। রুইয়া শব্দের অর্থ ঘুমন্ত অবস্থায় কিছু দেখা বা স্বপ্ন দেখা। তাবীরে রুইয়া মানে স্বপ্নের ব্যাখ্যা। রুইয়া বা স্বপ্ন কী? এর বাস্তবতা নিয়ে তর্কবিদ বা দার্শনিকগণ আলোচনা করেছেন। দ্বীনি জ্ঞানে জ্ঞানবান ব্যক্তিগণও এর যথার্থতা নিয়ে আলোচনা পেশ করেছেন। এ সম্পর্কে মেশকাত শরীফের শরাহ গ্রন্থে আলোচনা রয়েছে। মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিভঙ্গিতে যে আলোচনা করা হয়েছে, তা মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া কিতাব থেকে সংকলিত করে এখানে উপস্থাপন করা হলো।
কাযী আবু বকর ইবনুল আরাবী ছিলেন মালেকী মাযহাবের অন্যতম বড় আলেম। তিনি বলেন, স্বপ্ন এমন একটি অনুভূতি যা আল্লাহ্তায়ালা ফেরেশতার মাধ্যমে প্রকৃত অবস্থায় অথবা রূপক অবস্থায় বান্দার নিকট প্রকাশ করেন। স্বপ্ন শয়তানের মাধ্যমেও প্রকাশ পেতে পারে।
হাকিম এবং উকাইলী (رحمة الله) বর্ণনা করেছেন, একদা সাইয়্যেদুনা ওমর ফারুক (رضي الله عنه) সাইয়্যেদুনা হজরত আলী মুর্তযা (رضي الله عنه) কে বললেন, হে হাসানের পিতা! এক ব্যক্তি একটি স্বপ্ন দেখেছে, তার কিছু অংশ সত্য আর কিছু অংশ মিথ্যা মনে হয়। তিনি বললেন, হাঁ, আমি রসুল করীম (ﷺ) কে বলতে শুনেছি, মানুষ গভীর নিদ্রায় অচেতন হলে তার রূহ আরশের দিকে উড়ে যায়। তখন ওই আরশ থেকে যা প্রকাশ পায়, তাই সে স্বপ্নের আকারে দেখে থাকে। আর যে রূহ আরশের নীচে থেকে যায়, তার দর্শন হয় মিথ্যা। ইমাম যাহাবী এই হাদীছকে সহীহ বলেননি।
ইবনে কাইয়্যুম এক হাদীছে বর্ণনা করেন, মুসলমানের সাথে আল্লাহ্তায়ালা যে কালাম করেন, তাই হচ্ছে মুসলমানের স্বপ্ন। অর্থাৎ কোনো মানুষের জন্য এটা সম্ভব ও সমীচীন নয় যে, আল্লাহ্তায়ালা তার সঙ্গে কথা বলবেন। বললে ওহীর মাধ্যমে, না হয় পর্দার অন্তরাল থেকে বলবেন।
ইমাম তিরমিযী বলেন, কোনো মুফাসসির ‘পর্দার অন্তরাল থেকে কথা ’ এর অর্থ করেন স্বপ্ন। আল্লাহ্তায়ালা নবীর সঙ্গে কথা বললে তার নাম হবে ওহী। আর স্বপ্নের মাধ্যমে বললে সেটাও ওহী। নবীর কাছে আসা ওহী হোক বা স্বপ্ন হোক, তার মধ্যে কোনোরূপ মিথ্যার মিশ্রণ নেই। কেনোনা নবীগণ সকলেই সবসময় আল্লাহ্তায়ালার নেগাবানী এবং ইসমতের মধ্যে অবস্থান করেন। নবী ছাড়া অন্য কোনো মানুষের কাছে ওহী আসা সম্ভবই নয়। তারা স্বপ্ন দেখতে পারেন। আর সেই স্বপ্ন আল্লাহ্পাকের তরফ থেকে এলহাম স্বরূপও হতে পারে। আবার শয়তানও কোনো আকৃতি বানিয়ে তাকে স্বপ্ন দেখাতে পারে। অর্থাৎ স্বপ্ন যে সবটুকুই আল্লাহর তরফ থেকে, সে নিশ্চয়তা নেই।
বোখারী শরীফে হজরত আনাস রা থেকে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে, নেককার লোকের ভালো স্বপ্ন নবুওয়াতের ছেচলিশ্ল ভাগের একভাগ। এই হাদীছ দ্বারা নেককার লোকের অধিকাংশ স্বপ্ন ভালো এবং সত্য হয়ে থাকে, এটাই বুঝানো হয়েছে। নেককার লোক কোনো কোনো সময় দুঃস্বপ্ন এবং পেরেশানীর স্বপ্নও দেখে থাকেন, কিন্তু তা বিরল। আরেকটি কারণও রয়েছে। সেটা হচ্ছে, নেককার লোকের উপর শয়তানের প্রতিপত্তি খুবই কম। কিন্তু গোনাহ্গারের উপর শয়তানের প্রভাবপ্রতিপত্তি পূর্ণমাত্রায় বিরাজ করে।
উল্লেখিত হাদীছ থেকে একটা জটিলতার উদ্ভব হয়— স্বপ্ন নবুওয়াতের অংশ হতে পারে কেমন করে। নবী করীম (ﷺ) এর মাধ্যমে তো নবুওয়াতের ধারা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। উত্তর এই যে, নবী করীম (ﷺ) এর দেখা স্বপ্ন প্রকৃতই নবুওয়াতের অংশ। আর নবী ছাড়া অন্যের স্বপ্ন মাজাযী বা রূপকভাবে, উদাহরণিক হিসেবে। অর্থাৎ নবুওয়াতের মাধ্যমে যেমন এলেম হাসিল হয়, স্বপ্নের মাধ্যমে সেরকম আংশিক এলেম হাসিল হয়ে থাকে।
কেউ কেউ বলেন, নবুওয়াতের অংশ মানে নবুওয়াতের এলেমের অংশ। কেনোনা নবুওয়াতের সিলসিলা বা ধারা বন্ধ হয়ে গেলেও তার এলেম এখনও বিদ্যমান।
ইমাম মালেক (رحمة الله) কে লোকেরা জিজ্ঞেস করেছিলো, সব মানুষই কি স্বপ্নের তাবীর বলতে পারে? প্রশ্নের ভঙ্গিতে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, নবুওয়াত নিয়ে কি খেলা করা যায়? তারপর তিনি বলেছিলেন, স্বপ্ন নবুওয়াতের অংশ। তাঁর একথার তাৎপর্য পূর্বের আলোচনার আলোকেই বুঝে নিতে হবে।
স্বপ্ন নবুওয়াতের অংশ- কথাটির তাৎপর্য কেউ কেউ ব্যাখ্যা করেছেন, কোনো ব্যক্তি যদি উচ্চকণ্ঠে আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লালহ বলে তাহলে তাকে মুয়াজ্জিন বলা যাবে না। তেমনি নবুওয়াতের অংশ স্বপ্ন- কেউ তা দেখলেই তাকে নবী বলা যাবে না। সাইয়্যেদা হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) এর হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, আমার পর বাশারাত অর্থাৎ সুসংবাদ প্রদানের সিলসিলা আর জারী থাকবে না। কিন্তু সুুস্বপ্ন জারী থাকবে।
ইমাম মুসলিম ও আবু দাউদ (رحمة الله) হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন। নবী করীম (ﷺ) যে অসুখে পড়ে এ দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছিলেন, সে অসুখের সময় একদিন তিনি হুজরা শরীফের পর্দা উঠিয়ে পবিত্র মস্তক বের করলেন। তাঁর মাথায় পট্টি বাঁধা ছিলো। সাহাবীগণ হজরত আবু বকর সিদ্দীক (رضي الله عنه) এর পিছনে কাতারবন্দী হয়ে নামাজের জন্য দণ্ডায়মান ছিলেন। রসুলেপাক (ﷺ) বললেন, হে লোকসকল! নবুওয়াতের সুসংবাদ দানকারী দুনিয়াতে আর থাকবে না। তবে সুস্বপ্ন অবশ্যই থাকবে।
স্বপ্ন মুসলমানগণ দেখবে এবং তাদেরকে দেখানো হবে। নবী করীম (ﷺ) যে সুসংবাদের কথা বলেছেন, তা ছিলো আধিক্য ভিত্তিক। ভয়ভীতি প্রদর্শনের স্বপ্নও মুসলমান দেখবে না, এরকম বুঝানো উদ্দেশ্য নয়। তাও কখনও কখনও দেখবে। আল্লাহ্তায়ালা অত্যন্ত করুণা করে তাঁর প্রিয় বান্দাকে পূর্ব থেকে সাবধান করে দেয়া অথবা কোনোকিছু জানিয়ে দেয়ার জন্য এসব স্বপ্ন দেখাবেন।
ক্বারী আবু বকর ইবনুল আরাবী (رحمة الله) বলেন, স্বপ্নকে প্রকৃত নবুওয়াতের অংশ মনে করা ঠিক হবে না। তবে এই নবুওয়াতের অংশ বলতে রসুলে করীম (ﷺ) যেরকম অংশ মনে করেছেন, ঠিক সেরকমই মনে করতে হবে। স্বপ্ন সাধারণভাবে নবুওয়াতের অংশ এই হিসেবে যে, নবুওয়াতের মধ্যেও এক ধরনের গায়বী খবর থাকে। তবে তফসিলী হিসেবে অবশ্যই নয়। তফসিলী হিসেবে হওয়া নবুওয়াতের তফসিলী এলেম হাসিলের উপর নির্ভর করে। ইমাম রাযী (رحمة الله) বলেন, আলেমের জন্য প্রত্যেক জিনিসকে তফসিলী এবং পরিপূর্ণভাবে জানা অপরিহার্য। আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক বিষয়ের এলেমের একটি সীমা রেখেছেন। সুতরাং কোনো কোনো জিনিসকে বান্দা সেই নির্ধারিত সীমা অনুসারে পরিপূর্ণ এবং বিস্তৃতভাবে জানে। আবার কোনো কোনো জিনিসকে সংক্ষিপ্তভাবে জানে।
স্বপ্নের এলেমটিও ঠিক এ ধরনের। স্বপ্ন নবুওয়াতী এলেমের অংশ হওয়া সম্পর্কেও বিভিন্ন রকম বিবরণ আছে। কোনো কোনো বিবরণে বলা হয়েছে, পঁয়তালিশ্ল ভাগের একভাগ। কোনো বর্ণনায় আছে, সত্তর ভাগের একভাগ। কোনো বর্ণনায় আছে, চুয়াত্তর ভাগের এক ভাগ। কোথাও আছে, ছাব্বিশ ভাগের একভাগ। আবার কোথাও আছে চব্বিশ ভাগের একভাগ। বর্ণনাগুলোর বিশুদ্ধতার উপর নির্ভর করা যায় না।
তবে ছেচল্লিশ ভাগের একভাগ বর্ণনাটি সুবিখ্যাত। জানা যায়, রসুলেপাক (ﷺ) এর উপর স্বপ্নযোগে ওহী নাযিল হয়েছিলো ছয়মাস। বাকী জিন্দেগীতে জাগ্রত অবস্থায়ই ওহী নাযিল হয়েছিলো। আর তাঁর এ জগতে নবুওয়াতের কাল ছিলো
তেইশ বৎসর। সুতরাং তেইশ বৎসর থেকে ছয় মাস ছেচল্লিশ ভাগের এক ভাগই হয়ে থাকে। এ হিসেবেও নবুওয়াতের ছেচলিশ্ল ভাগের একভাগ কথাটি যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয়।
খাত্তাবী (رحمة الله) বলেন, স্বপ্ন নবুওয়াতের কতভাগের একভাগ- এ সম্পর্কে তাবীল করে কিছু নির্ধারণ করা আহলে এলেমদের জন্য জরুরী কোনো বিষয় নয়। এ সম্পর্কে বিভিন্ন রকম সংখ্যার কথা বলা হয়েছে, যার একটিও প্রমাণযোগ্য নয়। আর এ ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো হাদীছের বর্ণনাও আমরা পাই না এবং দাবিকারীরাও এমন কোনো দলীল প্রমাণ উপস্থাপন করেননি। যে যাই বলেছেন, আপন আপন ধারণা থেকে বলেছেন। আর ধারণা বাস্তবের ক্ষেত্রে কোনো প্রমাণ রাখতে পারে না। যে বিষয়াবলীর এলেম উহ্য রাখা হয়েছে, সেগুলোকে নামাজের রাকাতের সংখ্যা, রোজার দিনের সংখ্যা এবং হজের কংকরের সংখ্যার ন্যায় নির্ধারণ করা আমাদের জন্য কোনো জরুরী ব্যাপার নয়। সুতরাং এ ব্যাপারে সংখ্যা নিরূপণ করার দিকে ধাবিত না হওয়াই যুক্তিযুক্ত।
➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)]