সৈয়্যদ আহমদ শাহ ছিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলাইহির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম
প্রভাষক, আল-কুরআন এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ,
জামেয়া কাদেরিয়া তৈয়্যেবিয়া কামিল মাদরাসা, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।

নাম ও উপনাম : সৈয়্যদ আহমদ শাহ, বাংলাদেশের জনগণের কাছে তিনি ছিরিকোটি হুজুর বা পেশোয়ারী হুজুর নামে পরিচিত।
জন্ম ও বংশ পরিচিতি: তিনি ১৮৫৭ সালে পাকিস্থানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ (বর্তমান খায়বার পাখতুনখা-KPK) হাজারা জিলার অন্তর্গত ছিরিকোট নামক গ্রামের সম্ভ্রান্ত রাসূল বংশে জন্ম গ্রহণ করেন। শাজরা শরিফের বংশনামা অনূযায়ী তিনি প্রিয় নবি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ৩৯ তম নূরানী সন্তান। তাঁর পূর্বপুরুষ হযরত সৈয়্যদ গফুর শাহ প্রকাশ কাপুর শাহ সর্বপ্রথম দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে বর্তমান পাকিস্তানের সীমান্ত প্রদেশ সিরিকোট অঞ্চলে আসেন এবং বিজয় ও আবাদ করেন। এ জন্য তাঁকে ফাতিহে সিরিকোট বা সিরিকোট বিজেতা বলা হয়। তিনি ছিলেন হযরত সৈয়্যদ আহমদ সিরিকোটি রহমাতুল্লহি আলায়হি’র ঊর্ধতন ১৪তম পূর্বপুরুষ।
শিক্ষাকাল: অতি অল্প বয়সে তিনি পবিত্র কুরআন মুখস্ত করেন। অতঃপর স্বদেশে ও বিদেশে দ্বীনি শিক্ষার বিভিন্ন সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ বিষয়ে অসাধারণ পান্ডিত্য অর্জন করেন এবং উচ্চতর ডিগ্রী লাভ করেন। ১৮৮০ সালে শ্রেষ্ঠত্বের জন্য প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক সর্বোচ্চ স্বীকৃতি ‘ফাযিল’ সনদ লাভ করেন।
বায়আত ও খিলাফত লাভ: দীর্ঘ দিন ব্যবসা ও দ্বীনী কর্মে আফ্রিকায় অবস্থানের পর ১৯১২ সালে আফ্রিকা হতে স্বদেশে ফিরে আসেন এবং হযরত আল্লামা আবদুর রহমান চৌহরভী রহমাতুল্লাহি আলায়হি’র হাতে ক্বাদিরীয়া ত্বরীকায় বায়‘আত গ্রহণ করেন। তিনি দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর সিরিকোটের পাহাড় হতে ১১ মাইল দূরে পীরের লঙ্গর খানার জন্য কাঠ বহন করে আনতেন ১৯২৩ সালে তিনি তাঁর পীর কর্তৃক খিলাফত ও ইজাযত প্রাপ্ত হন।
অবদান: আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ শাহ ছিরিকোটির উল্লেখযোগ্য অবদান হল-
১. আফ্রিকার ক্যাপাটাউন, জাঞ্জিবা ও মোমবাসা শহরে সেখানকার জনগণের মাঝে দ্বীনী দাওয়াত পৌঁছান। এ সময় তিনি শিয়া সম্প্রদায়ের ভ্রান্ত মতবাদ হতে সাধারণ মুসলমানদের আক্বিদা-আমল সংশোধনে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং তাদেরকে সুন্নী-হানাফী মাযহাবে দীক্ষিত করেন। সেখানকার ইতিহাসের প্রামাণ্য গ্রন্থ হতে জানা যায় যে, তিনিই সেখানে সর্বপ্রথম মসজিদটি নির্মাণ করেন।
২. পীরের নির্দেশে তিনি ১৯২০ সালে র্বামার উদ্দেশ্যে পুনরায় স্বদেশ ত্যাগ করেন এবং সেখানে প্রায় ষোল বছর অবস্থান করেন। সেখানকার বিভিন্ন মসজিদে তিনি ইমাম ও খতীবের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং সাধারণ মুসলমানদেরকে ইসলামের সঠিক রূপরেখার দিক-নির্দেশনা দান করেন। মাযহাব-মিল্লাতের খিদমাত সূচারূপে বাস্তবায়ন কল্পে তিনি ১৯২৫ সালে আনঞ্জুমান-এ-শুরায়ে রহমানিয়া নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন।
৩. ১৯৪১ সালে রেঙ্গুন হতে তিনি স্থায়ীভাবে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে আসেন এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সঠিক আক্বিদার প্রচার-প্রসারে আত্ম নিয়োগ করেন। তিনি সুন্নি আক্বিদা প্রচারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রাম জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। তরিকতের কর্ম সম্পাদনের জন্য আনঞ্জুমান-এ-রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া বাংলাদেশ, নামে একটি ট্রাস্ট গঠন করেন; যার মধ্যমে আজ বাংলাদেশে শতাধিক সুন্নি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়ে ইসলামের সঠিক মতাদর্শ বাস্তবায়নে হাজার হাজার আলেমে দ্বীন তৈরিতে নিরলস অবদান রেখে চলেছে। রাজধানী ঢাকার জামেয়া কাদেরিয়া তৈয়্যেবিয়া কামিল মাদরাসা ১৯৬৪ সালে তারই সুযোগ্য উত্তরসূরী ও একমাত্র সন্তান হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি’র পবিত্র হস্তে প্রতিষ্ঠিত হয়।
৪. তাঁর পীর খাজা আব্দিুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি রচিত ত্রিশপার সম্বলিত অদ্বিতীয় দূরুদ শরিফের কিতাব ‘মাজমুয়ায়ে সালাওয়াতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রকাশনা তাঁরই পবিত্র হস্তে সম্পাদিত হয়।
৫. বাংলাদেশে ‘মাসলকে আ’লা হযরত’ (ইমাম শাহ আহমদ রেযা খান বেরেলভী রাহমাতুল্লাহি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ইসলামের সঠিক মতাদর্শ) প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
কারামাত:
১. আধ্যাত্মিক উৎর্কষতা সাধনে আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটি রহমাতুল্লাহি আলায়হি’র অদম্য স্পৃহা ও মনের ব্যাকুলতা দেখে তার পীর হযরত আল্লামা আবদুর রহমান চৌহরভী রহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁকে আশ্বস্থ করেন। স্বয়ং আল্লামা সিরিকোটি রহমাতুল্লাহিআলায়হি তা বর্ণনা প্রদান করেন এভাবে, “একদা আমি হুযুর কিবলা আল্লামা আবদুর রহমান চৌহরভী রহমাতুল্লাহি’র হুযরা শরীফের সম্মুখস্থ বারান্দায় এ বিষয়ে চিন্তা মগ্ন ছিলাম। হঠাৎ হুযুর দরজা খুলে এসে আমাকে উদ্দেশ করে সম্মুখস্থ নবনির্মিত মসজিদের দিকে ইশারা করে বলতে লাগলেন-“দেখ! এই মসজিদের বাইরে চুনকাম করা হচ্ছে।” পরে দেখা গেল, আমি চৌহর শরীফে যাতায়াতকালে যখনই কোন কিছুর দিকে দেখি না কেন; তা আমাকে সালাম দিতে থাকে আর আমিও সালামের উত্তর দিতে লাগলাম। পরে বুঝতে পারলাম যে, এ দ্বারা আমার সময় নষ্ট হচ্ছে তাই সে দিকে খেয়াল ছেড়ে দিলাম।
২. আল্লামা সিরিকোটি রহমাতুল¬াহি আলাইহি যখনই মসজিদে রুকু-সিজদা করতেন, তখন তাঁর সাথে সাথে মসজিদের মিনার কাত হয়ে যেত। এমনকি মসজিদের আশে-পাশের গাছ-গাছালিকেও সিজদায় অবনত হতে দেখা গেছে। তা দেখে সেখানকার খ্যাতনামা অলি আবদুল হামিদ প্রকাশ সুলতানুল আউলিয়া একদা শোরগোল করে উঠেন এবং বায়’আত হওয়ার অভিলাষ ব্যক্ত করলেন।
৩. বাঙ্গালী মসজিদে তিনি প্রত্যহ আসরের নামাজের পর তাকরীর করতেন। সেখানে উপস্থিত মুসল্লীদের জন্য তিনি প্রতিদিন একপোয়া (২৫০ গ্রাম) ওজনের খাবার সংকুলান হয়, এমন ডেক্সিতে হালুয়া রান্না করতেন এবং নিজ হাতে পরিবেশন করতেন। দেখা যেত- কোন কোন দিন ৪০ থেকে ৫০ জনও উপস্থিত থাকত। সবাই সমানভাবে খাবার গ্রহণ করতেন।
৪. উক্ত মসজিদের মুয়াজ্জিন বলেন, একদা আমি মাগরিবের সময় মসজিদ সাফ করে সংলগ্ন হাউযে গেলাম, তখন দেখি তিনি সেখানে অযু করতেছেন। ঐ সময় মসজিদের দোতলায়
গিয়ে দেখি তিনি সেখানে মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে তাকরীর ফরমাচ্ছেন।
৫. ১৯২৮ সালে শা’বান মাসের ৩ তারিখ, বুধবার যোহরের সময় হুযূর কিবলা আল্লামা সিরিকোটি রহমাতুল্লাহি আলায়হি’র প্রথম পুত্র আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ সালিহ শাহ রহমাতুল্লাহি আলায়হি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সে দিন আসরের নামাযের পর আল্লমা সিরিকোটি রহমাতুল্লাহি আলায়হি বার্মার রেঙ্গুনের বাঙ্গালী মসজিদ সংশ্লিষ্ট হুযরাতে দরজা বন্ধ করে ঢুকে পড়েন র্দীঘক্ষণ ধরে। ওদিকে ঐ সময়ে নিজবাড়ীর সন্নিকটস্থ জানাযার মাঠে তাঁকে ঐ সন্তানের জানাযার নামায পড়াতে দেখা যায়।
ওফাত: ক্ষণ জন্মা এই মহা মনীষী ১৩৮০ হিজরি মুতাবিক ১৯৬১ সালের ১০ যিলক্বদ, বৃহস্পতিবার সিরিকোট শরীফে ইন্তেকাল করেন।
আগামী ২৬ আগস্ট রোজ: বুধবার এই মাহান সাধকের ফাতিহা খানি ঢাকার জামেয়া কাদেরিয়া তৈয়্যেবিয়া কামিল মাদরাসা ও চট্টগ্রাম আলমগীর খানেকাতে ১১ যিলক্বদ ২৭ আগস্ট রোজ: বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত হবে। সবান্ধব দাওয়াত রইল।
সৈয়্যদ আহমদ শাহ ছিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলাইহির বিস্তারিত জীবনী জানতে পড়ুন- ১. সুন্নিয়াতের পঞ্চরত্ন: বদিউল আলম রিজভী
২. সিরিকোট থেকে রেঙ্গুন: মোসাহেব উদ্দিন বখতিয়ার
৩. বাংলা মজমুআ সালাওয়াতে রাসূল এর ভূমিকা: এম এ মান্নান
৪.শাজরা শরীফ: প্রকাশনায়, আন্জুমান-এ-রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট, চট্টগ্রাম।
৫.মাসিক তরজুমান (বিভিন্ন সংখ্যা ): প্রকাশনায়, আন্জুমান-এ-রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট, চট্টগ্রাম।
৬.বাগে ছিরিকোটি প্রকাশনায়, আল্লামা তৈয়্যেবিয়া সোসাইটি, চট্টগ্রাম।
৭. পাকিস্তান: দেশ ও কৃষ্টি, প্রকাশক, ইষ্ট পাকিস্তান স্কুল টেক্স বুক বোর্ড।
৮. আঞ্জুমান ওয়েব সাইট, ইত্যাদি।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment