সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (রহঃ) (১৫ জানুয়ারি ১৮২৬ – ২৩ জানুয়ারি ১৯০৬) হলেন একজন সুফি সাধক ও মাইজভান্ডারী তরীকার প্রতিষ্ঠাতা। তিনি আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী নামেই বহুল পরিচিত। তার অনুসারীগণ যে সকল প্রচার- প্রকাশনা বাংলা, আরবি, উর্দু এবং ইংরেজি সহ বিভিন্ন ভাষায় ছাপিয়ে আসছে, তাতে তার নাম গাউছুল আজম হযরত মৌলানা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী কেবলা ক্বাবা কাদ্দাছাল্লাহু ছিরহুল আজিজ / (কঃ) লিখতে দেখা যায়। এছাড়াও তিনি গাউছুল আজম, হযরত কেবলা, গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী, বড় মৌলানা, খাতেমুল অলদ, শাঁই-এ-লিল্লাহ্ প্রভৃতি উপনামেও পরিচিত।
• জন্ম
আহমদ উল্লাহ ১৮২৬ সালে ১৪ জানুয়ারী (১ম মাঘ, ১২৩৩ বাংলা সন) চট্টগ্রাম শহর হতে ৪০ কিলোমিটার উত্তরে তৎকালীন প্রত্যন্ত মাইজভান্ডার গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন।তার পিতার নাম সৈয়দ মতিউল্লাহ মাইজভান্ডারী ও মাতার নাম সৈয়দা খায়রুন্নেছা। তার পারিবারিক নাম ছিল সৈয়দ আহমদ উল্লাহ।
• বংশ পরিচয়
আহমদ উল্লাহর পুর্ব পুরুষ সৈয়দ হামিদ উদ্দিন, গৌড়নগরে ইমাম এবং কাজীর পদে নি্য়োজিত ছিলেন। তিনি গৌড় নগরে মহামারীর কারণে ১৫৭৫ সনে চট্রগ্রামের পটিয়া থানার কাঞ্চন নগরে বসতি স্হাপন করেন; সেখানে তার নামানুসারে হামিদ গাঁও নামে একটি গ্রাম আছে। তার এক পু্ত্র সৈয়দ আব্দুল কাদের ফটিকছড়ি থানার আজিমনগর গ্রা্মে ইমামতি উপলক্ষে এসে বসতি স্হাপন করেন। তার পুত্র সৈয়দ আতাউল্লাহ তৎ পুত্র সৈয়দ তৈয়বুল্লাহর মেজ় পুত্র সৈয়দ মতিউল্লাহ মাইজভাণ্ডার গ্রামে এসে বসতি স্হাপন করেন।
• শিক্ষা জীবন
আহমদ উল্লাহ গ্রামের মক্তবের পড়ালেখা শেষ করার পর ১২৬০ হিজরীতে উচ্চ শিক্ষার্জনের উদ্দেশ্যে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। তিনি ১২৬৮ হিজরীতে বিশেষ কৃতিত্বের সাথে পরীক্ষায় পাশ করেন। সেখানেই তিনি তৎকালীন সর্বোচ্চ পর্যায়ের শিক্ষা সমাপন করে ধর্মীয় নানা অনুষ্ঠানাদিতে আমন্ত্রিত অতিথি বা বক্তা হিসাবে যথেষ্ট সুনামের সাথে ধর্মীয় প্রচার-প্রচারণার কাজে লিপ্ত ছিলেন।
• কর্ম জীবন
তিনি শিক্ষা জীবন শেষে করে হিজরী ১২৬৯ সালে ব্রিটিশ শাসনাধীন অবিভক্ত ভারতের যশোর অঞ্চলেরবিচার বিভাগীয় কাজী পদে যোগদান করেন এবং একই সঙ্গে মুন্সেফী অধ্যায়ন শুরু করেন। পরবর্তিতে ১২৭০ হিজরীতে কাজী পদে ইস্তফা দিয়ে তিনি কলিকাতায় মুন্সী বু আলী মাদ্রাসায় প্রধান মোদাররেছ হিসাবে যোগদান করেন। পরবর্তি সময়ে মুন্সেফী পরীক্ষায় ও তিনি প্রথম স্থান অধিকার করে ছিলেন।
আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী হাদিস, তাফসির, ফিকহ, মন্তেক, হিকমত, বালাগত, উছুল, আকায়েদ, ফিলছফা, ফারায়েজ সহ যাবতীয় বিষয়ে অত্যন্ত অভিজ্ঞ ছিলেন। আরবী, উর্দু, বাংলা ও ফারসি ভাষায় তিনি বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তৎকালীন সময়ে ওয়ায়েজ এবং বক্তা হিসাবে তার নামডাক বিশেষ ভাবে ছডিয়ে পড়ে। অল্প কিছু দিন পরই তিনি আধ্যাত্মিক জীবন যাপনে আত্ম নিয়োগ করেন। তখন হতে তিনি বাকি জীবন একজন সুফি সাধক হিসাবে অতিবাহিত করেন।
• বেলায়ত অর্জন
আহমদ উল্লাহ হযরত বড়পীর সৈয়দ আব্দুল কাদের জিলানী (কঃ)-এর বংশধর ও উক্ত তরিকার খেলাফত প্রাপ্ত সৈয়দ আবু শাহামা মুহাম্মদ ছালেহ আল কাদেরী লাহোরী (রঃ) নিকট বায়েত গ্রহনের মাধ্যমে বেলায়ত অর্জন করেন এবং সৈয়দ দেলওয়ার আলী পাকবাজ (রঃ) এর নিকট হতে এত্তাহাদী কুতুবিয়তের ক্ষমতা অর্জন করেন। তিনি দিনে দ্বীনি শিক্ষাদান ও রাতে এবাদত ও রেয়াজতের মাধ্যমে সময় কাটাতেন। এভাবে কঠোর সাধনার ফলে তিনি আধ্যাত্মিক জগতের সর্বোচ্চ বেলায়ত অর্জন করেছিলেন।
• খলিফা
আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী জীবদ্দশায় তাঁর সুফি তরীকার দীক্ষা সমাজে মানুষের মাঝে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে বহু সুফি প্রতিনিধি বা খলিফা নিয়োগ করেন বলে উল্লেখ রয়েছে। তন্মধ্যে ২০৪ খলিফার নাম ইতঃপূর্বে বেশ কয়েকটি প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক গণ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
• সাংসারিক জীবন
আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী ১২৭৬ হিজরীতে ৩২ বছর বয়সে আজিম নগর নিবাসী মুন্সী সৈয়দ আফাজ উদ্দিন আহমদের কন্যা সৈয়দা আলফুন্নেছা বিবির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্ত বিয়ের ছয় মাসের মাথায় তাঁর স্ত্রী মারা যান। সেই বছরই তিনি পুনরায় সৈয়দা লুৎফুন্নেছা বিবিকে বিয়ে করেন। ১২৭৮ হিজরী সালে তাঁর প্রথম মেয়ে সৈয়দা বদিউন্নেছা বিবি জন্মগ্রহন করেন। কিন্তু মেয়েটি চার বছর বয়সে মারা যায়। এরপর তাঁর আরোও একটি ছেলে জন্মগ্রহন করে অল্প দিনের মধ্যে মারা যান। অতঃপর ১২৮২ হিজরীতে দ্বিতীয় পুত্র সৈয়দ ফয়জুল হক (রঃ) এবং ১২৮৯ হিজরী সালে দ্বিতীয় কন্যা সৈয়দা আনোয়ারুন্নেছা জন্মগ্রহন করেন। তাঁর দ্বিতীয় পুত্রও পিতার পুর্বে ইন্তেকাল করেন।
• মাইজভান্ডারী তরিকা প্রতিষ্ঠা ও মাইজভান্ডার দরবার শরীফ – এর গোড়াপত্তন
হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী (কঃ) তাঁর পীরে ত্বরিকতের নির্দেশে ১৮৫৭ সালে নিজ গ্রাম মাইজভান্ডারে ফিরে আসেন। আধ্যাত্মিক সাধক ও দোয়া প্রত্যাশীদের ভীড়ে এই সাধকের পবিত্র বাসগৃহ বিশ্ব মানবতার কল্যাণধারক এক উচ্চমার্গীয় আধ্যাত্মিক দরবারে পরিণত হয়। লোকসমাজে পরিচিতি পায়‘মাইজভান্ডার দরবার শরীফ’ হিসেবে। হযরত কেবলার (কঃ) অসংখ্যা কারামতের ঘটনা বিভিন্ন গ্রন্থে ও লোকমুখে প্রচারিত। যেমনঃ (১) হযরতে আধ্যাত্মিক প্রভাবে মোহছেনিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা ও মোদার্রেছ নিযুক্তি। (২) হযরতের আধ্যাত্মিক প্রভাবে এক রাতে মক্কা শরীফ হতে চট্টগ্রাম শহরে হাজীর প্রত্যাগমন। (৩) হযরতের বেলায়তী ক্ষমতায় বাহুতে হাত রেখে জনৈক হাজীর অলৌকিক ভাবে বাড়ীতে প্রত্যাবর্তন (৪) হযরতের আধ্যাত্মিক প্রভাবে বাঘের মুখে লোটা নিক্ষেপে ভক্ত উদ্ধার (৫) হযরতের বেলায়তী প্রভাবে মৃত্যূকালে আজরাইল ফেরত ও ষাট বৎসর আয়ু বৃদ্ধি। (৬) হযরতের আদেশে রেয়াজ উদ্দিন উকিলের ভূ-সম্পত্তি খরিদ ও রেয়াজ উদ্দিন বাজারের পত্তন। (৭) হযরতের আশ্চর্য্য কেরামতে বগলের নীচে কাবা শরীফে মুছল্লির প্রবেশ করতে দেখা -ইত্যাদি। এই ধরনের উচ্চমার্গীয় কেরামত গাউছে আজমিয়তের পরিচয় বহন করে। হযরত মুহিউদ্দীন ইবনুল আরাবীর ভবিষ্যৎবাণীঃ বিশিষ্ট ছুফী তাত্ত্বিক গবেষক ও বুযুর্গ হযরত মহিউদ্দীন ইবনুল আরাবী তাঁর ‘ফছুছুল হেকম’ গ্রন্থের ‘ফচ্ছে শীচি’ অধ্যায়ে হযরত গাউছুল আজম মওলানা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (কঃ) এঁর আগমণ ও তাঁর গাউছুল আজম হওয়ার ভবিষ্যৎবাণী করে গেছেন।
• বিশ্ব মানবতায় বেলায়তের স্বরূপঃ হযরত আকদাছ (কঃ)’র বেলায়তের পরশ পেয়ে ধন্য হয়েছেন মাটিস্ত বুজুর্গানে দ্বীনন এবং তারা জামালী হতে জালালীর মধ্যে রূপ ধারণ করেছেন। কামালিয়তের বা বুজুর্গীর কোন প্রশংসা তাঁর বুজুর্গীতে বাদ পড়েনা। তিনি এমন এক খোদা -প্রদত্ত শ্রেষ্ঠত্ব সম্পন্ন অলি , যিনি খোদার ইচ্ছা শক্তিতে তাঁর গাউছে আজমিয়তের প্রভাবে জনগণের না হওয়ার মত কাম্য বস্তুকে হওয়ার রূপ দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন। তাঁর সাথে হযরত খাজা খিজির (আঃ) এঁর খুবই ঘনিষ্ট আধ্যাত্মিক সম্পর্ক ছিল। সমসাময়িক ওলামায়ে কেরাম ও বুজুর্গগণ তাঁর প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাপূর্ণ উচ্চ ধারণা পোষন করতেন যা তাদের লিখিত কসিদা, শের, কবিতা, মন্তব্য ইত্যাদি থেকে উপলদ্ধি করা যায়। তাঁর আধ্যাত্মিক পরশ প্রাপ্ত অসংখ্যা অলী-দরবেশ বিভিন্ন স্থানে আধ্যাত্মিকতার দাওয়াত পৌঁছে দিয়ে বিশ্ব মানবতার কল্যাণের অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন।
উত্তরাধিকারী খলিফা নির্ধারণ ও গদী অর্পণঃ গাউছুল আজম হযরত মওলানা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (কঃ) তাঁর নশ্বর জীবনের শেষ দিকে এক জুমাবারে এলাকার সমাজপতি ও জনগণের উপস্থিতিতে তাঁর পবিত্র হুজুরা শরীফ দোয়ার মেহরাবে নিজ পুত্র বংশীয় আদরের নাতি সাজ্জাদানশীনে গাউছুল আজম হযরত মাওলানা শাহ্ ছুফী সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভান্ডারী (কঃ) -কে নিজ গদী শরীফ অর্পণে স্থলাভিষিক্ত আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন।
• ওফাত ও ওরশঃ
গাউছুল আজম হযরত মওলানা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (কঃ) ৭৯ বছর বয়সে ২৩ জানুয়ারী ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দ ,১০ মাঘ ১৩১৩ বঙ্গাব্দ ,সোমবার দিবাগত রাতে ইহধাম ত্যাগ করেন। তাঁর ওফাত দিবস উপলক্ষে প্রতি বছর ৮,৯ ও ১০ মাঘ ৩ দিন ব্যাপী ওরশ শরীফ অনুষ্ঠিত হয়।
• অছীয়ে গাউছুল আজম হযরত মওলানা সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভান্ডারী (কঃ)
হযরত মওলানা সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভান্ডারী (কঃ) ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৩, ১৩ ফাল্গুন, ১২৯৯ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হযরত শাহ্ সুফি মওলানা সৈয়দ ফয়জুল হক (কঃ) (১৮৬৫-১৯০২)।তাঁর দাদা গাউছুল আজম হযরত মওলানা শাহ্ ছুফী সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (কঃ) । হযরত মওলানা সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভান্ডারী (কঃ) ১৯৮২ সালের ১৬ জানুয়ারী ,২মাঘ ১৩৮৮ ,শনিবার ইন্তেকাল করেন।
• আধ্যাত্মিক জীবনের দীক্ষা ও আধ্যাত্মিক উচ্চাসনঃ
গাউছুল আজম হযরত মওলানা শাহ্ ছুফী সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (কঃ) ছিলেন তাঁর পীরে তরিকত । অন্যদিকে হযরত মওলানা সৈয়দ আমিনুল হক মাইজভান্ডারী (কঃ) ছিলেন তাঁর পীরে বায়াত ,হযরত মওলানা সৈয়দ গোলাম রহমান মাইজভান্ডারী (কঃ) ছিলেন তাঁর পীরে তাফাইয়োজ। তাঁর আধ্যাত্মিক উচ্চাসনের কথা হযরতের (কঃ) রহস্যপূর্ণ বাক্যের মাধ্যমে প্রকাশ পেতো। যেমনঃ “নবাব হামারা দেলা ময়না হ্যায়,ফের আওর কোন নবাব হ্যায়?” “তোম কোন সুলতান হ্যায়? সুলতান হামারা দেলা ময়না হ্যায়।”
• মাইজভান্ডারী ত্বরিকার তাত্ত্বিক বিশ্লেষকঃ
হযরত মওলানা সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভান্ডারী (কঃ) পরিকল্পিতভাবে মাইজভান্ডারী তরিকার মৌলিক ভাবাদর্শ ও বৈশিষ্ট্যাবলি বিশ্লেষণ ও উপস্থাপনের প্রয়াস নেন। তাঁর প্রকাশিত ও সম্পাদিত রচনাবলির সংখ্যা ১০ (দশ)। যথাঃ- ১। গাউছুল আজম মাইজভান্ডারীর জীবনী ও কেরামত , ২। বেলায়তে মোত্লাকা, ৩। গঠনতন্ত্র , ৪। প্রতিবাদ লিপি, ৫। এলাকার রেনাসাঁ যুগের একটি দিক, ৬। বিশ্ব মানবতায় বেলায়তের স্বরূপ, ৭। মানব সভ্যতা, ৮। মিলাদে নববী ও তাওয়াল্লোদে গাউছিয়া , ৯। মুসলিম আচার ধর্ম, ১০। মূলতত্ত্ব বা তাজকীয়ায়ে মোখতাছার (১ম খন্ড)। এই সব গ্রন্থাবলি মাইজভান্ডারী ত্বরিকা সম্পর্কে জানার ও গবেষণার Primary source হিসেবে বিবেচিত।
• ঐতিহাসিক বিশেষত্ব ও ‘অছীয়ে গাউছুল আজমঃ
’- তাঁর সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক বিশেষত্ব এই যে, তিনি গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী (কঃ) এঁর জাগতিক বংশধারা ও আধ্যাত্মিক ‘গাউছিয়ত’ -এর একক উত্তরাধিকারী ছিলেন। এই অনন্য জাগতিক ও আধ্যাত্মিক বিশেষত্বের ফলশ্রুতিতে তিনি মাইজভান্ডারী পরিমন্ডলে ‘অছীয়ে গাউছুল আজম’ হিসেবে পরিচিত।
• মাইজভান্ডারী তরিকার আদর্শ প্রচারে সাংগঠনিক ভিত্তিঃ
হযরত মওলানা সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভান্ডারী (কঃ) পীরি ছায়র বা মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুরিদ করানো ও হাদিয়া গ্রহণ করার প্রথা বিরুদ্ধ ছিলেন। সর্বস্তরের মানুষের কাছে মাইজভান্ডারী তরিকার দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার জন্য “আঞ্জুমানে মোত্তাবেয়ীনে গাউছে মাইজভান্ডারী ” নামক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।
• নির্বিলাস জীবনাচার ও খাদেমুল ফোকরাঃ
হযরত মওলানা সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভান্ডারী (কঃ) ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী ও নির্বিলাস জীবন-যাপনে অভ্যস্ত। অতি বিনয়ে নিজ পরিচয় দিতেন খাদেমুল ফোকরা বা আল্লাহর ফকিরদের সেবক। তিনি তাঁর জন্য মাজার না করার এবং আলাদাভাবে কোন ওরশ না করার জন্য অছিয়ত করে যান। তাঁর এই অছিয়তের প্রতি সম্মান প্রদর্শন পূর্বক তাঁর কোন মাজার নির্মাণ করা হয়নি এবং তাঁর জন্য আলাদা কোন ওরশের আয়োজন করা হয়না। মানব ও মানবাত্মার অন্তিম যাত্রা ও চিরস্থায়ী গন্তব্যের মর্মস্পর্শী চিত্র ফুটে উঠেছে তাঁরই রচিত কবিতার মাঝে-
মানব প্রকৃতির কঠিন আকৃতি তোমার মদিরা পাত্র।
সরস মাটির বিশাল দেহ তোমারই ফুল ক্ষেত্র।
কোলাহল পরিহারে,নির্জনতার আসরে ,
তোমারই প্রতীক্ষায় রহিয়াছে আজি-তোমারই বাসরে।
মাইজভান্ডারী তরিকা
ইসলাম ধর্মে আধ্যাত্মিক সাধনার ধারাবাহিকতায় উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কোরান ও হাদীসের শিক্ষাকে অনুসরণ করে গাউছুল আজম হযরত মওলানা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (কঃ)-এঁর আধ্যাত্মিক শক্তি ও শিক্ষাকে ধারণ করে মাইজভান্ডারী তরিকা প্রচারের সূচনা হয়। হযরত মওলানা সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভান্ডারী (কঃ) বলেন, “ এই ত্রিবিধ বেলায়তী ধারা ,নবুয়তী ধারার সমন্বয়ে অর্থাৎ জাহের বাতেন তা’লীমে এরশাদী সহ শরীয়ত ,তরীকত ,হাকীকত ও মায়ারেফত প্রভাবে ও সংমিশ্রেণে মাইজভান্ডারী তরীকারূপ মহা সাগরের উৎপত্তি।” মাইজভান্ডারী তরিকার বৈশিষ্ট্যঃ এই তরিকা ছিলছিলার দৃষ্টিকোণে কাদেরীয়া তরিকার সাথে সম্পর্কিত। অন্যান্য তরিকার আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট্যগুলো মাইজভান্ডারী তরিকায় সন্নিবেশিত হয়েছে। এই তরিকা কোরান ও হাদিসের শিক্ষাকে পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করে। একই সাথে এই তরিকা অসাম্প্রদায়িক ,উদার,নৈতিক ধর্ম-প্রাধান্যসম্পন্ন,শ্রেণি-বৈষম্যহীন ও মানবদরদী। মানুষের মনে ঐশী প্রেম জাগ্রত করে সুন্দর ও ন্যায়ের পথে জীবন যাপনে মানব সমাজকে উদ্বুদ্ধ করে মানবতার ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তি ও কল্যাণ নিশ্চিত করার শিক্ষা ও দীক্ষা দেয়।
• হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী (কঃ) -এঁর উত্তরাধিকারীঃ
হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী (কঃ) তাঁর ওফাতের পূর্বে আপন নাতি হযরত মওলানা সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভান্ডারীকে (কঃ)বালেগ ঘোষণা করে মাইজভান্ডার দরবার শরীফে তাঁর গদীর আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারী নির্ধারণ করে যান। হযরত কেবলা (কঃ) এই প্রসঙ্গে বলেন, “আমার ‘দেলাময়না’ বালেগ। দেলাময়নাই আমার গদীতে বসবে।”
• মাইজভান্ডার দরবার শরীফে বর্তমান পীরে তরিকত ও সাজ্জাদানশীনঃ
খেলাফত প্রদানপূর্বক সাজ্জাদানশীন মনোনয়নের মাধ্যমে গাউছিয়ত জারি রাখার নিয়মের অনুসরণে হযরত মওলানা সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভান্ডারী (কঃ) তাঁর জীবিতাবস্থায় তদীয় তৃতীয় পুত্র হযরত মাওলানা শাহ্ সুফি সৈয়দ এমদাদুল হক (মঃ) কে নিজ গদীর উত্তরাধিকারী ও মাইজভান্ডার দরবার শরীফের সাজ্জাদানশীন সাব্যস্ত করে যান। তিনি মাওলানা শাহ্ সুফি সৈয়দ এমদাদুল হক (মঃ) কে সাজ্জাদানশীনের দায়িত্ব অর্পণের বিষয়টি ‘জরুরী বিজ্ঞপ্তি’ প্রকাশ ও তাঁর লিখিত ‘মানব সভ্যতা’ নামক বইয়ের ভূমিকাংশে উল্লেখের মাধ্যমে প্রামাণ্যকরণ করেন। ‘মানব সভ্যতা’ বইয়ের ভূমিকাংশে তিনি উল্লেখ করেন, “অত্র বইটি আমার জীবন সায়াহ্নে ছাপাইয়া যাইতে পারিব কিনা ভবিতব্য খোদাই তাহা ভাল জানেন। তাই বইটি ছাপাইবার জন্য আমাদের প্রচলিত ‘আঞ্জুমানে মোত্তাবেয়ীনে গাউছে মাইজভান্ডারী ’ সমাজ-সংস্কার ও নৈতিক উন্নয়নমূলক সমাজ সংগঠক পদ্ধতির সফলতার উদ্দেশ্যে হানেফী মজহাব এজমা ফতোয়ার ভিত্তিতে আমি যেইভাবে কামেল অলীউল্লাহর নির্দেশিত গদীর সাজ্জাদানশীন সাব্যস্ত তদ্মতে আমার ছেলেদের মধ্যে যোগ্যতম সৈয়দ এমদাদুল হক মিঞাকে ‘সাজ্জাদানশীন’ মনোনীত করিবার পর এই গ্রন্থটি তাহার হস্তে অর্পণ করিলাম। ”
• মাইজভান্ডারী তরিকার অনুসারীদের প্রতি বর্তমান সাজ্জাদানশীনের কিছু দিক নির্দেশনাঃ
মাইজভান্ডার দরবার শরীফের বর্তমান সাজ্জাদানশীন হযরত মাওলানা শাহ্ সুফি সৈয়দ এমদাদুল হক (মঃ) আধ্যাত্মিক সাধনায় সফলতা লাভের জন্য শরীয়তের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের প্রয়োজনীয়তার উপর জোরারোপ করেন।তিনি বায়াত প্রদানকালে মুরীদদের সবসময় বলেন, “শরীয়তকে বাদ দিয়ে তরিকত নাই। ” তিনি বায়াত প্রদানকালে মুরীদদের প্রথম যে বিষয়ের জন্য বলেন তা হচ্ছে নিয়মিত নামাজ পড়া;রোজা রাখা; সামর্থ্য থাকলে হজ্ব-জাকাত আদায় করা অর্থাৎ ইসলামী শরীয়ত পালন করা। ইসলামী সভ্যতার বিকাশে সুফিবাদের অবদান অনস্বীকার্য।যুগ যুগ ধরে সুফি তরিকাসমূহ ইসলামী চরিত্র গড়ার এক একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় মাইজভান্ডারী তরিকা জনসমাজকে ধর্মের মূল সৌন্দর্য অবলোকন করে এর অন্তর্নিহিত শক্তির সাথে সম্পর্কযুক্ত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।
• মাইজভান্ডারী তরিকার উসুলে সাবআ বা সপ্ত পদ্ধতিঃ
নফ্ছে ইনসানীর কুপ্রবৃত্তি বন্ধ করে রূহে ইনসানীর সুপ্রবৃত্তি জাগ্রত করার জন্য হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী (কঃ) নির্বিঘ্ন ও সহজসাধ্য মাধ্যম হিসেবে সপ্ত-পদ্ধতির প্রবর্তন করেন। সপ্ত -পদ্ধতি দুই স্তরে অনুশীলিত হয়।
• ফানায়ে ছালাছা বা রিপুর ত্রিবিধ বিনাশ স্তরঃ
১। ফানা আনিল খাল্কঃ পরমুখাপেক্ষী না হয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করা।
২। ফানা আনিল হাওয়াঃ অনর্থক কাজকর্ম ও কথাবার্তা হতে বিরত থাকা।
৩। ফানা আনিল এরাদাঃ নিজ ইচ্ছা বাসনাকে খোদার ইচ্ছায় বিলীন করে তাছলিম ও রজা অর্জন করা।
• মাউতে আরবা বা প্রবৃত্তির চতুর্বিধ মৃত্যুঃ
১। মউতে আবয়্যাজ বা সাদা মৃত্যুঃ উপবাস ও সংযমের মাধ্যমে অর্জিত এই মৃত্যুতে মানব মনে উজ্জ্বলতা ও আলো দেখা দেয়।
২। মউতে আছওয়াদ বা কালো মৃত্যুঃ সমালোচনায় বিরক্ত বা রাগান্বিত না হয়ে আত্মসমালোচনার মাধ্যমে নিজকে সংশোধনের মনমানসিকতা অর্জনই কালো মৃত্যু।
৩। মউতে আহমর বা লাল মৃত্যুঃ কামস্পৃহা ও লোভ-লালসা হতে মুক্তিতে হাসিল হয়।
৪। মউতে আখজার বা সবুজ মৃত্যুঃ নির্বিলাস জীবন যাপনে অভ্যস্ত হওয়ার মাধ্যমে সবুজ মৃত্যু লাভ হয়।
এই কোরআনী হেদায়তের সপ্তপদ্ধতি, মানবজীবনের এক নিখুত সহজ, সরল ও স্বাভাবিক পন্থা; যা মানব জীবন পদ্ধতিতে স্বাচ্ছন্দ্য আনয়ন করে।