পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।
সূচি
১. সৃষ্টির মূল উৎস নূরে মোহাম্মদী/ ০১
২. নবীপ্রেম সমস্ত ইবাদতের প্রাণ/০৮
৩. নবীপ্রেম খোদাপ্রাপ্তির পূর্বশর্ত/১১
৪. নবীজির গোলামের কোন চিন্তা নেই/১৭
৫. সমস্ত জ্ঞানের মূল উৎস আল্লাহর প্রিয় রসূল/১৯
৬. ইলমে গায়্ব নবী করীমের নুবূয়তের অন্যতম দলীল/২২
৭. হায়াতুন্ নবী সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম/২৭
৮. মক্বামে মাহমূদ/৩২
৯. শাফাআত : রসূল-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র অনন্য বৈশিষ্ট্য/৩৫
১০. খতমে নুবূয়ত/৪২
১১. যাঁরা হাশরের দিন আরশের ছায়ায় থাকবে/৪৬
১২. হাত তুলে দোআ-মুনাজাত করা/৫০
১৩. মুহার্রম ও আশুরার রোযা/৫৪
১৪. আহলে বায়তে রসূল কিশতিয়ে নূহ/৫৮
১৫. শতাব্দির মুজাদ্দিদ/৬৪
১৬. বিনা প্রয়োজনে মাথা মুণ্ডানো খারেজীদের আলামত/৭০
১৭. নবীপ্রেমের বাস্তব প্রতিচ্ছবি সিদ্দীক্ব-ই আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু/৭৩
১৮. কদমবুচি শুধু জায়েয নয়, সুন্নাতে সাহাবাও/৭৭
১৯. যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর/৮১
২০. নবীজীর প্রতি জড়পদার্থের সম্মান/৮৫
২১. কবরের উপর ফুল ছিটানো/৮৯
২২. মিরাজুন্নবী সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম/৯৪
২৩. মিঞ্চরাজ রজনীতে নবীজীর স্বচক্ষে আল্লাহ’র দীদার লাভ/৯৮
২৪. চলো মুসাফির মদীনার পানে/১০৩
২৫. কেবল পানাহার বর্জনে রোযার সার্থকতা নেই/১০৯
২৬. তারাবীর নামায আট রাকজ্ঞআত নয়, বিশ রাক্আত/১১২
২৭. শাওয়ালের ৬ রোযা : সারা বছর রোযা রাখার সাওয়াব/১১৭
২৮. নামাযে ইমামের পেছনে মুক্বতাদীর ক্বিরআত পাঠ না করা বং চুপে চুপে ‘আ-মী-ন’ বলা/১২১
২৯. ক্বোরবানী ত্যাগের প্রোজ্জ্বল নিদর্শন/১২৭
৩০. সাতটি চরিত্র মানুষকে ধ্বংস করে দেয়/১৩১
৩১. হাদীস শরীফ চর্চাকারীদের জন্য নবী করীমের দোআ/১৩৪
৩২. প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদী/১৪০
৩৩. ওলী বিদ্বেষীরা খোদাদ্রোহী/১৪৪
সৃষ্টির মূল উৎস নূরে মোহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম
عَنْ جَابِر بْن عَبْدِ اللّٰہِ قَالَ قُلْتُ یَارَسُوْلَ اللّٰہِ بِاَبِیْ اَنْتَ وَاُمِّیْ اَخْبِرْنِیْ عَنْ اَوَّلِ شَیْءٍ خَلَقَہُ اللّٰہُ تَعَالٰی قَبْلَ الْاَشْیَاءِ؟ قَالَ یَاجَابِرُ اِنَّ اللّٰہَ تَعَالٰی قَدْ خَلَقَ قَبْلَ الْاَشْیَاءِ نُوْرَ نَبِیِّکَ مِنْ نُوْرِہٖ فَجَعَلَ ذَالِکَ النُّوْر یَدُوْرُ بِالْقُدْرَۃِ حَیْثُ شَآءَ اللّٰہُ تَعَالٰی وَلَمْ یَکُنْ فِیْ ذَالِکَ الْوَقْتِ لَوْحٌ وَلَا قَلَمٌ وَلَا جَنَّۃٌ وَلَا نَارٌ وَلَا مَلَکٌ وَلَا سَمَاءٌ وَلَااَرْضٌ وَلَاشَمْسٌ وَلَاقَمَرٌوَلَا جِنٌّ وَلاَ اِنْسٌ فَلَمَّا اَرَادَ اللّٰہُ تَعَالٰی اَنْ یَّخْلُقَ الْخَلْقَ قَسَّمَ ذَالِکَ النُّوْر اَرْبَعَۃ اَجْزَاء فَخَلَقَ مِنَ الْجُزْءِ الْاَوّلِ الْقَلَمَ وَمِنَ الثَّانِی اللَّوْحَ وَمِنْ الثَّالِثِ الْعَرْشَ ثُمَّ قَسَّمَ الْجُزْءَ الرَّابِعَ اَرْبَعَۃَ اَجْزَاءِ فَخَلَقَ مِنَ الْاَوّلِ حَمَلَۃَ الْعَرْشِ وَمِنَ الثَّانِیْ الْکُرْسِیَّ وَمِنَ الثَالِثِ بَاقِیَ الْمَلَآءِکَۃِ ثُمَّ قَسَّمَ الرَّابِعَ اَرْبَعَۃَ اَجْزَاءَ فَخَلَقَ مِنَ الْاَوّلِ السَّمٰوَاتِ وَمِنَ الثَّانِی الْاَرْضِیْنَ وَمِنَ الثَّالِثِ الْجَنَّۃَ وَالنَّار۔۔۔ الخ
অনুবাদ ঃ
হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ্ রদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আবেদন করলাম, এয়া রসূলাল্লাহ্! আমার মা-বাবা আপনার কদমে উৎসর্গিত, আপনি দয়া করে বলুন, সকল বস্তুর পূর্বে সর্বপ্রথম আল্লাহ্ তাজ্ঞআলা কোন বস্তুটি সৃষ্টি করেছিলেন? নবীজী এরশাদ করলেন, নিশ্চয় আল্লাহ্ সমস্ত কিছুর পূর্বে তোমার নবীর (আমার) নূরকেই তাঁরই নূর হতে সৃষ্টি করেছেন অতঃপর ওই নূর আল্লাহ্ তাআলারই মর্জি মুতাবেক তাঁরই কুদরতি শক্তিতে পরিভ্রমণ করতে লাগল। ওই সময় না ছিল লৌহ-কলম, না ছিল বেহেশ্ত-দোযখ, আর ছিলনা আসমান- যমীন, চন্দ্র-সূর্য, মানব ও দানব। এক পর্যায়ে মহান আল্লাহ্ যখন সৃষ্টিজগত পয়দা করার মনস্থ করলেন, প্রথমেই ওই নূর মুবারক চারভাগে বিভক্ত করে প্রথম অংশ দিয়ে কলম, দ্বিতীয় অংশ দিয়ে লওহ, তৃতীয় অংশ দিয়ে আর্শ, সৃষ্টি করে চতুর্থাংশকে পুনরায় চারভাগে বিভক্ত করে প্রথমাংশ দিয়ে আর্শবহনকারী ফেরেশ্তাদের, দ্বিতীয় অংশ দ্বারা কুর্সী, তৃতীয় অংশ দ্বারা অন্যান্য ফেরেশ্তাদের সৃষ্টি করে চতুর্থাংশকে আবারও চারভাগে বিভক্ত করে প্রথম ভাগ দিয়ে সপ্ত আসমান, দ্বিতীয় ভাগ দিয়ে সপ্ত যমীন, তৃতীয় ভাগ দিয়ে বেহেশ্ত-দোযখ এবং পরবর্তী ভাগ দিয়ে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য সকল বস্তু সৃষ্টি করেছেন।
[ইমাম কুস্তলানী : আল্ মাওয়াহিবুল লাদুনিয়া, ১ম খণ্ড, ৭১ পৃষ্ঠা। ইমাম যুরকানী : শরহুল মাওয়াহিব, ১ম খণ্ড, ৮৯-৯১ পৃষ্ঠা। হালভী : আস্সিরাতুল হালভিয়া, ১ম খণ্ড, ৫০ পৃষ্ঠা। আল্লামা আজলুনী : কাশফুল খেফা, ১ম খণ্ড, ৩১১ পৃষ্ঠা। শায়খ আবদুর রায্যাক : আল্ মুসান্নাফ। ড.তাহেরুল কাদেরী : খাছাইছে মুস্তফা। নাবহানী : আল্ আনওয়ারুল মুহাম্মদিয়া ১৩ পৃষ্ঠা, ইস্তাম্বুল থেকে প্রকাশিত। ইমাম আহমদ রেযা রহমাতুল্লাহি আলাইহি : সালাতুস্ সফা।]
হাদীসের বর্ণনাকারী
হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ্ রদ্বিয়াল্লাহু আনহু। নবীপ্রেমে উৎসর্গিত এক তরুণ সাহাবী। মাত্র আঠার বৎসর বয়সে দ্বিতীয় আকাবায় ইসলামের পতাকাতলে সমবেত, হন কম বয়সের কারণে বদর-উহুদের জিহাদে শরিক হতে না পারলেও পরবর্তীতে প্রায় ১০ জিহাদে অংশগ্রহণ করে বীরত্ব প্রদর্শন করেছিলেন। মদীনার মসজিদে নবভী হতে এক মাইল দূরে তাঁর বাসস্থান হওয়া সত্ত্বেও পাঁচ ওয়াক্ত নামায মসজিদে নবভীতেই জামাআত সহকারে নিয়মিত আদায় করতেন। ঐতিহাসিক খন্দকের যুদ্ধে অবিরাম পরিশ্রম আর উপবাসের কারণে মুসলিম সৈন্যদের অবস্থা একেবারে কাহিল। এমনকি নবীজীর পবিত্র পেট মুবারকেও পাথর বাঁধা দেখে হযরত জাবের রদ্বিয়াল্লাহু আনহু নিজেকে আর সামলাতে না পেরে বিদ্যুৎবেগে দৌঁড়ে ঘরে পৌঁছে বিবির কাছে জানতে পারলেন তাঁদের ঘরে সামান্য আটা আর একটি ছোট ছাগলছানা ছাড়া আর কিছুই নেই। বিবিকে নির্দেশ দিলেন ঠিক আছে এই ছাগলছানা জবাই করে রান্না কর; আর যৎসামান্য আটা যা-ই রয়েছে তা দিয়ে রুটি তৈরি কর, আমি হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দাওয়াত দিয়ে আসি। এ কথা বলে আরেক দৌঁড়ে নবী করীমের খেদমতে এসে একেবারে কাছে গিয়ে কানে কানে দাওয়াতটা দিলেন এবং জানিয়ে দিলেন নবী পাক সাথে যাঁরা যাবেন তাঁদের সংখ্যা যেন দশজন অতিক্রম না করে। দাওয়াত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নবীজী সৈন্যবাহিনীর কাছে ঘোষণা দিলেন সবাই জাবেরের বাড়িতে যাব। সেখানে খাবারের আয়োজন হয়েছে। নবী করীমের এই আম ঘোষণা শুনে হযরত জাবির রদিয়াল্লাহু আনহুর মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল! ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন। ছোট একটা বকরির বাচ্চা দিয়ে দশজনের বেশি খাওয়া কোন অবস্থাতেই সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রে এ লোককে নবী করীম দাওয়াত দিয়ে দিলেন। কিন্তু আপত্তি-অভিযোগ করার কোন সাহস ছিল না। তবে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল নবীর দরবারে কোন অভাব নেই। ব্যবস্থা একটা হয়ে যাবে নিশ্চয়। এ চিন্তা করতে করতে নবী করীম সেনা বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে তাঁর ঘরে এসে হাযির হলেন। এরপর সামান্য আটা যা ছিল তার উপর এবং বকরির রান্না করা গোশ্ত ও হাঁড়ির মধ্যে থুথু মুবারক নিক্ষেপ করলেন। তারপর খাবার পরিবেশন শুরু হল। নবী পাকের পবিত্র থুথু মুবারকের ওসীলায় খাবারের এতই বরকত হয়ে গেল যে, পর্যায়ক্রমে সেখান থেকে হাজার হাজার ক্ষুধার্ত লোককে তৃপ্তি সহকারে খাওয়ানোর পরও প্রথম অবস্থায় খাবার যা ছিল তাঞ্চই রয়ে গেল [সুবহানাল্লাহ্]।
হাদীসের ব্যাখ্যা
গভীর দৃষ্টিতে লক্ষ করলে দেখা যায়, পবিত্র ক্বোরআনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রত্যেকটি সূরার প্রতিটি আয়াতে কোননা কোনভাবেই আমাদের প্রিয়নবী হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রশংসা বর্ণিত হয়েছে। দুনিয়ার অন্য কোন সৃষ্টির সাথে তাঁর তুলনা হয় না। কারণ, তিনি সৃষ্টির মূল আর অন্যরা তাঁরই শাখা-প্রশাখা। তিনিই আল্লাহর প্রথম সৃষ্টি এবং আল্লাহর দরবারে প্রথম আত্মসমর্পণকারী। যেমন পবিত্র ক্বোরআনে এরশাদ হয়েছে-
قُلْ اِنَّ صَلٰوتِیْ وَنُسُکِیْ وَمَحْیَاءِیْ وَمَمَاتِیْ لِلّٰہِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ لَاشَرِیْکَ لَہٗ وَبِذَالِکَ اُمِرْتُ وَاَنَا اَوَّلُ الْمُسْلِمِیْنَ
অর্থাৎ হে নবী! আপনি বলুন, নিশ্চয় আমার নামায, হজ্ব, কোরবানী, আমার জীবন ও ওফাত বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্যই; যার কোন শরীক নেই এবং এ বিষয়ে আমি আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই প্রথম মুসলমান (আল্লাহর দরবারে আত্মনিবেদনকারী)। [ সূরা আন্আম, আ.১৬২-১৬৩।]
আলোচ্য আয়াতের শেষের অংশ ‘আমিই প্রথম মুসলমান’ থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়, রসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই আল্লাহর দরবারে প্রথম আত্মসমর্পণকারী এমনকি মানবজাতির আদিপিতা হযরত আদম আলাইহিস সালামের আগেও। শুধু তাই নয় মানবজাতির আগে জিনজাতির মধ্যে যারা আল্লাহর দরবারে আত্মসমর্পণকারী ছিল তাদেরও পূর্বে। এমনকি ফেরেশতাদেরও পূর্বে। সৃষ্টিজগতের সকল সৃষ্টিই আল্লাহর দরবারে আত্মসমর্পণকারী ছিল। কেউ আগে আবার কেউ পরে। কেউ স্বেচ্ছায়, কেউ বাধ্য হয়ে। যেমন এরশাদ হয়েছে- وَلَہٗ اَسْلَمَ مَنْ فِی السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضِ طَوْعًا وَّ کَرْھًا وَاِلَیْہِ یَرجِعُوْن
অর্থাৎ আসমান-যমীনে যা কিছু রয়েছে সকলই স্বেচ্ছায় হোক কিংবা বাধ্য হয়ে, তারই কাছে আত্মসমর্পণ করেছে এবং তাঁরই প্রতি সকলই প্রত্যাবর্তিত হবে। [সূরা আলে ইমরান, আ.৮৩।]
কাজেই সৃষ্টিকুলের মধ্যে সর্বপ্রথম আত্মসমর্পণকারী হলেন হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সুতরাং তিনিই সর্বপ্রথম সৃষ্টি। এভাবে পবিত্র ক্বোরআনের অনেক আয়াত রয়েছে যদ্বারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনুধাবন করা যায়, নবী করীম সৃষ্টির মূল উৎস ছিলেন এবং তাঁরই পবিত্র নূর হতে অন্যান্য জগত সৃজিত, যা হাদীস শরীফের ভাষ্য দ্বারা প্রতিভাত হয়েছে।
তেমনি অপর এক হাদীস শরীফে রয়েছে, হযরত আবূ হুরায়রা রদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- کُنْتُ اَوّلُ النَّبِیِٖنَ فِی الْخَلْقِ وَاٰخِرُھُمْ فِی الْبَعْثِ অর্থাৎ আমি সৃষ্টিগতভাবে প্রথম নবী আর দুনিয়াতে আগমনের দিক দিয়ে শেষ নবী। [দাইলামী : আল্ ফেরদাউস, ৩য় খণ্ড, ২৮২ পৃষ্ঠা; ইবনে কাসীর : তাফসীরুল কোরআন আল্ আযীম, ৩য় খণ্ড, ৪৭০ পৃষ্ঠা।]
হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী করীম এরশাদ করেন-
کُنْتُ نُوْرًا بَیْنَ یَدَی رَبِّیْ قَبْلَ خَلْقِ اٰدَمَ عَلَیْہِ الصَّلٰوۃُ وَالسَّلَامُ بِاَرْبَعَۃِ عَشَرَ اَلْفَ عَامٍ
অর্থাৎ হযরত আদম আলাইহিস্ সালামকে সৃষ্টির চৌদ্দহাজার বৎসর পূর্বে আমি আমার রবের দরবারে নূরের আকৃতিতে মওজূদ ছিলাম।
[কুস্তলানী : আল্ মাওয়াহেবুল্ লাদুনিয়া; আজলুনী : কাশফুল খেফা, ২য় খণ্ড, ১৭০ পৃষ্ঠা।]
আল্লামা বুরহানুদ্দীন হালবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এ প্রসঙ্গে একটি হাদীস শরীফ স্বীয় প্রসিদ্ধ কিতাব ‘সিরাতে হালাবিয়া’য় সঙ্কলন করেন-
عَنْ اَبِیْ ھُرَیْرَۃَ رَضِیَ اللّٰہُ عَنْہُ انَّ رَسُوْلَ اللّٰہِ صَلَّی اللّٰہُ عَلَیْہِ وَسَلَّمَ سَأَلَ جِبْرَاءِیْلَ عَلَیْہِ السَّلَام فَقَالَ یَاجِبْرَءِیْلُ کَمْ عمَرْکََ مِنَ السّنِیْنَ؟ فَقَالَ یَارَسُوْلَ اللّٰہِ لَسْتُ اَعْلَمُ غَیْرَ اَنَّ فِی الْحِجَابِ الرَّابِعِ نَجْمًا یَطْلَعُ فِیْ کُلِّ سَبْعِیْنَ اَلْفَ سَنَۃٍ مَرَّۃً رَأیْتُہٗ اِثْنِیْنِ وَسَبْعِیْنَ اَلْفَ مَرَّۃٍ فَقَالَ یَاجِبْرَءِیْلُ وَعِزَّۃِ رَبِّیْ جَلَّ جَلَالُہٗ اَنَا ذَالِکَ الْکَوْکَبُ
অর্থাৎ হযরত আবূ হুরায়রা রদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস্ সালামকে জিজ্ঞেস করলেন- ওহে জিব্রাঈল! আপনার বয়স কত? উত্তরে জিব্রাঈল আলাইহিস্ সালাম বললেন, এয়া রসূলাল্লাহ্! আমি তাতো সঠিক জানি না। তবে এতটুকু বলতে পারি (সৃষ্টিজগত সৃষ্টির পূর্বে) আল্লাহ্ তাআলার নূরানী আযমতের পর্দাসমূহের চতুর্থ পর্দায় একটি নূরানী তারকা সত্তর হাজার বছর পর পর উদিত হত। আমি আমার জীবনে সেই নূরানী তারকা বাহাত্তর হাজার বার দেখেছি। অতঃপর নবীপাক এরশাদ করলেন, মহান রব্বুল আলামীনের ইয্যাতের ক্বসম করে বলছি, সেই অত্যুজ্জ্বল নূরানী তারকা আমিই ছিলাম। [আল্ হালভী : আস্ সীরাতুল হালভিয়া, ১ম খণ্ড, ৩০ পৃষ্ঠা।]
উপরিউক্ত কোরআন-হাদীসের আলোচনা থেকেই বুঝা গেল রসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৃষ্টির মূল উৎস। এরপরেও একশ্রেণীর লোক বলে বেড়ায় নবী আমাদের মত সাধারণ মানুষ, মাটির তৈরি মানুষ, দোষে-গুণে মানুষ, তিনি অতিমানব নন, না নূরের তৈরি ইত্যাদি। [গোলাম আযম : সিরাতুন্ নবী সঙ্কলণ।]
আল্লাহ্ পাক তাঁর প্রিয়হাবীবকে এমন অসংখ্য নূরানী ও অনন্য বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, যা অন্য মানুষতো দূরের কথা অন্য নবীকেও দেওয়া হয়নি। এ বিষয়টি তন্মধ্যে অন্যতম। কাজেই হাদীস শরীফের ভাষ্যমতে নবী করীমের নূর মুবারক তখনই সৃষ্টি করা হয়েছিল যখন মাটিতো দূরের কথা আর্শ, কুর্সী, লওহ্, কলম তথা সৃষ্টিকুলের কোন কিছুই সৃষ্টি করা হয়নি। সুতরাং কীভাবে এ কথা তারা বলার দুঃসাহস দেখায়, নবী আমাদের মত মাটির তৈরি? [গোলাম আযম : সিরাতুন্ নবী সঙ্কলণ]
তারা বলে নবী আমাদের মত। কারণ, তিনি খাবার খেয়েছেন, বাজার করেছেন, সংসার করেছেন ইত্যাদি। তাহলে আমরা বলব এ যুক্তি তো কাফিরদেরই। পবিত্র ক্বোরআনে এসেছে কাফিররা নবী করীমের উপর ঈমান না আনার জন্য এ হেন খোঁড়া যুক্তি প্রদর্শন করেছিল,
مَالِھٰذَا الرَّسُوْلِ یَأْکُلُ الطَّعَامَ وَیَمْشِیْ فِی الْاَسْوَاقِ
অর্থাৎ ‘‘এ রসূলের কী হয়েছে (ইনি কিভাবে রসূল হতে পারেন) যিনি খাবার খান এবং বাজারে চলাফেরা করেন।’’ সুতরাং কাফিরদের কথার সাথে সূর মিলিয়ে কেউ যদি নিজেদেরকে কাফিরদের দলভুক্ত করে নিতে চায় তাহলে আমাদের করার কী আছে?
তারা বলে বেড়ায় নবী কিভাবে নূরের তৈরি, তিনিতো আমাদের মত রক্তমাংসে গড়া মানুষ। তাহলে আমরা বলব সহীহ হাদীস শরীফে দেখা যায়, নবী পাকের পবিত্র দেহ মুবারকে কোন দিন মশা- মাছি বসেনি; অথবা সুযোগ পেলেই মশা-মাছি আমাদের শরীরের রক্ত টেনে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। নবী পাকের নূরানী দেহ আর আমাদের দেহ কোন দিন এক হতে পারে না। সাধারণ মানুষ মারা যাওয়ার পর কবরে তাদের দেহ মাটির সাথে মিশে যায়। কিন্তু নবীগণের দেহ মোবারক কবরের মাটিতে বিলীন হয় না। আর আমাদের নবীর শানতো অনেক উর্ধ্বে। হাদীস পাকে এসেছে,
اِنَّ اللّٰہَ حَرَّمَ عَلَی الْاَرْضِ اَنْ تَأْکُل اَجْسَادَ الْاَنْبِیَاء
অর্থাৎ- নিশ্চয় আল্লাহ্ পাক (ইন্তিকালের পর) নবীগণের দেহ মুবারক খাওয়া মাটির জন্য হারাম করে দিয়েছেন। [ফাদলুস্ সালাওয়াত। ]
তারা বলে আমাদের যেমন শরীরে রক্ত আছে নবীর শরীরেও রক্ত ছিল তিনি কি আমাদের মত নন? বড় দুঃখের সাথে লক্ষ করছি আমরা নবীর উম্মত হয়ে এই এক শ্রেণীর লোক ছলে-বলে- কৌশলে চাচ্ছে যে, নবী তাদের মতই হোক, আর তারা নবীর মত হয়ে যাক (নাঊযুবিল্লাহ্)।
তাহলে আমরা তাদের প্রত্যেকের কাছে জানতে চাই, তুমি কি জান তোমার রক্ত নাপাক, খাওয়াতো দূরের কথা কারো গায়ে লাগলেও ধুয়ে ফেলা আবশ্যক? কিন্তু নবী পাকের রক্ত মুবারক নাপাক ছিল বলে শরীয়তের কোন প্রমাণ দেখাতে পারবেন কি? বরং নবী করীমের রক্ত মুবারকের পবিত্রতার উপর অসংখ্য হাদীস শরীফ বিদ্যমান। ঐতিহাসিক উহুদ যুদ্ধে নবী করীমের দাঁত মুবারক শহীদ হওয়ার পর মুখ দিয়ে যখন রক্ত ঝরে পড়ছিল তখন সাহাবীরা গিয়ে হাত বসিয়ে দিয়েছিলেন এবং এক বিন্দু রক্তও মাটিতে পড়তে দেন্নি। নবীজী ওই রক্ত মুবারক হিফাযত করার জন্য সাহাবী হযরত মালিক ইবনে সিনান রদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যাতে কেউ দেখতে না পায়। যুদ্ধের মাঠে নবী করীমের সেই রক্ত মুবারক হিফাযতের এমন কোন জায়গা খুঁজে পেলেন্ না যেখানে কেউ দেখবে না। পরিশেষে বুদ্ধি করে চুমুক দিয়ে রক্তের সবটুকুই পান করে নিলেন। পরবর্তীতে নবী করীম ওই রক্ত মুবারকের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে, তিনি বললেন, হুযূর এমন জায়গায় লুকিয়ে রেখেছি যেখানে দুনিয়ার কোন মানুষ দেখতে পাবে না। নবী করীম জায়গাটির কথা জানতে চাইলেন। উত্তরে বললেন, হুযূর সেই নূরানী রক্ত মুবারক দুনিয়ার কোথাও রাখা আমার পছন্দ হয়নি তাই আমি তা নিজেই পান করেছি। প্রেমিক সাহাবীর এ ধরনের মুহাব্বত দেখে নবী করীম মুচকি হাসলেন আর সুসংবাদ দিলেন, যে পেটে আমার রক্ত পৌঁছেছে সে পেটকে কোনদিন জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না। [আল্ বুরহান।]
ওহাবী-খারেজী, দেওবন্দী, ক্বাদিয়ানী, মওদূদীবাদের অনুসারীরা কি কোন দিন প্রমাণ করতে পারবে- তাদের রক্ত পবিত্র এবং সেই রক্ত পানে জাহান্নাম থেকে মুক্তির সুসংবাদ দিতে পারবে? তাহলে কেন ওই সব শয়তানী যুক্তি দিয়ে সরলপ্রাণ মুসলিম মিল্লাতকে গোমরাহ্ করা হচ্ছে ?
আসলে নবীপাকের শান-মান শুনলে ঈমানদারের ঈমান মজবুত হয় আর শয়তানের মন হয়ে যায় দুঃখ ভারাক্রান্ত। যারা নবীপাকের সুউচ্চ শান-মান সহ্য করতে পারে না, তারা শয়তানের প্রেতাত্মা নয় কি? ঈমানদার সব সময় ক্বোরআন-হাদীসের আলোকেই কথা বলবে। কোন যুক্তি তার সামনে টিকে থাকতে পারে না। মহান আল্লাহ্ যেখানে তাঁর প্রিয় নবীর শান ও মান-মর্যাদাকে বুলন্দ করেছেন সেক্ষেত্রে নবীর দুশমনেরা হাজার চেষ্টা করলেও কোন কাজ হবে না।
পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবীর মাসে নবীপ্রেমিকরা উজ্জীবিত হয়, নব উদ্যমে তাঁদের মুখে মুখে থাকে প্রিয়নবীর প্রশংসাগীত। তিনিই আল্লাহ্র নূর, তিনিই সমস্ত সৃষ্টির রহমত এবং তিনিই সৃষ্টির মূল উৎস।
নবী মোর নূরে খোদা, তাঁরই তরে সকল পয়দা
আদমের কলবেতে তাঁরই নূরের রৌশনী।।
নবীর মোর পরশমণি।
পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!