এই পবিত্র আয়াতুল কারিম ক্বুরআনুল কারিম নাযীলের সময়কালের কাফীর-মুুশরিকদের ঈমানকে কটাক্ষ করে নাযীলকৃত।
এই আয়াতে প্রিয় নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) কে প্রেরণের আগে থেকে তাদের দীর্ঘ দিনের লালিত ঈমানের সাথে শির্কি আক্বিদার স্বরুপ তুলে ধরা হয়েছে।
তারা তাদেরই হাতে গড়া মূর্তী আর তাদেরই হাতে জ্বালানো আগুনের পূঁজা করত, সেগুলোকে তাদের দেবতা বানিয়ে নিয়েছিল।
আর সেগুলোকে আল্লাহর সহযোগী (Partner) বলে বিশ্বাস করত।
আয়াতটি :
وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللَّهِ إِلَّا وَهُمْ مُشْرِكُونَ
অর্থাৎ : “(মুশরিকদের মধ্যে) অনেক মানুষ এরুপও রয়েছে যে তারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে; আবার শিরকও করে।”
[সূরাহ্ ইউসূফ; ১২/১০৬।]
এ সুরাটি হিজরতের পূর্বে মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছিলো।
সুরাটি এমন এক সময়ে নাজিল করা হয় যখন প্রিয় নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরাম রা.-কে মক্কার কাফির-মুশরিকদের হাতে চরম নির্যাতন ও লাঞ্ছনা ভোগ করতে হচ্ছিল।
তাঁদের ওপর জুলুমের মাত্রা এতটাই সীমা লঙ্ঘন করেছিল, তাঁরা অপেক্ষায় ছিলেন কখন আল্লাহ তাআলা আসমানি সাহায্য নাজিল করবেন।
এমনকি অসহ্য হয়ে অনেকে মাতৃভূমি মক্কা ত্যাগ করার প্রাথমিক প্রস্তুতিও সম্পন্ন করেছিলেন।
মক্কার দেব-দেবীর পূঁজারী কাফির মুশরিকদের সাথে ছিলো আরবের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের আহলে কিতাব তথা ইহুদি-খ্রিস্টানদের সাথে গভীরতর সু-সম্পর্ক।
পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের তৎকালিন ইহুদি-খ্রিস্টান মুশরিকেরা যখন জানতে পারলো আল্লাহ্ (سبحانه و تعالى) এঁর হাবিব প্রিয় নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) রিসালাতের ঘোষণা প্রদানপূর্বক আল্লাহ্ (سبحانه و تعالى) এঁর তাউহিদ বা একত্ববাদের ডাক দিয়েছেন তখন আল্লাহ্ (سبحانه و تعالى) এঁর হাবিব প্রিয় নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) কে অপমান অপদস্থ করার মানসে আহলে কিতাব মুশরিকেরা হযরত ইউসূফ আ. এঁর ঘটনা বিস্তারিত জানানোর জন্যে বলে।
আহলে কিতাব ইহুদি-খ্রিস্টান মুশরিকদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো প্রিয় নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) মক্কাবাসী হওয়ায় হযরত ইউসূফ আ. এঁর সাথে সম্পর্কিত সুপ্রাচীন সে ঘটনা তিনি জানাতে পারবে না।
আল্লাহ তালার কাছে অতীত বর্তমান ভবিষ্যত বলতে কিছু নেই, তিনি সব বিষয়েই জ্ঞান রাখেন। কোনো কিছুই তার অজানা বা গায়িব নয়। নবী রাসূলগণকে আল্লাহতালাই অদৃশ্য বা গায়িব সম্পর্কে জ্ঞান বা ইলম দান করেন।
নবী রাসূলদের অলৌকিক কর্ম এবং যাদুকরের যাদু এক নয়।
আল্লাহ্ (سبحانه و تعالى) তাঁর হাবিব প্রিয় নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) এঁর নুবূয়্যাত (গায়বের খবর জানানোর মর্যাদায় অধিষ্ঠা) এর প্রমাণ হিসেবে হযরত ইউসূফ আ. এঁর সাথে সম্পর্কিত উক্ত ঘটনাকে ক্বুরআ’নুল কারিমের অংশ হিসেবে তাঁকে জানিয়ে দিয়ে তাঁর নুবূয়্যাতী ও রিসালাতের মর্যাদকে বুলন্দ করেন।
এই গায়িবি সংবাদের মাধ্যমে আহলে কিতাব ইহুদি খ্রিস্টানের চক্রান্তকে আল্লাহ্ (سبحانه و تعالى) নস্যাৎ করে দেন।
যেমন
ইরশাদ হয়েছে :
ذَٰلِكَ مِنْ أَنْبَاءِ الْغَيْبِ نُوحِيهِ إِلَيْكَ ۖ وَمَا كُنْتَ لَدَيْهِمْ إِذْ أَجْمَعُوا أَمْرَهُمْ وَهُمْ يَمْكُرُونَ
অর্থাৎ : “এগুলো অদৃশ্যের খবর, আমি আপনার কাছে প্রেরণ করি। আপনি তাদের কাছে ছিলেন না, যখন তারা স্বীয় কাজ সাব্যস্ত করছিল (বিষয়-বস্তু নির্ধারণ করছিল) এবং চক্রান্ত করছিল”।
[সূরাহ্ ইউসূফ; ১২/১০২]।
এ সূরার ১০৩ ও ১০৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَمَا أَكْثَرُ النَّاسِ وَلَوْ حَرَصْتَ بِمُؤْمِنِينَ (103) وَمَا تَسْأَلُهُمْ عَلَيْهِ مِنْ أَجْرٍ إِنْ هُوَ إِلَّا ذِكْرٌ لِلْعَالَمِينَ (104)
অর্থাৎ : “(হে রাসূল!) আপনি (নব্যুয়তের দায়িত্ব পালনের কারনে) যতই চান, অধিকাংশ মানুষ ঈমান আনবে না।”
[সূরাহ্ ইউসূফ; ১২/১০৩]।
পরবর্তী আয়াতে
“আপনি (নব্যুয়তের দায়িত্ব পালনের কারনে) তাদের কাছ থেকে তো কোনো বিনিময় খোঁজেন না।
এ কুরআন তো বিশ্বজগতের জন্য উপদেশ ব্যতীত আর কিছুই নয়।”
[সূরাহ্ ইউসূফ; ১২/১০৪]।
হযরত ইউসুফ (আ.) এঁর কাহিনী বর্ণনার পর এখন ইসলামের প্রতি প্রিয় নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) এঁর আহ্বানের ব্যাপারে মানুষের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বলা হচ্ছে, আল্লাহ বলছেন, হে নবী! মানুষকে সত্যের দাওয়াত দিতে গিয়ে আপনি তো তাদের কাছ থেকে কোনো পারিশ্রমিক দাবি করছেন না।
বরং তারা যাতে আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে সেজন্য আপনি চেষ্টা করছেন এবং কষ্ট করছেন।
তবে আপনি এটা জেনে রাখুন, অনেক মানুষই আছে যারা বিশ্বাস করবে না; সত্য গ্রহণ করতে আগ্রহ দেখাবে না। এমনকি আপনি অনেককেই পাবেন যারা আপনার কথা সত্য মনে করলেও তা গ্রহণ করবে না।
আল্লাহর দ্বীন প্রচারের জন্য নবী রাসূলদেরকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে।
কিন্তু দেখা গেছে অধিকাংশ মানুষ তাদের আহ্বানে সাড়া দেয়নি।
এজন্য নবী রাসূলরা দায়ী নন, মানুষকে আল্লাহতায়ালা জ্ঞান ও বিচার বুদ্ধি দিয়েছেন, কাজেই কোনো কিছু গ্রহণ ও বর্জন করার স্বধীনতা তাদের রয়েছে।
এ সূরার ১০৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
وَكَأَيِّنْ مِنْ آَيَةٍ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يَمُرُّونَ عَلَيْهَا وَهُمْ عَنْهَا مُعْرِضُونَ (105)
অর্থাৎ : “আকাশ ও পৃথিবীতে অনেক নিদর্শন রয়েছে যার ওপর দিয়ে তারা পথ অতিক্রম করে অথচ এসবের (তাৎপর্যের) প্রতি তারা উদাসীন।”
[সূরাহ্ ইউসূফ; ১২/১০৫]।
আগের আয়াতে বলা হয়েছে,
সত্য প্রতিভাত হলেও বহু মানুষ তা গ্রহণ করবে না।
এই আয়াতে প্রিয় নাবী রাসূলুন কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) কে সান্ত্বনা দিয়ে বলা হচ্ছে, তারা প্রতিনিয়ত আল্লাহর নিদর্শন প্রত্যক্ষ করে যাচ্ছে অথচ আল্লাহর অস্তিত্ব তাদের বোধগম্য হয় না।
কাজেই
তারা যদি আপনার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে তাহলে আপনি দুঃখিত হবেন না। আপনার আহ্বান তো বিশ্ববাসীর কল্যাণের উদ্দেশ্যে, এর পেছনে পার্থিব কোনো স্বার্থ নেই।
আপনার চিন্তিত বা উদ্বিগ্ন হওয়ারও কোনো কারণ নেই।
আকাশ ও পৃথিবীর সব সৃষ্টিই মহান আল্লাহর অসীম শক্তি ও কুদরতের নিদর্শন বহন করছে।
যারা এ ব্যাপারে উদাসীন তারাই সত্যকে গ্রহণ করার সৌভাগ্য লাভ করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
সূরা ইউসুফের ১০৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللَّهِ إِلَّا وَهُمْ مُشْرِكُونَ (106)
অর্থাৎ : “অনেক মানুষ আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে না, আবার তারা যেন শিরকও করে।”
[সূরাহ্ ইউসূফ; ১২/১০৬]।
এই আয়াতে বলা হচ্ছে,
অধিকাংশ মানুষ যেমন আল্লাহকেই বিশ্বাস করে না, আবার যারা বিশ্বাস করে তাদের অনেকেরই বিশ্বাস আবার খাঁটি নয়। তারা খাঁটি একত্ববাদী নয়।
তারা আল্লাহর পাশাপাশি অন্যের ওপরও নির্ভর করে, আল্লাহর সঙ্গে অংশীস্থাপন করে।
আল্লাহর এবাদত করে ঠিকই কিন্তু জীবনে আল্লাহর বিধান পুরোপুরি বাস্তবায়ন করে না।
এখানে শিরক বলতে দৈহিক মূর্তি পুজাকে বুঝানো হয়নি, আল্লাহ ছাড়া অন্যের ওপর নির্ভর করাকে বুঝানো হয়েছে।
যেমন : রিয়া, সুদ খাওয়া, কেবল সম্পদশালী ও ক্ষমতাধর হওয়ার কারনে কাউকে গুরুত্ব দেয়া, স্বজনপ্রীতি, নিজের প্রবৃত্তিকে ইলাহ্ বানিয়ে নেয়া অহংকারবশত শরিক স্থাপন; যেমন ইবলিশ শায়ত্বন করেছিল প্রভৃতি।
পৃথিবীতে অধিকাংশ মানুষ বা জ্বীনই সৃষ্টিকর্তা হিসাবে আল্লাহকে বিশ্বাস করে।
কিন্তু সেই সাথে উপরোক্ত বিভিন্ন কারনে অন্য কিছুকে শরীক করে।
যেমন মক্কার মুশরিকরা আল্লাহকে বিশ্বাস করত। আল্লাহকে বিশ্বাস করত তৎকালীন আহলে কিতাব ইহুদি-খ্রিস্টান মুশরিকরাও।
আসমান-যমীন, পাহাড়-পর্বত সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা হিসাবে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখত।
নবী ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে নবী বলে বিশ্বাস করত।
আখেরাতে বিশ্বাস পোষণ করত।
যেমন ইরশাদ হয়েছে :
অর্থাৎ : “আর যদি তুমি তাদেরকে প্রশ্ন কর, কে আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টি করেছেন এবং চাঁদ ও সূর্যকে নিয়োজিত করেছেন? তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ। তাহলে কোথায় তাদের ফিরানো হচ্ছে?
[সূরাহ্ আনকাবুত; ২৯/৬১]।
অথচ আল্লাহর সাথে তারা অন্য কিছুকে শরীক করত ও কুফরী করত।
যেমন তারা কা‘বা গৃহ ত্বাওয়াফকালে শিরকী তালবিয়াহ পাঠ করত।
যেমন তারা বলত, লাববাইকা লা শারীকা লাকা, ইল্লা শারীকান হুয়া লাক; তামলিকুহু ওয়া মা মালাক (আমি হাযির; তোমার কোন শরীক নেই, কেবল ঐ শরীক যা তোমার জন্য রয়েছে। তুমি যার মালিক এবং যা কিছুর সে মালিক।
গ্রন্থ সূত্রঃ
মুসলিম হা/১১৮৫;
মিশকাত হা/২৫৫৪ ‘ইহরাম ও তালবিয়াহ’ অনুচ্ছেদ;
ইবনু কাছীর, ত্বাবারী, ঐ আয়াতের তাফসীর।
বস্তুতঃ বিগত যুগের ন্যায় বর্তমান যুগেও পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মূর্তিপুঁজারী মুশরিকেরা বা আহলে কিতাব ইহুদি-খ্রিস্টান মুশরিকেরা শিরকী আক্বীদা ও আমলে অভ্যস্ত।
কাজেই
وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللَّهِ إِلَّا وَهُمْ مُشْرِكُونَ (106)
অর্থাৎ : “অনেক মানুষ আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে না, আবার তারা যেন শিরকও করে।”
[সূরাহ্ ইউসূফ; ১২/১০৬]।
উক্ত অায়াতুল কারিমে উল্লেখিত বাণীর ব্যাখ্যা হচ্ছে নিম্নোক্ত আয়াতুল কারিম
فَإِذَا رَڪِبُواْ فِى ٱلۡفُلۡكِ دَعَوُاْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ فَلَمَّا نَجَّٮٰهُمۡ إِلَى ٱلۡبَرِّ إِذَا هُمۡ يُشۡرِكُونَ ٦٥
অর্থাৎ : “(তৎকালের মক্বার মুশরিক ও আহলে কিতাবিদের বৈশিষ্ঠ্য সম্পর্কে বলা হচ্ছে) তারা যখন নৌযানে আরোহন করে, তখন তারা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহকে ডাকে। অতঃপর যখন তিনি তাদেরকে স্থলে পৌঁছে দেন, তখনই তারা শিরকে লিপ্ত হয়”।
[সূরাহ্ আনকাবুত; ২৯/৬৫]।
আর
তাদের এরুপ শিরকে লিপ্ত হওয়ার কারণ হিসেবে ইরশাদ হয়েছে :
لِيَكۡفُرُواْ بِمَآ ءَاتَيۡنَـٰهُمۡ وَلِيَتَمَتَّعُواْۖ فَسَوۡفَ يَعۡلَمُونَ ٦٦
অর্থাৎ : “যাতে আমি তাদেরকে যা দিয়েছি, তা তারা অস্বীকার করতে পারে এবং তারা যেন ভোগ-বিলাসে মত্ত থাকতে পারে। অতঃপর শীঘ্রই তারা জানতে পারবে”।
[সূরাহ্ আনকাবুত; ২৯/৬৬]।
ক্বুরআ’নুল কারিম নাযিলের মাধ্যমে আল্লাহ্ (سبحانه و تعالى) মক্কার মুশরিক ও ইহুদি-খ্রিস্টান আহলে কিতাবিদের শিরিকী বিশ্বাস বা আক্বিদাকে খণ্ডন করে ইসলামী বিশুদ্ধ বিশ্বাসকে প্রতিস্থাপন করেছেন।
মক্কার মুশরিক ও ইহুদি-খ্রিস্টান আহলে কিতাবিদের শিরিকী বিশ্বাস বা আক্বিদার অন্যতম হচ্ছে আল্লাহ্ (سبحانه و تعالى) এঁর জাত-স্বত্ত্বাকে তারা সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্যতার বিশ্বাসে বিশ্বাস পোষণ করত।
তাছাড়া
তারা মানবের মাঝে অবধারিত পরষ্পর তাওয়াস্সুল বা উসিলা এবং শাফায়াত বা সুপারিশের বিষয়ে ভূল ধারণা পোষণ করত।
ক্বুরআ’নুল কারিমে আল্লাহ্ (سبحانه و تعالى) সত্যকে গ্রহণ না করাকে তিরষ্কার করেছেন।
যেমন ইরশাদ হয়েছে :
وَمَنۡ أَظۡلَمُ مِمَّنِ ٱفۡتَرَىٰ عَلَى ٱللَّهِ ڪَذِبًا أَوۡ كَذَّبَ بِٱلۡحَقِّ لَمَّا جَآءَهُ ۥۤۚ أَلَيۡسَ فِى جَهَنَّمَ مَثۡوً۬ى لِّلۡڪَـٰفِرِينَ ٦٨
অর্থাৎ : “আর সে ব্যক্তির চেয়ে যালিম আর কে, যে আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করে অথবা তার নিকট সত্য আসার পর তা অস্বীকার করে? জাহান্নামের মধ্যেই কি কাফিরদের আবাস নয়”?
[সূরাহ্ আনকাবুত; ২৯/৬৮]।
পরের আয়াতেই আল্লাহ্ (سبحانه و تعالى) ইরশাদ করেন :
وَٱلَّذِينَ جَـٰهَدُواْ فِينَا لَنَہۡدِيَنَّہُمۡ سُبُلَنَاۚ وَإِنَّ ٱللَّهَ لَمَعَ ٱلۡمُحۡسِنِينَ ٦٩
অর্থাৎ : “আর যারা আমার পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, তাদেরকে আমি অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করব। আর নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সাথেই আছেন”।
[সূরাহ্ আনকাবুত; ২৯/৬৯]।
সুপ্রিয় পাঠক, এ পর্যায়ে আসুন যুগশ্রেষ্ঠ মুফাসসিরিনে ক্বিরামের তাফসীর থেকে উক্ত আয়াতের তাফসীর দেখে নিইঃ
উদ্ধৃতি : আল্লামা কাজী সানাউল্লাহ্ পানিপথী রহ. স্বীয় তাফসীরে মাযহারী সূরাহ্ ইউসূফ ১০৬ এর তাফসীর করা হয়েছে নিম্নরূপ :
অর্থাৎ : “তাদের অধিকাংশ وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللَّهِ إِلَّا وَهُمْ مُشْرِكُون একথার অর্থ, হে রাসূল! দেখুন, এ সকল লোক আল্লাহর প্রতি এক ধরনের বিশ্বাস রাখে। কিন্তু তাদের এ বিশ্বাসের সঙ্গে রয়েছে অংশিবাদীতা। তারা আল্লাহকেও ডাকে আবার পূঁজা করে কল্পিত দেব-দেবীদের। তাদেরকে আপনি জিজ্ঞেস করে দেখুুন, আকাশ, পৃথিবী সৃষ্টি করেছন কে? তারা বলবে, আল্লাহ্।
আরো বলে দেখুন, আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন কে? তারা বলবে, আল্লাহ্। এরুপ বলা সত্ত্বেও তারা উপাসনা করবে বৃক্ষের, পাথরের, দেব-দেবীদের।
হযরত ইবনূ আব্বাস রা. বলেন, অংশিবাদিরাও হজ্জ করত। হজ্জের সময় বলত, ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক (আমি হাজির, হে আল্লাহ্! আমি হাজির)’।
হজ্জের ইহরাম পরে বৃত্তাকারে কাবা শরিফ প্রদক্ষিণের সময় বলত, ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক (আমি হাজির, হে আল্লাহ্! আমি হাজির)’, তোমার কোন অংশিদার নেই ঐ সকল দেব-দেবীরা ছাড়া যাদেরকে তুমি তোমার অংশিদার করে নিয়েছ। তুমি তাদের (দেব-দেবীদের) প্রভূ। তারা তোমার প্রভূ নয়।
আতা বলেন, অংশিবাদিরা শিরকমিশ্রিত এরুপ প্রার্থণা করত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সময়ে। কিন্তু বিপদআপদের সময় তারা আল্লাহ্ ছাড়া আর কাউকে ডাকত না। যেমন এক আয়াতে বলা হয়েছে,
فَإِذَا رَڪِبُواْ فِى ٱلۡفُلۡكِ دَعَوُاْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ فَلَمَّا نَجَّٮٰهُمۡ إِلَى ٱلۡبَرِّ إِذَا هُمۡ يُشۡرِكُونَ ٦٥
অর্থাৎ : “তারা যখন নৌযানে আরোহন করে, তখন তারা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহকে ডাকে। অতঃপর যখন তিনি তাদেরকে স্থলে পৌঁছে দেন, তখনই তারা শিরকে লিপ্ত হয়”।
[সূরাহ্ আনকাবুত; ২৯/৬৫]।
উলামায়ে ক্বিরাম রহ. বলেন, ‘ইল্লা ওয়াহুম মুশরিকুন (কিন্তু তারা শিরক করে)’ কথাটির অর্থ হবে, তারা আল্লাহর বিধানের প্রতিকূলে পথভ্রষ্ট ধর্মনেতাদের বিধানানুসারে চলে। তাদেরকেই বসায় প্রভূ পালনকর্তার আসনে। অথবা আল্লাহর সাথে স্থাপন করে পিতা-পুত্রের সম্পর্ক। তারা বলে, আমরা আল্লাহর সন্তান। কিংবা তারা করে আগুনের উপাসনা।
মুতা’জিলারাও এরুপ অংশীবাদিদের অন্তর্ভূক্ত।
কারণ তারা বলে মানুষ তার কর্মের স্রষ্টা।
কিন্তু তাওহিদের বিশুদ্ধ বিশ্বাস হচ্ছে, আল্লাহ্ পাকই হচ্ছেন এক ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী স্রষ্টা। তাকদিরের ভালো-মন্দ আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশ্বাসের অপরিহার্য অঙ্গ।
সূফী সাধকগণই হচ্ছেন বিশুদ্ধ বিশ্বাসী। আর মুতা’জিলারা অবশ্যই পথভ্রষ্ঠ্য।
গ্রন্থ সূত্র :
আল্লামা কাজী সানাউল্লাহ্ পানিপথী রহ. : তাফসীরে মাযহারী; সূরাহ্ ইউসূফ, আয়াত ১০৬।
______
সম্মানিত পাঠক,
সকল যুগের সকল মুফাসসিরিনে ক্বিরাম স্ব-স্ব তাফসীর উপরোক্ত অনুরুপ তাফসীর পেশ করেছেন। তাঁদের তাফসীরে রয়েছে সাদৃশ্যতা; কেবল কিছুটা উদ্ধৃতির বিভিন্নতা, বাক্যের নান্দনিকতা, উপস্থাপনায় স্বকীয়তা রয়েছে।
______
তথাকথিত আহলে হাদীস নামক বর্তমান সময়ের ভংকর ফিতনা, ভাইরাস সদৃশ বদমাযহাবীরা সকলেই খারিজী, মুতা’জিলা ফির্কার নব্য গঠিত রুপ।
কারণ খারিজীরা কোরআনুল কারীমে বর্ণিত অসংখ্য আয়াত যা সরাসরি তখনকার সময়ের কাফির, মুশরিকদের শিরক-কুফরের বিষয়ে নাযিল হয়েছিল তা তৎকালীন মো’মিনদেরকে কাফির, মুশরিক বলার জন্যে ইতিহাসে নিন্দিত কুখ্যাত খারিজী ফির্কা-সম্প্রদায়টি তাদের উত্থানের সময়ে প্রয়োগ করেছিল।
আর এখন এই নব গঠিত নব্য খারিজী ফির্কাও মু’মিনদের বিষয়ে প্রযোজ্য নয় এরুপ আয়াতকে মু’মিনদের কাফীর মুশরিক বলার জন্যে অপব্যাখ্যামূলক অপচেষ্টা করছে।
হাদীস শরীফ থেকে জানা যায় যারা কোরআন শরীফের এসব আয়াত অর্থাৎ কাফেরদের বিরোধীতায় নাযিলকৃত আয়াতগুলো যদি কেউ মো’মিনদের উপর প্রয়োগ করার অপচেষ্টা করে তাহলে তারা ইসলাম বহির্ভূত / খারিজী; আর হাদিস শরিফে খারিজীদের জাহান্নামের কুকুর বলা হয়েছে।
সুতরাং সকল মু’মিন ভাই-বোন সাবধান!
সকলেই এধরনের ফিতনাওয়ালা নামধারী শায়েখদের থেকে দূরে থাকুন।
তারা আপনার আমার অজান্তেই আমাদের ঈমান খেয়ে ফেলবে।
আল্লাহ্ সকলের ঈমান-আক্বিদা-আ’মাল হিফাজাত করুন, আমীন।