সুফিগণের ভালবাসার পদ্ধতি

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

সুফিগণের তরিকাঃ সবার জন্য ভালবাসা
————————————————————-
সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া আজহারি

মানুষ মূলতঃ দুই প্রকার, ১.ভালবাসার দল (আহলে ইশক) ২.ঘৃণার দল (আহলে বুগজ)।  ভালবাসার দলের মানুষের মন মানসিকতা, কথাবার্তা, চলাফেরা ও আচার আচরন ঘৃনার দলের মানুষের সাথে কোনদিনও মিলবে না।

ভালবাসার অর্থ কী আসলেই আমরা বুঝি? ভালবাসার সবচাইতে ভাল সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে এমন, “কোন সংজ্ঞা দ্বারাই এটাকে ব্যাখ্যা করে বুঝানো সম্ভব নয় এই ভালবাসা কী জিনিস, এমন একটি অনুভূতির নাম ভালবাসা ।”

তবুও এরকম বলা হয়েছে, ميلان القلب الي شيئ لوجود الجمال او الكمال فيه او لاحسان

“কারো প্রতি বা কোন কিছুর প্রতি অন্তর ঝুকে যাওয়া উনার মধ্যকার সৌন্দর্যের জন্য বা ঐ জিনিসে মধ্যকার সৌন্দর্যের জন্য , উনার গুণের পরিপূর্ণতার জন্য বা উনার কোন ইহসানের (উপকার) জন্য। “

মুসলমানদের মধ্যে মূলতঃ দুই প্রকারের লোক আছেন যাদের মধ্যে ঘৃণা আছে। তাদের মধ্য এক প্রকারের  লোক দাবি করেন “আমরা প্রিয় নবিজীর ﷺ ভালবাসাতে বাড়াবাড়ি করি। সারাক্ষণ খালি নবিজীর ﷺ ভালবাসার কথা বলি, দরুদ ও সালামের কথা বেশি বেশি বলি।” আরে ভাই প্রিয় নবিজির ﷺ ভালবাসা আল্লাহর ভালবাসা থেকে আলাদা কিছু নয়। যদি প্রিয় নবিজির ﷺ ভালবাসাকে আলাদা কিছু মনে করেন কেউ তবেই কেবল সমস্যা।

يَحْلِفُونَ بِاللَّهِ لَكُمْ لِيُرْضُوكُمْ وَاللَّهُ وَرَسُولُهُ أَحَقُّ أَن يُرْضُوهُ إِن كَانُوا مُؤْمِنِينَ
তোমাদের সামনে আল্লাহর কসম খায় যাতে তোমাদের রাযী করতে পারে। অবশ্য তারা যদি ঈমানদার হয়ে থাকে, তবে আল্লাহকে এবং তাঁর রসূলকে রাযী করা অধিক জরুরী। (আল কুরআন,  ৯ঃ৬২)

আরবি ব্যকরণ যারা জানেন তারা বুঝবেন, এখানে আল্লাহ ও তার রাসুল ﷺদুজনের জন্য একবচনের সর্বনাম ব্যবহার হয়েছে। يُرْضُوهُ,    এসেছে يرضوهما এর জায়গায়। উনাদের দুজনকে রাজি করা অধিক জরুরী বুঝাতে উনাকে রাজী করা অধিক জরুরী বলা হয়েছে। উদ্দেশ্য একটাই, এটা বুঝানো যে আল্লাহ এবং তার রাসুলের রাজি খুশি একই।

لِّتُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَتُعَزِّرُوهُ وَتُوَقِّرُوهُ وَتُسَبِّحُوهُ بُكْرَةً وَأَصِيلًا
যাতে তোমরা আল্লাহ ও রসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর এবং তাঁকে সাহায্য ও সম্মান কর এবং সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা কর। (আল কুরআন,  ৪৮ঃ৯)

সর্বনাম ব্যবহারের ক্ষেত্রে এখানেও দ্বিবচনের জায়গায় একবচন নেয়া হয়েছে।

مَّن يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ ۖ وَمَن تَوَلَّىٰ فَمَا أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيظًا
যে লোক রসূলের হুকুম মান্য করবে সে আল্লাহরই হুকুম মান্য করল। আর যে লোক বিমুখতা অবলম্বন করল, আমি আপনাকে (হে মুহাম্মদ), তাদের জন্য রক্ষণাবেক্ষণকারী নিযুক্ত করে পাঠাইনি। (আল কুরআন, ৪ঃ৮০)

إِنَّ الَّذِينَ يُؤْذُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَأَعَدَّ لَهُمْ عَذَابًا مُّهِينًا
যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাদের প্রতি ইহকালে ও পরকালে অভিসম্পাত করেন এবং তাদের জন্যে প্রস্তুত রেখেছেন অবমাননাকর শাস্তি। (আল কুরআন,  ৩৩ঃ৫৭)

إِنَّ الَّذِينَ يُبَايِعُونَكَ إِنَّمَا يُبَايِعُونَ اللَّهَ يَدُ اللَّهِ فَوْقَ أَيْدِيهِمْ ۚ فَمَن نَّكَثَ فَإِنَّمَا يَنكُثُ عَلَىٰ نَفْسِهِ ۖ وَمَنْ أَوْفَىٰ بِمَا عَاهَدَ عَلَيْهُ اللَّهَ فَسَيُؤْتِيهِ أَجْرًا عَظِيمًا
যারা আপনার কাছে বায়আত গ্রহন করে, তারা তো আল্লাহর কাছে বায়আত গ্রহন করে। আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর রয়েছে। অতএব, যে শপথ ভঙ্গ করে; অতি অবশ্যই সে তা নিজের ক্ষতির জন্যেই করে এবং যে আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করে; আল্লাহ সত্ত্বরই তাকে মহাপুরস্কার দান করবেন। (আল কুরআন,  ৪৮ঃ১০)

 وَمَا رَمَيْتَ إِذْ رَمَيْتَ وَلَٰكِنَّ اللَّهَ رَمَىٰ ۚ وَلِيُبْلِيَ الْمُؤْمِنِينَ مِنْهُ بَلَاءً حَسَنًا ۚ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
 আর তুমি মাটির মুষ্ঠি নিক্ষেপ করনি, যখন তা নিক্ষেপ করেছিলে, বরং তা নিক্ষেপ করেছিলেন আল্লাহ স্বয়ং যেন ঈমানদারদের প্রতি এহসান করতে পারেন যথার্থভাবে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ শ্রবণকারী; পরিজ্ঞাত। (আল কুরআন,  ৮ঃ১৭)

وَمَا يَنطِقُ عَنِ الْهَوَىٰ
এবং প্রবৃত্তির তাড়নায় কথা বলেন না।

إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَىٰ
কোরআন ওহী, যা প্রত্যাদেশ হয়। (আল কুরআন,  ৫৩ঃ৩-৪)

আল্লাহ ও তার রাসুলের ﷺ জাত আলাদা, অস্তিত্ব আলাদা কিন্তু, বাকি সব এক। রাসুলের ﷺ আনুগত্য, আল্লাহর আনুগত্য, নবিজির ﷺ রাজি- খুশি আল্লাহর রাজি খুশি, নবিজির ﷺ হাত মোবারক আল্লাহর কুদরতি হাত, নবিজির ﷺ কংকর নিক্ষেপ মূলতঃ আল্লাহর কংকর নিক্ষেপ, নবিজির ﷺ হাতে বাইয়াত মূলতঃ আল্লাহর কুদরতি হাতে বায়াত। নবিজির ﷺ কথা মূলতঃ আল্লাহর কথা।নবিজিকে ﷺ সাহায্য করা মূলতঃ আল্লাহকে সাহায্য করা,  নবিজিকে ﷺ সম্মান করা ও ভালবাসা মূলতঃ আল্লাহকে তাজিম করা ভালবাসা। তাহলে এখানে বাড়াবাড়ি কোথা থেকে আসে?

احبوا  الله لما يغذوكم من نعمه واحبوني لحب الله واحبوا اهل بيتي لحبي

সুনান তিরমিজিতে হুজুর রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, তোমরা আল্লাহকে ভালবাস কারন তিনি তোমাদেরকে বহু নিয়ামত দিয়েছেন, আর আমাকে ভালবাস আল্লাহর ভালবাসার ওয়াস্তে, আমার আহলে বায়তকে ভালবাস আমার ভালবাসার ওয়াস্তে।

কাজেই আমরা হুজুর নবিয়ে পাক ﷺ কে ভালবাসি আল্লাহকে ভালবাসার কারনে উনাকে রাজিখুশি করানোর জন্যই।

 যারা বলেন যে নবিজীর ﷺ অনুসরনই নবিজির ভালবাসা, তারা অনেক বড় পরিক্ষার সম্মুখীন। ভালবাসা এক জিনিস আর অনুসরন আরেক জিনিস। ভালবাসার সংজ্ঞা তাই বলে। কারো দিকে আপনার রুহ ঝুকে যাওয়াকে ভালবাসা বলে, আর অনুসরন হচ্ছে ভালবাসার লাওয়াযিমাতের (যা ভালবাসার কারনে আবশ্যক হয় )  অন্যতম।

قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ ۗ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহ ও তোমাদিগকে ভালবাসেন এবং তোমাদিগকে তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাকারী দয়ালু। (আল কুরআন,  ৩ঃ৩১)

আগে ভালবাসা আসে তারপর বলা হচ্ছে অনুসরন।  তাই অনুসরনই ভালবাসা বলাটা বিরাট বড় ভুল। তবে ভালবাসার পর অনুসরন করলেই কেবল আল্লাহর ভালবাসা পাওয়া যায়, তখনই মানুষ অলি বা আল্লাহর বন্ধু হয়। যদি তাই না হত তবে নবিজিﷺশরাব পানের অপরাধে কয়েকবার শাস্তি পাওয়া সাহাবি আব্দুল্লাহ আল হিমার রাঃ র ব্যপারে এই স্বাক্ষ্য দিতেন না যে, তোমরা আমার আব্দুল্লাহ আল হিমারকে লানত করবে না, তিনি আল্লাহ ও তার রাসুলকে ﷺ ভালবাসেন। (সহিহ বুখারি, শাস্তির অধ্যায়, হাদিস নং ৬৩৯৮)

প্রাণের চাইতে অধিক ভালবাসতে বলা হয়েছে, তাই এখানে বাড়াবাড়ির কোথা থেকে আসে? আমরা কেউ প্রাণ দিয়ে কোথায় ভালবাসতে পারলাম রাসুল ﷺ কে?

 রাসুল ﷺ হজরত ওমর রাঃ কে বললেন, না হে ওমর! যতক্ষন না প্রানের চেয়ে বেশি ভালবাস ততক্ষন তোমার ইমান পরিপূর্ন হবে না।

একদিন খালিদ ইবন ওয়ালিদ রাঃ দাওয়াত দিলেন ওমর রাঃ কে। খলিফাকে দাওয়াত দিয়েছেন, আমিরুল মুমিনিনকে। তাইয়া অনেক আইটেম রান্না করা হলো, আমিরুল মুমিনিনের সামনে উপস্থাপন করা হলো। ওমর রাঃ কাদতে শুরু করলেন। খালিদ ইবন ওয়ালিদ রাঃ জিজ্ঞেস করলেন, ما يبكيك يا امير المؤمنين؟

হে আমিরুল মুমিনিন! আপনি কাদছেন কেন?

তিনি জবাব দিলেন, আমার দুইজন সাথী ( প্রিয় নবিজি ﷺ ও আবু বকর রাঃ)  চলে গেছেন,  যারা একটির বেশি দুইটি আইটেম দিয়ে খান নাই কোনদিন, এক নাগাড়ে তিন দিন কোনসময় পেট পুড়ে খান নাই। এই বলে তিনি খাওয়া থেকে ওঠে গেলেন।

এটা ভালবাসা ছিল যা উনার মনে ঐ সময় উদয় হয়েছে। যা উনার মনকে খেতে সায় দেয়াতে পারেনি। ভালবাসা এমনই। ভাল খাওয়া জায়েজ,  হারাম নয়। কয়েক পদ দিয়ে খাওয়াও জায়েজ,  কিন্তু ভালবাসা যখন প্রাণের চেয়ে অধিক কারো প্রতি হয়ে যায় তখন আশিকের অবস্থা এমনই হয়।

আর ভালবাসা হবেই বা না কেন বেশি?

ভালবাসার সংজ্ঞা অনুযায়ী আমরা যদি প্রিয় নবিজির ﷺ  দিকে তাকাই, তাহলে দেখব পৃথিবীর সব সৌন্দর্য তার মাঝে ছিল।

নবিজীর ﷺ বাহ্যিক সৌন্দর্য সম্পর্কে সব চাইতে সুন্দর যা বলা হয়েছে তা হলোঃ

ইউসুফ নবির  সৌন্দর্য্যে বিমোহিত মিশরের রমনীরা ছুরি দিয়ে নিজেদের হাত কেটে ফেললেন,

ইয়া রাসুলাল্লাহ ﷺ! আপনার সৌন্দর্য্যে বিমোহিত সাহাবিগন জিহাদের ময়দানে আপনার জন্য নিজেদের সর (মাথা) কাটিয়ে ফেললেন।

আর নবিজির ﷺ আখলাকি কামাল সম্পর্কে কী বলব? যাদ সম্পর্কে আলাহ তায়ালা বলেন,
وَإِنَّكَ لَعَلَىٰ خُلُقٍ عَظِيمٍ
আপনি অবশ্যই সুমহান চরিত্রের অধিকারী। (আল কুরআন,  ৬৮ঃ৪)

আমাদের প্রতি ইহসান! ইমান পেলাম উনার মাধ্যমে, ইসলাম পেলাম উনার মাধ্যমে,  কুরআন পেলাম উনার মাধ্যমে, স্বয়ং  আল্লাহর সঠিক পরিচয় জানলাম উনার মাধ্যমে। এর চেয়ে বড় ইহসান দুনিয়ার কোন মানুষ কারো উপরে করেছে বলে কেউ চিন্তা করতে পারে?

দরুদ ও সালামে বাড়াবাড়ি কিভাবে আসে?

إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ ۚ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি রহমত প্রেরণ করেন। হে মুমিনগণ! তোমরা নবীর জন্যে রহমতের তরে দোয়া কর এবং তাঁর প্রতি সালাম প্রেরণ কর বেশি বেশি। (আল কুরআন,  ৩৩ঃ৫৬)

নবিজি ﷺ বলেছেম, কেয়ামতের দিন সেই আমার সবচাইতে নিকটে থাকবে যে আমার উপর বেশি বেশি দরুদ পাঠ করে।

শুক্রবারে বেশি বেশি দরুদ পড়তে বলা হয়েছে। দরুদ পাঠের জন্য কোন নির্দিষ্ট দিন বা ক্ষণ ঠিক করে দেয়া হয়নি। বরং যে যত বেশি পড়তে পারেন যখন খুশি।

হজরত উবাই ইবন কা’ব রাঃ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ   يا رسول الله  اني اكثر الصلاة عليك فكم
اجعل لك من صلاتي
আমি আমার ইবাদাতের (ফরজ ইবাদাত আদায় করে বাকি সময়ের কতটুকু) কতটুকু আপনার উপর দরুদ পড়ব? প্রিয় রাসুল ﷺ বললেন, তুমি যেরকম চাও। তিনি বললেন, চার ভাগের একভাগ? প্রিয় নবি ﷺ বললেন,
وان زدت كان خيرا لك

যদি আরো বেশি করতে ভাল হত।

তিন ভাগের দুইভাগ? প্রিয় নবি ﷺ বললেন,
وان زدت كان خيرا لك

যদি আরো বেশি করতে ভাল হত।

তিনি বললেন, অর্ধেক?

وان زدت كان خيرا لك

যদি আরো বেশি করতে ভাল হত।

তিনি বললেন, اجعل لك صلاتي كلها
“আমি আমার সকল সময় দরুদে দিয়ে দেব”।

নবিজি ﷺ বললেন, তাহলে তোমার দুঃখ দূর্দশা সব দূর হয়ে যাবে, তোমাকে ক্ষমা করে দেয়া হবে। “

তাই এখানে বাড়াবাড়ি কোথা থেকে আসে?

আর মানুষের মধ্যকার অপর দল বলে, আমরা মানুষকে আল্লাহর ওয়াস্তেই ঘৃণা করি। অর্থ্যাৎ আল্লাহর রাজি খুশি পাওয়ার জন্যই কাউকে ঘৃণা করি। তাদের দলিল, الحب في الله والبغض في الله

প্রফেসর ড. সায়্যিদ শামিমুদ্দিন আহমেদ মুনায়েমি (মা জি আ) কে জিজ্ঞেস করলাম এই হাদিস খানার ব্যাখ্যা সম্পর্কে। তিনি বললেন, আজহারি সাহেব! আমরা আল্লাহর ওয়াস্তে কাউকে  ঘৃণা করব কিভাবে? যদি তাই হয় তবে আমরা আমাদের নিজেদেরকে কতটুকু ঘৃণা করি?

দুনিয়ার সকল গোনাহ খাতা করার পরও নিজেকে যদি সবচাইতে বেশি ভালবাসতে পারি তবে গোনাহ করার কারনে, অন্যায় করার কারনে অপরকে কিভাবে ঘৃণা করব? বরং আমাদের উচিত কোন মানুষকে নয়, তাদের খারাপ আমল ও গোনাহের কাজগুলোকে ঘৃণা করা। আল্লাহর ওয়াস্তে গোনাহের কাজ ও খারাপ আমলের প্রতি ঘৃণা থাকা।

আর আমরা সবাই তো দ্বীনের দায়ী। ডাক্তার শারীরিক রোগের চিকিৎসা করে৷ কোন ডাক্তার যদি তার রোগীকে রোগের জন্য ঘৃণা করে দূরে সড়িয়ে রাখতে শুরু করে তবে কী ঐ রোগী কোনদিনও ভাল হবে?

আমরা প্রত্যেক মুসলমান দ্বীনের দায়ী। মানুষের কলবি ব্যামারের ডাক্তার। কুফর, মুনাফিকি, আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি দুশমনি, রাগ, লোভ, জিদ- হিংসা, অহংকার, জিনা, ফাহিশ,  মদ, জুয়া ইত্যাদিসহ যত গোনাহ আছে সব আমাদের রোগীর কাছে থাকতে পারে,  কিন্তু সেজন্য কী আমরা কাউকে ঘৃণা করতে পারব? ঘৃণা করলে ঐ কলবি বিমার রোগী ভাল হবে কিভাবে? তাই পাপকে ঘৃণা করা যায়, পাপীকে না।

আমরা সাধারন মানুষ যেন ঐ পথে প্রভাবিত না হই সেজন্য দূরে থাকতে পারি। কিন্তু কোন মানুষকেই ঘৃণা করতে পারি না। সে যে মতবাদ বা ধর্মেরই হোক না কেন। এতটুকু সহনশীলতা আমাদের মধ্যে থাকতে হবে।

ভালবাসা দিয়ে সব জয় করা সম্ভব। আমরা কিন্তু ঐ রাস্তায় হাটি কম। বরং ঘৃণা ও নফরতের রাস্তায় হাটতে শুরু করি। ঘৃণা দিয়ে কিছুই হাসিল হবে না। প্রিয় নবিজি ﷺ তার বড় বড় শত্রুকে ভালবাসা ও আখলাক দিয়ে কাছে টেনে নিয়েছেন। পথে কাটা বিছানো সেই ইহুদি বুড়ি থেকে শুরু করে উনারই ভয়ে অন্য শহরে পলায়ন করা বুড়ি পর্যন্ত। সবাইকে ভালবাসা ও আখলাক দিয়ে জয় করেছেন। কারো মধ্যে খারাপ কোন অভ্যাস দেখলে তাও আদর, সোহাগ ও  ভালবাসা দিয়ে দূর করেছেন। তিনি জিনা করার অনুমতি চাওয়া সেই সাহাবিই হন, শরাবি সেই সাহাবিই হন আর যেই হন। কাউকে হত্যা করার জন্য এগিয়ে যাননি, আক্রমনের স্বীকার হলে প্রতিরক্ষা করেছেন।

সুফিগণও এই তরিকাই অনুসরন করেছেন। ভালবাসা ও উত্তম আখলাক দিয়েই সবাইকে জয় করেছেন। রাজ্য জয় করেছেন মুসলিম শাসকরা। সাধারন মানুষের মন জয় করেছেন সুফিগন এবং তা তলোয়ারের মাধ্যমে হয়নি, কোনদিনও তা সম্ভব ছিল না। আরবের দুই একটা দেশ ছাড়া সারা পৃথিবীর মুসলমান  সুফিগনের মাধ্যমেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। এটা আমি দাবীর সাথে বলতে পারি। শায়খ জাকারিয়া বাহাউদ্দিন মুলতানি রাহঃ যেরকম বলে গেছেন, যদি কোন এলাকার মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দিতে হয় তবে ২ বছত পর্যন্ত মুখে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। বরং সেখানে একটা ব্যবসা দাও। আখলাক ও আমানতদারীর মাধ্যমে সবার সাথে চল এমনিতেই তোমার ধর্মের প্রতি মানুষ আকৃষ্ট হবে।

আগের যুগের সুফিগন ঘন্টার পর ঘন্টা ওয়াজ করেন নি, নসিহত করেন নি, শত শত কিতাব লিখেন নি। কিন্তু তাদের হাতেই মানুষ বাপ দাদা চৌদ্দ পুরুষের ধর্ম ছেড়ে দিয়ে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় চলে এসেছে। তা কিভাবে সম্ভব হয়েছে? ভালবাসা ও উত্তম আখলাকের মাধ্যমে, ঘৃণা হিংসার মাধ্যমে তা সম্ভব ছিল না।

শায়খ হাবিব আলি আল জিফরি সাহেব একজন জাপানী মুসলমানকে জিজ্ঞেস করলেন, ভাই জাপানে তো মুসলমান নেই বেশি। আপনি মুসলমান কিভাবে হলেন? ঐ জাপানী ভাই জবাব দিলেন, আমি না বরং আমার আব্বা ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তিনি ব্যবসা করতেন। তার পাশের দোকানের মালিক ছিলেন ইন্দোনেশিয়ান এক মুসলমান যার দোকানে প্রচুর ব্যবসা হত। আমার আব্বার ব্যবসা উনার দোকানের কারনে বেশি চলত না, তাই আমার আব্বা ঐ ইন্দোনেশিয়ান মুসলমান ভদ্রলোককে ঘৃণা করতেন, হিংসা করতেন। কিন্তু ঐ ইন্দোনেশিয়ান মুসলমান আমার বাবাকে হিংসাও করতেন না, ঘৃণাও করতেন না, আমার বাবার সাথে ভাল ব্যবহার করতেন, হাসিমুখে কথা বলতেন বরং লোকজনকে আমার বাবার দোকানে আসতে বলতেন। এক পর্যায়ে আমার বাবা ব্যবসা বন্ধ করে চলে যাওয়ার সময় ঐ ইন্দোনেশিয়ান ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলেন,  ভাই আমি তোমার সাথে অনেক হিংসা পোষন করেছি, তোমার সাথে বাজে ব্যবহার করেছি, কিন্তু তুমি আমার সাথে হাশিমুখে চলেছ, ভাল ব্যবহার করেছ। তার কারন কী?

ঐ ইন্দোনেশিয়ান ভদ্রলোক জবাব দিলেন, এটা আমার ধর্ম আমাকে করতে শিখিয়েছে। সাথে সাথে আমার আব্বা বললেন, তাহলে আমাকে তোমার ধর্মে শামিল করে নাও ভাই। আমার আব্বা কালিমাহ পড়ে মুসলমান হয়ে গেলেন।

ইসলাম এভাবেই ছড়িয়েছে। ভালবাসা, উত্তম ব্যবহার ও আখলাকের মাধ্যমে।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment