সিররুল আসরার [দ্বিতীয় পর্ব]

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

মূল: গাউসুল আজম শায়খ আবদুল কাদির জিলানী (র.)

ড. এ. এস. এম. ইউসুফ

………………………………..

জগত সৃষ্টির সূচনা

সর্বপ্রথম আল্লাহ তা’আলা স্বীয় জামাল বা সৌন্দর্যের নূর (জ্যোতি) থেকে তাঁর প্রিয় হাবীব নবী করীম মুহাম্মদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সৃষ্টি করেছেন। যেমনিভাবে হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তা’আলা বলেন-

خَلَقْتُ رُوحَ مُحَمَّدٍ مِنْ نُوْرِي وَجْهِي-

“আমি সর্বপ্রথম আমার সত্তার নূর দ্বারা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের রূহ মোবারক সৃজন করেছি। [কাত্তালী, তানযিয়াতুশ শরীফাহ, ১: ৩৭]

নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো এরশাদ করেছেন,

أَوَّلُ مَا خَلَقَ اللَّهُ رُوحِي وَأَوَّلَ مَا خَلَقَ اللهُ نُورِي اَوَّلُ مَا خَلَقَ اللَّهُ الْقَلَمَ وَ أَوَّلُ مَا خَلَقَ اللَّهُ الْعَقْلَ

সর্বপ্রথম আল্লাহ তা’আলা আমার রূহ বা আত্মাকে সৃষ্টি করেছেন। সবার আগে আল্লাহ তা’আলা আমার নূর সৃষ্টি করেছেন। সবকিছুর পূর্বে আল্লাহ তা’আলা কলম সৃষ্টি করেছেন। সর্বাগ্রে আল্লাহ তা’আলা আকল সৃষ্টি করেছেন। [আবু দাউদ আসসুনান হাদিস নং 4700]

فَالْمُرَادُ مِنْهَا شَيْءٌ وَاحِدٌ وَهُوَ الْحَقيقَةُ المَحْمُدِيَّةُ عَلَيْهِ التَّحِبَّةُ وَالثَّناءُ

আর এসবগুলো দ্বারা উদ্দেশ্য একটিই আর তা হল- সর্বপ্রথম আল্লাহ তায়ালা হাকীকতে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম।[ নিশাপুরী, তাফসীরে নিশাপুরী, ৫/১৪২ ]

হুযুর নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের সত্তাকে ‘নূর’ বলা হয়েছে। কারণ, তিনি আল্লাহর মহিমা ও কৃপায় অন্ধকার ও অজ্ঞতা থেকে পূত-পবিত্র।

যেমন আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন-

قَدْ جَاءَكُم مِّنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتَبٌ مُّبِين-

নিশ্চয় তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি নূর (জ্যোতি) ও সুস্পষ্ট কিতাব এসেছে। [সূরা মায়িদা (৫):১৫]

হাকিকতে মুহাম্মদীয়া তথা নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের বরকতময় সত্তাকে আকলও বলা হয়েছে। কেননা, তাঁকে সকল বিষয়ের সন্তুষ্টিগত জ্ঞান দান করা হয়েছে।

আর প্রিয় নবীকে ‘কলম’ দ্বারা এজন্য নামকরণ করা হয়েছে যে, কলম হচ্ছে জ্ঞান প্রসারের মাধ্যম। যেমনিভাবে এ কলম লিপির জগতে জ্ঞানের মূল মাধ্যম ও উপকরণ তেমনিভাবে হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমগ্র সৃষ্টির মূল, জগত সৃষ্টির সূচনা ও আসল। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-

آنَا مِنَ الله وَالْمُؤْمِنُونَ مِنِّي –

আমি আল্লাহ থেকে আর সকল ঈমানদার আমার থেকে। [ইসমাইল হক্কী : তাফসীর-ই রুহুল বয়ান, ৩/২১৭: সাখাবী: মাকাসিদুল হাসানাহ্, ১/৫৫]

আল্লাহ তা’আলা মানবজাতির রূহগুলোকে আলমে লাহুতে হুযূর সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের সত্তা থেকে সুন্দরতম গঠনে প্রকৃত আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন। আলমে লাহুতে এর নাম হুজলাতুল উনস তথা ওই জগতের মানবজাতির ঘর। আর ওটাই মানবজাতির আসল জগত । যখন জাতে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের রূহ মোবারক সৃষ্টির পর চার হাজার বছর অতিবাহিত হল তখন আল্লাহ তা’আলা নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের নূর মুবারক থেকে আরশ সৃষ্টি করলেন। আর অবশিষ্ট জগতসমূহ আরশ থেকে সৃষ্টি করলেন। অতঃপর সৃষ্ট রূহগুলোকে (দেহ ও কায়ায় পরিবর্তন করে) আলমে আসফাল বা সর্ব নিম্নস্তরে স্থানান্তরিত করে দেয়া হল। যেমন আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন-

ثُمَّ رَدَدْنَهُ أَسْفَلَ سَفِلِينَ –

অতঃপর আমি তাকে নিম্ন থেকে নিম্নতর স্তরে প্রত্যাবর্তিত করেছি। [সূরা তীন: 5]

অর্থাৎ প্রথমে তাকে আলমে লাহুত থেকে আলমে জবারুতে স্থানান্তরিত করেছেন। এরপর আল্লাহ তা’আলা ঐরূহগুলোকে দু’হেরমের মধ্যখানে জাবারুতের নূরের পোশাক পরিধান করিয়েছেন। আর এ পোষাকের নাম হচ্ছে রূহে-সুলতানী। অতঃপর তাদেরকে ঐ পোশাকে আলমে মালাকুতেরে দিকে স্থানান্তরিত করলেন এবং এখানে তাদেরকে মালাকুতের নূরের পোশাক দ্বারা সুসজ্জিত করলেন। এটাকে রূহে রাওয়ানী বলা হয়। অতঃপর আলমে মুলকে (এ নশ্বর জগতে) প্রেরণ করে তাদেরকে নূরের পোষাক পরিধান করালেন। আর এটা হল রূহে জিসমানী (কায়িক আত্মা)। অতঃপর আলমে-মূল্‌ক থেকে দেহ ও কায়ার জগত সৃষ্টি করেছেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন-

مِنْهَا خَلَقْتَكُمْ وَفِيهَا نُعِيدُكُمْ وَمِنْهَا تُخْرِجُكُمْ تَارَةً أُخْرَى –

আমি ভূ-পৃষ্ঠ থেকে তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি, সেটার মধ্যেই তোমাদেরকে নিয়ে যাব এবং পুনরায় সেটা থেকে তোমাদেরকে বের করব। [সূরা তোয়াহা, ২০:৫৫]

অতঃপর আল্লাহ তা’আলা রূহগুলোকে কায়ায় প্রবেশের নির্দেশ দিলেন। আর সেগুলো নির্দেশ পেতেই কায়াসমূহে প্রবিষ্ট হয়ে গেল। যেমন আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-

وَنَفَحْتُ فِيهِ مِن رُّوحِي-

এবং আমি তাতে আমার পক্ষ থেকে রূহ সঞ্চার করেছি। [সূরা সোয়াদ (৩৮):৭২]

আর যখন দেহ ও আত্নার মধ্যে সম্পর্ক সুদৃঢ় হল এবং দেহ ও আত্মা ও মধ্যে প্রীতির বন্ধন গড়ে উঠল, তখন সেগুলো তাদের দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা ভুলে গেল যে ওয়াদা তারা স্বীয় রবের সাথে আলমে আরওয়াহে করেছিল যে, আপনিই আমাদের রব। যেমন আল্লাহ তায়ালা এ ঘটনাটি বর্ণনা করে বলেন-

أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ قَالُوا بَلَى-

-আমি কি তোমাদের রব নই? সবাই সমস্বরে বলেছিল, হ্যাঁ, আপনিই আমাদের রব। [সূরা আ’রাফ ৭/১৭২]

এ ভুলের কারণে মানুষ আসল জগতে প্রত্যাবর্তন করলো না। সেজন্য পরম দয়ালু আল্লাহ তায়ালা আসমানী কিতাব অবতীর্ণ করে তাদের মূল ঠিকানার কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। এরশাদ করলেন-

وَذَكَرْهُم بِأَيّامِ اللَّهِ-

আর (হে হাবীব!) আপনি তাদেরকে আল্লাহ তা’আলার (সাথে প্রতিশ্রুতির) দিনগুলো স্মরণ করিয়ে দিন। [সুরা ইবরাহীম, ১৪/৫]

অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালার সাথে মিলনের ঐসব দিন স্মরণ করে দিলেন যেগুলো রূহসমূহ দর্শন করেছে। আর সকল রাসূল ও নবীগণ তাদেরকে ওই দিনসমূহ স্মরণ করিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে পৃথিবীতে আগমন করেছেন। অতঃপর পরজগতে পাড়ি জমান। কিন্তু খুব অল্পসংখ্যক লোকই তাঁদের উপদেশের উপর আমল করেছে এবং তাতে আগ্রহী হয়েছে এবং সফলভাবে তাদের আসল ঠিকানায় পৌছতে পেরেছে। কিন্তু যে সব লোক তাদের প্রতি নিবিষ্ট হল) তাদের হৃদয় আসল জগতের প্রেমে উদ্দোলিত হল এবং তারা সফলভাবে লক্ষ্যস্থলে উপনীত হয়ে গেল। এভাবে শেষ পর্যন্ত নবুয়তের এ মিশন নবুয়ত ও রিসালাতের ধারা সমাপ্তকারী, সঠিক পথনির্দেশক রাসূল মুহাম্মদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করল। এ পৃথীবিতে যেসব মানুষের হৃদয়ে উদাসীনতার পর্দা পড়েছিল তাদের অন্তর্দৃষ্টিকে উদাসীনতার নিদ্রা থেকে সজাগ করার জন্য আল্লাহ তা’আলা তাঁকে প্রেরণ করেছেন। রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে আল্লাহ তা’আলার দিকে, তাঁর সাথে মিলন ও তাঁর অনাদি সৌন্দর্য দর্শনের প্রতি আহ্বান করতে লাগলেন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন-

قُلْ هَذِهِ سَبِيلِي أَدْعُوا إِلَى اللَّهِ عَلَى بَصِيرَةٍ –أنا ومن اتبعني-

হে হাবীব! আপনি বলে দিন এটাই আমার পথ, আমি আল্লাহর প্রতি আহ্বান করছি স্বজ্ঞানে। আমি ও আমার অনুসারীরা অন্তরচক্ষু সম্পন্ন। [সূরা ইউসুফ ১২:১০৮]

এখানে بصيرت (অন্তর্দৃষ্টি) হল আত্মার চক্ষু, যা আউলিয়ায়ে কিরামদের মাধ্যমে অন্ত করণে উন্মোচিত হয়। যা علم ظاهري (প্রকাশ্য জ্ঞান) দ্বারা অর্জিত হয় না বরং علم باطني (অপ্রকাশ্য ইলম) তথা ইলমে লাদুন্নীর মাধ্যমে লাভ হয়। যেমন আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন-

وَعَلَّمْناهُ مِن لَّدُنَّا عِلَّما-

-আমি তাকে (খিযির আলাইহিস সালামকে) আমার বিশেষ জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন। [সূরা কাহফ (১৮):৬৫]

তাই মানুষের জন্য অত্যাবশ্যক হল তারা যেন অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ও আলমে লাহুতের রহস্য সম্পর্কে জ্ঞাত মুরশিদে কামিলের দীক্ষা লাভ করে বাতিনী দৃষ্টি অর্জনে সচেষ্ট হয়।

হে আমার ভাইগণ! সাবধান! তাওবা করে আপন রবের ক্ষমা লাভের জন্য অগ্রসর হও। যেভাবে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন-

وَسَارِعُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِّن رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَوَاتُ والْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ

এবং দ্রুত অগ্রসর হও স্বীয় প্রতিপালকের ক্ষমা ও এমন বেহেশতের প্রতি যার প্রশস্ত আসমান ও যমীনের সমান, যা খোদাভীরুদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। [সূরা আলে ইমরান, ৩/১৩৩]

অতএব তোমরা তরীকতের পথ গ্রহণ কর এবং আধ্যাত্মিক কাফেলা (অভিযাত্রা) গুলোর সাথে আপন রবের প্রতি অগ্রসর হও। কেননা, অতি শীঘ্রই তরিকতের এ পথ বন্ধ হয়ে যাবে। আর তুমি ওই আসলজগতে পৌঁছার কোন সফরসঙ্গী পাবে না। আমরা এ ধ্বংসশীল উপত্যাকায় (নশ্বর পৃথিবীতে) স্থায়ীভাবে অবস্থানের জন্য আসিনি এবং না পানাহার আমাদের আসল উদ্দেশ্য। আর না কু-রিপু ও মন্দচিত্তের স্বাদের পরিতৃপ্তি লাভের জন্য আমরা এসেছি। হে লোক সকল! তোমাদের প্রিয় রাসূল তোমাদের প্রতীক্ষায় ও তোমাদের জন্য চিন্তিত রয়েছেন। যেমন স্বয়ং সরকারে দোআলম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-

غَمِّيْ لِأَجَلٍ أُمَّنِي الَّذِي فَي آخِرِ الزَّمَانِ،

আমার চিন্তা ও উৎকণ্ঠা শেষ যুগে আগমনকারী আমার উম্মতের জন্য ।

[চলবে]

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment