সাহাবা (রা.)-বৃন্দ সম্পর্কে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের আকীদাহ

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

=(অনলাইনের বর্তমান বেহাল দশার পরিপ্রেক্ষিতে)=

-এডমিন

[হায় আফসোস! অনলাইনে, বিশেষ করে ফেইসবুকে ইসলামের অন্তর্ঘাতী শত্রুর দল অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছে। এর মধ্যে ঘি ঢালছেন সুন্নী ঘরানা হতে উৎপন্ন কতিপয় আলেম-উলামা। তাঁরা দাবি করছেন যে সাহাবা কেরাম (রা.)-এর বিষয়টি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের মূল আকীদাগত বিষয় নয়, এ সম্পর্কে কবরে, হাশরে, নশরে ও আখেরাতে প্রশ্ন করা হবে না! মাফ করবেন, কী বল্লেন জনাব? জি, অবশ্যই প্রশ্ন করা হবে! যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে, তাদের কাছে আল্লাহ হিসেব নেবেন বলে জানিয়েছেন। আর এ এক মস্ত ব্যাধি যা বর্তমানে মুসলমানদেরকে কুরে কুরে খাচ্ছে। চলুন, সাহাবা (রা.)-বৃন্দ সম্পর্কে আহলে সুন্নাতের আকীদাহ-বিশ্বাস কী হওয়া উচিত তা আমারই একটি অনুবাদ থেকে জানার চেষ্টা করি। – এডমিন]

*ক্বুর’আন মজীদে বর্ণিত সাহাবায়ে কেরাম (রা.)’এর উচ্চমর্যাদা*

পবিত্র ক্বুর’আনে নিম্নোক্ত আয়াতগুলোর প্রতি লক্ষ্য করুন –

(১) – كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ

অর্থ: তোমরা হলে শ্রেষ্ঠতম ওই সব উম্মতের মধ্যে…। [আল-ক্বুর’আন, ৩/১১০; নূরুল ইরফান]

(২) – وَكَذَلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطاً لِّتَكُونُواْ شُهَدَآءَ عَلَى ٱلنَّاسِ

অর্থ: এবং কথা হলো এই যে, আমি তোমাদেরকে সব উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ করেছি…। [আল-ক্বুর’আন, ২/১৪৩; নূরুল ইরফান]

এই দুটি আয়াতের সরাসরি সম্বোধনের উদ্দিষ্ট পুণ্যাত্মাবৃন্দ হলেন স্বয়ং সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)। প্রথম আয়াতে তাঁদেরকে “সকল জাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠ” উপাধিতে বিভূষিত করা হয়েছে; সমগ্র উম্মাহর রোল-মডেল এবং পথপ্রদর্শক হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে। দ্বিতীয় আয়াতে “মধ্যম প্রকৃতির” মর্মে শব্দগুলো দ্বারা প্রশংসা করার পাশাপাশি তাঁদের জন্য একটি অনন্য সম্মানের কথা বলা হয়েছে: আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন হযরতে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীর জন্য সাক্ষী হবেন, তেমনি সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-ও তাঁদের পরবর্তীদের জন্য সাক্ষী ও অনুকরণীয় আদর্শ হবেন।

(৩) – مُّحَمَّدٌ رَّسُولُ ٱللهِ وَٱلَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّآءُ عَلَى ٱلْكُفَّارِ رُحَمَآءُ بَيْنَهُمْ تَرَاهُمْ رُكَّعاً سُجَّداً يَبْتَغُونَ فَضْلاً مِّنَ ٱللهِ وَرِضْوَاناً سِيمَاهُمْ فِي وُجُوهِهِمْ مِّنْ أَثَرِ ٱلسُّجُودِ ذَلِكَ مَثَلُهُمْ فِي ٱلتَّوْرَاةِ وَمَثَلُهُمْ فِي ٱلإِنجِيلِ كَزَرْعٍ أَخْرَجَ شَطْأَهُ فَآزَرَهُ فَٱسْتَغْلَظَ فَٱسْتَوَىٰ عَلَىٰ سُوقِهِ يُعْجِبُ ٱلزُّرَّاعَ لِيَغِيظَ بِهِمُ ٱلْكُفَّارَ وَعَدَ ٱللهُ ٱلَّذِينَ آمَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّالِحَاتِ مِنْهُم مَّغْفِرَةً وَأَجْراً عَظِيماً

অর্থ: মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রাসূল; এবং তাঁর সঙ্গে যারা আছে, কাফিরদের প্রতি কঠোর এবং পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল, আপনি তাদেরকে দেখবেন রুকূ’কারী, সেজদারত, আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনা করে; তাদের চিহ্ন তাদের চেহারায় রয়েছে সেজদার চিহ্ন থেকে; তাদের এ বৈশিষ্ট্য তাওরীতের মধ্যে রয়েছে এবং তাদের (অনুরূপ) বৈশিষ্ট্য রয়েছে ইনজীলে; যেমন একটা ক্ষেত, যা আপন চারা উৎপন্ন করেছে, অতঃপর সেটাকে শক্তিশালী করেছে, তারপর তা শক্ত হয়েছে, তারপর আপন কাণ্ডের উপর সোজা হয়ে দণ্ডায়মান হয়েছে, যা চাষীদেরকে আনন্দ দেয়, যাতে তাদের দ্বারা কাফিরদের অন্তর (হিংসার আগুনে) জ্বলে; আল্লাহ ওয়াদা করেছেন তাদের সাথে, যারা তাদের মধ্যে ঈমানদার ও সৎকর্মপরায়ণ – ক্ষমা ও মহা প্রতিদানের। [আল-ক্বুর’আন, ৪৯/২৯; নূরুল ইরফান]

এই আয়াতে, “মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল” বাক্যাংশটি একটি দাবি এবং “যারা তাঁর সঙ্গে…” – বাক্যটি সেই দাবির প্রমাণ। পরবর্তী বাক্যাংশটি সমগ্র সাহাবা (রা.)-কুলকে অন্তর্ভুক্ত করে। আল্লাহ তাঁদেরকে আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নুবুওয়াতের প্রমাণ হিসেবে পেশ করেন, আর এর পাশাপাশি তাঁদের তাকওয়া, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং সততার প্রমাণও দেন। যে ব্যক্তি সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-মণ্ডলীর সমালোচনা করে সে কেবল আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নুবুওয়াতেই দোষ খুঁজে বেড়ায় না, বরং পবিত্র কুর’আনের দাবিকেও অস্বীকার করে। এই আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয়, যে ব্যক্তি সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-বৃন্দের প্রতি রাগ ও ক্ষোভ পোষণ করে, সে স্রেফ কোনো কাফেরই হবে; এ যেনো সাহাবায়ে কেরাম (রা.)’বৃন্দের অস্তিত্বই কাফেরদের ক্রোধের কারণ ছিলো। সবশেষে, আল্লাহতায়ালা সাহাবা (রা.)’মণ্ডলীর জন্য তাঁদের ঈমান ও নেক আমলের ওপরে ভিত্তি করে ক্ষমা ও অপরিসীম পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

(৪) – {وَٱلسَّابِقُونَ ٱلأَوَّلُونَ مِنَ ٱلْمُهَاجِرِينَ وَٱلأَنْصَارِ وَٱلَّذِينَ ٱتَّبَعُوهُم بِإِحْسَانٍ رَّضِيَ ٱللهُ عَنْهُمْ وَرَضُواْ عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا ٱلأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَآ أَبَداً ذٰلِكَ ٱلْفَوْزُ ٱلْعَظِيمُ}

অর্থ: এবং সবার মধ্যে অগ্রগামী প্রথম মুহাজির ও আনসার আর যারা সৎকর্মের সাথে তাদের অনুসারী হয়েছে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট; আর তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন বাগানসমূহ (জান্নাতসমূহ), যেগুলোর নিম্নদেশে নহরসমূহ প্রবহমান। তারা সদা-সর্বদা সেগুলোর মধ্যে অবস্থান করবে। এটাই হচ্ছে মহা সাফল্য! [আল-ক্বুর’আন, ৯/১০০; নূরুল ইরফান]

এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীকে দুটি শ্রেণী হিসেবে বর্ণনা করেছেন। প্রথমটি হলেন “মুহাজির” এবং দ্বিতীয়টি “আনসার”। তাঁরা নিঃশর্তভাবে একটি “মহান সাফল্যের” সুসংবাদের পাশাপাশি চারটি (ঐশী) অনুগ্রহ লাভের নিশ্চয়তা পেয়েছেন। এই চারটি প্রতিশ্রুতি হলো:

১/ আল্লাহতায়ালা তাঁদের প্রতি চির সন্তুষ্ট;

২/ তাঁরা আল্লাহর প্রতি সর্বদা সন্তুষ্ট;

৩/ তাঁদের জন্য জান্নাত প্রস্তুত করা হয়েছে;

৪/ তাঁরা জান্নাতে চিরকাল অবস্থান করবেন।

(৫) – {وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ آمِنُواْ كَمَآ آمَنَ ٱلنَّاسُ قَالُوۤاْ أَنُؤْمِنُ كَمَآ آمَنَ ٱلسُّفَهَآءُ أَلاۤ إِنَّهُمْ هُمُ ٱلسُّفَهَآءُ وَلَـٰكِن لاَّ يَعْلَمُونَ}

অর্থ: এবং যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘ঈমান আনো যেমন অপরাপর লোকেরা ঈমান এনেছে,’ তখন তারা বলে, ‘আমরা কি নির্বোধদের মতো ঈমান নিয়ে আসবো?’ শুনছো! তারাই হলো নির্বোধ; কিন্তু তারা জানে না। [আল-ক্বুর’আন, ২/১৩; নূরুল ইরফান]

এই আয়াতটি সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের ঈমানকে পরিপূর্ণ এবং এর পাশাপাশি আল্লাহর দৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় মানদণ্ড হিসেবে ঘোষণা করেছে। সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীর ঈমানের মাপকাঠিতে পরিমাপ না করা পর্যন্ত মানুষের ঈমান পূর্ণ হবে না। ঈমানের গ্রহণযোগ্য মানদণ্ড হচ্ছেন সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম); তাই যে ব্যক্তি সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের ঈমানের সমালোচনা করে, সে বাস্তবিকই মুনাফিকদের পথ ধরেছে। যে ব্যক্তি সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীকে অজ্ঞ-মূর্খ মনে করে, আল্লাহর দৃষ্টিতে সে ব্যক্তি-ই প্রকৃতপক্ষে গণ্ডমূর্খ। সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের মাঝে যারাই দোষ খুঁজে বেড়ায়, তারা তাদের নিছক অজ্ঞতা, সংকীর্ণতা, প্রমাদ ও জ্ঞানের অভাবের কারণে তা করে থাকে।

আমার উদ্দেশ্য সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীর মর্যাদাসম্পর্কিত সমস্ত আয়াতকে পরিবেষ্টন করা নয় এবং যা উল্লেখ করা হয়েছে তা থেকে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যথেষ্ট হবে যে তাঁরা আল্লাহর দরবারে মকবূল তথা গৃহীত হয়েছেন এবং তাঁদেরকে জান্নাতের ওয়াদা করা হয়েছে। যাঁরা এটা গ্রহণ করতে ইচ্ছুক তাঁদের জন্য ওপরের পাঁচটি আয়াতই যথেষ্ট। যারা গ্রহণ করতে ইচ্ছুক নয় তাদের জন্য পুরো কুরআন মজীদ উদ্ধৃত করা হলেও তা পর্যাপ্ত হবে না।

*হাদীস শরীফে বর্ণিত সাহাবায়ে কেরাম (রা.)’এর উচ্চমর্যাদা*

নিম্নের হাদীসগুলোর প্রতি লক্ষ্য করুন –

(১) – عَنْ عَبْدِ اللهِ ـ رضى الله عنه ـ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ: خَيْرُ النَّاسِ قَرْنِي، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ

অর্থ: হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফরমান: “সর্বোত্তম হলো আমার যুগের মানুষেরা। তারপর উত্তম হলো এদের পরবর্তী যুগের মানুষেরা; তারপর উত্তম হলো তাদের পরবর্তী যুগের মানুষেরা।” [সহীহ বুখারী, ২৬৫২, বই-৫২, হাদীস-১৬; মুসলিম, ২য় খণ্ড, ৩০৯ পৃষ্ঠা]

(২) – عَنْ عُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَكْرِمُوا أَصْحَابِي فَإِنَّهُمْ خِيَارُكُمْ

অর্থ: হযরত উমর ফারূক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরশাদ ফরমান: “আমার সাহাবাদেরকে সম্মান করো! কেননা নিশ্চয় তারা তোমাদের মাঝে সর্বোত্তম।” [মিশকাতুল মাসাবীহ, ৬০১২]

(৩) – و عن جابر رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال: لاَ تَمَسُّ النَّارُ مُسْلِمًا رَآنِي أَوْ رَأَى مَنْ رَآنِي

অর্থ: ”জাহান্নামের আগুন এমন মুসলিম ব্যক্তিকে ছুঁবে না, যে আমাকে দেখেছে, অথবা আমার দর্শনলাভকারী কাউকে দেখেছে।” [জামিউত্ তিরমিযী, ১ম খণ্ড, বই-৪৬, হাদীস-৩৮৫৮]

(৪) – عن أنس رضي الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم مثل أصحابي في أمتي كالملح في الطعام لا يصلح الطعام إلا بالملح

অর্থ: “আমার উম্মতের মাঝে আমার সাহাবাদের উপমা হচ্ছে খাবারে লবণের মতো; খাবার সুস্বাদু/পরিশুদ্ধ হয় না লবণ মেশানো ছাড়া।” [মিশকাত, ৫৫৪ পৃষ্ঠা]

(৫) – فَمَنْ أَحَبَّهُمْ فَبِحُبِّي أَحَبَّهُمْ وَمَنْ أَبْغَضَهُمْ فَبِبُغْضِي أَبْغَضَهُمْ

অর্থ: “যে ব্যক্তি আমার সাহাবাদেরকে ভালোবাসে, সে আমাকে ভালোবাসার খাতিরেই তাদেরকে ভালোবাসে, আর যে লোক আমার সাহাবাদের প্রতি বৈরি মনোভাব পোষণ করে, সে প্রকৃতপক্ষে আমারই প্রতি বৈরিভাবের কারণে তা পোষণ করে থাকে।” [মিশকাতুল মাসাবীহ, ৬০১৪; তিরমিযী ৩৮৬২]

*সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে গালমন্দ করা নিষেধ*

হাদীসসমূহে যেমন সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’মণ্ডলীর অগণিত ফযীলত বর্ণনা করা হয়েছে, তেমনি তাঁদেরকে অপমান করার বিরুদ্ধেও নিষেধ করা হয়েছে। নিম্নবর্ণিত হাদীসগুলোকে বিবেচনা করুন:

(১) – اللهُ اللهَ فِي أَصْحَابِي لَا تَتَّخِذُوهُمْ غَرَضًا مِنْ بَعْدِي

অর্থ: আল্লাহকে ভয় করো, আল্লাহকে ভয় করো আমার সাহাবাদের ব্যাপারে। আমার (বেসালের) পরে তাদেরকে সমালোচনার পাত্র হিসেবে গ্রহণ কোরো না। [মিশকাতুল মাসাবীহ, ৬০১৪ (৮); তিরমিযী, ৩৮৬২]

(২) – لَا تَسُبُّوا أَصْحَابِي فَلَوْ أَنَّ أَحَدَكُمْ أَنْفَقَ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا مَا بَلَغَ مُدَّ أَحَدِهِمْ وَلَا نصيفه

অর্থ: তোমরা আমার সাহাবাদেরকে গালমন্দ কোরো না। কেননা তোমাদের মধ্যে কেউ যদি ওহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণও আল্লহর পথে ব্যয় করে, তবুও মর্যাদায় তা তাদের ব্যয়কৃত এক মুদ্দ কিংবা অর্ধ মুদ্দ (যব/গম)-এর সমান সওয়াবে পৌঁছুতে সক্ষম হবে না। [মিশকাতুল মাসাবীহ, ৬০০৭ (১); সহীহ বুখারী, ৩৬৭৩; মুসলিম, ২২১-(২৫৪০); তিরমিযী ৩৮৬১; আবূ দাউদ, ৪৬৫৮ ইত্যাদি] {নোট: ১ মুদ্দ সমান ৭৫০ মি.লি.)}

(৩) – إِذَا رَأَيْتُمُ الَّذِينَ يَسُبُّونَ أَصْحَابِي فَقُولُوا لَعْنَةُ اللهِ عَلَى شَرِّكُمْ

অর্থ: যারা আমার সাহাবাদেরকে গালিগালাজ করে, তাদের দেখলে তোমরা বলবে: ‘তোমাদের দুষ্কর্মের প্রতি আল্লাহতায়ালার অভিসম্পাত।’ [সুনানে তিরমিযী, ৩৮৬৬; মিশকাত ৬০১৭]

এই বর্ণনাটি ব্যাখ্যা করার সময় আমার পরামর্শদাতা মওলানা ইঊসুফ লুধিয়ানভী সাহেব নিম্নলিখিত জ্ঞানের রত্নগুলি ভাগাভাগি করেছেন, যা কেবলমাত্র ধার্মিকদের অন্তরেই অনুপ্রাণিত হয়:

(ক) – এই বর্ণনায় “অভিসম্পাত” শব্দের অর্থ কেবল অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহার করা নয়, বরং এতে এমন কোনো তিরস্কারের শব্দ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যা সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু অনহুম)-কে যে কোনোভাবে হেয় করতে পারে। এ থেকে বোঝা যায় যে, সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে গালি দেওয়া বা অসম্মান করা জায়েজ নয়। যে ব্যক্তি তা করবে সে অভিশপ্ত হবে এবং আল্লাহর রহমতের গণ্ডি থেকে বহিষ্কৃত হবে।

(খ) – সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’বৃন্দের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বরকতময় অন্তরকে কষ্ট দেয়। এটা তাঁর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট – وَمَنْ أَبْغَضَهُمْ فَبِبُغْضِي أَبْغَضَهُمْ – “আর যে লোক আমার সাহাবাদের প্রতি বৈরি মনোভাব পোষণ করে, সে প্রকৃতপক্ষে আমারই প্রতি বৈরিভাবের কারণে তা পোষণ করে থাকে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বরকতময় অন্তরে দুঃখ সৃষ্টি করলে নেক আমল তথা পুণ্যদায়ক কর্মের পুরস্কার নষ্ট হয়ে যাওয়ার সমূহ বিপদ রয়েছে।

আল্লাহতায়ালা ক্বুর’আন মজীদে ঘোষণা করেন:

أَن تَحْبَطَ أَعْمَالُكُمْ وَأَنتُمْ لاَ تَشْعُرُونَ.

অর্থ: যেনো কখনো তোমাদের কর্মসমূহ নিষ্ফল না হয়ে যায়। [আল-ক্বুর’আন, ৪৯/২; নূরুল ইরফান]

সুতরাং, সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-কে গালিগালাজ করলে কারো ঈমান হারানোর সমূহ সম্ভাবনা থাকতে পারে। [বঙ্গানুবাদকের নোট: এর কারণ এটা প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর সাথে প্রকাশ্য দুশমনি]

(গ) – সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের সম্মান রক্ষা করা এবং তাঁদের প্রতি উত্থাপিত অভিযোগের জবাব দেওয়া একটি ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা।

(ঘ) – রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেননি যে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’মণ্ডলীর বিরুদ্ধে প্রতিটি সমালোচনারই বিস্তারিত জবাব দিতে হবে, কারণ এর ফলে উত্তর ও পাল্টা জবাবের একটি অন্তহীন প্রক্রিয়া চালু হবে। তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন একটি সামগ্রিক ও মুখ্য জবাব দেওয়া উচিত, যা হলো – لَعْنَةُ اللهِ عَلَى شَرِّكُمْ – মানে “তোমাদের মন্দ বা দুষ্কর্মের প্রতি আল্লাহতায়ালার অভিসম্পাত।”

(ঙ) – ওপরের – شَرِّكُمْ – তথা “তোমাদের (মধ্যে অধিকতর) মন্দ” মর্মে বাক্যটির দুটি সম্ভাব্য অর্থ রয়েছে। এতে – شرّ – ‘মন্দ’ শব্দটি একটি ব্যক্তিগত সর্বনামের সাথে সংযুক্ত (মানে তোমাদের), যা দ্বারা বোঝাবে: “আল্লাহর অভিসম্পাত তোমাদের মন্দের ওপরে পতিত হোক, যা সর্বত্র বিস্তৃত হয়েছে।” দ্বিতীয় সম্ভাব্য অর্থ হবে এই যে, ‘মন্দ’ শব্দটি তীব্রতা ও তুলনার একটি মাত্রাকে বোঝায়। তাই এতে বোঝাবে, তোমাদের ও সাহাবাদের মধ্যে (তুলনায়) যারা অধিকতর মন্দ তাদের ওপরে আল্লাহর লা’নত পড়ুক। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই বাক্যটিতে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে যারা গালাগালি করে, তাদের প্রতি সূক্ষ্ম একটি সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করেছেন। কেউ এ নিয়ে চিন্তা করলে উপলব্ধি করতে পারবেন, যারা সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে অবজ্ঞা করে তাদের শেকড় কেটে দেয়া হয়েছে। এটা অনেকটাই স্পষ্ট যে, সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’বৃন্দ যাই হোন না কেন, তাঁরা সর্বদা আপনাদের চেয়ে উত্তম হবেন। আপনারা হয়তো বাতাসে উড়তে পারবেন, আকাশে উঠতে পারবেন বা একশত জীবন (মানে দীর্ঘ জীবন) যাপন করতে পারবেন কিন্তু কখনোই সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীর মর্যাদায় উন্নীত হতে পারবেন না। এমন চোখ কোথায় পাবেন যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্দর চেহারা মোবারক দেখেতে পেরেছে? এমন কান কোথায় পাবেন যা আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কথা শ্রবণ দ্বারা সম্মানিত হয়েছে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দীপ্তিতে আলোকিত এমন হৃদয় কোথায় পাবেন? আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বারা অনুপ্রাণিত এমন মন কোথায় পাবেন? এমন হাত কোথায় পাবেন যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বরকতময় ত্বক স্পর্শ করতে পেরেছে এবং সারা জীবন সুঘ্রাণময় থেকেছে? তাঁর বরকতময় সাহচর্যের দিকে যেতে গিয়ে যে পায়ে ফোসকা পড়েছিলো, তা কোথায় পাবেন? এমন জায়গা কোথায় পাবেন যেখানে জগতের নেতৃত্বদাতা কর্তৃত্ব করেছিলেন? এমন সমাবেশ কোথায় পাবেন যেখানে উভয় জগতের সাফল্যের পানপাত্র পরিবেশন করা হচ্ছিলো? এমন পরিবেশ কোথায় পাবেন যেখানে ‘মনে হয় যেনো আল্লাহকে আমার সামনে দেখছি’ – এই অনুভূতি সর্বদা বিরাজমান ছিলো? কোথায় পাবেন এমন সমাবেশ যেখানে পরিবেশ ছিলো ‘যেনো পাখিরা আমাদের মাথায় ঘোরাফেরা করছে?’ কোথায় পাবেন সেই তিমি মাছের তন্তুজাত সুগন্ধি দ্রব্য, যার সুঘ্রাণময় হাওয়ায় মদীনা মুনাওয়ারার রাস্তা-ঘাট ছিলো সুবাসিত? এমন ভালোবাসা কোথায় পাবেন যা আশেক্ব/(খোদা)-প্রেমিককে স্রেফ প্রেমাস্পদের দিকে তাকিয়ে থাকতেই ঘুম থেকে বিরত রাখে? সারা পৃথিবী আলোকিত করে এমন ঈমান কোথায় পাবেন? আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক অনুমোদিত মানদণ্ড অনুযায়ী সুনির্দিষ্টভাবে সম্পাদিত আমল/কর্মগুলো কোথায় পাবেন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শ অনুকরণকারী এমন চরিত্র কোথায় পাবেন? ‘আল্লাহর রঙে’ রঞ্জিত এমন রং কোথায় পাবেন? আপনারা এমন আচরণ কোথায় পাবেন যা অবলোকনকারীদেরকে তা অনুকরণ করতে অনুপ্রাণিত করে? এমন সালাত কোথায় পাবেন যেখানে ইমামতি করেছিলেন সকল পয়গাম্বর (আলাইহিমুস্ সালাম)-এর ইমাম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)? আপনারা কীভাবে এমন একটি জামা’আত গঠন করবেন যার ইমাম সকল পয়গাম্বর (আলাইহিমুস সালাম)-এর সাইয়্যেদ? আপনারা সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে এক লক্ষবার গালি দিতে পারেন, কিন্তু আপনাদের অন্তরে গভীরভাবে তাকান এবং স্বীকার করুন: আপনারা কি তাঁদের চেয়ে খারাপ নন? তাঁরা যদি ঘৃণা ও তিরস্কারের যোগ্য হন, তাহলে আপনারা কি ক্রোধ ও অভিশাপের যোগ্য নন? যদি আপনারা ন্যায়পরায়ণ হন এবং বিনয়ের কোনো লেশচিহ্নও আপনাদের মাঝে থেকে থাকে, তবে আপনাদের আত্মার গভীরে অনুসন্ধান করুন এবং সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীর ব্যাপারে চুপ থাকুন।

আল্লামা তীবী (রাহিমাহুল্লাহ) সাইয়্যিদুনা হাসান ইবনে সাবিত (রাদিয়াল্লাহু আনহু)’এর একটি অনন্য কবিতা উদ্ধৃত করেছেন এবং এই রওয়ায়াত/বর্ণনার ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেছেন:

তুমি কি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে গালি দাও,

যবে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সমকক্ষ নও?

তোমাদের দু জনের মধ্যে যে লোকটি মন্দতর,

সে হোক উৎসর্গিত ওই পুণ্যাত্মার তরে, যিনি তোমার চেয়েও শ্রেয়তর। (ভাবানুবাদ)

(চ) – এই বর্ণনা থেকে এটাও বোঝা যায়, যে ব্যক্তি সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে গালি দেয় সে অহংকারী, দাম্ভিক এবং হীন। যদি কেউ অন্যের কর্মের সমালোচনা করে, তবে সে বোঝায় সমালোচিত জন কোনো এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে তার থেকে নিকৃষ্ট। সুতরাং, উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো ব্যক্তি মন্তব্য করে এ মর্মে যে, কোনো নির্দিষ্ট সাহাবী (রা.) ন্যায়বিচার ও নিরপেক্ষতার চাহিদা পূরণ করেননি, তাহলে এর অর্থ হবে, এই ব্যক্তি যদি ওই সাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু আনহুর মতো একই অবস্থানে থাকতো, তাহলে সে আরো ভালোভাবে ন্যায়বিচারের পূর্বশর্ত পূরণ করতো, যেনো সে সাহাবী (রা.)’এর চেয়েও ন্যায়পরায়ণতার বেলায় উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন। এটি অহংকারের পাপ এবং আত্মম্ভরিতার ভ্রষ্টাচরণ যা কাউকে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’এর প্রতি গালি দিতে প্ররোচিত করে থাকে। এই মন্দের সংশোধন প্রয়োজন, যা ওপরের এই হাদীসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইঙ্গিত করেছেন।

(ছ) – এ বর্ণনায় কারো সাথে আলোচনায় প্রবৃত্ত হবার ও বিতর্কের আদবও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কোনো প্রতিপক্ষকে সরাসরি “আপনি অভিশপ্ত হতে পারেন!”- মর্মে এই কথা দ্বারা সম্বোধন করা উচিত নয়। এর পরিবর্তে তাকে বলা উচিত: “আপনাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সবচেয়ে মন্দ সে অভিশপ্ত হোক!” এটি এমন একটি নিরপেক্ষ পন্থা যার সাথে সকলেই একমত হবেন এবং কারো পক্ষে এটি নিয়ে বিতর্ক করার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে প্রশ্ন এখনো রয়ে গেলো “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি বেশি মন্দ”- মর্মে এই বাক্যাংশ দ্বারা কাকে উল্লেখ করা হয়েছে? সমালোচককে? নাকি যাঁর সমালোচনা করা হয়েছে তাঁকে? এর উত্তর পাওয়া কঠিন নয় এবং উভয়ের স্ব স্ব সামষ্টিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে যে কোনো সহজ-সরল মনের মানুষ সহজেই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারবেন এই বিষয়ে যে সাহাবা কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) মন্দ, নাকি মূর্খ সমালোচক?

(জ) – এই বর্ণনায় উম্মাহকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে – فَقُولُوا – “তোমরা (সমালোচককে) বলবে,” যা দ্বারা বোঝায়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবা (রা.)-বৃন্দের সমালোচককে এই উম্মতের অংশ বিবেচনা করেন না। পক্ষান্তরে, সমালোচক এই উম্মাতের বিরোধিতাকারী গোষ্ঠী থেকে আবির্ভূত। এটি সেসব লোকের জন্য একটি কঠোর সতর্কবাণী যারা সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-কে গালিগালাজ করে, অন্যান্য সীমালঙ্ঘনের মতো যার জন্য উপদেশ দেওয়া হয়েছে: “সে আমাদের থেকে নয়।”

(ঝ) – এ বর্ণনা থেকে এটাও বোঝা যায়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে ইসলামের হুকুম-আহকামের উচ্চমর্যাদার (তাকিদের) ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন, একইভাবে তিনি সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীর সম্মান রক্ষার তাকিদের ব্যাপারেও সতর্ক ছিলেন। ইসলামের মূল ভিত্তি তাঁদের উপরেই গড়ে উঠেছে। বর্ণনাটি আমাদেরকে আরো জানায়, যারা সাহাবায়ে কেরাম (রা.)’বৃন্দের কুৎসা রটনা করে তারা ঠিক তাদেরই মতো যারা ইসলাম থেকে দূরে সরে গেছে। এ ধরনের লোকদের তিরস্কার করার জন্য উম্মতকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই বিষয়বস্তুটি অন্যান্য বর্ণনায়ও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে [ দেখুন- মাসিক বাইয়্যিনাত, মুহর্রম ১৩৯০ হিজরী]:

যে ব্যক্তি তাঁদের (সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) অভিশাপ দেয় তার উপর আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাবৃন্দ এবং সকল মানুষের লা’নত বর্ষিত হোক। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার কাছ থেকে কোনো নেক আমল কবুল করবেন না, তা হোক না ফরয অথবা নফল। [তাফসীরে ক্বুরতুবী, ১৬তম খণ্ড, ২৯৭-২৯৮ পৃষ্ঠা]

*সাহাবায়ে কেরাম (রা.) তাঁদের নিজের ভাষায়*

সাইয়্যিদুনা সাঈদ ইবনে যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু, যিনি (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক) বেহেশত লাভের আগাম সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন সাহাবার একজন, তিনি বলেন:

و الله لمشهد رجل منهم مع رسول الله صلى الله عليه وسلم يغبر فيه وجهه فيه خير من عمل أحدكم عمره ولو عمر عمر نوح.

অর্থ: আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোনো সাহাবী (রা.) যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর সাহচর্যে যে অল্প সময়ই অতিবাহিত করুন না কেন, যার দরুন হযতো তাঁর মুখমণ্ডল ধুলোয় ঢেকে গিয়ে থাকতে পারে, তা তোমাদের (অ-সাহাবীদের) যে কারো সারা জীবনের ইবাদতের চেয়েও বেশি মূল্যবান, এমন কী যদি তোমাদের প্রতি পয়গাম্বর নূহ ‘আলাইহিস্ সালামের দীর্ঘ হায়াতও মঞ্জুর করা হয়। [আবূ দাউদ, ৬৩৯ পৃষ্ঠা; মুসনাদে আহমদ (হাম্বল), ১ম খণ্ড, ১৮৭ পৃষ্ঠা]

*’আক্বীদা-বিশ্বাসের আলোকে সাহাবায়ে কেরাম (রা.)’কে হেয় প্রতিপন্ন করা নিষেধ*

পবিত্র ক্বুর’আন ও হাদীসে এই বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাতের আক্বীদা-বিশ্বাসের বইগুলি দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করে যে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলী ন্যায়পরায়ণ এবং বিশ্বস্ত ছিলেন, এবং তাঁরা যে কোনো ধরনের নিন্দার ঊর্ধ্বে ছিলেন। যে কেউ তাঁদের বদনাম করলে তার ঈমান ও ইসলাম প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং এমন ব্যক্তি শাস্তির যোগ্য হবে। সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত (তাঁরা হানাফী, শাফেঈ, মালিকী বা হাম্বলী মাযহাবেরই হোন না কেন) সকলেই তাঁদের বিশ্বাসে একমত এবং তাঁদের মধ্যে (এ ব্যাপারে) কোন ভিন্নতা নেই।

আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদাহ-বিশ্বাসমূলক গ্রন্থাবলী থেকে আমাদের দলিল গ্রহণ করা উচিত, যেগুলোতে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে হেয় করার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়েছে। এগুলোকে আপনাদের জীবনের মূলনীতি করুন এবং একই সাথে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে অপমানকারীদের ব্যাপারে ধর্মীয় রায় সম্পর্কেও সচেতন হন।

আল-আকীদাহ আল-তাহাবিয়্যাহ শিরোনামের গ্রন্থটি আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাতের একটি নির্ভরযোগ্য রচনা। এতে ইমাম আবু জা’ফর আল-তাহাভী রাহিমাহুল্লাহ (বেসাল: ৩২১ হিজরী) আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা সংক্ষিপ্তভাবে সংকলন করেছেন, যা হাদীসের পণ্ডিতদের পদ্ধতির সাথে সাথে তিনজন আইয়েম্মাহ তথা ইমাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহ (বেসাল: ১৫০ হিজরী), ইমাম আবু ইউসুফ রাহিমাহুল্লাহ (বেসাল: ১৮২ হিজরী) এবং ইমাম মুহাম্মদ রাহিমাহুুল্লাহ (বেসাল: ১৮৯ হিজরী) প্রমুখের বক্তব্যের ওপরে ভিত্তিশীল। আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের সকল অনুসারী এই অনুকরণীয় সংকলনকে প্রজন্মান্তরে গ্রহণ করেছেন এবং এটি সর্বত্র অধ্যয়ন ও পাঠদান অব্যাহত রয়েছে। বর্তমান যুগেও সৌদি আরবে এই গ্রন্থ পড়ানো হয়।

উক্ত গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে,

و نحب أصحاب النبي صلى الله عليه و سلم و لا نفرط في حب أحد منهم ، ولا نتبرأ من أحد منهم ، ونبغض من يبغضهم وبغير الحق لا نذكرهم، نذكرهم إلا بخير ، وحبهم دين وإيمان وإحسان ، وبغضهم كفر ونفاق وطغيان … إلى قوله … ومن أحسن القول في أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم و أزواجه و ذريارته فقد برئ من النفاق.

অর্থ: “…এবং আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সকল সাহাবী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে ভালোবাসি। আমরা তাঁদের কারো প্রতি আমাদের ভালবাসায় চরমে যাই না এবং তাঁদের কাউকে বর্জনও করি না। যারা ঘৃণা পোষণ করে বা তাঁদের সম্পর্কে খারাপ কথা বলে আমরা তাকে ঘৃণা করি। আমরা তাঁদের সম্পর্কে কেবল ভালো কথা বলি। তাঁদের প্রতি ভালোবাসা দ্বীন, ইসলাম ও তাকওয়ার অংশ। তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ কুফর, ভণ্ডামি ও মন্দদায়ক… যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের সম্পর্কে ভালো কথা বলেন, তাঁর স্ত্রী ও পরিবারবর্গ মুনাফেকী/কপটতা থেকে মুক্ত।” [আল-আক্বীদাতুত্ তাহাবীয়্যাহ, ১১১-১২ পৃষ্ঠা]

ইমাম মালিক রহমতুল্লাহি আলাইহি (বেসাল: ১৭৯ হিজরী) হতে বর্ণিত হয়েছে,

ومن شتم أصحابه أدب وقال أيضا من شتم واحدا من أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم أبا بكر أو عمر أو عثمان أو معاوية أو عمرو بن العاص فإن قال كانوا في ضلال قتل و ان شتم بغير هذا من مشاتمة الناس نكالا شديدا.

অর্থ: যে ব্যক্তি সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীকে গালি দেয় তাকে শাস্তি দেয়া উচিত। যে ব্যক্তি বলে, সাহাবী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-দের মধ্যে যে-ই হোন, হযরত আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু, কিংবা হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু, অথবা হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু, বা হযরত মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু কিংবা ‘আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রমুখ গোমরাহ ছিলেন, তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া উচিত। সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের বিরুদ্ধে কেউ অশ্রাব্য ভাষা প্রয়োগ বা বেয়াদবিমূলক আচরণ করলে তাকে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। [রাসায়েলে ইবনে আবেদীন শা’মী, ১ম খণ্ড, ৩৫৮ পৃষ্ঠা]

মায়মূনী (রহ.) বর্ণনা করেছেন যে তিনি ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ’কে বলতে শুনেছেন:

وقال الميموني سمعت أحمد يقول: ما لهم ولمعاوية رضي الله عنه نسئل الله العافية وقال يا أبا الحسن إذا رأيت أحدا يذكر أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم بسوء فاتهمه على الإسلام.

অর্থ: “হযরত মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) সম্পর্কে কুৎসা রটনাকারী লোকদের কী হলো? আমরা আল্লাহর কাছে সুস্থ (বিবেকের) জন্য একান্ত প্রার্থনা করি!” অতঃপর ইমাম আহমদ (রহমতুল্লাহি আলাইহি) বলেন: “ওহে আবূল হাসান! তুমি যখনই দেখবে কেউ সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) সম্পর্কে মন্দ উক্তি করছে, তৎক্ষণাৎ তার ইসলাম সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করবে।” [আল-সা’রিমুল মাসলূল, ৫৭৩ পৃষ্ঠা]

ইমাম আবূ যুরা’আহ আল-রাযী (রহমতুল্লাহি আলাইহি – বেসাল: ২৬১ হিজরী) বলেন:

إذا رأيت الرجل ينتقص أحدا من أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم فأعلم أنه زنديق.

অর্থ: তুমি যখন কোনো ব্যক্তিকে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’বৃন্দের কোনো একজনকে হেয় করতে দেখবে, তখন জানবে সে একজন যিনদিক্ব/ধর্মদ্রোহী বা ধর্মত্যাগী অবিশ্বাসী। [আল-ইসা’বাহ, ১ম খণ্ড, ২২ পৃষ্ঠা]

ইমাম আবূ বকর সারাখসী (রহমতুল্লাহি আলাইহি – বেসাল: ৪৮৩ হিজরী) লেখেন:

إن الله تعالى أثنى عليهم في غير موضع من كتاب كما قال تعالى “محمد رسول الله والذين معه” (الآية) ورسول الله صلى الله عليه وسلم وصفهم بأنهم خير الناس فقال “خير الناس قرني الذين أنا فيهم” والشريعة إنما بلغتنا بنقلهم، فمن طعن فيهم فهو ملحد منابذ للإسلام دواؤه السيف إن لم يتب.

অর্থ: নিঃসন্দেহে আল্লাহ পবিত্র ক্বুর’আনের বিভিন্ন স্থানে সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের প্রশংসা করেছেন; উদাহরণস্বরূপ: “মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসূল..।” আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদেরকে “মানবজাতির মাঝে সর্বোত্তম” বলে বর্ণনা করেছেন তাঁরই বিবৃতিতে: “আমি যে যুগে আছি সেই যুগের মানুষই সেরা।” ইসলামের বিধি-বিধান আমাদের কাছে পৌঁছেছে তাঁদের প্রচারের মাধ্যমে, তাই যে কেউ তাঁদের প্রতি সীমালঙ্ঘনকারী বলে গালি দেয় সে ইসলামের বিরুদ্ধে চলে গেছে। যদি সে নিবৃত্ত না হয়, তবে তার একমাত্র নিরাময় হলো তরবারি। [উসূলুস্ সারাখসী, ২য় খণ্ড, ১৩৪ পৃষ্ঠা]

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment