২৭ রজব ৫৮৩ হিজরি। খ্রিস্টান ক্রুসেডারদের হাত থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস দখলমুক্ত হওয়ার দিন আজ। বীর সেনাপতি সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবির যোগ্য নেতৃত্বেই মুক্ত হয়েছিল বায়তুল মুকাদ্দাস।
বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের প্রথম কেবলা। অসংখ্য নবি-রাসুলের স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক স্থান ও মর্যাদপূর্ণ ইবাদতের জায়গা এ বায়তুল মুকাদ্দাস। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐতিহাসিক মেরাজের রাতে মসজিদুল হারাম তথা কাবা শরিফ থেকে মসজিদুল আকসা তথা এ বায়তুল মুকাদ্দাসেই প্রথম সফর করেন। কুরআনুল কারিমে এ সফরের কথাই ওঠে এসেছে-
سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلاً مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ البَصِيرُ
পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে (মুহাম্মাদ সা.) রাতের বেলায় মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যান্ত ভ্রমণ করিয়েছিলেন। যার চার দিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি যাতে আমি তাঁকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল।’ (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ১)
প্রিয় নবি হজরত মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মেরাজ গমনের সময় এই মসজিদে সব নবি–রাসুলের ইমামতি করে নামাজ আদায় করেন। এ কারণেই তিনি ‘ইমামুল আম্বিয়া’ সব নবিদের ইমাম ও ‘সায়্যিদুল মুরসালিন’ সব রাসুলদের নেতা হিসেবে স্বীকৃত হন।
এই মসজিদে আকসা বহুকাল ধরে ইসলামের প্রাণকেন্দ্র এবং ইসলামি সংস্কৃতির চারণভূমি ছিল। খলিফাতুল মুসলিমিন হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর খেলাফেতের সময় ৬৩৮ সালে বায়তুল মুকাদ্দাস, জেরুজালেমসহ পুরো ফিলিস্তিন পুরোপুরি মুসলমানদের অধিকারে আসে।
কালের পরিক্রমায় ১০৯৯ সালের ৭ জুন খ্রিষ্টান ক্রুসেডাররা বায়তুল মুকাদ্দাস অবরোধ করেন। ১৫ জুলাই ১০৯৯ সালে খ্রিষ্টান ক্রুসেডাররা নামধারী মুসলিম শাসকদের সহায়তায় সমগ্র সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও জেরুজালেম দখল করে।
১৫ জুলাই ১০৯৯ সালে খ্রিস্টানরা বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করে। মসজিদে ব্যাপক পরিবর্তন করে একে গির্জায় পরিণত করে। ক্রুসেডাররা মসজিদে প্রবেশ করে সেখানে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।
সেদিন মুসলমানদের রক্তে প্লাবিত হয়েছিল পবিত্র আল কুদসের ভেতর ও বাহির। এভাবেই জেরুজালেমের ৪৬২ বছরের মুসলিম শাসনের পতন ঘটে। এভাবেই অব্যাহত থাকে জেরুজালেম ফিলিস্তিন ও মসজিদে আকসার দখল।
ফিলিস্তিনের মুসলিমরা একজন নেতার অপেক্ষায় দিন অতিবাহিত করছিল। যে নেতার নেতৃত্বে মুসলিমরা তাদের হারানো গৌরব ফিরে পাবে। জিল্লতি, গোলামীর জিঝ্হির ও নির্যাতন থেকে মুক্তি পাবে মুসলিম মানবতা। মসজিদে আকসায় আবারও ধ্বনিতে হবে ইসলামের সুমহান আজান।
কে এই সালাহউদ্দিন আইয়ুবী?
খ্রিস্টান ক্রুসেডারদের বায়তুল মুকাদ্দাস দখলের সময়কালীন একটি ঘটনা। ১০৯৯ সালের কোনো এক সময়ের ঘটনা এটি। বায়তুল মুকাদ্দাস তখন খ্রিস্টান ক্রুসেডারদের দখলে। সেময় বাগদাদ শহরের এক কাঠমিস্ত্রি বসবাস করতেন। এ কাঠমিস্ত্রি মনের ভালোবাসা দিয়ে কারুকার্যমণ্ডিত একটি মিম্বার তৈরি করেন।
মিম্বারটি সৌন্দর্যের কথা লোক মুখে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আর তা দেখতে মানুষ দলে দলে কাঠমিস্ত্রির বাড়িতে আসতে শুরু করে। অনেকেই মিম্বারটি কিনতে চায়। কিন্তু কাঠমিস্ত্রি তা বিক্রি করতে রাজি হয়নি। তার একই জবাব-
‘এ মিম্বার বিক্রির জন্য নয়; বরং এটি বানিয়েছি মসজিদে আল আকসার জন্য‘ কাঠ মিস্ত্রির কথা শুনে সবাই হাসতো। অনেকে তাকে পাগল বলে সম্বোধন করতো। কিন্তু কাঠমিস্ত্রি তার সিদ্ধান্তে ছিলেন অটল-অবিচল।
অনেকদিন পর…
একদিন এক ছোট্ট ছেলে তার বাবার হাত ধরে মিম্বারটি দেখতে এসেছিল। কাঠমিস্ত্রির কাছে তার স্বপ্নে কথাও জেনেছিল। সেদিনই ওই ছোট্ট ছেলেটি প্রতিজ্ঞা করেছিল- সে কাঠমিস্ত্রির স্বপ্ন পূরণ করবে। সেই ছেলেটি আর কেউ নন; তিনি হলেন- বীর সেনাপতি সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী। আর তিনি বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়ের পর সেই মিম্বারটি এ মসজিদে স্থাপন করেছিলেন।
সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর জন্ম
বর্তমান ইরাকের টাইগ্রিস বা দজলা ও ইউফ্রেটিস বা ফোরাত নদী দুটির মধ্যবর্তী অঞ্চলে গড়ে উঠা মেসোপটেমিয়ার তিকরিতে ১১৩৭ সালে জন্ম গ্রহন করেন সালাহউদ্দীন ইউসুফ ইবনে আইয়ুব।
তার নাম ইউসুফ, সালাহউদ্দিন হল লকব যার অর্থ ‘বিশ্বাসের ন্যায়পরায়ণ’। তিনি ছিলেন মিশর ও সিরিয়ার প্রথম সুলতান এবং আইয়ুবীয় রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা।
ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে তার সালতানাতে মিশর, সিরিয়া, মেসোপটেমিয়া, হেজাজ, ইয়েমেন এবং উত্তর আফ্রিকার অন্যান্য অংশ অন্তর্ভুক্ত ছিল। সালাহউদ্দীন ছিলেন মুসলিম, আরব, তুর্কি ও কুর্দি সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব।
১১৮৭ সালে মুসলিম বীর সিপাহসালার সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবীর হাত ধরেই পুনরায় জেরুজালেম শহর মুসলমানদের অধিকারে আসে।
এক নজরে সালাহউদ্দিন আইয়ুবী
পূর্ণ নাম : সালাহউদ্দীন ইউসুফ ইবনে আইয়ুব।
রাজবংশ : আইয়ুবী।
পিতা : নাজমুদ্দিন আইয়ুব।
জন্ম : ৫৩২ হিজরি (১১৩৮ খ্রিষ্টাব্দ)।
জন্মস্থান : তিকরিত, মসুল আমিরাত।
ধর্ম বিশ্বাস : ইসলাম (সুন্নি)।
দাম্পত্যসঙ্গী : ইসমতউদ্দিন খাতুন।
পূর্বসূরি : নুরউদ্দিন জেনগি।
উত্তরসূরি : আল আফদাল (সিরিয়া) ও আল আজিজ উসমান (মিশর)।
রাজ্যাভিষেক : ১১৭৪, কায়রো।
রাজত্বকাল : ১১৭৪-১১৯৩।
মৃত্যু : ৪ মার্চ ১১৯৩ (৫৫ বছর)।
মৃত্যুস্থান : দামেস্ক, সিরিয়া।
সমাধিস্থল : উমাইয়া মসজিদ, দামেস্ক, সিরিয়া।
ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র
সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী জেরুজালেম স্বাধীন করার পর থেকে ফিলিস্তিনে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। এ অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য ইয়াহুদি ধর্মাবলম্বীরা তৎকালীন তুরস্কের শাসক সুলতান আবদুল হামিদের কাছে ফিলিস্তিনে বসতির অনুমতি চায়। দূরদর্শী সুলতান তাদের এ দুরভিসন্ধিমূলক প্রস্তাবে রাজি হননি।
অবশেষে ১৯১৭ সালে ইংরেজরা ফিলিস্তিনে অনুপ্রবেশ করে এবং ১৯২০ সালে তারা সেখানে পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। অল্প সময়ের মধ্যে ইয়াহুদিরা ফিলিস্তিনে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে।
ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমিতে ইয়াহুদিদের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানদের সঙ্গে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দাঙ্গা নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়। এ সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা অন্যায়ভাবে মুসলমানদের ফিলিস্তিন ভূমিকে মুসলমান ও ইহুদিদের মধ্যে ভাগ করে দেয়।
ফলে ১৯৪৮ সালের ১৫ মে বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে জায়ানবাদী অবৈধ ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন থেকে মুসলমানদের প্রতি জায়ানবাদী ইসরায়েলিদের জুলুম, নির্যাতন ও অত্যাচারের মাত্রা আরও বাড়তে থাকে, যা অদ্যাবধি চলছে।
অবৈধভাবে গড়ে ওঠা রাষ্ট্র ইসরায়েল ও দখলদার বাহিনী ১৯৬৭ সালে ‘মসজিদে আকসা’ জোরপূর্বক দখল করে নেয়। এরপর থেকে সেখানকার মুসলিম জনগণ মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু জায়ানবাদী ইসরায়েল একের পর এক মুসলিম–অধ্যুষিত এলাকা জোরপূর্বক দখল করে ইয়াহুদি বসতি সম্প্রসারণ অব্যাহত রাখে এবং হত্যা-গুম চালিয়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে মসজিদে আকসা ও জেরুজালেম নগরী দখলদার ইসরায়েলিদের নিয়ন্ত্রণে। সেখানে মুসলিমরা নির্যাতিত হচ্ছে। প্রতিনিয়ত তারা ফিলিস্তিনের ভূখন্ড দখল করে নিচ্ছে।
৮৬০ বছর পরও…
আজ শুধু ফিলিস্তিন নয় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মুসলিম মানবাত্মা একজন সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর জন্য কাঁদছে। অপেক্ষার প্রহর গুনছে। দীর্ঘ ৮৬০ বছর পর ১৪৪২ হিজরির আজকের এই দিনে মনে পড়ে বীর সেনাপতি সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে। জেরুজালেম, ফিলিস্তিনে বসবাসরত মুক্তিকামী মুসলিম জনতা একজন সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর অপেক্ষায় দিন অতিবাহিত করছে। কবে আসবে তাদের মুক্তি? কে হবে এ যুগের সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী?
আল্লাহ তাআলা বর্তমান মুসলিম উম্মাহকে একজন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী দান করুন। এ ক্রুসেড বিজয়ীবীর ১১৯৩ সনের ৪ মার্চ দামেস্কে ইন্তিকাল করেন। মহান রাব্বুল আলামীন সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসিব করুন। আমিন।