সাইয়্যেদুনা মু’য়াবিয়া (রা:) সম্পর্কে ইতিহাস বিকৃতির অপনোদন:

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

মূল: মওলানা মুহাম্মদ জা’ফর ইক্ববাল

বঙ্গানুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

প্রকাশক: মাহাজ্জাহ-ডট-কম

[Bengali translation of the book “Sayyidunaa Mu’awiyah (Ra:) – Dispelling distortions of history”]

বঙ্গানুবাদকের আরজ

সাহাবী ও মুসলিম শাসক হযরতে মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর বিরু্দ্ধে ভ্রান্ত শিয়াপন্থী ও তাঁদের তল্পিবাহকদের মিথ্যে অভিযোগ অনেক। তাঁরা তাঁকে ইতিহাসের খলনায়ক হিসেবে চিত্রিত করতে অপতৎপর। কিন্তু আহলে সুন্নাতের ইমামবৃন্দ (রা.) ও বিভিন্ন মসলকের আলেম-উলামা শিয়া মতবাদীদেরকে দলিলভিত্তিক জবাব দিয়েছেন। এমনি একটি জবাব হলো মওলানা জা’ফর ইক্ববাল সাহেবের এই বইটি। এতে সুন্নী আলেম-উলামার পাশাপাশি অন্যান্য ঘরানার মওলভীদের ভাষ্যও বিধৃত হয়েছে। আমরা এ বইটি অনুবাদে ব্রত হলাম, মওলার মর্জি।

সূচিপত্র:

মুখবন্ধ

-অবতরণিকা

-ভূমিকা

সাইয়্যেদুনা মু’য়াবিয়া (রা:) সম্পর্কে ইতিহাস বিকৃতির অপনোদন:

ক্বুরআন মজীদে বর্ণিত সাহাবায়ে কেরাম (রা.)’এর উচ্চমর্যাদা

হাদীস শরীফে বর্ণিত সাহাবায়ে কেরাম (রা.)’এর উচ্চমর্যাদা

সাহাবায়ে কেরাম (রা.)’কে গালি দেয়া নিষেধ

সাহাবায়ে কেরাম (রা.) তাঁদের নিজের ভাষায়

’আক্বীদা-বিশ্বাসের আলোকে সাহাবায়ে কেরাম (রা.)’কে হেয় প্রতিপন্ন করা নিষেধ

সাহাবায়ে কেরাম (রা.) ও ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)

সাহাবা (রা.)’বৃন্দের স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই

পাপের সম্ভাবনা ঐশী জ্ঞানের অধীন

বনূ উমাইয়া সবচেয়ে ঘৃণ্য গোত্র মর্মে অভিযোগ:

স্পষ্টীকরণ

এই বর্ণনায় বনূ উমাইয়াকে যুক্ত করার বেলায় দায়ী কে?

দিরা’এয়াহ (ব্যাখ্যা)

বৈবাহিক সম্পর্ক

বৈবাহিক আত্মীয়তা নেই এমন সংশ্লিষ্টতা ও গুণাবলী

সাইয়্যেদুনা আলী আল-মুর্তদা (ক.) ও বনূ উমাইয়া

আলোচনার সারাংশ

কোনো ফযীলত/ সৎ গুণ ধারণ না করার অভিযোগ:

ভুল ধারণার অপনোদন 

বর্ণনা সহীহ না হলে কি তা আপনাআপনি জাল হওয়ার ইঙ্গিতবহ?

সাইয়্যিদুনা মুয়াবিয়া (রা.)’এর ফজিলত সম্পর্কে কয়েকটি হাদীস

ওপরোক্ত বর্ণনাগুলো সম্পর্কে ইবনে কাসীরের ভাষ্য

আরো সমর্থন

হাফিয জালালউদ্দীন সৈয়ূতী (রহ.)’এর মন্তব্য

অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে

ইবনে তাইমিয়ার রেফারেন্স

বিদ’আতের অভিযোগ:

প্রথম যুক্তি: বিদ’আতের সংজ্ঞা

দ্বিতীয় যুক্তি: রেফারেন্স যাচাই

ফুতূহা’তুল্ মক্কীয়াহ (গ্রন্থ)

পাপ সংঘটন করার অভিযোগ:

১/ ইমামে আলী (ক.)’এর প্রতি আমীরে মুয়াবিয়া (রা.)’এর আচরণ:

ইমামে আলী (ক.)’এর আচরণ

২/ রাজনৈতিক বিষয়ে ভুলকে ইজতিহাদী ভ্রান্তি বলা যায় না:

একটি প্রশ্ন

৩/ ইজতিহাদ বুঝতে ভুল করা:

(১) ইমাম আবূল হাসান আশ’আরী (রহ.)

(২) ইমাম আবূ ইসহাক্ব ইসফারাঈনী (রহ.)

(৩) হাফিয ইবনে হাযম আন্দালূসী (রহ.)

(৪) ইমাম গাজ্জালী (রহ.)

(৫) আল্লামা ইবনে আসীর জাযিরী (রহ.)

(৬) আল্লামা ক্বুরতূবী মালিকী (রহ.)

(৭) ইমাম মহিউদ্দীন নববী (রহ.)

(৮) হাফিয ইমাদউদ্দীন ইবনে কাসীর

(৯) হাফিয ইবনে তাইমিয়া

(১০) আল্লামা তাফতাযানী (রহ.)

(১১) আল্লামা ইবনে খালদুন মাগরিবী (রহ.)

(১২) হাফিয ইবনে হাজর আসক্বালানী (রহ.)

(১৩) আল্লামা ইবনে হুমাম 

(১৪) হাফিয ইবনে হাজর মক্কী (রহ.)

(১৫) শায়খ মুজাদ্দেদে আলফে সানী (রহ.)

(১৬) আল্লামা খাফফাজী (রহ.)

(১৭) মোল্লা আলী ক্বারী )রহ.)

(১৮) আল্লামা আবদুল আযীয ফারহারাউয়ী

(১৯) মৌলভী রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী

(২০) মৌলভী হুসাইন আহমদ মাদানী

(২১) মুফতী মুহাম্মদ শফী

(২২) খাজা শামসউদ্দীন শিয়ালভী

শেষ বিবৃতি

আমীরে মু’য়াবিয়া (রা.) ও ইমামে আলী (ক.)’এর ইজতিহাদ

মওলানা আবদুর রহমান জামী (রহ.)’এর রেফারেন্স

আহলে সুন্নাতের বইপত্রে শিয়া-চক্রের সন্নিবেশ

আহলুস সুন্নাহর বড় বড় গবেষণাকর্মে সাধিত ক্ষতি

মওলানা জামী (রহ.)’এর বইপত্রের অবস্থা

শাওয়াহিদ আল-নুবুওয়াহ পুস্তকে শিয়া সন্নিবেশের কয়েকটি উদাহরণ

মওলানা জামী (রহ.)’এর উচ্চমর্যাদা

আমাদের অবস্থান

শিয়া ষড়যন্ত্র থেকে নিজেকে রক্ষা করার মূলনীতি

সিদ্ধান্ত

মওদূদীর বিতর্কিত প্রাচ্যবাদী ‘মাস্টারপিস’

সাইয়্যেদুনা হাসান (রা.)’কে বিষ প্রয়োগের অভিযোগ:

১/ আল-বিদায়াহ ওয়ান্ নিহায়াহ

২/ তারীখ আত্ তাবারী

৩/ তারীখ আল-আসাকির

৪/ সির্রুশ্ শাহাদাতাইন

৫/ তারীখ ইবনে আসীর জাযিরী

৬/ তারীখ আল-খামীস্

৭/ শওয়াহিদুন্ নুবুওয়াহ

৮/ আল-ইসাবাহ ফীত্ তামীয আল-সাহাবাহ

৯/ হায়াত আল-হায়াওয়ান

১০/ মুরূজ আল-যাহাব

চিন্তার বিষয়

১১/ তুহাফ আল-উক্বূল

১২/ আল-ইস্তিয়াব

(১) হাফিয ইবনে তাইমিয়া

(২) হাফিয শামসউদ্দীন যাহাবী

(৩) আল্লামা আবদুল আযীয ফারহারাউয়ী

একটি অলীক যুদ্ধবিরতির অভিযোগ:

যুদ্ধবিরতি ছিল রাসূলুল্লাহ (দ.)’এর সুসংবাদের পরিপূর্ণতা

আহলে বাইত (রা.)’বৃন্দের প্রতি সাইয়্যিদুনা মুয়াবিয়া (রা.)’এর উদারতা

সায়্যিদুনা মুয়াবিয়া (রা.) কর্তৃক আহলে বাইত (রা.)’এর প্রতি বরাদ্দ ভাতা

বনূ হাশিম কর্তৃক জিহাদে অংশগ্রহণ

আহলে বাইত (রা.)’বৃন্দ চুক্তির শর্তগুলো কঠোরভাবে মান্য করেন

সাইয়্যিদিনা মুয়াবিয়া (রা.)’কে আমীরুল মুমিনীন উপাধিতে সম্বোধন

সারসংক্ষেপ

হযরত মু’য়াবিয়া (রা.)’এর খেলাফত অনুসরণের অযোগ্য মর্মে অভিযোগ:

ইসলামে কি রাজত্ব নিন্দিত?

সাইয়্যেদুনা মুয়াবিয়া (রা.)’এর খিলাফত

প্রথম যুক্তি

দ্বিতীয় যুক্তি

তৃতীয় যুক্তি

খুলাফায়ে রাশিদীন চারজন:

সঠিক পথে পরিচালিত খলীফাদের অনুসরণ সংক্রান্ত হাদীসসমূহ

ওহী-লেখক হিসেবে সাইয়্যিদুনা মুয়াবিয়া (রা.):

সমাপনী মন্তব্য:

সিফফীনবাসীদের নিয়ে একটি ভালো স্বপ্ন

আবূ মাইসারার স্বপ্ন

খলীফা উমর ইবনে আবদিল আজীজ (রহ.)’এর স্বপ্ন

শেষ কথা।

মুখবন্ধ 

এই অযোগ্য লেখকের হৃদয় সমস্ত অনুগ্রহের চূড়ান্ত পুরস্কারদাতার কাছে চির কৃতজ্ঞ এবং আমার জিহ্বা তাঁর প্রশংসা ও মহিমা বর্ণনায় সর্বদা রত, কারণ আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহ ও করুণার মাধ্যমে আমাকে সম্মান রক্ষা করার এবং গুণাবলী গণনা করার সুযোগ দিয়েছেন এমন এক সম্মানিত সাহাবী (রা.)’এর, যিনি কাতেবে ওহী (ঐশীবাণী লিপিবদ্ধকারী), রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রক্তের সম্পর্কীয় আত্মীয়, উম্মতের মামা, সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু। এই সাহাবীর মহৎ মর্যাদাকে অপমানিত ও অসম্মান করার অপপ্রয়াসে শুধু ন্যায়পরায়ণতার সীমারেখাই অতিক্রম করা হয়নি – যে ন্যায়পরায়ণতা সাধারণত যুক্তি ও বুদ্ধির লোকদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত – বরঞ্চ সততা ও মানবতার সীমাকেও পদদলিত করা হয়েছে।

সাইয়্যিদুনা ‘আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু এবং সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হলেন সেই ব্যক্তিত্বদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত, যাঁদের প্রতি ঐতিহাসিক বর্ণনার আলোকে অত্যন্ত কঠোর আচরণ করা হয়েছে; অতিরঞ্জন ও উপহাসের মেঘাবরণে তাঁদের সম্মান ও মর্যাদা এতে ঝাপসা হয়ে এসেছে। এই ব্যক্তিত্বদের যাচাইয়ে প্রতিটি দল নিজেদের কুসংস্কারের দৃষ্টিতে দেখেছে, যে মতাদর্শ, বিশ্বাস এবং দৃষ্টিভঙ্গি তাদের আবদ্ধ করেছে। ফলস্বরূপ, এই দুই ব্যক্তিত্বকে বিরোধী বিশ্বাস এবং উদ্দেশ্য নিয়ে দুটি ভিন্ন পথে দাঁড়ানো বলে চিত্রিত করা হয়েছে। প্রতিটি দল নিজস্ব (সীমিত) গবেষণা ও মানদণ্ডের ওপর নির্ভর করেছে, একজনকে উচ্চমর্যাদা দিয়ে এবং অন্যজনকে অসম্মান করে; আর তারা এটা করেছে স্রেফ এ দাবির ভিত্তিতে যে এটাই বাস্তবতার প্রতিফলন। অথচ প্রকৃত চিত্র এ থেকে কতোই না দূরে অবস্থিত।

এরকম এক পরিস্থিতিতেই আমি সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর গুণাবলী নির্ণয় করার জন্য এবং তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো খণ্ডন করার জন্য আমার কলম তুলে নিয়েছি। আমি অতিরঞ্জন ও উপহাসের কাঁটা থেকে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছি, আর এই সাগর পাড়ি দিয়ে তীরে পৌঁছুনো মোটেই সহজ কাজ ছিল না। তবুও এই অযোগ্য লেখক, আল্লাহর ওপর দৃঢ় ভরসা রেখে এবং তাঁর অনুগ্রহ কামনা করে এই যাত্রাটুকু শুরু করেছিলাম। নিরাপদ পথ চলা নিশ্চিত করার জন্য আমি পুণ্যবান পূর্বসূরীদের হাত ছাড়বো না বলে অঙ্গীকার করেছিলাম, তবুও যদি (এখানে ব্যক্ত) কোনো দৃষ্টিভঙ্গি তাঁদের পথ থেকে বিচ্যুত বলে মনে হয় (কারো), তবে আমি আগেই তা প্রত্যাহার করছি।

মাঝে মাঝে এ আলোচনা দীর্ঘ পথ নিয়েছে এবং এর কারণ আমি উল্লেখ না করে পারছি না। সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-বৃন্দের সমালোচনা ও খণ্ডন করার রাফেযী অপচেষ্টার জবাবে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের তৎপর যুবক ও তরুণ আলেম-উলামা (আসলে এঁদের মধ্যে স্বনামধন্য আলেমও আছেন কয়েকজন) ইঙ্গিত করতে লাগলেন সাইয়্যিদুনা আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু এবং সাইয়্যিদুনা হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর (অমূলক) দোষত্রুটি; তাঁরা এটাকে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের জন্য একটা মহান পাণ্ডিত্যপূর্ণ সেবা বলে মনে করেছিলেন। এই মিথ্যাচারের জবাবে অন্য একটি দলও নিজেদেরকে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ-এর সাথে যুক্ত করে (এই দুই পুণ্যাত্মার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগের জবাব না দিয়ে এবং শেষোক্ত দলটির গবেষণায় ফাঁকফোকর প্রকাশ করার পরিবর্তে) সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং আবূ সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহুকে ইয়াজিদের অপকর্মের কারণে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেন; তাঁরা এটাকে সাইয়্যেদুনা ‘আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু এবং সাইয়্যিদুনা হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু’র প্রতি প্রথমোক্ত দলটির আক্রমণের সবচেয়ে উপযুক্ত জবাব বলে ধরে নিয়েছিলেন। সময়ের পরিক্রমণে মতের এই পার্থক্যটি বিরোধিতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে, প্রবণতা পক্ষপাতে পরিণত হয় এবং ধীরে ধীরে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত-এর সদস্যদেরকে রওয়াফিয [শিয়া চক্র] বা নওয়াসিবের [হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু’র প্রতি বিদ্বেষ ভাবাপন্ন গোষ্ঠী] পক্ষপাতদুষ্ট বলে বর্ণনা করা হয়; অথচ আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত সবসময় উভয় দলেরই বিরোধিতা করে এসেছেন; কেননা বাতিলপন্থী দুটো দলই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রিয়জনদেরকে হেয় করে থাকে, আর এর ফলশ্রুতিতে তাঁর অন্তরে ব্যথা দেয় বিধায় তাদের ঈমানহারা হবার সমূহ সম্ভাবনা বিদ্যমান। আজকে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের তথাকথিত সদস্যরা যদি একই রকম আচরণ করেন, তাহলে আমাদের এবং রওয়াফিয ও নওয়াসিবের মধ্যে কী পার্থক্য থাকবে?

আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআত সর্বদা রওয়াফিয এবং নওয়াসিব উভয়ের সাথেই মতভেদ করেছেন এবং উম্মাহর বুযূর্গ আলেম-উলামা সর্বদা সতর্কতা অবলম্বন করেছেন যেনো উভয় সম্প্রদায়ের কণ্টকাকীর্ণ ফাঁদে না পড়েন, যাতে সাহাবা ও আহলুল বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন) উভয়ের প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রাখতে পারেন। পুণ্যাত্মা আলেম-উলামা উভয় ভ্রান্ত পক্ষের অভিযোগের এমন প্রমাণসম্বলিত জবাব দিয়েছেন যে, সমগ্র উম্মত তাঁদের অমূল্য সেবার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। এটা কতোখানি দুঃসাহস হতে পারে যে রওয়াফিযের জবাব দেওয়ার সময় আহলে বাইতে (রা.)’বৃন্দের বিরোধিতার সুরে কথা বলা হয়? অথবা নওয়াসিবের জবাব দেওয়ার সময় সাহাবায়ে কেরামে (রা.)’মণ্ডলীর সমালোচনার সুরে কথা বলা হয়? রাফিযীয়্যা ও নাসিবীয়্যার প্রতি এরূপ ঝোঁক, যা আজকে কিছু আলেম-উলামা তাঁদের লেখায় গ্রহণ করেছেন, তা অত্যন্ত দুঃখজনক।

মোটকথা, আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা’আত-এর সাথে তাদের (মানে রওয়াফিজ ও নাসেবী পক্ষীয়দের) সম্পৃক্ততা থাকা সত্ত্বেও এই উভয় দলই আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের সামষ্টিক প্রতিষ্ঠিত দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক দূরে। ন্যায্যতা ও সমতা আহলুস সুন্নাতের বিশিষ্ট বৈশিষ্ট্য: আমরা রওয়াফিজদের মতো বাড়াবাড়ি করি না এবং নওয়াসিবদের মতো উপহাসও করি না। আমরা সাহাবা ও আহলে বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন)’এর মধ্যে পার্থক্য করি না; উভয়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শনকে বাধ্যতামূলক মনে করি এবং তাঁদের কাউকে ছোট করা পরিতাপযোগ্য এবং আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়ার মতো (পাপ বলে) বিবেচনা করি।

এক ভারাক্রান্ত হৃদয় এবং চরম উদ্বেগসহ আমি উভয় পক্ষের প্রতি আমার হাত প্রসারিত করে অনুরোধ করছি, আল্লাহর ওয়াস্তে, আপনাদের অবস্থান পুনরায় যাচাই করুন। (যদি আপনারা শিয়া না-ও হন তবুও) আহলুল বাইত বা সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন)-বৃন্দের প্রতি আপনাদের সমালোচনার বিষয়ে এক মুহূর্তের জন্য চিন্তা করুন: আপনারা কাদের সংকল্পকে শক্তিশালী করছেন এবং কাদের ভিত্তি উপড়ে ফেলছেন, এবং সর্বোপরি, কাদের আশীর্বাদপূর্ণ অন্তরে কষ্ট দিচ্ছেন। আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর আহলে বাইত এবং সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন)-মণ্ডলী উভয়কেই ভালোবাসতেন, যাঁরা তাঁর নুবূওয়াত ও রিসালাতের প্রাথমিক সাক্ষী ছিলেন, তাঁর মিশনের প্রতি প্রথম সাক্ষ্য দিয়েছিলেন এবং তাঁর সাথে তা প্রচারও করেছিলেন, আর যাঁরা তাঁর পাশে থেকে (শত্রুর বিরুদ্ধে) যুদ্ধ করেছিলেন এবং তাঁর পক্ষ সমর্থন করেছিলেন, এবং যাঁরা তাঁর দৃঢ় সংকল্প এবং সংস্কারমূলক সাফল্যের প্রমাণস্বরূপ ছিলেন। এটা আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অনন্য সম্মান যে আমরা সাহাবা ও আহলে বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন)’বৃন্দের সেবা করি। সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) যদি “হেদায়েতের নক্ষত্র” হন তবে আহলে বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) হলেন “সফলতা ও মুক্তির কিস্তি/নৌকা।” তাঁরা সবাই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর (মালিকানাধীন) একই বাগানের সুগন্ধি ফুল, যাঁদের মর্যাদা আলাদা হতে পারে কিন্তু যাঁদের মধ্যে আমরা ভেদাভেদ করি না, হোন তাঁরা বড় বা ছোট, কিংবা হোক ঈমানী ফুলের প্রস্ফুটনে তাঁদের দেরি বা জলদি। অতীতের সমগ্র উম্মাহ তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণকে চিরস্থায়ী সৌভাগ্য ও সাফল্যের মাধ্যম বলে মনে করতেন এবং ভবিষ্যতের সমগ্র উম্মাহ তাঁদের দেখানো পথের উপর নির্ভরশীল। যদি কোনো হতভাগ্য ব্যক্তি তাঁদের পথ ছাড়া অন্য পথ অবলম্বন করে তবে সে লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না।

আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে তাঁদের পদতলে স্থান দান করুন, তাঁদের জন্য আমাদের অন্তরকে সত্যিকারের ভালবাসায় পূর্ণ করুন, তাঁদের অনুসরণ করার ক্ষমতা আমাদের দান করুন; কারণ তাঁদের প্রতি ভালোবাসা এবং তাঁদের আনুগত্য করাই হচ্ছে দুনিয়া ও আখেরাতে প্রকৃত সাফল্য।

উল্লেখিত এই দুই দলের চরমপন্থা ও উগ্রতার বিষয়ে আমি যা বলতে চেয়েছিলাম তাই বলেছি এবং উভয় পক্ষের কাছেই আমার আশা আছে যে, তারা এই বইটি গভীরভাবে পড়বে এবং এর বিষয়বস্তু নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে। যদি তারা তা করতে ব্যর্থ হয় তবে আমরা আল্লাহর কাছে আবেদন করি:

হে রব! তারা উপলব্ধি করতে হয়েছে ব্যর্থ, বুঝতে পারেনি আমার ব্যক্ত মর্মকথা 

আপনি তাদের মঞ্জুর করুন এমন অন্তর, যেটা অনুধাবনে সক্ষম তাই, যা বোঝাতে অক্ষম মোর জিহ্বা।

এই বইটি সংকলনে যে তড়িঘড়ি করা হয়েছে, সে জন্যে এই উম্মতের নিরপেক্ষ মনের অধিকারী ও ন্যায়পরায়ণ আলেম-উলামার কাছে আমি বিনীত ও আন্তরিক ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমি স্বীকার করি যে ভাষার ব্যবহার একটি সূক্ষ্ম বিষয় এবং এতে অত্যন্ত যত্নের প্রয়োজন; তাই যদি এই বিনীত লেখকের কথা অর্থবোধক মনে হয়, তবে এটাকে গ্রহণ করুন এবং এটাকে এই উম্মতের পুণ্যবান পূর্বসূরিদের কৃতিত্ব বলে বুঝে নিন। কিন্তু যদি কিছু ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়, তবে দয়া করে তা আমার নজরে আনবেন।

আমি কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই সম্মানিত মুহাদ্দীস মওলানা সেলিমুল্লাহ খান, শাইখুল হাদীস মওলানা জাহিদ আল রশিদী, শ্রদ্ধেয় ভাই আমির উসমানী, মওলানা আসলাম শাইখপুরী (আমরা যেন তাঁদের থেকে উপকৃত হতে পারি)। এঁরা নিজেদের মূল্যবান সময় ব্যয় করে পাঠ করেছেন এই অযোগ্য লেখকের বইটি এবং আমার এ প্রচেষ্টায় আমাকে উৎসাহিত করেছেন। উপরন্তু, তাঁরা প্রশংসা এবং স্বীকৃতিসূচক বাণী দ্বারা এই বইটির মূল্য বৃদ্ধিতে সময় দিয়েছেন। আল্লাহ তা’আলা আমার সম্পর্কে তাঁদের ভাল মতামতকে কবুল করুন এবং তা সত্যে পরিণত হতে এজাযত দিন। আমি আমার বন্ধু সুলায়মান ‘আমির ও ভাই গুল মুহাম্মাদের প্রতিও ধন্যবাদ জানাতে চাই যাঁরা আমাকে এই বইটি সম্পাদনায় সহায়তা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁদেরকে সর্বোত্তম পুরস্কারে পুরস্কৃত করুন, আমীন।

পরিশেষে, কিন্তু শেষবারের মতো নয়, আমরা আল্লাহ তা’আলার কাছে এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাকে তাঁর দরবারে কবুল করার জন্য আর্জি পেশ করি; তিনি যেনো এটাকে এই লেখকের, তার পিতামাতার ও আসা’তিযাহ-এর জন্য তাঁরই রেযামন্দি/সন্তুষ্টি অর্জনের একটি মাধ্যম করে দেন এবং এটা যে উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছে তা অর্জনের অনুমতি দেন। যদি এই বইটি জ্ঞানের অভাবের কারণে উদ্ভূত সন্দেহগুলো দূর করে, সত্যিকারের ঈমান নিয়ে কারো অন্তরে দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের প্রতি তাঁর ভালবাসা ও প্রশংসা বৃদ্ধি করে, তবে এই প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হবে। কিন্তু যদি এই প্রচেষ্টা (যা লেখকের কোনো কৃতিত্ব নয় বরং আমাদের জ্যেষ্ঠ বুযূর্গবৃন্দের বইপত্রেরই পুনর্মুদ্রণ) সফলভাবে সাহাবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমের সম্মান রক্ষা করে, বিশেষ করে সাইয়্যিদুনা মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহুর বিরুদ্ধে করা সন্দেহ ও অভিযোগগুলোকে সফলভাবে রদ করে, তাহলে এর চেয়ে বড় খুশির বিষয় আর কিছু হতে পারে না। আর যদি এই প্রচেষ্টার কারণে লেখককে সাহাবা ও আহলে বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন)-বৃন্দের পায়ের কাছে স্থান দেওয়া হয় তবে এটা তার চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন করবে। পরিশেষে, যারা সাহাবা ও আহলে বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন)-মণ্ডলীর প্রতি আক্রমণ হানে এবং তাঁদের সমালোচনা করে, তাদের উদ্দেশ্যে বলছি:

হে সাহাবা ও আহলে বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন)-বৃন্দের শত্রু দল! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আলোকবর্তিকা যে পুণ্যাত্মাবৃন্দ, তাঁদের সম্মান উম্মতের অন্তর থেকে মুছে ফেলার লক্ষ্যে তোমাদের অপচেষ্টা এক নিষ্ফল কাজ…

এঁরা এমন লণ্ঠন যা এক ফুৎকারে নেভানো যায় না। 

সাহাবা ও আহলে বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন)’বৃন্দের সেবক,

মুহাম্মদ জা’ফর ইকবাল (আল্লাহ তাকে মাফ করুন)।

অবতরণিকা

-শাইখুল হাদীস মওলানা সালিমউল্লাহ খাঁন সাহেব

بسم الله الرحمن الرحيم

الحمد لله الذى رضى لنا بالاسلام دينا و بخير الأنام و صفوة خلقه نبيا و بصحابه نبيه أعوانا و أنصارا و الصلاة و السلام على سيد الرسل وخاتم الأنبياء محمد المصطفى والمجتبى و على آله و صحبه الذين اختارهم الله تعالى لصحبة نبيه وإقامة دينه من جميع أمته و بعد.

শ্রদ্ধেয় মুহম্মদ জাফর ইকবাল, আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রচেষ্টা ও পুণ্য বৃদ্ধি করুন, এই বইটি সংকলন করেছেন – ‘সাইয়্যিদুনা মুয়াবিয়া (রা.) সম্পর্কে ইতিহাস বিকৃতির অপনোদন।’ লেখক শুধু গবেষণার অধিকারই পূর্ণ করেননি বরং সাহাবায়ে কেরাম (রা.)’কে সম্মান করার এবং তাঁদের ভালোবাসার প্রয়োজনীয়তাকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে এর সত্যতা স্বীকার করা ছাড়া নিরপেক্ষ পাঠকের কাছে আর কোনো উপায় থাকবে না।

এই বইটির উৎকর্ষকে কয়েকটি শব্দে গণনা করা অসম্ভব, তবে কেউ বলতে পারেন যে এই বইটি অকাট্য এবং এর আগে এই প্রকৃতির কোনো ব্যাপক আলোচনা বিদ্যমান ছিল না। আল্লাহ তা’আলা এটাকে কবুল করুন, লেখকের জন্য এটাকে পরিত্রাণের মাধ্যম করে দিন এবং অসংখ্য মানুষকে এই বই থেকে উপকৃত হবার তৌফিক দান করুন, (আমীন)।

সালিমউল্লাহ খাঁন

অধ্যক্ষ, জামেয়া ফারূক্বীয়া, করাচী (পাকিস্তান)।

১২ই যিলহজ্জ, ১৪২৫/২৩শে জানুয়ারী, ২০০৫

অবতরণিকা

-মওলানা আসলাম শায়খপুরী

আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কতো বড় দূরদর্শিতার আশীর্বাদ পেয়েছিলেন যে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এমন বিদ্বেষপূর্ণ লোকের জন্ম হবে যারা তাঁর বিশুদ্ধ ও মহৎ সাহাবা (রা.)’বৃন্দকে সমালোচনার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করবে। নিজেদের ভুল-ত্রুটি ও দুর্বলতা নিয়ে চিন্তাভাবনা না করে তারা পূর্বসূরীদের প্রথম দলটিরই ত্রুটিবিচ্যুতি তালাশ করবে। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত জোর দিয়ে বলেছেন:

 “আল্লাহকে ভয় করো! আমার সাহাবাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো! আমার পরে তাদেরকে সমালোচনার লক্ষ্যে পরিণত করবে না।” 

ক্বুর’আন মজীদে বর্ণিত সমস্ত গুণাবলী ও সচ্চরিত্র, সমস্ত উল্লেখিত সুসংবাদই প্রথমে সাহাবায়ে কেরাম (রা.) এবং তারপর অন্যদের জন্য প্রযোজ্য। যদি আল-ক্বুর’আন এমন পুণ্যাত্মাবৃন্দকে সত্যিকারের ঈমানদার (বিশ্বাসী), ধার্মিক, আল্লাহভীরু, রাতভর প্রার্থনাকারী, নম্র এবং উদার বলে সম্বোধন করে, তাদের জন্য একটি মহান পুরস্কার, ক্ষমা, হেদায়েত, রহমত এবং জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয়, তাহলে এগুলো সম্মানিত ও বিশিষ্ট ফুকাহা, মুহাদ্দিসীন ও মুফাসসিরীনের আগে প্রথমে সাহাবা (রা.)’মণ্ডলীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে। আল্লাহ না করুন, তাঁরা ঈমান ও হেদায়েত-শূন্য হলে এই পৃথিবীতে কোনো মানুষই ঈমান ও হেদায়েত লাভ করতে পারতেন না।

নির্যাতিত সাহাবী, যিনি প্রায়শই এই ধরনের সমালোচনার লক্ষ্যবস্তু হন, তিনি ছিলেন ওহী (প্রত্যাদেশ)-এর লেখক, আমীরুল মু’মিনীন সাইয়িদুনা মু’য়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহু। তাঁর বিশ বছর সময়কালের খিলাফত ও উম্মাহকে শাসন, তাঁর অর্জিত গৌরবময় বিজয় এবং তাঁরই নেতৃত্বে যে অগ্রগতি হয় তা উপস্থাপন করা অধিকতর উপযুক্ত হওয়া উচিত ছিল, যা সম্মানের সাথে স্মরণ করা উচিত। তাঁর দক্ষতা ও প্রতিভা, ঈমান ও সচ্চরিত্র নিয়ে আলোচনা করা আরও উপযুক্ত হতো, কিন্তু দুঃখজনকভাবে এর বিপরীতটাই ঘটেছে। বরং তাঁর ব্যক্তিসত্তার প্রতি এমন নোংরামি আরোপ করা হয়েছে যে স্রেফ এ ধৃষ্টতার কথা ভাবলেই কেঁপে উঠতে হয়। ধর্মে অবিশ্বাসী কারো কাছ থেকে এটা প্রত্যাশিত হতো; কিন্তু এসব অভিযোগ আমাদের সম্প্রদায়ের ভেতর থেকেই এসেছে এমনভাবে যে তাদের নাম নিতেও লজ্জা লাগে। এই আক্রমণ এ একজন সাহাবী (রা.) যিনি আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রক্তের আত্মীয়, স্রেফ তাঁরই প্রতি সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা বনূ উমাইয়া গোত্রের উপরও ছড়িয়ে পড়েছিলো, আর তা এমন পর্যায়ে যে তাঁদের সবাইকেই চিত্রিত করা হয়েছে স্বৈরাচারী ও অত্যাচারী এবং বদমাইশ দখলদার হিসেবে। যারা ইতিহাসের পাতা ও বর্ণনাকে বিকৃত করেছে তারা চিন্তাও করেনি যে তারা সেই হাতকেই কামড়াচ্ছিল যেটা তাদেরকে টিকিয়ে রেখেছে; কারণ তারা যে দেশে বাস করছে সেগুলোকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বনূ উমাইয়া গোত্রই ইসলামের পতাকাতলে নিয়ে এসেছিলন। তাঁদের শাসনের অধীনেই ইসলামের সীমানা আফ্রিকা, ইউরোপ এবং এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল, যে দূরবর্তী ভূমিগুলোতে ইসলামের আলো জ্বলছিল। এসব ভূখণ্ডে (সীমানার) যে সম্প্রসারণ অব্যাহত ছিল তাও পরবর্তীকালে বনূ উমাইয়ার শাসনামলে সংঘটিত হয়েছিল।

শ্রদ্ধেয় মওলানা জাফর ইকবাল (আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধি করুন) এই বইয়ে এমন সব অভিযোগকারীর অভিযোগ খণ্ডন করেছেন যারা হয়তো নিজেদেরকে আহলুস সুন্নাহ এবং সাহাবা (রা.)’বৃন্দের আশেক্ব-ভক্ত বলে দাবি করতে পারে, কিন্তু যাদের কথা ও লেখা নিজেদের দাবিকেই সমর্থন দিতে ব্যর্থ। সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর বিরুদ্ধে কলম তুলতে গিয়ে অনেক লোক এমনভাবে ছিটকে পড়েছে যে, অনেক সময় তারা মানুষকে সাইয়্যিদুনা ‘আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’এর প্রতি সন্দেহ করার এবং তাঁর বিরুদ্ধাচরণে করার বেলায় প্ররোচিত করেছে। এ কারণেই মওলানা সাহেব এই ধরনের অভিযোগ খণ্ডন করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন, কখনো ন্যায়ের পথ থেকে বিচ্যুত হননি বা তাঁর ভাষার ব্যবহারও কোনোভাবেই অবমাননাকর হয়ে ওঠেনি। শ্রদ্ধেয় লেখকের কেবল তাঁর কলম এবং জিহ্বার নিয়ন্ত্রণই নয়, বরং প্রতিপাদ্য বিষয়ের ওপরও নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, যে কারণে তাঁর বইটি পাঠককে স্বস্তি দিতে এবং আশ্বস্ত করতে সফল হয়েছে। যে কেউ এই বইটি পক্ষপাতমুক্ত হয়ে পড়লে আমার সাথে সম্পূর্ণ একমত হবেন।

সাহাবায়ে কেরাম (রা.)’বৃন্দের হীন সেবক,

মুহাম্মদ আসলাম শায়খপুরী

অবতরণিকা

-মওলানা যাহিদ আল-রাশিদী

نحمده تبارك و تعالى و نصلى و نسلم على رسوله الكريم و على اله و اصحابه و اتباعه أجمعين.

আমীরুল মু’মিনীন সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহু হলেন ইসলামের সেসব মহান ব্যক্তিত্বদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত, যাঁরা ইসলামের সীমানা ও শাসনকে প্রসারিত করেছিলেন, ধর্মের সেবা ও এর খাতিরে ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাঁর বিশ বছরের খিলাফত, যা ছিল আপন অধিকারে অনন্য, তা পরবর্তীকালে ঘটে যাওয়া মহান বিজয় ও ইসলামের প্রসারের মূল কারণ। তিনি ছিলেন আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একজন সাহাবী, ওহী লেখক, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় এবং আরব বিশ্বের অন্যতম মহান রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বিখ্যাত। তাঁর সহনশীলতা, ধৈর্য এবং রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টি সর্বদা স্বীকৃত ছিল। তিনি যেভাবে বিশ বছর ধরে সমগ্র উম্মাহকে পরিচালনা করেছেন তা ইসলামের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়। একজন নেতা ও রাজনীতিবিদ হওয়ার পাশাপাশি তিনি একজন মুজতাহিদও ছিলেন, যাঁর মর্যাদা জ্যেষ্ঠ সাহাবা (রা.)’বৃন্দও স্বীকার করেছেন। এটি একটি সর্বজনবিদিত সত্য যে, যখন কোনো মুজতাহিদ তাঁর ধীশক্তিকে কোনো ফায়সালার দিকে প্রয়োগ করেন তখন তা সঠিক বা ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাঁর কিছু রায় হয়তো তাঁর সমসাময়িকদের দ্বারা গৃহীত নাও হতে পারে এবং এই ধরনের ক্ষেত্রে যাঁরা তাঁর সাথে ভিন্নমত পোষণ করেন তাঁদের সকলের মতো তাঁরও একই অধিকার রয়েছে। তবে কিছু লোক এসব মতপার্থক্যকে সমালোচনার বস্তুতে পরিণত করেছে এবং প্রকৃতপক্ষে তাঁকে প্রত্যাখ্যান ও নিগ্রহের ছুতো বানিয়েছে। এই ধারা আজো অব্যাহত রয়েছে, যা জ্ঞান ও ন্যায্যতা উভয়েরই বিরোধিতা করে, আর যার ফলে সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু আজ ইসলামী ইতিহাসের অন্যতম নিপীড়িত ব্যক্তিত্বে পরিণত।

সমস্ত অভিযোগের তীর এরপর সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বনূ উমাইয়া গোত্রের দিকে তাক হয়ে যায়; অথচ বনূ উমাইয়্যার শাসন আফ্রিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার সীমানা পর্যন্ত দূরদূরান্তে ইসলামের পতাকা উড্ডীনের গৌরব অর্জন করেছে। তাঁদের নেতৃত্বেই রোম ও পারস্যের সাম্রাজ্য পরাভূত হয়, আর এটা আরবদেরকে গণনা করার মতো শক্তিতে পরিণত করে। সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু যে পদ্ধতিতে ইসলামের আইন ও শিক্ষাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ অনুসারে প্রয়োগ করেছিলেন তা ইমাম তিরমিযী (রহ.)’এর নিম্নোক্ত বর্ণনা থেকে সহজেই অনুমেয়: 

একবার রোমানবর্গ হযরতে আমীরে মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর সাথে একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষর করেছিল। মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার সময় ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে আমীরে মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে দামেস্ক ছেড়ে রোমান সীমান্তের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন এই ভেবে যে, চুক্তিটি শেষ হওয়ার সাথে সাথে তাঁর সৈন্যরা সীমান্ত থেকে অগ্রসর হতে প্রস্তুত হবে। তাঁরা যখন ওই পথে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবী হযরত ’আমর ইবনে আবাসাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু দ্রুতগতিতে তাঁদের পিছু পিছু চলে এলেন। তিনি মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একখানা হাদীস অবহিত করেন এ মর্মে যে, যদি অন্য জাতির সাথে আপনার কোনো (যুদ্ধবিরতির) সন্ধিচুক্তি থাকে, তবে যতোক্ষণ পর্যন্ত চুক্তিটি বহাল থাকবে ততোক্ষণ আপনি আপনার সৈন্যদের অগ্রসরও করবেন না। আমীরে মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এই কথা শোনার সাথে সাথে কেবল অগ্রসর হওয়াই বন্ধ করেননি, বরং তাঁর সৈন্যদেরও দামেস্কে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। [ইমাম তিরমিযী]

অনুরূপভাবে, ইমাম তাবারানী রাহিমাহুল্লাহ এবং আবু ইয়ালা রাহিমাহুল্লাহ তাঁদের এসনাদ-সহ আরেকটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন, যে সম্পর্কে ইমাম ইবনে হাজর আল-হাইসামী রাহিমাহুল্লাহ (মাজমা’ আল-জাওয়ায়েদ খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-২৩৬) বলেছেন: “বর্ণনাকারীরা সকলেই নির্ভরযোগ্য।” ঘটনাটি নিম্নরূপ: 

আমীরে মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর স্বাভাবিক নিয়ম ভেঙ্গে এক শুক্রবার জুমুআ’র খুতবায় বলেছিলেন: “যুদ্ধের গনীমতের বণ্টন এবং সরকারি কোষাগার আমার বিবেচনার বিষয়; আমি যাকে চাই তাকে দেবো এবং যাকে দিতে চাই না তাকে দেবো না।” এ কথা বলার পর কেউ কোনো জবাব দেননি। পরের সপ্তাহে তিনি একই কথা বললেন এবং কেউই উত্তর দিলেন না। তবে তৃতীয় সপ্তাহে যখন তিনি এটি পুনরাবৃত্তি করলেন, তখন ভিড়ের মধ্য থেকে একজন দাঁড়িয়ে বললেন: “কখনোই না! যুদ্ধের গনীমত ও সরকারি কোষাগার সকল মুসলমানের; কেউ আমাদের এবং এগুলোর মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়ালে তাঁর ভাগ্য তরবারির দ্বারা নির্ধারিত হবে।” সালাতের পর হযরতে মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু লোকটিকে তাঁর সামনে ডেকে পাঠালেন। হযরতে আমীরে মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর সাথে কঠোর আচরণ করতে পারেন অনুমান করে অন্যরা তাঁর পক্ষে সুপারিশ করার জন্য দরবারে উপস্থিত হন। যখন তাঁরা দরবারে পৌঁছেন, তাঁরা দেখতে পান যে হযরতে মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু লোকটিকে তাঁর পাশে বসিয়েছেন এবং তিনি যা বলেছিলেন তার জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানাচ্ছিলেন। অতঃপর আমীরে মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁদের বললেন, “আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, এমন সব নেতার আবির্ভাব হবে যারা যা খুশি তাই বলবে অথচ কেউই তাদের (কথার) প্রতি আপত্তি করবে না। এই ধরনের নেতাদের বানরে রূপান্তরিত করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এই কথা মাথায় রেখেই আমি খুতবায় এ কথা বলেছিলাম, কেউ আপত্তি করবে কি না তা দেখার উদ্দেশ্যে। যখন কেউ আপত্তি করেনি, তখন আমি খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম এবং তাই আমি দ্বিতীয় সপ্তাহে আবার এটি পুনরাবৃত্তি করেছি কিন্তু আবার কেউ আপত্তি করেনি এবং আমার উদ্বেগ এতে আরো বেড়ে যায়। কিন্তু আজ যখন আমি তৃতীয়বার পুনরাবৃত্তি করলাম, তখন এই ব্যক্তি আপত্তি করলেন, যার দরুন আমি সান্ত্বনা পেলাম যে আমি সেই শাসকদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত নই। তিনি আমাকে জীবন দিয়েছেন এবং আল্লাহ তাঁকেও জীবন দান করুন।” [ইমাম ইবনে হাজর হায়সামী মক্কী, মজমাউয্ যওয়াঈদ, ৫:২৩৬]

এমন ব্যক্তিত্বের অধিকারী, যিনি একটি হাদীস শোনার পর তাঁর সৈন্যদের ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন, যিনি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সতর্কবাণী সম্পর্কে এতোটাই চিন্তিত যে তিনি উপরে বর্ণিত পদ্ধতিতে কাজ করেন, তাঁর বিরুদ্ধে কুরআন ও সুন্নাহ পরিবর্তনের অভিযোগ উত্থাপন কি মানহানিকর নয়? আল্লাহ মাফ করুন! অভিযোগকারীরা সত্যি ন্যায্যতার পরিমণ্ডল থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেছে!

এ দিয়েই আমার উত্তম বন্ধু মওলানা মুহাম্মাদ জাফর ইকবাল সাহেব হযরতে সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর পক্ষে কলম তুলে নিয়েছেন। তিনি সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলি বিশদভাবে অধ্যয়ন করেছেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে গভীর ঘৃণা ও কুসংস্কারের ফলস্বরূপ আগত অভিযোগসমূহের অনেকগুলিকে ভিত্তিহীন প্রমাণ করেছেন। কিছু অভিযোগ শুধুমাত্র ফিক্বাহ/বিধানশাস্ত্রের বিষয়গুলির সাথে সম্পর্কিত, কিন্তু অভিযোগকারীরা মুজতাহিদ হিসেবে সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর মর্যাদাকে উপেক্ষা করেছে এবং তাঁর (ফিক্বহী) মতামতের জন্য তাঁকে অপমান করেছে।

আল্লাহ তা’আলা মওলানা জাফর ইকবালকে অগণিত উত্তম প্রতিদান দিন এবং তাঁকে এই ক্ষেত্রে খেদমত চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা প্রদান করুন। 

আবু আম্মার জাহিদ আল রশিদী

পাকিস্তান ধর্মীয় পরিষদের মহাসচিব

১০ই মার্চ ২০০৫

ভূমিকা

بسم الله الرحمن الرحيم

و صلى الله على النبي الكريم.

একটি সাধারণ নীতি আছে যা ছাড়া কোনো ব্যক্তিই আমাদের স্বীকৃতির সিস্টেমকে বুঝতে সক্ষম হবে না; অন্য কথায় যে পদ্ধতির মাধ্যমে স্বীকৃতি এবং মর্যাদা দেয়া হয়। এই নীতিটি বোঝা খুবই সহজ যখনই কোনো ব্যক্তি বা সত্তা হক্ব (খোদা তায়ালার সত্য)’এর সাথে যুক্ত হন, তখন এই ব্যক্তি শুধুমাত্র তাঁর ব্যক্তিগত গুণাবলীর কারণে প্রশংসা পাবেন না, বরং ওই ঐশী সত্যের সাথে তিনি যে সংযোগের ভাগিদার সেটার কারণেই তাঁর প্রশংসা করা হবে। .

একে অন্যভাবে বলতে গেলে, সম্পূর্ণ নাজাত পাওয়ার জন্য প্রত্যেক ব্যক্তির পক্ষে নিজেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে যুক্ত করা অবশ্য কর্তব্য। এই সংযোগটি-ই স্বীকৃতির পার্থক্যকারী বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত মূলভিত্তি। নিঃসন্দেহে আহলুল বাইত এবং মহান সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন) ছিলেন ন্যায়পরায়ণতার অন্তহীন ঝর্ণা; কিন্তু আসল পার্থক্যকারী বৈশিষ্ট্য, যা তাঁদেরকে শ্রেষ্ঠত্বের সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেছিল, তা হলো আল্লাহর প্রিয়তম সায়্যিদুনা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে তাঁদের সংশ্লিষ্টতা। এই সম্মান তাঁদের একক অধিকার।

নিঃসন্দেহে তাঁদের ব্যক্তিগত গুণাবলী তাঁদের উচ্চ মর্যাদায় অবদান রাখবে, তবে এটি স্বীকৃতির মৌলিক মানদণ্ড নয়। একইভাবে, ব্যক্তিগত ত্রুটিগুলি তাঁদের উচ্চ মর্যাদাকে ক্ষুন্ন করবে না। যে নীতিটি প্রত্যেকের বুঝতে হবে তা হলো, এমন কোনো অর্জন নেই যা সাহাবী হওয়ার মর্যাদাকে অতিক্রম করতে পারে এবং কুফর ছাড়া এমন কোনো ত্রুটি নেই যা একজন সাহাবীর মর্যাদাকে ক্ষুন্ন করতে পারে।

পরিতাপের বিষয়, এমন একাধিক দল রয়েছে যারা এই মৌলিক নীতি থেকে দূরে সরে গেছে এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষা থেকে আরো দূরে সরে যাচ্ছে। বিপথগামী দলগুলোকে বাদ দিন, আহলুস সুন্নাতের মধ্যেই এমন লোক পাওয়া যাবে যারা সম্মানিত সাহাবা (রা.)’বৃন্দের প্রশ্নাতীত মর্যাদাকে অবজ্ঞা করেছে।

এই লোকদের মধ্যে যারা তাসাউফ (সূফীবাদ)-এর আবরণের নিচে তাদের (অসৎ) উদ্দেশ্যকে আবৃত করে রেখেছেন, যে সূফীবাদে বিশিষ্ট সাহাবী সাইয়্যিদুনা ‘আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু অতীব গুরুত্বপূর্ণ আসনে অধিষ্ঠিত।

এই ব্যক্তিদের সাইয়্যিদুনা ‘আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র প্রতি এমন চরম ভালোবাসা রয়েছে যে, তাঁর প্রতি তাদের ভক্তি প্রমাণ করার জন্য তাদের উচ্ছ্বাসে তারা চরমপন্থা এবং উদাসীনতার মধ্যে পার্থক্য করতে ব্যর্থ হয়; এটা আরো প্রযোজ্য যখন সাইয়্যিদুনা মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর সাথে সম্পর্কিত হওয়ার প্রসঙ্গ ওঠে। সাইয়্যিদুনা মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর প্রতি তাদের মনে বিদ্বেষ সাইয়্যিদুনা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’কে ভালোবাসার পূর্বশর্ত, এবং এইসব গোঁড়া কথোপকথন তাদের তথাকথিত আধ্যাত্মিক সমাবেশের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কুরআন ও সুন্নাহর শিক্ষার পরিপন্থী। এই প্রকৃতির আধ্যাত্মিক সমাবেশগুলি গুরু বা শিষ্যদের কোনো উপকার করে না এবং তা ইসলামের নীতি থেকে দূরে সরে যায়।

যে সকল (তথাকথিত) ’দরবেশ’ এই সমাবেশগুলি পরিচালনা করে, নিজেদের শিষ্যদের আধ্যাত্মিক উন্নতিতে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। তাদের একমাত্র আগ্রহ ভক্তদের একটি দল তৈরি করা, যারা তাদের ‘পূজা’ ও ভক্তি করবে। এটি অর্জনের জন্য তারা সাইয়্যিদুনা ‘আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’-এর পবিত্র নামের অপব্যবহার করে, যাঁকে ঘিরে কিংবদন্তির এক গুচ্ছ কল্পকাহিনি বানানো হয়েছে। তবে সত্য হলো, এই গল্পগুলি ভিত্তিহীন এবং তাদের ঊর্বর মস্তিষ্কের ফসল। সাইয়্যিদুনা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর মহান ব্যক্তিত্বের সাথে এসব কাহিনীর কোনো সম্পর্কই নেই। পয়গাম্বর ঈসা আলাইহিস সালাম-সম্পর্কিত গল্পগুলি অতি উৎসাহী খ্রিস্টানবর্গ যেমনটি বানিয়ে নিয়েছে, ঠিক তেমনি সাইয়্যিদুনা ‘আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু’ সম্পর্কেও কাল্পনিক কাহিনী অনবহিত মানুষদেরকে ধোঁকা দেয়ার জন্যে বানানো হয়েছে।

এসব লোকের সীমিত যুক্তি ও বুঝ অনুসারে তারা ঘোষণা করে যে, সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’এর মধ্যে কারো যদি সাইয়্যিদুনা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর সাথে মতভেদ থাকে, তাহলে সেই সাহাবী (রা.)’কে ইসলামের গণ্ডি থেকে বের করে দেওয়ার জন্য তা-ই যথেষ্ট হবে। অন্যদিকে, সাইয়্যিদুনা আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং সাইয়্যিদুনা ‘উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর সাথে কোনো সাহাবীর মতানৈক্যের কোনো অনুরূপ ফলাফল নেই। এই বিভ্রান্তির কারণ হলো, তারা সাইয়্যিদুনা ‘আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’-এর সাথে এমন কিছু গুণাবলীকে সংযুক্ত করেছে, যেগুলো শুধুমাত্র আল্লাহ তা’আলার জন্য বা আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য সুনির্দিষ্ট।

মহীয়ান সাহাবী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’বৃন্দ একটি দল হিসাবে তাঁদের মর্যাদার প্রশ্নে সবাই সমান, এবং একজন সাহাবীর পক্ষে অপর সাহাবীর সাথে দ্বিমত পোষণ করা ন্যায়সঙ্গত। এই মতবিরোধগুলি সঠিক বা ভুলও হতে পারে। যখন জনৈক সাহাবী জ্ঞানী সাহাবী ও খলীফা সাইয়্যিদুনা উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে দেনমহরের একটি নির্দিষ্ট বিধান সম্পর্কে প্রশ্ন করতে পারেন, তখন সাইয়্যিদুনা মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর পক্ষে খলীফা উসমান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর হত্যাকারীদের বিচার চেয়ে সাইয়্যিদুনা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর সিদ্ধান্তকে প্রশ্ন করা কেন ভুল হবে?

সাইয়্যিদিনা মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক সায়্যিদুনা উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর হত্যার বিষয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকার ছিল কি না তা প্রথমেই প্রতিষ্ঠিত করা আবশ্যক। এটা কি ধর্মীয় বিষয় ছিল না? এই বিষয়ে আরো প্রশ্ন করা কি ধর্মহীনতা ছিল? কেউ বেশির থেকে বেশি হলে যা প্রমাণ করতে পারবেন তা হলো, উভয় সাহাবী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা) খলীফা উসমান (রাদ্বিয়াল্লাহু অনহু)’এর হত্যার বিষয়টি কীভাবে সমাধান করা যায়, তা নিয়ে নিজেদের ইজতেহাদগত মতপার্থক্যে জড়িয়েছিলেন। হ্যাঁ, তাঁরা হয়তো এই প্রক্রিয়ায় ভুল করেছিলেন, কিন্তু এর জন্য তাঁরা তবুও পুরস্কৃত হবেন, যা আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের প্রতিষ্ঠিত দৃষ্টিভঙ্গিগত অবস্থান। হায়! সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুকে যদি সায়্যিদুনা উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর হত্যার সঙ্গে জড়িত সবাইকে গ্রেপ্তার ও শাস্তি দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হতো, তবে আজকে বর্তমানের অবিশ্বাস ও বিভাজনের অনেক বিষয় অস্তিত্বশীল থাকতো না; আর সাইয়্যিদুনা খলীফা উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর খিলাফতকালে আরম্ভ হওয়া ইসলামের বিজয় থেমে যেতো না। নিঃসন্দেহে সাইয়্যিদুনা ‘উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’-এর শাহাদাত উম্মাহর চেতনাকে ভেঙে দিয়েছিল, যা সাইয়্যিদুনা ‘আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বা সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কেউই আর পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি। [বঙ্গানুবাদকের নোট: সুন্নী জামা’আতের সিদ্ধান্ত হলো খলীফা ইমামে আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু’এর ইজতিহাদ সঠিক ছিলো এবং আমীরে মু’য়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র ইজতিহাদ ভুল ছিলো; তবে এ কথা সত্য যে, ওই সময়কাল ছিলো ইসলামের জন্যে চরম পরীক্ষার; কেননা ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেছিলো সাবাইয়্যা-চক্র] 

যখন আমি ‘সাইয়্যিদুনা মুয়াবিয়া (রা.) সম্পর্কে ইতিহাস বিকৃতির অপনোদন’ শিরোনামের বইটি দেখতে পেলাম, তখন গভীর কৃতজ্ঞতার অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হলাম এ কারণে যে, আল্লাহর রহমতে মুহাম্মদ জাফর ইকবাল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি ভালোবাসার একটি প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করেছেন।

আল্লাহ তা’আলা তাঁকে এই উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য এবং এ বই সুসম্পন্নকরণ নিশ্চিত করার জন্য প্রচুর প্রতিদান দিন। আল্লাহ তাঁকে তাঁর সবচেয়ে নেক বান্দাদের কাতারে উন্নীত করুন (আমীন)।

ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবালের সাথে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করার সম্মান আমার হয়নি, তবে আমি জানি যে তিনি সম্মানিত মওলানা ইঊসুফ লুধিয়ানবী শহীদের একজন একনিষ্ঠ পরিচিত ব্যক্তিত্ব। তিনি মওলানা সেলিমুল্লাহ খানের সম্মানিত ব্যক্তিত্ব (সোহবত) থেকেও ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়েছেন এবং যাঁরা আল্লামা খালিদ মাহমূদের সঙ্গ ও শিক্ষা থেকে উপকৃত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে তিনিও রয়েছেন। তিনি অনেক উল্লেখযোগ্য আলেমদের মজলিশে নিয়মিত যাতায়াত করেন এবং আল্লাহ তা’আলা তাঁকে বিচক্ষণ জ্ঞান এবং দীন বোঝার জন্য প্রয়োজনীয় গুণাবলী দ্বারা আশীর্বাদধন্য করেছেন।

কুরআনের মহান মুফাসসির, মওলানা আহমদ ‘আলী লাহোরী রাহিমাহু আল্লাহ একবার বলেছিলেন:

ঈমান রক্ষা ও দ্বীনের উপর অটল-অবিচল থাকার জন্য দুটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এই দুটি বৈশিষ্ট্য হলো:

(১) আখেরাতের চিন্তা;

(২) ধার্মিক পূর্বসূরীদের উপর নির্ভর করা। 

জাফর ইকবাল ভাইয়ের নির্ভরতা তাঁর বই থেকে স্পষ্ট। আল্লাহ ইচ্ছায় পরকালের জন্য তাঁর উদ্বেগও প্রশংসনীয়। আমি এ কথা বলছি কারণ যে ব্যক্তি পূর্বসূরীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন তিনি পরকালের চিন্তাশূন্য হবেন না। আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার প্রবীণদের কাছ থেকে শুনেছি, যে ব্যক্তি পূর্বসূরীদের শিক্ষাকে অগ্রাহ্য করবে সে প্রকৃতপক্ষে তার দৈহিক কামনা-বাসনার দাস হয়ে যাবে এবং শুধুমাত্র এই পার্থিব জগতের আনন্দ অর্জনের দিকে মনোনিবেশ করবে। এই ধরনের ব্যক্তি সর্বদা পরকালের চেয়ে পার্থিব অর্জনকে প্রাধান্য দেয়। আল্লাহ তা’আলা আমাদের সকল ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করুন এবং আমাদেরকে ধার্মিকদের পথে অবিচল রাখুন (আমীন)।

আলোচ্য বইটির উদ্দেশ্য হলো সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অনেকগুলি নিন্দামূলক এবং ভিত্তিহীন অভিযোগের উত্তর দেয়া। অভিযোগগুলো এমনই বিতর্কিত প্রকৃতির যে, কোনো মুসলমান কখনোই তা সহ্য করবেন না। সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর বিরুদ্ধে আরোপিত ভিত্তিহীন যেসব অভিযোগ এই গ্রন্থে স্পষ্ট করা হবে তা নিম্নরূপ:

-বনূ উমাইয়া বনূ হাশিমের প্রতি চরম ঘৃণা পোষণ করতেন।

-সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর মর্যাদা ও ফজিলত সম্পর্কিত বর্ণনাগুলো অসত্য।

-সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাঁর খিলাফতকালে অনেক বিদ’আত উদ্ভাবনের সূচনা করেছিলেন।

-সাইয়্যিদুনা ‘আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানো ছিল সাইয়্যেদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক সংঘটিত একটি ক্ষমার অযোগ্য ভুল।

-সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু সায়্যিদুনা হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছিলেন।

-সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং সাইয়্যেদুনা হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহুর মধ্যে যে শান্তি চুক্তি হয়েছিল তা ছিল অলীক।

-সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর খিলাফত অনুসরণের যোগ্য নয়।

-সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কয়েকটি পত্রের লেখক ছিলেন এবং ওহীর লেখক ছিলেন না।

বনূ উমাইয়া এবং সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর প্রতি বিশেষভাবে নির্দেশিত সাধারণ সমালোচনা এই ভুল ধারণার কারণে উদ্ভূত হয় যে সাইয়্যেদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং বনূ উমাইয়াকে প্রশংসা করা বা স্বীকার করা আহলে বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’কে গালি দেয়ার সামিল। অন্য কথায়, আহলে বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’বৃন্দের প্রতি ভালবাসা ও শ্রদ্ধা তখনই সত্য হতে পারে যখন কেউ বনূ উমাইয়া এবং সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুকে নিন্দা ও গালি দেয়।

মওলানা জাফর ইকবাল উল্লেখযোগ্যভাবে এই ধরনের পক্ষপাতের ত্রুটিগুলি তুলে ধরেছেন এবং বনূ উমাইয়া গোত্রভুক্ত অনেক ব্যক্তির কৃতিত্ব ও মর্যাদা সতর্কতার সাথে প্রমাণ করেছেন। প্রায়শই গোঁড়ামিবাদী তার ভুল বংশগত কুসংস্কারে সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুকে গালিগালাজ করার নিরলস মিশনে শুরু করে, যাতে তাকে মনে করিয়ে দেয়া প্রয়োজন হয় যে এই অপমান যদি সাইয়্যিদুনা ‘আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু কিংবা সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু’র প্রতি নির্দেশিত হয়, তবে এটি খন্ডনের দাবি রাখে; এই নীতি প্রত্যেক সাহাবী (রা.)’এর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

বনূ উমাইয়া এবং ইয়াযীদ-সম্পর্কিত তিনটি হাদীস প্রায়শই সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর বিরোধীরা উদ্ধৃত করে বাস্তবে এ কথাই প্রমাণ করে যে হাদীস-শাস্ত্রে প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও যোগ্যতা থেকে তারা বঞ্চিত। যদি তাদের কোনো জ্ঞান থাকতো, তাহলে তারা কখনোই আল-হাকিম আল- নিশা’পুরীর বর্ণনাগুলোর উপর নির্ভর করতো না। অন্যদিকে, মওলানা জাফর ইকবাল সমস্ত উপাদান যাচাই-বাছাই করেছেন এবং পদ্ধতিগতভাবে সেগুলোর অবিশ্বস্ততা প্রমাণ করেছেন।

যেসব হাদীসে মানাক্বীব (গুণ ও যোগ্যতা) উল্লেখ করা হয়েছে তার অধিকাংশই সহীহ (প্রমাণিত) পর্যায়ের নয়। অনুরূপভাবে, মুহাদ্দীসবৃন্দ সাইয়্যিদুনা ‘আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’ সংক্রান্ত বর্ণনার সত্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে যে পরিমাণ কাজ করেছেন অন্য কোনো সাহাবী (রা.)’এর বেলায় তা করা হয়নি। সহজ কথায়, সাইয়্যিদুনা ‘আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’-এর ফযীলত-সম্পর্কিত অধ্যায়ে ইসলামের আলেম-উলামা যে পরিমাণ ভুলত্রুটি আবিষ্কার করেছেন তা এতোটাই বেশি যে, এ ক্ষেত্রে অস্বীকার করার আর কোনো বিকল্প নেই। এতদসত্ত্বেও ইসলামের আলেম-উলামা কখনো বলেননি যে সাইয়্যিদুনা ‘আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’-এর মর্যাদা প্রমাণিত নয়। তাহলে সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর ক্ষেত্রে একই মনোভাব ও নীতি কেন প্রয়োগ করা হয় না?

তদুপরি, সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু একজন বিদ’আতী ছিলেন মর্মে দাবির পক্ষে প্রমাণস্বরূপ ব্যবহৃত বর্ণনাটিকে নির্ভুলভাবে ভিত্তিহীন সাবেত/প্রমাণ করেছেন মওলানা জাফর ইকবাল সাহেব। এই আলোকে মওলানা মুহাম্মাদ নাফী’র ব্যাখ্যা এমন জ্ঞানদীপ্ত যে আশা করি সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর সকল বিরোধীদের জন্য এটা সাফল্য ও হেদায়াত/পথপ্রদর্শনের মাধ্যম হবে।

সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর বিরুদ্ধে সাধারণতঃ উত্থাপিত একটি যুক্তি ছিল এই যে, তিনি-ই সাইয়্যিদুনা হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বিষ প্রয়োগের উদ্যোগ নিয়েছিলেন বা এতে উস্কানি দিয়েছিলেন। মওলানা জাফর ইকবাল এ বিষয়ে যে কোনো এবং সব ধরনের ভুল বোঝাবুঝিরই খণ্ডন করেছেন।

সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর যুগ সম্পর্কে পণ্ডিতদের অভিমত এই যে, এটি ‘খিলাফত আল-রাশিদাহ’ হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ খিলাফতের অংশ নয়, তবে এর অর্থ এই নয় যে এটি ইসলামের জন্য উপকারশূন্য এবং অনুসরণের অযোগ্য যুগ ছিল। মওলানা জাফর ইকবাল সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর খিলাফত নিয়ে বিভিন্ন সন্দেহ ও অভিযোগের খণ্ডনেও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন।

সায়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর বিরোধীরা তাঁর বিরুদ্ধে যুক্তি দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে যে সাধারণ ভুলগুলো করে থাকেন তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এই অভিযোগ, সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু ওহীর লেখক ছিলেন না, বরং তিনি কেবলমাত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কয়েকটি পত্রের লেখক ছিলেন। মওলানা জাফর ইকবাল আবারো এই অভিযোগটি খণ্ডন করেছেন এবং সত্য ও নির্ভরযোগ্য বর্ণনার পাশাপাশি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের এক বিন্যাস উপস্থাপন করেছেন যা চূড়ান্তভাবে এই বিষয়টির সমাধান করে দিয়েছে। আল্লাহর রহমতে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে ইবনে হাজম রাহিমাহু লিল্লাহ, আল-খতীব আল-বাগদাদী রাহিমাহুল্লাহ, ইবনে হাজার আল-আসকালানী রাহিমাহুল্লাহ, আল-যাহাবী রাহিমাহুল্লাহ এবং তাঁদের মতো জ্ঞানের পথিকৃৎবৃন্দের বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগের কোনো মূল্যই নেই।

সংক্ষেপে, সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর প্রতি সন্দিহান লোকেরা যে সমস্ত ভিত্তিহীন সমালোচনা উপস্থাপন করার দুঃসাহস দেখায়, সেগুলিকে লেখক মওলানা জাফর ইকবাল নাকচ ও খণ্ডন করেছেন। সূচি এবং পাণ্ডিত্যপূর্ণ উপস্থাপনা পূর্ববর্তী যুগের জ্ঞান বিশারদবৃন্দের রচিত গ্রন্থাবলীর অনুস্মারক এবং এটি-ই এই বইটিকে সত্যিকার অর্থে একটি মাস্টারপিস করে তুলেছে।

উপসংহারে আমি সেসব সংশয়বাদীর প্রতি উদ্দেশ্যকৃত এই রদের প্রশংসা করতে চাই এ মর্মে যে, সংশয়বাদীরা মাঝে মাঝে শিয়া মতবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারে, বিশেষ করে যখন কেউ তাদের চারপাশের ওই পরিস্থিতি বিবেচনা করে যেখানে এই ধরনের অনুভূতি প্রকাশ করা অসম্ভব না হলেও অত্যন্ত কঠিন, কিন্তু এর পাশাপাশি কেউ এটাও বুঝতে পারেন যে এই সংশয়বাদীরাও শিয়াদের মতো একই অপরাধে দোষী। দুঃখের বিষয়, এই দিনে ও যুগে সাইয়্যিদুনা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে প্রাধান্য দেয়াটা নির্দিষ্ট কিছু সম্প্রদায়ের মাঝে একটা মৌলিক বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে; কখনো কখনো তাদের ধর্মান্ধতা বিচ্যুতির দিকে নিয়ে যায়। বস্তুতঃ এই (উগ্র) বিশ্বাসের কারণেই ইতিহাসে অনেক রক্ত ​​ঝরেছে এবং তাই এর দ্বার রুদ্ধ করা শরঈ (ধর্মীয়) প্রয়োজনে পরিণত হয়েছে। বিষয়টি এতোটাই গুরুতর যে, কিছু ব্যক্তি সাইয়্যিদুনা ‘আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’কে বাকি আম্বিয়া (আলাইহিমিস সালাম)’বৃন্দের চেয়েও উচ্চাসনে বসিয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর মহান পরিবারকে ভালোবাসা ও সম্মান করা ঈমানের পূর্বশর্ত, কিন্তু একই সাথে সতর্ক থাকতে হবে যেনো এই ভালোবাসাকে ব্যক্তিগত লাভের জন্য ব্যবহার না করা হয়। এ রকম করা ইসলামের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা ও শত্রুতা হবে।

তবু সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর পক্ষ সমর্থনে এই পাণ্ডুলিপিটি প্রস্তুত করার জন্য মওলানা জাফর ইকবালের প্রতি আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট, যা (আল্লাহর ইচ্ছায়) সবার জন্য অনেক উপকারী হবে। আল্লাহ তা’আলা তাঁকে তাঁর প্রচেষ্টার জন্য প্রচুর পুরস্কৃত করুন এবং তাঁকে তাঁর সমস্ত প্রচেষ্টায় সফলতা দান করুন (আমীন)। 

জাবিদ আমীর ‘উসমানী 

ইকবাল একাডেমী

লাহোর, পাকিস্তান।

সাইয়্যেদুনা মু’য়াবিয়া (রা:) সম্পর্কে ইতিহাস বিকৃতির অপনোদন

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি যথেষ্ট এবং তাঁর নির্বাচিত বান্দাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সেই দ্বীন সাহাবায়ে কেরামের প্রতি আরোপ করেছেন, যা তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি সম্পূর্ণ করেছিলেন এবং যে সমৃদ্ধিকর ধর্মের প্রতি তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন:

اَلْیَوْمَ اَكْمَلْتُ لَكُمْ دِیْنَكُمْ وَاَتْمَمْتُ عَلَیْكُمْ نِعْمَتِیْ وَرَضِیْتُ لَكُمُ الْاِسْلَامَ دِیْنًا.

অর্থ: আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন মনোনীত করলাম। [আল-ক্বুর’আন ৫:৩; নূরুল ইরফান]

ইসলামের ইতিহাস শুরু হয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’বৃন্দের মাধ্যমে। তাঁদের গুণাবলী ও শ্রেষ্ঠত্ব পূর্ববর্তী নবী-রাসূল (আলাইহিমিস্ সালাম)-বৃন্দ স্বীকার করেছিলেন এবং পূর্ববর্তী সকল জাতিগোষ্ঠী তাঁদের (মানে সাহাবা কেরামের) প্রতি করা প্রশংসাস্তুতি বর্ণনা করে নিজেদের ঈমান মজবুত করতেন:

ذٰلِکَ مَثَلُهُمْ  فِی التَّوْرٰىةِ وَ مَثَلُهُمْ  فِی الْاِنْجِیْلِ.

অর্থ: তাদের এ বৈশিষ্ট্য তাওরীতের মধ্যে রয়েছে এবং তাদের (অনুরূপ) বৈশিষ্ট্য রয়েছে ইনজীলে…। [আল-ক্বুর’আন, ৪৮:২৯; নূরুল ইরফান]

ইসলামের ইতিহাস থেকে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-কে মুছে ফেললে ইসলামী দ্বীন এক ধাপও এগোতে পারবে না।

عن عويم بن ساعدة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : أن الله تبارك وتعالى اختارني واختار لي اصحابا ، فجعل لي منهم وزراء و أنصارا و أصهارا ، فمن سبهم فعليه لعنة الله والملائكة والناس أجمعين ، لا يقبل منه يوم القيامة صرف ولا عدل. (هذا حديث صحيح الإسناد ولم يخرجاه وقال الذهبي رحمة الله عليه صحيح )

অর্থ: হযরত উওয়াইম ইবনে সা’ঈদাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: “নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা আমাকে মনোনীত করেন এবং সাহাবাদেরকে আমার জন্যে মনোনীত করেন। তিনি তাদের মধ্যে কাউকে কাউকে আমার উজির, কাউকে কাউকে আনসার (মানে সাহায্যকারী), কাউকে কাউকে বিয়ে-শাদীর মাধ্যমে আমার আত্মীয়স্বজন বানান। অতঃপর যে ব্যক্তি তাদেরকে গালিগালাজ করবে তার প্রতি আল্লাহর, তাঁর ফেরেশতাকুলের ও সমগ্র মানবজাতির অভিশাপ পতিত হোক! পুনরুত্থান দিবসে তার কোনো ভালো আমল বা ন্যায়পরায়ণতাই আল্লাহর দরবারে ক্ববূল হবে না।” [ইমাম যাহাবীর দৃষ্টিতে সহীহ হাদীস: ‘মুস্তাদরাক আল-হাকিম,’ ৫ম খণ্ড, ৬৩২ পৃষ্ঠা]

সাইয়্যেদুনা আবদুল্লাহ ইবনে মাস’উদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন:

إن الله نظر في قلوب العباد فاختار محمدا صلى الله عليه وسلم فبعثه برسالته وانتخبه بعلمه ، ثم نظر في قلوب الناس بعده ، فاختار له أصحابا ، فجعلهم أنصار دينه ووزراء نبيه ، وما رآه المؤمنون حسنا فهو عند الله حسن، وما رآه المؤمنون قبيحا فهو عند الله قبيح.

অর্থ: আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের অন্তরের প্রতি নজর/দৃষ্টিপাত করে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে মনোনীত করেন এবং তাঁকে রেসালাত-সহ প্রেরণ করেন, আর তাঁকে (খোদার) আপন জ্ঞানের ভাণ্ডারের জন্যে বেছে নেন। অতঃপর আল্লাহ মানবজাতির অন্তরের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন এবং (তাদের মধ্য হতে) রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর জন্যে সাহাবাদেরকে মনোনীত করেন। তিনি তাদেরকে তাঁর দ্বীনের সাহায্যকারী এবং তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর উজির বানিয়ে দেন। ঈমানদার মুসলমান সাধারণ সর্বসম্মতিক্রমে যা কিছুকে উত্তম বিবেচনা করে, তা আল্লাহর দৃষ্টিতেও উত্তম বলে গৃহীত; আর ঈমানদার মুসলমান সাধারণ সর্বসম্মতিক্রমে যা কিছুকে মন্দ বিবেচনা করে, তা আল্লাহর দৃষ্টিতেও মন্দ হিসেবে গৃহীত। [মুসনাদে আবী দাউদ তায়্যালিসী, ৩৩ পৃষ্ঠা]

ওপরে উল্লিখিত বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, আল্লাহ যেভাবে সমগ্র সৃষ্টির মধ্য থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মনোনীত করেছেন, তেমনি সমগ্র মানবজাতির মধ্য থেকে সবচেয়ে সৌভাগ্যবান ব্যক্তিত্ব ও পুণ্যাত্মামণ্ডলীকে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর সাহচর্যের জন্য মনোনীত করা হয়েছে। নবী/রাসূল আলাইহিমুস্ সালাম ছাড়া এই ব্যক্তিবৃন্দ তাঁদের আভিজাত্য, শ্রেষ্ঠত্ব, মর্যাদা, গুণাবলী ও উচ্চপদমর্যাদায় সমগ্র সৃষ্টিকুল হতে শ্রেষ্ঠ। যদি সৃষ্টির মধ্যে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’বৃন্দের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর অন্য কোনো লোক থাকতেন, তাহলে আল্লাহ তাঁদেরকেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহচর্য ও বন্ধুত্বের জন্য মনোনীত করতেন।

তাই সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম’এর বদনাম করা, তাঁদেরকে অসম্মান করা এবং তিরস্কার করা শুধু আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে তাঁদের সাহচর্যকেই ব্যঙ্গ করে না, বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁদের নির্বাচনকেও উপহাস করে।

আহলে বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’বৃন্দের ক্ষেত্রেও অনুরূপ ব্যাপার; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে আত্মীয়তার মর্যাদা লাভ করার সাথে সাথে তাঁরাও সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’এর অন্তর্ভুক্ত, কারণ তাঁরাও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সান্নিধ্যে থাকার সম্মান পেয়েছিলেন, যাঁরা তাঁর যাহেরী হায়াতে জিন্দেগীর সমযকালে জীবিত ছিলেন। সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে সম্মান করা বাধ্যতামূলক, একইভাবে আহলে বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে সম্মান করাও অত্যাবশ্যক।

আল্লামা খা’লিদ মাহমূদ লেখেন:

সাহাবা ও খুলাফা আল-রাশিদীন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে সম্মান করা যেমন একজন প্রকৃত মুসলমানের বিশ্বাসের অপরিহার্য উপাদান, তেমনি যে ব্যক্তি আহলে বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে গালি দেয় সে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অংশ হিসেবে গণ্য হওয়ার যোগ্য নয়। [আহল আল-বাইত আল-কিরাম, ৪ পৃষ্ঠা]

ইমামে রব্বানী মোজাদ্দেদে আলফে সানী রাহিমাহুল্লাহ (বেসাল: ১০৩৪ হিজরী) লেখেন:

এটা কীভাবে অনুমান করা যায় যে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত (শ্রদ্ধেয়) আহলে বাইত রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম’কে মহব্বত করে না, অথচ আহলে বাইত রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম’এর প্রতি ভালোবাসাকে ঈমানের একটি উপাদান বলে বিবেচনা করা হয়, এবং যন্ত্রণাবিহীন সহজে মৃত্যুবরণ করা তাঁদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধের ওপর নির্ভরশীল। আহলুল বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’বৃন্দের প্রতি ভালোবাসা আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের একটি চিহ্নযুক্ত বৈশিষ্ট্য, অথচ আমাদের বিরোধীরা এই বাস্তবতা সম্পর্কে অবগত নয় এবং তারা আহলে বাইতে (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’বৃন্দের প্রতি মধ্যমপন্থী ভালোবাসার ধারণা সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞ। তারা এই প্রেমের ব্যাপারে এক চরমপন্থা অবলম্বন করেছে; আবার অন্যান্যরা বাকি সবাইকে ইসলাম-বর্হিভূত মনে করে আরেক চরমপন্থা অবলম্বন করেছে।

তারা বুঝতে পারে না যে, আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত যে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করেছে তা হলো দুটি চরমের মাঝামাঝি। এটাই সত্যের সারমর্ম এবং সঠিক অবস্থান। আল্লাহ তাঁদের প্রচেষ্টাকে কবুল করুন (আমীন)। [মকতুবাতে ইমামে রব্বানী, ২য় খণ্ড, ৩৬ পৃষ্ঠা]

আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা’আত অনুযায়ী সাহাবা ও আহলে বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন)’এর মধ্যে কোনো বিভাজন নেই। আমাদের আলোচনায় যেখানেই সাহাবা শব্দটি উপস্থিত হয়েছে সেখানেই আহলে বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন)’কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক প্রদত্ত শিক্ষা ও নির্দেশনা সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’কে সমগ্র জগতের জন্য আদর্শ ও পথপ্রদর্শক হতে প্রস্তুত করেছিল। তাঁরা ছিলেন নুবূওয়াত ও উম্মাতের মধ্যে যোগসূত্র। সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মহিমা ও ঔজ্জ্বল্য নিজেদের মধ্যে এমনভাবে ধারণ করেছিলেন যে তাঁদের জীবন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনের একটি উপাদান হয়ে গিয়েছিল। সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’এর জীবনী উল্লেখ না করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বরকতময় জীবনকে সম্পূর্ণভাবে উল্লেখ করা অসম্ভব, কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপদেশ ও পরামর্শ দানের ব্যাপারে সাক্ষী হলেন সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)।

সাহাবাবৃন্দের (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) শ্রেষ্ঠত্ব বোঝার পর মহান কুর’আন ও সুন্নাহ দ্বারা নির্ধারিত মানদণ্ডের আলোকে সাহাবায়ে কেরামের (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) মর্যাদাকে অনুধাবন করা যথাযথ হবে। আমাদের দুর্ভাগ্য এমন যে আমরা সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) এবং তাঁদের মতভেদকে দুনিয়াবী রাজনৈতিক নেতাদের বিবাদ ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির আয়নায় দেখতে শুরু করেছি। অথচ প্রায়শই বিশ্ব নেতৃবৃন্দ শুধুমাত্র ক্ষমতার খাতিরে দুনিয়া ও আখিরাতে মানুষের মঙ্গল নষ্ট করতে ইচ্ছুক।

আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের মতে, সাহাবাবৃন্দ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) হলেন ঈমান ও ইসলামের ভিত্তি। আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের জন্য এটা আকীদা-বিশ্বাসগত বিষয় যে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের মধ্যে যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছিলো, যদিও তা তাঁদের মধ্যে যুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো, তবুও তা ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষার উপর ভিত্তি করে ছিল না। প্রতিটি দল ইসলামকে রক্ষা ও সমুন্নত করার প্রেক্ষাপটে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। এই সমস্ত ব্যক্তিত্বের মতামত ছিল যে বিরোধী দলের অবস্থানও সঠিক ধর্মীয় সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ছিল। সুতরাং, যদিও প্রতিটি দল অন্যের মতামত বা অনুমানকে ভুল বলে মনে করেছিলেন, তবুও তাঁরা প্রতিপক্ষকে মোনাফেক/অন্তর্ঘাতী শত্রু বা কাফের/অবিশ্বাসী বলে মনে করেননি। [ইমামে রব্বানী মোজাদ্দেদে আলফে সানী (রহ.) কৃত মকতূবা’ত; চিঠি নং ৯৬]

এর অতিরিক্ত বিবরণ উপযুক্ত জায়গায় আলোচনা করা হবে। এটি আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সর্বসম্মত মত। আকায়েদ (ইসলামী বিশ্বাস)-এর সমস্ত বইয়ে এই বিষয়টি এতদুদ্দেশ্যে উৎসর্গিত একটি অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে যার শিরোনাম: “সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’বৃন্দের মর্যাদা ও স্বীকৃতি।” তাই কোনো ঐতিহাসিক বর্ণনার প্রতি এক নজর বুলিয়ে তাঁদের মর্যাদা নির্ণয় ও নির্ধারণ করা যায় না।

ইতিহাসের বিষয়বস্তুর গুরুত্ব ও অবস্থান নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে (দেওবন্দী ঘরানার) মুফতি মুহাম্মদ শফী (মৃত্যু: ১৩৯৬ হি.) উল্লেখ করেছেন: 

শুধুমাত্র ঐতিহাসিক বর্ণনার ভিত্তিতে সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের চরিত্র ও মর্যাদা নির্ধারণ করা অনুচিত। নুবূওয়াহ এবং উম্মাহর মধ্যে যোগসূত্র হিসাবে তাঁদের ভূমিকায় এই ব্যক্তিবৃন্দ মহান কুর’আন ও সুন্নাহর আলোকে একটি বিশেষ অবস্থান দখল করে আছেন। ঐতিহাসিক বর্ণনাগুলো কুর’আন মজীদ ও সুন্নাহর মতো একই পর্যায়ের নয় এবং এভাবে সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীর মর্যাদা কেবল ঐতিহাসিক বর্ণনার উপর ভিত্তি করে বাড়ানো বা কমানো যায় না। তবে কোনোক্রমে এ-ও বোঝানো যায় না যে ইতিহাসের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করা যাবে না এবং তা অকেজো। বাস্তবতা হলো, বিশ্বাসযোগ্যতার ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা রয়েছে। ইসলাম-ধর্ম পবিত্র কুর’আন এবং মুতাওয়াতির হাদীসকে [নোট: বিশাল সংখ্যক আলেমের বর্ণিত হাদীস যা তাঁদের ঐকমত্যের দরুন মিথ্যে হওয়া অসম্ভব] সাধারণ হাদীস এবং ঐতিহাসিক বর্ণনার তুলনায় যে বিশ্বাসযোগ্যতার মর্যাদা দিয়েছে তা একই অবস্থানের নয়। অনুরূপভাবে, সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীর বাণীও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথার সমান ওজন রাখে না। একই প্রামাণিক সাক্ষ্য দ্বারা ঐতিহাসিক বর্ণনার নির্ভরযোগ্যতার মাত্রা কুর’আন মজীদ, সুন্নাহ বা সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের প্রামাণিকভাবে প্রতিষ্ঠিত বাণীগুলির মতো নয়। যদি মুতাওয়াতির নয় এমন কোনো হাদীস আল-কুর’আনের পাঠের সাথে সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে সেই অর্থের জন্য একটি ব্যাখ্যা খুঁজে বের করা অপরিহার্য হবে। যদি উপযুক্ত কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া না যায়, তাহলে পবিত্র কুর’আনের পাঠের সাথে সাংঘর্ষিক অর্থ বর্জন করতে হবে। একইভাবে, কোনো ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে প্রাপ্ত কোনো বিষয় যদি আল-কুর’আন ও সুন্নাহ হতে প্রতিষ্ঠিত সিদ্ধান্তের পরিপন্থী হয়, তাহলে ঐতিহাসিক বর্ণনার সত্যতা যতোই শক্তিশালী হোক না কেন, তা বাতিল করা হবে, কিংবা উপযুক্ত ব্যাখ্যা চাওয়া হবে। [মাক্বাম-এ-সাহা’বাহ, ১৪-১৫ পৃষ্ঠা]

মুফতী মুহাম্মদ শফী তাঁর উপরোল্লিখিত বইয়ের কয়েক পৃষ্ঠা পরে লেখেন:

সমগ্র উম্মাহর ঐকমত্য এই যে, সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু অনহুম)’বৃন্দের তাৎপর্য, তাঁদের মর্যাদা এবং তাঁদের মধ্যে যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছিলো তা ইতিহাসের কোনো সাধারণ বিষয় যেভাবে শেষ করা হয় সেভাবে শেষ করা যাবে না। সাহাবা (রা.)’বৃন্দের গুরুত্ব হাদীসশাস্ত্রের একটি মৌলিক উপাদান, যেমনটি হাফিজ ইবনে হাজর রাহিমাহু ল্লাহ কর্তৃক ‘আল-ইসাবাহ’ গ্রন্থের ভূমিকায় এবং হাফিজ ইবনে আবদুল বার্র রাহিমাহুল্লাহ কর্তৃক ‘আল-ইসতিয়াব’ পুস্তকের ভূমিকায় স্পষ্ট করা হয়েছে। এই উম্মাতের আলেম-উলামা হযরতে সাহাবায়ে কেরাম (রা.)’মণ্ডলীর মর্যাদা, তাঁদের মধ্যে বিভিন্ন পদমর্যাদা এবং তাঁদের মধ্যে উদ্ভূত মতপার্থক্যসমূহ আকীদা-বিশ্বাসগত শাস্ত্রে একটি পৃথক বিষয় হিসেবে বিবেচনা করেছেন এবং ইসলামের সমস্ত গ্রন্থে এ বিষয়ে আলোচনার জন্য অধ্যায়সমূহ উৎসর্গ করেছেন। ইসলামী আকীদার সাথে সম্পৃক্ত একটি বিষয়স্বরূপ, যার ভিত্তিতে অনেক মুসলিম দল-উপদল অস্তিত্ব লাভ করেছে, এটা সুস্পষ্ট যে কুরআন, সুন্নাহ এবং ইজমা’ (উম্মাহর ঐকমত্য)-এর মতো উৎগুলোকে (এ ক্ষেত্রে) সদ্ব্যবহার করতে হবে। যদি কোনো হাদীস/রওয়ায়াত থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়, তাহলে তা হাদীসের উসূল তথা নীতি অনুযায়ী বিশ্লেষণ করা মৌলিক শর্ত হবে। কোনো উৎসের অনুসন্ধান কেবল ঐতিহাসিক বর্ণনার মধ্যে করা, এবং তার উপর নির্ভর করা একটি মৌলিক ত্রুটি। যদিও নির্ভরযোগ্য ও হাদীসশাস্ত্রের বিশ্বস্ত পণ্ডিতবৃন্দের দ্বারা ইতিহাস সংকলিত হতে পারে, তবুও সারমর্মে এটি ইতিহাসই রয়ে গেছে, আর ইতিহাসে প্রামাণিক এবং অপ্রমাণিত উভয় তথ্য-উপাত্তই একত্রিত করা একটি প্রচলিত রীতি। [মাক্বামে সাহা’বাহ, ৩৫-৩৬ পৃষ্ঠা]

ইমাম ইবনে হাজর হায়সামী আল-মক্কী (বেসাল: ৯৭৪ হিজরী) বিবৃত করেন: 

و الواجب أيضا على كل من سمع شيئا من ذلك أن يتثبت فيه و لا ينسبه الى أحد منهم بمجرد رؤية في كتاب أو سماعه من شخص، بل لا بد أن يبحث عنه حتى يصح عنده نسبته الى أحدهم، فحينئذ الواجب أن يلتمس لهم أحسن التأويلات.

অর্থ:  যে ব্যক্তি সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’বৃন্দের মধ্যে মতপার্থক্য ও ভুল বোঝাবুঝির বিষয়ে কিছু শোনেন, সে বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা তাঁর জন্য কর্তব্য। শুধুমাত্র একটি বইয়ে পড়া অথবা অন্যের কাছ থেকে শোনা কিছুর ওপর ভিত্তি করে তাঁদের কারোর প্রতি দোষারোপ করা উচিত নয়। যতোক্ষণ না এর দায় সঠিকভাবে নিরূপণ করা যায় ততোক্ষণ পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করা জরুরি। সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যাখ্যা খোঁজা এই মুহূর্তে বিচক্ষণতার পরিচায়ক হবে। [আস্ সাওয়ায়িক্বুল মুহরিক্বা, ২১৬ পৃষ্ঠা] 

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের আক্বীদাহ-বিশ্বাস আলোচনাকালে ইবনে তাইমিয়া (মৃত্যু: ৭২৮ হিজরী) লেখেন:

ويتبرؤون من طريقة الروافض الذين يبغضون الصحابة ويسبونهم وطريقة النواصب الذين يؤذون أهل البيت بقول أو عمل، و يمسكون عما شجر بين الصحابة ويقولون: أن هذه الآثار المروية في مساويهم منها ما هو كذب ومنها ما قد زيد فيه و نقص غير عن وجهه، والصحيح منه هم فيه معذورون، إما مجتهدون مصيبون وإما مجتهدون مخطئون. وهم مع ذلك لا يعتقدون أن كل واحد من الصحابة معصومعن كبائر الإثم وصغائره، بل يجوز عليهم الذنوب في الجملة، ولهم من الفضائل و السوابق ما يوجب مغفرته ما يصدر منهم ان يصدر ،حتى إنهم يغفر لهم من السيئات ما لا يغفر لمن بعدهم.

অর্থ: আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ শিয়াদের গৃহীত পদ্ধতি থেকে মুক্ত, যে শিয়াচক্র সাহাবা (রা.)’বৃন্দের প্রতি ঘৃণা পোষণ করে এবং তাঁদের মন্দ বলে মনে করে। একইভাবে, আমরা নওয়াসিবের পদ্ধতি থেকে মুক্ত, যারা মৌখিক বা কর্মের দ্বারা আহলে বাইত (রা.)’বৃন্দের ক্ষতি সাধন করে। আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত হযরতে সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-মণ্ডলীর মধ্যে যে মতভেদ দেখা দিয়েছিলো, সে বিষয়ে নীরবতা অবলম্বন করাকে বেছে নিয়েছেন। তাঁরা বলেন যে, সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-বৃন্দের বিরুদ্ধে বর্ণিত কথা বিভিন্ন; সেসব বর্ণনার মধ্যে বেশ কিছু বানোয়াট, আবার কিছু বর্ণনা এমন যে কিছু পরিবর্তন এমন মাত্রায় করা হয়েছে যার দরুন সেগুলোর সঠিক অর্থ ভেজাল হয়ে গিয়েছে। তথাপি এমন কিছু বর্ণনাও রয়েছে যা সহীহ/বিশুদ্ধ। এ ক্ষেত্রে সাহাবা (রা.)’বৃন্দকে (অভিযোগ) হতে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে; কেননা তাঁরা হয় তাঁদের ইজতিহাদে (বিশ্লেষণমূলক যুক্তি/গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত) সঠিক ছিলেন, নতুবা তাঁরা সঠিক বিশ্লেষণী পদ্ধতি অনুসরণ করার পরেও (ইজতিহাদী) ভুল করেছিলেন। একইভাবে, আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত এই বিশ্বাস পোষণ করেন না যে সাহাবায়ে কেরাম (রা.) কোনো ছোট বা বড় গুনাহ করা থেকে মা’সূম/নিষ্পাপ ছিলেন [বঙ্গানুবাদকের নোট: সুন্নী বিশ্বাস হলো তাঁরা মাহফূয তথা আল্লাহ কর্তৃক পাপ হতে হেফাযত বা সুরক্ষাপ্রাপ্ত; আম্বিয়ায়ে কেরাম আলাইহিমুস্ সালাম-ই কেবল মা’সূম]। মূলত তাঁদের পাপ করার সম্ভাবনা ছিলো। তবে তাঁদের গুণাবলী এবং যোগ্যতা এতোটাই অপরিসীম যে এটি তাঁদেরকে ক্ষমার ওয়ারেন্টি দেয়, এমন কী যদি তাঁদের কাছ থেকে কোনো ভুলভ্রান্তি ঘটেও থাকে। প্রকৃতপক্ষে, তাঁদের জন্য ক্ষমা এমন এক মাত্রায় সম্প্রসারিত হবে যা তাঁদের পরবর্তী কারো দ্বারা সম্ভাব্য হবে না। [আল-আক্বীদাহ আল-ওয়া’সিতিয়্যাহ, ১৭৩ পৃষ্ঠা]

হযরতে ইমামে রব্বানী মুজাদ্দেদে আলফে সানী (বেসাল: ১০২৪ হিজরী) বিবৃত করেন:

সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-মণ্ডলীর মধ্যে যে বিবাদ-বিসম্বাদ দেখা দেয়, তা ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা উচিত এবং ব্যক্তিবাদী বা উপদলীয় উদ্দেশ্য থেকে যতোটা সম্ভব দূরে থাকা উচিত। এই পার্থক্যগুলি মূলত বিশ্লেষণাত্মক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ব্যাখ্যার উপর ভিত্তি করে ঘটেছিলো, খায়েশের উপর নয়। এটাই আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের দৃষ্টিভঙ্গি… আমাদের জন্য আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত অনুযায়ী আমাদের আকীদা-বিশ্বাস বজায় রাখা এবং কোনো বোকা লোকের কথায় কান না দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। ভ্রান্ত লোকের মতের ভিত্তিতে নিজের আকীদা ও মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করা ঈমান নষ্ট করার সামিল। যাঁরা নাজাত লাভ করবেন, অর্থাৎ আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত, তাঁদের পথ অনুসরণ করা অত্যাবশ্যক, যাতে কেউ নাজাত লাভের আশাবাদী হতে পারে। [মাকতূবাতে ইমামে রব্বানী, ২৫১ নং চিঠি]

ক্বুর’আন মজীদে বর্ণিত সাহাবায়ে কেরাম (রা.)’এর উচ্চমর্যাদা

পবিত্র ক্বুর’আনে নিম্নোক্ত আয়াতগুলোর প্রতি লক্ষ্য করুন – 

(১) –  كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ

অর্থ: তোমরা হলে শ্রেষ্ঠতম ওই সব উম্মতের মধ্যে…। [আল-ক্বুর’আন, ৩/১১০; নূরুল ইরফান]

(২) – وَكَذَلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطاً لِّتَكُونُواْ شُهَدَآءَ عَلَى ٱلنَّاسِ

অর্থ: এবং কথা হলো এই যে, আমি তোমাদেরকে সব উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ করেছি…। [আল-ক্বুর’আন, ২/১৪৩; নূরুল ইরফান]

এই দুটি আয়াতের সরাসরি সম্বোধনের উদ্দিষ্ট পুণ্যাত্মাবৃন্দ হলেন স্বয়ং সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)। প্রথম আয়াতে তাঁদেরকে “সকল জাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠ” উপাধিতে বিভূষিত করা হয়েছে; সমগ্র উম্মাহর রোল-মডেল এবং পথপ্রদর্শক হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে। দ্বিতীয় আয়াতে “মধ্যম প্রকৃতির” মর্মে শব্দগুলো দ্বারা প্রশংসা করার পাশাপাশি তাঁদের জন্য একটি অনন্য সম্মানের কথা বলা হয়েছে: আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন হযরতে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীর জন্য সাক্ষী হবেন, তেমনি সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-ও তাঁদের পরবর্তীদের জন্য সাক্ষী ও অনুকরণীয় আদর্শ হবেন।

(৩) – مُّحَمَّدٌ رَّسُولُ ٱللهِ وَٱلَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّآءُ عَلَى ٱلْكُفَّارِ رُحَمَآءُ بَيْنَهُمْ تَرَاهُمْ رُكَّعاً سُجَّداً يَبْتَغُونَ فَضْلاً مِّنَ ٱللهِ وَرِضْوَاناً سِيمَاهُمْ فِي وُجُوهِهِمْ مِّنْ أَثَرِ ٱلسُّجُودِ ذَلِكَ مَثَلُهُمْ فِي ٱلتَّوْرَاةِ وَمَثَلُهُمْ فِي ٱلإِنجِيلِ كَزَرْعٍ أَخْرَجَ شَطْأَهُ فَآزَرَهُ فَٱسْتَغْلَظَ فَٱسْتَوَىٰ عَلَىٰ سُوقِهِ يُعْجِبُ ٱلزُّرَّاعَ لِيَغِيظَ بِهِمُ ٱلْكُفَّارَ وَعَدَ ٱللهُ ٱلَّذِينَ آمَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّالِحَاتِ مِنْهُم مَّغْفِرَةً وَأَجْراً عَظِيماً

অর্থ: মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রাসূল; এবং তাঁর সঙ্গে যারা আছে, কাফিরদের প্রতি কঠোর এবং পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল, আপনি তাদেরকে দেখবেন রুকূ’কারী, সেজদারত, আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনা করে; তাদের চিহ্ন তাদের চেহারায় রয়েছে সেজদার চিহ্ন থেকে; তাদের এ বৈশিষ্ট্য তাওরীতের মধ্যে রয়েছে এবং তাদের (অনুরূপ) বৈশিষ্ট্য রয়েছে ইনজীলে; যেমন একটা ক্ষেত, যা আপন চারা উৎপন্ন করেছে, অতঃপর সেটাকে শক্তিশালী করেছে, তারপর তা শক্ত হয়েছে, তারপর আপন কাণ্ডের উপর সোজা হয়ে দণ্ডায়মান হয়েছে, যা চাষীদেরকে আনন্দ দেয়, যাতে তাদের দ্বারা কাফিরদের অন্তর (হিংসার আগুনে) জ্বলে; আল্লাহ ওয়াদা করেছেন তাদের সাথে, যারা তাদের মধ্যে ঈমানদার ও সৎকর্মপরায়ণ – ক্ষমা ও মহা প্রতিদানের। [আল-ক্বুর’আন, ৪৯/২৯; নূরুল ইরফান]  

এই আয়াতে, “মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল” বাক্যাংশটি একটি দাবি এবং “যারা তাঁর সঙ্গে…” – বাক্যটি সেই দাবির প্রমাণ। পরবর্তী বাক্যাংশটি সমগ্র সাহাবা (রা.)-কুলকে অন্তর্ভুক্ত করে। আল্লাহ তাঁদেরকে আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নুবুওয়াতের প্রমাণ হিসেবে পেশ করেন, আর এর পাশাপাশি তাঁদের তাকওয়া, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং সততার প্রমাণও দেন। যে ব্যক্তি সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-মণ্ডলীর সমালোচনা করে সে কেবল আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নুবুওয়াতেই দোষ খুঁজে বেড়ায় না, বরং পবিত্র কুর’আনের দাবিকেও অস্বীকার করে। এই আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয়, যে ব্যক্তি সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-বৃন্দের প্রতি রাগ ও ক্ষোভ পোষণ করে, সে স্রেফ কোনো কাফেরই হবে; এ যেনো সাহাবায়ে কেরাম (রা.)’বৃন্দের অস্তিত্বই কাফেরদের ক্রোধের কারণ ছিলো। সবশেষে, আল্লাহতায়ালা সাহাবা (রা.)’মণ্ডলীর জন্য তাঁদের ঈমান ও নেক আমলের ওপরে ভিত্তি করে ক্ষমা ও অপরিসীম পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

(৪) – {وَٱلسَّابِقُونَ ٱلأَوَّلُونَ مِنَ ٱلْمُهَاجِرِينَ وَٱلأَنْصَارِ وَٱلَّذِينَ ٱتَّبَعُوهُم بِإِحْسَانٍ رَّضِيَ ٱللهُ عَنْهُمْ وَرَضُواْ عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا ٱلأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَآ أَبَداً ذٰلِكَ ٱلْفَوْزُ ٱلْعَظِيمُ}

অর্থ: এবং সবার মধ্যে অগ্রগামী প্রথম মুহাজির ও আনসার আর যারা সৎকর্মের সাথে তাদের অনুসারী হয়েছে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট; আর তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন বাগানসমূহ (জান্নাতসমূহ), যেগুলোর নিম্নদেশে নহরসমূহ প্রবহমান। তারা সদা-সর্বদা সেগুলোর মধ্যে অবস্থান করবে। এটাই হচ্ছে মহা সাফল্য! [আল-ক্বুর’আন, ৯/১০০; নূরুল ইরফান]

এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীকে দুটি শ্রেণী হিসেবে বর্ণনা করেছেন। প্রথমটি হলেন “মুহাজির” এবং দ্বিতীয়টি “আনসার”। তাঁরা নিঃশর্তভাবে একটি “মহান সাফল্যের” সুসংবাদের পাশাপাশি চারটি (ঐশী) অনুগ্রহ লাভের নিশ্চয়তা পেয়েছেন। এই চারটি প্রতিশ্রুতি হলো:

১/ আল্লাহতায়ালা তাঁদের প্রতি চির সন্তুষ্ট;

২/ তাঁরা আল্লাহর প্রতি সর্বদা সন্তুষ্ট;

৩/ তাঁদের জন্য জান্নাত প্রস্তুত করা হয়েছে;

৪/ তাঁরা জান্নাতে চিরকাল অবস্থান করবেন।

(৫) – {وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ آمِنُواْ كَمَآ آمَنَ ٱلنَّاسُ قَالُوۤاْ أَنُؤْمِنُ كَمَآ آمَنَ ٱلسُّفَهَآءُ أَلاۤ إِنَّهُمْ هُمُ ٱلسُّفَهَآءُ وَلَـٰكِن لاَّ يَعْلَمُونَ}

অর্থ: এবং যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘ঈমান আনো যেমন অপরাপর লোকেরা ঈমান এনেছে,’ তখন তারা বলে, ‘আমরা কি নির্বোধদের মতো ঈমান নিয়ে আসবো?’ শুনছো! তারাই হলো নির্বোধ; কিন্তু তারা জানে না। [আল-ক্বুর’আন, ২/১৩; নূরুল ইরফান]

এই আয়াতটি সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের ঈমানকে পরিপূর্ণ এবং এর পাশাপাশি আল্লাহর দৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় মানদণ্ড হিসেবে ঘোষণা করেছে। সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীর ঈমানের মাপকাঠিতে পরিমাপ না করা পর্যন্ত মানুষের ঈমান পূর্ণ হবে না। ঈমানের গ্রহণযোগ্য মানদণ্ড হচ্ছেন সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম); তাই যে ব্যক্তি সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের ঈমানের সমালোচনা করে, সে বাস্তবিকই মুনাফিকদের পথ ধরেছে। যে ব্যক্তি সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীকে অজ্ঞ-মূর্খ মনে করে, আল্লাহর দৃষ্টিতে সে ব্যক্তি-ই প্রকৃতপক্ষে গণ্ডমূর্খ। সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের মাঝে যারাই দোষ খুঁজে বেড়ায়, তারা তাদের নিছক অজ্ঞতা, সংকীর্ণতা, প্রমাদ ও জ্ঞানের অভাবের কারণে তা করে থাকে।

আমার উদ্দেশ্য সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীর মর্যাদাসম্পর্কিত সমস্ত আয়াতকে পরিবেষ্টন করা নয় এবং যা উল্লেখ করা হয়েছে তা থেকে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যথেষ্ট হবে যে তাঁরা আল্লাহর দরবারে মকবূল তথা গৃহীত হয়েছেন এবং তাঁদেরকে জান্নাতের ওয়াদা করা হয়েছে। যাঁরা এটা গ্রহণ করতে ইচ্ছুক তাঁদের জন্য ওপরের পাঁচটি আয়াতই যথেষ্ট। যারা গ্রহণ করতে ইচ্ছুক নয় তাদের জন্য পুরো কুরআন মজীদ উদ্ধৃত করা হলেও তা পর্যাপ্ত হবে না।

হাদীস শরীফে বর্ণিত সাহাবায়ে কেরাম (রা.)’এর উচ্চমর্যাদা

নিম্নের হাদীসগুলোর প্রতি লক্ষ্য করুন – 

(১) – عَنْ عَبْدِ اللهِ ـ رضى الله عنه ـ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ: خَيْرُ النَّاسِ قَرْنِي، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ

অর্থ: হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফরমান: “সর্বোত্তম হলো আমার যুগের মানুষেরা। তারপর উত্তম হলো এদের পরবর্তী যুগের মানুষেরা; তারপর উত্তম হলো তাদের পরবর্তী যুগের মানুষেরা।” [সহীহ বুখারী, ২৬৫২, বই-৫২, হাদীস-১৬; মুসলিম, ২য় খণ্ড, ৩০৯ পৃষ্ঠা]

(২) – عَنْ عُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَكْرِمُوا أَصْحَابِي فَإِنَّهُمْ خِيَارُكُمْ

অর্থ: হযরত উমর ফারূক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরশাদ ফরমান: “আমার সাহাবাদেরকে সম্মান করো! কেননা নিশ্চয় তারা তোমাদের মাঝে সর্বোত্তম।” [মিশকাতুল মাসাবীহ, ৬০১২]

(৩) – و عن جابر رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال: لاَ تَمَسُّ النَّارُ مُسْلِمًا رَآنِي أَوْ رَأَى مَنْ رَآنِي 

অর্থ: ”জাহান্নামের আগুন এমন মুসলিম ব্যক্তিকে ছুঁবে না, যে আমাকে দেখেছে, অথবা আমার দর্শনলাভকারী কাউকে দেখেছে।” [জামিউত্ তিরমিযী, ১ম খণ্ড, বই-৪৬, হাদীস-৩৮৫৮]

(৪) – عن أنس رضي الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم مثل أصحابي في أمتي كالملح في الطعام لا يصلح الطعام إلا بالملح 

অর্থ: “আমার উম্মতের মাঝে আমার সাহাবাদের উপমা হচ্ছে খাবারে লবণের মতো; খাবার সুস্বাদু/পরিশুদ্ধ হয় না লবণ মেশানো ছাড়া।” [মিশকাত, ৫৫৪ পৃষ্ঠা]

(৫) – فَمَنْ أَحَبَّهُمْ فَبِحُبِّي أَحَبَّهُمْ وَمَنْ أَبْغَضَهُمْ فَبِبُغْضِي أَبْغَضَهُمْ

অর্থ: “যে ব্যক্তি আমার সাহাবাদেরকে ভালোবাসে, সে আমাকে ভালোবাসার খাতিরেই তাদেরকে ভালোবাসে, আর যে লোক আমার সাহাবাদের প্রতি বৈরি মনোভাব পোষণ করে, সে প্রকৃতপক্ষে আমারই প্রতি বৈরিভাবের কারণে তা পোষণ করে থাকে।” [মিশকাতুল মাসাবীহ, ৬০১৪; তিরমিযী ৩৮৬২]

সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে গালমন্দ করা নিষেধ

হাদীসসমূহে যেমন সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’মণ্ডলীর অগণিত ফযীলত বর্ণনা করা হয়েছে, তেমনি তাঁদেরকে অপমান করার বিরুদ্ধেও নিষেধ করা হয়েছে। নিম্নবর্ণিত হাদীসগুলোকে বিবেচনা করুন:

(১) – اللهُ اللهَ فِي أَصْحَابِي لَا تَتَّخِذُوهُمْ غَرَضًا مِنْ بَعْدِي

অর্থ: আল্লাহকে ভয় করো, আল্লাহকে ভয় করো আমার সাহাবাদের ব্যাপারে। আমার (বেসালের) পরে তাদেরকে সমালোচনার পাত্র হিসেবে গ্রহণ কোরো না। [মিশকাতুল মাসাবীহ, ৬০১৪ (৮); তিরমিযী, ৩৮৬২]

(২) – لَا تَسُبُّوا أَصْحَابِي فَلَوْ أَنَّ أَحَدَكُمْ أَنْفَقَ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا مَا بَلَغَ مُدَّ أَحَدِهِمْ وَلَا نصيفه

অর্থ: তোমরা আমার সাহাবাদেরকে গালমন্দ কোরো না। কেননা তোমাদের মধ্যে কেউ যদি ওহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণও আল্লহর পথে ব্যয় করে, তবুও মর্যাদায় তা তাদের ব্যয়কৃত এক মুদ্দ কিংবা অর্ধ মুদ্দ (যব/গম)-এর সমান সওয়াবে পৌঁছুতে সক্ষম হবে না। [মিশকাতুল মাসাবীহ, ৬০০৭ (১); সহীহ বুখারী, ৩৬৭৩; মুসলিম, ২২১-(২৫৪০); তিরমিযী ৩৮৬১; আবূ দাউদ, ৪৬৫৮ ইত্যাদি] {নোট: ১ মুদ্দ সমান ৭৫০ মি.লি.)}

(৩) – إِذَا رَأَيْتُمُ الَّذِينَ يَسُبُّونَ أَصْحَابِي فَقُولُوا لَعْنَةُ اللهِ عَلَى شَرِّكُمْ 

অর্থ: যারা আমার সাহাবাদেরকে গালিগালাজ করে, তাদের দেখলে তোমরা বলবে: ‘তোমাদের দুষ্কর্মের প্রতি আল্লাহতায়ালার অভিসম্পাত।’ [সুনানে তিরমিযী, ৩৮৬৬; মিশকাত ৬০১৭]

এই বর্ণনাটি ব্যাখ্যা করার সময় আমার পরামর্শদাতা মওলানা ইঊসুফ লুধিয়ানভী সাহেব নিম্নলিখিত জ্ঞানের রত্নগুলি ভাগাভাগি করেছেন, যা কেবলমাত্র ধার্মিকদের অন্তরেই অনুপ্রাণিত হয়:

(ক) – এই বর্ণনায় “অভিসম্পাত” শব্দের অর্থ কেবল অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহার করা নয়, বরং এতে এমন কোনো তিরস্কারের শব্দ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যা সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু অনহুম)-কে যে কোনোভাবে হেয় করতে পারে। এ থেকে বোঝা যায় যে, সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে গালি দেওয়া বা অসম্মান করা জায়েজ নয়। যে ব্যক্তি তা করবে সে অভিশপ্ত হবে এবং আল্লাহর রহমতের গণ্ডি থেকে বহিষ্কৃত হবে।

(খ) – সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’বৃন্দের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বরকতময় অন্তরকে কষ্ট দেয়। এটা তাঁর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট – وَمَنْ أَبْغَضَهُمْ فَبِبُغْضِي أَبْغَضَهُمْ – “আর যে লোক আমার সাহাবাদের প্রতি বৈরি মনোভাব পোষণ করে, সে প্রকৃতপক্ষে আমারই প্রতি বৈরিভাবের কারণে তা পোষণ করে থাকে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বরকতময় অন্তরে দুঃখ সৃষ্টি করলে নেক আমল তথা পুণ্যদায়ক কর্মের পুরস্কার নষ্ট হয়ে যাওয়ার সমূহ বিপদ রয়েছে।

আল্লাহতায়ালা ক্বুর’আন মজীদে ঘোষণা করেন: 

أَن تَحْبَطَ أَعْمَالُكُمْ وَأَنتُمْ لاَ تَشْعُرُونَ. 

অর্থ: যেনো কখনো তোমাদের কর্মসমূহ নিষ্ফল না হয়ে যায়। [আল-ক্বুর’আন, ৪৯/২; নূরুল ইরফান]

সুতরাং, সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-কে গালিগালাজ করলে কারো ঈমান হারানোর সমূহ সম্ভাবনা থাকতে পারে। [বঙ্গানুবাদকের নোট: এর কারণ এটা প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর সাথে প্রকাশ্য দুশমনি]

(গ) – সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের সম্মান রক্ষা করা এবং তাঁদের প্রতি উত্থাপিত অভিযোগের জবাব দেওয়া একটি ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা।

(ঘ) – রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেননি যে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’মণ্ডলীর বিরুদ্ধে প্রতিটি সমালোচনারই বিস্তারিত জবাব দিতে হবে, কারণ এর ফলে উত্তর ও পাল্টা জবাবের একটি অন্তহীন প্রক্রিয়া চালু হবে। তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন একটি সামগ্রিক ও মুখ্য জবাব দেওয়া উচিত, যা হলো – لَعْنَةُ اللهِ عَلَى شَرِّكُمْ – মানে “তোমাদের মন্দ বা দুষ্কর্মের প্রতি আল্লাহতায়ালার অভিসম্পাত।”    

(ঙ) – ওপরের – شَرِّكُمْ – তথা “তোমাদের (মধ্যে অধিকতর) মন্দ” মর্মে বাক্যটির দুটি সম্ভাব্য অর্থ রয়েছে। এতে – شرّ – ‘মন্দ’ শব্দটি একটি ব্যক্তিগত সর্বনামের সাথে সংযুক্ত (মানে তোমাদের), যা দ্বারা বোঝাবে: “আল্লাহর অভিসম্পাত তোমাদের মন্দের ওপরে পতিত হোক, যা সর্বত্র বিস্তৃত হয়েছে।” দ্বিতীয় সম্ভাব্য অর্থ হবে এই যে, ‘মন্দ’ শব্দটি তীব্রতা ও তুলনার একটি মাত্রাকে বোঝায়। তাই এতে বোঝাবে, তোমাদের ও সাহাবাদের মধ্যে (তুলনায়) যারা অধিকতর মন্দ তাদের ওপরে আল্লাহর লা’নত পড়ুক। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই বাক্যটিতে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে যারা গালাগালি করে, তাদের প্রতি সূক্ষ্ম একটি সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করেছেন। কেউ এ নিয়ে চিন্তা করলে উপলব্ধি করতে পারবেন, যারা সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে অবজ্ঞা করে তাদের শেকড় কেটে দেয়া হয়েছে। এটা অনেকটাই স্পষ্ট যে, সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’বৃন্দ যাই হোন না কেন, তাঁরা সর্বদা আপনাদের চেয়ে উত্তম হবেন। আপনারা হয়তো বাতাসে উড়তে পারবেন, আকাশে উঠতে পারবেন বা একশত জীবন (মানে দীর্ঘ জীবন) যাপন করতে পারবেন কিন্তু কখনোই সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীর মর্যাদায় উন্নীত হতে পারবেন না। এমন চোখ কোথায় পাবেন যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্দর চেহারা মোবারক দেখেতে পেরেছে? এমন কান কোথায় পাবেন যা আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কথা শ্রবণ দ্বারা সম্মানিত হয়েছে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দীপ্তিতে আলোকিত এমন হৃদয় কোথায় পাবেন? আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বারা অনুপ্রাণিত এমন মন কোথায় পাবেন? এমন হাত কোথায় পাবেন যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বরকতময় ত্বক স্পর্শ করতে পেরেছে এবং সারা জীবন সুঘ্রাণময় থেকেছে? তাঁর বরকতময় সাহচর্যের দিকে যেতে গিয়ে যে পায়ে ফোসকা পড়েছিলো, তা কোথায় পাবেন? এমন জায়গা কোথায় পাবেন যেখানে জগতের নেতৃত্বদাতা কর্তৃত্ব করেছিলেন? এমন সমাবেশ কোথায় পাবেন যেখানে উভয় জগতের সাফল্যের পানপাত্র পরিবেশন করা হচ্ছিলো? এমন পরিবেশ কোথায় পাবেন যেখানে ‘মনে হয় যেনো আল্লাহকে আমার সামনে দেখছি’ – এই অনুভূতি সর্বদা বিরাজমান ছিলো? কোথায় পাবেন এমন সমাবেশ যেখানে পরিবেশ ছিলো ‘যেনো পাখিরা আমাদের মাথায় ঘোরাফেরা করছে?’ কোথায় পাবেন সেই তিমি মাছের তন্তুজাত সুগন্ধি দ্রব্য, যার সুঘ্রাণময় হাওয়ায় মদীনা মুনাওয়ারার রাস্তা-ঘাট ছিলো সুবাসিত? এমন ভালোবাসা কোথায় পাবেন যা আশেক্ব/(খোদা)-প্রেমিককে স্রেফ প্রেমাস্পদের দিকে তাকিয়ে থাকতেই ঘুম থেকে বিরত রাখে? সারা পৃথিবী আলোকিত করে এমন ঈমান কোথায় পাবেন? আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক অনুমোদিত মানদণ্ড অনুযায়ী সুনির্দিষ্টভাবে সম্পাদিত আমল/কর্মগুলো কোথায় পাবেন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শ অনুকরণকারী এমন চরিত্র কোথায় পাবেন? ‘আল্লাহর রঙে’ রঞ্জিত এমন রং কোথায় পাবেন? আপনারা এমন আচরণ কোথায় পাবেন যা অবলোকনকারীদেরকে তা অনুকরণ করতে অনুপ্রাণিত করে? এমন সালাত কোথায় পাবেন যেখানে ইমামতি করেছিলেন সকল পয়গাম্বর (আলাইহিমুস্ সালাম)-এর ইমাম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)? আপনারা কীভাবে এমন একটি জামা’আত গঠন করবেন যার ইমাম সকল পয়গাম্বর (আলাইহিমুস সালাম)-এর সাইয়্যেদ? আপনারা সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে এক লক্ষবার গালি দিতে পারেন, কিন্তু আপনাদের অন্তরে গভীরভাবে তাকান এবং স্বীকার করুন: আপনারা কি তাঁদের চেয়ে খারাপ নন? তাঁরা যদি ঘৃণা ও তিরস্কারের যোগ্য হন, তাহলে আপনারা কি ক্রোধ ও অভিশাপের যোগ্য নন? যদি আপনারা ন্যায়পরায়ণ হন এবং বিনয়ের কোনো লেশচিহ্নও আপনাদের মাঝে থেকে থাকে, তবে আপনাদের আত্মার গভীরে অনুসন্ধান করুন এবং সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীর ব্যাপারে চুপ থাকুন।      

আল্লামা তীবী (রাহিমাহুল্লাহ) সাইয়্যিদুনা হাসান ইবনে সাবিত (রাদিয়াল্লাহু আনহু)’এর একটি অনন্য কবিতা উদ্ধৃত করেছেন এবং এই রওয়ায়াত/বর্ণনার ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেছেন:

তুমি কি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে গালি দাও,

যবে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সমকক্ষ নও?

তোমাদের দু জনের মধ্যে যে লোকটি মন্দতর,

সে হোক উৎসর্গিত ওই পুণ্যাত্মার তরে, যিনি তোমার চেয়েও শ্রেয়তর। (ভাবানুবাদ)

(চ) – এই বর্ণনা থেকে এটাও বোঝা যায়, যে ব্যক্তি সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে গালি দেয় সে অহংকারী, দাম্ভিক এবং হীন। যদি কেউ অন্যের কর্মের সমালোচনা করে, তবে সে বোঝায় সমালোচিত জন কোনো এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে তার থেকে নিকৃষ্ট। সুতরাং, উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো ব্যক্তি মন্তব্য করে এ মর্মে যে, কোনো নির্দিষ্ট সাহাবী (রা.) ন্যায়বিচার ও নিরপেক্ষতার চাহিদা পূরণ করেননি, তাহলে এর অর্থ হবে, এই ব্যক্তি যদি ওই সাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু আনহুর মতো একই অবস্থানে থাকতো, তাহলে সে আরো ভালোভাবে ন্যায়বিচারের পূর্বশর্ত পূরণ করতো, যেনো সে সাহাবী (রা.)’এর চেয়েও ন্যায়পরায়ণতার বেলায় উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন। এটি অহংকারের পাপ এবং আত্মম্ভরিতার ভ্রষ্টাচরণ যা কাউকে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’এর প্রতি গালি দিতে প্ররোচিত করে থাকে। এই মন্দের সংশোধন প্রয়োজন, যা ওপরের এই হাদীসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইঙ্গিত করেছেন।

(ছ) – এ বর্ণনায় কারো সাথে আলোচনায় প্রবৃত্ত হবার ও বিতর্কের আদবও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কোনো প্রতিপক্ষকে সরাসরি “আপনি অভিশপ্ত হতে পারেন!”- মর্মে এই কথা দ্বারা সম্বোধন করা উচিত নয়। এর পরিবর্তে তাকে বলা উচিত: “আপনাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সবচেয়ে মন্দ সে অভিশপ্ত হোক!” এটি এমন একটি নিরপেক্ষ পন্থা যার সাথে সকলেই একমত হবেন এবং কারো পক্ষে এটি নিয়ে বিতর্ক করার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে প্রশ্ন এখনো রয়ে গেলো “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি বেশি মন্দ”- মর্মে এই বাক্যাংশ দ্বারা কাকে উল্লেখ করা হয়েছে? সমালোচককে? নাকি যাঁর সমালোচনা করা হয়েছে তাঁকে? এর উত্তর পাওয়া কঠিন নয় এবং উভয়ের স্ব স্ব সামষ্টিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে যে কোনো সহজ-সরল মনের মানুষ সহজেই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারবেন এই বিষয়ে যে সাহাবা কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) মন্দ, নাকি মূর্খ সমালোচক?

(জ) – এই বর্ণনায় উম্মাহকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে – فَقُولُوا – “তোমরা (সমালোচককে) বলবে,” যা দ্বারা বোঝায়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবা (রা.)-বৃন্দের সমালোচককে এই উম্মতের অংশ বিবেচনা করেন না। পক্ষান্তরে, সমালোচক এই উম্মাতের বিরোধিতাকারী গোষ্ঠী থেকে আবির্ভূত। এটি সেসব লোকের জন্য একটি কঠোর সতর্কবাণী যারা সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-কে গালিগালাজ করে, অন্যান্য সীমালঙ্ঘনের মতো যার জন্য উপদেশ দেওয়া হয়েছে: “সে আমাদের থেকে নয়।”

(ঝ) – এ বর্ণনা থেকে এটাও বোঝা যায়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে ইসলামের হুকুম-আহকামের উচ্চমর্যাদার (তাকিদের) ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন, একইভাবে তিনি সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীর সম্মান রক্ষার তাকিদের ব্যাপারেও সতর্ক ছিলেন। ইসলামের মূল ভিত্তি তাঁদের উপরেই গড়ে উঠেছে। বর্ণনাটি আমাদেরকে আরো জানায়, যারা সাহাবায়ে কেরাম (রা.)’বৃন্দের কুৎসা রটনা করে তারা ঠিক তাদেরই মতো যারা ইসলাম থেকে দূরে সরে গেছে। এ ধরনের লোকদের তিরস্কার করার জন্য উম্মতকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই বিষয়বস্তুটি অন্যান্য বর্ণনায়ও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে [ দেখুন- মাসিক বাইয়্যিনাত, মুহর্রম ১৩৯০ হিজরী]:

যে ব্যক্তি তাঁদের (সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) অভিশাপ দেয় তার উপর আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাবৃন্দ এবং সকল মানুষের লা’নত বর্ষিত হোক। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার কাছ থেকে কোনো নেক আমল কবুল করবেন না, তা হোক না ফরয অথবা নফল। [তাফসীরে ক্বুরতুবী, ১৬তম খণ্ড, ২৯৭-২৯৮ পৃষ্ঠা]

সাহাবায়ে কেরাম (রা.) তাঁদের নিজের ভাষায়

সাইয়্যিদুনা সাঈদ ইবনে যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু, যিনি (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক) বেহেশত লাভের আগাম সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন সাহাবার একজন, তিনি বলেন:

و الله لمشهد رجل منهم مع رسول الله صلى الله عليه وسلم يغبر فيه وجهه فيه خير من عمل أحدكم عمره ولو عمر عمر نوح.

অর্থ: আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোনো সাহাবী (রা.) যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর সাহচর্যে যে অল্প সময়ই অতিবাহিত করুন না কেন, যার দরুন হযতো তাঁর মুখমণ্ডল ধুলোয় ঢেকে গিয়ে থাকতে পারে, তা তোমাদের (অ-সাহাবীদের) যে কারো সারা জীবনের ইবাদতের চেয়েও বেশি মূল্যবান, এমন কী যদি তোমাদের প্রতি পয়গাম্বর নূহ ‘আলাইহিস্ সালামের দীর্ঘ হায়াতও মঞ্জুর করা হয়। [আবূ দাউদ, ৬৩৯ পৃষ্ঠা; মুসনাদে আহমদ (হাম্বল), ১ম খণ্ড, ১৮৭ পৃষ্ঠা]

’আক্বীদা-বিশ্বাসের আলোকে সাহাবায়ে কেরাম (রা.)’কে হেয় প্রতিপন্ন করা নিষেধ

পবিত্র ক্বুর’আন ও হাদীসে এই বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাতের আক্বীদা-বিশ্বাসের বইগুলি দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করে যে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলী ন্যায়পরায়ণ এবং বিশ্বস্ত ছিলেন, এবং তাঁরা যে কোনো ধরনের নিন্দার ঊর্ধ্বে ছিলেন। যে কেউ তাঁদের বদনাম করলে তার ঈমান ও ইসলাম প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং এমন ব্যক্তি শাস্তির যোগ্য হবে। সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত (তাঁরা হানাফী, শাফেঈ, মালিকী বা হাম্বলী মাযহাবেরই হোন না কেন) সকলেই তাঁদের বিশ্বাসে একমত এবং তাঁদের মধ্যে (এ ব্যাপারে) কোন ভিন্নতা নেই।

আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদাহ-বিশ্বাসমূলক গ্রন্থাবলী থেকে আমাদের দলিল গ্রহণ করা উচিত, যেগুলোতে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে হেয় করার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়েছে। এগুলোকে আপনাদের জীবনের মূলনীতি করুন এবং একই সাথে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে অপমানকারীদের ব্যাপারে ধর্মীয় রায় সম্পর্কেও সচেতন হন।

আল-আকীদাহ আল-তাহাবিয়্যাহ শিরোনামের গ্রন্থটি আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাতের একটি নির্ভরযোগ্য রচনা। এতে ইমাম আবু জা’ফর আল-তাহাভী রাহিমাহুল্লাহ (বেসাল: ৩২১ হিজরী) আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা সংক্ষিপ্তভাবে সংকলন করেছেন, যা হাদীসের পণ্ডিতদের পদ্ধতির সাথে সাথে তিনজন আইয়েম্মাহ তথা ইমাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহ (বেসাল: ১৫০ হিজরী), ইমাম আবু ইউসুফ রাহিমাহুল্লাহ (বেসাল: ১৮২ হিজরী) এবং ইমাম মুহাম্মদ রাহিমাহুুল্লাহ (বেসাল: ১৮৯ হিজরী) প্রমুখের বক্তব্যের ওপরে ভিত্তিশীল। আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের সকল অনুসারী এই অনুকরণীয় সংকলনকে প্রজন্মান্তরে গ্রহণ করেছেন এবং এটি সর্বত্র অধ্যয়ন ও পাঠদান অব্যাহত রয়েছে। বর্তমান যুগেও সৌদি আরবে এই গ্রন্থ পড়ানো হয়।

উক্ত গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে,  

و نحب أصحاب النبي صلى الله عليه و سلم و لا نفرط في حب أحد منهم ، ولا نتبرأ من أحد منهم ، ونبغض من يبغضهم وبغير الحق لا نذكرهم، نذكرهم إلا بخير ، وحبهم دين وإيمان وإحسان ، وبغضهم كفر ونفاق وطغيان … إلى قوله … ومن أحسن القول في أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم و أزواجه و ذريارته فقد برئ من النفاق.

অর্থ: “…এবং আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সকল সাহাবী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে ভালোবাসি। আমরা তাঁদের কারো প্রতি আমাদের ভালবাসায় চরমে যাই না এবং তাঁদের কাউকে বর্জনও করি না। যারা ঘৃণা পোষণ করে বা তাঁদের সম্পর্কে খারাপ কথা বলে আমরা তাকে ঘৃণা করি। আমরা তাঁদের সম্পর্কে কেবল ভালো কথা বলি। তাঁদের প্রতি ভালোবাসা দ্বীন, ইসলাম ও তাকওয়ার অংশ। তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ কুফর, ভণ্ডামি ও মন্দদায়ক… যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের সম্পর্কে ভালো কথা বলেন, তাঁর স্ত্রী ও পরিবারবর্গ মুনাফেকী/কপটতা থেকে মুক্ত।” [আল-আক্বীদাতুত্ তাহাবীয়্যাহ, ১১১-১২ পৃষ্ঠা]

ইমাম মালিক রহমতুল্লাহি আলাইহি (বেসাল: ১৭৯ হিজরী) হতে বর্ণিত হয়েছে,

ومن شتم أصحابه أدب وقال أيضا من شتم واحدا من أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم أبا بكر أو عمر أو عثمان أو معاوية أو عمرو بن العاص فإن قال كانوا في ضلال قتل و ان شتم بغير هذا من مشاتمة الناس نكالا شديدا. 

অর্থ: যে ব্যক্তি সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীকে গালি দেয় তাকে শাস্তি দেয়া উচিত। যে ব্যক্তি বলে, সাহাবী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-দের মধ্যে যে-ই  হোন, হযরত আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু, কিংবা হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু, অথবা হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু, বা হযরত মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু কিংবা ‘আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রমুখ গোমরাহ ছিলেন, তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া উচিত। সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের বিরুদ্ধে কেউ অশ্রাব্য ভাষা প্রয়োগ বা বেয়াদবিমূলক আচরণ করলে তাকে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। [রাসায়েলে ইবনে আবেদীন শা’মী, ১ম খণ্ড, ৩৫৮ পৃষ্ঠা]

মায়মূনী (রহ.) বর্ণনা করেছেন যে তিনি ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ’কে বলতে শুনেছেন:

وقال الميموني سمعت أحمد يقول: ما لهم ولمعاوية رضي الله عنه نسئل الله العافية وقال يا أبا الحسن إذا رأيت أحدا يذكر أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم بسوء فاتهمه على الإسلام.

অর্থ: “হযরত মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) সম্পর্কে কুৎসা রটনাকারী লোকদের কী হলো? আমরা আল্লাহর কাছে সুস্থ (বিবেকের) জন্য একান্ত প্রার্থনা করি!” অতঃপর ইমাম আহমদ (রহমতুল্লাহি আলাইহি) বলেন: “ওহে আবূল হাসান! তুমি যখনই দেখবে কেউ সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) সম্পর্কে মন্দ উক্তি করছে, তৎক্ষণাৎ তার ইসলাম সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করবে।” [আল-সা’রিমুল মাসলূল, ৫৭৩ পৃষ্ঠা]

ইমাম আবূ যুরা’আহ আল-রাযী (রহমতুল্লাহি আলাইহি – বেসাল: ২৬১ হিজরী) বলেন:

إذا رأيت الرجل ينتقص أحدا من أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم فأعلم أنه زنديق.

অর্থ: তুমি যখন কোনো ব্যক্তিকে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’বৃন্দের কোনো একজনকে হেয় করতে দেখবে, তখন জানবে সে একজন যিনদিক্ব/ধর্মদ্রোহী বা ধর্মত্যাগী অবিশ্বাসী। [আল-ইসা’বাহ, ১ম খণ্ড, ২২ পৃষ্ঠা]

ইমাম আবূ বকর সারাখসী (রহমতুল্লাহি আলাইহি – বেসাল: ৪৮৩ হিজরী) লেখেন:

إن الله تعالى أثنى عليهم في غير موضع من كتاب كما قال تعالى “محمد رسول الله والذين معه” (الآية) ورسول الله صلى الله عليه وسلم وصفهم بأنهم خير الناس فقال “خير الناس قرني الذين أنا فيهم” والشريعة إنما بلغتنا بنقلهم، فمن طعن فيهم فهو ملحد منابذ للإسلام دواؤه السيف إن لم يتب.

অর্থ: নিঃসন্দেহে আল্লাহ পবিত্র ক্বুর’আনের বিভিন্ন স্থানে সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের প্রশংসা করেছেন; উদাহরণস্বরূপ: “মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসূল..।” আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদেরকে “মানবজাতির মাঝে সর্বোত্তম” বলে বর্ণনা করেছেন তাঁরই বিবৃতিতে: “আমি যে যুগে আছি সেই যুগের মানুষই সেরা।” ইসলামের বিধি-বিধান আমাদের কাছে পৌঁছেছে তাঁদের প্রচারের মাধ্যমে, তাই যে কেউ তাঁদের প্রতি সীমালঙ্ঘনকারী বলে গালি দেয় সে ইসলামের বিরুদ্ধে চলে গেছে। যদি সে নিবৃত্ত না হয়, তবে তার একমাত্র নিরাময় হলো তরবারি। [উসূলুস্ সারাখসী, ২য় খণ্ড, ১৩৪ পৃষ্ঠা]

সাহাবায়ে কেরাম (রা.) ও ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)

ইমাম আবূ হানীফাহ (রহমতুল্লাহি আলাইহি – বেসাল: ১৫০ হিজরী) বিবৃত করেন:

ولا نذكر الصحابة إلا بخير.

অর্থ: আমরা সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) সম্পর্কে কেবল ভালো ছাড়া কিছু বলি না। [শরহে ফিক্বাহে আকবর, ৮৫ পৃষ্ঠা]

সাহাবা (রা.)’বৃন্দের স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই

এটা সর্বসম্মত ও অবিসংবাদিত যে, সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দ ন্যায়পরায়ণ এবং এই উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা এই উম্মাহর কোনো ব্যক্তির দ্বারা প্রত্যায়িত হবার প্রয়োজন নেই; কেননা আল্লাহতায়ালা যিনি তাঁদের অন্তর সম্পর্কে সর্বজ্ঞ, তিনি তাঁদের বিশ্বস্ততা নিশ্চিত করেছেন। বুযূর্গ আলেম-উলামা নিজেদের গ্রন্থসমূহে এ বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে আলোচনা করেছেন।

হাফিয আবূ বকর আল-খতীব আল-বাগদাদী (রহমতুল্লাহি আলাইহি – বেসাল: ৪৬৩ হিজরী) ব্যাখ্যা করেন:

فلا يحتاج أحد منهم مع تعديل الله تعالى لهم، المطلع على بواطنهم الى تعديل أحد من الخلق.

অর্থ: সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীর ধার্মিকতা সৃষ্টিকুলের কারো দ্বারা প্রতিপাদনের ব্যাপারে তাঁরা মুখাপেক্ষী নন, কেননা স্বয়ং আল্লাহতায়ালাই তাঁদের বাতেন তথা অন্তরের উন্নত অবস্থার পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন। [আল-কিফায়া, ৪৭ পৃষ্ঠা; আল-আওয়া’সিম মিনাল-ক্বাওয়া’সিম, ৩৪ পৃষ্ঠা; আস্ সাওয়ায়িক্বুল মোহরিক্বাহ, ২১০ পৃষ্ঠা]

ইমাম ইবনে আসীর আল-জাযারী (রহমতুল্লাহি আলাইহি – বেসাল: ৬৩০ হিজরী) লেখেন:

والصحابة يشاركون سائر الرواة في جميع ذلك إلا في الجرح والتعديل فانهم كلهم عدول لا يتطرق اليهم الجرح لأن الله عز وجل ورسوله زكاهم وعدلاهم وذلك مشهور لا نحتاج لذكره.

অর্থ: সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দ তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা ব্যতিরেকে সকল দিক থেকে অন্যান্য বর্ণনাকারীদের মতোই, কেননা তাঁদের সকলেই ছিলেন নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য। তাঁদের সমালোচনা করা যাবে না, যেহেতু আল্লাহ এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের সততা সম্পর্কে ঘোষণা করেছেন। তাঁদের সত্যতা সুপরিচিত এবং এর উল্লেখের কোনো প্রয়োজন নেই। [উসদুল গা’বাহ, ১ম খণ্ড, ১৪ পৃষ্ঠা]

বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ও আলেম ইবনে খালদূন আল-মাগরিবী (রহমতু্ল্লাহি আলাইহি) বলেন:

هذا هو الذي ينبغي أن تحمل عليه أفعال السلف من الصحابة و التابعين فهم خيار الأمة و إذا جعلناهم عرضة القدح فمن الذي يختص بالعدالة و النبي صلى الله عليه و سلم يقول خير الناس قرني ثم الذين يلونهم مرتين أو ثلاثا ثم يفشوا الكذب فجعل الخيرة و هي العدالة مختصة بالقرن الأول و الذي يليه فإياك أن تعود نفسك أو لسانك التعرض لأحد منهم.

অর্থ: আমাদের পূর্বসূরী সাহাবা (রা.) ও তাবিয়ীন (রহ.)-বৃন্দের কর্মকাণ্ডকে উত্তমভাবে ব্যাখ্যা করাই উপযুক্ত; কারণ তাঁরা এই উম্মতের মধ্যে সেরা ছিলেন। আমরা যদি তাঁদেরকে সমালোচনার লক্ষ্যবস্তু করি, তাহলে সততার ব্যাপারে কাকে আলাদা করা যাবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “সর্বোত্তম হলো আমার যুগের মানুষ এবং তারপর যারা তাদের অনুসরণ করবে (তিনি এটি আরেকবার বলেছিলেন)। তারপর মিথ্যা ছড়িয়ে পড়বে।” আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথম এবং দ্বিতীয় (বা তৃতীয়) যুগ পর্যন্ত কল্যাণ অব্যাহত থাকবে বলেছিলেন; এর দ্বারা তিনি সাহাবা (রা.)-মণ্ডলীর বিশ্বাসযোগ্যতা বুঝিয়েছিলেন। তাঁদের কারো বিরুদ্ধে খারাপ অনুভূতি পোষণ করা বা তাঁদের বিরুদ্ধে অবজ্ঞাসূচক কথা উচ্চারণ করা থেকে সাবধান হও! [মুক্বাদ্দমা-এ-ইবনে খালদূন, ২১৮ পৃষ্ঠা]

পাপের সম্ভাবনা ঐশী জ্ঞানের অধীন

পবিত্র ক্বুর’আন ও হাদীস এবং পুণ্যাত্মা পূর্বসূরীবৃন্দের বাণী থেকে এটা স্পষ্ট যে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’মণ্ডলী আল্লাহ ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রশংসা অর্জন করেছেন। তাঁদের কৃতিত্ব ও গুণাবলী বর্ণনাসূচক আল্লাহর ওহী প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান এবং তাই তাঁদের অন্য কারো কাছ থেকে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতার অনুমোদনের কোনো প্রয়োজনই নেই। যখন তাঁরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, তখন তাঁদের অন্তরগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহীর নূর তথা দীপ্তিতে আলোকিত হয়েছিলো। এর দ্বারা তাঁরা পবিত্রতা ও সততার এমন একটি অবস্থানে উন্নীত হয়েছিলেন যে তাঁদের এ অর্জন ফেরেশতাদের কাছেও ঈর্ষনীয় (সাফল্য) হয়ে দাঁড়ায়। যদি তাঁদের দ্বারা কোনো বিচ্ছিন্ন (ইজতিহাদী/গবেষণাক্ষেত্রে) ভ্রান্তি সংঘটিত হয়ে থাকে, যা প্রায় অস্তিত্বহীনই ছিলো, তবে আল্লাহর ঐশী প্রজ্ঞাও এতে ভূমিকা রেখেছে।

ইমাম আবূ হানীফাহ (রহমতুল্লাহি আলাইহি – বেসাল: ১৫০ হিজরী) বলেন:

ما قاتل أحد عليًا إلا و علي أولى بالحق منه، ولولا ما سار علي فيهم ما علم أحد كيف السيرة في المسلمين.

অর্থ: হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’এর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত এমন কেউই হননি, স্রেফ এ ছাড়া যে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)-ই এক্ষেত্রে সত্যের অধিকতর নিকটবর্তী (মানে সবার অগ্রবর্তী) ছিলেন। তিনি (ক.) যদি তাঁদের সাথে এরকম ভূমিকা না গ্রহণ করতেন, তাহলে কেউই জানতে পারতেন না মুসলমানদের মধ্যে দ্বন্দ্ব/সংঘাতের কোনো নজিরের সময় কীভাবে তা মোকাবিলা করতে হয়। [মানা’ক্বিবে ইমামে আযম, ২য় খণ্ড, ৮৩-৮৪ পৃষ্ঠা]

শাহ আবদুর রহীম রায়পুরী সাহেবের জীবনী আলোচনাকালে মওলানা আশিক্ব-এ-ইলাহী মিরাঠী সাহেব নিজ ‘তাযকিরাতুল খলীল’ পুস্তকে লেখেন:

শাহ আবদুর রহীম রায়পুরী সাহেবের স্বাভাবিক অভ্যাস অনুসারে একদিন ‘আসরের সালাতে’র পর তিনি বাগানের প্রাঙ্গণে একটি বিছানায় বসেছিলেন; চারপাশে পরিচারক ও মানুষের এক বিশাল দল দ্বারা তিনি পরিবেষ্টিত ছিলেন, যাঁদের মধ্যে কেউ কেউ বাগানে পাতা (স্থায়ী) আসনে বসে ছিলেন। এই সময় রাও মুরাদ ‘আলী খাঁন হযরতে সাহাবায়ে কেরামের (রা.) মধ্যকার দ্বন্দ্বের বিষয়টি উত্থাপন করেন। এতে (উপস্থিত) লোকেরা তাঁদের মতামত প্রকাশ করতে শুরু করেন; কেউ একজন বলেন যে অমুক (সাহাবী) ভুল করেছিলেন এবং তমুক (সাহাবী)-এর এমন আচরণ করা উচিত হয়নি। এই পর্যায়ে পৌঁছুলে শাহ (আবদুর রহীম রায়পুরী সাহেব আল্লাহকে উল্লেখ করে) ক্রোধান্বিত হয়ে কম্পিত স্বরে নীরবতা ভেঙ্গে বললেন: “ওহে রাও! আমার কিছু কথা শোনো! আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সৃষ্টিকুলকে কেয়ামত পর্যন্ত উদ্ভব হবে এমন তাঁদের যাবতীয় দ্বীনসংশ্লিষ্ট ও এর পাশাপাশি পার্থিব প্রয়োজন সম্পর্কে অবহিত করার জন্য এই ধরাধামে শুভাগমন করেছিলেন। এটা প্রতীয়মান হয় যে, এমন একটি মহান বার্তা প্রদানের জন্য এবং উদ্ভূত প্রতিটি পরিস্থিতি ও ঘটনার সৃষ্টি সম্পর্কে অবহিত করার জন্য তাঁকে নিজ অবদান রাখায় খুব ক্ষুদ্র (জাহেরী/প্রকাশ্য) হায়াতে জিন্দেগী দেওয়া হয়েছিলো। এই পরিস্থিতির ফলশ্রুতি দ্বারা জগতবাসী শিখতে পেরেছেন কীভাবে কোনো নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে নিজেদের আচরণকে পরিচালনা করতে হয়।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে নীতিগতভাবে কোনো অপ্রাসঙ্গিক ঘটনা ঘটেনি। এই ঘটনাগুলো ছিল দুই ধরনের: প্রথমত, এমন কিছু ঘটনা ছিল যা নুবূওয়াতের অবস্থানের বিরোধিতা করেনি। দ্বিতীয়ত, এমন কিছু ঘটনা ছিল যেগুলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিশিষ্ট অবস্থানের সাথে সাংঘর্ষিক ছিল। আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই প্রথম কিসিমের ঘটনাগুলির অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন; যেমন, বিবাহ, সন্তান জন্মদান, বেসাল (আল্লাহর সাথে পরলোকে মিলনপ্রাপ্তি), দাফন ইত্যাদি। সুখ-দুঃখের সমস্ত ঘটনার মধ্য দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন, জগতবাসী এসব পরিস্থিতিতে কীভাবে আচরণ করতে হয় তা শিখেছেন। উদাহরণস্বরূপ, যখন কোনো আত্মীয় ইন্তিক্বাল করেন, তখন কোন্ কাজগুলি উপযুক্ত এবং কোনগুলি নয়, সে সম্পর্কে তাঁরা জেনেছেন। কারো জন্মের সময় বা বিবাহের সময় বা অন্য কোনো আনন্দ অনুষ্ঠানে কোনটি জায়েয এবং কোনটি সুন্নাতের পরিপন্থী, সে সম্পর্কেও জেনেছেন দুনিয়াবাসী।

এমন কিছু ঘটনাও ছিল যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উচ্চমর্যাদার সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারতো। যদি সেগুলো স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে ঘটে থাকে (যা অবশ্য ঘটেনি), তাহলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিশিষ্ট মক্বামকে ক্ষুণ্ন করতো। উদাহরণস্বরূপ, যদি ব্যভিচার, চুরি ইত্যাদি সংঘটিত হয়, তাহলে কীভাবে শাস্তি কার্যকর করা উচিত, বা যদি কোনো দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়ে বা আত্মস্বার্থে কোনো তর্কের সূত্রপাত ঘটে, তাহলে কীভাবে মীমাংসা করতে হবে এমন সব ঘটনার ক্ষেত্রে। এটা অনুচিত হতো যদি এই ঘটনাগুলো স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ক্ষেত্রে ঘটতো, যখন একই সময়ে এগুলো ঘটার প্রয়োজন ছিল।

এ কারণেই সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দ নিজেদেরকে এ দ্বীনের সেবক হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন; এ যেনো তাঁরা নিজেদের সাথে এমন ঘটনা ঘটতে দিতে সম্মত হয়েছিলেন, যেগুলো ঘটা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিশিষ্ট অবস্থানের সাথে সাংঘর্ষিক ছিল। এসব ঘটনার ফলাফল (নির্দিষ্ট ছকে) সংজ্ঞায়িত করার জন্য এটা হয়েছিল, যাতে ইসলাম ধর্ম তার পরিপূর্ণতায় পৌঁছাতে পারে। অতএব, সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীর ক্ষেত্রে এমন সব ঘটনা ঘটেছে যা কিয়ামত পর্যন্ত তাঁদের পরবর্তী সকলের জন্য হেদায়েতের মাধ্যম হিসেবে কাজ করবে। এই ঘটনাগুলির মাধ্যমে প্রত্যেক সাধারণ মানুষ এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে কাজ করতে হয় তা জানতে পারেন।

শুধুমাত্র হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দ্বীনের পরিপূর্ণতার জন্য কি এমন কোনো সাহসী ও নিবেদিতপ্রাণ আত্মা আছেন যাঁরা সম্মান হিসেবে সব অপমান এবং শক্তি-সামর্থ্য হিসেবে ত্রুটি-বিচ্যুতিকে এবং এর পাশাপাশি সমালোচনার আঘাতকে সহ্য করতে ইচ্ছুক? এ যেনো সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের কর্মগুলোই ঘোষণা করেছে:

“প্রত্যেকেই খ্যাতি, সম্মান এবং প্রসিদ্ধি কামনা করে, কিন্তু একজন আশেক্ব-ভক্তকে জিজ্ঞাসা করুন ভক্তির মাধুর্য কী এবং মাশূক্ব/প্রেমাস্পদের পথে অসম্মান সহ্য করার মধ্যে কী খুশি উপভোগ করা যায়।”

এই ধরনের প্রকৃত আশেক্ব-ভক্ত আমাদের পথনির্দেশনা ও সংশোধনের জন্য তাঁদের সম্মান ও আত্মসম্মানবোধকে বিসর্জন দিয়েছিলেন। তবুও তেরো (বর্তমানে চৌদ্দ) শত বছর পরে আমরা তাঁদের ট্রাইব্যুনালে কমিশনারের (মানে বিচারকের) মতো বিচারে বসেছি তাঁদের ব্যাপারে রায় দেওয়ার জন্য। আমরা তাঁদের দোষ খুঁজে বেড়াচ্ছি এবং নিজেদের নসীব/ভাগ্য বরবাদ করছি। এ থেকে আমরা কী পাবো? আমরা যদি সুন্নতের এই রত্নগুলোর প্রশংসা না করতে পারি, তাহলে অন্তত আমাদের উচিত তাঁদের সমালোচনা থেকে মুখ বন্ধ রাখা।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “আল্লাহকে ভয় করো! আমার সাহাবাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো! আমার পরে তাদেরকে সমালোচনার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত কোরো না!

শাহ সাহেব অনেকক্ষণ ধরে এই ধারায় তাঁর বক্তৃতা চালিয়ে যান; এ যেনো তাঁর মুখ থেকে পাপড়ি ছিটানো হচ্ছিলো এবং শ্রোতাবৃন্দ এর ঘ্রাণে বিমোহিত হচ্ছিলেন। [তাযকিরাতুল খলীল, ২৪৬-২৪৮ পৃষ্ঠা]

এই মুহূর্তে আমি (মওলানা জা’ফর ইক্ববাল) আরেকটি সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে উল্লেখ করতে চাই। কয়েক বছর আগে ইসলাম ও শিয়া মতবাদের মধ্যে একটি তুলনামূলক গবেষণার উপর আমার প্রবন্ধটি সংকলন করার সময়, শিয়া মতবাদের পক্ষে ও বিপক্ষে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত অনুসন্ধান করার সময়, আমি ‘না’ম ওয়া নাসাব’ শিরোনামের নাসিরুদ্দীন নাসর গোলরাভির একটি বইয়ের রেফারেন্স পাই। এটি ঘটেছিলো আমার দ্বারা ‘সুন্নী মাওক্বাফ’ নামক আরেকটি বই পাশাপাশি পড়ার সময়কালে, যেটি মওলানা আলী শের হায়দারী সাহেব রাহিমাহুল্লাহর বয়ানের একটি সংকলন। আমি জানতে কৌতূহলী ছিলাম কে এই ব্যক্তি, যিনি শিয়া মতবাদের বিরুদ্ধে না’ম ওয়া নাসাব শিরোনামে একটি বই লিখেছেন।

বইটি কেনার পর আমি বুঝতে পারি সেটির বিষয়বস্তু বিশেষভাবে শিয়া মতবাদের বিরুদ্ধে নয়, বরং শিয়া পণ্ডিত নাজম আল হাসান কারা’রভী সাহেবের প্রতি একখানা জবাব, যে শিয়া পণ্ডিত হযরত শাইখ আবদুল কা’দির জিলা’নী রহমতুল্লাহি আলাইহি’র (বেসাল: ৫৬১ হিজরী) খান্দানের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট কিছু অভিযোগ করেছিলেন। বইটির একাদশ অধ্যায়ে মাত্র ১১৯ পৃষ্ঠাই (উক্ত) বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত ছিল, বাকিটুকু (এর বিশাল আয়তন সত্ত্বেও) আলোচনার সাথে সম্পর্কিত ছিল না। বইটিতে চিত্রসহ পৃষ্ঠাগুলি বাদে মোট ৯৪৬টি পৃষ্ঠা রয়েছে। বইটি পড়ার সময় আমি বুঝতে পারি যে অষ্টম অধ্যায়টি বিশেষভাবে শিয়া মতবাদের বিরুদ্ধে লেখা এবং এতে আমি নিম্নলিখিত অনুচ্ছেদটি পড়লাম:

দুঃখজনকভাবে আহলুস সুন্নাতের আকীদা-বিশ্বাস শিয়া ও খাওয়া’রিজদের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। আহলুস সুন্নাতের কিছু লোক শিয়া মতবাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে এমন চরম পর্যায়ে চলে গেছে যে তারা খাওয়া’রিজদের মতোই অভদ্র ও অসভ্য হয়ে উঠেছে। অপর দিকে কিছু আহলুস সুন্নাতপন্থী খাওয়ারিজদের বিরোধিতায় এতোটাই মগ্ন হয়ে উঠেছে যে তারা শিয়াদের মতোই অভদ্র হয়ে গেছে। কারণ খাওয়ারিজ-চক্র হযরতে আহলে বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে অপমান করে, আর শিয়া গোষ্ঠী হযরতে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে অপমান করে। এ কারণেই এ গ্রন্থে উভয়ের ভ্রষ্ট বিশ্বাস ও ভ্রান্ত ধারণাকে দৃঢ়ভাবে খণ্ডন করা হয়েছে। আহলুস সুন্নাতকে খাওয়া’রিজ এবং শী’আহ উভয় দলের আকীদা-বিশ্বাস থেকেই দূরে থাকতে হবে এবং সর্ব-হযরত আহলে বাইত ও সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন)’বৃন্দের প্রতি তাঁদের ভালবাসায় মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে হবে। একজনের প্রশংসা অপর জনের প্রতি অবজ্ঞার পরিণতি বরণ করা উচিত নয়। [না’ম ওয়া নাসাব, ৪২৭ পৃষ্ঠা]

তিনি আরো উল্লেখ করেছেন:

আমরা শান্তভাবে মানুষের ছোঁড়া এক রাশ অপমানজনক বিবৃতি শ্রবণ করি। আল্লাহর কসম! আমরা আমাদের পূর্বসূরীদেরকে এর চেয়ে কম মর্যাদা আর কখনো দেইনি, যাঁদের উচ্চমর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব পবিত্র কুর’আন ও সুন্নাহতে নিহিত রয়েছে ইসলামেরই নীতিমালা-নির্ধারিত সীমারেখায়। আল্লাহর আম্বিয়া (আলাইহিমুস্ সালাম)-বৃন্দ হলেন আল্লাহরই পয়গাম্বর, কিন্তু তারপরও আমাদের নিজেদেরকে হযরতে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’মণ্ডলীর গোলাম হিসেবে উপলব্ধি করা উচিত, যা অধিকাংশ পুণ্যাত্মা আউলিয়া (রহমতুল্লাহি আলাইহিম) তাঁদের ভাষণে বা বচনে প্রকাশ্যে জ্ঞাত করেছেন। আমরা কখনোই কোনো সাহাবী (রা.) বা পুণ্যবান ওলী (রহ.)-কে মা’সূম তথা নিষ্পাপ মনে করিনি। এটা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত যে শুধুমাত্র পয়গাম্বর (আলাইহিমুস্ সালাম)-বৃন্দই মা’সূম; তবে সর্ব-হযরত আহলে বাইত (রা.), সাহাবা (রা.) এবং এই উম্মাহর অন্যান্য পুণ্যবান ব্যক্তিবৃন্দ মাহফূয তথা পাপ থেকে হেফাজত-প্রাপ্ত। অভ্রান্ততা (আসমত) এবং পাপ থেকে হেফাজত-প্রাপ্তির মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে ইসলামী আলেম-উলামা তথা জ্ঞানী ব্যক্তিবৃন্দ অধিক অবহিত। আমি আহলুস সুন্নাতের আকীদা-বিশ্বাসকে অন্তরে ধারণ না করা মুসলিম ভাইদের প্রতি আহলুস সুন্নাতের পদ্ধতি বেছে নেওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। একজন সুন্নী এমন ব্যক্তি নন যে শুধুমাত্র আহলুস সুন্নাহর কিছু আকীদা গ্রহণ করেন, বরং তিনি এর সমস্ত আকীদা-বিশ্বাসকে ধারণ করে চলেন; আর আহলুস সুন্নাতের এই আকীদা-বিশ্বাসে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে হযরতে আহলে বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে শ্রদ্ধা করা এবং হযরতে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে সম্মান করা। হযরতে আহলে বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে ঘৃণা করা খাওয়া’রিজদের মতবাদসদৃশ এবং হযরতে  সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-এর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা শিয়া মতবাদ। হযরতে আহলে বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’বৃন্দের প্রতি শ্রদ্ধা, হযরতে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’মণ্ডলীর প্রতি সম্মান এবং পুণ্যবান আউলিয়া (রহমতুল্লাহি আলাইহিম)-বৃন্দের প্রতি শ্রদ্ধা আহলুস সুন্নাতেরই (গুরুত্বপূর্ণ) অংশ। এই বক্তব্যগুলো নিয়ে চিন্তা করলে যে কেউ বুঝতে পারবেন যে, খাওয়া’রিজ-বর্গ হযরতে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে গ্রহণ করেছে, কিন্তু হযরতে আহলে বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে বর্জন করেছে। শিয়া-চক্র হযরতে আহলে বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে মেনে নিয়েছে, কিন্তু হযরতে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাক্বলীদ (মানে মাযহাব) অমান্যকারী ও ওহাবীদের বেশিরভাগই হযরতে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে গ্রহণ করেছে কিন্তু উল্লেখযোগ্যভাবে হযরতে আহলে বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে বাদ দিয়েছে। এর পাশাপাশি তারা সচেতনভাবে আল্লাহর নেক বান্দা (মানে আউলিয়া)-দের অবজ্ঞা ও হেয় প্রতিপন্ন করেছে। যাঁরা আহলুস সুন্নাতের আকীদা-বিশ্বাস অন্তরে পোষণ করেন, হোন না কেন চিশতী, নিজামী, কাদেরী, সোহরওয়ার্দী বা নকশাবন্দী, তাঁরা সকলেই এই ধার্মিক পুণ্যাত্মাবৃন্দের পদচুম্বন করেছেন এবং তাঁদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেছেন।

আহলুস সুন্নাতের মতাদর্শে ধার্মিক পুণ্যাত্মা ও ইমামমণ্ডলীর প্রতি শ্রদ্ধা, হযরতে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’বৃন্দের প্রতি সম্মান এবং সেই সাথে হযরতে ইমামে আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু এবং হযরতে ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আনহা-এর পরিবারের (মানে খান্দানের) জন্য প্রশংসা খুঁজে পাওয়া যায়। ওহে ঈমানদার ভাইয়েরা! আহলুস সুন্নাতের পন্থা অবলম্বন করুন। এই রীতি-পদ্ধতি আমাদের কাছে বর্ণনা করা হয়েছে; এটি যুক্তিযুক্ত এবং হক্ব সোবহানাহু তায়ালার দরবারে গ্রহণযোগ্য। [প্রাগুক্ত না’ম ওয়া নাসাব, ৪৪৫ পৃষ্ঠা]

তিনি আরো উল্লেখ করেছেন:

ইসলামী দুনিয়ায় হযরতে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয় এবং তাঁদের প্রতি এই অসাধারণ শ্রদ্ধা প্রদর্শন কেবল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ঘনিষ্ঠ সাথী হওয়ার সম্মানের খাতিরেই। তাঁদের সম্মান করা প্রকৃতপক্ষে সাইয়্যেদুল ক্বওনাঈন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেই সম্মান করা। [প্রাগুক্ত না’ম ওয়া নাসাব, ৪৭০ পৃষ্ঠা]

সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! নাসিরুদ্দীনের (ওপরের) এই বক্তব্য পাঠে আমাদের অন্তরে মহা আনন্দ বয়ে আনে; কেননা এতে মনে হয় তিনি যে কোনো চরমপন্থা থেকে মুক্ত অবস্থানে থেকেছেন এবং তাঁর বইতে আহলুল বাইত এবং আসহাব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন) সম্পর্কে তাঁর চিন্তাভাবনা সুশৃঙ্খল করেছেন। তাঁর সম্পর্কে এই ইতিবাচক ধারণা বেশিদিন থাকেনি; কারণ তাঁর শিয়া মতবাদ ও খাওয়ারিজ ধ্যানধারণা খণ্ডনের দাবিগুলো ফাঁকা ছাড়া আর কিছুই প্রমাণিত হয়নি। এক পর্যায়ে তিনি নিম্নোক্ত দোয়াটি করেছেন:

হে আল্লাহ! আহলে বাইত এবং আসহাব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন) উভয়ের জন্য আমাদের (অন্তরে) প্রচুর ভালোবাসা এবং ভক্তিশ্রদ্ধা মঞ্জুর করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দৃষ্টিতে কোনো বিশেষ সাহাবী (রা.)’এর যে মর্যাদা ছিল, সেই সাহাবী (রা.)’এর জন্য আমাদের (অন্তরে) সেই স্তরের ভক্তিশ্রদ্ধা মঞ্জুর করুন। এটাই ইসলাম। এই আনুগত্য। এটাই ঈমান। [না’ম ওয়া নাসাব, ৫১৯ পৃষ্ঠা]

তিনি এরপর (তাঁর বইয়ে) যা লিখেছেন তা স্পষ্টভাবে এই প্রার্থনার বিরোধিতা করেছে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দকে অন্য কোনো সাহাবী (রা.)’এর ব্যাপারে কোনো অভিযোগ বা ক্ষোভ প্রকাশ করা থেকে বিরত রাখতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

لَا يُبَلِّغُنِي أَحَدٌ مِنْ أَصْحَابِي عَنْ أَحَدٍ شَيْئًا فَإِنِّي أُحِبُّ أَنْ أَخْرُجَ إِلَيْكُمْ وَأَنَا سَلِيمُ الصَّدْرِ.

অর্থ: আমার সাহাবাদের মধ্যে কেউ আমাকে (অপর) কোনো সাহাবীর ব্যাপারে কোনো মন্দ কথা শোনাবে না। কেননা আমি নির্ভার অন্তর নিয়ে তোমাদের সাথে সাক্ষাতে আসতে ভালোবাসি। [তিরমিযী, ২য় খণ্ড, ২৫২ পৃষ্ঠা/ অনলাইন-৩৮৯৬; আবূ দাউদ, ২য় খণ্ড, ৩১১ পৃষ্ঠা/অনলাইন-৪৮৬০]

এটাই ছিল সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দকে প্রদত্ত নির্দেশ। উপরন্তু, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতকে উপদেশ দিয়েছেন:

اللهَ اللهَ فِي أَصْحَابِي اللهَ اللهَ فِي أَصْحَابِي لاَ تَتَّخِذُوهُمْ غَرَضًا بَعْدِي.

অর্থ: আল্লাহকে ভয় করো, আল্লাহকে ভয় করো আমার সাহাবাদের ব্যাপারে। আমার (বেসালের) পরে তাদেরকে সমালোচনার পাত্র হিসেবে গ্রহণ কোরো না। [তিরমিযী, ২য় খণ্ড, ২২৫ পৃষ্ঠা/অনলাইন-৩৮৬২]

ধার্মিক পূর্বসূরীদের ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফা রাহিমাহুল্লাহ (বেসাল: ১৫০ হিজরী), যাঁকে আল্লাহ এমন বৈশিষ্ট্য দিয়েছিলেন যা ইসলামের মহিমা ও মর্যাদার মূর্ত প্রতীক ছিল, তিনি সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের যুগের শেষ বছরগুলি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাঁর কেবল এই সম্মানিত পুণ্যাত্মাবৃন্দের (রা.) জীবন সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টিই ছিল না, বরঞ্চ তিনি তাঁদের সঙ্গ লাভ দ্বারা আশীর্বাদধন্যও ছিলেন। তাঁরই প্রচেষ্টার মাধ্যমে ইসলামী বিধানশাস্ত্র (ফিক্বাহ) প্রথমবারের মতো সুসংহত হয়। তিনিই সেই হাদিসটির উপযুক্ত উদ্দিষ্ট ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যা তাঁর জন্য সুসংবাদ নির্দেশ করেছে যে এমন কী তিনি জ্ঞানের সন্ধানে নক্ষত্রের কাছেও যেতে পারেন। [তাবঈদ-উস-সহীফাহ, প্রণেতা: হাফিজ আস্ সৈয়ূতী, ২০ পৃষ্ঠা]

সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীর মধ্যে যে মতপার্থক্য দেখা দেয় সে সম্পর্কে ইমাম আবু হানীফা রাহিমাহুল্লাহ অত্যন্ত গভীর, সংক্ষিপ্ত, বিচক্ষণ ও বিজ্ঞ বক্তব্য দিয়েছেন।

ইমাম শামসুদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে ইঊসুফ আস্ সা’লিহি আদ্ দিমাশকী আশ্ শাফিঈ (বেসাল: ৯৪৭ হিজরী) লিখেছেন:

سئل أبو حنيفة عن علي و معاوية و قتلى صفين، فقال أخاف أن أقدم على الله تعالى بشيء يسألني عنه، و إذا أقامني يوم القيامة بين يديه لا يسألني عن شيء من أمورهم، يسألني عما كلفـني، فالإشتغال بذلك أولى.

অর্থ: কেউ একজন ইমাম আবু হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ)-কে হযরতে ইমামে ‘আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, হযরতে আমীরে মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এবং সিফফীনের যুদ্ধে শহীদানের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলেন। ইমাম আবু হানীফাহ (রহমতুল্লাহি আলাইহি) উত্তরে বলেন: “আমি আল্লাহর সামনে (মানে সাক্ষী রেখে) এমন কথা বলতে ভয় পাচ্ছি, যে সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। কিয়ামতের দিন আল্লাহ যখন আমাকে তাঁর সামনে দাঁড় করাবেন, তখন তিনি আমাকে এই পুণ্যাত্মাবৃন্দ (অর্থাৎ, আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু, মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু) এবং সিফফীনের যুদ্ধে শহীদানের বিষয়ে প্রশ্ন করবেন না। তবে আল্লাহ আমাকে সেসব বিষয়ে প্রশ্ন করবেন যেগুলোর জন্য আমি দায়ী। সেসবের জন্য প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত থাকাটা আমার কাছে বেশি যথাযথ। [উক্বূদ আল-জামান, ৩০৫ পৃষ্ঠা]

খলীফা উমর বিন আবদিল আযীয (রাহিমাহুল্লাহ) সম্পর্কে মুহাম্মদ ইবনে নাদরা বলেন:

قال (محمد بن النضر): ذكروا اختلاف أصحاب محمد صلى الله عليه و سلم عند عمر بن عبد العزيز فقال: أمر أخرج الله أيديكم منه ما تعلمون ألسنتكم فيه؟

অর্থ: খলীফা উমর বিন আবদিল আযীয (রহমতুল্লাহি আলাইহি)’এর উপস্থিতিতে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’বৃন্দের মধ্যকার মতপার্থক্যগুলো সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়। খলীফা বলেন: “এটা এমন একটা বিধানগত বিষয় যাকে আল্লাহতায়ালা তোমাদের হাতের (আওতার) বাইরে রেখেছেন। অতএব, তোমাদের জিহ্বাগুলো এ ব্যাপারে আর কী-ই বা জানবে?” [তাবাক্বাত-এ-ইবনে সা’আদ, ৫ম খণ্ড, ২৯৭ পৃষ্ঠা]

বর্ণিত আছে যে খলীফা (রহ.) আরো বলেছেন – تلك دماء كف الله يدي عنها وأنا أكره أن أغمس لساني فيها – এ এমন রক্ত যা (ঝরানো) হতে আল্লাহ আমার হাতকে রক্ষা করেছেন। আর তাই এর পবিত্রতা ক্ষুন্ন করতে আমি আমার জিহ্বাকে ধুলোয় লুণ্ঠিত করার ব্যাপারটি (খুবই) অপছন্দ করি। [প্রাগুক্ত তাবাক্বাত-এ-ইবনে সা’আদ, ৫ম খণ্ড, ৩০৭ পৃষ্ঠা]

ইমাম শাফেঈ (রহমতুল্লাহি আলাইহি) বলেন:

تلك دماء طهر الله عنها أيدينا فلنطهر عنها ألسنتنا.

অর্থ: আল্লাহতায়ালা আমাদের হাতগুলোকে (সিফফীন ও জামালের যুদ্ধে ঝরানো) ওই রক্ত হতে পবিত্র (মানে সুরক্ষিত) রেখেছেন; অতএব, আমাদের উচিত নিজেদের জিহ্বাগুলোকেও তা থেকে (মানে সমালোচনা করা থেকে) হেফাজত করা। [শরহুল মাওয়া’ক্বিফ, ৮ম খণ্ড, ৩৭৪ পৃষ্ঠা; মাকতূবা’ত-এ-ইমাম-এ-রব্বানী, ২৫১ নং পত্র]

হযরত ইবরাহীম আন্ নাখাঈ (রহমতুল্লাহি আলাইহি – বেসাল: ৯৫ হিজরী) বিবৃত করেন:

تلك دماء طهر الله أيدينا منها افـنلطخ ألسنتنا.

অর্থ: সেটা এমন রক্ত যা ঝরানো হতে আল্লাহ আমাদের হাতকে পবিত্র রেখেছেন; এখন কি সেটার পবিত্রতা ক্ষুন্ন করে আমরা নিজেদের জিহ্বাকে দূষিত করবো? [আন্ না’হিয়্যা, ৬ পৃষ্ঠা]

ইমাম হাসান আল-বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি – বেসাল: ১১০ হিজরী) বলেন:

قتال شهده أصحاب محمد صلى الله عليه وسلم وغبنا، وعلموا وجهلنا، واجتمعوا فاتبعنا، واختلفوا فوقفنا.

অর্থ: এগুলো এমন যুদ্ধ ছিল যেগুলোতে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলী জড়িত ছিলেন এবং আমরা (ওই সময়) উপস্থিত ছিলাম না। তাঁরা তাঁদের সাথে সম্পর্কিত সমস্ত পরিস্থিতির ব্যাপারে সম্পূর্ণ অবগত ছিলেন এবং আমরা সে সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞ। আমরা সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীকে অনুসরণ করি এমন বিষয়াদিতে যেগুলোতে তাঁরা সর্বসম্মত ছিলেন। যেসব বিষয়ে তাঁরা মতভেদ করেছেন সেগুলোতে আমরা নীরবতা অবলম্বন করি। [জা’মেউল্ আহকা’মিল্ ক্বুর’আন, প্রণেতা: ইমাম আল-ক্বুরতূবী, ১৬তম খণ্ড, ১৩২২ পৃষ্ঠা]

এসব কারণেই আমাদের পুণ্যাত্মা পূর্বসূরীবৃন্দ হযরতে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীর মতবিরোধ নিয়ে কোনো অপ্রয়োজনীয় আলোচনা করতে দেননি। তবে নির্দিষ্ট কিছু তথাকথিত ‘আলোকিত’ মস্তিষ্কের লোক হযরতে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের মধ্যে উদ্ভূত মতভেদের জটিল ভূমিতে খালি পায়ে পা রেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশ এবং পূর্বসূরীদের শিক্ষাকে উপেক্ষার পথ বেছে নিয়েছে।

না’ম ওয়া নাসাব শীর্ষক বইটির লেখক তাঁর নিজের অনুমানের ভিত্তিতে আহলে বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীর প্রশংসা ও আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রক্রিয়ায় সাইয়্যিদুনা মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর সম্মানকে চরমভাবে অবমাননা ও আঘাত করেছেন, যেখানে সাইয়্যিদুনা ইমামে ‘আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, যাঁকে এ লেখক আবেগের সাথে প্রশংসা করেন, তিনিই নির্দেশ দিয়েছেন:

لا تقولوا إلا خيرا.

অর্থ: (মুআবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু ও তাঁর সঙ্গীদের সম্পর্কে) উত্তম ছাড়া আর কিছু বলবে না। [মিনহাজুস্ সুন্নাহ, ৩য় খণ্ড, ৬১ পৃষ্ঠা]

মনে হয় লেখক অনেকাংশে এই নীতি ভুলে গেছেন যে প্রেম আনুগত্যের দাবি রাখে। তাই যে ব্যক্তি সাইয়্যিদুনা ‘আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’কে ভালোবাসে বলে দাবি করে তার উপরও তাঁর আনুগত্য করা ওয়া’জিব। একজন কবি বলেছেন:

لو كان حبك صادقا لاطعته ــ إن المحب لمن يحب مطيع.

তোমার প্রেম হলে সত্য, 

তুমি প্রেমাস্পদের করবে আনুগত্য,

নিশ্চয় প্রেমিক প্রেমাস্পদের আনুগত্যে দৃঢ়চিত্ত।

(ভাবানুবাদ)

পূর্বসূরীদের অনুসরণ, সাহাবায়ে কেরামকে সম্মান করা এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরিবার-পরিজনকে ভালোবাসার ওপর জোর দেওয়ার ক্ষেত্রে না’ম ওয়া নাসাব বইটির লেখক কোনোভাবেই তাঁর জিহ্বা বা কলম দিয়ে কম করেননি। কিন্তু তাঁর অনুশীলনের ক্ষেত্রে, কেন তিনি তাঁর নিজের পরামর্শে মনোযোগ দেননি তার কোনো (যুক্তিগ্রাহ্য) অর্থ নেই। কেন দেওয়া এবং নেওয়ার মানদণ্ড আলাদা?

নওয়া’সিবকে খণ্ডন করার ছদ্মাবরণে সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুকে যেভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়েছে, তা প্রকাশ করে থাকে শিয়া ও তাদের হৈচৈয়ে কোনো ব্যক্তি কতোটা কলঙ্কিত। একমাত্র পার্থক্য হলো, যখন শিয়া-চক্র সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করে তখন তারা তাঁকে কেবল “মু’য়াবিয়াহ” বলে উল্লেখ করে; পক্ষান্তরে, আহলুস সুন্নাতের ছদ্মবেশে আগত সমালোচকবর্গ নিজেদেরকে লুকিয়ে রেখে তাঁকে “মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু” বলে উল্লেখ করে। 

সবচেয়ে বড় দুঃখের বিষয় হলো, না’ম ওয়া নাসাব পুস্তকটির লেখক বড়পীর শাইখ মহিউদ্দীন আবদুল কা’দির জিলানি রাহিমাহুল্লাহর বংশের প্রতি উত্থাপিত অভিযোগগুলিকে তাঁর নিজের ধর্মীয় আনুগত্য এবং আধ্যাত্মিক সংশ্লিষ্টতার প্রতি আনুগত্যবিরোধী হিসেবে বিবেচনা করেছেন, তিনি কিন্তু একই সম্মান সাইয়্যিদুনা আমীরে মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর প্রতি প্রদর্শন করেননি। পাঁচ বছর নিরন্তর প্রচেষ্টার পরে তিনি ৯৪৬ পৃষ্ঠার একটি গবেষণাপত্রে (বড়পীর সাহেব কেবলার প্রতি উত্থাপিত) ওই অভিযোগগুলির একটি খণ্ডন প্রস্তুত করেন। এতে আমাদের বিন্দুমাত্র আপত্তিও থাকতো না এবং এতে আমাদের কোনো ক্ষতিও সাধিত হতো না – যদি না তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোনো সাহাবীকে (রা.)-কে গালি দিতেন। প্রকৃতপক্ষে আমরা সহ প্রত্যেক মুসলমান তাঁর প্রচেষ্টার প্রশংসা করতাম। অথচ এই বইটিতে লেখক সাইয়্যিদুনা হযরতে আমীরে মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর সমালোচনা করতে ও তাঁর প্রতি অপবাদ দিতে একটা গোটা অধ্যায় বরাদ্দ করেছেন।

প্রকৃতপক্ষে সাইয়্যিদুনা আমীরে মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু একজন সাহাবী ছিলেন, আর বড়পীর শাইখ আবদুল কা’দির জিলানী রাহিমাহুল্লাহ একজন দরবেশ ছিলেন;  দরবেশির মর্যাদা যতো উচ্চই হোক না কেন, এটি একজন সাহাবী হওয়ার মর্যাদার সমকক্ষ হতে পারে না। [বঙ্গানুবাদকের নোট: গাউসুল আযম বড়পীর সাহেব কেবলা (রহমতু্ল্লাহি আলাইহি) স্বয়ং এ মর্মে বক্তব্য দিয়েছেন।]

শাইখ মুজাদ্দিদ-ই আলফ-ই সানী রাহিমাহুল্লাহ (বেসাল: ১০২৪ হিজরী) বলেছেন:

وفضيلة الصحبة فوق جميع الفضائل والكمالات و لهذا لم يبلغ اويس القرني الذي هو خير التابعين مرتبة ادنى من صحبه عليه الصلاة و السلام فلا تعدل بفضيلة الصحبة شيئا كائنا ما كان فإن إيمانهم ببركة الصحبة و نزول الوحى يصير شهوديا.

অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহচর্যের শ্রেষ্ঠত্ব অন্য সব গুণ ও কৃতিত্বকে ছাড়িয়ে যায়। এই কারণেই উওয়াইস আল কারনী রাহিমাহুল্লাহ, যিনি সর্বোচ্চ মর্যাদার তাবেয়ী ছিলেন, তিনি সর্বনিম্ন পর্যায়ের সাহাবী (রা.)-এর মর্যাদায় পৌঁছাতে পারেননি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহচর্যের মর্যাদার সাথে কোনো কিছুকে সমতুল্য কোরো না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে তাঁদের সাহচর্যের আশীর্বাদের ভিত্তিতেই রচিত হয়েছিলো তাঁদের ঈমানদারি। ওহী অবতীর্ণ হওয়ার সাক্ষী হওয়ার ফলশ্রুতিতেই তাঁরা হয়েছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী। [মকতূবাত-এ-ইমাম-এ-রব্বানী, চিঠি নং ৫৯]

ইবনে হাজার আল মক্কী (বেসাল: ৯৪৪ হিজরী) উল্লেখ করেছেন:

أن فضيلة صحبته صلى الله عليه و سلم و رؤيته لا يعدلها شيء.

অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর (রহমতপূর্ণ) সাহচর্য ও দর্শনলাভের সমতুল্য কোনো কিছুই হতে পারে না। [আস্ সাওয়া‘য়েক্বুল মুহরিক্বাহ, ২১৩ পৃষ্ঠা]

শাহ আবদুল ক্বুদ্দূস গাঙ্গুহী (ইন্তিক্বাল: ৯৪৪ হিজরী) বলেন:

এটা আমাদের আক্বীদা-বিশ্বাসের অংশ, যে ব্যক্তি সাহাবী নন, যদিও তিনি বেলায়াত বা দরবেশিতে উচ্চ মর্যাদা অর্জন করতে পারেন এবং মহা ক্ষমতা ও অনুগ্রহের অধিকারী হন, তবুও তিনি সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের মর্যাদায় পৌঁছুতে পারবেন না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহচর্যের শ্রেষ্ঠত্ব একটি সর্বজনীন গুণ, অপর দিকে দরবেশি একটি আংশিক গুণ। কোনো আংশিক পুণ্য কখনোই একটি সর্বজনীন পুণ্যের সমান হতে পারে না। [মাকতূবাত-এ-ক্বুদসিয়্যাহ, ৫০ পৃষ্ঠা]

আল্লামাহ খা’লিদ মাহমূদ বিবৃত করেন:

এটা আহলুস সুন্নাতের আক্বীদা-বিশ্বাস যে একজন সাহা’বী হওয়া সেটার আপন অধিকারেই এক (মহা) সম্মান, যা কোনো একাডেমিক শ্রেষ্ঠত্ব বা অর্জনের উপর ভিত্তি করে নয়। সর্ব-ইমাম আবূ হানীফা, মালিক, জুনায়েদ আল-বাগদাদী অথবা বায়েজীদ আল-বুস্তামী (রহমতুল্লাহি আলাইহিম)-এর মতো জ্ঞান, তাকওয়া বা কৃতিত্বই হোক না কেন, তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাহচর্যের মর্যাদার সমান হতে পারে না। [মি’য়্যার-এ-সাহা’বিয়্যাত, ২৭ পৃষ্ঠা]

তবু কেউ কেউ কোনো ওলী/দরবেশের পুতঃপবিত্রতা বা পাপশূন্যতার প্রশংসাকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে বিবেচনা করছে, অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর একজন সাহা’বী (রা.)-এর প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করাকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করছে। এটাকে কি সাহাবা (রা.)-বৃন্দের প্রতি সম্মান প্রদর্শন বলে?

সাইয়্যেদুনা আমীরে মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) সম্পর্কে বড়পীর শাইখ আবদুল ক্বা’দির জিলা’নী (রহমতুল্লাহি আলাইহি – বেসাল: ৫৬১ হিজরী) বলেন:

যদি আমি হযরত মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর (চলার) পথে বসতাম এবং আমীরে মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঘোড়ার খুরের ধুলো আমার উপর পড়তো, তাহলে আমি এটাকে আমার নাজাতের মাধ্যম মনে করতাম। [ইমদা’দ আল-ফাতা’ওয়া’, ৪র্থ খণ্ড, ১৩৩ পৃষ্ঠা]

অনুরূপভাবে, বড়পীর শাইখ আবদুল ক্বা’দির জিলা’নী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) হযরতে আসহাবে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীর মাঝে উদ্ভূত (ইজতিহাদী) মতপার্থক্য সম্পর্কে বলেন: 

وأما قتاله رضي الله عنه لطلحة والزبير وعائشة ومعاوية رضي الله عنهم فقد نص الإمام أحمد رحمه الله على الإمساك عن ذلك وجميع ما شجر بينهم من منازعة ومنافرة وخصومة ، كما قال عز وجل : وَنَزَعْنَا مَا فِي صُدُورِهِم مِّنْ غِلٍّ إِخْوَانًا عَلَى سُرُرٍ مُّتَقَابِلِينَ.

অর্থ: সর্ব-হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, তালহা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, যুবাইর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা এবং মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া প্রসঙ্গে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন: “সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের মধ্যে সংঘটিত সমস্ত (ইজতিহাদী) মতপার্থক্য, তর্ক-বিতর্ক ও বিরোধের ব্যাপারে চুপ থাকাই উত্তম। কেয়ামতের দিন, আল্লাহ তাঁদের মধ্যে ঘটে যাওয়া এই সমস্ত (ইজতিহাদী) মতপার্থক্য থেকে তাঁদের মুক্ত করবেন, যেমনটি আল্লাহ বলেন: “এবং আমি তাদের বক্ষসমূহের মধ্যে যা-কিছু হিংসা-বিদ্বেষ ছিলো সবই টেনে বের করে নিয়েছি, পরস্পর ভাই-ভাই, আসনসমূহের উপর মুখোমুখি হয়ে বসবে” {আল-ক্বুর’আন, ১৫/৪৭; নূরুল ইরফান}। [গুনইয়াতুত্ তা’লিবীন, ৭৭ পৃষ্ঠা]

সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু সেই সাহাবী যাঁর সম্পর্কে বড়পীর শাইখ মহিউদ্দীন আব্দুল কা’দির জিলানী রহমতুল্লাহি আলাইহি এমন অনুভূতি প্রকাশ করেছিলেন যে তিনি সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঘোড়ার ধুলাকেই তাঁর সৌভাগ্য ও নাজাতের জন্য যথেষ্ট মনে করতেন। শাইখ আব্দুল কা’দির জিলানী রাহিমাহুল্লাহ এমনকি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) মধ্যে মতপার্থক্য সম্পর্কে আলোচনা করতেও বাধা দিয়েছেন।

বর্তমানে কিছু মূর্খ লোক সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর ব্যাপারে বড়পীর শাইখ আব্দুল কা’দির জিলানী রাহিমাহুল্লাহর এই উপদেশ জানার পরও তাঁকে অপমান করে। বড়পীর শাইখ আব্দুল কা’দির জিলানী রাহিমাহুল্লাহ’র প্রতি গভীর ভালোবাসা রয়েছে বলে দাবি করা সত্ত্বেও এটি তারা করে থাকে। সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বিদ’আতী বলে চিহ্নিত করতে তারা মোটেও বিচলিত হয় না। তাহলে তারা কীভাবে আশা করতে পারে যে তাদের লেখনী বড়পীর শাইখ আব্দুল কা’দির জিলানী রাহিমাহুল্লাহ’কে খুশি করবে?

শাইখ আব্দুল কাদির আল জিলানী রাহিমাহুল্লাহ তাঁর দোয়ার শেষে নিম্নোক্ত দ্বিচরণ শ্লোক পাঠ করতেন:

ومن يترك الآثار قد ضل سعيه      وهل يترك الآثار من كان مسلما

যে ব্যক্তি ছেড়েছে পুণ্যাত্মা পূর্বসূরীদের পদাঙ্ক অনুসরণ, 

নিশ্চয় তার হয়েছে পথভ্রষ্টতার মন্দ পরিণতি বরণ,

কীভাবে কোনো মুসলমান পরিত্যাগ করতে পারেন পুণ্যাত্মা পূর্বসূরীদের অনুগমন? 

[ক্বালাঈদ আল-জওয়া’হির ফী মানা’ক্বিব-এ-আবদিল ক্বা’দির, ৪১ পৃষ্ঠা]

(ভাবানুবাদ)

না’ম ওয়া নাসাব শীর্ষক পুস্তকের লেখক এই অধ্যায়ে নতুন কোনো গবেষণা উপস্থাপন করেননি, বরং তিনি মওদূদী এবং শিয়াদের মতো তাঁরই অন্যান্য সমমনা রোল-মডেলের বই থেকে পূর্বের সমালোচনাগুলো নকল করেছেন। ইসলামের বুযূর্গ/জ্যেষ্ঠ আলেম-উলামা অনেক আগেই এসব সমালোচনার জবাব দিয়েছেন। [বঙ্গানুবাদকের নোট: দেখুন – মওলানা এম, এ, মান্নান সাহেবের রচিত ‘শিয়া ও মওদূদী মতবাদের পারস্পরিক সম্পর্ক’ বইটির পিডিএফ: https://www.mediafire.com/file/dd30mmtdcbzd71k/]

হাদীসে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে “হেদায়াত ও ধার্মিকতার নক্ষত্র” এবং আহলুল বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে “নাজাত ও সাফল্যের তরী” হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা বলেছেন তার আলোকে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত হযরতে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) এবং আহলে বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’বৃন্দের প্রশংসাকে একে অপরের জন্য (অবিচ্ছেদ্যভাবে) অপরিহার্য বলে মনে করে।

আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা’আত এ ব্যাপারে নিশ্চিত, যে ব্যক্তি আহলে বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’এর তরী থেকে নিজেকে দূরে রাখে সে গোমরাহীর সাগরে ডুবে যাবে। অনুরূপভাবে, যে ব্যক্তি আহলে বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’বৃন্দের জাহাজে আরোহণ করে কিন্তু সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’মণ্ডলীর নক্ষত্ররাজি থেকে হেদায়েতের আলো গ্রহণে বঞ্চিত হয়, সেও গোমরাহীর সাগরে ডুবে যাবে। সাগরে অন্ধকার আছে এবং তারকারাজির আভা ভ্রমণকারীদের পথপ্রদর্শনের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।

মিরকাত শিরোনামের মিশকাত গ্রন্থের শরাহ তথা ব্যাখ্যায় মোল্লা আলী ক্বারী রহিমাহুল্লাহ (বেসাল: ১০৪০ হিজরী) ইমাম ফখর আল-দীন আল-রাজী রাহিমাহুল্লাহ (বেসাল: ৬০৬ হিজরী)’এর এই বক্তব্যটি উদ্ধৃত করেছেন, যা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের স্বতন্ত্রতার চিহ্ন:

نحن معاشر أهل السنة بحمد الله تعالى ركبنا سفينة محبة أهل البيت واهتدينا بنجم هدي أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم فنـرجوا النجاة من أهوال القيامة ودركات الجحيم والهداية إلى ما يوجب درجات الجنان والنعيم المقيم.

অর্থ: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, আমরা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা’আত হযরতে আহলে বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’বৃন্দের ভালোবাসার জাহাজে আরোহণ করেছি এবং আমরা হযরতে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’মণ্ডলীর তারকারাজি দ্বারা (সঠিক পথে) পরিচালিত হয়েছি। সুতরাং, আমরা কিয়ামত দিবসের ভীতি এবং আগুনের খন্দক থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার আশাবাদী। আমরা সেই হেদায়েত লাভের ব্যাপারে আশাবাদী যা আমাদেরকে জান্নাতের স্তরগুলোর ও চিরস্থায়ী নেয়ামত-সমূহের যোগ্য করে তুলবে। [মিরক্বা’তুল মাফা’তীহ, ১০ খণ্ড, ৫৫৩ পৃষ্ঠা]

হাফিয ইবনে তাইমিয়া (মৃত্যু: ৭২৮ হিজরী) লেখেন:

وأما أهل السنة فيـتولون جميع المؤمنين، ويتكلمون بعلم وعدل، ليسوا من اهل الجهل ولا من أهل الأهواء ويتبرؤن من طريقة الروافض والنواصب جميعا ويتولون السابقين والأولين كلهم ويعرفون قدر الصحابة وفضلهم ومناقبهم ويرعون حقوق أهل البيت شرعها الله لهم.

অর্থ: আহলুস সুন্নাহ সকল মুমিনদের সাথে বন্ধুত্ব করেন এবং তাঁরা জ্ঞান ও ন্যায়ের শক্তিতে কথা বলেন। তাঁরা অজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত নন, আর যারা নিজেদের খায়েশের অনুসারী তাদেরও অন্তর্ভুক্ত নন। তাঁরা রওয়া’ফিদ ও নওয়া’সিব উভয়ের (ভ্রান্ত) পথ থেকে মুক্ত। তাঁরা সকল পূর্বসূরীদের প্রতি অতি উচ্চ শ্রদ্ধা রাখেন এবং সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের উচ্চ মর্যাদা, সম্মান ও গুণগত বৈশিষ্ট্য স্বীকার করেন। এসবের সাথে তাঁরা আহলুল বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীর অধিকার পূরণ করাকে অপরিহার্য মনে করেন, যেমনটি শরীয়ত হতে (দৃঢ়) প্রতিষ্ঠিত। [মিনহাজুস্ সুন্নাহ, ১ম খণ্ড, ১৬৫ পৃষ্ঠা]

এই অধম খেদমতগারের (মানে লেখকের) আধ্যাত্মিক শিক্ষক মওলানা ইঊসুফ লুধিয়্যানভী (ইনতিকাল: ১৪২১ হিজরী) বলেন:

আমি সকল আহলে বাইত ও সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন)-বৃন্দের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান করাকে ঈমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান মনে করি। তাঁদের কারো প্রতি সামান্যতম অসম্মান দেখানোকে আমি ঈমানের অবক্ষয়ের চিহ্ন হিসেবে গণ্য করি, যদি তা অনুমান করার মতোও হয়। এটা আমার দৃঢ় প্রত্যয় এবং আমি এই দৃঢ় প্রত্যয় নিয়েই আল্লাহর দরবারে হাজির হতে চাই। [এখতেলাফে উম্মাহ আওর সীরাতে মুসতাক্বীম, ২৪ পৃষ্ঠা]

ইমাম আল-রাজী (রাহিমাহুল্লাহ), হাফিজ ইবনে তাইমিয়া এবং মওলানা ইঊসুফ লুধিয়ানভী সাহেবের বক্তব্যগুলো স্বর্ণাক্ষরে লেখা যথার্থ। এই দিন এবং যুগে যখন ধার্মিক পূর্বসূরীদের অপমান করা একটি সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে, তখন এই বিবৃতিগুলো আগামী প্রজন্মের জন্য একটি নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করবে। আল্লাহ আমাদেরকে এমন অবস্থায় ইনতিক্বাল মঞ্জুর করুন যখন আমরা এই আকীদা ও আমলগুলোকে সুদৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারি।

আমি এর আরেকটি দিক উল্লেখ করতে চাই যা সম্পর্কে চিন্তা করার প্রয়োজন। যথা, যখনই এই ধরনের অভিযোগ বিভিন্ন রেফারেন্স দিয়ে খণ্ডন করা হয়, তখন নিম্নোক্ত দাবি উত্থাপন করা হয়:

এগুলো সবই কল্পকাহিনী এবং বিষবাষ্প যা খাওয়া’রিজদের বই থেকে চুরি করা হয়েছে এবং যা কোনো যুক্তিবাদী মানুষ মেনে নেবেন না। [না’ম ওয়া নাসাব, ৫৩৭ পৃষ্ঠা]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর একজন সাহাবী (রা.)-এর বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপিত হলে এই একই নীতি কেন মাথায় রাখা হয় না? কেন এই ধরনের সমালোচক কখনো বলেন না:

এগুলো সবই বানোয়াট কাহিনী এবং বিষবাষ্প যা শিয়াদের বই থেকে চুরি করা হয়েছে এবং যা কোনো যুক্তিবাদী মানুষ মেনে নেবেন না?

সাহাবায়ে কেরাম ও আহলে বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন)-মণ্ডলীর প্রতি এ দ্বিমুখী নীতি গ্রহণ করা হয়ে থাকে কেন? জনৈক কবি বলেন:

সে পর্দার আড়ালে কঠোর নির্জনতায় রয়েছে উপবিষ্ট,

কিন্তু নয়কো সে পুরোপুরি গুপ্ত, নয় দর্শন দানেও স্পষ্ট।

বিশেষ করে সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র ব্যাপারে বিশ্বাসযোগ্য তথ্যসূত্রের উপর নির্ভর করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর দুটি কারণ রয়েছে:

১/ – সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর বিরুদ্ধে প্রচুর অপপ্রচার তাঁর যুগে ইতিমধ্যেই শিকড় গেড়েছিলো। একবার কেউ একজন সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে জিজ্ঞেস করেন, “আপনি এতো তাড়াতাড়ি বুড়ো হয়ে গেলেন কেন?” তিনি উত্তর দেন:

كيف لا ولا ازال ارى رجلا من العرب قائما على رأسي يلقح لي كلاما ما يلزمني جوابه، فإن اصبت لم أحمد وإن أخطأت سارت بها البرود.

অর্থ: কেন এমন হওয়া উচিত নয় যখন একজন আরব লোক এখনো আমার মাথার উপর ক্রমাগত দণ্ডায়মান, যে এমন মিথ্যে বিষয় বানিয়ে চলেছে যার জন্য আমি জবাব দিতে বাধ্য? আমি সঠিকভাবে কিছু করলে কেউ তা স্বীকার করে না, আর আমি যদি ভুল করি তবে খবর সর্বত্র রটে বেড়ায়? [আল-বেদায়া ওয়ান্ নেহায়া, ৮ম খণ্ড, ১৪০ পৃষ্ঠা]

২/ – আব্বাসীয় খিলাফত শুরু হয় উমাইয়া খিলাফতের পর ১৩২ হিজরিতে (৭৪৯ খ্রি.)। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আবু আল-আব্বাস আল-সাফফাহ। তিনি এবং তাঁর উত্তরসূরীরা উমাইয়া খিলাফতকে উৎখাত করেছিলেন এবং বনূ উমাইয়াকে তাঁদের শত্রুতার একটি বিশেষ লক্ষ্যে পরিণত করেছিলেন। এমন কী তাঁরা বনূ উমাইয়ার বেশ কয়েকজন নেতার কবর খনন করার পর্যায়েও গিয়েছিলেন এবং উমাইয়া শাসক ও তাঁদের সমর্থকদের অনেক সন্তানকে বেছে বেছে হত্যা করেছিলেন। সুপরিচিত আব্বাসীয় খলিফা মা’মূন আর্ রশীদ একটি ঘোষণা জারি করেছিলেন:

برئت الذمة ممن ذكر معاوية بخير.

অর্থ: যে কেউ মু‘য়াবিয়ার পক্ষে কথা বল্লে তার ব্যাপারে আমরা দায়ী হতে পারি না। [দুওয়াল আল-ইসলাম, ১ম খণ্ড, ১২৯ পৃষ্ঠা]

শিয়া ইতিহাসবিদ মাস’উদী তাঁর ’মুরূজ আল-যাহাব’ গ্রন্থে এই দিকটি সম্পর্কে লিখেন:

وفي سنته اثنـتى عشرة ومائتين نادى منادى المأمون: برئت الذمة من أحد من الناس ذكر معاوية بخير أو قدمه (على أحد) من أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم.

অর্থ: হিজরী ২১২ সালে (আব্বাসীয় খলীফা) মা’মুনের মুখপাত্র ঘোষণা করেন: “যে ব্যক্তি মু’য়াবিয়াকে প্রশংসা সহকারে উল্লেখ করে বা তাঁকে অন্য কোনো সাহাবী (রা.)-এর চেয়ে উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন মনে করে, তার জন্য সরকার দায়ী নয়।” [মুরূজ-উয-যাহাব, ৪র্থ খণ্ড, ৪০ পৃষ্ঠা]

এটা ছিলো ইসলামী ইতিহাসের এমন একটি সময় যখন ইসলামী শিক্ষার বিভিন্ন মৌলিক বিদ্যাশাস্ত্র একত্রিত এবং নথিভুক্ত করা হচ্ছিলো। এই পরিবেশে ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যগুলোকে সঠিকভাবে নথিভুক্ত করা ঐতিহাসিকদের জন্য কতোখানি চ্যালেঞ্জপূর্ণ কাজ ছিলো তা যে কেউ কল্পনা করতে পারেন। তবে কিছু ব্যতিক্রম ছিলো। বিখ্যাত মওলানা শাহ মুঈনউদ্দীন নদভী লিখেন:

আব্বাসীয় খিলাফত যখন গঠিত হয়েছিলো তখনো তাঁরা বনূ উমাইয়াদের চিরশত্রু ছিলেন। আমীরে মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর যুগে বনূ উমাইয়াদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত আপত্তি আব্বাসীয়দের শাসনামল জুড়েই বেগ পেতে থাকে। বরং হৈচৈ আরো প্রবল হয়ে ওঠে এবং ততোক্ষণে আব্বাসীয় খিলাফত পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিস্তৃত হয়। এভাবে আমীরে মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর বিরুদ্ধে অভিযোগ মুসলিম সাম্রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। এই যুগটি ইসলামী ইতিহাস সংকলনের সূচনা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলো এবং বহু বানোয়াট বর্ণনা, যা দীর্ঘকাল ধরে মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত ছিলো, তা ঐতিহাসিক নথিপত্রে স্থান পেয়ে যায়।। যেহেতু এটা ইতিহাস লিপিবদ্ধকরণের সূচনা ছিলো, তাই যাচাইকরণের প্রক্রিয়াগুলো স্থাপন করা চ্যালেঞ্জপূর্ণ ছিলো, যা দ্বারা প্রামাণিক বর্ণনাগুলোকে বানোয়াটগুলো থেকে আলাদা করা যেতে পারতো। যাচাইকরণের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এমন অনেক বর্ণনা পরবর্তীকালে বাদ দেওয়া হয় যার একেবারে কোনো ভিত্তিই ছিলো না এবং যা স্পষ্টতই অযৌক্তিক ছিলো। তথাপিও অন্যান্য অসংখ্য ভুলভাবে প্রদত্ত ঘটনার বিবরণ এখনো ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। [সিয়্যারুস্ সাহাবা, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ৯৩-৯৪ পৃষ্ঠা]

আল-’আওয়াসিম মিনাল কাওয়াসিম গ্রন্থের লেখক মুহিব্বুদ্দীন আল-খতীব সাহেব (ইন্তিকাল: ১৩৯০ হিজরী) যিনি একজন সুপরিচিত গবেষক, তিনি বলেন:

إن التاريخ الإسلامي لم يبدأ تدوينه الاّ بعد زوال بني أمية و قيام دول لا يسر رجالها التحدث بمفاخر ذلك الماضى و محاسن أهله. فتولى تدوين تاريخ الإسلام ثلاث طوائف : طائفة كانت تنشد العيش والجدة من التقرب الى مبغض بني امية بما تكتبه و تؤلفه.

অর্থ: ইসলামী ইতিহাসের নথিপত্র লেখা শুরু হয় উমাইয়া খিলাফতের পতনের পর এবং সেই রাজবংশের সূচনাকালে যার নেতৃবর্গ অতীতের কৃতিত্ব এবং সেগুলোর অভিভাবকদের সততা নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। ইসলামী ইতিহাস সংকলন তিন শ্রেণীর লোক দ্বারা করা হয়েছিলো। প্রথমত, এমন কিছু লোক ছিলো যাদের আবেশ ছিলো বনু উমাইয়াদের প্রতি বিদ্বেষ ও শত্রুতা, আর এর পাশাপাশি তাঁদের শত্রু তথা আব্বাসীয় শাসকদের কাছ থেকে অনুগ্রহ লাভের জন্য তাঁদের (উমাইয়াদের) কৃতিত্বে ত্রুটি অন্বেষণ। [আল-’আওয়াসিম মিনাল-ক্বাওয়াসিম, পাদটীকা নং – ১৭৭]

মওলানা আবদুল শাকূর লক্ষ্ণৌভী (ইনতেকাল: ১৩৮৩ হিজরী)-এর পর্যবেক্ষণ এখানে উল্লেখযোগ্য, যা’তে তিনি সংক্ষিপ্ত ও যথাযথভাবে সাইয়্যিদুনা মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু’র সমালোচকদেরকে তিনটি দলে শ্রেণীবদ্ধ করেছেন:

হযরতে আমীরে মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর বিরুদ্ধে যারা হিংসা-বিদ্বেষ (অন্তরে) পোষণ করে তারা তিন ধরনের: প্রথমটি হলো রাওয়াফিয/রাফেযী শিয়া, যাদের বিদ্বেষ আশ্চর্যজনক নয়। তারা এমন মহৎ ব্যক্তিদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে যাঁদের সাথে উম্মাহর কারোরই তুলনা চলে না। দ্বিতীয় দল হলো গণ্ডমূর্থ সূফী-লেবাসধারী/ভণ্ড, যারা সাইয়্যেদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু সম্পর্কে খারাপ কথা বলাকে ‘হযরতে ইমামে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’-এর প্রশংসার চিহ্ন মনে করে। এই লোকেরা নিজেদেরকে সুন্নী বলে মনে করলেও বাস্তবে তারা এই বিষয়ে এবং অন্যান্য অনেক বিষয়ে আহলুস সুন্নাহ’র সাথে ভিন্নমত পোষণ করে, হোক তা নীতিগত বা নির্দিষ্ট। এটা প্রায়শই তাদেরকে শিয়া সম্প্রদায়ের অংশ হিসেবে উপস্থাপন করে। তৃতীয় দল হলো বর্তমানের জাহিরী (তথা আক্ষরিক/বাহ্যিক) অর্থ সমর্থকদের কেউ কেউ। কখনো কখনো তারা এমন রওয়ায়াত/বর্ণনার মাধ্যমে অনুধাবন করে যা হয়তো (দৃশ্যতঃ) সাইয়্যেদুনা আমীরে মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর সমালোচনা করতে পারে। তবে শাস্ত্রলিপির প্রতি তাদের আক্ষরিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাদের মস্তিষ্ক এর যথাযথ ব্যাখ্যার গভীরে ডুব দেয় না। সবচেয়ে ক্ষতিকর হলো দ্বিতীয় দলটি যারা অজ্ঞ সূফী-লেবাসধারী/তরীক্বতপন্থী তথা ভণ্ড। [ইযা’লাতুল খেফা, ১ম খণ্ড, ৫৭১ পৃষ্ঠা] {বঙ্গানুবাদকের নোট: বর্তমানে আমাদের দেশে ইরানী শিয়াদের পেট্রো-ডলারের মদদপুষ্ট হয়ে এমন ভণ্ড লোকেরা ফেইসবুক-কেন্দ্রিক অপপ্রচারে নিয়োজিত হয়েছে। এতে বিভিন্ন দরবারের আওলাদ ও মুরীদরাও এখন শরীকদার} 

এই প্রাথমিক আলোচনার পর আমরা এখন সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর বিরুদ্ধে উত্থাপিত মনগড়া অভিযোগগুলো খণ্ডনের প্রতি মনোনিবেশ করবো।

والأمر بيد الله تعالى وهو الموفق.

অর্থ: বিষয়টি (মানে এর মীমাংসা) আল্লাহর হাতে এবং তিনি (ভালো কাজ করার) সক্ষমতা/সামর্থ্য দেন।

সবশেষে, আমাদের এ আলোচনা শুরু করার আগে আমি (মওলানা জা’ফর ইকবাল) বলতে চাই:

তোমার সততা প্রমাণের জন্য কোরো না তাড়াহুড়ো; 

তোমার কোলের দিকে, আপন পরনের কোটের দিকে দেখো। [ভাবানুবাদ]

খিমা’র বারা’ বাঙ্কঈ বলেছেন:

তুমি করার আগে অন্যের সমালোচনা,

প্রথমে নিজের সামনে রেখো একখানা আয়না। [ভাবানুবাদ]

বনূ উমাইয়া সবচেয়ে ঘৃণ্য গোত্র মর্মে অভিযোগ

সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুকে হেয় প্রতিপন্ন ও তাঁর প্রতি কুৎসা রটনা করার অপপ্রয়াসে কিছু প্রাচ্যবিদ এমন কিছু ‘হাদীস’ উদ্ধৃত করেন যা বনূ উমাইয়ার পুরো গোত্র, যে বংশে এয়াযীদের জন্ম হয়েছিলো, তাকে অপমান করেছে। উদাহরণ স্বরূপ:

أهل بيتي سيلقون بعدي من أمتي قتلا و تشديدا وإن أشد قومنا لنا بغضا بنو أمية وبنو مخزوم. رواه الحاكم.

অর্থ: আমার পরিবার হত্যা এবং কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে এবং বনূ উমাইয়া ও বনূ মাখজূম আমাদের সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করবে। [না’ম ওয়া নাসাব, ৫১২ পৃষ্ঠা]

যেহেতু উপরোক্ত বর্ণনাটি মুস্তাদরাক আল-হাকিম পুস্তকে বর্ণিত হয়েছে, তাই তাঁরা এই বিষয়টির উপর জোর দিয়েছেন যে উপরোল্লিখিত বর্ণনাটি শিয়া নয়, বরং একজন ‘সুন্নী’ কর্তৃৃক বর্ণিত হয়েছে, যার বাস্তবতা আমরা সহসা স্পষ্ট করবো।

এই আপত্তির জবাব আমাদেরকে রিওয়ায়াহ (বর্ণনা) এবং দিরায়াহ (ব্যাখ্যা) দ্বারা দেওয়া উপযুক্ত, যার মাধ্যমে এই বর্ণনা – যা দাবি করে যে বনূ উমাইয়া সবচেয়ে ঘৃণ্য গোত্র ছিলো – তার বাস্তবতা স্পষ্ট করা হবে। অতঃপর প্রশ্ন করা হবে, এ ধরনের বর্ণনা কি গ্রহণ করা যাবে? এমন হওয়া কি উচিত নয় যে, যারা এ ধরনের বর্ণনা উদ্ধৃত করেন তাঁরাই সহীহ হাদীসের উপজীব্য? যেমন –

حَدَّثَنَا مَكِّيُّ بْنُ إِبْرَاهِيمَ، قَالَ حَدَّثَنَا يَزِيدُ بْنُ أَبِي عُبَيْدٍ، عَنْ سَلَمَةَ، قَالَ سَمِعْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ ‏ “‏ مَنْ يَقُلْ عَلَىَّ مَا لَمْ أَقُلْ فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ ‏”‏‏.‏

অর্থ: ‘যে ব্যক্তি আমার উপর এমন কথা আরোপ করে যা আমি বলিনি, সে যেনো জাহান্নামে তার ঠিকানা বানিয়ে নেয়।’ [সহীহ বুখারী, ১০৯ আন্তর্জাতিক নম্বর]

উপরন্তু, এটা কি ঐতিহাসিক সত্য ও সরল যুক্তির বিরোধী নয়? এই উভয় ক্ষেত্র বোঝার পরে কোনো আপত্তি আর থাকবে না, ইন-শা-আল্লাহ!

এ বিষয়টির উপর জোর দেওয়া হয়েছে, যে ব্যক্তি এটা বর্ণনা করেছে সে শিয়া নয়, বরং একজন খাঁটি সুন্নী। তবে যতোই জোর দেওয়া হোক না কেন, বাস্তবতা হলো দুঃখজনকভাবে এই যে, বইটির লেখক (আবূ আবদুল্লাহ আল-হাকিম আল- নিশাপুরী) যেখান থেকে এই বর্ণনাটি নেওয়া হয়েছে (মুস্তাদরাক আল-হাকিম), তিনি ছিলেন একজন শিয়া। আপনার যদি এ কথায় বিশ্বাস না হয়, তবে লিসা’ন আল-মিযা’ন বইটি অধ্যয়ন করুন যা ব্যক্ত করে::

هو شيعي مشهور.

অর্থ: সে কুখ্যাত এক শিয়া। [লিসা’নুল মিযা’ন, ৫ম খণ্ড, ২৩৩ পৃষ্ঠা]

হাফিজ আয-যাহাবী রাহিমাহুল্লাহ (ইন্তিকাল: ৭৪৮ হিজরী) একটি বর্ণনার অধীনে আল-হাকিম সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন:

قلت قبح الله رافضيا افتراه.

অর্থ: আমি বলি: আল্লাহ সেই রাফিযীর বিনাশ করুন, যে এ জাল হাদীস তৈরি করেছে। [মুসতাদরাক আল-হাকিম, ৩য় খণ্ড, ৩২ পৃষ্ঠা; এই জালিয়াতির জন্য দায়ী ফযল ইবনে মুহাম্মদ নামের এক ব্যক্তি]

এছাড়াও, বিখ্যাত শিয়া বর্ণনাকারীদের যাচাই-বাছাইকারক (শিয়াপন্থী) আইয়া’ন আল-শিয়া (৯ম খণ্ড, ৩৯১ পৃষ্ঠা) এবং আল-কুনা’ ওয়াল-আলক্কাব (২য় খণ্ড, ১৭০ পৃষ্ঠা) গ্রন্থগুলো আল-হাকিমের একটি জীবনী অন্তর্ভুক্ত করেছে।

স্পষ্টীকরণ

এই মুহূর্তে আমরা এ কথা পরিষ্কার করা প্রয়োজন মনে করি যে, কোনো বর্ণনাকে খণ্ডন করা সেটার বর্ণনাকারীকে কেবল শিয়া আখ্যায়িত করার ভিত্তিতে যথেষ্ট নয়। কেননা পূর্ববর্তী ও পরবর্তীকালের ইসলামী পণ্ডিতমণ্ডলীর (ব্যবহৃত) পরিভাষা অনুসারে, শিয়া হওয়ার সংজ্ঞায় বিভিন্নতা বিদ্যমান (তাহযীবুত্ তাহযীব, ১ম খণ্ড, ১১৮-৯ পৃষ্ঠা)। অতএব, পূর্ববর্তী আলেমবৃন্দের দ্বারা একজন বর্ণনাকারীকে শিয়া হিসেবে চিহ্নিত করা পরবর্তীকালের আলেমবৃন্দের সংজ্ঞার আলোকে বিবেচনা করা উচিত নয়।

আল-হাকিম নিঃসন্দেহে একজন শিয়া ছিলেন। তবে তাঁর যুগ থেকে আজ পর্যন্ত হাদীস বিশারদমণ্ডলী তাঁর বর্ণনাকে গ্রহণ করেছেন। এটাও উল্লেখ্য যে, ’মুসতাদরাক আল-হাকিম’ গ্রন্থের সব বর্ণনা একই স্তরের নয়, বরং এতে বিভিন্ন ধরনের বর্ণনা পাওয়া যায়। অতএব, হাদীস বিশারদবৃন্দের মতে, আল-হাকিমের সেসব বর্ণনাই গ্রহণ করা হবে যা হাফিজ আল-যাহাবী রাহিমাহুল্লাহ তাঁর ‘তালখীস আল-মুসতাদরাক’ পুস্তকে যাচাই-বাছাই করেছেন। এ কথা শাহ ‘আব্দুল ‘আযীয মুহাদ্দিস-এ-দেহেলভী রাহিমাহুল্লাহ (ইন্তিকাল: ১২৩৯ হিজরী) বলেছেন:

এ কারণেই হাদিস বিশারদমণ্ডলী ব্যাখ্যা করেছেন যে, আয-যাহাবীর ’তালখীস’ পুস্তকটি ছাড়া আল-হাকিমের ’মুসতাদরাক’ কিতাবের ওপর নির্ভর করা উচিত নয়। [’বুস্তান-এ-মুহাদ্দিসীন’, ১১৩ পৃষ্ঠা]

অতএব, ’যে ব্যক্তি এটা বর্ণনা করেছে সে শিয়া নয় বরং খাঁটি সুন্নী’ মর্মে এই জাতীয় দাবির অযৌক্তিকতা উন্মোচন করার জন্য আমরা এ বিষয়টি স্পষ্ট করলাম।

এবার ’মুস্তাদরাক আল-হাকিম’ গ্রন্থে বর্ণিত হাদীসের ইসনাদটি অধ্যয়ন করুন, যা নিম্নরূপ:

أخبرني محمد بن المؤمل بن الحسن حدثنا الفضل حدثنا نعيم بن حماد ثنا الوليد بن مسلم عن أبي رافع إسماعيل بن رافع عن أبي نضرة قال قال أبو سعيد الخدري قال رسول الله صلى الله عليه وسلم إن أهل بيتي سيلقون …الخ هذا حديث صحيح الإسناد ولم يخرجاه. مستدرك الحاكم، كتاب الفتن والملاحم.

হাফেয আল-যাহাবী (রহ.) এই হাদীস সম্পর্কে লেখেন:

لا والله ليس بصحيح كيف واسماعيل متروك ثم لم يصح السند إليه. أيضا

অর্থ: আল্লাহর কসম, এই বর্ণনাটি সহীহ (প্রমাণিত) নয়; এটা কীভাবে সহীহ হবে যেখানে ইসমাঈল মাতরূক (বাতিল/প্রত্যাখ্যাত)? তাছাড়া, ইসমাঈল পর্যন্ত বর্ণনার ইসনাদও সহীহ নয়। [বুস্তান আল-মুহাদ্দেসীন, ১১৩ পৃষ্ঠা]

আমরা উপরে উল্লেখ করেছি শাহ ‘আব্দুল ‘আযীয রহিমাহুল্লাহ’র রেফারেন্স দ্বারা এ মর্মে যে, মুসতাদরাক গ্রন্থের সেই বর্ণনাই গ্রহণ করা হবে যা হাফিজ আয্-যাহাবী রহিমাহুুল্লাহ কর্তৃৃক সত্যায়ন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে হাফিজ আয্-যাহাবী রাহিমাহুল্লাহ আল্লাহর নামে শপথ নিয়ে ঘোষণা করেন যে এই বর্ণনাটি সহীহ নয়।

এবার অন্য বর্ণনাকারীদের পরীক্ষা করা যাক:

বর্ণনাকারীদের ইসনাদের মধ্যে আল-ফাদল ইবনে মুহাম্মাদ আশ্ শা’রানী রয়েছে। হাদীসশাস্ত্র বিশারদ আল- কিতবা’নী বলেন সে একজন কাযযাব (মহা মিথ্যেবাদী)। মিজা’ন আল- ই’তিদা’ল বলেছে সে চরমপন্থী শিয়া। [মিযা’নুল ই’তিদা’ল, ৩য় খণ্ড, ৩৫৮ পৃষ্ঠা]

তাহলে একজন চরমপন্থী শিয়ার বর্ণনা কীভাবে মেনে নেয়া যায়? একজন খাঁটি সুন্নী (আলেম) এটা বর্ণনা করেছেন মর্মে এ দাবি কতোখানি (মারাত্মক) ভুল!

নুয়াইম ইবনে হাম্মাদ বর্ণনার ইসনাদে রয়েছে। তার নির্ভরযোগ্যতা ও দুর্বলতা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। ইবনে মাঈন রাহিমাহুল্লাহ বলেন, হাদীসে তার কিছুই নেই। ইমাম আবূ দাউদ রাহিমাহুল্লাহ বলেন সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এমন বিশটি হাদীস বর্ণনা করেছে যার কোনো ভিত্তি নেই। (খুব সম্ভব এই বর্ণনাটি সেগুলোর একটি – লেখক মওলানা জা’ফর ইক্ববাল)। ইমাম নাসাঈ রহিমাহুল্লাহ বলেন, সে দুর্বল। নুআইম ইবনে হাম্মাদ সুন্নাহকে শক্তিশালী করার জন্য হাদীস জাল করতো এবং সে ইমাম আবূ হানীফাহ রাহিমাহুল্লাকে হেয় করার জন্য কাহিনী বানাতো। এগুলোর সবই মিথ্যা ছিলো। [তাহযীবুত্ তাহযীব, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা – ৫২৬, ৫৩০]

ইমাম আবূ হানীফাহ রাহিমাহুল্লাহ’র এই শত্রু (আমাদের) প্রসিদ্ধ হযরত ইমামকে অপবাদ দেওয়ার জন্য যে মিথ্যা বর্ণনা করেছে তা তারই বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট হবে। আহলুস সুন্নাহর কোনো শালীন/আদবশীল অনুসারী কীভাবে (হযরত ইমামের বিরুদ্ধে) এই কুৎসা মেনে নিতে পারেন? [নোট: পরিচিত আহলে হাদীস সম্প্রদায়ের আলেম ইব্রাহীম মীর সিয়ালকোটি সাহেব ’মিজা’ন আল-ই’তিদা’ল,’ ’তাহযীব আত্-তাহযীব’ ও ‘নিহায়াত আল- সু’উল’ কিতাবগুলোর উল্লেখ করে নুআইম ইবনে হাম্মাদ কর্তৃক সমালোচনার উল্লেখ করার পর বলেন: “সারসংক্ষেপ হলো, নুয়াইম এমন একজন ব্যক্তিত্ব, যার (জাল) বর্ণনার ভিত্তিতে ইমাম আবূ হানীফাহ রহমতুল্লাহি আলাইহির মতো এমন মহান ব্যক্তিত্বকে নিন্দা করা যায় না। হাফিজ শামস আদ্-দীন আয্-যাহাবীর মতো (হাদীস) বর্ণনাকারীদের একজন পর্যালোচক তাঁকে (মানে ইমাম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি’কে) সম্মানজনক উপাধিসহ উল্লেখ করেছেন। এ কথা উল্লেখ করা উচিত যে, আহলে হাদীস সম্প্রদায়ের কোনো পণ্ডিত হযরত ইমাম আবূ হানীফাহ রাহিমাহুল্লাহ’র সমালোচনামূলক নুয়াইম ইবনে হাম্মাদের কোনো বর্ণনা গ্রহণ করেন না, তবুও বনূ উমাইয়া গোত্র যার মধ্যে রয়েছেন সর্ব-খলীফা উসমান ইবনে আফফান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও ‘উমর ইবনে ‘আব্দুল ‘আযীয রাহিমাহুল্লাহ’র মতো ব্যক্তিত্ব, তাকে কেউ কেউ ঘৃ্ণ্য ও ভীষণ অপছন্দনীয় ঘোষণা করতে ইচ্ছুক (তারীখ-এ-আহলে হাদীস, পৃষ্ঠা ৪৫)।”]

ওয়ালীদ ইবনে মুসলিমও এই বর্ণনার একজন রাবী/বর্ণনাকারী। সে মুদাল্লিস। [কারো কাছ থেকে বর্ণনা করার সময় তাঁকে যে ব্যক্তি গোপন করে বা বাদ দেয়, সেই মুদাল্লিস]

আবূ মুশীর রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন যে তিনি এমন কী মিথ্যেবাদী বর্ণনাকারীদেরও বাদ দেন। হাফিজ যাহাবী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন কেউ যখন “عن” (হতে) শব্দটি ব্যবহার করে বর্ণনা করে, তখন তার হাদীসের উপর নির্ভর করা যায় না। [মিযা’নুল ই’তিদা’ল, ৪র্থ খণ্ড, ৩৪৭ পৃষ্ঠা]

এতো সব ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও যদি এই বর্ণনাটিকে এখনো সহীহ বলে গণ্য করা হয়, তাহলে পৃথিবীর কোনো বর্ণনাকেই আর দুর্বল বা এমন কী বানোয়াটও বলা যাবে না!

একইভাবে, আল-হাকিম তাঁর মুস্তাদরাক গ্রন্থে সাইয়্যিদুনা আবূ বারযাহ আল-আসলামী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে আরেকটি রওয়ায়াত বর্ণনা করেছেন:

كان أبغض الأحياء إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم بنو أمية وبنو حنيفة وثقيف.

অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে সবচেয়ে ঘৃণ্য গোত্র ছিলো বনূ উমাইয়া, বনূ হানীফাহ ও বনূ সাকীফ।

অথচ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ তাঁর মুসনাদ গ্রন্থে সাইয়্যিদুনা আবু বারযাহ আল-আসলামী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে সমস্ত বর্ণনা এনেছেন, কিন্তু উপরের বর্ণনাটি উদ্ধৃত করার সময় বনূ উমাইয়ার কোনো উল্লেখ করা হয়নি। শুধু বনূ হানীফাহ ও বনূ সাকীফের কথা বলা হয়েছে। [মুসনাদে আহমদ, ৪র্থ খণ্ড, ৪২৮ পৃষ্ঠা]

এই বর্ণনায় বনূ উমাইয়াকে যুক্ত করার ক্ষেত্রে দায়ী কে?

এমন কী যদি আমরা এই বর্ণনাগুলোকে সহীহ বলেও মেনে নিই, তাহলেও এর অর্থ কখনোই এ হতে পারে না যে এই গোত্রের প্রত্যেকটি ব্যক্তিই অপছন্দনীয় ও হতভাগ্য। একইভাবে, কোনো নির্দিষ্ট গোত্র বা শহরের সাথে সম্পর্ক থাকার অর্থ কখনো এ হতে পারে যে এই শহরের বা গোত্রের প্রতিটি ব্যক্তিকে প্রিয় বলে মনে করা হবে। কুরাইশ ছিলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে সবচেয়ে প্রিয় গোত্র এবং মক্কা মুকাররামা ও মদীনা মুনাওয়ারাহ ছিলো তাঁর কাছে সবচেয়ে প্রিয় শহর। তবে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবু লাহাব, আবু জাহল এবং তাদের মতো অন্যদেরকে ভালোবাসতেন না, যদিও তারা কুরাইশদের মধ্য থেকেই ছিলো এবং মক্কা মুকাররামায় বসবাস করতো। একইভাবে মদীনা মুনাওয়ারায় ইহুদী ও মুনাফিকবর্গ বাস করতো, কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে অপছন্দ করতেন।

ইমাম ইবনে হাজর আল মক্কী রাহিমাহুল্লাহ (বোসাল: ৯৭৪ হিজরী) লিখেছেন:

أن هذا الاستنتاج أعنى قول المعترض فهو الخ دليل على جهل مستنجه وأنه لا دراية له بمبادئ العلوم، فضلا عن غوامضها، لأنه يلزم على هذه النتيجة لو سلمت أن عثمان وعمر بن عبد العزيز كليهما لا أهلية فيهما للخلافة وأنهما من الأشرار، وذلك خرق لإجماع المسلمين، والحاد في الدين… فبطلت تلك النتيجة وبان أن قائلها جاهل أو معاند فلا يرفع إليه رأس ولا يقال له وزن ولا يعبأ بما يلقيه ولا يعتد بما يبديه لقصور فهمه وتحقق كذبه ووهمه.

অর্থ: উত্তর হলো, হযরত মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু সম্পর্কে এই হাদীস থেকে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ বাস্তবে তাদেরই অজ্ঞতা প্রকাশ করে, যারা এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়। এটা ইঙ্গিত দেয় যে প্রাথমিক জ্ঞান সম্পর্কে তাদের বুঝ নেই, জ্ঞানের জটিল দিকগুলো তো বহু দূরে। কারণ এই সিদ্ধান্তের মানে হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং উমর ইবনে আবদিল আযীয রাহিমাহুল্লাহ খিলাফতের যোগ্য ছিলেন না। এছাড়াও এর মানে এই যে, (আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন) তাঁরা খারাপ লোকদের মধ্য থেকে ছিলেন। এটা মুসলমানদের ঐকমত্যের পরিপন্থী এবং স্পষ্ট ধর্মদ্রোহিতা। অতএব, এই সিদ্ধান্ত ভিত্তিহীন এবং যে ব্যক্তি এ কথা উচ্চারণ করে সে হয় অজ্ঞ নতুবা একগুঁয়ে। তার কথায় মনোযোগ দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই, কারণ তার উপলব্ধি কম এবং সে যে মিথ্যাবাদী তাও প্রতিষ্ঠিত। [তাতহীরুল জিনা’ন, ৩০-৩১ পৃষ্ঠা]

দিরা’এয়াহ (ব্যাখ্যা)

বর্ণনার ইসনাদ পর্যালোচনা করার পর, আমরা এখানে যোগ করতে চাই যে বনূ উমাইয়া যদি এমনই একটি ঘৃণ্য গোত্র হতো, তাহলে বনূ হাশিম কেন তাদের সাথে এতো ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখেছিলো? বিবাহের ক্ষেত্রে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও এ সম্পর্ক ছিলো কেন? কেন তাঁদের এতো উচ্চ ও মুখ্য পদসমূহ দেওয়া হয়েছিলো? এক্ষণে বনূ উমাইয়া ও বনূ হাশিমের মধ্যে কয়েকটি বৈবাহিক সম্পর্ক এবং বৈবাহিক আত্মীয়তা নেই এমন সংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ করা হবে।

বৈবাহিক সম্পর্ক

১/ – রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কন্যা সাইয়্যিদাহ রুকাইয়া রাদিয়াল্লাহু আনহাকে সাইয়্যিদুনা উসমান ইবনে আফফান আল-উমাবী রাদিয়াল্লাহু আনহুর সাথে বিবাহ দিয়েছিলেন। [উসদুল গাবাহ, ৩য় খণ্ড, ৬০৭ পৃষ্ঠা]

২/ – সাইয়্যিদা রুকাইয়া রাদিয়াল্লাহু আনহা-এর ইন্তেকালের পর, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর অপর কন্যা সাইয়্যিদাহ উম্মী কুলসূম রাদিয়াল্লাহু আনহাকে সাইয়্যিদুনা ‘উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহা’র সাথে বিয়ে দেন। [তাবাক্বাত ইবনে সা’আদ, ৮ম খণ্ড, ৩০-৩১ পৃষ্ঠা]

৩/ – সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর বোন সাইয়্যিদা উম্মী হাবীবা বিনতে আবি সুফিয়ান আল-উমাবি রাদিয়াল্লাহু আনহা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে বিবাহিত ছিলেন। [প্রাগুক্ত তাবাক্বাত ইবনে সা’আদ, ৮ম খণ্ড, ৭৭ পৃষ্ঠা]

৪/ – সাইয়্যিদুনা উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর নানী ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ফুফু। তাঁর নাম ছিলো উম্মী হাকিম আল-বায়দা বিনতে আবদিল মুত্তালিব ইবনে হাশিম ইবনে আবদিল মানাফ। [মুসতাদরাক আল-হাকিম, ৩য় খণ্ড, ৯৬ পৃষ্ঠা]

৫/ – সাইয়্যিদুনা উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর মাতা ও পিতার বংশানুক্রমে ষষ্ঠ ও পঞ্চম প্রজন্মের খান্দান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খান্দানের সাথে মিলিত হয়। [মুরূজ আল-যাহাব, ২য় খণ্ড, ৩৪১ পৃষ্ঠা]

৬/ – সাইয়্যিদুনা মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুই বোনকে বিয়ে করেছিলেন: উম্মুল মু’মিনীন উম্মী সালামা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা)-এর বোন ক্বারীবাহ আল-সুগরা (রা.) সাইয়্যিদুনা মুয়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু)-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। [আল-মুহবির, ১০২ পৃষ্ঠা]

৭/ – সাইয়্যিদুনা জা’ফর আল-তাইয়ার ইবনে আবি তালিব (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু)-এর নাতনী উম্মী কুলসুম (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা) ছিলেন সাইয়্যিদুনা ‘উসমান (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু)-এর ছেলের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ। [ইবনু ক্বুতায়বাহ কৃত ‘আল-মা’আরিফ,’ ৯০ পৃষ্ঠা]

৮/ – সাইয়্যেদুনা হুসাইন ইবনে আলী ইবনে আবি তালিব (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর কন্যা সাইয়্যেদাহ সাকিনাহ বিনতে হুসাইন (রাদিয়াল্লাহু আনহা) ছিলেন সাইয়্যিদুনা ‘উসমান ইবনে ‘আফফান (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর নাতী যায়েদ ইবনে ‘আমর ইবনে উসমান (রহ.)-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ। [তাবাক্বাত-এ-ইবনে সা’আদ, ৮ম খণ্ড, ৩৪৭ পৃষ্ঠা]

৯/ – সাইয়্যিদুনা হুসাইন (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর কন্যা সাইয়্যিদা ফাতিমা বিনতে হুসাইন ইবন ‘আলী ইবন আবি তালিব (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা) ছিলেন সাইয়্যিদুনা ‘উসমান (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু)-এর নাতী আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে উসমান (রা.)-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ। [প্রাগুক্ত তাবাক্বাত-এ-ইবনে সা’আদ, ৮ম খণ্ড, ৩৪৬ পৃষ্ঠা]

১০/ – সাইয়্যিদুনা হাসান (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর নাতনী সাইয়্যিদাহ উম্মী কাসিম বিনতে হাসান ইবন হাসান ইবন আলী ইবন আবি তালিব (রাদিয়াল্লাহু আনহা) ছিলেন সাইয়্যিদুনা উসমান ইবন আফফান (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর নাতী মারওয়ান ইবন আবা’ন ইবন উসমান (রাদ্বিয়াল্লাহু  আনহু)-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ। [জামহারাত আল-আনসা’ব আল-’আরব, ১ম খণ্ড, ৮৫ পৃষ্ঠা]

১১/ – হিন্দ বিনতে আবি সুফিয়ান আল-উমাবী (রা.) হযরত হারিস ইবনে নওফাল ইবনে আবদুল মুত্তালিব (রা.)-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, যিনি ছিলেন সাইয়্যিদুনা আলী ইবনে আবি তালিব (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর সন্তানদের একজন। [আল-ইসা’বাহ, ৮ম খণ্ড, ৩৪৫ পৃষ্ঠা]

১২/ – সাইয়্যিদুনা হুসাইন (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু)-এর পুত্র হযরত ‘আলী ইবনে হুসাইন ইবনে ‘আলী ইবনে আবি তালিব (রহ.)-এর মাতা হলেন মায়মুনাহ বিনতে আবি সুফিয়ান ইবনে হারব আল উমাবী (রা.)। আরেক কথায়, সাইয়্যিদুনা হুসাইন (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর শাশুড়ী হলেন মায়মুনা বিনতে আবি সুফিয়ান আল-উমাবী (রা.)। উনি কারবালার শহীদ আলী আল-আকবর (রাহিমাহুল্লাহ)-এর মাতামহী। [নসব ক্বুরাইশ, ৫৭ পৃষ্ঠা]

১৩/ – রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রিয় চাচাজান সায়্যিদুনা আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর নাতনী লুবাবা বিনতে ‘উবাইদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রহ.) হযরত আবূ সুফিয়ান আল-উমাবী (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর নাতী ওয়ালীদ ইবনে উতবাহ ইবনে আবি সুফিয়ান (রহ.)-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। [আল-মুহবির, ৪৪১ পৃষ্ঠা]

১৪/ – সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া আল-উমাবী (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর ভাগ্নে আবূল কাসিম ইবনে ওয়ালীদ ইবনে উতবাহ ইবনে আবি সুফিয়ান (রহ.) সাইয়্যিদুনা জা’ফর আল-তাইয়ার (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর নাতনী রামলাহ বিনতে মুহাম্মদ ইবনে জা’ফর ইবনে আবি তালিব (রহ.)-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। [আল-মুহবির, ৪৪১ পৃষ্ঠা]

১৫/ – সাইয়্যিদুনা হাসান (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর কন্যা সাইয়্যিদা নাফিসাহ বিনতে যায়েদ ইবনে হাসান ইবনে আলী ইবনে আবি তালিব (রহ.)-এর বিয়ে হয়েছিলো সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া আল-উমাবী (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর ভাগ্নে ওয়ালীদ ইবনে আবদিল মালিক ইবনে মারওয়ান ইবনে হাকাম ইবনে আবীল ‘আস ইবনে উমাইয়া (রহ.)-এর সাথে।[তাবাক্বাত-এ-ইবনে সা’আদ, ৫ম খণ্ড, ২৩৪ পৃষ্ঠা]

১৬/ – সাইয়্যিদুনা ‘আলী (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু)-এর কন্যা সাইয়্যেদাহ রমলাহ বিনতে ‘আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)-এর বিয়ে হয়েছিলো মারওয়ানের পুত্র মু’য়াবিয়া ইবনে মারওয়ান ইবনে হাকাম ইবনে আবীল-আস ইবনে উমাইয়ার সঙ্গে। [নসব ক্বুরাইশ, ৪৫ পৃষ্ঠা]

১৭/ – সাইয়্যিদুনা হাসান (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর নাতনী সাইয়্যেদাহ জয়নাব বিনতে হাসান ইবনে হাসান ইবনে আবী তালিব (রহ.)-এর বিয়ে হয়েছিলো মারওয়ানের নাতী ওয়ালীদ ইবনে আবদিল মালিক ইবনে মারওয়ানের সাথে। [নসব ক্বুরাইশ, ৫২ পৃষ্ঠা]

১৮/ – মারওয়ান আল উমাবীর ভাই ইসমাইল ইবনে আবদীল মালিক ইবনে হারিস ইবনে হাকাম ইবনে আবীল-আস ইবনে উমাইয়া বিয়ে করেছিলেন সাইয়্যিদুনা হাসান ইবনে আলী ইবনে আবী তালিব (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর নাতনী সাইয়্যেদাহ খাদিজা বিনতে হাসান ইবনে আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)-কে। [প্রাগুক্ত নসব ক্বুরাইশ, ১৭১ পৃষ্ঠা]

১৯/ – রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “আমার চল্লিশটি কন্যা থাকলেও আমি তাদেরকে উসমান (বিন আফফান)-এর সাথে পালাক্রমে বিয়ে দিতাম।” [উসদুল গাবাহ, ৩য় খণ্ড, ৩৭৬ পৃষ্ঠা; তারীখু ইবনু আসাকির, ৩৯ খণ্ড, ৪৩ পৃষ্ঠা]

খান্দান/বংশ এবং পারিবারিক সম্পর্কের এতোখানি দৃঢ় বন্ধন কি এমন একটি গোত্রের সাথে থাকতে পারে যাকে সবচেয়ে ঘৃণ্য বলে মনে করা হয়?

 বৈবাহিক আত্মীয়তা নেই এমন সংশ্লিষ্টতা ও গুণাবলী

১/ – সাইয়্যিদুনা উসমান ইবনে আফফান আল-উমাবী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) কাতিবে ওহী তথা ওহী লেখক ছিলেন।

২/ – সায়্যিদুনা উসমান ইবনে আফফান (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ছিলেন হক্ক তথা সত্য-সঠিক তৃতীয় খলীফা।

৩/ – সাইয়্যিদুনা ‘উসমান (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু)-এর কারণে ১৪০০ জন সাহাবা (রা.) আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করেছিলেন।

৪/ – সাইয়্যিদুনা উসমান ইবনে আফফান (রাদিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর স্ত্রী সায়্যিদাহ রুকাইয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহা)-এর সেবাযত্নে উপস্থিত থাকার কারণে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি; তবুও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে গণ্য করেন এবং তাঁকে গনীমতের মালের একটি অংশ দান করেন। [আল-বুখারী, ১ম খণ্ড, ৫২২ পৃষ্ঠা; আন্তর্জাতিক নম্বর ৪০৬৬ – وَأَمَّا تَغَيُّبُهُ عَنْ بَدْرٍ فَإِنَّهُ كَانَ تَحْتَهُ بِنْتُ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَكَانَتْ مَرِيضَةً، فَقَالَ لَهُ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم: إِنَّ لَكَ أَجْرَ رَجُلٍ مِمَّنْ شَهِدَ بَدْرًا وَسَهْمَهُ]

৫/ – তাবুকের যুদ্ধের সময় সাইয়্যিদুনা ‘উসমান (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) সেনাবাহিনীর প্রস্তুতির জন্য প্রচুর সম্পদ দান করেছিলেন এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছিলেন – ما ضر عثمان ما عمل بعد هذا اليوم – অর্থ: “আজকের পরে উসমান (আল-উমাবী) যা করবে, তাতে তার কোনো ক্ষতি হবে না।” [মোস্তাদরাকে হাকিম, ৪৫৫৩; তবে অন্য বর্ণনাকারীবৃন্দ হলেন সর্ব-ইমাম আহমদ, ২০৬৩০; ইমাম তিরমিযী, ৩৭০১ -مَا ضَرَّ ابْنُ عَفَّانَ مَا عَمِلَ بَعْدَ الْيَوْمِ يُرَدِّدُهَا مِرَارًا]

৬/ – হুদায়বিয়ার সন্ধি উপলক্ষে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হযরত উসমান (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-কে তাঁর দূত হিসেবে মক্কা মুকাররমায় পাঠান। [বুখারী, ৪০৬৬; আন্তর্জাতিক নম্বর]

৭/ – এ উপলক্ষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তাঁর হাতটি উসমান (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর হাত। [বুখারী, প্রাগুক্ত ৪০৬৬ – فَقَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم بِيَدِهِ الْيُمْنَى هَذِهِ يَدُ عُثْمَانَ]

৮/ – মক্কা মুকাররামা বিজয় উপলক্ষে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছিলেন যে আবূ সুফিয়ান আল-উমাবী (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর ঘর একটি নিরাপদ স্থান। [মুসলিম শরীফ, ২য় খণ্ড, ১০৪ পৃষ্ঠা; 1780c আন্তর্জাতিক নম্বর – مَنْ دَخَلَ دَارَ أَبِي سُفْيَانَ فَهُوَ آمِنٌ‏]

৯/ – হুনাইনের যুদ্ধের সময় যখন অমুসলিম বন্দীদের পাহারা দেওয়ার প্রয়োজন ছিলো, তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবূ সুফিয়ান আল-উমাবী (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-কে তাদের পাহারা দেওয়ার জন্য নিযুক্ত করেছিলেন। [মুসান্নাফ-এ-আবদির রাযযাক্ব, ৫ম খণ্ড, ৩৮১ পৃষ্ঠা] 

১০/ – যখন নাজরান জয় করা হয়, তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবূ সুফিয়ান আল-উমাবী (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-কে দাতব্য দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, গভর্নর ও নেতা নিযুক্ত করেন। [সুনানে দারু কুতনী, ৪র্থ খণ্ড, ১৬ পৃষ্ঠা]

১১/ – বনূ সাকীফ যখন ইসলাম গ্রহণ করে, তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের মূর্তি ধ্বংস করার জন্য মুগীরাহ ইবনে শুবা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এবং আবূ সুফিয়ান আল-উমাবী (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-কে পাঠান। [আল-বেদায়াহ ওয়ান্ নেহায়াহ, ৫ম খণ্ড, ৩০-৩৩ পৃষ্ঠা]

১২/ – ইয়াযীদ ইবনে আবি সুফিয়ান আল-উমাবী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ওহী-লেখক ছিলেন। [জওয়ামিউল-সীরাহ, ২৬ পৃষ্ঠা]

১৩/ – রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাইয়্যিদুনা ইয়াযীদ ইবনে আবি সুফিয়ান (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-কে তীমা’ এলাকার গভর্নর/প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন। [আল-মুহবির, ১২৬ পৃষ্ঠা]

১৪/ – রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাইয়্যিদুনা ইয়াযীদ ইবনে আবি সুফিয়ান (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-কে বনূ ফিরাস গোত্রের দাতব্য দপ্তরের দায়িত্বে নিযুক্ত করেছিলেন। [আল-ইসা’বাহ, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ৫১৬ পৃষ্ঠা]

১৫/ – রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর মেহমানদের সাথে দেখা করতে আসা প্রতিনিধি দলগুলো সাইয়্যিদুনা ইয়াযীদ ইবনে আবী সুফিয়ান (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর বাড়িতে অবস্থান করতো। [তাবাকাত ইবনে সা’আদ, ৭ম খণ্ড, ১৪৯ পৃষ্ঠা]

১৬/ – সাইয়্যেদুনা মু’য়াবিয়াহ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) একজন কাতিবে ওহী ছিলেন। [জওয়া’মিউস্ সীরাহ, ৪৭ পৃষ্ঠা]

১৭/ – রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-কে জমির অংশসমূহ নির্ধারণের জন্য প্রেরণ করেন। [ইমাম বুখারী কৃত আত্ তারীখুল কবীর, ৪র্থ খণ্ড, ১৭৫ পৃষ্ঠা]

১৮/ – সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হযরত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পবিত্র চুল মোবারক কাটার সম্মান পেয়েছিলেন।

১৯/ – রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাইয়্যিদুনা ঈতা’ব ইবনে উসাইদ আল-উমাবী (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-কে মক্কা মুকাররামার গভর্নর নিযুক্ত করেছিলেন।

২০/ – সায়্যিদুনা খালিদ ইবনে সাঈদ আল-উমাবী (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগে বনূ মাযহাজের দাতব্য বিভাগের দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়েছিলো এবং তিনি সানা ও ইয়েমেনের গভর্নর ছিলেন।

২১/ – রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রথমে সাইয়্যিদুনা আবা’ন ইবনে সাঈদ ইবনুল্ আস আল-উমাবী (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-কে সুরায়ার গভর্নর নিযুক্ত করেন এবং পরে বাহরাইনের গভর্নর নিযুক্ত করেন। [মিনহাজুস্ সুন্নাহ, ৩য় খণ্ড, ১৭৫, ১৭৬ পৃষ্ঠাগুলো]

২২/ – উসমান ইবনে আবিল্ আস তায়েফ ও আশেপাশের এলাকার গভর্নর নিযুক্ত হন। [তাহযীব আত্ তাহযীব, ৫ম খণ্ড, ৪৯১ পৃষ্ঠা]

আমার তরফ থেকে ওপরে পেশকৃত এই বাইশটি রেফারেন্স-ই যথেষ্ট এবং আমি (এক্ষণে) জিজ্ঞাসা করি: কেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে সবচেয়ে অপছন্দনীয় ও ঘৃণিত গোত্রটি তাঁরই দ্বারা এমন কর্তৃত্বের পদে ভূষিত হয়েছিলো? সংক্ষেপ করার খাতিরে আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে সর্ব-হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এবং উমর ফারূক্ব (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর খিলাফতকালে তাঁদের (উমাইয়া নেতৃবৃন্দের) সেবা ও অবস্থান উল্লেখ করিনি। ইবনে তাইমিয়া বলেন:

وكان بنو امية اكثر القبائل عمالا للنبي صلى الله عليه وسلم.

অর্থ: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক নিযুক্ত অধিকাংশ গভর্নর/প্রাদেশিক শাসনকর্তা ছিলেন বনূ উমাইয়া গোত্রের। [মিনহাজুস্ সুন্নাহ, ২য় খণ্ড, ১৪৫ পৃষ্ঠা]

হযরত আবূ বকর ইবনুল আরবী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) লেখেন:

وعجبا لاستكبار الناس ولاية بني أمية، وأول من عقدهم الولاية رسول الله صلى الله عليه وسلم.

অর্থ: এটা লক্ষ্য করে অবাক হতে হয় যে, লোকেরা বনূ উমাইয়ার শাসন সম্পর্কে (নিজেদের) নাক সিটকায়, অথচ প্রথম যিনি তাঁদেরকে নেতৃত্বে নিযুক্ত করেছিলেন তিনি খোদ/স্বয়ং আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। [আল-আওয়া’সিম মিনাল-ক্বাওয়া’সিম, ২৩৪ পৃষ্ঠা]

ইবনে তাইমিয়া (আরো) লিখেছেন:

أن بني أمية كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يستعملهم في حياته واستعملهم من بعده من لا يتهم بقرابة فيهم أبو بكر الصديق رضي الله عنه وعمر رضي الله عنه.

অর্থ: তাঁর (প্রকাশ্য) জীবদ্দশায় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বনূ উমাইয়া গোত্র হতে অনেককে গভর্নর নিযুক্ত করেছিলেন এবং তাঁর (বেসাল হওয়ার) পরে সর্ব-হযরত আবূ বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এবং উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) তাঁদেরকে উচ্চ পদে নিযুক্ত করেছিলেন এবং তাঁদের বিরুদ্ধে বনূ উমাইয়্যার সাথে কোনো পারিবারিক সংশ্লিষ্টতার তথা আত্মীয়তার সম্পর্কের অভিযোগ ছিলো না। [মিনহাজুস্ সুন্নাহ, ৩য় খণ্ড, ১৭৫ পৃষ্ঠা]

বিখ্যাত ঐতিহাসিক মওলানা শাহ মুঈনউদ্দীন নদভী সাহেব বনূ উমাইয়াকে শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছেন:

বনূ উমাইয়া ছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে সুপুরুষ, যার সাক্ষ্য দেয় খলীফা উসমান (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) এবং হযরত মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু)-এর শাসনামলের বিজয়গুলো। রোমান সাগর পাড়ি দেন সর্বপ্রথম বনূ উমাইয়া; তাঁরা আফ্রিকা জয় করেছিলেন এবং ইউরোপের দরজায় কড়া নেড়েছিলেন। বনূ উমাইয়া এগিয়ে যান নি (কেবল) আমীরে মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু) তাঁদের পরিবারসদস্য হওয়ার কারণে, বরঞ্চ তাঁরা এগিয়ে গিয়েছিলেন তরবারির ওস্তাদ ও যুদ্ধের ময়দানে সুপুরষ হওয়ার দরুন। এ কারণেই বনূ উমাইয়্যার যুগে যেসব বিজয় সংঘটিত হয়েছিলো তা তৎপরবর্তী ইতিহাসে আর দেখা যায়নি। [সিয়্যারুস্ সাহাবাহ, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ১২৭ পৃষ্ঠা]

সম্মানিত পাঠক, আপনি হযরত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), সর্ব-খলীফা আবূ বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু), ‘উমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) এবং বনূ উমাইয়াদের মধ্যকার সম্পর্কগুলো প্রমাণসহ অধ্যয়ন করেছেন। বনূ হাশেম গোত্রের সাথে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কেমন আচরণ করেছিলেন? পড়ুন (তাহলে) হাকিম মাহমূদ আহমদ জা’ফর কী বলেছেন:

পক্ষান্তরে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর (প্রকাশ্য) জীবদ্দশায় হাশিমী গোত্রভুক্ত কাউকে কোনো প্রদেশের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেননি; তিনি তাঁদের কাউকে সেনাবাহিনীর অধিনায়ক পদেও নিযুক্ত করেননি। তাঁর (প্রকাশ্য) জীবনের শেষ সময়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হযরত ‘আলী (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু)-কে অল্প সময়ের জন্য ইয়েমেনে সংগ্রাহক/কালেক্টর নিযুক্ত করেছিলেন। তবে (সেখানে) সর্বোচ্চ নেতৃত্বের পদ দেওয়া হয়েছিলো সর্ব-হযরত আবূ মুসা আল-আশআরী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এবং মু’আয ইবনে জাবাল (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-কে। [হিলইয়াতুল আউলিয়া, ১ম খণ্ড, ৩৫৪ পৃষ্ঠা; মাদা’রিজুন্ নুবূওয়াত, ৫০২ পৃষ্ঠা; যুরক্বানী, ৩য় খণ্ড, ৯৯ পৃষ্ঠা; মুসনাদ-এ-আহমদ হাম্বল, ৫ম খণ্ড, ২৩৫ পৃষ্ঠা]

তাছাড়া, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগের পুরো ইতিহাস অধ্যয়ন করুন এবং তাতে বনূ হাশিমের সাথে রক্তের সম্পর্কযুক্ত এমন একজন গভর্নরকেও আপনি খুঁজে পাবেন না। প্রকৃতপক্ষে বনূ হাশিমের কেউ কেউ নেতৃত্বের পদে নিযুক্ত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তা গ্রহণ করেননি। এ কারণেই রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দুনিয়াবী জীবনের সায়াহ্নে সাইয়্যিদুনা আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) সায়্যিদুনা আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-কে বলেছিলেন:

حَدَّثَنِي إِسْحَاقُ، أَخْبَرَنَا بِشْرُ بْنُ شُعَيْبِ بْنِ أَبِي حَمْزَةَ، قَالَ حَدَّثَنِي أَبِي، عَنِ الزُّهْرِيِّ، قَالَ أَخْبَرَنِي عَبْدُ اللهِ بْنُ كَعْبِ بْنِ مَالِكٍ الأَنْصَارِيُّ ـ وَكَانَ كَعْبُ بْنُ مَالِكٍ أَحَدَ الثَّلاَثَةِ الَّذِينَ تِيبَ عَلَيْهِمْ أَنَّ عَبْدَ اللهِ بْنَ عَبَّاسٍ أَخْبَرَهُ أَنَّ عَلِيَّ بْنَ أَبِي طَالِبٍ ـ رضى الله عنه ـ خَرَجَ مِنْ عِنْدِ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فِي وَجَعِهِ الَّذِي تُوُفِّيَ فِيهِ، فَقَالَ النَّاسُ يَا أَبَا حَسَنٍ، كَيْفَ أَصْبَحَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ أَصْبَحَ بِحَمْدِ اللهِ بَارِئًا، فَأَخَذَ بِيَدِهِ عَبَّاسُ بْنُ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ، فَقَالَ لَهُ أَنْتَ وَاللهِ بَعْدَ ثَلاَثٍ عَبْدُ الْعَصَا، وَإِنِّي وَاللهِ لأُرَى رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم سَوْفَ يُتَوَفَّى مِنْ وَجَعِهِ هَذَا، إِنِّي لأَعْرِفُ وُجُوهَ بَنِي عَبْدِ الْمُطَّلِبِ عِنْدَ الْمَوْتِ، اذْهَبْ بِنَا إِلَى رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَلْنَسْأَلْهُ فِيمَنْ هَذَا الأَمْرُ، إِنْ كَانَ فِينَا عَلِمْنَا ذَلِكَ، وَإِنْ كَانَ فِي غَيْرِنَا عَلِمْنَاهُ فَأَوْصَى بِنَا‏.‏ فَقَالَ عَلِيٌّ إِنَّا وَاللهِ لَئِنْ سَأَلْنَاهَا رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَمَنَعَنَاهَا لاَ يُعْطِينَاهَا النَّاسُ بَعْدَهُ، وَإِنِّي وَاللهِ لاَ أَسْأَلُهَا رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم‏. 

“ওহে আলী! আল্লাহর কসম, তিন দিন পর তোমাদের ওপর (শাসন করতে) অন্য একজন শাসক আসবেন এবং তোমরা তাঁরই প্রজা হবে। আল্লাহর কসম, আমি অনুভব করছি, এই অসুস্থতায় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বেসাল-প্রাপ্ত হবেন। অতএব, এটা সবচেয়ে ভালো হবে যদি আমরা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছ থেকে জানতে চেষ্টা তাঁর পরে খলীফা কে হবেন। যদি আমাদের (মানে বনূ হাশিম গোত্রের) পক্ষ থেকে হন, তবে আমরা জানতে পারবো, অন্যথায় তিনি আমাদের (করণীয়ের) পক্ষে অসীয়ত/অন্তিম উপদেশ প্রদান করবেন।”

হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) এ কথায় উত্তর দেন: 

“এটা সম্ভব যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের প্রত্যাখ্যান করবেন এবং আমরা চিরতরে বঞ্চিত হবো। আল্লাহর কসম, আমি তাঁকে এ বিষয়ে একটি কথাও বলবো না।” [বুখারী, মুসনাদে আহমদ, আল-বেদায়াহ ওয়ান্ নেহায়াহ]

মোটকথা, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগে বনূ উমাইয়া গোত্র হতেই বেশিরভাগ গভর্নর/প্রাদেশিক শাসনকর্তা ওই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং বনূ হাশিমের মধ্যে একজনকেও গভর্নর করা হয়নি; অথচ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর চাচা সাইয়্যেদুনা আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ও তাঁর চাচাতো ভাই সাইয়্যিদুনা আকীল ইবনে আবি তালিব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এবং সাইয়্যিদুনা আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-সহ আরো অনেকে উপস্থিত ছিলেন। সরকারি পদগুলো কিন্তু একটা বিষয়; রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ২৮ বার যুদ্ধের জন্য মদীনা মুনাওয়ারাহ ত্যাগ করেছিলেন, অথচ একটি বারও তিনি বনূ হাশিম থেকে কোনো ডেপুটি/ভারপ্রাপ্ত সহকারী শাসক নিয়োগ করে যাননি। প্রকৃতপক্ষে, তিনি কখনো বনূ উমাইয়া থেকে একজন প্রতিনিধি আবার কখনো মদীনার একজন আনসারী সাহাবীকে নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি কখনো কখনো একজন মাখযূমীকেও নিয়োগ করতেন, কখনো কখনো এমন কী একজন কালবী অথবা গাফা’রীকেও নিযুক্ত করতেন। তাবুকের যুদ্ধের সময় প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাইয়্যিদুনা ‘আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-কে তাঁর ডেপুটি/সহকারী নিযুক্ত করেছিলেন, কিন্তু তিনি মদীনা মুনাওয়ারার ডেপুটি এবং গভর্নর ছিলেন না, বরং তাঁকে পরিবারগুলোকে দেখাশোনার জন্যই রেখে যাওয়া হয়েছিলো। সেই ঘটনা উপলক্ষে মদীনা মুনাওয়ারায় ডেপুটি/ভারপ্রাপ্ত সহকারী ছিলেন হযরত মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা আল-আনসারী (রাদিয়াল্লাহু আনহু)। [তাবাক্বাত ইবনে সা’আদ, ১ম খণ্ড, ১১৯ পৃষ্ঠা]

এক্ষণে বনূ উমাইয়ার মর্যাদাগত অবস্থান বর্ণনা ও ব্যাখ্যার মাধ্যমে স্পষ্ট করা হয়েছে এবং ইতিহাসে বিরাজমান তথ্যগত ভুলভ্রান্তিও প্রকাশ করা হয়েছে; আমরা নিচে মুহাদ্দিসীনবৃন্দের কয়েকটি বক্তব্য উল্লেখ করছি যা এই ধরনের বর্ণনার অবস্থার প্রতি আলোকপাত করেছে। ইবনে কাইয়্যিম জওযিয়্যা (ইন্তিক্বাল: ৭৫১ হিজরী) লিখেছেন:

ومن ذلك الأحاديث في ذم معاوية رضي الله عنه وكل حديث في ذمه فهو كذب وكل حديث في ذم بني امية فهو كذب.

অর্থ: বানোয়াট বর্ণনার মধ্যে হযরত মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-কে ছোট করেছে এমন হাদীস এবং তাঁকে নিন্দাকারী প্রতিটি হাদীস মিথ্যা এবং বনূ উমাইয়া গোত্রকে ছোট করেছে এমন প্রতিটি হাদীসও মিথ্যা। [আল-মানা’রুল মুনীফ, ১১০ পৃষ্ঠা]

মুল্লা ‘আলী কারী আল হানাফী রাহিমাহুল্লাহ (ইন্তিক্বাল: ১০১৪ হিজরী) বলেছেন:

ومن ذلك الأحاديث في ذم معاوية …وذم بني أمية.

অর্থ: এসব বর্ণনার মধ্যে বানোয়াট ওইগুলো, যা’তে হযরতে মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এবং বনূ উমাইয়াকে গালিগালাজ করা হয়েছে। [আল-মওযু’আত, ১০৬ পৃষ্ঠা]

সাইয়্যেদুনা আলী আল-মুর্তদা (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) ও বনূ উমাইয়া

বনূ উমাইয়ার প্রশংসায় সাইয়্যিদুনা ‘আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিম্নোক্ত বক্তব্যগুলো অধ্যয়ন করুন:

عن ابن سيرين قال قال رجل لعلي أخبرني عن قريش قال ارزننا احلاما اخوتنا بني أمية.

অর্থ: ইবনে সিরীন থেকে বর্ণিত আছে যে, এক ব্যক্তি হযরতে ইমামে আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-কে বললেন, ’আমাকে কুরাইশদের সম্পর্কে বলুন।’ হযরত আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) উত্তরে বললেন: “সহনশীলতার দিক থেকে আমাদের ভাই বনূ উমাইয়া গোত্র এগিয়ে আছেন।”

বর্ণিত আছে যে, তিনি (হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) আরো বলেছেন:

فقال وأما بنو امية فقادة، أدبة ذادة.

অর্থ: আর বনূ উমাইয়া গোত্র হচ্ছেন নেতৃত্বদাতা, তাঁরা উদার এবং তাঁরা সমর্থনদাতা ও রক্ষাকারী। [প্রাগুক্ত আল-মওযু’আত, ১১তম খণ্ড, ৫৭ পৃষ্ঠা]

আলোচনার সারাংশ

সংক্ষেপে, সাইয়্যিদুনা ইমামে ‘আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর বক্তব্য ও কাজগুলো স্পষ্ট করে যে বনূ উমাইয়া এক স্বীকৃত/গৃহীত, সমর্থনকারী, নেক এবং প্রিয়ভাজন গোত্র। যেসব বর্ণনায় বনূ উমাইয়াকে ঘৃণ্য ও অপছন্দনীয় বলা হয়েছে তা মুহাদ্দিসীনদের মতে সহীহ নয়। অতএব, যারা এই বানোয়াট বর্ণনাগুলোর উপর নির্ভর করে বনূ উমাইয়াকে একটি ঘৃণ্য ও প্রত্যাখ্যাত গোত্র বলায় অবিচল থাকে, তাদের আমরা বলি:

ভারসাম্যপূর্ণ প্রকৃতি ও বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন কোনো ব্যক্তি একটি বিশদ অধ্যয়ন থেকে বনূ উমাইয়ার মর্যাদাগত অবস্থান নির্ধারণ করতে সক্ষম হবেন। এরপরও কোনো সন্দেহের উদ্রেক হলে, যদিও আমরা আমাদের নিজস্ব মতামত হতে এখানে কিছু বলিনি, তবু যারা বনূ উমাইয়াকে ঘৃণার চোখে দেখে, আমরা তাদের হেদায়েতের জন্য আন্তরিকভাবে (আল্লাহর দরবারে) প্রার্থনা করি।

কোনো ফযীলত/গুণগত মাহাত্ম্য ধারণ না করার অভিযোগ:

সাইয়্যিদুনা মুয়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর সমালোচকবর্গ তাঁর ফযীলত সম্পর্কে ইসহাক ইবন রাহাওয়াইহ (রহিমাহুল্লাহ)-এর বক্তব্য নিয়ে অনেক হৈচৈ করে। এর আলোকে তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর ফযীলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে ‘সহীহ’ কিছুই বর্ণিত হয়নি।

সহীহ আল-বুখারীর ভাষ্যকার ইবনে হাজর আল-আসকালানী (রাহিমাহুল্লাহ) লিখেছেন:

ইসহাক ইবনে রাহাওয়াইহ থেকে নিম্নোক্ত বর্ণনাটি এসেছে – 

لم يصح في فضائل معاوية شيء.

অর্থ: মু’য়াবিয়ার ফযীলত/গুণগত মাহাত্ম্য প্রমাণ করে এমন কোনো সহীহ বর্ণনা নেই।

বর্ণিত হয়েছে যে, ইমাম নাসায়ী (রাহিমাহুল্লাহ)-ও এ কথার সাথে একমত পোষণ করেছেন এবং হাফিজ আস্ সুয়ূতী (রাহিমাহুল্লাহ)-ও। [না’ম ওয়া নাসাব, ৫১৪-৫১৫ পৃষ্ঠা]

ভুল ধারণার অপনোদন 

আহলে বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের গুণাবলীর উল্লেখ এবং তাঁদের প্রতি ভালোবাসা ও অনুরাগ প্রদর্শনের প্রসঙ্গে, আহলুস সুন্নাহ কখনোই তাঁদের ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেননি এবং সর্বদা তাঁদের ভালোবাসা এবং সম্মান করাকে আমাদের (ধর্মীয়) বিশ্বাসের একটি মূলনীতি বলে মনে করেছেন। আহলুল্ বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের প্রতি ভালোবাসা সর্বদাই গর্বের বিষয় এবং আহলুস সুন্নাহর অনুসারীদের দ্বারা পরিত্রাণের উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। আহলুস সুন্নাহর বইগুলো শুধুমাত্র আহলুল বাইত তথা সর্ব-হযরত আলী, ফাতিমা, হাসান ও হুসাইন (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের গুণাবলীর প্রতি উৎসর্গীকৃত অধ্যায় দিয়ে পরিপূর্ণ। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই জন্য, এই দৃষ্টিভঙ্গি কুর’আন ও সুন্নাহ উভয়ের মধ্যে যা আছে এবং সেই সাথে সাহাবা কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীর শিক্ষায় যা পাওয়া যায় তারই সমষ্টি।

পাকিস্তানের দেওবন্দী ঘরানার সাবেক গ্র্যান্ড মুফতী মুহাম্মদ শফী’ (মৃত্যু: ১৯৭৯ খ্রীষ্টাব্দ) বলেছেন:

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে সবার চেয়ে বেশি ভালোবাসা ও সম্মান করা ঈমানের অংশ; বরঞ্চ মূলভিত্তি। এটা বোঝায় যে, যাঁরা তাঁর সাথে কোনো পারিবারিক বন্ধন রাখেন তাঁরাও একই সম্মান এবং ভালোবাসার যোগ্য। অতএব, তাঁর সাথে কারো সম্পর্ক যতোখানি মজবুত হবে, তাঁর বা তাঁদের সাথে আমাদের সম্পর্কও ততোখানি শক্তিশালী হবে। নিঃসন্দেহে বংশীয় সম্পর্ক মানুষের মধ্যে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সামাজিক বন্ধনকে ধারণ করে, তাই তাঁদের প্রতি ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধাও ঈমানের অংশ হবে। তবে এ দ্বারা এই সত্যকে অস্বীকার করা উচিত নয় যে আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বরকতময় স্ত্রীবৃন্দ এবং অন্যান্য বিশিষ্ট সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দ তাঁর সাথে একাধিক (আত্মীয়তা)-সূত্রে সম্পর্কিত ছিলেন।

মোটকথা, আহলে বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে ভালোবাসার বিষয়টি কখনোই উম্মাহর মধ্যে মতবিরোধের বিষয় ছিলো না। বস্তুতঃ ইজমা’ (ঐকমত্য) এই মর্মে প্রতিষ্ঠিত যে, তাঁদের প্রতি ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা ঈমানের পূর্বশর্ত। যখন উল্লেখযোগ্য  অন্যান্য ব্যক্তিবৃন্দের অপমান করার চেষ্টা করা হয়েছিলো, তখন বিভিন্ন মত দেখা দিয়েছিলো; কিন্তু আহলে বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম), তাঁদের বংশতালিকা আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে যতোই দূরের হোক না কেন, তাঁদের প্রতি ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা পরকালীন পরিত্রাণ ও সুখ-শান্তি অর্জনের একটি উপায় বটে। [মা’আরিফুল ক্বুর’আন, ৭ম খণ্ড, ৬৮৩-৬৮৬ পৃষ্ঠা]

সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-কে উপরোল্লিখিত উদ্ধৃতিগুলোর মাধ্যমে ফযীলত-বিহীন প্রমাণ করার অপচেষ্টা, যদিও তা ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু কিছু (শিয়াপন্থী) আলেমের অনুভূতির প্রতিনিধিত্ব করতে পারে, তথাপিও তা সংখ্যাগরিষ্ঠ (সুন্নী) আলেম-উলামার দ্বারা সমর্থিত নয়; আর তা কোনো সাহাবী (রা.), তাবিয়ী (রহ.) বা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কোনো সহীহ রওয়ায়েত দ্বারাও সমর্থিত নয়। এটা খুবই সম্ভব যে সহীহ রওয়ায়াত-গুলো সেই সংখ্যালঘু (শিয়া) গোষ্ঠীর কাছে পৌঁছায়নি। কোনো মুহাদ্দীস কর্তৃক নির্দিষ্ট কোনো হাদীস সম্পর্কে না জানাটা সেটার অনস্তিত্বকে আবশ্যক করে তোলে নেই।

হাকিমুল উম্মত মুফতী আহমেদ ইয়ার খাঁন নঈমী আশরাফী গুজরাটি (রহমতুল্লাহি আলাইহি) মন্তব্য করেছেন:

নির্দিষ্ট কোনো হাদীস সম্পর্কে কোনো মুহাদ্দীসের জ্ঞান না থাকাটা ওই হাদীসের অস্তিত্বহীনতাকে আবশ্যক করে তোলে না। [আমীরে মু’য়াবিয়াহ পার্ এ’তেরা’যা’ত ওয়া জওয়া’বা’ত – নং ১২, ২য় খণ্ড, ৮৯ পৃষ্ঠা]

এই ধরনের দাবির উৎস/উৎপত্তি নজিরবিহীন কিছু নয়; সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু) সম্পর্কে প্রাথমিক যুগের অনেক লোকই ভিন্নমত পোষণ করেছিলো। ‘মু’য়াবিয়া-বিরোধী’ শিবিরটি সায়্যিদুনা ‘আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-কে রক্ষা ও ভালোবাসার নামে অযৌক্তিক দাবি করতো। তাই সাইয়্যিদুনা ‘আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর এই ছদ্ম-অনুসারীদের দাবি কখনোই তাঁর প্রতি তাদের তথাকথিত ‘ভালোবাসা’-কে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা যাবে না; (সুন্নী) উলামায়ে কেরাম এ ধরনের সম্ভাব্য সমস্ত সন্দেহের উত্তর দিয়েছেন।

বর্ণনা সহীহ না হলে কি তা আপনাআপনি জাল হওয়ার ইঙ্গিতবহ?

আরেকটি বিষয় (এখানে) উল্লেখযোগ্য: যদি কোনো রওয়ায়াত/বর্ণনা নির্ভরযোগ্য না হয়, তাহলে তা কি আপনাআপনি বোঝায় যে এটা বানোয়াট? সহজ উত্তর হলো, না। যে ব্যক্তি এর সাথে দ্বিমত পোষণ করে, সে কেবল মুহাদ্দিসীনবৃন্দের (হাদীস) শ্রেণীকরণের সাথে অপরিচিত। নিম্নে বিভিন্ন উলামায়ে কেরামের প্রদত্ত উদ্ধৃতির একটি তালিকা দেওয়া হলো, যা ওপরে ব্যক্ত সত্যের পুনরাবৃত্তি করেছে।

ইমাম ইবনে হাজর আসক্বালানী (রহমতুল্লাহি আলাইহ – বেসাল: ৮৫২ হিজরী) বলেন:

لا يلزم من كون الحديث لم يصح أن يكون موضوعا.

অর্থ: কোনো হাদীস সম্পর্কে যদি বলা হয় “এটা অ-সহীহ,” তাতে তা জাল হওয়ার আবশ্যকতা বোঝায় না। [আল-ক্বওলুল মুসাদ্দাদ, ৮৯ পৃষ্ঠা]

আল্লামা আবদুল বাক্বী যুরক্বানী (রহমতুল্লাহি আলাইহি – বেসাল: ১১২২ হিজরী) বলেন:

نفية الصحة لا ينافي أنه حسن كما علم.

অর্থ: কোনো হাদীসের অ-সহীহ হওয়ার দরুন ‘হাসান’ (নির্ভরযোগ্য) হবার সম্ভাবনাকে নাকচ করে না, যেমনটি (মুহাদ্দেসীন) উলামাবৃন্দের কাছে জ্ঞাত। [শরহুয্ যুরক্বানী আলাল-মাওয়াহীব, ৫ম খণ্ড, ৫৫ পৃষ্ঠা]

হাফেয ইবনে হুমাম (রহমতুল্লাহি আলাইহি – ইন্তিক্বাল: ৮৬১ হিজরী) হতে বর্ণিত আছে যে তিনি বলেন:

و قول من يقول في حديث أنه لم يصح أن سلم لم يقدح لأن الحجة لا تتوقف على الصحة بل الحسن كاف.

অর্থ: “এটি সহীহ নয়” বলে যদি কারো বক্তব্য গ্রহণ করা হয় তবে তা দ্বারা হাদীসের মান-নির্ণায়ক প্রকৃতি খর্ব হয় না। ‘হাসান’ হাদীস শরী‘আতে গ্রহণযোগ্য এবং তা সহীহ হতে হবে এমনটি (কিন্তু) নয়। [মিরক্বাতুল মাফা’তীহ, ৩য় খণ্ড, ৮৮ পৃষ্ঠা]

ইমাম নূরুদ্দীন সামহূদী (রহমতুল্লাহি আলাইহি – বেসাল: ৯১১ হিজরী) ‘জওয়া’হিরুল আক্বদাইন ফী ফদলিশ্ শারাফাইন’ গ্রন্থে বলেন:

قد يكون غير صحيح وهو صالح للاحتجاج به إذ الحسن رتبته بين الصحيح و الضعيف.

অর্থ: কখনো কখনো একটি বর্ণনা যা সহীহ নয়, তা (শরঈ) বিধান প্রণয়নের জন্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে; কারণ তা ‘হাসান’ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা সহীহ এবং দাঈফ (দুর্বল)-এর মধ্যে বিশুদ্ধতার একটি পর্যায়/স্তর। [আর্ রাফউ ওয়াত্ তাকমীল, ১৯৬ পৃষ্ঠা]

ইমাম ইবনে হাজর হায়তামী মক্কী (রহমতুল্লাহি আলাইহি – বেসাল: ৯৬৪ হিজরী) ইমাম আহমদ হাম্বল (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর বক্তব্য প্রসঙ্গে বলেন:

قول أحمد إنه لا يصح أى لذاته فلا ينفي كونه حسنا لغيره و الحسن لغيره يحتج به كما بـين في علم الحديث.

অর্থ: ইমাম আহমদ (রহ.)-এর “এটি সহীহ নয়” মর্মে ভাষ্য হাদীসটির ‘হাসান লি-গায়রিহি’ (অন্যান্য কারণে নির্ভরযোগ্য) হওয়ার সম্ভাবনাকে অস্বীকার করে না। যেমন, হাদীস-শাস্ত্র বিশারদবৃন্দের মধ্যে জ্ঞাত যে এ ধরনের হাদীস শরী‘আতে গ্রহণযোগ্য। [আস্ সওয়ায়েক্বুল্ মুহরিক্বাহ, ১৮৫ পৃষ্ঠা]

মৌলভী আবদুল হাই লৌক্ষ্ণভী (মৃত্যু: ১৩০৪ হিজরী) লেখেন:

كثيرا ما يقولون: لا يصح ولا يثبت هذا الحديث و يظن منه من لا علم له أنه موضوع أو ضعيف وهو مبني على جهله بمصطلحاتهم وعدم وقوفه على مصرحاتهم.

অর্থ: অনেক সময় আপনি তাঁদেরকে (হাদীস বিশারদদের) বলতে দেখবেন: “এই হাদীসটি সহীহ নয়,” অথবা “এই হাদীসটি প্রমাণিত হয়নি;” আর যে ব্যক্তি হাদীসের শ্রেণীবিভাগ ও এই শাস্ত্রীয় জ্ঞান রাখে না সে হাদীসটিকে দঈফ (দুর্বল), এমন কী মওদু’ (বানোয়াট) বলে ধরে নেবে। [আর্ রাফউ ওয়াত্ তাকমীল, ১৯১ পৃষ্ঠা]

ইমাম আহমদ রেযা খাঁন বেরেলভী (রহমতুল্লাহি আলাইহি – বেসাল: ১৩৪১ হিজরী) লেখেন:

যদি কোনো হাদীস বিশারদ বলেন, “এই হাদীসটি সহীহ নয়,” তাহলে এর অর্থ এই নয় যে এটা সম্পূর্ণ বাতিল ও ভিত্তিহীন। বরঞ্চ মুহাদ্দিসীনের মতে সহীহ শব্দটি উচ্চস্তরের বিশুদ্ধতাকে বোঝায়, যার শর্তাবলী অনেক এবং একই সাথে কঠোর। এই সমস্ত শর্ত একসাথে খুঁজে পাওয়া কিছুটা বিরল, এবং এমন কী যদি সেগুলো পাওয়াও যায় তবুও এই জাতীয় শর্ত প্রতিষ্ঠার জন্য কঠোর যাচাইয়ের প্রয়োজন। এই ধরনের একটি প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করার জন্য বেশ বিশদ বিবরণের প্রয়োজন হবে; এটা বলাই যথেষ্ট, যখন মুহাদ্দিসবৃন্দ কোনো নির্দিষ্ট শর্তের অভাবযুক্ত একটি হাদীস খুঁজে পান, তখন তাঁরা এটাকে সহীহ হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করবেন না। অন্য কথায়, বর্ণনাটি এতো বেশি প্রামাণিকতার স্তরে পৌঁছায়নি যাতে আমরা এটাকে সহীহ হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করতে পারি। তবে এটা আরেকটা শ্রেণীর অধীনে পড়বে – সামান্য নিচে – যাকে ‘হাসান’ বলা হয়, যেটার নামই ইতিবাচক কিছুর দিকে ইঙ্গিত করে, নেতিবাচক নয়। একটি হাসান রওয়ায়াত/বর্ণনা কোনো সহীহ বর্ণনার একই গুণাবলীর অধিকারী, তবে কিছুটা কম মাত্রায়। সহীহ মুসলিম ও সহীহ বুখারী-সহ হাদীসের ছয়টি সহীহ গ্রন্থে শত শত এরকম বর্ণনা পাওয়া যায়। এই ধরনের বর্ণনাগুলোকে (ধর্মীয়) বিধি-বিধান (ইহতিজাজ) প্রণয়নের জন্য গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করা হয় এবং এর দরুন ‘উলামাবৃন্দ যাঁরা আবশ্যিকভাবে এগুলোকে প্রামাণিক হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ নাও করতে পারেন তাঁরা তবু হালাল ও হারাম-সম্পর্কিত বিধানগুলোতে এগুলোর ব্যবহার করেন। [মিযানুল আঈন, ২১ পৃষ্ঠা]

উক্ত বইয়ের কয়েক পৃষ্ঠা পরেই ইমাম আহমদ রেযা খাঁন (রহমতুল্লাহি আলাইহি) পীর নাসির ও তাঁর সমমনা ব্যক্তিদের প্রসঙ্গ আলোচনাকালে বলেন:

কিছু অজ্ঞ ব্যক্তি বলে যে, হযরত মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর ফজীলত প্রমাণের পক্ষে কোনো সহীহ বর্ণনা নেই। এটা নিছকই তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক অপরিপক্কতার ফল। হাদীস-শাস্ত্র বিশারদমণ্ডলী নির্দিষ্ট পরিভাষা ব্যবহার করে কথা বলেন! কোত্থেকে এবং কীভাবে যে এই অজ্ঞ ব্যক্তিরা তাঁদের কথার ভুল ব্যাখ্যা করে থাকে তা একমাত্র আল্লাহই জানেন। বর্ণনাগুলো সহীহ না হলে অন্তত হাসান। প্রকৃতপক্ষে, দাঈফ হাদীসও এ ব্যাপারে গ্রহণযোগ্য (ফাদায়েলুল-আ’মাল তথা নেক কাজের উদ্দেশ্যে)। [প্রাগুক্ত মিযানুল আঈন, ৫৩ পৃষ্ঠা]

ইমাম আহমদ রেযা খাঁন (রহমতুল্লাহি আলাইহি) অন্যত্র লেখেন:

(لا يصح) لا ينفي وجود الحسن.

অর্থ: “এই বর্ণনাটি সহীহ নয়” – পরিভাষাটি এর ‘হাসান’ হওয়ার সম্ভাবনাকে নাকচ করে না। [ফাতাওয়া-এ-রেযভীয়া, ১ম খণ্ড, ২৬ পৃষ্ঠা]

ইসলামী ফিক্বাহ তথা বিধি-বিধান জারিতে ‘হাসান’ হাদীস গ্রহণযোগ্য প্রমাণ করে ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী (রাহিমাহুল্লাহ) লেখেন:

هذا القسم من الحسن مشارك لا صحيح في الاحتجاج به وإن كان دونه.

অর্থ: এই ধরনের হাসান হাদীস যদিও একটি সহীহ হাদীসের তুলনায় শক্তিতে কম, তবুও শরঈ বিধান প্রণয়নের সময় শক্তিতে সমান। [নুযহাতুন্ নযরি ফী তওদীহি নুখবাতিল্ ফিকর – نزهة النظر في توضيح نخبة الفكر – ৩৩ পৃষ্ঠা]

হাকিমুল উম্মত মুফতী আহমদ ইয়ার খাঁন নঈমী আশরাফী গুজরাটী (রহমতুল্লাহি আলাইহি – বেসাল: ১৩৯১ হিজরী) লেখেন:

কোনো রওয়ায়াত/বর্ণনা সহীহ তথা বিশুদ্ধ না হওয়ার মানে এই নয় যে তা আপনাআপনি দঈফ/দুর্বল বলে গণ্য হবে। কারণ একটি বর্ণনা ‘হাসান’-ও হতে পারে, যা সহীহ ও দঈফের মধ্যবর্তী একটি শ্রেণি। যতোক্ষণ পর্যন্ত একটি বর্ণনা অন্তত হাসান পর্যায়ে শক্তিশালী হয়, ততোক্ষণ এটা যথেষ্ট। [জা’য়াল হক্ব, ৩৫০ পৃষ্ঠা]

ওপরে উল্লেখিত সকল উদ্ধৃতি প্রমাণ করে, যদিও অতীতে কিছু লোক সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর বিরুদ্ধে (হাদীসে বর্ণিত কথাগুলো সহীহ পর্যায়ে না হওয়ার কারণে) এই ধরনের দাবি করেছিলো, তবুও এটা অবশ্যই সেগুলোকে হাসান পর্যায়ের হাদীসের বাইরে নেয় না। হাদীস-শাস্ত্রের বিশারদবৃন্দ ইমাম ইসহাক ইবনে রাহাওয়াইহ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর বক্তব্যের অর্থ কীভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তার আলোকে বিষয়টি বোঝা দরকার।

অতএব, ইমাম ইবনুল আসাকির (রাহিমাহুল্লাহ – বেসাল: ৫৭১ হিজরী) এবং ইবনুল কাসীর (মৃত্যু: ৭৭৪ হিজরী) উভয়ই নিম্নরূপ ব্যাখ্যা করেছেন:

كتب إلي أبو نصر القشيري أنا أبو بكر البيهقي أنا أبو عبد الله الحافظ قال سمعت أبا العباس الأصم قال سمعت أبي يقول سمعت إسحاق بن إبراهيم الحنظلي يقول لا يصح عن النبي صلى الله عليه و سلم في فضل معاوية بن أبي سفيان شيء و أصح ما روى في فضل معاوية حديث أبي حمزة عن ابن عباس “ أنه كان كاتب النبي” فقد أخرجه مسلم في صحيحه و بعده حديث العرباض: “ اللهم علمه الكتاب” و بعده حديث ابن أبـي عميرة : اللهم اجعله هاديا مهديا.

অর্থ: ইমাম ইসহাক ইবনে রাহাওয়াইহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: “আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে আমীরে মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর কোনো গুণের প্রতি ইঙ্গিতবহ এমন কোনো সহীহ হাদীস নেই। হযরত মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর গুণাবলী প্রকাশ করে এমন সবচেয়ে সহীহ বর্ণনা হলো হযরত ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে আবূ হামযার বর্ণনা, যা ব্যক্ত করে আমীরে মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হযরতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাতিব তথা ওহী-লেখক ছিলেন। ইমাম মুসলিম (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর সহীহ গ্রন্থে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। এর পরবর্তী (সবচেয়ে প্রামাণিক) বর্ণনাটি হলো আল-ইরবাদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর বর্ণনা (এ মর্মে) যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘হে আল্লাহ! তাকে (মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু’কে) কিতাব (কুর’আন) শিক্ষা দিন।’ চূড়ান্ত বর্ণনাটি ইবনে আবি উমাইরা (রহ.) থেকে এসেছে (এ মর্মে) যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: “হে আল্লাহ! তাকে (মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু’কে) হেদায়েত দান করুন এবং অন্যদের জন্য পথপ্রদর্শক হতে দিন।” [তারীখু মদীনাহ ওয়া দিমাশক্ব, ২১তম খণ্ড, ১৯৩ পৃষ্ঠা; আল-বেদায়াহ ওয়ান্ নেহায়াহ, ৮ম খণ্ড, ১২২ পৃষ্ঠা]

ইমাম জালালউদ্দীন সৈয়ূতী (রহমতুল্লাহি আলাইহি – বেসাল: ৯১১ হিজরী) অনুরূপ একটি বক্তব্য প্রদান করেছেন:

وقال السيوطي الشافعي أصح ما ورد في فضل معاوية حديث ابن عباس “أنه كاتب النبي صلى الله عليه وسلم” فقد أخرجه مسلم في صحيحه و بعده حديث العرباض رضي الله عنه:” اللهم علمه الكتاب” و بعده حديث ابن أبـي عميرة : “ اللهم اجعله هاديا مهديا “.

অর্থ: আমীরে মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর গুণাবলী প্রকাশ করে এমন সবচেয়ে সহীহ রওয়ায়াত হলো হযরত ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে আবূ হামযা (রহ.)-এর বর্ণনা: “মু’য়াবিয়া (রা.) রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাতিব/ওহী লেখক ছিলেন।” ইমাম মুসলিম (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর সহীহ গ্রন্থে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। পরবর্তী (সবচেয়ে প্রামাণিক) বর্ণনাটি হলো আল-ইরবাদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর বর্ণনা (এ মর্মে) যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: “হে আল্লাহ! তাকে (মু’য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু’কে) কিতাব (কুর’আন) শিক্ষা দিন।” শেষ বর্ণনাটি ইবনে আবি উমাইরা (রহ.) থেকে এসেছে (এ মর্মে) যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: “হে আল্লাহ! তাকে (মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু’কে) হেদায়েত দান করুন এবং অন্যদের জন্য পথপ্রদর্শক হতে দিন।” [তানযীহুশ্ শরীআহ, ২য় খণ্ড, ৮ পৃষ্ঠা]

ইমাম ইবনে হাজর মক্কী (রহমতুল্লাহি আলাইহি – বেসাল: ৯৭৪ হিজরী) বলেন:

قيل عبر البخاري بقوله باب ذكر معاوية ولم يقبل فضائله ولا مناقبه لأنه لم يصح في فضائله شيء كما قاله ابن راهويه وذلك أن تقول: إن كان المراد من هذه العبارة أنه لم يصح منها شيء على وفق شرط البخاري فأكثر الصحابة كذلك إذا لم يصح شيء عنها، وان لم يعتبر ذلك القيد فلا يضره ذلك لما يأتي ان من فضائله ما حديثه حسن حتى عند الترمذي كما صرح به جامعه وستعلمه مما يأتى. و الحديث الحسن لذاته كما هنا حجة إجماعا بل الضعيف في المناقب حجة أيضا، وحينئذ فما ذكره ابن راهويه بقدير صحته لا يخدش في فضائل معاوية.

অর্থ: বলা হয়েছে যে, যখন ইমাম বুখারী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) হযরত মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর বিবরণ উল্লেখ করতে শুরু করলেন, তখন তিনি এই শিরোনামের অধীনে তা করেছিলেন – “মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-সম্পর্কিত অধ্যায়” – যা ছিলো নিম্নের এ শিরোনামের পরিবর্তে: “মু’য়াবিয়া (রা.)-এর ফজীলত-সম্পর্কিত অধ্যায়।” কেননা ইমাম ইসহাক ইবনে রাহাওয়াইহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছিলেন যে তাঁর ফজীলত প্রমাণ করে এমন কোনো সহীহ হাদীস বিদ্যমান নেই। যদি এই উক্তিটি দ্বারা বোঝানো হয় – “মু’য়াবিয়া (রা.)-এর ফযীলত সম্পর্কে কোন সহীহ বর্ণনা নেই”, তাহলে এর মানে দাঁড়ায় এই যে মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর ফযীলত সম্পর্কে ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর আরোপিত শর্তানুযায়ী কোনো সহীহ বর্ণনা নেই। এ মাপকাঠিতে অধিকাংশ সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-ই হযরতে মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর মতো একই পরিস্থিতিতে পড়বেন। আর যদি ইমাম বুখারী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর শর্ত উহ্য না থাকে, তাহলে উক্তিটি অপ্রয়োজনীয় হবে; কেননা প্রকৃতপক্ষে ইমাম তিরমিযী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর মতানুযায়ী এমন সব ‘হাসান’ পর্যায়ের রওয়ায়াত/বর্ণনা বিদ্যমান (যেমন তাঁর জা’মে গ্রন্থে), যা’তে হযরতে মুয়াবিয়া রাহিমাহুল্লাহর ফযীলত প্রমাণ হয়; (আর আপনারা যেমন জানতে পারবেন) মূলতঃ হাসান কোনো বর্ণনাকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে (শরীয়াহ আইন প্রণয়নের জন্য)। বস্তুতঃ দঈফ/দুর্বল বর্ণনাকেও ফাদায়েল (গুণ) প্রমাণের একটি বৈধ দলিল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ কারণে ইসহাক ইবনে রাহাওয়াইহ (রহ.) যা বলেছেন তা সত্য বলে ধরে নিলে, হযরতে মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর গুণাবলীর উপর তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। [তাতহীরুজ্ জিনা’ন ওয়াল-লিসা’ন, ১০৯ খণ্ড]

ওপরে যা উল্লেখ করা হয়েছে তার আলোকে এটা স্পষ্ট যে, সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) প্রকৃতপক্ষে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাতিব তথা ওহী-লেখক হওয়ার সম্মান ও গুণের অধিকারী ছিলেন, যেমনটি ইমাম মুসলিম (রহিমাহুল্লাহ) বর্ণনা করেছেন তাঁর সহীহ গ্রন্থে। বস্তুতঃ এই বর্ণনাটি আমীরে মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর পক্ষে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এক রওয়ায়াত। সুতরাং সহীহ বর্ণনা না থাকার কারণে সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর জন্য কোনো ফজীলত প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার অভিযোগটি বাতিল। হাদীস বিশারদদের মতে, (তাঁর পক্ষে) অবশিষ্ট বর্ণনাগুলো ‘হাসান’ হাদীসের মানদণ্ড পূরণ করে। হাসান পর্যায়ের হাদীস শরঈ আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যে গ্রহণযোগ্য, যেমনটি ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।

আল্লামা আল-ফারহা’রাউয়ী (ইন্তিক্বাল: ১২৩৯ হিজরী) লেখেছেন:

فإن أريد بعدم الصحة عدم الثبوت فهو مردود لما مر بين المحدثين فلا ضير فإن فسحتها ضيقة و عامة الأحكام والفضائل إنما تثبت بالأحاديث الحسان لعزة الصحاح ولا ينحط ما في المسند والسنن عن درجة الحسن وقد تقرر في فن الحديث جواز العمل بالحديث الضعيف في الفضائل فضلا عن الحسن وقد رأيت في بعض الكتب المعتبرة من كلام الإمام مجد الدين بن الأثير صاحب ميزان الجامع حديث مسند أحمد في فضيلة معاوية صحيح الا اني لا استحضر الكتاب في الوقت و لم ينصف الشيخ عبد الحق الدهلوي رحمه الله في شرح سفر السعادة فانه اقر الكلام المصنف ولم يتعقبه كتعقبه على سائر تعصباته. 

অর্থ: যদি “মু’য়াবিয়া (রা.)-এর ফযীলত প্রতিষ্ঠা করার মতো কিছুই সহীহ নেই” বলতে এ কথা বোঝানো হয় যে তাঁর ফযীলত প্রমাণিত নয়, তাহলে তা ভুল। তবে যদি বিবৃতিটিকে সূক্ষ্ম পারিভাষিক অর্থে বুঝতে হয় – যেমনটি হাদীসশাস্ত্রের পণ্ডিতদের দ্বারা বোঝা যায়- তাহলে প্রকৃতপক্ষে এর কোনো নেতিবাচক অর্থ নেই। কারণ হলো, সহীহ বর্ণনার সংখ্যা এতোই কম যে অধিকাংশ শরঈ বিধান ও ফজীলত ‘হাসান’ হাদীস দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। বস্তুতঃ, সুনান সংকলনগুলোতে এবং ইমাম আহমদ (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর মুসনাদে পাওয়া অনেক হাদীসই (বিশুদ্ধতায়) হাসানের চেয়ে কম মানের বর্ণনা। হাদীস বিশারদদের মধ্যে এটা একটা জ্ঞাত বাস্তবতা যে, হাসান বর্ণনার কথা তো দূরে, ফজীলত প্রতিষ্ঠার জন্য দঈফ বর্ণনাও গ্রহণযোগ্য। এমন কী আমি মুজাদ্দিদ ইবনুল আসীর রাহিমাহুল্লাহ-এর মতো পণ্ডিতদেরকেও দেখেছি এ কথা বলতে যে ইমাম আহমদ (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর মুসনাদ গ্রন্থে হযরত মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর ফজিলত-জ্ঞাপক সহীহ বর্ণনা পাওয়া যায়। দুর্ভাগ্যবশত, আমি এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না যে তিনি কোন বইতে এটি উল্লেখ করেছেন। শাইখ ‘আব্দুল হক দেহলভী (রহ.) সফরুস্ সা’আদাহ বইটি সম্পর্কে লেখা তাঁর শরাহ/ব্যাখ্যাটিতে সেটার সুবিচার করেননি। তিনি এই বিষয়ে লেখকের সমালোচনা করেননি, যেমনটি ওই বইয়ের অন্যান্য অংশে তাঁর (সমালোচনার) রীতি (পরিদৃষ্ট) হয়েছিলো। [আন্ নাহিয়াহ, ৩৯ পৃষ্ঠা]

সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া (রা.)’এর ফজিলত সম্পর্কে কয়েকটি হাদীস

সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর ফযীলত বর্ণনা করে মুহাদ্দিসবৃন্দের লিপিবদ্ধ এমন কয়েকটি হাদীসের তালিকা নিম্নে দেওয়া হলো –

সাইয়্যিদিনা আবদুর রহমান ইবনে আবী উমাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:

اللهم علمه الكتاب والحساب وقه العذاب.

অর্থ: হে আল্লাহ! তাকে (মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু) কিতাব (কুরআন) এবং হিসাব শিক্ষা দিন এবং তাকে (পরকালের) শাস্তি থেকে রক্ষা করুন। [আল-বিদায়াহ ওয়ান্ নিহায়াহ, ৮ম খণ্ড, ১২১ পৃষ্ঠা; ইমাম যাহাবী কৃত তারীখুল ইসলাম, ২য় খণ্ড, ৩০৯ পৃষ্ঠা; আ’লামুল্ নুবালা,’ ৪র্থ খণ্ড, ২৮৮ পৃষ্ঠা; আল-ইসা’বাহ, ২য় খণ্ড, ১৬৪ পৃষ্ঠা; মুসনাদু আহমদ, ১ম খণ্ড, ৪৬৬ পৃষ্ঠঅ; মজমাউয্ যওয়াঈদ, ৯ম খণ্ড, ৫৯৪ পৃষ্ঠা; হাফিয যাহাবী বলেন, “এ হাদীসের সকল বর্ণনাকারী সিকা/বিশ্বস্ত, তবে আবদুর রহমান (রা.) সাহাবী ছিলেন কি-না সে বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। প্রাধান্যপ্রাপ্ত মতটি হলো তিনি বাস্তবিকই একজন সাহাবী ছিলেন” (তারীখুল ইসলাম, ২য় খণ্ড, ৩০৯ পৃষ্ঠা)। মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) বলেন, “এ হাদীসের সকল বর্ণনাকারী বিশ্বস্ত” (মকতুবাত শরীফ, ২৫১ নং পত্র)।]

সাইয়্যেদুনা ইরবা’দ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন যে তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছেন এ কথা – 

اَللّٰهُمَّ عَلِّمْ مُعَاوِيَةَ الْكِتَابَ وَالْـحِسَابَ وَقِهِ الْعَذَابَ.

অর্থ: হে আল্লাহ! মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-কে কিতাব (কুর’আন) এবং হিসাব শিক্ষা দিন এবং তাকে (পরকালের) শাস্তি থেকে রক্ষা করুন। [মুসনাদু আহমদ, ৪র্থ খণ্ড, ৫৭ পৃষ্ঠা; সহীহু ইবনু হিব্বান, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ৩৭১ পৃষ্ঠা; তারীখুল ইসলাম, ২য় খণ্ড, ৩০৯ পৃষ্ঠা; মজমাউয্ যওয়াঈদ, ৯ম খণ্ড, ৫৯৪ পৃষ্ঠা; আল-ইসতী’আব, ৩য় খণ্ড, ৪৭৪ পৃষ্ঠা; আ’লামুল নুবালা’, ৪র্থ খণ্ড, ২৮৮ পৃষ্ঠা; তারীখুল কবীর, ৮ম খণ্ড, ২০৪ পৃষ্ঠা; আল-বিদায়াহ ওয়ান্ নিহায়াহ, ৮ম খণ্ড, ১২০ পৃষ্ঠা; মাওয়া’রিদুদ্ দামা’ন, ৫৬৬ পৃষ্ঠা; কানযুল উম্মাল, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ১০৯ পৃষ্ঠা; ইবনুল আসীরকে উদ্ধৃত করে আল্লামাহ আবদুল আযীয ফারহা’রাউয়ী বলেন যে তাঁর বর্ণনা সহীহ (আন্ নাহিয়াহ, ৩৯ পৃষ্ঠা)]

সাইয়্যেদুনা আবদুর রহমান ইবনে আবী উমায়রাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন যে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিম্নের দুআ’টি আমীরে মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর জন্য (আল্লাহর দরবারে আরয) করেন – 

اللهم اجعله هاديا مهديا واهد به. قال الترمذى حسن غريب.

অর্থ: “হে আল্লাহ! তাকে (মু’য়াবিয়াকে) হাদী/হেদায়াতদাতা বানিয়ে দিন, হেদায়াতপ্রাপ্ত করে দিন, আর তার মাধ্যমে অন্যান্যদেরও হেদায়াত দিন।” ইমাম তিরমিযী (রহ.) বলেন, “এই হাদীস হাসান-গরীব।” [তিরমিযী, ৫৭৪ পৃষ্ঠা; আত্ তারীখুল কবীর, ৭ম খণ্ড, ২০৪ পৃষ্ঠা; তারীখুল ইসলাম, ২য় খণ্ড, ৩১০ পৃষ্ঠা; মিশকা’তুল মাসা’বীহ, ৫৭৯ পৃষ্ঠা; আল-বিদায়াহ ওয়ান্ নিহায়াহ, ৮ম খণ্ড, ১২১ পৃষ্ঠা; আ’লামুল নুবালা’, ৪র্থ খণ্ড, ২৮৮ পৃষ্ঠা; মাওয়া’রিদুদ্ দামা’ন, ৫৬৬ পৃষ্ঠা; হিলইয়াতুল আউলিয়া, ৮ম খণ্ড, ৩৫৮ পৃষ্ঠা; আল-মু’জামুল আওসাত, ১ম খণ্ড, ৩৮০ পৃষ্ঠা]

সাইয়্যেদুনা উমর ইবনে সা’আদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, হযরত মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) সম্পর্কে ভালো ছাড়া মন্দ বোলো না; কেননা আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি এ কথা – 

اللهم اهده.

অর্থ: হে আল্লাহ, তাকে (মু’য়াবিয়াকে) হেদায়াত তথা সঠিক পথে পরিচালিত করুন। [আত্ তারীখুল কবীর, ৪র্থ খণ্ড, ২৯০ পৃষ্ঠা; তিরমিযী, ৫৪৭ পৃষ্ঠা; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৮ম খণ্ড, ১২২ পৃষ্ঠা]

ওপরোক্ত বর্ণনাগুলো সম্পর্কে ইবনে কাসীরের ভাষ্য

উপরে উল্লিখিত চারটি বর্ণনাই ইবনে কাসীর নিজ আল-বিদায়াহ ওয়ান্ নিহায়াহ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন (রেফারেন্স প্রদত্ত)। এই বর্ণনাগুলো উদ্ধৃত করার পর ইবনুল কাসীর মন্তব্য করেন:

واكتفينا بما أوردناه من الأحاديث الصحاح والحسان والمستجادات عما سواها من الموضوعات والمنكرات.

অর্থ: শুধুমাত্র সহীহ, হাসান এবং জায়্যিদ (উত্তম) হাদীস বেছে নেওয়াই আমাদের জন্য যথেষ্ট। আমরা মওদু’ ও মুনকার (প্রত্যাখ্যাত) বর্ণনা (উল্লেখ করা) থেকে বিরত রেখেছি। [আল-বিদায়াহ ওয়ান্ নিহায়াহ, ৮ম খণ্ড, ১৩২ পৃষ্ঠা]

অতিরিক্ত সমর্থন

আমরা এখন সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর ফযীলত-সম্পর্কিত আরো কিছু সহীহ বর্ণনা উল্লেখ করবো। আমরা সমালোচকদের প্রতি এটাকে খোলা মনে চিন্তা করার পরামর্শ দেই।

সহীহ আল-বুখারী হাদীসগ্রন্থে “রোমানদের সাথে যুদ্ধ সম্পর্কে যা বর্ণিত হয়েছে” শীর্ষক অধ্যায়ের অধীনে বর্ননা এসেছে যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:

أَوَّلُ جَيْشٍ مِنْ أُمَّتِي يَغْزُونَ الْبَحْرَ قَدْ أَوْجَبُوا.

অর্থ: আমার উম্মাতের মধ্যে প্রথম যে (সেনা) দলটি নৌযুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে তারা যেনো জান্নাত অনিবার্য করে ফেল্লো। [বুখারী, আন্তর্জাতিক নম্বর-২৯২৪; মুসলিম, ২য় খণ্ড, ১৪১ পৃষ্ঠা]

উম্মাহর মাঝে এ মর্মে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত যে, “প্রথম সেনাবাহিনী” বলতে সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর বাহিনীকে বুঝিয়েছে। এই সহীহ হাদীসটি সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর পক্ষে গণ্য নয় কি? জান্নাতের নিশ্চয়তা পাওয়া কি বড় ফযীলত/পুণ্য নয়? ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী (রাহিমাহুল্লাহ – বেসাল: ৮৫২ হিজনী) এবং হাফিজ বদরুদ্দীন আল-আঈনী (রাহিমাহুল্লাহ – বেসাল: ৮৫৫ হিজনী) বলেন:

قال المهلب في هذا الحديث منقبة لمعاوية لأنه أول من غزا البحر. 

অর্থ: আল-মুহলিব এই বর্ণনা সম্পর্কে বলেছেন: “এই হাদীসটি হযরত মু’য়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর প্রসঙ্গে বর্ণিত, কেননা নিশ্চয় তিনি-ই প্রথম ব্যক্তি যিনি সমুদ্রে যুদ্ধ করেছিলেন।” [ফাতহুল বারী, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ১০২ পৃষ্ঠা]

এটা সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর প্রতি মঞ্জুরকৃত এক মহা অনুগ্রহ যে, তিনি দুনিয়াতেই জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েছিলেন। তাই তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ফযীলত/পুণ্য না থাকার অভিযোগ ভিত্তিহীন।

সাইয়্যেদুনা আবদুল মালিক ইবনে উমাইর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন যে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফরমান:

يا معاوية! إن ملكت فأحسن.

অর্থ: ওহে মু’য়াবিয়া! যদি তোমাকে মানুষের শাসনভার দেওয়া হয়, তবে তাদের কল্যাণ সাধন কোরো (সুশাসন দ্বারা)। [আল-মুসান্নাফু ইবনু আবী শায়বাহ, ১১তম খণ্ড, ১৪৭ পৃষ্ঠা; আল-মাতা’লিবুল আলিয়্যাহ, ৪র্থ খণ্ড, ১০৮ পৃষ্ঠা]

ইমাম ইবনে হাজর মক্কী (রহ.) এই হাদীস সম্পর্কে বলেন:

والحديث حسن كما علمت، فهو مما يحتج به على فضل معاوية رضي الله عنه.

অর্থ: আপনি জানেন যে, এটা একটা হাসান-সহীহ হাদীস। এটা সেগুলোর মধ্য হতে, যা দ্বারা হযরতে আমীরে মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর ফজীলত প্রমাণিত হয়। [আস্ সাওয়ায়েক্বুল মুহরিক্বা, ২১৮ পৃষ্ঠা]

আরো সমর্থন

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সম্মানিত দরবারে কাতিব তথা ওহী-লেখক হওয়া স্বয়ং একটি মহান গুণ। জীবনী-সংক্রান্ত বইগুলোতে যেখানেই ওহী-লেখকদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু)-এর নামও পাওয়া যায়। [বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন – ইস্তি’আব, ৩য় খণ্ড, ৩৬৫ পৃষ্ঠা; মজমাউয্ যওয়াঈদ, ৯ম খণ্ড, ৩৫৭ পৃষ্ঠা; আল-বিদায়াহ ওয়ান্ নিহায়াহ, ৮ম খণ্ড, ২১ পৃষ্ঠা; জওয়া’মিউল সীরাহ, ২০ পৃষ্ঠা]

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর খেদমত/সেবা করা সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ কাজ, যা সমগ্র দুনিয়ার চেয়েও মূল্যবান। সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু)-কে বারবার রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সেবা করার মহৎ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো।

সাইয়্যিদুনা ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু) একদিন উল্লেখ করেন:

عن ابن عباس رضي الله عنه عَنْ مُعَاوِيَةَ رَضِيَ اللهُ عنْه، قالَ: قَصَّرْتُ عن رَسولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ بمِشْقَصٍ.

অর্থ: হযরত মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, “আমি (সুযোগ পেয়েছিলাম) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বরকতময় চুলের একটি অংশ কাটার। [সহীহ বুখারী, ১৭৩০]

সায়্যিদুনা মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর কাছে বরকত আদায়ের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বরকতময় চুল ও কাটা নখ ছিলো। তিনি অসীয়ত/উইল করেছিলেন যেনো তাঁকে এই বরকতময় অংশ-সহ সমাহিত করা হয়; তাঁর অসীয়তটি পালন করা হয়েছিলো। [তারীখুল খলাফা, ৭০ পৃষ্ঠা]

সাইয়্যিদুনা মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) অনেক জ্বিহাদে অংশ নিয়েছিলেন: হুনাইন, তায়েফ এবং তাবুক, যেখানে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সংশ্লিষ্ট অংশগ্রহণকারীদের প্রতি তাঁর বিশেষ মনোযোগ প্রদান করেছিলেন। এটা তাঁর (রা.) জন্য এমন একটা সম্মান ছিলো যে, মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু)-এর সমালোচকবর্গ এই চমকপ্রদ বাস্তবতা অস্বীকার করার ক্ষেত্রে নিজেদেরকে এক চোরাবালিতে আটক দেখতে পাবে। তিনি হাজ্জাতুল ওয়াদা (বিদায় হজ্জ)-তে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথেও উপস্থিত ছিলেন। এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে:

জোহরের সালাতের পর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর উটে আরোহণ করলেন এবং মদীনায় ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। তিনি মু’য়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-কে সরাসরি তাঁর পিছনের আসনে বসালেন এবং তাঁর তাওয়াফ আল-ইফা’দাহ শুরু করলেন, যা তাওয়া’ফ আল-সদর ও তাওয়া’ফ আল-জিয়ারাত নামেও পরিচিত। [দিয়্যাউন্নবী, ৪র্থ খণ্ড, ৭৬৮ পৃষ্ঠা]

সাইয়্যেদুনা মু’য়াবিয়া (রা:) সম্পর্কে ইতিহাস বিকৃতির অপনোদন (পর্ব-৪৩)*

মূল: মওলানা মুহাম্মদ জা’ফর ইক্ববাল

বঙ্গানুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

প্রকাশক: মাহাজ্জাহ-ডট-কম

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment