ইসলামে তৃতীয় খলিফা, খলিফায়ে রাশেদ সাইয়্যেদুনা উসমান গণী যুন্নুরাঈন রাদিআল্লাহু আনহু জন্মগ্রহণ ঐতিহাসিক “ফীল” এর ঘটনার ছয় বছর পর।বিশুদ্ধ বর্ণনা মতে,’ আবরাহা কর্তৃক মক্কা শরীফ আক্রমণ এর ছয় বছর পরে তিনি মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। ‘ (সুনানে বায়হাকী) কেউ কেউ তাঁর জন্মস্থান তাফেয় বলেও আখ্যায়িত করেছেন। তিনি ছিলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এঁর চেয়ে দুনিয়াবি জিন্দেগীর হিসেবে ৫ বছরের ছোট।
ইমাম জুহরি বলেন, “উসমান যুন্নুরাঈন রাদিআল্লাহু আনহু স্বাভাবিক উচ্চতার অধিকারী,আকর্ষণীয় চুল ও চেহারার অধিকারী ছিলেন।শেষ বয়সে মাথার চুল পড়ে গিয়েছিলো। উভয় পায়ের মাঝে সুন্দর দূরত্ব ছিলো।উন্নত নাসিকা, প্রশস্ত বক্ষ ও পশমে আবৃত ছিলো তাঁর দীর্ঘ বাহু।দাঁত অত্যন্ত চমৎকার। রক্তবর্ণ ওষ্ঠাধর ছিলো বেশি চিত্তাকর্ষক। কান পর্যন্ত কেশরাজি এবং মনলোভা চেহারা। ( তারিখে তাবারি,সিফাতুস সাফওয়া)
উসমান গণী যুন্নুরাঈন রাদিআল্লাহু আনহু কে যখন আবু বকর আস সিদ্দিক রাদিআল্লাহু আনহু ইসলামের দাওয়াত দেন তখন তাঁর বয়স ছিলো ৩৪। তিনি ছিলেন ইসলাম গ্রহণকারী ৪র্থ পুরুষ। ইসলাম গ্রহণের কারণে তিনি তাঁর চাচা হাকাক ইবনে আবিল আস এর হাতে নির্মমভাবে নির্যাতিত হন।আশারায়ে মুবাশশরা বা জান্নাতী সুসংবাদপ্রাপ্ত ১০ জনের মধ্যে উসমান যুন্নুরাঈন রাদিআল্লাহু ছিলেন অন্যতম। তিনি ছিলেন বিনয়ী,ক্ষমাশীল,দয়ালু,দানশীল, ধৈর্য্যশীল এবং মহৎ হৃদয়ের অধিকারী।
হিজরতের আগে উসমান গণী যুন্নুরাঈন রাদিআল্লাহু আনহু সাইয়্যেদা রুকাইয়া বিনতে রাসূল রাদিআল্লাহু আনহাকে বিয়ে করেন এবং উনাকে নিয়ে আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। এরপর মদীনায় মুনাওওরায় হিজরত করেন। সাইয়্যেদা রুকাইয়া বিনতে রাসূল রাদিআল্লাহু আনহার ইন্তেকাল এর পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাইয়্যেদা উম্মে কুলসুম বিনতে রাসূল রাদিআল্লাহু আনহাকে উসমান গণী যুন্নুরাঈন রাদিআল্লাহু আনহুর সাথে বিয়ে দেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দুই কণ্যাকে বিয়ে করার কারণে তিনি যুন্নুরাঈন বা দুই নূরের অধিকারী লকবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।
মদীনায় মুনাওওরায় উসমান রাদিআল্লাহু আনহু সাইয়্যেদা রুকাইয়া বিনতে রাসূল রাদিআল্লাহু আনহার সার্বক্ষণিক সাহচর্যে থাকতেন। তাঁর শিক্ষক ছিলেন স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসমান রাদিআল্লাহু আনহুকে মদীনাতে হযরত বিলাল রাদিআল্লাহু আনহুর সাথে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হন।
বদরের যুদ্ধের সময় সাইয়্যেদা রুকাইয়া বিনতে রাসূল রাদিআল্লাহু আনহার অসুস্থতার কারণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে মদীনায় রয়ে যান। উহুদ-খন্দক-হুনাইনের যুদ্ধেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। “গাজওয়ায়ে গাফতান” এর অভিযানের সময় এবং “গাজওয়ায়ে যাতুর রিকা” এর অভিযানের সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসমান রাদিআল্লাহু আনহুকে মদীনাতে স্থলাভিষিক্ত করে যান।
৬ষ্ঠ হিজরিতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে মক্কায় উমরাহ উদ্দেশ্যে রওনা হন এবং হুদাইবিয়ার নামক স্থানে যাত্রাবিরতি করে উসমান গণী যুন্নুরাঈন রাদিআল্লাহু আনহুকে মক্কার কুরাইশদের সাথে আলোচনা করতে পাঠান। কুরাইশরা উসমান গণী যুন্নুরাঈন রাদিআল্লাহু আনহুকে একাই উমরাহ করার প্রস্তাব দিলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে। উসমান গণী যুন্নুরাঈন রাদিআল্লাহু আনহুর ফিরতে দেরি হলে খবর ছড়ায় যে উনাকে হত্যা করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক গাছের নিচে তাঁর ১৪০০ সাহাবাকে উসমান গণী যুন্নুরাঈন রাদিআল্লাহু আনহুর প্রতিশোধ নেওয়ার শপথ বাক্য করান। এই শপথে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের হাত মোবারককে উসমান গণী যুন্নুরাঈন রাদিআল্লাহু আনহুর হাত মোবারক বলে উল্লেখ করেন। এই শপথকেই বাইয়াতে রিদওয়ান বা বাইয়াতুস শাজারা বলা হয়। উসমান গণী যুন্নুরাঈন রাদিআল্লাহু আনহু ফিরে আসলে স্বস্তি ফিরে আসে। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে কুরআনের আয়াত নাযিল হয়।
৯ম হিজরিতে “গাজওয়ায়ে তাবুক” এর অভিযানে ৯৪০ টি উট ও ৬০ টি ঘোড়া সরবরাহ করেন। উসমান গণী যুন্নুরাঈন রাদিআল্লাহু আনহুর এই বাহিনীর সমারাস্ত্র দিয়ে সজ্জিতকরণে ১০ হাজার দিনার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্মুখে পেশ করেন। “গাজওয়ায়ে তাবুক” এ কোন যুদ্ধ সংগঠিত না হলেও উসমান গণী যুন্নুরাঈন রাদিআল্লাহু আনহুর এসব সমরাস্ত্র বা অর্থ ফেরত নেয়ার চিন্তাও করেন নাই। পরবর্তীতে যখনই মুসলমানদের কোন প্রয়োজনে আর্থিক সহায়তার প্রস্তাব এসেছে,তিনি সব সময়ই অনতিবিলম্বে সাগ্রহে অংশ নিয়েছেন।
মদীনায় মুনাওওরায় খাবার পানির অভাব দেখা দিলে তিনি রুমা নামক একটি কূপ কিনে তা মদীনাবাসীর জন্য ওয়াকফ করে দেন। মসজিদে নববির সম্প্রসারণের জন্য তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আহবানে সাড়া দিয়ে ২০/ ২৫ হাজার দিরহাম দিয়ে মসজিদ সংলগ্ন জায়গা কিনে দান করে দেন।
আবু বকর আস সিদ্দিক ও উমর আল ফারুক রাদিআল্লাহু আনহুমের খিলাফাতকালে তিনি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ ও আর্থিক সহায়তায় দেন। উমর রাদিআল্লাহু আনহুর শাহাদাৎ এর পর ২৪ হিজরির শুরুতে উসমান গণী যুন্নুরাঈন রাদিআল্লাহু আনহু খলিফা মনোণীত হন। তিনি কুরআনুল কারীমের চুড়ান্তভাবে সংকলনের কাজ করেন।মুসলিম উম্মাহ বিভক্তির হাত থেকে রক্ষা পায়।
উসমান গণী যুন্নুরাঈন রাদিআল্লাহু আনহুর খিলাফাতকালে উত্তর আফ্রিকা, আরমেনিয়া ও রোমান সাম্রাজ্যে অভিজান পরিচালিত হয়।
উপকূলীয় এলাকায় নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা ও আবাদকরণে উসমান গণী যুন্নুরাঈন রাদিআল্লাহু আনহু বিভিন্ন নির্দেশনা দেন।
উসমান গণী যুন্নুরাঈন রাদিআল্লাহু আনহুর খিলাফাত কালেই জনগণ স্বচ্ছলতা লাভ করে। যেকেউ তার নিয়োগকৃত গভর্নরদের বিষয়ে বিষয়ে অভিযোগ করলে তিনি দ্রুত তদন্ত সাপেক্ষে ব্যাবস্থা নিতেন ও প্রয়োজনে শাস্তিও দিতেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাধিকবার উসমান যুন্নুরাঈন রাদিআল্লাহু আনহুর শাহাদাৎ এর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তাঁর খিলাফাতের শেষ দিকে তাঁর ব্যাপারে কুৎসা রটানো শুরু হয়। ইয়েমেনী বংশোদ্ভূত আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা নামক এক ইহুদি যে কি না ননওমুসলিম হয়েছিলো, সে এই কুৎসা রটানোয় নেতৃত্ব৷ দেয়। অনেক মুসলমানও তার এই ধোঁকায় পতিত হয়ে বিদ্রোহ করেন।
৩৫ হিজরি জিলক্বদ মাসে এসব বিদ্রোহীরা উসমান যুন্নুরাঈন রাদিআল্লাহু আনহুকে খিলাফাত ত্যাগের জন্য চাপ দিতে মদীনাতে অবস্থান নেয়। এক পর্যায়ে তারা তাঁর বাসভবন অবরোধ করে।
মাওলা আলী রাদিআল্লাহু আনহু সহ সাহাবায়ে কেরাম বারবার অনুমতি চেয়েও উসমান যুন্নুরাঈন রাদিআল্লাহু আনহুর কাছ থেকে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের অনুমতি পান নাই।তিনি স্পষ্টভাবে সবাইকে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলেন যে, খিফাফত আল্লাহ ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমানত।এটা এমন কোন বাদশাহী নয় যার জন্য জনগণের রক্ত প্রবাহিত করা যায়।
অবরোধের এক পর্যায়ে বিদ্রোহী সন্ত্রাসীরা বাড়িতে প্রবেশ করে। ৩৫ হিজরি ১৮ জিলহজ্জ সূর্যাস্তের আগ মুহুর্তে কুরআনুল কারীম পাঠরত অবস্থায় উসমান যুন্নুরাঈন রাদিআল্লাহু আনহু নির্মমভাবে শহীদ হন। শাহাদাৎ এর সময় তাঁর৷ বয়স ছিলো ৮২ বছর।
উসমান যুন্নুরাঈন রাদিআল্লাহু আনহুর স্ত্রী নাইলা ছুটে এসে তাঁকে আড়াল করতে চাইলে বিদ্রোহী সন্ত্রাসীদের তরবারির আঘাতে নাইলা রাদিআল্লাহু আনহার আঙ্গুলগুলো কাটা পড়ে। বন উজাড় করা আগুনের চেয়েও তীব্র বেগে উসমান যুন্নুরাঈন রাদিআল্লাহু আনহুর শাহাদাৎ এর খবর পুরো মদীনায়ে মুনাওওরায় ছড়িয়ে পড়ে। ছুটে আসেন উম্মুহাতুল মু’মিনীন, আহলে বাইত ও আসহাবে কেরাম রাদিআল্লাহু আনহুম।
শহীদ উসমান যুন্নুরাঈন রাদিআল্লাহু আনহুকে গোসল দেয়া হয় নাই কারণ শহীদের জন্য পরিহিত কাপড়-ই কাফন। জানাযার পর মদিনায়ে মুনাওওরার জান্নাতুল বাকীর এক প্রান্তে উসমান যুন্নুরাঈন রাদিআল্লাহু আনহুকে নিয়ে যাওয়া হয়। লজ্জা,ধৈর্য্য ও পবিত্রতার এই সূর্যপুরুষ পবিত্র জান্নাতুল বাকীর জমিনে সমাহিত হন।