করোনাকালীন এই সময়ে অনেকে ধৈর্য হারা হয়ে যাচ্ছেন এমনকি কেউ কেউ সময় তথা এই বছরকে মন্দ বলছেন, গালি দিচ্ছেন। কিন্তু আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী ﷺ বলেনঃ মহীয়ান গরীয়ান আল্লাহ বলেন, আদম সন্তান আমাকে কষ্ট দেয়, সে সময়কে গালি দেয়, অথচ আমিই সময় (নিয়ন্ত্রণ করি), রাত ও দিন আমিই পরিবর্তন করে থাকি। (সহিহ মুসলিম ৫৭৫৬, সুনান আবূ দাউদ ৫২৭৪)
আমাদের উপর যে বিপদ আপদ আপতিত হয় সেগুলো আমাদের উপর পরীক্ষাস্বরূপ কিংবা আমাদের কৃতকর্মেরই ফল। আবার এই বিপদ দ্বারাই (বিপদে ধৈর্যধারণ করলে) আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের গুনাহ ক্ষমা করেন অন্যদিকে অকৃতজ্ঞ আর কাফেরদেরকে তাঁর পথে ফিরে আসার সুযোগ দেন কিংবা তাদের আযাবের ব্যবস্থা করেন। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“মানুষের কৃতকর্মের দরুন স্থলে ও জলে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে। এর পরিণামে তিনি কর্মের (শাস্তির) স্বাদ তাদের ভোগ করাবেন, যাতে তারা (সঠিক পথে) ফিরে আসে।” (সূরা আর রুম, আয়াত ৪১)
“আর তোমাদের কৃতকর্মের কারণেই তোমাদের ওপর বিপদ নেমে আসে আর তিনি অনেক কিছুই ক্ষমা করে থাকেন।” (সূরা আশ শুরা, আয়াত ৩০)
“আল্লাহ যদি মানুষকে তাদের সীমালঙ্ঘনের জন্য পাকড়াও করতেন, তাহলে যমীনের উপর কোন প্রাণীকেই তিনি রেহাই দিতেন না। কিন্তু তিনি একটা নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত তাদেরকে সময় দেন। তাদের সময় এসে গেলে এক মুহূর্তও অগ্র-পশ্চাৎ করা হয় না।” (সূরা নাহল, আয়াত ৬১)
“এবং আল্লাহ্ তোমাদেরকে শাস্তি দিয়ে কি করবেন, যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো ও ঈমান আনো ? এবং আল্লাহ্ পুরস্কারদাতা, সর্বজ্ঞ।” (সূরা আন নিসা, আয়াত ১৪৭)
“মানুষ কি মনে করেছে যে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’ এ কথা বললেই তাদেরকে অব্যাহতি দেয়া হবে এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবেনা? আমিতো তাদের পূর্ববর্তীদেরকেও পরীক্ষা করেছিলাম; আল্লাহ অবশ্যই প্রকাশ করে দিবেন কারা সত্যবাদী ও কারা মিথ্যাবাদী।” (সূরা আল আনকাবুতঃ আয়াত ২, ৩)
“আমি কোন জনপদে এমন কোন নবীই পাঠাইনি যেখানকার অধিবাসীদেরকে অভাব-অনটন আর দুঃখ-কষ্ট দ্বারা পীড়িত করিনি যাতে তারা (আল্লাহর পথে ফিরে এসে) নম্রতা ও কাতরতা প্রকাশ করে। তারপর আমি মন্দ অবস্থাকে ভাল অবস্থা দ্বারা বদলে দিয়েছি। অবশেষে তারা প্রাচুর্য লাভ করেছে এবং (অকৃতজ্ঞ স্বরে) বলেছে, ‘আমাদের বাপ-দাদাদেরকেও দুর্দশা ও আনন্দ স্পর্শ করেছে।’ অতঃপর আমি তাদেরকে হঠাৎ পাকড়াও করেছি এমনভাবে যে, তারা উপলব্ধিও করতে পারেনি।” (সূরা আরাফ, আয়াত ৯৪-৯৫)
“এবং অবশ্যই আমি তোমাদের পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও ধৈর্যধারণকারীদের। যারা তাদের উপরে কোনো আপদ-বিপদ ঘটলে বলে -নিঃসন্দেহে আমরা আল্লাহ্র জন্যে, আর অবশ্যই আমরা তাঁরই কাছে প্রত্যাবর্তনকারী। এদের প্রতি রয়েছে তাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে অনুগ্রহ ও করুণা আর এরাই হিদায়াতপ্রাপ্ত। (সূরা বাক্বারাহ, আয়াত ১৫৫-১৫৭)
হযরত আয়িশাহ (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে প্লেগ/ মহামারী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে উত্তরে তিনি বললেন, তা একটি আযাব। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাদের প্রতি ইচ্ছা করেন তাদের উপর তা প্রেরণ করেন। আর আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর মুমিন বান্দাগণের উপর তা রহমত করে দিয়েছেন। কোন ব্যক্তি যখন প্লেগে আক্রান্ত জায়গায় সাওয়াবের আশায় ধৈর্য ধরে অবস্থান করে এবং তার অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস থাকে যে, আল্লাহ্ তাকদীরে যা লিখে রেখেছেন তাই হবে তাহলে সে একজন শহীদের সমান সওয়াব পাবে। (সহীহ বুখারী ৩৪৭৪)
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ মুমিনের অবস্থা বিস্ময়কর। সকল কাজই তার জন্য কল্যাণকর। মু’মিন ছাড়া অন্য কেউ এ বৈশিষ্ট্য লাভ করতে পারে না। তারা সুখ-শান্তি লাভ করলে শুকর-গুজার করে আর অস্বচ্ছলতা বা দুঃখ-মুসীবাতে আক্রান্ত হলে সবর করে, প্রত্যেকটাই তার জন্য কল্যাণকর। (সহীহ মুসলিম ৭৩৯০)
তিনি ﷺ আরো বলেনঃ মুসলিম ব্যক্তির উপর যে কষ্ট ক্লেশ, রোগ-ব্যাধি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, কষ্ট ও পেরেশানী আসে, এমনকি যে কাঁটা তার দেহে ফুটে, এ সবের মাধ্যমে আল্লাহ তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন। (সহীহ বুখারী ৫৬৪১)
এক সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ﷺ! মানুষের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশি মুসিবতের সম্মুখীন হয় কে? তিনি ﷺ বললেনঃ নবীগণ, এরপর যারা উত্তম মানুষ তারা, এরপর যারা উত্তম তারা। একজন তার দ্বীনদারীর অনুপাতে পরীক্ষায় নিপতিত হয়। যদি সে তার দ্বীনে মজবুত হয় তবে তার পরীক্ষাও তুলনামূলকভাবে কঠোরতর হয়; আর সে যদি দ্বীনের ক্ষেত্রে দুর্বল ও হালকা হয় তবে সে তার দ্বীনদারীর অনুপাতেই পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। এভাবে বান্দা বিপদ-আপদে পড়তে থাকে শেষ পর্যন্ত সে পৃথিবীতে এমন মুক্তভাবে বিচরণ করতে থাকে যে তার উপর আর কোন গুনাহর দায় থাকে না। (সূনান আত তিরমিজী ২৩৯৮, সুনান ইবনে মাজাহ ৪০২৩)
বলুন, আমাদের জন্য আল্লাহ যা লিখেছেন তা ছাড়া আমাদের অন্য কিছু ঘটবে না; তিনি আমাদের অভিভাবক। আর আল্লাহর উপরই মুমিনদের নির্ভর করা উচিত।” (সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত ৫১)
কিন্তু আমরা অকৃতজ্ঞদের অভিযোগের কোন শেষ নেই। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা বলছেন,
“মানুষ এরূপ যে, যখন তার পালনকর্তা তাকে পরীক্ষা করেন, অতঃপর সম্মান ও অনুগ্রহ দান করেন, তখন বলে, আমার পালনকর্তা আমাকে সম্মানিত করেছেন। আর যখন তাকে পরীক্ষা করেন, অতঃপর রিযিক সংকুচিত করে দেন, তখন বলে, আমার পালনকর্তা আমাকে হেয় /অপমানিত করেছেন। না, কখনোই না (রিযক কখনো মান-সম্মানের মানদন্ড নয়) বরং তোমরা ইয়াতীমের প্রতি সম্মানজনক আচরণ কর না। এবং মিসকীন বা অভাবগ্রস্তকে অন্নদানে পরস্পরকে উৎসাহিত কর না। আর তোমরা উত্তরাধিকারীদের (প্রাপ্য) সব ধন-সম্পদ খেয়ে ফেলো। এবং তোমরা ধন-সম্পদকে অতিরিক্ত ভালবাস। এটা অনুচিত। পৃথিবীকে যখন টুকরো টুকরো করে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়া হবে এবং তোমার রব এর নির্দেশ আসবে আর ফিরিশতাগণ আসবে কাতার কাতার (সারিবদ্ধ) হয়ে, আর সেদিন জাহান্নামকে আনা হবে, সেদিন মানুষ উপলব্ধি করবে, কিন্তু এই উপলব্ধি কি তার কাজে আসবে? সে বলবে, হায়! এ জীবনের জন্যে আমি যদি কিছু আগে পাঠাতাম! অতঃপর সেদিন তাঁর আযাবের মত আযাব কেউ দিতে পারবে না। (সূরা আল ফজর, আয়াত ১৫-২৫)
“যে সকল বস্তু তোমরা চেয়েছ, তার প্রত্যেকটি থেকেই তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন। যদি আল্লাহর নেয়ামত গণনা কর, তবে গুণে শেষ করতে পারবে না। নিশ্চয় মানুষ অত্যন্ত অন্যায়কারী, অকৃতজ্ঞ।”
(সূরা ইব্রাহিম, আয়াত ৩৪)
“অতএব, তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন কোন অনুগ্রহকে অস্বীকার করবে?” (সূরা আর-রহমান)
“আর (স্মরণ করুন) যখন তোমাদের রব ঘোষণা দিলেন, ‘যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় করো, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের বাড়িয়ে দেবো, আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, নিশ্চয় আমার আযাব বড় কঠিন।” (সূরা ইব্রাহীম, আয়াত ৭)
মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা আমাদেরকে সকল বিপদ আপদে ধৈর্য ধারণ করার তাওফিক দান করুক, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা আদায় করার তাওফিক দান করুক।