সত্যালোকের সন্ধ্যানে : বারবার ইচ্ছা করে খানায়ে ‘কাবা’ তাওয়াফ করতে

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

মোহাম্মদ মোস্তাকিম হোসাইন : মহা বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সর্বাধিক ফজিলত ও মর্যাদাপূর্ণ যে ঘর তার নাম খানায়ে কাবা। অর্থাৎ বাইতুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর। মহান আল্লাহ বলেন, “নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্মিত সেটা এই ঘর যা মক্কায় অবস্থিত যা পবিত্র এবং সারাজাহানের জন্য হিদায়ত। (সূরা আলে ইমরান-৯৬) পবিত্র কাবাঘর আল্লাহর ঘর। একে ঘিরে আছে মাসজিদুল হারাম। জীবাত্মা ও পরমাত্মার সেতুবন্ধন এই কাবা অবস্থিত পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল মক্কা নগরীতে। ভৌগোলিক অবস্থানের দিক দিয়ে মক্কার অবস্থান এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার মধ্যস্থল।বিশ্বের প্রতিটি মুসলমানের অন্তরে একান্ত কামনা বাসনা হলো হজ্বের পবিত্র বিধানটি পালন করার সৌভাগ্য অর্জন। আমারও মনের মধ্যে ঠিক একই বাসনা। ছোটবেলা থেকেই কাবা ঘর স্বচোখে দেখা, তাওয়াফ করা এবং মহাবিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, কুল মাকলুকাতের রহমত, সাইয়্যেদুল মোরছালিন, খাতামান নাবিইন হযরত মুহাম্মদ (সা,) এর রওজায় দাঁড়িয়ে ছালাম জানানোর ইচ্ছা। দীর্ঘ প্রতীক্ষা ও মনের মাধুরিতে লুকায়িত স্বপ্ন বাস্তবায়নের সেই সুবর্ণ সুযোগ করে দিলেন মহান ¯্রষ্ঠা আল্লাহ তায়ালা। তাই প্রথমে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছি। আলহামদুলিল্লাহ। গত বছর ২০১৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর আমার শ্রদ্ধেয় মা সৈয়দা নুর জাহান খানমকে নিয়ে পবিত্র হজব্রত পালনের জন্য বাড়ি থেকে রওনা দিলাম, সঙ্গে আমার ছোট ভাই সৈয়দ রেজভী আহম্মেদ ফারুক বিমানে ওঠার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ছিল। যাওয়ার পূর্বে পাড়া-প্রতিবেশীদের নিয়ে আমার শ্রদ্ধেয় বাবা মরহুম আলহাজ ইয়াছিন আলী, দাদা মরহুম কছির উদ্দিন বিন মকবুল্লাহ (রহ.) ও দাদী মরহুমা ছকিনা বিবিসহ পারিবারিক গোরস্থানে কবর জিয়ারত করলাম, ক্ষমা চাইলাম জিবিত ও মৃত আত্মীয় স্বজনদের এবং মাকে নিয়ে যেন সুস্থ শরীরে হজের যাবতীয় হুকুম আহকামসমূহ পালন করতে পারি। মহান আল্লাহ দোয়া কবুল করেছিলেন বলেই অসুস্থ মা সুস্থ হয়ে হজের যাবতীয় কার্যক্রম সম্পূর্ণ করতে পেরেছিলেন।পবিত্র হজ হচ্ছে ফরজ ইবাদত। আল্লাহ বলেন, মানুষের প্রতি আল্লাহর এ অধিকার রয়েছে যে, এই ঘর (কাবা) পর্যন্ত পৌঁছার সামর্থ্য-পাথেয় যার রয়েছে সে যেন তার হজ সম্পন্ন করে। আর যারাই তা অস্বীকার করবে তাদের জেনে রাখা উচিত, আল্লাহ দুনিয়াবাসীর মুখাপেক্ষী নন। (আলে ইমরান-৯৭) অন্যত্র আল্লাহ বলেন, অর্থাৎ আল্লাহর জন্য হজ ও উমরা পূরণ কর। (বাকারাহ-১৯৬) শরিয়তের পরিভাষায় বাইতুল্লাহ গমন করে নির্দিষ্ট তারিখে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানসমূহ নির্দিষ্ট নিয়মে বাইতুল্লাহ তাওয়াফসহ কতগুলো কাজ সম্পাদন করাকে হজ বলে। এর মাধ্যমে মানসিক, শারীরিক ও আর্থিক ইবাদত হয়ে যায়। আমরা হজ ক্যাম্পে গিয়ে হাজির হলাম দুপুর ১২টার দিকে, আমাদের হজের সাথী ছিলেন ইসলামিক ফাউন্ডেশন বগুড়ায় কর্মরত আরিফুর রহমান। হজ ক্যাম্পে আগে থেকে অপেক্ষা করছিলেন আমাদের এজেন্সি মুহিব্বিন টুরিস্ট অ্যান্ড ট্রাভেলসের মালিক মইনুল ইসলাম। হজ ক্যাম্পে যেতেই তিনি আমাদের রিসিভ করলেন। শুভেচ্ছা জানালেন সরকারের পক্ষ থেকে দায়িত্বে নিয়োজিতরা, বিভিন্ন পত্রিকা ও বেসরকারি সংস্থা। এছাড়াও সেখানে হজ গাইড (নির্দেশিকা) বই বিনামূল্যে সরবরাহ করছে। জোহরের নামাজের পর খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বিশ্রাম নিলাম। মা মহিলাদের ক্যাম্পে রয়েছে। মাকে বলেছি সমস্যা হলে ফোন দিতে।আসরের পর ইফায় কর্মরত মোহসিন ভাই দেখা করতে এলেন। কুশল বিনিময় করলেন। এজেন্সি থেকে ভিসা লাগানো পাসপোর্ট এবং পরিচিতি কার্ড সরবরাহ হলো। রাতে যাবতীয় কার্য সম্পাদন করা হয়। পাসপোর্টে সৌদি সরকারের প্রদত্ত বাসভাড়া এবং জিয়ারতের জন্য স্টিকার লাগানো হয়। ঘোষণা হলো সকাল ৭টায় ফ্লাইট। রাতেই লাগেজ দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে নিলাম এবং মায়ের ল্যাগেজও বেঁধে দিলাম। মনের মধ্যে আলাদা অনুভূতি। মাকে বললাম, সকাল ৬টায় বিমানবন্দরে পৌঁছাতে হবে।রাতে তেমন ঘুম হয়নি। শেষ রাতে উঠে গোসল সেরে তাহাজ্জুদ, কোরআন তেলাওয়াত শেষে ফজরের আগেই এজেন্সির পক্ষ থেকে ইহরাম বাঁধার জন্য প্রস্তুতি নিতে বললেন। মঈন ভাই আমাকে ইহরাম বাঁধানো শিক্ষা দিলেন। আমি বাঁধলাম এবং অন্যদের সহযোগিতা করলাম। মাকে ফোন দিলাম। মা বললো আমি অনেক আগেই উঠেছি, তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি। ফজরের আজান হলো। জামায়াতের সাথে ফজরের নামাজ পড়ে নিলাম। ইহরাম বাধা হচ্ছে হজের কার্যক্রম শুরু করা। হজের তিন ফরজের একটি। আমরা তামাত্তু হজের নিয়ত করলাম। তাই আগে উমরার পর হজ করতে হয়। সবাই সাদা সেলাইবিহীন দুখ- সাদা কাপড় পরে শ্রষ্ঠার নিকট লাভের জন্য দুরাকাত নামাজ পড়ে তালবিয়া পাঠ করলাম লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লাশারিকালাকা লাব্বাইক; ইন্নাল হামদা ওয়ান নি মাতা লাকাওয়া লমুকক লাশারিকালাক। মনের মধ্যে দুনিয়াবী চিন্তা ত্যাগ করে মনের মাধুরিতে শ্রষ্ঠাকে আলিঙ্গন করার জন্য ব্যাকুল হয়ে রয়েছে দেহ-মন। ৬টার মধ্যে মা’সহ সব হাজীকে নিয়ে পৌঁছে গেলাম শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। ইমিগ্রেশনে গিয়ে মাকে ছাড় দিয়ে এক কর্মকর্তা আমাকে আটকিয়ে দিলেন। আমার বয়স নাকি কম। বলছে ৩০/৩৫ বছর বয়সে আমাদের দেশ থেকে যারা সৌদিতে হজ ও উমরা করতে যায় তারা আর ফিরে আসে না। আমি আমার পরিচয় দিলাম এবং বললাম মার সঙ্গে আমাকে যেতেই হবে। কর্মকর্তা বললেন, বিমানের ফিরতি টিকিট দেখান। ফিরতি টিকিট দেখার কিছুক্ষণের মধ্যে ছেড়ে দিলেন। দেখলাম মা ভিতরে বসে আমার জন্য চিন্তা করছেন। মাকে নিয়ে লাগেজগুলো জমা দিয়ে সোজা চলে গেলাম কাচঘেরা প্রকোষ্ঠে। সেখানে বসে বসে সবাই তালবিয়া পাঠ করছে। আমাদের বিমান আসেনি, কিছুক্ষণের মধ্যে বিশাল আকৃতির দোতলা বিমান সৌদি এয়ারলাইন্স এসে নামলো। এটি আমাদের জন্য। ৯টার দিকে দরজা খুলে দিয়ে আসন গ্রহণের ঘোষণা আসলো। মনের মধ্যে আলাদা আনন্দ, ব্যতিক্রমধর্মী অনুভূতি। জীবনের এ প্রথম উড়োজাহাজে ওঠা। শ্রদ্ধেয় মায়ের হাত ধরে উঠে গেলাম দ্বিতীয় তলায়। ৪৩৭/৩৮নং সিটে গিয়ে বসলাম। মা জানালার পাশে। বুকের মধ্যে অজানা অনুভূতি কাজ করছে। উদ্দেশ্য আল্লাহকে পাওয়া তাকে খুশি করা। বিমান ছেড়ে দেয়ার আগ মুহূর্তে কথা হলো এস পি স্যার মোজাম্মেল হক, পিপিএম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল ওয়ারিস, করতোয়া সম্পাদক মোজাম্মেল হক লালু ভাই, পুলিশ লাইন কলেজের অধ্যক্ষ শাহাদৎ আলম ঝুনু, গিন্নি সিফাতী যোয়ারিয়া গানি, ছোট ভাই রাজু, ফোরকান, ছালাম, মনি আপা, আরেফা আপাসহ বেশ কয়েকজনের সাথে। ফারুক ফোন দিয়ে কান্না শুরু করেছে। বলছে, ভাই আমাদের জন্য দোয়া করবেন, মাকে দোয়া করতে বলবেন। বিমান উড্ডয়নের পূর্বেই মোবাইল বন্ধ করার ঘোষণা আসলো। বিমানবালাগণ বেল্ট বাধা, ইয়ার মাস্ক পরা, লাইফ জ্যাকেট ও জরুরি নির্গমনের সব দরকারি জিনিসগুলো দেখিয়ে দিলেন। আমারটা বেঁধে মায়েরটা বেঁধে দিলাম। ঘোষণা আসলো আর কিছুক্ষণের মধ্যে বিমান ছেড়ে দিবে। ঢাকা থেকে জিদ্দার দুরুত্ব ৫২৩৫ কি.মি। জিদ্দার উদ্দেশ্যে প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ থেকে পূন্যভূমি সৌদির উদ্দেশ্যে বিমান ছেড়ে দিচ্ছে। ঘোষনা আসলো, “আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার আলহামদুল্লিহি ….. সবাই দোয়া পড়লাম। বিশাল আকৃতির বিমান আস্তে আস্তে উড়তে লাগলো উপরের দিকে। প্রায় ৩০-৩৫ হাজার ফুট উপরে দিয়ে উড়াল দিয়েছে জিদ্দার উদ্দেশ্যে। মনের মধ্যে প্রথমে মৃদু ভয় অনুভব হচ্ছিল। বুকের মধ্যে দুরু দুরু ভাব বিরাজ করলেও বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ফজিলত পূর্ণ ঘর দেখা ও তাওয়াফ করার প্রচন্ড ইচ্ছা বার বার উকি মারছে। মা ছেলে দুই জনই অনেক গল্প করলাম। দুনিয়া আখেরাতের কথা হচ্ছে। জানালা দিয়ে নজর করে দেখতে পেলাম পাহাড়ের মত মেঘমালা গুলো ভেসে রয়েছে তার উপর দিয়ে দ্রুত গতিতে উড়ে চলেছে বিমান। ঘোষক মাঝে মধ্যে আকর্ষণীয় কন্ঠে বিভিন্ন বিষয় জানিয়ে দিচ্ছে। সবার সিটের সঙ্গে মিনি টেবিল মেলে ধরে ফলমূল, জুস, চকলেটসহ প্রায় ১০/১২ রকমের নাস্তা দিয়েছে। দেড় ঘন্টা পর দুপুরে মোরগ পোলাও খাবার পরিবেশন করা হয়। তৃপ্তি সহকারে খেয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম। আমাদের মিকাত ইয়ালাম লামে এসে বিমান একটু ধিরে চললো এবং মিকাত থেকে পুনরায় আমরা হজের নিয়ত করলাম। ঘোষকের সাথে সাথে আমরাও উচ্চৈঃস্বরে তালবিয়া (লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা) পাঠ করলাম। সবাই আল্লাহর নিকট হাজিরা দেয়ার জন্য মৃত্যুর পূর্বেই মৃত্যুর জীবন্ত মহড়া স্বরূপ দুখ- সেলাইবিহীন ইহরামের (কাফনের) কাপড় পড়ে দুনিয়ার সমস্ত চিন্তা-চেতনা পরিহার করে অশ্রুসিক্ত নয়নে মহান মাবুদের দিকে এগিয়ে চলেছি ক্ষমা, দয়া আর দুনিয়া-আখেরাতের কল্যাণ লাভের জন্য। কিছুক্ষণের মধ্যে পৃথিবীর প্রথম মানব আদম (আ.) এর পদচারণার ক্ষেত্রভূমি, আরব লোহিত সাগরের প্রচ- উর্মিমালায় আছড়ে পড়া উপকূল আদি মাতা আম্মাজান বিবি হাওয়া (আ.) নামানুসারে পরিচিত জিদ্দায় নিরাপদে নেমে পড়ল উড়োজাহাজটি। আহামদুলিল্লাহ বিমান থেকে নেমে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে করে জিদ্দায় বিমানের চেক পয়েন্টে নিয়ে আসলে আমরা জহুরের নামাজ আদায় করলাম। ঢাকা থেকে পাওয়া সৌদি মোবাইল সিমকার্ড মোবাইলে তুলে বাড়িতে ফোন দিলাম গিন্নি সিফাতী যোয়ারিয়া গানিকে। ফ্রেস হয়ে হালকা নাস্তা করে চেকিং শেষে জিদ্দার সুবিশাল সুডৌল ছত্রাকারে কারুকার্য খচিত ইসলামী ঐতিহ্যে নির্মিত আকর্ষণীয় ভবনে বাংলাদেশ মিশনের পতাকা তলে অপেক্ষা করছিলাম। ইতিমধ্যে খুঁজে নিতে হয় সবার ল্যাগেজ। কিছুক্ষণ পর সুপ্রশান্ত যানজট ও কোলাহলমুক্ত মসৃণ মহাসড়কে এসি বাসে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলল ৪৫ কিমি দূরে অবস্থিত পবিত্র মক্কানগরীর দিকে। যাত্রাপথে মক্কার প্রবেশ দ্বারে পিলগ্রিম চেকপোস্টে পৌঁছার পর জমজমের পানি, বড় একটি নাস্তার বক্স দিয়ে আগত আল্লাহর মেহমানদের আপ্যায়ন করা হয়। চেকিং শেষে আমরা ৮৪নং মুয়াল্লিম অফিসে হাজির হলাম। এখানেও আপ্যায়ন করা হয়। এখানে পাসপোর্টগুলো জমা দিতে হয়। আমাদের হ্যান্ডব্যাজ, গোলফিতা ও আইডি কার্ড দেয়া হয়। যেন পরিচয় প্রদানে অসুবিধা না হয়। জিদ্দা থেকে আছর নামাজ পড়ে রওনা হয়ে রাস্তায় মক্কার এক আকর্ষণীয় মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায় করা হয়। পবিত্র মক্কা নগরী আতশবাতি দিয়ে কোরআনের বিভিন্ন আয়াত সংবলিত বাতি দিয়ে সুসজ্জিত করাÑ যা অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও মনোরম। কিছুক্ষণের মধ্যে জমজম বা মক্কা টাওয়ারের সুবিশাল দৃষ্টিনন্দন ঘড়ি নজরে পড়ল। আমাদের হৃদয়মন আর বাঁধ মানছে না, বারবার উঁকিঝুকি কাবার মিনার দেখার জন্য। কাবার পাশে ‘রিদম’ নামক হোস্টেলে পৌঁছলাম। হোস্টেলে ওঠার পর মনের মধ্যে একটাই বাসনা, কখন দেখব সেই বাইতুল্লাহ, কখন তাওয়াফ করব আল্লাহর ঘর। কারণ আমরা ইহরামের বন্দিশালায় রয়েছিÑ উমরা হজ শেষ করে খোলা হতে হবে। হজ গাইড লিয়াকত ভাই বললেন, ইচ্ছা করলে রাতেই উমরা শেষ করতে পারেন অথবা ফজরের পর যেতে পারেন। আমরা রাতেই কাবা ঘর দর্শনের নিয়ত করলাম। কারণ যে ঘর তাওয়াফের জন্য জীবনের দীর্ঘ প্রতীক্ষা। জীবনের বড় কামনা ও বাসনা। যে ঘরটি হচ্ছে মুসলমানদের জন্য ‘কেবলা’, আল্লাহর নির্দেশে সর্বপ্রথম ফেরেস্তারা সর্বপ্রথম মক্কা নগরিতে কাবাঘর নির্মাণ করে এখানে ইবাদত করেন। কাবাঘরটি আল্লাহর আরশ মুয়াল্লার ছায়াতলে সোজাসুুজি সপ্তম আসমানে অবস্থিত মসজিদে বাইতুল মামুরের আকৃতি অনুসারে ভিত্তি স্থাপন করা হয়। মহান রাব্বুল আলামিন কাবাঘরটি মানবজাতির ইবাদতের কেন্দ্রস্থলরূপে নির্দিষ্ট করেছেন। এই ঘরটি বর্গাকারে দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ৪৫ ও ৪০ ফুট। এ ঘরটি মহাবিশ্বে সর্বপ্রথম তৈরি করা হয়। বিখ্যাত গ্রন্থ তারিখ আল মক্কাতে সায়ূতি উল্লেখ করেন পবিত্র কাবাঘর নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ হয়েছে দশবার। এই ঘরের ফজিলত সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, “আল্লাহ তায়ালা তার সম্মানিত ঘরের উদ্দেশ্যে আগমনকারীদের জন্য প্রতিদিন একশত কুড়িটি রহমত নাযিল করেন। ৬০টি তাওয়াফকারিদের জন্য, ৪০টি নামাজ আদায়কারীদের জন্য আর ২০টি রহমত নাযিল করেন ঘরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধকারীর জন্য। (বাইহাকী)নবী (সা.) এরশাদ করেন : আর পুণ্যময় হজের একমাত্র পুরস্কার হলো জান্নাত বা বেহেস্ত। (বোখারী ও মুসলিম) পরিষ্কার কথা হচ্ছে ‘কাবাই’ একমাত্র ঘর যে ঘরের দিকে তাকালেও সওয়াব, তাওয়াফ করলেও সওয়াব নামাজ পড়লেও সওয়াব। মনের মাধুরিতে লুকায়িত সব আবেগ-অনুভূতি আর আকর্ষণ নিয়ে রাত সাড়ে এগারটার দিকে রওনা হলাম কাবা ঘর তাওয়াফের উদ্দেশ্যে। মায়ের হাত ধরে অনেকের সঙ্গে হেঁটে হেঁটে চললাম হারামের দিকে, ইব্রাহিম খলিল রোড পার হয়ে দেখলাম হারামের চত্বর। ১০ মিনিটের মধ্যে প্রবেশ করলাম। মসজিদে হারামে, নামাজ পড়লাম এশার, তার পর নফল নামাজ পড়ে তাওয়াফের জন্য এগিয়ে চললাম। অচেনা-অজানা গন্তব্য মহাবিশ্বের সর্বাধিক উৎকৃষ্ট ঘর কাবার দিকে হঠাৎ চোখে পড়ল কালো গিলাফে ঢাকা ঐ প্রতীক্ষিত রহমত বরকতের শ্রেষ্ঠ ঘর কাবার দিকে। কি যে এক অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। নীলবাতি থেকে তাওয়াফ শুরু করতে হবে। তাই মায়ের হাত ধরে তাওয়াফ শুরু করলাম। মনের মাধুরিত লুকায়িত, বহু প্রতীক্ষার বাস্তব কাবা দর্শনে পুলকিত হয়ে উঠলো দেহ-মন। প্রতিটি চক্করে চক্করে মনে মনে দোয়া দরুদ পড়া হচ্ছে। মাকে নিয়ে একেবারে কাবা ঘরের দেয়াল ঘেঁষে তাওয়াফ শুরু করলাম। অসুস্থকে দেখলাম একবারে সুস্থ সবল দেহমন। মায়ের হাত ধরেই একবারে কাবার দেয়ালে হাত বুলিয়ে দিলাম। মা দুই হাত কাবার সঙ্গে লাগিয়ে খোদার দরবারে ফরিয়াদ করল। আমিও করলাম। দেখলাম মায়ের চোখে পানি, আমারও অশ্রুজলে বুক ভিজে গেল। দোয়া করলাম মৃত বাবা মরহুম আলহাজ্ব ইয়াছিন আলীসহ দাদা-দাদী, নানা-নানী, শ্বশুরসহ মৃত আত্মীয়-স্বজনদের জন্য। সেই সাথে স্ত্রী, পুত্র, ভাই, বোনসহ জীবিতদের মঙ্গল কামনা। যারা দোয়া চেয়েছিল তাদের জন্য। সাত চক্কর তাওয়াফ শেষ করে মাকামে ইব্রাহিমের পার্শ্বে দু’ রাকাত নামাজ পড়ে আবারও কাবাকে সামনে রেখে দুই হাত তুলে প্রার্থনা। মনে হচ্ছে আজ বিশ্বের ¯্রষ্টা মহান আল্লাহকে সামনে পেয়েছি। তিনি আমাদের সকল দুঃখ-বেদনার কথা শুনছেন। ক্ষমা করছেন যাবতীয় পাপরাশি। কবুল করছেন যাবতীয় কামনা-বাসনা। দোয়া শেষ করে সেই জান্নাতি কুয়া জমজমের সুস্বাদু পানি তৃপ্তি সহকারে পান করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম। এখানে বলা দরকার তা হচ্ছে কাবা ঘর দু-তিন চক্কর পর পরিচিত সবাইকে হারিয়েছি। শুধু মা ছাড়া। এখন সাফওয়া ও মারওয়া পাহাড়দ্বয় সাই করতে হবে। জিজ্ঞাসা করে জেনে নিলাম, মায়ের হাত ধরে এগিয়ে গেলাম। সাফা থেকে মারওয়া-মারওয়া থেকে সাফওয়া শুরু হলো দৌড়ানো। মনে হচ্ছে ইসমাইল (আ.) ও তার মাতা হাজেরা (আ.) পানির জন্য ছটফট করে শিশুপুত্র রেখে যেমনিভাবে দৌড়াতে ছিলেন। সাতবার সাই করতে আমাদের পরিচিত হজের সঙ্গী দিনাজপুরের খায়রুলের সঙ্গে দেখা। সে তার বৃদ্ধ মাকে নিয়ে সাই করছে। বললো, একটু অপেক্ষা করেন; একসঙ্গে হোস্টেলে যাব, কিছুক্ষণ পরে রওনা হলাম হোস্টেলের দিকে। পৌঁছে মাথা মু-ন করে গোসল করে ইহরাম খুলে ফেলে ফ্রেস হলাম। মায়ের মাথার চুল একটু কেটে দিলাম। বহু প্রতীক্ষার সেই কাবা ঘর দর্শন করে মা বললো, বাবা তুমি খুব ভাগ্যবান ছেলে আমার। তুমি জন্মের পরই আমাদের যত উন্নতি। তুমি আমাকে আল্লাহর রহমতে যা দেখালে, যা আমার বাবা-মাও দেখেনি। আল্লাহ তোমার কল্যাণ করুন। আমার ছোট ভাই-বোনদের জন্য দোয়া করলেন। কিছুক্ষণ পর তাহাজ্জুদ আযান। আবারও কাবা ঘর দর্শনে রওনা। গিয়ে তাহাজ্জুদ পড়ে জিকির-আজকার করে ফজরের নামাজ পড়ে এসে বিশ্রাম নিলাম। এখানে হজের গুরুত্ব ও তাৎপর্যের কথা লিখতে পারছি না। হজের বিষয়গুলো অন্যদিন লিখব ইনশাআল্লাহ। তবে মক্কায় একটি সেমিনারের কথা উল্লেখ করতে চাই। একদিন রাসূল (সা.)-এর বাড়ি মা আমেনার ঘরে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ এক ভদ্রলোক নাম মাছুম। তার সাথে পরিচয় হলো, তার নাম্বার দিল। সেই মক্কার উম্মুল কোরাআন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছে। পরিচয় হয়ে দেখলাম সে আমার পরিচিত। ঢাকাতে তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। দেখলাম আমার সাথে তার ঘনিষ্ঠতা, আপনাকে হজের পর একটি সেমিনারে যেতে হবে। হজের পর ১৪/১০/১৪ ইং তারিখে বন্ধুর একিউএম মাছুম বিল্লাহ মজুমদারের আহ্বানে মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি শাখায় দারুল হাদীস আল খাইরিয়া মিলনায়তনে মাগরিবের আগেই সেমিনারে যোগ দিলাম। সেমিনারটি সৌদি সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীনে মক্কা শরিফের আর রোসাইফা দাওয়া সেন্টারের উদ্যোগে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সৌদি সরকারের রাজকীয় বোর্ডের পরামর্শদাতা শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুতলাফ, ড. ফয়সাল, তাওয়াসুল প্রোগামের আহ্বায়ক ড. হাশেম আল আহদাল, প্রোগ্রাম চিফ মাজেদ আল কোরাইশীসহ বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, ঘানা, নাইজেরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সেনেগাল, মালয়েশিয়া, আইভরিকোস্ট, তুর্কি, বুরগীনি, পাচুসহ বিশ্বের প্রায় ৩০/৩৫টি রাষ্ট্রের ইসলামী গবেষক, আলেম, চিন্তাবিদরা উপস্থিত ছিলেন। বিষয় ছিল “আল জাছাদুল ওয়াহেদ” এক দেহ। অর্থাৎ বিশ্বের সকল মুসলিম, একটি দেহের মতো। কারণ আমাদের কোরআন একটি, আমাদের নবী একটি, আমাদের আল্লাহ এক। তাই আমাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ রাখা উচিত নয়। বিশ্বের সকল মুসলমানদের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেমিনারে এহরামের কাপড়, চশমা, চাদরসহ প্রায় ১৫টি আকর্ষণীয় পণ্যভর্তি ১টি ব্যাগ অংশগ্রহণকারী সকলকে প্রদান করে। এই সেমিনারে অংশগ্রহণ আমার জীবনে চিরস্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবে।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment