সংশোধনীয় ভ্রান্ত ধারণাসমূহ

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

মূল: শায়খ সাইয়্যেদ মুহাম্মদ আলূয়ী মালেকী আল-হাসানী (রহ:)

অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

[Bengali translation of Shaykh Muhammad Alawi Maliki al-Hasani’s book “Notions that must be corrected” as found in Suraqah Abdul Azeez’s English translation] 

বঙ্গানুবাদকের আরয

الحمد لله والصلاة والسلام على رسول الله سيد المرسلين رحمة العالمين راحة العاشقين مراد المشتاقين حبيبنا وطبيبنا سيدنا مولانا محمد صلى الله عليه وسلم وعلى آله واهله وأصحابه وأولياء أمته وعلماء ملته أجمعين. أما بعد.  

হারামাইন শরীফাইনের মহান আলেমে হক্কানী-রব্বানী শায়খ সাইয়্যেদ মুহাম্মদ আলূয়ী মালেকী আল-হাসানী (রহ:) সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। ‘সংশোধনীয় ভ্রান্ত ধারণাসমূহ’  (‘মাফা-হীমু ইয়াজিবু আন্ তাসোয়াহ্হাহা’) শীর্ষক এ বইয়ে তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত পেশ করা হয়েছে। বস্তুতঃ তিনি বইটিতে মুসলমান সমাজে বিরাজমান নানা বিভ্রান্তি নিরসন করেছেন। তবে তিনি যেহেতু সউদী আরব রাষ্ট্রের নাগরিক, সেহেতু ওই দেশের রাজা-বাদশাহদের প্রশংসা তাঁকে করতে হয়েছে। বলা বাহুল্য যে, সউদী রাজাদের রাষ্ট্রীয় নীতির কারণেই কিন্তু ওই সব বিভ্রান্তি মুসলমান সমাজে দানা বেঁধেছে। শায়খ আলাউয়ী (রহ:) যেসব সমস্যার প্রতিকারে এ বই লেখেছেন, সেই ফিতনা ও ফাসাদ-ই সউদী সরকারি মোল্লা-পুরোহিতবর্গ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রচার করে থাকে। এমতাবস্থায় পাঠকমণ্ডলীর দৃষ্টি এদিকে আকর্ষণ করা যথাযথ বিবেচনা করেছি আমি। বিষয়টি মাথায় রেখে সবাই বইটি পড়লে উপকৃত হবেন বলে আমি মনে করি।

উৎসর্গ: পীর ও মোর্শেদ হযরতুল আল্লামা সৈয়্যদ এ, জেড, এম, সেহাবউদ্দীন খালেদ আল-কাদেরী আল-চিশ্তী (রহ:)-এর পুণ্যস্মৃতিতে…..  

অনুবাদকের ভূমিকা

আমি সর্বপ্রথম ‘সংশোধনীয় ভ্রান্ত ধারণাসমূহ’ বইটির দেখা পাই বেশ কিছু বছর আগে; ওই সময় আমার মধ্যেও বদ্ধমূল ছিল সেই একই ভ্রান্ত কিছু ধারণা, যেগুলো সম্পর্কে আমাদের সম্মানিত লেখক উল্লেখ করেছেন তাঁর এ বইতে। অনেক সাল পরে আল্লাহতা’লা আমাকে এই বইটির কাছে ফেরার সামর্থ্য দান করেন, তবে তা প্রতিপক্ষ হিসেবে নয়, বরঞ্চ একজন অতি নগণ্য শিক্ষার্থী হিসেবে, যে শিক্ষার্থী বইয়ের লেখকের লেখনী ও আধ্যাত্মিক মকাম (মর্যাদাপূর্ণ পর্যায়) হতে (ঐশী) কল্যাণ ও উপকার গ্রহণ করেন। শায়খ মুহাম্মদ আলাউয়ী মালেকী (রহ:) যেসব ভ্রান্ত ধারণা সংশোধনের প্রয়াস পেয়েছেন, তার ধারক বেশির ভাগ মানুষ-ই নেক তথা সৎ নিয়্যত-সম্পন্ন এবং তারা আল্লাহর ধর্মের জন্যে গভীর উৎসাহ-উদ্দীপনা অন্তরে রাখেন। ধর্মীয় নির্মলতা ও সরলতা অন্বেষণে তারা এমন কিছু লোকের কথায় কান দিয়েছেন, যারা সবচেয়ে উচ্চ কণ্ঠে কথা বলে এবং অন্যদের প্রতি পথভ্রষ্টতা (গোমরাহী), কুফর (অবিশ্বাস) ও বেদআত (নতুন প্রথা প্রবর্তন)-এর বিশেষণ (ফতোওয়া) আরোপ করে। আল্লাহতা’লার করুণায় এবং এ জাতীয় বইপত্রের মাধ্যমে আশা করা যায় যে এজতেহাদ তথা স্বাধীন শরয়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়গুলো, যেগুলোতে উলামাবৃন্দ পারস্পরিক ভিন্নমত পোষণ করেছেন, সেসব বিষয়ে ওপরোক্ত ওইসব মানুষ অন্যদেরকে গোমরাহী ও কুফরীর দোষারোপ করার ক্ষেত্রে নিজেদের ভ্রান্তি সম্পর্কে উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন। 

আমরা আশা ও প্রার্থনা করি, এই দীর্ঘ প্রতীক্ষিত অনুবাদ পশ্চিমা বিশ্বেও আমাদের মুসলমান সমাজে শেকড় গেড়ে বসা বহু ভ্রান্ত ধারণাকে সংশোধনের ক্ষেত্রে একই প্রভাব ফেলবে। আল্লাহ পাক লেখক, তাঁর পরিবার ও ছাত্রছাত্রীবৃন্দকে আশীর্বাদ করুন, এবং তাঁদেরও করুন যাঁরা এই মহাকীর্তিকে আন্তর্জাতিক ভাষায় রূপান্তর করতে সহায়তা করেছেন। 

বিশ্বজগতের প্রভু আল্লাহতা’লারই প্রতি সমস্ত প্রশংসা। 

“পুণ্যবান আউলিয়াকে ভালোবাসি, যদিও তাঁদের মধ্য হতে আমি নই, 

যাতে তাঁদের সুপারিশ অর্জনে সাফল্যমণ্ডিত হই,

কিন্তু আমি ঘৃণা করি (ঐশী) আনুগত্য হতে যারা বিপথগামী,

এমন কী যদি আমায়ও করা হয় একই মামলায় আসামি।” [ভাবানুবাদ] 

সুরাক্বাহ আবদুল আযীয

২৩ শে আগস্ট, ২০০৮

প্রকাশকের ভূমিকা

বিশ্বজগতের মহাপ্রভু আল্লাহতা’লার প্রতি সমস্ত প্রশংসা জানাই। অতঃপর সালাত-সালাম জানাই আমাদের আকা ও মওলা হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি এবং তাঁর পরিবার-পরিজন, সাথীবৃন্দ ও তাঁদের পদাঙ্ক অনুসারীদের প্রতিও।

হেজায অঞ্চলে আহলুস্ সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের প্রথিতযশা লেখক ও সূফী, শায়খ সাইয়্যেদ মুহাম্মদ বিন আলাউয়ী আল-মালেকী আল-হাসানী (রহ:) প্রণীত ‘সংশোধনীয় ভ্রান্ত ধারণাসমূহ’ শিরোনামের প্রসিদ্ধ বইটির দীর্ঘ প্রতীক্ষিত অনুবাদ অবশেষে পেশ করতে পেরে আমরা গৌরবান্বিত বোধ করছি। শায়খের লেখা সমস্ত বইয়ের মধ্যে সম্ভবতঃ এই বইটা-ই সেরা, যেটা ‘মাফা-হীমু এয়াজিবু আন্ তাসোয়াহ্হাহা’ নামে অধিক খ্যাত এবং যেটা আমাদের যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমসাময়িক ইসলামী বই হওয়ার যথোপযুক্ত প্রসিদ্ধি অর্জন করেছে।

এই বইয়ের প্রকাশনায় সাহায্য করার জন্যে আমরা আল্লাহতা’লার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। সাথে সাথে যাঁরা একাজে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, তাঁদেরকেও জানাচ্ছি ধন্যবাদ। এ বইটি পাঠ করে উপকার লাভকারীদের প্রতি আমাদের অনুরোধ, আমাদেরকে যাঁরা এ মহৎ কাজে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন তাঁদের জন্যে যেন আপনারা দোয়া করেন। 

আমরা প্রার্থনা করি আল্লাহ পাক যেন শায়খ সাইয়্যেদ মুহাম্মদ আলাউয়ী মালেকী (রহ:)-এর রূহ মোবারকের প্রতি আপন আশীর্বাদ বর্ষণ করেন; তাঁর পিতা সাইয়্যেদ আলাউয়ী মালেকী (রহ:)-এর প্রতিও তা করেন; আর তাঁর প্রপিতা সাইয়্যেদ আব্বাস মালেকী (রহ:)-এর প্রতিও তা করেন। আল্লাহতা’লা যেন তাঁদের বংশকে জারি রাখেন। 

— সুন্নী পাবলিকেশন্স, রটারড্যাম, হল্যান্ড

লেখক পরিচিতি

হিজরী ১৩৬৭ সালে শায়খ সাইয়্যেদ মুহাম্মদ বিন আলাউয়ী মালেকী (রহ:)-এর জন্ম। মহানবী (দ:)-এর পৌত্র হযরত ইমাম হাসান (রা:)-এর বংশধর শায়খ সাইয়্যেদ মুহাম্মদ আলাউয়ী (রহ:) পুণ্যবান উলামাবৃন্দের এক দীর্ঘ বংশীয় পরম্পরায় শুভাগমন করেন, যাঁদের আদি নিবাস মরক্কো অঞ্চলে। তাঁর প্রপিতা শায়খ সাইয়্যেদ আব্বাস আল-মালেকী (রহ:) উসমানীয় তুর্কী শাসনামলে মক্কা মোয়াযযমা’র মুফতী ও (মসজিদে) হারাম শরীফের ইমাম ছিলেন এবং সউদী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনের সময়কালেও তিনি ওই পদ ধরে রাখেন। তাঁর পিতা সাইয়্যেদ আলাউয়ী (রহ:) মক্কা নগরীর শীর্ষস্থানীয় মালেকী মাযহাবের আলেম ও চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় যাবত হারাম শরীফে শিক্ষক ছিলেন। 

শায়খ মুহাম্মদ আলাউয়ী (রহ:)-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষক ছিলেন তাঁরই মহান পিতা, তবে তিনি বিশ্বের অন্যান্য শিক্ষকদের কাছ থেকেও জ্ঞান শিক্ষা করেন। এঁদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত সর্ব-শায়খ মুহাম্মদ নূর সাইফ, মুহাম্মদ আল-মাশা‘ত, মুহাম্মদ আমীন আল-কুতবী, হাসান ফাদ’আক্ব, মুহাম্মদ আল-হা’ফেয আল-তিজা’নী, আহমদ রিদওয়া’ন, আবদুল হালীম মাহমূদ, সা’লেহ আল-জা’ফরী, সাঈদ এয়ামানী ও মুহাম্মদ যা’কী ইবরা’হীম। শায়খ মুহাম্মদ আলাউয়ী (রহ:) মিসরের জামেউল আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও হাদীস-শাস্ত্রের ওপর পিএইচডি সনদপ্রাপ্ত।

শায়খ আলাউয়ী (রহ:) সারা জীবন তাঁর পিতার মতোই ইয়েমেন রাজ্যের ‘বা-আলাউয়ী’ উলামাদের সাথে বিশেষভাবে সম্পর্ক বজায় রাখেন। তাঁর বাবার বেসালের পরে মক্কা মোয়াযযমার উলামাবৃন্দ হারাম শরীফে শিক্ষক হিসেবে স্থলাভিষিক্ত করার জন্যে তাঁকে মনোনীত করেন। তিনি মক্কার উম্মুল ক্বুরা’ বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষকতা করেন এবং নিজ আবাসস্থলে নিজস্ব বিদ্যালয় চালু করেন। বিভিন্ন বিষয়ে তিনি অসংখ্য বইপত্র লেখেন। সারা বিশ্বে ধর্মীয় সভা-সমাবেশ ও মাহফিলে তিনি যোগদান করেন এবং পৃথিবীর অন্যতম সেরা সম্মানীয় ও প্রিয় আলেম হন। এই মহান পুণ্যাত্মা তাঁর প্রভুর সান্নিধ্যে ১৪২২ হিজরী সালের ১৫ই রমযান তারিখে প্রত্যাবর্তন করেন। তাঁর লক্ষ লক্ষ ভক্ত ও গুণগ্রাহী তাঁরই নামাযে জানাযা’য় অংশগ্রহণ করেন এবং আরো বহু জন তাঁর তিরোধানে শোকাহত হন। আল্লাহ তাঁকে আশীর্বাদ মঞ্জুর করুন। 

সূচিপত্র

শায়খ হাসানাইন মুহাম্মদ মাখলূফ (রহ:)-এর প্রারম্ভিক মন্তব্য

মুখবন্ধ

জরুরি বিজ্ঞপ্তি

এ বইয়ে উদ্ধৃত হাদীসের বিবরণ প্রসঙ্গে

প্রথম অধ্যায়: আক্বীদা-বিশ্বাসের বিভিন্ন বিষয়

তাকফির (কুফর) ও দালালাত (পথভ্রষ্টতা)-সম্পর্কিত বর্তমানকালের নানা অভিযোগের মানদণ্ডে প্রাপ্ত দূষণ

তাকফিরের দায়-দায়িত্বহীন অভিযোগ উত্থাপন হতে সতর্কীকরণ

শায়খ মুহাম্মদ ইবনে আবদিল ওয়াহহাবের এতদসংক্রান্ত অবস্থান

এসম্পর্কে শায়খ ইবনে আবদিল ওয়াহহাবের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পত্র

কোনো মুসলমানকে হেয় করা দূষণীয় এবং তাঁর সাথে যুদ্ধ করা কুফর (অবিশ্বাস)

স্রষ্টার মক্বাম ও সৃষ্টির মক্বাম

সৃষ্টির মক্বাম

এই দুই মক্বামের মাঝে শরীক হওয়া বিষয়গুলো যা ঐশী সর্বশ্রেষ্ঠত্বের পরিপন্থী নয়

যৌক্তিক উপমা ও এর ব্যবহার

ঈমান ও কুফরের মানদণ্ডে আলঙ্কারিক অংশ উপলব্ধির প্রয়োজনীয়তা

বান্দাদের প্রতি কর্মের দায় আরোপের বাস্তবতা

বিভিন্ন দায় আরোপের ভিত্তিতে এর অর্থের পার্থক্য

প্রশংসা: এবাদত ও আদব/শিষ্টাচারের মধ্যকার পার্থক্য

শির্ক (অংশীবাদ)-এর মাধ্যম

সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম

এক মিথ্যের বস্ত্রাবরণ

উত্তম নতুন প্রচলন ও মন্দ নতুন প্রচলনের মধ্যকার পার্থক্য

ঐশী বিধানভিত্তিক নতুন প্রচলন ও ভাষাগত নতুন প্রচলনের মধ্যকার পার্থক্য নির্ণয়ের প্রয়োজনীয়তা

ঐশী বিধানানুযায়ী অনুশীলনের প্রতি সূফীবাদী ইমামবৃন্দের আহ্বান

আশ’আরী ইমামবৃন্দ

গবেষণায় যেসব তথ্য হারিয়ে গিয়েছে

তাওয়াসসুল  (অসীলা গ্রহণ) সম্পর্কে উপলব্ধি

তাওয়াসসুল সম্পর্কে ঐকমত্যের বিষয়াদি

মুসলমানদের পালিত তাওয়াসসুলের প্রামাণ্য দলিল

মহানবী (দ:)-এর শুভাগমনের আগে তাঁর তাওয়াসসুল

পয়গম্বর আদম (আ:)-এর পালিত তাওয়াসসুল-সম্পর্কিত হাদীসের সমর্থনকারী অন্যান্য হাদীস

এই অনন্যতার অর্থের ব্যাপারে ইবনে তাইমিয়ার সংশোধনী

ইবনে তাইমিয়ার মতামতের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ যা তার অনুসারীদের মস্তিষ্কে অনুপস্থিত

রাসূলুল্লাহ (দ:) প্রবেশ না করা পর্যন্ত বেহেশত নিষিদ্ধ

হুযূর পাক (দ:)-এর নাম মোবারকের সাথে বিশ্বজগতের সংশ্লিষ্টতা

মহানবী (দ:)-এর মাধ্যমে ইহুদীদের তাওয়াসসুল

নবী করীম (দ:)-এর যাহেরী জিন্দেগীতে ও বেসাল শরীফে পালিত তাওয়াসসুল

আরেকটি উদাহরণ এবং ইবনে তাইমিয়ার এটাকে সমর্থন দান

নিষ্ফল অপচেষ্টা

শেষ বিচার দিবসের ময়দানে মহানবী (দ:)-এর মাধ্যমে তাওয়াসসুল

ইবনে তাইমিয়ার গৃহীত পদ্ধতির নিরিখে তাওয়াসসুলের বৈধতা

মহানবী (দ:)-এর তাওয়াসসুলের বৈধতা সম্পর্কে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:) ও ইবনে তাইমিয়ার সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি

শওকানীর দৃষ্টিতে তাওয়াসসুলের বৈধতা

মুহাম্মদ ইবনে আব্দিল ওয়াহহাব তাওয়াসসুলের অনুমতি দেন

শায়খ নজদী কর্তৃক তাওয়াসসুল পালনকারীদেরকে কাফের ফতোয়া দানের অভিযোগকারীদের প্রতি অস্বীকৃতির ঘোষণা

মহানবী (দ:)-এর ব্যক্তিগত পবিত্র স্মৃতিচিহ্নগুলোর তাওয়াসসুল

আম্বিয়া (আ:)-বৃন্দের ব্যক্তিগত পবিত্র স্মৃতিচিহ্নগুলোর তাওয়াসসুল

হুযূর পূর নূর (দ:) ও আম্বিয়া (আ:) এবং পুণ্যবান বান্দাদের হক্ক (অধিকার) দ্বারা তাওয়াসসুল

রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর কৃত তাওয়াসসুল সেসব বান্দাদের হক্কের খাতিরে যাঁরা প্রার্থনা করেন

মা আয়েশা (রা:)-এর নির্দেশে মহানবী (দ:)-এর রওযার মাধ্যমে তাওয়াসসুল

মা আয়েশা (রা:) এবং হুযূর (দ:)-এর রওযা শরীফ সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি

হযরত উমর (রা:)-এর খেলাফত আমলে নবী করীম (দ:)-এর রওযার তাওয়াসসুল

এয়ামা-মা দিবসে রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর মাধ্যমে মুসলমানদের তাওয়াসসুল

রোগ-ব্যাধি ও কঠিন পরিস্থিতিতে নবী পাক (দ:)-এর তাওয়াসসুল

মহানবী (দ:) ছাড়াও অন্যান্যদের তাওয়াসসুল

হযরত আব্বাস (রা:)-এর মাধ্যমে খলীফা উমর (রা:)-এর তাওয়াসসুলের অর্থ

আল-’উতবী ও তাওয়াসসুলের ঘটনা

রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর রওযার বাইরে ধাতুর গ্রিলের ওপর আল-’উতবী’র কাব্যের ছত্র

এক প্রত্যাখ্যাত সন্দেহ

মহানবী (দ:) শোনেন না, দেখেন না এবং আমাদের জানেনও না মর্মে অজ্ঞ লোকদের দাবি

তাওয়াসসুল সমর্থক মুসলমানদের ইমামবৃন্দ (রহ:)

মহানবী (দ:)-এর শাফায়াত অন্বেষণ করেন সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)

ইবনে তাইমিয়া কর্তৃক শাফায়াত-সংক্রান্ত আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা ও এ জীবনে মহানবী (দ:)-এর শাফায়াত কামনার অনুমতি প্রদান

’আপনারই এবাদত করি ও আপনার কাছেই সাহায্য চাই’ (আল-আয়াতের ব্যাখ্যা)

সাহায্য প্রার্থনা ও মহানবী (দ:)-এর কাছে আবেদন পেশ

আবূ হোরায়রা (রা:) কর্তৃক বিস্মরণ-প্রবণতার ব্যাপারে আবেদন পেশ

রাসূলুল্লাহ (দ:) আমাদের ভিত্তিস্তম্ভ, আশ্রয়ের কেন্দ্রবিন্দু ও সাহায্য

হামযা (রা:) সৎকর্মশীল ও মুসিবত দূরকারী

একটি মিথ্যে দাবি

যে জিনিস একমাত্র আল্লাহ মঞ্জুর করতে পারেন তা কারো কাছ থেকে চাওয়া কি শির্ক?

’যখন তুমি চাইবে আল্লাহর কাছেই চাও, আর যখন সাহায্য প্রার্থনা করবে তখন তাঁরই কাছে সাহায্য প্রার্থনা কোরো’

’চাইলে আল্লাহর কাছেই চাও’

’আমার কাছ থেকে সাহায্য চাওয়া যাবে না’

এসব অভিব্যক্তি যেটাকে তারা মূর্তিপূজা ও গোমরাহী বলে দাবি করে সে সম্পর্কে ইবনে আব্দিল ওয়াহহাবের দৃষ্টিভঙ্গি

উপসংহার

দ্বিতীয় অধ্যায়: নবুওয়্যত-সম্পর্কিত গবেষণা

মহানবী (দ:)-এর অনন্য ও বিশেষ গুণাবলী, নবুওয়্যতের বাস্তবতা, মানবের বাস্তবতা ও বরযখ বা পরকালীন জীবনের বাস্তবতা সম্পর্কে ব্যাখ্যা

নবুওয়্যতের অনন্য গুণাবলী ও এতদসংক্রান্ত বিষয়ে উলামাবৃন্দের দৃষ্টিভঙ্গি

ইবনে তাইমিয়া ও নবুওয়্যতের বৈশিষ্ট্যাবলী

ইবনে কাইয়্যেম আল-জাওযিয়্যা এবং মহানবী (দ:)-এর আরশে উপবিষ্ট হওয়ার বিষয়

কাশশা-ফ আল-ক্বিনা’ এবং বিস্ময়কর অনন্য গুণাবলী

বেহেশত যদি মায়ের পদতলে হতে পারে, তাহলে বেহেশত কেন মহানবী (দ:)-এর আজ্ঞাধীন হবে না?

বেহেশতে প্রবেশের জন্যে সম্পত্তি-দলিল তাঁরই হাতে ন্যস্ত

‘আমার ব্যাপারে অতিরঞ্জন কোরো না’

আম্বিয়া (আ:)-বৃন্দ মানব-সুরতবিশিষ্ট, কিন্তু…..

তাবাররুক (আশীর্বাদ) গ্রহণ সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি

মহানবী (দ:)-এর পবিত্র রক্ত মোবারক হতে আশীর্বাদ গ্রহণ

এতদসংক্রান্ত বিষয়ে উলামাবৃন্দের বক্তব্য

মহানবী (দ:)-এর স্পর্শ যাঁরা পেয়েছেন, তাঁদের হস্ত মোবারক চুম্বন দ্বারা বরকত (আশীর্বাদ) আদায়

হুযূর (দ:)-এর জুব্বা মোবারক হতে বরকত আদায়

তাঁর হাত মোবারক যেসব বস্তু স্পর্শ করেছে, সেগুলো হতে বরকত আদায়

তাঁর ব্যবহৃত পানির পাত্র ও নামায পড়ার জন্যে গমনকৃত মসজিদ হতে বরকত আদায়

মহানবী (দ:)-এর পদচিহ্ন হতে বরকত আদায়

আশীর্বাদধন্য বসতঘর হতে বরকত আদায়

রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর মিম্বর হতে আশীর্বাদ গ্রহণ

তাঁর মহাসম্মানিত রওযা মোবারক হতে বরকত আদায়

আম্বিয়া (আ:)-বৃন্দ, নেককার পুণ্যাত্মা ও অতীতকালের বুযূর্গদের ব্যক্তিগত স্মৃতিচিহ্নগুলো হতে বরকত আদায়

সর্ব-হযরত মূসা (আ:) ও হারূন (আ:)-এর ঐশী সিন্দুক হতে বরকত আদায়

মসজিদুল ’আসহা’র হতে বরকত আদায়

আমরা মহানবী (দ:)-এর আশীর্বাদধন্য

ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহ:) বরকত অন্বেষণ করেছেন এবং ইমাম যাহাবী তাঁকে সমর্থন করেছেন

উপসংহার

তৃতীয় অধ্যায়: গবেষণার বিভিন্ন বিষয়

রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর যেয়ারত এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিষয়, যেমন স্মৃতিচিহ্ন হতে বরকত আদায়, মাযার-রওযা যেয়ারত ও বিশেষ দিন উদযাপন

বরযখ-জীবন হচ্ছে বাস্তব

বরযখ জীবনে আম্বিয়া (আ:)-বৃন্দের অনন্য বৈশিষ্ট্যাবলী

আম্বিয়া (আ:)-বৃন্দের মাযার-রওযায় তাঁদের আদায়কৃত নামায ও অন্যান্য এবাদত-বন্দেগী

আমাদের মহানবী (দ:)-এর বিশেষ (বরযখ) জীবন

’এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)’ বলে যে ব্যক্তি আহ্বান করেন, তাঁর ডাকে হুযূর পাক (দ:) সাড়া দেন

বাহক মারফত রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর প্রতি সালাত-সালাম পেশ

মহানবী (দ:)-এর পাক রওযায় সালাম ও আযান শোনা যাওয়ার ঘটনা

এসব ঘটনার প্রতি ইবনে তাইমিয়ার সমর্থন

আম্বিয়া (আ:) ভিন্ন অন্যান্যদের বেলায়ও এরকম অলৌকিক ঘটনার সত্যতা স্বীকার

’সফর করো না’ (মাযার/রওযার দিকে)

ইবনে তাইমিয়ার মতে মাযার/রওযা যেয়ারত মসজিদ যেয়ারতের সমান

একটি উপকারী বিশ্লেষণ

ইমাম মালেক (রহ:) ও মাযার/রওযা যেয়ারত

হাম্বলী ও অন্যান্য উলামা-মণ্ডলী কর্তৃক মহানবী (দ:)-এর রওযা যেয়ারতের প্রতি সমর্থন

আমাদের মহানবী (দ:)-এর যেয়ারত ও এতদুদ্দেশ্যে রওযা অভিমুখে সফরের বৈধতা প্রসঙ্গে সালাফ আস্ সালেহীন ইমাম-মণ্ডলীর বাণী

সালাফ আস্ সালেহীন কর্তৃক মহানবী (দ:)-এর রওযা শরীফ যেয়ারত

রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর যেয়ারত সম্পর্কে ইবনে কাইয়েম আল-জাওযিয়া

হুযূর পূর নূর (দ:)-এর মহাসম্মানিত রওযা

রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর রওযা মোবারক ও (সেখানে কৃত) প্রার্থনা

ইবনে তাইমিয়ার অভিমত

ইবনে তাইমিয়ার বক্তব্যের বিশ্লেষণ

মাযার/রওযায় কৃত প্রার্থনা সম্পর্কে মুহাম্মদ ইবনে আব্দিল ওয়াহহাবের মত: ‘মাযারে প্রার্থনা বেদআত নয়, কুফর-ও নয়’

মহানবী (দ:)-এর রওযা বা (তা আচ্ছাদনের) কাপড় চুম্বন কিংবা ছুঁয়ে বরকত আদায়

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রা:)-এর মতামত

মহানবী (দ:)-এর রওযা পাক কুফর ও মূর্তিপূজো হতে ঐশীভাবে রক্ষাপ্রাপ্ত

নবুওয়্যতের স্মৃতিচিহ্ন ও ধর্মীয় পবিত্র স্থান পরিদর্শন ও তা হতে বরকত আদায়

মাযার/রওযা ও স্মৃতিচিহ্নের প্রতি গুরুত্বারোপ

অতীতের পয়গম্বর (আ:)-বৃন্দের স্মৃতিচিহ্নের প্রতি আল-কুরআনে প্রদত্ত গুরুত্ব

চার খুলাফায়ে রাশেদীন (রা:) ও তাঁদের দ্বারা মহানবী (দ:)-এর আংটির হেফাযত

চার খুলাফায়ে রাশেদীন (রা:) ও তাঁদের দ্বারা মহানবী (দ:)-এর বর্শার হেফাযত

হযরত উমর (রা:) কর্তৃক হযরত আব্বাস (রা:)-এর জল-প্রণালী সংরক্ষণ, যেহেতু হুযূর (দ:) তা স্থাপন করেছিলেন

স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণের ব্যাপারে হযরত উমর (রা:) একা নন

হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) ও প্রাচীন স্মৃতিচিহ্ন

নবী করীম (দ:)-এর স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণের ব্যাপারে হযরত উমর (রা:)-এর ঈর্ষা

মহানবী (দ:)-এর স্যান্ডেলের প্রতি গুরুত্বারোপ ও সেগুলোর ব্যাপারে পরিচালিত গবেষণা

ওই স্মৃতিচিহ্নের প্রতি সৌদি রাজ্যের প্রদত্ত গুরুত্ব

ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্নের সংরক্ষণ

মসজিদ ও এবাদতের স্থানসমূহ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিচিহ্ন

নগর পরিকল্পনা, (ভবন) পুনঃনির্মাণ ও ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন

মহানবী (দ:)-এর ঘর ও সম্মানিত মসজিদ

হুযূর (দ:)-এর ঘরের ব্যাপারে প্রদত্ত ইবনে আব্দিল ওয়াহহাবের ফতোয়া

সবুজ গুম্বজ সম্পর্কে ইবনে আব্দিল ওয়াহহাবের অভিমত

বাদশাহ ফাহাদ বিন আব্দিল আযীযের পত্রে রাসূল (দ:)-এর স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণের প্রতি গুরুত্বারোপ

মাহফিল/সমাবেশ সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি

মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপন সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি

সোয়াইবিয়ার দাসত্ব থেকে মুক্তির ঘটনা

এই গবেষণার সার-সংক্ষেপ

উপসংহার

সংযোজনী – ১: নির্দিষ্ট কিছু ভ্রান্ত ধারণার প্রতি জবাব

সংযোজনী – ২: বিভিন্ন উলামা-এ-কেরামের অনুমোদন

গ্রন্থপঞ্জি

উলামাবৃন্দের সমর্থন

১/ – শায়খ মুহাম্মদ আল-খাযরাজী, সংযুক্ত আরব আমিরাত

২/ – ড: মুহাম্মদ আল-তাইয়্যেব আল-নাজ্জার, মিসর

৩/ – সাইয়্যেদ আবদুল্লাহ গুয়েনন আল-হাসানী, মরক্কো

৪/ – ড: হাশিম আল-হুসাইনী, মিসর

৫/ – ড: রা’উফ শিবলী, মিসর

৬/ – সাইয়্যেদ ইউসুফ হাশিম আল-রেফাঈ, কুয়েত

৭/ – ড: আবদ্ আল-ফাততাহ বারাকা, মিসর

৮/ – ড: আহমদ উমর হাশিম, মিসর

৯/ – শায়খ মুহাম্মদ আল-সিনরাউয়ী, মিসর

১০/- ড: আবদ্ আল-গনী আল-রাজিহী, মিসর

১১/ – সাইয়্যেদ আহমদ আল-আওয়াদ আল-মাদানী, সুদান

১২/ – শায়খ মুহাম্মদ মালিক আল-কানদাহলাভী, পাকিস্তান

১৩/ – শায়খ মুহাম্মদ উবায়দুল্লাহ মুফতী, পাকিস্তান

১৪/ – শায়খ আবদ আল-রাহমান, পাকিস্তান

১৫/ – শায়খ হামিদ মিয়াহ বিন মুহাম্মদ মিয়াহ, পাকিস্তান

১৬/ – ড: আবদ্ আল-রাযযাক্ব ইসকানদার, পাকিস্তান

১৭/ – শায়খ মুহাম্মদ ইউসুফ বিননূরী, পাকিস্তান

১৮/ – সাইয়্যেদ মুহাম্মদ আবদ্ আল-ক্বাদির আযাদ, পাকিস্তান

১৯/ – শায়খ নাফীস্ আল-হুসাইনী, পাকিস্তান

২০/ – শায়খ মুহাম্মদ আবদুল গনী, পাকিস্তান

২১/ – শায়খ আলী আসগর, পাকিস্তান

২২/ – শায়খ মুহাম্মদ আবদ্ আল-ওয়াহিদ, পাকিস্তান

২৩/ – ড: হাসান আল-ফাতিহ ক্বারীবুল্লাহ, সুদান

২৪/ – শায়খ আহমদ আবদ্ আল-গাফূর আত্তার, সৌদি আরব

২৫/ – শায়খ ইউসুফ বিন আহমদ আল-সিদ্দীকী, বাহরাইন

২৬/ – সাইয়্যেদ আহমদ বিন মুহাম্মদ যাবারা, ইয়েমেন

২৭/ – সাইয়্যেদ ইবরাহীম বিন উমর বিন আক্বীল, ইয়েমেন

২৮/ – শায়খ আসাদ বিন হামযা বিন আবদ্ আল-ক্বাদির, ইয়েমেন

২৯/ – শায়খ আহমদ দাউদ, ইয়েমেন

৩০/ – সাইয়্যেদ আবদ্ আল-হাদী আজীলী, ইয়েমেন

৩১/ – শায়খ মুহাম্মদ হাযযাম আল-মুক্বরিমী, ইয়েমেন

৩২/ – শায়খ আহমদ আলী আল-ওয়াসাবী, ইয়েমেন

৩৩/ – সাইয়্যেদ মুহাম্মদ বিন সুলাইমান, ইয়েমেন

৩৪/ – শায়খ আবদ আল-কারীম বিন আবব্দিল্লাহ, ইয়েমেন

৩৫/ – শায়খ হুসাইন বিন আবদিল্লাহ আল-ওয়াসাবী, ইয়েমেন

৩৬/ – শায়খ সাইয়্যেদ মুহাম্মদ আলী আল-বাত্তাহ, ইয়েমেন

৩৭/ – মুফতী মুহাম্মদ আলী মুকরিম, ইয়েমেন

৩৮/ – শায়খ মুহাম্মদ বিন আলী আল-মানসূর, ইয়েমেন

৩৯/ – শায়খ মুহাম্মদ আল-শাযিলী আল-নায়ফুর, তিউনিশিয়া

৪০/ – শায়খ মুহাম্মদ ফা‘ল আল-বানানী, মৌরিতানিয়া

৪১/ – শায়খ মুহাম্মদ সালিম আদ্দূদ, মৌরিতানিয়া

৪২/ – শায়খ মুহাম্মদ আযীয আল-রাহমান, পাকিস্তান

৪৩/ – শায়খ আবূ যায়দ ইবরাহীম সাইয়্যেদ, মিসর

৪৪/ – শায়খ মুহাম্মদ আবদ আল-ওয়াহিদ আহমদ, মিসর

৪৫/ – শায়খ ইবরাহীম আল-দাসূক্বী মারী, মিসর

৪৬/ – শায়খ হুসাইন মাহমূদ মু’আওওয়াদ, মিসর

৪৭/ – শায়খ আবদ আল-সালাম জিবরান, মরক্কো

৪৮/ – শায়খ সীদী আল-ফারূকী আল-রাহহালী, মরক্কো

৪৯/ – শায়খ সাইয়্যেদ আবদুল্লাহ আল-গুমারী, মরক্কো

৫০/ – শায়খ সাইয়্যেদ আবদ আল-আযীয আল-গুমারী, মরক্কো

৫১/ – সাইয়েদ মুহাম্মদ বিন আলী আল-হাবাশী, ইন্দোনেশিয়া

৫২/ – হাবীব আবদ্ আল-ক্বাদির আল-সাক্বক্বাফ, ইয়েমেন

শায়খ হাসানাইন মুহাম্মদ মাখলূফ (রহ:)-এর প্রারম্ভিক মন্তব্য

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজগতের প্রভু আল্লাহতা’লারই প্রাপ্য। সালাত-সালাম বর্ষিত হোক আমাদের আকা ও মওলা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের প্রতি, তাঁর পরিবার, সাথীবৃন্দ ও অনুসারীদের প্রতিও। মূল আলোচনায় আসা যাক: মহান আলেম ও গবেষক, শিক্ষক ও সাইয়্যেদ, (শায়খ) মুহাম্মদ আলাউয়ী মালেকী (রহ:)-এর এই অসাধারণ গ্রন্থে উল্লেখযোগ্য বিষয়াদির পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ও মঙ্গলকর গবেষণার দিকগুলোও বিদ্যমান; যা এ আধুনিক যুগের মুসলমানদের জন্যে উপকারী হিসেবে প্রমাণিত হবে। এই জমানায় দ্বীন-ইসলামের খেদমত আঞ্জাম দান এবং ইসলামী আক্বীদা-বিশ্বাসকে সুসংহতকরণ, আর মহানবী (দ:) তাঁর উম্মতকে যা আঁকড়ে ধরতে তাকিদ দিয়েছিলেন, তার দিকে অন্যান্যদেরকে আহ্বান জানানোর ক্ষেত্রে মুসলমানদের একান্ত প্রয়োজন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত ও সার্বিক সিদ্ধান্তসমূহের (ফতোয়ার) প্রতি দৃঢ় সমর্থন ব্যক্তকরণ এবং ব্যাপক প্রচার দ্বারা সেগুলোর দিকে সবাইকে আহ্বান। এটা এমন-ই এক সময় যখন দ্বীন-ইসলামকে অনেক শত্রু আক্রমণ করছে, যারা এ ধর্ম ও এর অনুসারীদের বিরুদ্ধে বিভ্রান্ত নীতি এবং মিথ্যে দাবিকে সাহায্য-সহায়তা করার উপায় খুঁজছে। আল্লাহতা’লা এই মহান আলেম (ও এ বইয়ের লেখক)-কে সাফল্যমণ্ডিত করে, তাঁর আহ্বান ছড়িয়ে দিয়ে ও সেটার (অর্থাৎ, আহ্বানের) বিষয়বস্তুর সত্যতা প্রতিপাদন করে তাঁকে সাহায্য করে, এবং প্রকৃত হেদায়াত ও নির্ভুল জ্ঞানের বিমূর্ত প্রতীক এসব চমৎকার বিদ্যা, মূল্যবান ফায়দা ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদির দিকে অন্যদেরকে পরিচালিত করে আপন মুসলমান বান্দাদের প্রতি নিজ নূরকে পূর্ণতা দেবেন। এটা নিশ্চয় বড় একখানা আমন্ত্রণের দ্বার উন্মোচন করবে যা মতপার্থক্য, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, আত্মম্ভরিতা ও (পাল্টাপাল্টি) প্রতিযোগিতাকে রহিত করবে।

এই বইয়ে অন্তর্ভুক্ত গবেষণার বিভিন্ন বিষয়গুলো দেখে স্পষ্ট বোধগম্য হয় যে এগুলো শক্ত ও নির্ভরযোগ্য দলিল, আর সত্যনিষ্ঠ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও। মুসলমানদের জন্যে এতে নিহিত রয়েছে সম্মান ও মহত্ত্ব এবং এটা এমন-ই এক অনুসন্ধান যা (লেখকের প্রতি) আস্থা পূরণ করে। এ বইটির প্রচার-প্রসার ইসলামের প্রতি মর্যাদাকর বলে বিবেচিত হবে এবং শত্রুদের চক্রান্ত নস্যাতের উপলক্ষ হবে।

এই বইয়ের লেখক, আল্লাহ তাঁকে হেফাযত করুন, বিভিন্ন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ স্পষ্ট করার জন্যে অনেক কষ্ট স্বীকার করেছেন। বইটিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি সম্পর্কে জ্ঞানদীপ্ত আলোচনা করেছেন এবং গভীর অনুসন্ধান চালিয়েছেন। তিনি সবাইকে সঠিক ও স্পষ্ট ধারণা দিয়ে সচেতন করে তুলেছেন এবং প্রতিটি ভ্রান্ত ধারণা ও ভুল ব্যাখ্যার প্রতি জবাব দিয়েছেন: এগুলোর সবই তিনি করেছেন দুশমনদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে এবং মুসলমানদের রাজ্যগুলোতে প্রকৃত সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে। তাঁর বইয়ে, সত্যের দিকে তাঁর এ আহ্বানে এবং তাঁর অটল লেখনীধারায় গবেষণার যেসব দিক রয়েছে, সেগুলো নিম্নরূপ:

মুসলমানদের প্রতি তাকফিরের দায়-দায়িত্বহীন অভিযোগ উত্থাপন হতে সতর্কীকরণ: এই অধ্যায়ে লেখক সেই এজমা’ তথা উলামাবৃন্দের ঐকমত্য সম্পর্কে উদ্ধৃতি দিয়েছেন, যা’তে আহলে ক্বিবলা তথা মুসলমানদের প্রতি কুফর/অবিশ্বাসের দোষারোপ করা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে।

স্রষ্টার মক্বাম ও সৃষ্টির মক্বামের পার্থক্যকরণ: ইসলাম ও কুফরের মধ্যে এটা মীমাংসাকারী মানদণ্ড বা মাপকাঠি।

যৌক্তিক উপমা: ঈমানদারি ও অবিশ্বাসের বিষয়াদিতে এটাকে বিবেচনায় নিতে হবে এবং এবাদত (উপাসনা) ও আদব (শিষ্টাচার)-এর ক্ষেত্রে এটা ভারসাম্যপূর্ণ হতে হবে।

স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে মধ্যস্থতাকারী: এই অধ্যায়ে লেখক মূর্তিপূজাসূচক মধ্যস্থতার বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন।

বেদআত ও উলামাবৃন্দ কর্তৃক এর শ্রেণিকরণ: এই অধ্যায়ে লেখক বেদআত (ধর্মে প্রবর্তিত নতুন প্রথা) সম্পর্কে সঠিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং উলামামণ্ডলী কীভাবে এর শ্রেণিকরণ করেছেন তাও দেখিয়েছেন; আর ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী ও সংকীর্ণ অন্তরের লোক, যারা প্রতিটি নতুন বিষয়ের বিরোধিতা করে এবং উপকারী ও অভিনব বিষয়ের সমালোচনা করে, তাদের কাছে স্পষ্ট ব্যাখ্যাও দিয়েছেন।

আশ’আরী-মণ্ডলী: লেখক এই অধ্যায়ে আশ’আরী (আকীদা-বিশ্বাসগত) মাযহাবকে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট কতিপয় ইমাম সম্পর্কে উল্লেখও করেছেন; আর যারা তাঁদের প্রতি গোমরাহীর তীর ছুঁড়ে থাকে, তাদের প্রতি তিনি আল্লাহকে ভয় করার আহ্বান জানিয়েছেন।

তাওয়াসসুলের (মধ্যস্থতা গ্রহণের) বাস্তবতা: যে তাওয়াসসুল সম্পর্কে (উলামা-মণ্ডলীর) ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এই অধ্যায়ে লেখক তা ব্যাখ্যা করার পাশাপাশি পয়গম্বর আদম (আলাইহিস্ সালাম) কর্তৃক মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের তাওয়াসসুল সম্পর্কেও ব্যাখ্যা করেছেন। এ বিষয়ে তিনি অনেক মূল্যবান বাণী উদ্ধৃত করেছেন এবং হুযূর পূর নূর (দ:)-এর তাওয়াসসুলের বৈধতার পক্ষে ইবনে তাইমিয়া, মুহাম্মদ ইবনে আব্দিল ওয়াহহাব ও শওকানীর সমর্থনসূচক মতামত-ও তুলে ধরেছেন। এই অধ্যায়ে গবেষণা শেষে তিনি তাওয়াসসুলকে অনুমোদনকারী মহান ইমামবৃন্দের মধ্যে বিখ্যাত কয়েকজনের নাম-ও উল্লেখ করেছেন।

শাফাআত: এই অধ্যায়ে তিনি শাফাআতের বাস্তবতা, প্রিয়নবী (দ:)-এর কাছ থেকে কীভাবে সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) তাঁর সুপারিশ কামনা করতেন এবং এতদসংক্রান্ত ক্বুরআনের আয়াতগুলো সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়্যার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন।

সাহায্য প্রার্থনার সঠিক উপলব্ধি: এই বইয়ের দ্বিতীয় এ অংশে লেখক রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর কাছ থেকে সাহায্য প্রার্থনার সঠিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন এবং এতদসংক্রান্ত বিষয়ে কিছু ভুয়া দাবিরও জবাব দিয়েছেন। এতে তিনি নবুওয়্যতের অনন্য বৈশিষ্ট্যাবলী, নবুওয়্যত ও মানব-সুরতের বাস্তবতা, এবং বরযখ তথা পরকালীন (রূহানী) জীবনের উপলব্ধি সংক্রান্ত মূল্যবান গবেষণার কথা উল্লেখ করেছেন।

পৃথক একটি অধ্যায়ে লেখক বরকত আদায় তথা আশীর্বাদ লাভের ব্যাপারে এবং মানুষের মাঝে এবিষয়ে (প্রচলিত) ভ্রান্ত ধারণা ও তার বাস্তবতা সম্পর্কেও আলোকপাত করেছেন। বইটির তৃতীয় অংশে তিনি বিবিধ বিষয়ে কথা বলেছেন, যেগুলো গবেষকদের তৃষ্ণা মেটাবে। এতে তিনি প্রিয়নবী (দ:)-এর রওযা মোবারক যেয়ারতের বৈধতা ও এতদসংক্রান্ত অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। ‘সফর কোরো না…’ শীর্ষক হাদীসটির সঠিক ব্যাখ্যা ও উপলব্ধি এবং যেয়ারতে নববী (দ:)-এর বৈধতা ও এতদসংক্রান্ত বিষয়াদির পক্ষে সালাফ আস্ সালেহীন ইমামবৃন্দের বাণীও তিনি তুলে ধরেছেন। বইয়ের এই অংশে তিনি পুলক-সৃষ্টিকর এমন গবেষণা উপস্থাপন করেছেন, যা রাসূল (দ:)-এর স্মৃতিচিহ্ন, এগুলোর প্রতি প্রদর্শিত সম্মান ও যত্ন, অতীতের পয়গম্বর (আ:)-বৃন্দের স্মৃতিচিহ্নের প্রতি প্রদর্শিত শ্রদ্ধা এবং সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) কীভাবে মহানবী (দ:)-এর স্মৃতিচিহ্নগুলোর প্রতি যত্ন নিতেন, সেসব বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট। লেখক ধর্মীয় সভা-সমাবেশ ও মীলাদুন্নবী (দ:) সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি কী হবে তা এতে ব্যাখ্যা করেছেন এবং (আবূ লাহাবের দাসী) সোয়াইবিয়ার মুক্তির ঘটনা ও উলামা-মণ্ডলী এটাকে কীভাবে বুঝেছেন, তা-ও উল্লেখ করেছেন।

এটা বইয়ের বিভিন্ন বিষয়বস্তুর একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা মাত্র। লেখক শায়খ মুহাম্মদ আলাউয়ী মালেকী হাসানী (রহ:)-কে হারামাইন শরীফাইন (মক্কা মোয়াযযমা ও মদীনা মোনাওয়ারা)-এর একজন বিশিষ্ট আলেম হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং তিনি খোদায়ী (ঐশী) জ্ঞানের সাগর ও রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর সুন্নাহ-বিষয়ক বিদ্যায় বিজ্ঞজন। তিনি ইসলামী জ্ঞানভিত্তিক নানা সভা-সমাবেশের আয়োজন করে থাকেন এবং তাতে সুন্নাহ-বিষয়ক পাঠদান-ও করেন; এগুলোতে যোগদান করে থাকেন ফায়দা ও কল্যাণ-অন্বেষী বিপুল সংখ্যক মানুষ।

শায়খ মুহাম্মদ আলাউয়ী মালেকী আল-হাসানী (রহ:) ইসলামিক ওয়ার্ল্ড লীগের মাধ্যমে অগণিত গবেষণা ও ধর্মশাস্ত্রীয় আইনবিষয়ক কাউন্সিলে অংশগ্রহণ করেছেন; অার এর পাশাপাশি তিনি নবী পাক (দ;)-এর সুন্নাহ’র প্রতি নিবেদিত অনেক ক্বুরঅান হেফয প্রতিযোগিতা ও কনফারেন্স-এও যোগদান করেছেন। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে ত্রিশটিরও বেশি গ্রন্থের প্রণেতা, যেসব বিষয়ের মধ্যে রয়েছে আল-ক্বুরআন ও এর অন্তর্ভূত শাস্ত্রসমূহ, হাদীস ও এর বিদ্যার শাখাসমূহ, মহানবী (দ:)-এর জীবনী (সীরাহ), ধর্মীয় ফতোওয়া ও পরামর্শ, এবং সামাজিক সংস্কার। এগুলোর সবই এই বইয়ের প্রতি গভীর মূল্যায়নের দাবি রাখে এবং মুসলমানদেরকে এটা পড়তে আর এরই ডাকে (অন্যদের) আমন্ত্রণ (দাও’আ) জানাতেও উৎসাহিত করে। ইসলামী বিশ্বের জন্যে এটা অবশ্য-পাঠ্য হওয়া উচিত; আর সুস্পষ্ট সত্য, সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ইসলামী ধর্মপ্রাণতা যা এতে নিহিত, তার জন্যে বইটি অধ্যয়ন এবং তা শিশুদের শিক্ষাদান করা উচিত। এই বই শত্রুদের পথভ্রষ্টতা, মিথ্যের বেসাতি ও ভুয়া দাবির মূলোৎপাটন করে; নিশ্চয় আল্লাহতা’লা তাঁর দ্বীনকে সহায়তার মাধ্যমে তাঁরই পুণ্যবান ও ন্যায়পরায়ণ বান্দাদেরকে সাহায্য করবেন। পরিশেষে, আমরা মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করি যেন তিনি সকল মুসলমানকে এই গবেষণাকর্ম পড়ার এবং এরই আহ্বানকে সহায়তা করার তৌফীক দেন (আমীন)। আমরা মওলার দরবারে আরো কামনা করি যেন তিনি বইটির লেখককে পুরস্কৃত করেন এবং ষড়যন্ত্র থেকে হেফাযত করেন (সূম্মা আমীন)। কেননা, ক্বুরআন মজীদ সত্য-ন্যায় ও ধর্মের প্রতি সহায়তাকারীর বিজয়ের খোশ-খবরী/সুসংবাদ দেয় এবং ধর্মের শত্রুদের মধ্যে মিথ্যের প্রতি আহ্বানকারীদের শোচনীয় পরাজয় বরণ ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিবরণ-ও প্রদান করে। বস্তুতঃ আল্লাহতা’লা-ই চূড়ান্ত সাফল্য মঞ্জুর করেন এবং তিনি-ই খাঁটি সত্যের দিকে পথপ্রদর্শন করে থাকেন।

হাসানাইন মুহাম্মদ মাখলূফ

সাবেক মিসরীয় মুফতী

সদস্য, সিনিয়র উলামা পরিষদ, আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়, মিসর

সদস্য, সিনিয়র উলামা পরিষদ, আল-আযহার

সদস্য, প্রতিষ্ঠাতা কাউন্সিল, ইসলামিক ওয়ার্ল্ড লীগ

বিজয়ী, বাদশাহ ফায়সাল ইসলামী দাও’আ সার্ভিস (সৌদি আরব)

নিশ্চিতকারী:

-শায়খ মুহাম্মদ বিন আহমদ বিন হাসান আল-খাযরাজী, সংযুক্ত আরব আমিরাত

-ড: মুহাম্মদ আল-তাইয়্যেব আল-নাজ্জার, মিসর

-শায়খ আবূ আল-ওয়াফা’ আল-তাফতাযানী, মিসর

-শায়খ মুহাম্মদ বিন আবদ্ আল-রাহমান আ’ল আল-শায়খ বিন সা’লিম, কমোরোস দ্বীপপুঞ্জ ইসলামী প্রজাতন্ত্র

-সাইয়্যেদ আলী বিন আবদ্ আল-রাহমান আল-হাশেমী আল-হাসানী, সংযুক্ত আরব আমিরাত

-ইমাম মূসা’ দায়ফুল্লাহ, চাদ

মুখবন্ধ

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজগতের প্রভু আল্লাহতা’লারই প্রাপ্য। সালাত-সালাম জানাই আমাদের আকা ও মওলা নবীকুলশ্রেষ্ঠ হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি, তাঁর পরিবারসদস্য ও সাথীবৃন্দের প্রতিও।

নিশ্চয় আল্লাহতা’লা আমাদের প্রতি অসংখ্য নেয়ামত মঞ্জুর করেছেন, যার মধ্যে সেরা ও সবচেয়ে সম্মানিত নেয়ামত হচ্ছে দ্বীন-ইসলাম; আর এটা কতোই না বড় নেয়ামত! অন্যান্য আশীর্বাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে আমাদের ভোগকৃত নিরাপত্তা, এদেশে (মানে সৌদি আরবে) বিরাজিত শান্তি ও সন্তোষ, ঐশী আদেশের শাস্তি বিধান করে পবিত্র ইসলাম ধর্মের আইনকানুন বাস্তবায়ন এবং আল্লাহর কিতাব ও রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর সুন্নাহ মোতাবেক বিচার প্রার্থনা। অর্থাৎ, এটা সম্ভব হয়েছে প্রথমতঃ ও সর্বাগ্রে আল্লাহতা’লার দয়ায়, আর এরপর সেসব শাসকের ব-দৌলতে, যাদেরকে আল্লাহ হারামাইন শরীফাইনের অভিভাবক স্থাপন করেছেন; অধিকন্তু যাদেরকে আল্লাহ এই দুটি নগরীর সেবা করার সাফল্য মঞ্জুর করেছেন; যারা হারামাইন শরীফাইনের সুরক্ষা প্রদান, নিরাপত্তা বিধান ও দেখাশোনা করার দায়িত্বভার দ্বারা সম্মানিত হয়েছেন এবং যারা এ লক্ষ্যে সর্বাত্মক প্রয়াস পেয়েছেন। [বঙ্গানুবাদকের নোট: আরব দেশের নাগরিক বলে শায়খ আলাউয়ী মালেকী (রহ:)-কে সৌদি শাসকদের প্রশংসা করতে হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত চিত্র জানতে হলে পড়ুন – 

http://kazisaifuddin.tumblr.com/post/86853238026/]

আল্লাহতা’লারই জন্যে সকল প্রশংসা বিহিত, কেননা শাসকবর্গ সাহায্য খুঁজে পেয়েছেন আন্তরিক ও বিশ্বস্ত মানুষদের পুত্রদের মাঝে, যে অনুগত মানুষেরা সত্যবাদিতার সাথে আনুগত্যের অঙ্গীকার করেছেন, আন্তরিকতার সাথে প্রতিশ্রুত চুক্তি রক্ষা করেছেন, আর শাসকদের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতিতে চুক্তির ওয়াদা পালনে সদা তৎপর থেকেছেন। আমাদের প্রকৃত ঈমানদারি ও সম্প্রদায় যা আমরা সুন্নাহ ও সালাফ আস্ সালেহীন (মানে পূর্ববর্তী পুণ্যাত্মাবৃন্দ) হতে প্রাপ্ত হয়েছি, তারই সূত্রে ওই অঙ্গীকার ও চুক্তির প্রতি অানুগত্য বজায় রেখেছি। আল্লাহতা’লার দয়ায় এই রাজ্যগুলো (সৌদি আরব) সব ধরনের ময়লা-আবর্জনা ও মূর্তিপূজো হতে মুক্ত আছে, ঠিক যেমনটি মহানবী (দ:) আমাদের জানিয়েছিলেন যখন-ই তিনি এরশাদ করেছিলেন:

لا يجتمع دينان في جزيرة العرب

অর্থ: “আরব উপদ্বীপে দুটি ধর্ম সহ-অবস্থান করবে না।” তিনি আরো এরশাদ ফরমান:

إن الشيطان قد أيس أن يعبد في جزيرتكم

অর্থ: “তোমাদের (আরব) উপদ্বীপে শয়তানকে যে আর কখনোে উপাসনা করা হবে না, এ ব্যাপারে সে হতাশাগ্রস্ত।”

রাসূলুল্লাহ (দ:) আরো এরশাদ করেন: 

اللهم لا تجعل قبري وثناً يعبد

অর্থ: “হে আল্লাহ! আপনি আমার রওযাকে উপাস্য মূর্তি হতে দেবেন না।” আর নিশ্চয় তাঁর এ দোয়া/প্রার্থনা ক্ববূল হয়েছে। তিনি বলেন:

إن أخوف ما أتخوف على أمتي الإشراك بالله .. أما أني لست أقول يعبدون شمساً ولا قمراً ولا وثناً، ولكن أعمالاً لغير الله وشهوة خفية 

অর্থ: “আমি আমার উম্মতের জন্যে সবচেয়ে বেশি আশঙ্কা করি যে জিনিসটি, তা হচ্ছে আল্লাহর সাথে শরীক স্থাপন। আমি বলি না তারা সূর্য, চাঁদ, অথবা মূর্তিপূজো করবে, বরঞ্চ এ শরীক স্থাপন হবে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো বা কিছুর খাতিরে এবং প্রসিদ্ধি লাভের জন্যে গোপন আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে আমল পালন” [ইবনে মাজাহ, যুহদ/কৃচ্ছ্বব্রত সংক্রান্ত বই]। তিনি আমাদের জানান যে এসব রাজ্য হবে ঈমানদারির শক্ত ঘাঁটি, আর এর অধিবাসীদের জন্যে হবে নির্জন আশ্রয়স্থল; অধিকন্তু, ঈমান যাঁরা অন্তরে ধারণ করেন, তাঁদের জন্যেও হবে আশ্রয়স্থল। মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান: “নিশ্চয় ঈমান মদীনায় প্রত্যাবর্তন করে থাকে, যেমনিভাবে সাপ ফেরে তার গর্তে।” বর্ণনান্তরে তিনি বলেন, “নিশ্চয় ঈমানদারি হেজায অঞ্চলে প্রত্যাবর্তন করে থাকে।”

এই দেশের ইমামবৃন্দ ও (রাষ্ট্রীয়) নেতৃত্ব প্রথম থেকেই এর অধিবাসীদের অন্তরে এ মতাদর্শ প্রোথিত ও প্রতিষ্ঠিত করতে কাজ করেছেন, যা আরম্ভ হয়েছে বাদশাহ আবদুল আযীয বিন সৌদ থেকে, যিনি এ রাজ্যকে ঐক্যবদ্ধ করেন, এর জনগণের মাঝে সংহতি আনেন, তাঁদের গোঁড়ামিপূর্ণ বিভক্তি অপসারণ করেন, আর জাতি-গোষ্ঠীগত বিভেদের দেয়াল-ও দূর করেন [বঙ্গানুবাদকের নোট: বাদশাহ আবদুল আযীয আরবে ওহাবীবাদের প্রতিষ্ঠাতা। এই লোক মদীনা মোনাওয়ারায় অবস্থিত প্রিয়নবী (দ:)-এর রওযা শরীফেও কামানের গোলা নিক্ষেপ করতে কুণ্ঠিত হয়নি। দেখুন – ‘ওহাবীদের প্রতি নসীহত’, ২য় খণ্ড, ৪৩১/২ পৃষ্ঠা 

http://www.mediafire.com/file/bq2wggqn8zfepfz/]। বাদশাহর মৃত্যুর পরে এদেশের অধিবাসীরা একমাত্র পারস্পরিক মিলমিশ ও ঐক্যের ভিত্তিতেই বসবাস করে আসছেন, আর তাঁদের বিষয়াবলী একটি ব্যানারের অধীনেই সরলীকৃত: ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ – অর্থাৎ, ‘নেই কোনো উপাস্য আল্লাহ ছাড়া, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম তাঁরই প্রেরিত রাসূল/পয়গম্বর।’ তাঁরা এর ভিত্তিতেই একত্রে বসবাস করে এসেছেন, যদিও তাঁদের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এবং আলাদা আলাদা উপলব্ধি; এটা একারণে যে তাঁদের ভিত্তি ও আনুগত্য ছিল একই, আর তাঁদের আনুগত্য সত্য, যা কর্তব্য বলে তাঁরা বিবেচনা করেছিলেন।

তবে কিছু বিদেশি দুর্বৃত্ত ও ক্রীড়নক যারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে পছন্দ করে, তারা বাস্তবতাকে পরিবর্তন করে অনৈক্য সৃষ্টি করতে অপতৎপর; আর তারাই বদমাইশির অভিপ্রায়ে কপট নয় এমন অনুগত মানুষদের গায়ে কলঙ্কলেপন করেছে। এভাবে তারা সেই দ্বার উন্মোচিত করেছে, যেটা খোলা মোটেও উচিত হয়নি এবং তারা মানুষের মনোযোগ এমন সব বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ করেছে, যা সম্পর্কে তাঁরা ইতিপূর্বে ছিলেন অনবধান। এমতাবস্থায় আমরা বলি, পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, আল্লাহতা’লার ওপরই (আমাদের) সমস্ত নির্ভরশীলতা এবং আমাদের শাসকদের সম্পর্কে রয়েছে আমাদের ভালো ধারণা, যারা বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী এবং মানুষের মাঝে আস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম এমর্মে যে মুসলমানদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি যাদের একমাত্র লক্ষ্য, সেসব কুৎসা রটনাকারী ও অনৈক্যের প্রতি আহ্বানকারীর কথাকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নেবেন না।

আমরা এই সুন্নী মুসলমান অধ্যুষিত দেশের ছায়ায় আছি, যেটা সঠিক ও নির্মল মতাদর্শকে সুরক্ষা দেয়, আর তা প্রচার-প্রসার ও দাওয়া’ কার্যক্রম সম্প্রসারণে প্রয়াস পায়। আমরা আছি তাওহীদ (একত্ব)-বাদী এক জাতির ছায়ায়, যারা জ্ঞান এবং এর বাহক ও এর প্রতি আহ্বানকারীদের সহায়তাকারী। এ জাতি জ্ঞানের সকল শাখায় ও দিকে বিদ্যাচর্চা ও বস্তুনিষ্ঠ গবেষণাকে উৎসাহিত করে, আর তারা গবেষকদের অকাতরে পুরস্কৃত-ও করে থাকেন – চাই তারা হোন মুসলমান বা অমুসলমান, সৌদি নাগরিক বা অ-সৌদি নাগরিক। ইসলামী দাওয়া’ ও প্রায়োগিক গবেষণার ক্ষেত্রে গবেষকদেরকে সহায়তা বা সমর্থন দেয়া হয় (কেননা জ্ঞানের পরিমাপ নিশ্চয় জ্ঞানের আপন খাতিরে নয়, বরং কর্ম দ্বারাই)। তারা বুদ্ধি ও মেধার আয়না মুছে পরিষ্কার করে, অন্তর্দৃষ্টিকে আলোকিত করে, আর বিদ্বান ও গবেষক উভয়ের অভিব্যক্ত ও অনুভূত ভাবনাকে তাদের সাথে ভাগাভাগি করার সুযোগ দেয়, পণ্ডিত-ব্যক্তি ও গবেষকদেরকে নিজেদের মতামত ও সমঝদারি প্রকাশ করার সুযোগ-ও করে দেয়। সত্য নির্ণয়ে এটা নিঃসন্দেহে অন্যতম শক্তিশালী পদ্ধতি, কেননা কোনো শক্তিশালী ও সুসংহত নাগরিক সমাজ গড়ে তোলার ভিত্তিগুলোর একটি হচ্ছে স্বচ্ছতা বা স্পষ্টতা। এধরনের কোনো সমাজ গড়ে তোলা যাবে না, যদি মানুষকে ইসলামী বা অন্য যে কোনো বিষয়ে তাঁদের মতামত ও উপলব্ধি প্রকাশের সুযোগ দেয়া না হয়। এই মূলনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে যাকে ইসলামের দাওআ’ কার্যক্রমে আঁকড়ে ধরতেই হবে।

ইসলাম ধর্ম এর শত্রুদেরকে অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করার সুযোগ দিয়েছে। আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান:

 وَإِنْ أَحَدٌ مِّنَ ٱلْمُشْرِكِينَ ٱسْتَجَارَكَ فَأَجِرْهُ حَتَّىٰ يَسْمَعَ كَلاَمَ ٱللهِ 

অর্থ: “এবং হে মাহবূব! যদি কোনো মুশরিক (অংশীবাদী/মূর্তিপূজারী) আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে, তবে তাকে আশ্রয় দিন, যাতে সে আল্লাহর বাণী শুনতে পায়।” [সূরা তওবা, ৬ আয়াত; মুফতী আহমদ এয়ার খাঁন কৃত ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’]

দ্বীন-ইসলাম প্রতিপক্ষ ও অস্বীকারকারীদের কাছে তাদের যে কোনো প্রশ্ন, বিরোধিতা, উপলব্ধি বা প্রামাণ্য দলিল প্রকাশেরও সুযোগ দিয়েছে। আল্লাহতা’লা বলেন,

 قُلْ هَاتُواْ بُرْهَانَكُمْ إِن كُنْتُمْ صَادِقِينَ 

অর্থ: “(হে হাবীব), আপনি বলুন, ‘(তোমরা) তোমাদের প্রমাণ পেশ করো, যদি সত্যবাদী হও’।” [সূরা বাক্বারা, ১১১ আয়াত]

আল্লাহতা’লা মূর্তিপূজারীদের মধ্যে কখনো ব্যক্তিবর্গ, আবার কখনো বিভিন্ন দলকে সম্বোধন করে তাদের কাছে এ দাবি করেছেন যে তারা ধর্মের বিষয়ে যেন অনুসন্ধান করে এবং গভীরভাবে চিন্তা-ও করে। ধর্মের বাস্তবতা ও ধর্মের দিকে আহ্বানকারী হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের বাস্তবতা-সংক্রান্ত সংলাপের খাতিরে এধরনের কর্মকাণ্ড সভা-সমাবেশের মাধ্যমে পরিচালনা করা যেতে পারে।

আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান:

قُلْ إِنَّمَآ أَعِظُكُمْ بِوَاحِدَةٍ أَن تَقُومُواْ لِلهِ مَثْنَىٰ وَفُرَادَىٰ ثُمَّ تَتَفَكَّرُواْ مَا بِصَاحِبِكُمْ مِّن جِنَّةٍ

অর্থ: “আপনি বলুন, ‘আমি তোমাদেরকে একটা উপদেশ দিচ্ছি যে আল্লাহর জন্যে দণ্ডায়মান থাকো দু’দু’জন এবং একা একা। অতঃপর চিন্তা করো…।” [সূরা সাবা, ৪৬ আয়াত]

না, এ দুটোর চেয়েও বড় বিষয় হলো, আল্লাহতা’লা প্রতিপক্ষকে সাহস যুগিয়েছেন সামনে এসে কথা বলতে এবং নিজেকে ও নিজের অনুভূতিকে প্রকাশ করতে, যাতে সে বুঝতে পারে যে তার অবস্থানে সে এক জীবন্ত সত্তা – যার নিজস্ব মস্তিষ্ককে বোঝা উচিত, আর অনুধাবন করা উচিত তার নিজস্ব অনন্য উপলব্ধিকেও। এ কথা বলার সাথে সাথে এ-ও বলা দরকার যে, ওই ধরনের কোনো ব্যক্তিকে বোঝা ও মূল্যায়ন করতে হলে তার সমঝদারি-ও অবশ্যঅবশ্য ফলদায়ক হতে হবে। মহান আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান:

وَإِنَّآ أَوْ إِيَّاكُمْ لَعَلَىٰ هُدًى أَوْ فِي ضَلاَلٍ مُّبِينٍ

অর্থ: “আর নিশ্চয় আমরা অথবা তোমরা হয়তো হেদায়াতের ওপর স্থিত, নতুবা প্রকাশ্য ভ্রান্তিতে পতিত” [সূরা সাবা, ২৪ আয়াত]। এটাই আল্লাহ পাক তাঁর মহানবী (দ:)-এর প্রতি আদেশ করেছেন সেসব মূর্তিপূজারীর সাথে আলাপ-আলোচনার সময় তাদেরকে জানাতে, যারা পাপী এবং সত্য-ধর্ম ও সুদৃঢ় নীতি-আদর্শ হতে বিচ্যুত। এমতাবস্থায় হুযূর পূর নূর (দ:) তাদের বলতেন:

وَإِنَّآ أَوْ إِيَّاكُمْ لَعَلَىٰ هُدًى أَوْ فِي ضَلاَلٍ مُّبِينٍ

অর্থ: “আর নিশ্চয় আমরা অথবা তোমরা হয়তো হেদায়াতের ওপর স্থিত, নতুবা প্রকাশ্য ভ্রান্তিতে পতিত”[সূরা সাবা’, ২৪]।

ওপরের আলোচনার আলোকে আমি, প্রিয় পাঠকমণ্ডলী, আপনাদের সামনে সুনির্দিষ্ট ইসলামী বিষয়াদি সংক্রান্ত এসব ধারণা উপস্থাপন করছি, যেসব বিষয়ে উলামাবৃন্দের মতপার্থক্য বিদ্যমান, যেগুলো সম্পর্কে কেউই এ কথা বলার অধিকার রাখে না যে ওইসব বিষয় সম্পর্কে উলামাবৃন্দের সর্বসম্মতি রয়েছে। উলামা ও ইসলামী চিন্তাবিদ এবং গবেষকদের কাছে এ ধারণাগুলো গবেষণা ও অনুসন্ধানের জন্যে পেশ করা একান্ত কর্তব্য। এ বইতে যা লেখা হয়েছে তা সঠিক হলে আমাকে সাফল্য মঞ্জুর করার জন্যে আল্লাহতা’লারই প্রতি সমস্ত প্রশংসা বিহিত। আর যদি এতে কোনো ভুলত্রুটি পাওয়া যায়, তাহলে তা আমারই এবং আমারই এজতেহাদী (গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্তে) ভ্রান্তি। এই বইয়ের উদ্দেশ্য হলো নির্দিষ্ট কিছু বাস্তবতা সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেয়া এবং নির্দিষ্ট কিছু ভুল ধারণার সংশোধন। সংস্কার ও সংশোধন এবং সঠিক বিষয়কে উদ্দেশ্য করা ছাড়া এ বই লেখায় আমাদের আর অন্য কোনো অভিপ্রায় নেই; কেননা আমরা কেবল-ই মানুষ, যারা কখনো কখনো সঠিক হই, আবার কখনো কখনো ভুল করে থাকি। আমাদের যে কারো অভিমত গৃহীত বা প্রত্যাখ্যাত হতে পারে, ব্যতিক্রম শুধু খোদায়ী মদদে রক্ষাপ্রাপ্ত ও ভুলত্রুটিমুক্ত আমাদের আকা ও মওলা, মালিক ও মোখতার হযরত রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম, যিনি নিজের কামনা-বাসনা হতে কথা বলেন না, বরঞ্চ তাঁর প্রতি অবতীর্ণ ওহী (ঐশী প্রত্যাদেশ)-ই প্রকাশ করেন মাত্র।

প্রতিটি বইতেই তথ্যের সংযোজন হতে পারে, অথবা সেটার কিয়দংশ বিয়োজন-ও হতে পারে, আবার হতে পারে কাট-ছাঁট বা সম্পাদনা-ও; এর ব্যতিক্রম শুধু আল্লাহর কেতাব (আল-ক্বুরআন), যার প্রতি কোনো প্রকার মিথ্যে আরোপ-ই করা যায় না; আর যে ব্যক্তি এর উল্টো দাবি করে, সে মিথ্যের উদ্ভাবনকারী এক জালিয়াত ছাড়া কিছু নয়। আমরা আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি যাতে আমরা তর্ক-বিতর্ক করার দুরভিসন্ধি নিয়ে জ্ঞান অন্বেষণকারীদের মধ্য হতে আবির্ভূত বলে সাব্যস্ত না হই, যেমনটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন:

من طلب العلم ليماري به السفهاء أو يكابر به العلماء أو يصرف به وجوه الناس إليه أدخله الله النار

অর্থ: “অজ্ঞদের সাথে তর্ক-বিতর্ক, আলেম-উলামাবৃন্দের প্রতি দাম্ভিক আচরণ, কিংবা মানুষের মনোযোগ নিজের দিকে আকর্ষণের উদ্দেশ্যে কেউ জ্ঞান অন্বেষণ করলে আল্লাহতা’লা তাকে জাহান্নামে ছুঁড়ে ফেলবেন।” [তিরমিযী]

আমাদের এই বইটি যে কোনো বইয়ের মতোই সংস্কৃত হতে পারবে। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহতা’লারই জন্যে বিহিত, আমি আমার লেখা যাবতীয় বইতেই এ কথা স্বীকার করে থাকি। উপসংহারে আমি বলি, আমার লেখনীতে মহান আল্লাহর কাছে আমি সাফল্য ও সারল্য যাঞ্চা করি। সঠিক লিখে থাকলে তা আল্লাহরই দান, আর ভুল হলে তা আমারই এজতেহাদী ত্রুটি। আমি আশা করবো, এ বইতে কেউ কোনো ভুল-ভ্রান্তি পেলে অনুগ্রহ করে আমাকে জানাবেন। উলামাবৃন্দ কখনোই একে অপরকে এভাবে শুধরে দেয়ার প্রক্রিয়াটি পরিহার করেননি। কোনো বই ব্যাপক সাড়া ও গ্রহণযোগ্যতা পেলে কেউই তা হতে জ্ঞান আহরণ করতে ইতস্ততঃ করেন না, শুধু দাম্ভিক প্রকৃতির লোক ছাড়া। অবশ্য যদি না সেই লোকের কাছে কোনো ব্যাখ্যা, দৃষ্টিভঙ্গি, প্রামাণিক দলিল বা দলিলের মতো দেখতে কিছু থেকে থাকে। সেক্ষেত্রে ওই ধরনের লোক (কোনো বিষয়বস্তুর প্রতি বিরোধিতার) অজুহাত প্রদর্শনে যদি অক্ষম হয়, তাহলে তার পক্ষে অন্তত চুপ থাকাটাই সমীচীন হবে। উলামাদের মধ্যে সংলাপ এই কারণেই স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত যে তাঁরা প্রতিপাদ্য বিষয়ে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেন, পারস্পরিক সমঝোতা অন্বেষণের মনোভাব বজায় রাখেন, আর এর পাশাপাশি বিবেকবান হন এবং মহান প্রভু আল্লাহতা’লার প্রতি ভয় অন্তরে লালন করেন। তাঁদের নিয়্যত তথা উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহতা’লার পবিত্রতা উপলব্ধি করা, সেদিকে পথপ্রদর্শন করা এবং তা সমর্থন করা; আর মানুষের হাতগুলো ধরে তাদেরকে কল্যাণের দিকে পরিচালনা করা। এ সকল আলেম-ই পয়গম্বর (আ:)-বৃন্দের উত্তরাধিকারী। আমি মহান প্রভু আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদেরকে ভুলত্রুটির উৎস থেকে সরিয়ে সহজ, সরল পথে পরিচালিত করেন। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা এবং দোয়াপ্রার্থীদের প্রার্থনা ক্ববূলকারী। আল্লাহ ছাড়া আমার সহায় কেউ নেই।

মুহাম্মদ বিন আলাউয়ী আল-মালেকী আল-হাসানী 

প্রথম অধ্যায়: আক্বীদা-বিশ্বাসের বিভিন্ন বিষয়

তাকফির (কুফর) ও দালালাত (পথভ্রষ্টতা)-সম্পর্কিত বর্তমানকালের নানা অভিযোগের মানদণ্ডে প্রাপ্ত দূষণ

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

তাকফিরের দায়-দায়িত্বহীন অভিযোগ উত্থাপন হতে সতর্কীকরণ

দ্বীন-ইসলাম হতে কারোর খারিজ বা বেরিয়ে যাওয়ার প্রকৃত কারণগুলো এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে কুফর বা অবিশ্বাসের ফতোওয়া জারির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধির ক্ষেত্রে অনেক মানুষ-ই ভুল করে থাকেন, আল্লাহ তাদের সংশোধন করুন। এমন ব্যক্তিদেরকে আপনারা দেখবেন কোনো মুসলমান কর্তৃক পবিত্র শরঈ আইনের সামান্য একটু লঙ্ঘনের দায়ে তাঁকে কাফের বা অবিশ্বাসী সাব্যস্ত করতে, আর এটা তাদেরকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যায় যে (তাদের দৃষ্টিতে) পৃথিবীতে কয়েকজন ছাড়া কোনো মুসলমান-ই অবশিষ্ট থাকেন না। তাদের প্রতি সৎ চিন্তা হতে আমরা অজুহাত খুঁজি এবং বলি: হয়তো তাদের নিয়্যত ভালো এ উদ্দেশ্যে যে তারা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করছেন; তবে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে তারা যে বিষয়টি ভুলে গিয়েছেন, তা হচ্ছে এই দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন জ্ঞান-প্রজ্ঞা সহকারে ও উত্তম প্রেরণাদানের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হয়।

ভালো কাজের আদেশ দিতে যদি যুক্তিতর্কের প্রয়োজন হয়, তাহলে তা সর্বোত্তম উপায়ে উপস্থাপন করতে হবে, যেমনটি আল্লাহতা’লা ঘোষণা করেন: 

 ٱدْعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِٱلْحِكْمَةِ وَٱلْمَوْعِظَةِ ٱلْحَسَنَةِ وَجَٰدِلْهُم بِٱلَّتِي هِيَ أَحْسَنُ

“(আপনি) আপন রব্বের পথের দিকে আহ্বান করুন পরিপক্ক কলা-কৌশল ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে ওই পন্থায় তর্ক করুন, যা সর্বাধিক উত্তম হয়” [সূরা নাহল, ১২৫ আয়াত]। এটাই গ্রহণীয় হওয়ার সম্ভাবনা বেশি এবং কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনেরও অধিকতর নিকটবর্তী। এর বিরোধিতা করা ভ্রান্তি এবং নির্বুদ্ধিতা-ও।

অতএব, কোনো মুসলমান যিনি নামায পড়েন, আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মান্য করেন, আপন ধর্মের প্রতি দাওআত কার্যক্রম পরিচালনা করেন এবং মসজিদ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন, এমতাবস্থায় আপনি যা সত্য বলে বিশ্বাস করেন তাঁকে যদি সেটার প্রতি আহ্বান করেন আর তিনি যদি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নেন, অধিকন্তু (ইসলামী উলামাবৃন্দের) মতামত যদি ওই বিষয়টির পক্ষে বা বিপক্ষে স্মরণাতীতকাল হতে বিভক্ত থাকে, অতঃপর তিনি যদি আপনার মতামত না মানেন এবং এ সামান্য মতপার্থক্যের কারণে আপনি যদি তাঁকে কাফের বলে দোষারোপ করেন, তাহলে আপনি মহা এক মন্দ কাজ করবেন এবং এমন এক দুঃখজনক বিষয়ের অবতারণা করবেন যা থেকে আল্লাহ আপনাকে বারণ করেছেন, আর এর পরিবর্তে জ্ঞান ও সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে (গঠনমূলক) সমালোচনা করতে আদেশ করেছেন।

আল্লামা ও ইমাম সাইয়্যেদ আহমদ মাশহূর আল-হাদ্দাদ বলেন:

“উলামাবৃন্দ একমত হয়েছেন যে আহলে ক্বিবলা তথা মুসলমান সমাজের অন্তর্ভুক্ত কাউকে কুফর বা অবিশ্বাসের দোষারোপ করা অবৈধ; ব্যতিক্রম শুধু সেসব বিষয়ের ক্ষেত্রে যেখানে সর্বশক্তিমান স্রষ্টা ও শান-শওকতের মালিক আল্লাহতা’লাকে অস্বীকার করা হয়, অথবা তা’বিল বা ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার সম্ভাবনাহীন স্পষ্ট শির্ক তথা মূর্তিপূজার চিহ্ন বিরাজমান হয়, কিংবা নুবুওয়্যতকে অস্বীকার করা হয়, বা দ্বীনের জরুরি বিষয়াদিকে অস্বীকার করা হয়, কিংবা একাধিক এসনাদে (সনদে) বর্ণিত আহাদীস তথা মহানবী (দ:)-এর বাণী ও বিশুদ্ধ রওয়ায়াতকে অগ্রাহ্য করা হয়, অথবা দ্বীনের জরুরি অংশ হিসেবে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত বিষয়াদিকেও অস্বীকার করা হয়। তওহীদ (আল্লাহর একত্ব), রেসালাত, মহানবী (দ:)-এর শেষ নবী হওয়ার বিষয়, শেষ বিচার দিবসে পুনরুত্থান, হিসেব, পুরস্কার ও দণ্ড, বেহেশত ও দোযখ ইত্যাদি দ্বীনের অপরিহার্য বলে জ্ঞাত বিষয়াদি কেউ অস্বীকার করলে সে কাফের; আর এ ব্যাপারে অজ্ঞতার জন্যে কোনো মুসলমানেরই ওজর-আপত্তি খাটবে না; ব্যতিক্রম শুধু সদ্য ধর্ম ক্ববূলকারী নও-মুসলিম। তিনি এসব বিষয় না শেখা পর্যন্ত মাফ পাবেন; অতঃপর তাঁকেও তাঁর অজ্ঞতার জন্যে মাফ করা হবে না।

তাওয়াতুর হচ্ছে এমন বিশুদ্ধ বর্ণনা যা (মুসলমান সমাজের) একটি বড় দল বিচ্ছুরণ করে থাকেন, যাঁদের ব্যাপক জনশ্রুতিপূর্ণ বিবরণ কোনো মিথ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদেরই প্রকৃতিগত সম্ভাবনাকে নিরুদ্ধ করে, আর যাঁরা পালাক্রমে তাঁদেরই অনুরূপ পরবর্তী প্রজন্মের আরেকটি দলের কাছে সেসব বর্ণনা হস্তান্তর করেন। এটা (অর্থাৎ, তাওয়াতুর) হয় এক বর্ণনা-পরম্পরা যেমনটি ঘোষিত হয়েছে হাদীসে:

من كذب عليَّ متعمدًا فليتبوأ مقعده من النار

অর্থ: ‘যে কেউ ইচ্ছেকৃতভাবে আমার প্রতি মিথ্যে আরোপ করে, সে যেন জাহান্নামকে নিজের আবাসস্থল বানিয়ে নেয়’, নয়তো বিকল্পস্বরূপ একটি গোটা প্রজন্ম কর্তৃক প্রদত্ত বর্ণনা, যেমন আল-ক্বুরআনের বিষয়টি, যেটা প্রজন্মসমূহ হেফয/মুখস্থ করেন, তেলাওয়াত/আবৃত্তি করেন এবং পৃথিবীর পূর্ব হতে পশ্চিমে শিক্ষাদান করেন, যাতে কেউ অন্য কারো কাছ থেকে তা গ্রহণ করতে পারেন; আর তাই এটার (মানে আল-ক্বুরআনের) ক্ষেত্রে বর্ণনা-পরম্পরার প্রয়োজনই পড়েনি।

“ব্যাপক জনশ্রুতির বর্ণনাসমূহ কর্মের মাধ্যমেও প্রচার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা হতে পারে কোনো এক উপায়ে রাসূল (দ:)-এর বাণী প্রচারের যুগ হতে বর্তমানকাল পর্যন্ত বর্ণিত কোনো কর্মের ব্যাপক জনশ্রুতিপূর্ণ বিবরণ-ও। উপরন্ত, এটা হতে পারে মহানবী (দ:)-এর মো’জেযা তথা অলৌকিকত্বের মতো কোনো (বিশেষ) জ্ঞানসম্পর্কিত ব্যাপক জনশ্রুতিপূর্ণ বিবরণ-ও। ব্যক্তি পর্যায়ে এসব বিবরণের কিছু কিছু আহাদ বা একক সনদে (পরম্পরায়) বর্ণিত হয়েছে; তবে এগুলোর সমস্তকে সার্বিকভাবে একত্রিত করলে ব্যাপক জনশ্রুতিমূলক বর্ণনার মান অর্জন করে, যা প্রত্যেক মুসলমানের জন্যে চূড়ান্ত জ্ঞানের মৌল উপাদান গঠন করে থাকে।

“আমরা ওপরে যেসব (কুফর ও দালালাতের) বিষয় উল্লেখ করেছি, সেগুলো ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে কোনো মুসলমানকে অবিশ্বাসী বলে বিচার করা নিশ্চয় এক বিপজ্জনক ব্যাপার। একটি হাদীস শরীফে ঘোষিত হয়েছে:

إذا قال الرجل لأخيه يا كافر فقد باء بها أحدهما

অর্থ: কেউ যদি তার (মুসলমান) ভাইকে ’ওহে কাফের’ বলে ডাকে, তাহলে এটা (বাক্যটি) তাদের কোনো একজনের ওপর গিয়ে পড়ে [হযরত আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে আল-বুখারী]

“এই বিষয়টির বিচার এভাবে হওয়া সঠিক নয়; এটা শুধু সেই দ্বীনী আলেম-ই করতে পারেন যিনি পবিত্র ধর্মশাস্ত্রীয় আইনের আলোকে কুফর তথা অবিশ্বাসের নাড়িনক্ষত্র জানেন, যিনি মহৎ এ ধর্মের বিধানে আরোপিত অবিশ্বাস ও ঈমানদারির স্পষ্ট সীমারেখা সম্পর্কেও ওয়াকেফহাল।

“যাচাই-বাছাই ছাড়া, নিশ্চিত না হয়ে এবং সুগভীর জ্ঞান ব্যতিরেকে মাঠে ছুটে গিয়ে অন্য কাউকে স্রেফ ধারণা ও সন্দেহের ভিত্তিতে কুফরের দোষারোপ করার অনুমতি কারোরই নেই। নতুবা (গালাগাল/দোষারোপের) এই প্রবল জলধারা (ইসলামের) উপত্যকাটিকে প্লাবিত করবে এবং অল্প কিছু সংখ্যক মুসলমান ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনো মুসলমান-ই অবশিষ্ট থাকবে না। অনুরূপভাবে, কারো ঈমানের দুটি সাক্ষ্যের (মানে তওহীদ ও রেসালাত-বিষয়ক সাক্ষ্যের) প্রতি বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও (আমলের ক্ষেত্রে) আনুগত্যহীনতা তথা অনুশীলনশূন্যতার কারণে তার প্রতি কুফরের দোষারোপ করাও অনুমতিপ্রাপ্ত নয়। হযরত আনাস (রা:) বর্ণিত এক হাদীসে মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান,

ثلاث من أصل الإيمان الكف عمن قال : لا إله إلا الله لا نكفره بذنب ولا نخرجه عن الإسلام بالعمل ، والجهاد ماض منذ بعثني الله إلى أن يقاتل آخر أمتي الدجال لا يبطله جور جائر ولا عدل عادل والإيمان بالأقدار

অর্থ: ‘তিনটি বিষয় ঈমানের ভিত্তিমূল হতে নিঃসৃত: (১) যে ব্যক্তি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলে তার ক্ষতি না করা। আমরা কাউকে তার কোনো পাপের কারণে কুফরের দোষারোপ করি না কিংবা কোনো কর্মের ভিত্তিতে ইসলাম থেকে বহিষ্কার করি না; (২) আল্লাহ আমাকে যখন প্রেরণ করেছেন তখন থেকে জ্বিহাদ (পবিত্র সংগ্রাম/সাধনা) অস্তিত্বশীল আছে, আর তা-ই থাকবে যতোক্ষণ না আমার উম্মতের শেষ দলটি দজ্জালের সাথে যুদ্ধ করবে। এটা অপরাধীর অপরাধ বা ন্যায়পরায়ণের ন্যায়বিচারের দরুন অচল হবে না; এবং (৩) ঐশী বিধানের প্রতি বিশ্বাস।’ [আবূ দাউদ]

“কুফর (অবিশ্বাস) হিসেবে বিবেচ্য হওয়া উচিত এমন সব অভিব্যক্তিকে কুফর নয় এমন অভিব্যক্তি হতে পৃথক করতে যদি আমাদের বলা হয়, তাহলে আমরা জবাবে বলবো যে এটা আশা করা একদম নিরর্থক; কেননা এটা অনেক নাগালের বাইরের বিষয় এবং কণ্টকাকীর্ণ পথ, যা’তে জড়িত রয়েছে খোদ ‘তওহীদ’ (কালাম)-শাস্ত্রের ভিত্তিসমূহ; কেউ এই বিদ্যার চূড়ান্ত শিখরে আরোহণ করতে না পারলে তারই কুফর-বিষয়ক মানদণ্ডের ন্যায্যতা প্রতিপাদন করার ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য কোনো কিছুতে সে পৌঁছুতে সক্ষম হবে না।

“এই কারণেই ইতোমধ্যে ওপরে স্পষ্ট ব্যাখ্যাকৃত বিষয়গুলো ছাড়া কেউ দায়িত্বহীনভাবে অন্যদেরকে অবিশ্বাসের অভিযোগে অভিযুক্ত করার ব্যাপারে সতর্কীকরণে আমরা কড়াকড়ি করে থাকি। এটা ভীষণ বিপজ্জনক একটা বিষয়, আর আল্লাহতা’লাই সঠিক পথপ্রদর্শনকারী এবং তাঁর কাছেই আমাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে।” [আল্লামা ও ইমাম সাইয়্যেদ আহমদ মাশহূর আল-হাদ্দাদ]

শায়খ মুহাম্মদ ইবনে আবদিল ওয়াহহাবের এতদসংক্রান্ত অবস্থান

এক্ষেত্রে শায়খ মুহাম্মদ ইবনে আবদিল ওয়াহহাব এমন এক শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেছেন, যেটাকে তার প্রতি আরোপ করার দাবিকারী অনেকেই অস্বীকার করবেন; এরা শায়খ ইবনে আবদিল ওয়াহহাবের পদ্ধতির বিরোধিতাকারী ও তার মতবাদ প্রত্যাখ্যানকারী সকলের বিরুদ্ধে কুফরের ফতোওয়া কাণ্ডজ্ঞানহীনভাবে বিবেচনায় নিয়ে থাকেন। কিন্তু শায়খ ইবনে আবদিল ওয়াহহাব ওই বোকামিপূর্ণ কুৎসা যা তার প্রতি আরোপিত হয়েছে (তারই নিজস্ব মতবাদ হিসেবে), সেগুলোর সবই অস্বীকার করেছেন। ক্বাসিম গোত্রের লোকদের কাছে লেখা এক পত্রে তিনি নিজের মতবাদ সম্পর্কে উল্লেখ করেন:

“অতঃপর তোমাদের কাছে এ বিষয়টি গোপন নয় যা আমার কাছে খবর এসেছে এই মর্মে যে, শায়খ সুলাইমান সুহায়ম হতে একটি পত্র তোমাদের কাছে পৌঁছেছে এবং তোমাদের মধ্যে জ্ঞানীগুণীজন হিসেবে জ্ঞাত কতিপয় মানুষ তা গ্রহণ করেছেন এবং সমর্থন-ও করেছেন [অনুবাদকের নোট: শায়খ সুলায়মানের ওহাবী মতবাদবিরোধী ফতোওয়া ‘ওহাবীদের প্রতি নসীহত’ বাংলা সংস্করণ পুস্তকটির ২৮৪ পৃষ্ঠায় বিদ্যমান]। আল্লাহ জানেন, এই লোকটি আমার বিরুদ্ধে সেসব বিষয়ে কী কী আবিষ্কার করে নিয়েছেন যেগুলো আমি (কখনো) বলিনি, যার অধিকাংশ আমার চিন্তায়ও আসেনি। এটা স্পষ্ট হলে নিম্নের বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে তিনি আমার সমালোচনা করেছেন, যা স্রেফ কুৎসা বৈ কিছু নয়। যেমন তিনি দাবি করেছেন আমি নাকি ফেক্বাহ’র চার মাযহাবকে রহিত করেছি; আর আমি নাকি বলেছি বিগত ছয়’শ বছর যাবত মুসলমান সমাজ কুফরে নিমজ্জিত আছেন; অধিকন্তু আমি নাকি স্বঘোষিত মুজতাহিদ; আর আমি তাক্বলীদ (মাযহাবের কোনো এক ইমামের আনুগত্য) হতে বেরিয়ে গিয়েছি; উপরন্তু আমি নাকি বলেছি যে উলামাদের মধ্যকার মতপার্থক্য শাস্তিস্বরূপ; আর পুণ্যবানদের মধ্যস্থতায় তাওয়াসসুল (অসীলা গ্রহণ)-কারীদের প্রতি আমি নাকি কুফরের দোষারোপ করেছি; এছাড়াও ইমাম বুসাইরী’কে তাঁর ‘সৃষ্টিকুলের শ্রেষ্ঠ/মহানতম (সত্তা)’ বক্তব্যের কারণে নাকি আমি কুফরের দোষারোপ করেছি; আর আমি নাকি বলেছি রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর রওযার ওপরে অবস্থিত (সবুজ) গুম্বজটি ভাঙ্গতে পারলে আমি ভেঙ্গে দিতাম; অধিকন্তু আমার যদি কা’বার ওপর কর্তৃত্ব থাকতো তাহলে নাকি সেটার (সোনালী) নিধি বদলে কাঠের নিধি স্থাপন করতাম; আর আমি নাকি রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর রওযা যেয়ারত নিষেধ করি এবং মানুষের পিতামাতার ও অন্যান্যদের কবর যেয়ারত-ও অস্বীকার করি; আর আমি নাকি আল্লাহ ব্যতিরেকে অন্য কারো নামে কসমকারীকে কুফরের অভিযোগে অভিযুক্ত করি।

“এই হলো ১২টি বিষয়, যেগুলোর প্রতি আমার উত্তর হলো (আয়াত শরীফ): ‘হে আল্লাহ! আপনারই পবিত্রতা! এটা তো গুরুতর অপবাদ’ (সূরা নূর, ১৬ আয়াত)। কেননা তাঁর (শায়খ সুলাইমানের) আগে মহানবী (দ:)-এর প্রতি অপবাদদাতা ছিল একজন, যে বলেছিল তিনি ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ:) ও পুণ্যবানদের কুৎসা রটনা করেছিলেন। অতএব, মিথ্যে আবিষ্কার ও মিথ্যে সাক্ষ্য প্রদানের ক্ষেত্রে তাদের উভয়ের অন্তরের মিল রয়েছে। মহান প্রভু এরশাদ ফরমান: ‘মিথ্যে অপবাদ তারাই দেয়, যারা আল্লাহর আয়াতসমূহের ওপর ঈমান রাখে না’ (সূরা নাহল, ১০৫ আয়াত)। তারা তাঁকে (মহানবীকে) অপবাদ দেয় এ মর্মে যে তিনি বলেন: ‘ফেরেশতাকুল, ঈসা (আ:) ও উযায়র (আ:) জাহান্নামে জ্বলছেন।’ এরই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহতা’লা নাযেল করেন আয়াতে পাক: ‘নিশ্চয় ওইসব মানুষ যাদের জন্যে আমার প্রতিশ্রুতি কল্যাণের হয়েছে, তাদেরকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হয়েছে’ (সূরা আম্বিয়া, ১০১ আয়াত)।” [শায়খ মুহাম্মদ ইবনে আবদিল ওয়াহহাব]

‘মজমু’আ আল-মু’আল্লাফাত আল-শায়খ আল-ইমাম মুহাম্মদ বিন আবদ আল-ওয়াহহাব’ শীর্ষক বইতে সন্নিবেশিত পত্রাবলী দেখুন, যে বইটি আল-ইমাম মুহাম্মদ বিন সৌদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচেষ্টায় বিতরণ করা হয়েছে। [বঙ্গানুবাদকের নোট: শায়খ সুলায়মানের ফতোওয়াটি ইবনে আবদিল ওয়াহহাব নজদীর লিখিত ‘কিতাবুত্ তওহীদ’ ও ‘কাশফুশ্ শুবহাত’ শীর্ষক দুটো মহাভ্রান্ত আকীদা-বিশ্বাসসম্বলিত বইয়ের ভিত্তিতে প্রদত্ত হয়েছে। আমি নিজে ’কাশফুশ শুবহাত’ বইটি পড়েছি এবং সেটার রদ্দ-ও লিখেছি। বস্তুতঃ এ বইগুলোই তার গোমরাহীর অকাট্য প্রমাণ। দেখুন লিংক: http://www.mediafire.com/file/wzh071lp2cghiv3/]

এ সম্পর্কে শায়খ ইবনে আবদিল ওয়াহহাবের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পত্র

এই চিঠি মুহাম্মদ ইবনে আবদিল ওয়াহহাব কর্তৃক ইরাক্বীদের একজন (সুন্নী) আলেম ইমাম আবদুল্লাহ আল-সুওয়াইদী আল-বাগদাদীর বরাবরে প্রেরণ করা হয়; ইমাম সুওয়াইদী একটি বই ইবনে আবদিল ওয়াহহাবের কাছে পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করেন মানুষেরা তার (শায়খ নজদী) সম্পর্কে যা বলাবলি করছেন তা সত্য কি না। ইবনে আবদিল ওয়াহহাব এ চিঠিতে উত্তর দেন:

”নিশ্চয় কুৎসামূলক গুজব রটানো এমন এক জিনিস যা বুদ্ধিমান ব্যক্তির পক্ষে বর্ণনা করাটাই লজ্জার ব্যাপার, (গুজব) বানানো তো দূরের কথা।

“আর আপনি যা বলেছেন আমি নাকি আমার অনুসারীদের ছাড়া সবার প্রতি কুফরের দোষারোপ করি, তা কতোই না আশ্চর্যজনক! এটা কীভাবে একজন বুদ্ধিমান মানুষের মস্তিষ্কে প্রবেশ করতে পারলো?  কোনো মুসলমানের পক্ষে এই দোষারোপ করা কি সম্ভব?

“উপরন্তু, আপনি যে অভিযোগ করেছেন আমি নাকি দাবি করেছি, আমি যদি পারতাম তাহলে আমি মহানবী (দ:)-এর রওযার ওপরে (সবুজ) গুম্বজ ধ্বংস করতাম, আর আমি নাকি ‘দালাইল আল-খায়রা’ত’ কাব্যটির আবৃত্তিকে নিষেধ করেছি, অধিকন্তু মহানবী (দ:)-এর প্রতি সকল প্রকারের দরুদ-সালাম পাঠকেও নিষেধ করেছি; বস্তুতঃ এগুলোর সবই অপবাদ। মুসলমান কখনো তাঁর অন্তরে কোনো কিছুকে আল্লাহর কিতাবের (মানে ক্বুরআনের) চেয়ে মহত্তর বলে মনে করেন না। [বঙ্গানুবাদকের নোট: দেখুন কীভাবে মূল বিষয়কে পাশ কাটিয়ে ধূর্ত প্রকৃতির জবাব দেয়া হয়েছে]

একই বইয়ের ৬৪ পৃষ্ঠায় ইবনে আবদিল ওয়াহহাব বলেন:

“আর আপনি যা বলেছেন, আমি নাকি পুণ্যবানদের মধ্যস্থতায় তাওয়াসসুল (অসীলা গ্রহণ)-কারীদের প্রতি কুফরের দোষারোপ করি, আর আমি নাকি ইমাম বুসাইরীর প্রতি তাঁরই ‘হে সৃষ্টির সেরা’ কথাটি বলার কারণে কুফরের দোষারোপ করেছি, অধিকন্তু আমি নাকি মহানবী (দ:)-এর রওযা এবং কারো পিতা-মাতার কবর যেয়ারতকেও অস্বীকার করেছি, আর আল্লাহ ভিন্ন কারো নামে কসমকারীর প্রতি আমি নাকি কুফরের অভিযোগ উত্থাপন করেছি – এসব অভিযোগের ব্যাপারে আমার জবাব হলো: হে প্রভু (আল্লাহতা’লা), আপনারই জন্যে সমস্ত প্রশংসা! এ তো মারাত্মক কুৎসা রটনা!” [শায়খ মুহাম্মদ ইবনে আবদিল ওয়াহহাব নজদীর চিঠি]

কোনো মুসলমানকে হেয় করা দূষণীয় এবং তাঁর সাথে যুদ্ধ করা কুফর (অবিশ্বাস)

আপনাদের জানা উচিত যে মুসলমানবৃন্দকে ঘৃণা করা, তাঁদের এড়িয়ে চলা এবং তাঁদের সাথে যুদ্ধে জড়ানো নিষিদ্ধ। কোনো মুসলমানকে অপমান/অপদস্থ করা ‘ফুসূক্ব’ (দূষণীয়/পাপ), আর তাঁর সাথে যুদ্ধ করা কুফর তথা অবিশ্বাস, যদি তা ঘোষণার অনুমতিপ্রাপ্ত হয়।

হযরত খালেদ বিন ওয়ালীদ (রা:)-সম্পর্কিত হাদীসটি এ বিষয়ের নিরোধক হিসেবে যথেষ্ট। কোনো এক অভিযানে তিনি বনূ জুযায়মা গোত্রের কাছে গিয়ে তাঁদেরকে ইসলাম গ্রহণের দাও’আত দেন। তিনি তাঁদের কাছে গিয়ে বলেন, “ইসলাম গ্রহণ করো।” তাঁরা জবাবে বলেন, “আমরা মুসলমান।” এমতাবস্থায় তিনি বলেন, “সেক্ষেত্রে তোমাদের অস্ত্র নিচে রাখো এবং তোমাদের ঘোড়ার সওয়ার হতে নেমে আসো।” তাঁরা জবাব দেন, “না, আল্লাহর কসম, আমরা অস্ত্র নামিয়ে রাখলে নিহত হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না। আমরা আপনার ও আপনার সাথীদের তরফ হতে নিজেদের নিরাপদ বোধ করছি না।”

হযরত খালেদ বিন ওয়ালীদ (রা:) বলেন, “তোমরা ঘোড়ার সওয়ার থেকে অবতরণ না করলে আমি তোমাদের নিরাপত্তা দেবো না।” তাঁদের একটি দল নেমে আসেন, বাকি সবাই চলে যান। আরেকটি রওয়ায়াত তথা বর্ণনায় এসেছে যে হযরত খালেদ (রা:) ওই লোকদের কাছে পৌঁছে বলেন, “তোমরা সবাই কারা (মানে মুসলমান না অবিশ্বাসী)?” তাঁরা জবাবে বলেন, “আমরা এবাদত-বন্দেগীরত ও মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী মুসলমান। আমাদের এলাকায় আমরা মসজিদসমূহ নির্মাণ করেছি এবং সেখানে আযান দেই।” তাঁদের বাচনভঙ্গিতে তারা শুদ্ধভাবে এ কথা বলতে পারেননি যে, “আমরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছি (আসলামনা’)।” তাই তাঁরা বলেন, “সাবা’না, সাবা’না।” হযরত খালেদ (রা:) বলেন, “তাই যদি হবে, তাহলে তোমরা অস্ত্রসজ্জিত কেন?” তাঁরা উত্তর দেন, “আমাদের সাথে কিছু (বেদুঈন) আরবের শত্রুতা বিরাজমান, আর আমরা আশঙ্কা করি যে আপনিও তাদের একজন হতে পারেন; তাই আমরা অস্ত্রসজ্জিত হয়েছি।” অতঃপর হযরত খালেদ বিন ওয়ালীদ (রা:) বলেন, “তোমাদের অস্ত্র নিচে নামাও।” তাঁরা তা-ই করেন। তিনি আদেশ করেন, “আত্মসমর্পণ করো।” এরপর তিনি তাঁদের কিছু সংখ্যককে আজ্ঞাধীন করেন, আর কিছু সংখ্যককে বেঁধে তাঁর সাথীদের মাঝে বিতরণ করেন (গোলাম হিসেবে)। রাত সমাগত হলে হযরত খালেদ (রা:)-এর (বাহিনীর) একজন ঘোষক বলেন, “কারো কোনো বন্দি থাকলে তিনি তাকে হত্যা করতে পারেন।” এমতাবস্থায় বনূ সুলায়ম গোত্র তাদের কাছে থাকা বন্দিদের হত্যা করে; অপর দিকে মুহাজির (হিজরতকারী সাহাবাবৃন্দ) ও আনসার সাহাবীমণ্ডলী (আল্লাহ তাঁদের সবার প্রতি সন্তুষ্ট হোন) এরকম হত্যাকাণ্ড হতে বিরত থাকেন এবং তাঁদের হাতে বন্দিদের মুক্ত করে দেন। যখন এই ঘটনার এবং হযরত খালেদ বিন ওয়ালীদ (রা:)-এর নেয়া পদক্ষেপের সংবাদ মহানবী (দ:)-এর কাছে গিয়ে পৌঁছে, তখন তিনি দুবার উচ্চারণ করেন, “হে আল্লাহ, খালেদ যা করেছে, আপনার কাছে তা হতে আমি নিজেকে মুক্ত ঘোষণা করছি [মানে এর দায়দায়িত্ব নিচ্ছি না]।”

এ কথা বলা যেতে পারে যে হযরত খালেদ (রা:) হয়তো তাঁদের কথাকে প্রত্যাখ্যান, দাম্ভিকতা প্রদর্শন ও ইসলাম ধর্মের প্রতি আত্মসমর্পণে অস্বীকৃতি হিসেবে বুঝেছিলেন, আর ওই লোকদের উচ্চারিত ‘সাবা’না’ বাক্যের উদ্দেশ্য জানার আগে হযরত খালেদ (রা:)-এর ত্বরিত পদক্ষেপ ও তাঁদের বিষয়গুলো যাচাই করার ক্ষেত্রে ঘাটতির ব্যাপারেই কেবল মহানবী (দ:) তাঁর সমালোচনা করেছিলেন। নচেৎ তিনি হযরত খালেদ (রা:) সম্পর্কে (অন্যত্র) এরশাদ ফরমান, “খালেদ বিন ওয়ালীদ কতো-ই না উত্তম বান্দা ও তার পরিবারের প্রতি শ্রেষ্ঠ ভ্রাতা! সে আল্লাহরই তরবারি, যা কুফফার (অবিশ্বাসী) ও মোনাফেক্ব (কপট)-দের বিরুদ্ধে আল্লাহতা’লা কোষমুক্ত করেছেন।”

অনুরূপভাবে, বোখারী শরীফেও মহানবী (দ:)-এর প্রিয়পাত্র ও একজন প্রিয়ভাজনের পুত্র হযরত উসামা বিন যায়দ (রা:)-সম্পর্কিত একটি বর্ণনা পাওয়া যায়।

ইবনে যাবএয়া’ন বলেন, “আমি উসামা বিন যায়দ (রা:)-কে বলতে শুনেছি: রাসূলুল্লাহ (দ:) আমাদেরকে আল-হিরক্বা অঞ্চলে (যুদ্ধে) প্রেরণ করেন; আমরা সকালে তাদের (শত্রুদের) ওপর আক্রমণ পরিচালনা করি এবং তাদেরকে পরাভূত করি। আমি ও আনসা’র সাহাবী (রা:)-বৃন্দ হতে একজন তাদের (শত্রুদের) একজনকে ডাক দেই। আমরা তাকে ঘিরে ধরলে সে উচ্চারণ করে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।’ আনসার সাহাবী (রা:) তার কাছ থেকে পিছিয়ে যান, কিন্তু অপর দিকে অামি তাকে আমার বর্শার আঘাতে হত্যা করি। আমরা প্রত্যাবর্তন করলে এই খবর রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর কাছে পৌঁছে যায়; আর তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ’ওহে উসামা, ওই লোক লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলার পরেও কি তুমি তাকে হত্যা করেছিলে?’ আমি উত্তর দেই, ‘সে (মৃত্যু থেকে বাঁচার জন্যে) এটা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছিল।’ (সে সময়) মহানবী (দ:) তাঁর ওই কথা বারংবার উচ্চারণ করা হতে ক্ষান্ত দেননি, যতোক্ষণ না আমার এমন ইচ্ছা (মানে আফসোস) হয় যে আমি সেদিন ইসলাম ক্ববূলকারী না হলেই ভালো করতাম” (অর্থাৎ, তিনি অনুতপ্ত বোধ করেন)। আরেকটি বর্ণনায় এসেছে যে নবী পাক (দ:) তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কি তার বক্ষ বিদীর্ণ করে দেখেছিলে সে সত্যবাদী না মিথ্যেবাদী?” হযরত উসামা (রা:) বলেন, “আমি আর এমন কাউকে হত্যা করবো না, যিনি মুখে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ উচ্চারণ করেন।”

হযরত আলী (ক:)-কে একবার একটি দলের অন্তর্ভুক্ত তাঁরই কতিপয় প্রতিপক্ষীয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়: “এরা কি অবিশ্বাসী?” তিনি উত্তর দেন, “না, এরা বরঞ্চ অবিশ্বাস হতে পলায়মান।” এরপর তাঁকে আবার প্রশ্ন করা হয়, “তাহলে তারা কি মোনাফেক্ব?” তিনি জবাবে বলেন, “না, মোনাফেক্ববর্গ আল্লাহকে খুব একটা স্মরণ করে না; অথচ এরা আল্লাহকে প্রচুর স্মরণ করে।” এমতাবস্থায় তাঁকে আবার জিজ্ঞেস করা হয়, “তাহলে তারা কী?” হযরত আলী (ক:) উত্তর দেন, “তারা এমন-ই লোক যারা পরীক্ষার বোঝা দ্বারা ক্লিষ্ট; ফলশ্রুতিতে তারা অন্ধ ও বধির হয়ে গিয়েছে।”

স্রষ্টার মক্বাম ও সৃষ্টির মক্বাম

স্রষ্টা (আল্লাহতা’লা) ও সৃষ্টি উভয়ের দুটি মক্বামের (পর্যায়/স্তরের) মধ্যকার পার্থক্য-ই হচ্ছে ঈমানদারি ও কুফরির মাঝে বিভাজনকারী সীমারেখা। আমরা বিশ্বাস করি, যারা এই দুটি মক্বামের মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন (অর্থাৎ, বিভ্রান্তিতে পড়েন), তারা কুফর বা অবিশ্বাসের গহ্বরে পতিত হয়েছেন; আমরা এ থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি।

প্রতিটি মক্বামের ক্ষেত্রে বিশেষ বিশেষ হক্ক তথা অধিকার নির্দিষ্ট রয়েছে। তবে এমন কিছু বিষয় আছে, যেগুলো দ্বারা কেউ কেউ বিভ্রান্তিতে পড়তে পারেন; বিশেষ করে সেসব বিষয়ে যা’তে জড়িত রয়েছে মহানবী (দ:)-এর অনন্য বৈশিষ্ট্যাবলী।

মহানবী (দ:)-এর এসব গুণ তাঁকে বাকি মনুষ্যকুল হতে পৃথক এবং তাদের চেয়ে উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন করেছে। এব্যাপারে কারো কারো বিভ্রান্তিতে পড়ার কারণ তাদেরই সীমাবদ্ধ বুদ্ধি-বিবেচনা ও চিন্তার দুর্বলতা এবং স্থূল দৃষ্টিভঙ্গি ও বাজে উপলব্ধি; যার দরুন তারা রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর এসব অনন্য গুণে বিশ্বাসী (ও সমর্থনকারী) মুসলমানদের প্রতি কুফরী (অবিশ্বাস) ও ইসলাম হতে খারিজ হওয়ার দোষারোপ করতে দেরি করেন না। তারা মনে করেন এ বিষয়গুলো স্রষ্টা ও সৃষ্টির মক্বামগুলোকে সংমিশ্রণ করে এবং মহানবী (দ:)-কে খোদায়িত্বের পর্যায়ে উন্নীত করে। আল্লাহকে সামনে রেখে আমরা সেটা থেকে নিজেদেরকে নিষ্কলুষ রাখার ঘোষণা দিচ্ছি।

মহান আল্লাহতা’লা অনুগ্রহে আমরা জানি আল্লাহতা’লার জন্যে কী কী ওযা’জিব (প্রয়োজনীয়/খাস), আর কী কী ওয়া’জিব তাঁরই রাসূল (দ:)-এর জন্যে। আমরা এ-ও জানি আল্লাহতা’লার স্বকীয়/স্বতন্ত্র হক্ক বা অধিকার কী কী; আর তাঁরই প্রিয়নবী (দ:)-এর জন্যে সেগুলো কী কী –  দান করা বা দান না করা, (আল্লাহর খাস/স্বতন্ত্র ক্ষমতা) উপকার বা অপকার করা, পূর্ণ আধিপত্য স্থাপন ও সামগ্রিক রক্ষণাবেক্ষণ করা, সৃষ্টি করা, বিষয়াদির (হাক্বীক্বী/প্রকৃত) তাসাররুফ তথা পরিচালনা করা, স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত (খোদায়ী) পূর্ণতা ও উচ্চমর্যাদা, পুতঃপবিত্রতা ও বিভিন্ন ধরনের/পরিস্থিতির/মর্যাদার স্বকীয় বা স্বতন্ত্র এবাদত-বন্দেগী (অর্চনা) লাভ করার মতো ইত্যাকার রুবূবিয়্যা (প্রভুত্ব) ও উলূহিয়্যা (খোদায়িত্ব)-এর মাত্রাহীন বিবরণ ও অতিরঞ্জন ছাড়াই যা মহানবী (দ:)-এর মক্বামের বর্ণনা দিতে সক্ষম।

’মাত্রাহীন’ কথাটির মানে হলো রাসূলুল্লাহ (দ:)-কে ভালোবাসার, তাঁকে মান্য করার এবং তাঁর সাথে আত্মিক মেলবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার (অনুভূতিগত) তীব্রতা। এটা অতীব পছন্দনীয় ও কাঙ্ক্ষিত বিষয়, যেমনটি হাদীসে ঘোষিত হয়েছে: “আমার সম্পর্কে এমন অতিরঞ্জন করো না যেভাবে ইবনে মরিয়ম সম্পর্কে (অতিরঞ্জন) করেছে খৃষ্টান সম্প্রদায়।” এর অর্থ হলো দোষারোপযোগ্য পন্থায় তাঁর সম্পর্কে অতিরজ্ঞন ও তাঁকে প্রশংসা করা। (হাদীসটির) অর্থ যদি সেটা ভিন্ন কোনোভাবে অন্য কিছু হতো, তাহলে এর উদ্দিষ্ট মানে হতো তাঁর সর্বপ্রকার গুণগান ও প্রশংসার ওপর নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু একথা জ্ঞাত যে সবচেয়ে অজ্ঞ মুসলমান-ব্যক্তিটিও এধরনের দাবি উত্থাপন করবেন না; কেননা মহান আল্লাহতা’লা স্বয়ং তাঁর রাসূল (দ:)-কে আপন পাক কালামে সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রশংসা করেছেন। আর আল্লাহতা’লা যাঁকে প্রশংসা করতে আমাদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন, তাঁর প্রশংসা করা আমাদের অবশ্যকর্তব্য। তবে হ্যাঁ, খোদায়িত্বের বৈশিষ্ট্যাবলীসহ তাঁর প্রশংসা না করা আমাদের জন্যে জরুরি। আল্লাহ সে পুণ্যাত্মার প্রতি রহম করুন যিনি বলেছিলেন পদ্যাকারে:

“খৃষ্টান সম্প্রদায় আপন পয়গম্বর সম্পর্কে যা বলেন তা ছাড়ো,

মহানবী (দ:)-এর প্রশংসা যেভাবে মন চায় ভালোভাবে করো।”

খোদায়িত্বের বৈশিষ্ট্য ব্যতিরেকে মহানবী (দ:)-এর প্রশংসার মধ্যে কোনো ধরনের কুফর (অবিশ্বাস) অথবা শেরক (অংশীবাদ) নেই। না, বরঞ্চ তা সেরা আনুগত্যেরই নিদর্শন এবং ক্বুরবাত তথা নৈকট্য অর্জনের সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় বা মাধ্যম।

আল্লাহতা’লা যাঁদের যাঁদের প্রশংসা ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন, যেমন আম্বিয়া (আ:) ও এঁদের পাশাপাশি ফেরেশতামণ্ডলী, সিদ্দীক্বুন, শহীদান ও সুলাহাবৃন্দ (পুণ্যবান), তাঁদের সবার ক্ষেত্রে একই অবস্থা বিরাজ করবে। আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান:

ذٰلِكَ وَمَن يُعَظِّمْ شَعَائِرَ ٱللهِ فَإِنَّهَا مِن تَقْوَى ٱلْقُلُوبِ

“কথা হচ্ছে, যে কেউ আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে সম্মান করে, তবে এটা অন্তরগুলোর পরহেযগারির লক্ষণ” [সূরা হজ্জ্ব, ৩২ আয়াত]। তিনি অন্যত্র এরশাদ ফরমান,

 ذٰلِكَ وَمَن يُعَظِّمْ حُرُمَاتِ ٱللهِ فَهُوَ خَيْرٌ لَّهُ عِندَ رَبِّهِ

“কথা হচ্ছে এই, এবং যে কেউ আল্লাহর সম্মানিত বস্তুগুলোর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে, তবে তা তার জন্যে তারই রব্বের কাছে উত্তম” [সূরা হজ্জ্ব, ৩০ আয়াত]।

ঐশী এসব নিদর্শনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে কা’বা শরীফ, হজরে আসওয়াদ বা কালো পাথর এবং মাক্বামে ইবরাহীম (আ:)। এগুলো এমন-ই পাথর যার চারদিকে তওয়াফ পালন, ইয়েমেনী কোণা স্পর্শকরণ, কালো পাথরকে চুম্বন, এবং মাক্বামে ইবরাহীমের পেছনে আর কা’বা শরীফের দরজার ডানপার্শ্বে ও মুলতাযিম স্থানে দাঁড়িয়ে এবাদত-বন্দেগী পালনকে প্রশংসা করতে আল্লাহতা’লা আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা এগুলো সম্পাদন করলে মহান আল্লাহতা’লা ছাড়া আর কারোরই এবাদত করি না; অন্য কোনো স্বাধীন ঘটনাপ্রবাহ সংঘটনকারী/পরিচালনাকারী  সত্তায় আমরা বিশ্বাস স্থাপন করি না একমাত্র আল্লাহতা’লা ছাড়া, যিনি নেয়ামত (আশীর্বাদ) বা গযব/আযাব (শাস্তি/অনিষ্ট) প্রদানের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী। আল্লাহ ভিন্ন অন্য কারোরই এর ওপর মালিকানা নেই।

সৃষ্টির মক্বাম

মহানবী (দ:)-এর ক্ষেত্রে আমরা অবশ্যই বিশ্বাস করি যে তিনি ‘বাশার’ তথা মানব-সুরতসম্পন্ন; আর অন্যান্য মানবের মতো তাঁরও নৈমিত্তিক বৈশিষ্ট্যাবলী ও অসুস্থতা দেখা দিতে পারে, যেগুলোর দ্বারা ঘাটতি ও (মানুষের) বিচ্যুতি আবশ্যিক হয় না, ঠিক যেমনটি এক দ্বীনী লেখক (কাব্যাকারে) বলেন:

“আম্বিয়াবৃন্দের জন্যে অনুমতিপ্রাপ্ত নৈমিত্তিক বিশিষ্টতা,

ঘাটতি আবশ্যিক হয় না এমন হাল্কা জরাক্লিষ্টতা।” [ভাবানুবাদ]

আমরা এটাও বিশ্বাস করি যে, রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম হলেন (আল্লাহতা’লার) প্রিয়বান্দা; আর আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া তিনি উপকার বা অপকার সাধন ও জীবন-মৃত্যু-পুনরুত্থান নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। মহান প্রভু এরশাদ ফরমান, “(হে রাসূল) বলুন, আমি আমার নিজের ভালো-মন্দের মধ্যে খোদ্-মোখতার (স্বাধীন) নই, কিন্তু আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন এবং যদি আমি অদৃশ্যকে জেনে নিতাম, তবে এমনই হতো যেন আমি প্রভূত কল্যাণ সংগ্রহ করে নিয়েছি এবং আমাকে কোনো অনিষ্ট-ই স্পর্শ করেনি। আমি তো এ ভয় ও খুশির সংবাদদাতা হই তাদেরই প্রতি যারা ঈমান রাখে” (সূরা আ’রাফ, ১৮৮ আয়াত)। [মুফতী আহমদ এয়ার খাঁন সাহেব তাঁর ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’ গ্রন্থে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, এখানে ‘খায়রান’ মানে ‘দুনিয়ার আরাম, আনন্দ, বাহ্যিকভাবে শত্রুদের ওপর বিজয় ইত্যাদি’; নতুবা আল্লাহতা’লা হুযূরকে প্রচুর মঙ্গল দান করেছেন। মহান রাব্বুল আলামীন এরশাদ ফরমান – ‘যাঁকে হিকমত দান করা হয়েছে, নিশ্চয় তাঁকে প্রচুর মঙ্গল দান করা হয়েছে’ (আল-ক্বুরআন, ২:২৬৯)। আর তিনি হুযূর পাক (দ:)-কে তো হিকমত বণ্টনকারী করেছেনই। পার্থিব অনিষ্ট, অপকার ইত্যাদি রাসূল (দ:)-কে স্পর্শ করার দরুন বোঝা যায় যে, কোনো বিষয়েরই (স্বাধীন/স্বকীয়) ‘ইলমে গায়ব’ তাঁর কাছে নেই (বরঞ্চ তা স্রেফ আল্লাহপ্রদত্ত)। কিন্তু যদি এ আয়াতের দ্বারা তাঁকে ইলমে গায়ব (অদৃশ্য জ্ঞান) দানের কথা অস্বীকার করা হয়, তবে এ সিদ্ধান্তে অপরিহার্য হবে যে হুযূরের (দ:) কাছে একটি বিষয়ের জ্ঞানও নেই; অথচ তা হবে ক্বুরআন ও হাদীসের অকাট্য দলিলাদির পরিপন্থী। কেননা, ‘প্রদত্ত ইলমে গায়ব’কে যদি ‘গায়বী ইলম’ বলে স্বীকার করা না হয়, তাহলে নুবুয়্যত, রেসালত, কিতাব, জীবন, মু’জিযা ইত্যাদিকেও অস্বীকার করা অনিবার্য হয়ে যায় (নাউযুবিল্লাহ)! কেননা ওগুলোও তো আল্লাহপ্রদত্ত।]

আমরা (মুসলমান সমাজ) বিশ্বাস করি, মহানবী (দ:) তাঁর প্রতি অবতীর্ণ ঐশী বাণী যথাযথভাবে পৌঁছে দিয়েছেন, তাঁর প্রতি খোদাতা’লার অর্পিত আস্থা পুরো করেছেন, উম্মতকে সঠিক উপদেশ ও সৎ পরামর্শ দিয়েছেন, দুঃখকষ্ট অপসারণ করেছেন এবং আল্লাহর রাস্তায় জ্বেহাদ পরিচালনা করেছেন, যতোক্ষণ না আল্লাহ পাক তাঁর বেসাল (পরলোকে আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়া) দিয়েছেন, যার ফলশ্রতিতে তিনি আল্লাহর সান্নিধ্যে গমন করেছেন সন্তুষ্ট হয়ে এবং মহান প্রভুরও সন্তুষ্টি অর্জন করে, যেমনটি আল্লাহ পাক এরশাদ করেছেন:

إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُمْ مَّيِّتُونَ

“নিশ্চয় আপনাকেও বেসালপ্রাপ্ত হতে হবে এবং তাদেরকেও মরতে হবে” [সূরা যুমার, ৩০ আয়াত; জরুরি নোট: মুফতী আহমদ এয়ার খাঁন সাহেব এই আয়াতের তাফসীরে লিখেন, “স্মর্তব্য যে, মৃত্যুর দুটি ধরন – ১/ রূহ দেহ থেকে পৃথক হয়ে যাওয়া এবং ২/ রূহ দেহের মধ্যে ক্ষমতা প্রয়োগ ছেড়ে দেয়া এবং প্রতিপালনের সমাপ্তি ঘটা। আম্বিয়া (আ:)-এর বেসাল শরীফ প্রথম ধরনের; অর্থাৎ, তাঁদের দেহ মোবারক থেকে রূহ বের হয়ে যায় মাত্র। আর সাধারণ লোকের মৃত্যু প্রথম ও দ্বিতীয় উভয় অর্থেই ঘটে থাকে। সুতরাং পয়গম্বর (আ:)-বৃন্দের রূহ তাঁদের দেহ মোবারক থেকে পৃথক হয়ে যায়; যার ভিত্তিতে তাঁদের কাফন-দাফন সবই হয়ে থাকে; কিন্তু তাঁদের রূহ মোবারক তাঁদের পবিত্র দেহের লালন-পালন ও তাতে ক্ষমতা প্রয়োগ অব্যাহত রাখেন। এ কারণে তাঁদের দেহ মোবারক গলিত লাশ হয় না এবং যেয়ারতকারীকে চেনেন, তাদের সালাম শুনতে পান, তাদের ফরিয়াদ-ও শুনেন এবং তাদের সমস্যা-ও দূর করেন”]। 

আল্লাহতা’লা অন্যত্র এরশাদ ফরমান,

وَمَا جَعَلْنَا لِبَشَرٍ مِّن قَبْلِكَ ٱلْخُلْدَ أَفَإِنْ مِّتَّ فَهُمُ ٱلْخَالِدُونَ

“এবং আমি তোমাদের আগে কোনো মানুষেরই জন্যে পৃথিবীতে অনন্ত জীবন সৃষ্টি করিনি। সুতরাং (হে রাসূল) যদি আপনি বেসালপ্রাপ্ত হন, তবে এরা কি চিরজীবী হবে?” [সূরা আম্বিয়া, ৩৪ আয়াত; জরুরি নোট: মুফতী আহমদ এয়ার খাঁন সাহেব নিজ তাফসীরে লিখেন, “হুযূরের শত্রুরা তাঁর বেসালপ্রাপ্তির অপেক্ষায় থাকতো এবং খুশি হয়ে বলতো, এক সময় এমন আসবে যখন হুযূর পাক (দ:)-এর বেসাল শরীফ ঘটবে। এ প্রসঙ্গে আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছে। এতে এরশাদ হয়েছে, কেউই মৃত্যু থেকে দূরে নয়। মৃত্যু ঘটবে না দুনিয়াতে এমন কেউই নেই। এমন কি হযরত খিযির (আ:) ও হযরত ঈসা (আ:)-এরও বেসাল শরীফ হবে এবং ধিক্কৃত ইবলীসকেও অবশ্যঅবশ্য মৃত্যু গ্রাস করবে। এ থেকে হযরত ঈসা (আ:)-এর বেসাল হয়েছে মর্মে প্রমাণ পাওয়া যায় না, যেমনটি কাদিয়ানী গোষ্ঠী ধারণা করে থাকে। মোট কথা, দীর্ঘায়ু এক কথা, স্থায়িত্ব আরেক। দুনিয়াতে কেউই স্থায়ী নয়”]।

মহানবী (দ:)-এর সবচেয়ে মহৎ গুণ ছিল তাঁর খোদার বান্দা হওয়াটা। এ কারণেই তিনি এতে গর্ব করতেন এবং এরশাদ ফরমান, “আমি তো স্রেফ একজন বান্দা।” আল্লাহ পাক-ও তাঁকে বান্দা হিসেবে সর্বোচ্চ মক্বামে অধিষ্ঠিত বলে ঘোষণা করেন নিম্নের আয়াতে করীমায়,

سُبْحَانَ ٱلَّذِى أَسْرَىٰ بِعَبْدِهِ

পবিত্রতা তাঁরই জন্যে যিনি আপন বান্দাকে রাতারাতি নিয়ে গিয়েছেন (ঊর্ধ্বভ্রমণে) [সূরা বনী ইসরাঈল, ১] 

মহান প্রভু অন্যত্র এরশাদ ফরমান,

وَأَنَّهُ لَمَّا قَامَ عَبْدُ ٱللهِ يَدْعُوهُ كَادُواْ يَكُونُونَ عَلَيْهِ لِبَداً

“এবং যখন আল্লাহর বান্দা (মহানবী) তাঁর এবাদত করার জন্যে দণ্ডায়মান হতেন, তখন ওই সকল জ্বিন তাঁর নিকট প্রচণ্ড ভিড় জমাতো” [সূরা জ্বিন, ১৯]

রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর বিস্ময়কর প্রকৃতির নির্যাস ছিল তাঁর মানবতা বা মনুষ্যত্ব, কেননা তিনি ছিলেন বনি আদমেরই মধ্য হতে একজন। তবু তাঁর অনুপম বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী মানবকুল হতে তাঁকে করেছিল পৃথক; আর এসব বৈশিষ্ট্য ও গুণের ক্ষেত্রে কেউই তাঁর সমকক্ষ বা তুলনীয় নয়, যেমনটি তিনি নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন একটি সহীহ হাদীসে:

((إني لست كهيئتكم إني أبيت عند ربي يطعمني ويسقيني))

“আমি তোমাদের মতো নই, কেননা বাস্তবিকই আমি রাতে আমার প্রভুর সান্নিধ্যে থাকি এবং তিনি আমাকে পানাহার করান।”

সার কথা হলো, এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে তাঁর মানব-সুরতের বৈশিষ্ট্যগুলো এবং যেসব গুণ তাঁকে বাকি মনুষ্যকুল হতে পৃথক করেছে, যেমন ওপরে উল্লেখিত তাঁর (স্বকীয়) গুণাবলী, এ দুটো দিক-ই পাশাপাশি বর্ণনা করা জরুরি। এ বিষয়টি কেবল তাঁর ক্ষেত্রেই খাস তথা সুনির্দিষ্ট নয়, বরঞ্চ আল্লাহর সকল পয়গম্বর (আ:)-এর ক্ষেত্রেও সাধারণভাবে প্রযোজ্য। আম্বিয়া (আ:)-বৃন্দের সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি তাঁদের নিজ নিজ মক্বাম অনুযায়ী (নির্ধারিত)।

স্রেফ পয়গম্বর (আ:)-বৃন্দের স্বাভাবিক মানব-সুরতের দিকে তাকিয়ে তাঁদের এসব (অনন্য) বাকি বৈশিষ্ট্যকে গণনা না করাটা জাহেলীয়্যা (অন্ধকার) ও মূর্তিপূজোর যুগের দৃষ্টিভঙ্গি। এর সপক্ষে ক্বুরআন মজীদে অসংখ্য সাক্ষ্য বিদ্যমান। এ (মূর্খতাপ্রসূত) দৃষ্টিভঙ্গির উদাহরণ হচ্ছে হযরত নূহ (আ:)-এর প্রতি তাঁরই জাতির মনোভাব, যা আল্লাহতা’লার পাক কালামে বিধৃত হয়েছে এভাবে –

فَقَالَ ٱلْمَلأُ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ مِن قِوْمِهِ مَا نَرَاكَ إِلاَّ بَشَراً مِّثْلَنَا

“সুতরাং তাঁর সম্প্রদায়ের নেতৃবর্গ যারা কাফের ছিল, তারা বল্লো, ‘আমরা তো তোমাকে আমাদেরই মতো মানুষ দেখছি’।” [সূরা হূ-দ, ২৭ আয়াত; মুফতী আহমদ এয়ার খান কৃত ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’]

অনুরূপ মতামত ছিল সর্ব-হযরত মূসা (আ:) ও হারূন (আ:)-এর জাতির: 

فَقَالُوۤاْ أَنُؤْمِنُ لِبَشَرَيْنِ مِثْلِنَا وَقَوْمُهُمَا لَنَا عَابِدُونَ

“সুতরাং তারা বল্লো, আমরা কি ঈমান নিয়ে আসবো আমাদেরই মতো দু’জন লোকের প্রতি, অথচ তাদের সম্প্রদায় আমাদের দাসত্ব করছে?” [সূরা মু’মিনূ-ন, ৪৭ আয়াত; প্রাগুক্ত ‘নূরুল এরফান’]

একই রকম নজির পাওয়া যায় সামূদ গোত্রের লোকদের বক্তব্য থেকে:

مَآ أَنتَ إِلاَّ بَشَرٌ مِّثْلُنَا فَأْتِ بِآيَةٍ إِن كُنتَ مِنَ ٱلصَّادِقِينَ

“আপনি তো আমাদেরই মতো মানুষ। কাজেই কোনো নিদর্শন উপস্থিত করুন যদি সত্যবাদী হন।” [সূরা শু’আরা, ১৫৪ আয়াত; প্রাগুক্ত ‘নূরুল এরফান’]

পয়গম্বর হযরত শু’আইব (আ:)-এর প্রতি তাঁর কওম বা সম্প্রদায় আইকা’র লোকদের কথাতেও রয়েছে একই দৃষ্টান্ত:

قَالُوۤاْ إِنَّمَآ أَنتَ مِنَ ٱلْمُسَحَّرِينَ وَمَآ أَنتَ إِلاَّ بَشَرٌ مِّثْلُنَا وَإِن نَّظُنُّكَ لَمِنَ ٱلْكَاذِبِينَ

“তারা বল্লো, ‘আপনার ওপর জাদুর প্রভাব পড়েছে; আপনি তো আমাদের মতোই একজন মানুষ এবং নিশ্চয় আমরা আপনাকে মিথ্যাবাদী মনে করি’।” [সূরা শু’আরা, ১৮৫-৬ আয়াত; নূরুল এরফান]

আর আমাদের মহানবী (দ:)-কে তাঁর অনুপম বৈশিষ্ট্য ছাড়া স্রেফ মানব-সূরতে দেখতে সক্ষম মুশরিকীনদের মন্তব্যেও একই দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে ওঠেছে:

 وَقَالُواْ مَالِ هَـٰذَا ٱلرَّسُولِ يَأْكُلُ ٱلطَّعَامَ وَيَمْشِي فِي ٱلأَسْوَاقِ

“এবং (তারা) বল্লো, ‘ওই রাসূলের কী হলো যিনি (আমাদের মতোই) আহার করেন ও হাট-বাজারে চলাফেরা করেন’?” [সূরা ফোরকান, ৭ আয়াত; প্রাগুক্ত ‘নূরুল এরফান’]

বস্তুতঃ মনুষ্যকুল হতে পার্থক্যকারী (নুবুওয়্যতের) মহৎ গুণ/বৈশিষ্ট্যাবলী ও মো’জেযা (অলৌকিকত্ব) দ্বারা যে আল্লাহতা’লা তাঁর প্রিয়নবী (দ:)-কে মহাসম্মানিত (তথা বিভূষিত) করেছেন, নিজের সম্পর্কে সে সত্য কথাটি মহানবী (দ:) খোদ ব্যক্ত করেন।

এ কথা প্রকাশিত হয়েছে একটি সহীহ হাদীসে, যেখানে তিনি এরশাদ ফরমান:

(( تنام عيناي ولا ينام قلبي )) .

“আমার নয়নযুগল (কেবল) নিদ্রাগত হয়, কিন্তু আমার ক্বলব্ তথা অন্তর ঘুমোয় না।” 

(আল-বুখারীতে লিপিবদ্ধ) একটি হাদীসে তিনি এরশাদ ফরমান,

(( إني أراكم من وراء ظهري كما أراكم من أمامي )). 

“নিশ্চয় আমি তোমাদেরকে পেছনেও সেভাবে দেখতে পাই, যেভাবে দেখি আমার সামনে।” 

(( أوتيت مفاتيح خزائن الأرض )).

আরেকটি (বুখারী শরীফের) হাদীসে হুযূর পূর নূর (দ:) এরশাদ ফরমান, “আমাকে দুনিয়ার (তাবৎ) রত্নভাণ্ডারের চাবি মঞ্জুর করা হয়েছে।”

যদিও মহানবী (দ:) বেসাল (তথা পরলোকে খোদার সাথে মিলন)-প্রাপ্ত হয়েছেন, তবুও তিনি পূর্ণ অর্থেই এক বরযখ-জীবনে জীবিতাবস্থায় আছেন; তিনি কথাবার্তা শুনতে পান, কেউ সালাম দিলে তার জবাব দেন এবং তাঁর প্রতি ওই দুরুদ-সালাম তাঁর কাছে পৌঁছে যায়। উম্মতের আমলনামা তাঁর সামনে পেশ করা হয়; আর তিনি নেক আমলকারীদের পুণ্যদায়ক কর্ম অনুশীলন দর্শনে খুশি হন, মন্দকর্মে লিপ্ত মুসলমানদের জন্যে (মানে তাদের পক্ষে) আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। আল্লাহতা’লা তাঁর মোবারক দেহকে মাটির জন্যে হারাম (অর্থাৎ, মাটিতে ক্ষয় হওয়া থেকে মুক্ত) করে দিয়েছেন; আর তিনি সকল ভুলত্রুটি (এবং দুনিয়ার যাবতীয় পরিবর্তন) হতেও রক্ষাপ্রাপ্ত (মা’সূম/নিষ্পাপ)।

হযরত আউস বিন আউস (রা:) বর্ণনা করেন যে রাসূলে করীম (দ:) এরশাদ ফরমান:

((قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : من أفضل أيامكم يوم الجمعة : فيه خلق آدم وفيه قبض وفيه النفخة وفيه الصعقة ، فأكثروا عليَّ من الصلاة فيه ، فإن صلاتكم معروضة عليَّ )). قالوا : يا رسول الله ! وكيف تعرض صلاتنا عليك وقد أرمت يعني بليت ؟ فقال : ((إن الله عز وجل حرم على الأرض أن تأكل أجساد الأنبياء)).

“তোমাদের জন্যে সেরা দিন হচ্ছে শুক্রবার। ওই দিন পয়গম্বর আদম (আ:)-কে সৃষ্টি করা হয় এবং ওই দিন-ই তাঁর রূহকে (ফেরত) নেয়া হয় (বেসাল শরীফে)। ওই দিন-ই শিঙ্গায় ফুৎকার দেয়া হবে, আর ওই দিন-ই হবে অশনিসম্পাত। অতএব, তোমরা আমার প্রতি শুক্রবার দিনগুলোতে ঘনঘন সালাওয়াত পাঠ করো, কেননা তোমাদের দুরুদ-সালাম আমার কাছে পেশ করা হবে।” সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) আরয করেন, “এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! আপনি মাটিতে মিশে গেলে আমাদের দুরুদ-সালাম কীভাবে আপনার কাছে পেশ করা হবে?” হুযূর পাক (দ:) বলেন, “নিশ্চয় আল্লাহতা’লা আম্বিয়া (আ:)-বৃ্ন্দের মোবারক দেহকে মাটির জন্যে হারাম করে দিয়েছেন।”

এ প্রসঙ্গে ইমাম হাফেয জালালউদ্দীন সৈয়ূতী (রহ:)-এর প্রণীত ‘তানউয়ীর আল-হালাক’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ আছে।

হযরত ইবনে মাসউদ (রা:) বর্ণনা করেন মহানবী (দ:)-এর হাদীস শরীফ, যা’তে তিনি এরশাদ ফরমান: “আমার (পার্থিব) জীবন তোমাদের জন্যে (মহা)-কল্যাণময়, তোমরা তা বর্ণনা করবে এবং তা তোমাদেরকেও বর্ণনা করা হবে। আর আমার বেসাল শরীফ-ও তোমাদের জন্যে (মহা)-কল্যাণময়; তোমাদের আমলনামা আমার সামনে পেশ করা হবে (আমারই রওযায়)। তাতে ভালাই দেখলে আমি আল্লাহর প্রশংসা করবো, আর মন্দ দেখলে তোমাদের জন্যে/পক্ষে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা (মানে সুপারিশ) করবো।” আল-হায়তামী এ হাদীস সম্পর্কে বলেন, “এটা আল-বাযযার কর্তৃক বর্ণিত এবং এর রাবী (বর্ণনাকারী)-বৃন্দ সহীহ (আল-বুখারী)-এর একই এসনাদ (সনদ/পরম্পরা)-ভুক্ত ব্যক্তি।”

হযরত আবূ হুরায়রা (রা:) বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর হাদীস, যা’তে তিনি এরশাদ ফরমান: “কেউই আমাকে সালাম দেয় না ততোক্ষণ, আল্লাহতা’লা যতোক্ষণ না আমার (মোবারক) রূহ আমায় ফিরিয়ে দেন আর আমি তার সালাম গ্রহণ ও সম্ভাষণের প্রত্যুত্তর দেই।”

এই হাদীসটি সর্ব -ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:) ও দাউদ (রহ:)-ও বর্ণনা করেছেন। উলামাদের কেউ কেউ বলেন, “আমার (মোবারক) রূহ আমায় ফিরিয়ে দেন” – এ কথার মানে হলো, “আমার বাকশক্তি আমায় ফিরিয়ে দেন।” [এটা সঠিক ব্যাখ্যা, কেননা তা না হলে তিনি প্রত্যুত্তর দেবেন কীভাবে? – অনুবাদক] 

হযরত আম্মার বিন এয়াসা’র (রা:) বর্ণনা করেন যে মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান, “নিশ্চয় আল্লাহতা’লা আমার (পাক) রওযায় একজন ফেরেশতাকে দায়িত্ব অর্পণ করেছেন এবং তাঁকে সমস্ত সৃষ্টিকুলের নাম সম্পর্কেও জানিয়েছেন। শেষ বিচার দিবস অবধি কেউই আমার প্রতি সালাত-সালাম প্রেরণ করতে পারবে না, যতোক্ষণ না তিনি (অর্থাৎ, ওই ফেরেশতা) আমাকে জ্ঞাত করেন সালাওয়াৎ পাঠকারীর নাম ও তার বাবার নাম (এ কথা বলে), ‘অমুকের ছেলে অমুক আপনার প্রতি সালাত-সালাম প্রেরণ করেছেন’।”

এ বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেছেন আল-বাযযার ও ইবনে হিব্বান (যাঁর রওয়ায়াতে রয়েছে নিচের কথাটি): “রাসূলুল্লাহ (দ:) বলেন, নিশ্চয় মহান আল্লাহতা’লার একজন ফেরেশতা রয়েছেন যাঁকে তিনি সৃষ্টিকুলের নামগুলো জানিয়েছেন, আর তিনি আমার বেসালের পরে আমারই (মোবারক) রওযায় দণ্ডায়মান। অতঃপর কেউই আমার প্রতি সালাত-সালাম প্রেরণ করতে পারে না, যতোক্ষণ না তিনি বলেন, ‘এয়া মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম, অমুকের পুত্র অমুক আপনাকে সালাত-সালাম জানিয়েছেন’।” এরপর মহানবী (দ:) আরো বলেন, “এমতাবস্থায় মহান আল্লাহতা’লা-ও সালাত-সালাম প্রেরণকারীর প্রতিটি সালামের প্রতিদানস্বরূপ ওর দশগুণ আশীর্বাদ তাকে দান করবেন।” এ হাদীসটি আল-তাবারানী (রহ:) নিজ ‘আল-কবীর’ গ্রন্থে অনুরূপ অন্যান্য হাদীসের সাথে বর্ণনা করেছেন।

প্রিয়নবী (দ:)-এর বেসাল তথা পরলোকে আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়া সত্ত্বেও মহান প্রভুর দরবারে তাঁর (অনুপম) বৈশিষ্ট্যাবলী, (উচ্চ) মক্বাম/মর্যাদা সবই যথারীতি জারি আছে। ঈমানদারবৃন্দের এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ বা আপত্তি নেই। এ কারণেই আল্লাহর দরবারে তাঁর মাধ্যমে তাওয়াসসুল/অসীলা গ্রহণ প্রকৃপক্ষে এসব বাস্তবতায় ও তাঁর মহব্বতে বিশ্বাসের এবং আল্লাহর কাছে তাঁর উচ্চমর্যাদায়ও বিশ্বাসের ভিত্তি গড়ে তোলে; আর এটা তাঁর প্রতি ও তাঁর রেসালাতের প্রতি বিশ্বাসেরও ভিত্তি গড়ে তোলে।

এ বিষয়টি রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর পূজো-অর্চনা নয়, কেননা তাঁর মর্যাদা বা মক্বাম যতোই উঁচু হোক না কেন, তিনি তবু এক (অনুপম) সৃষ্টি, যিনি আল্লাহ ব্যতিরেকে এবং তাঁরই অনুমতি ছাড়া কোনো উপকার বা অপকার করতে পারেন না। মহান প্রভু আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান, “(হে রাসূল) আপনি বলুন, ‘প্রকাশ্য মানবীয় আকৃতিতে আমি তোমাদের মতো, আমার কাছে ওহী আসে যে তোমাদের মা’বূদ একমাত্র মা’বূদ’” [আল-ক্বুরআন, ১৯:১১০]। [অনুবাদকের নোট: মুফতী আহমদ এয়ার খাঁন (রহ:) এই আয়াতের তাফসীরে লেখেন, “হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম মহান আল্লাহর সৌন্দর্যের আয়না। আয়নার মধ্যে তখন-ই পূর্ণাঙ্গ ছবি আসে যখন এক পৃষ্ঠা পরিষ্কার হয়, আর অপর পৃষ্ঠায় রঙের আবরণ থাকে। হুযূর এদিকে নূর, অন্যদিকে হুযূরের ওপর বাশারিয়াতের গিলাফ রয়েছে, যাতে পূর্ণ আয়না হন। এ আয়াতে ‘বাশারিয়াত-বিশিষ্ট’ দিকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর ‘ক্বাদ জা’য়াকুম মিনাল্লাহে নূরুন’, অর্থাৎ, ‘নিশ্চয় তোমাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে নূর এসেছেন’, এ আয়াতটির মধ্যে অন্য দিকের উল্লেখ রয়েছে। ‘ক্বুল’ (হে রাসূল বলুন) বলে ইঙ্গিতে বলা হয়েছে যে, নিজেকে বিনয়বশতঃ ‘বশর’ (মানব-সুরতবিশিষ্ট) শুধু আপনি-ই বলতে পারবেন, অন্য কারোরই এ কথা বলে (আপনাকে) আহ্বান করার অনুমতি নেই। মহান রব্ব এরশাদ ফরমান, ‘তোমরা রাসূলকে নিজেদের পরস্পরের মতো আহ্বান করো না…।’ বাদশাহ নিজের প্রজাদেরকে বলেন, ‘আমি তোমাদের খাদেম।’ এটা হচ্ছে তাঁর পূর্ণতা। কিন্তু একথা অন্য কেউ উচ্চারণ করলে (বেয়াদবির কারণে) তার শাস্তি হবে।”]

এই দুই মক্বামের মাঝে শরীক বিষয়গুলো যা ঐশী সর্বশ্রেষ্ঠত্বের পরিপন্থী নয়

স্রষ্টার মক্বাম ও সৃষ্টির মক্বাম, এ দুটি মক্বামের মাঝে শরীক কিছু বিষয় সম্পর্কে বুঝতে অনেকে ভুল করে থাকেন। কেউ কেউ ভাবেন, এগুলোকে সৃষ্টির মক্বামের প্রতি আরোপ করা মহান আল্লাহর সাথে শেরক করারই পর্যায়ভুক্ত। এসব বিষয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে আম্বিয়া (আ:)-বৃন্দের সেসব বিশেষ গুণ যা তারা বুঝতে ভুল করেন। তারা ওই বৈশিষ্ট্যাবলীকে মনুষ্য সমাজের নিক্তিতে মেপে থাকেন এবং এ কারণেই তারা মহানবী (দ:)-এর প্রতি ওগুলো আরোপ করার ব্যাপারটিকে সীমা লঙ্ঘন ও অতিরঞ্জন মনে করেন। তারা ধারণা করেন, (নুবুওয়্যতের) ওই সকল বৈশিষ্ট্যসহ হুযূর পাক (দ:)-এর (সীফাত) বর্ণনা করলে তা খোদায়ী অনন্য গুণাবলীর সমকক্ষ হয়ে যাবে। এটা নিছক মূর্খতা, কেননা মহান আল্লাহ পাক যাঁকে চান, তাঁকে তা দান করতে পারেন; আর তা কোনো কারণের শর্তাধীনও নয়। বস্তুতঃ এটা স্রেফ তাঁরই অনুগ্রহ ও উদার দান, যা দ্বারা তিনি যে কাউকে ই্চ্ছা সম্মানিত ও উচ্চ মক্বামে আসীন করতে পারেন এবং অন্যান্য মানুষের মধ্যে তাঁর (অর্থাৎ, ঐশী দানগ্রহীতার) প্রাপ্ত নেয়ামতের শ্রেষ্ঠত্ব-ও প্রকাশ করতে পারেন। এর সাথে আল্লাহ পাকের খোদায়িত্ব ও উলূহিয়্যাত (উপাস্য হওয়া)-এর অধিকার সাংঘর্ষিক নয়, কেননা সেটা আল-হক্ক (আল্লাহতা’লা)-এর মক্বামের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ অধিকারসমূহে সুরক্ষিত।

কোনো সৃষ্টিকে এসব (নুবুওয়্যতের) গুণের যে কোনোটি সহ বর্ণনা করা হলে, তা তাঁর মানব-সুরতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ও যথোপযুক্ত। এসব বৈশিষ্ট্য (খোদার গুণাবলীর মতো) অসীম নয় এবং এগুলো আল্লাহরই অনুমতি, আশীর্বাদ ও ইচ্ছায় অর্জিত হয়েছে; অার এগুলো সৃষ্ট (পবিত্র) সত্তার স্বকীয় ক্ষমতা, সিদ্ধান্ত কিংবা আদেশে অর্জিত হয়নি। কেননা তিনি (আপনা হতে) অক্ষম ও দুর্বল, আর উপকার বা ক্ষতি, জীবন বা মৃত্যু, কিংবা প্রাণচাঞ্চল্য দানের ক্ষেত্রে (স্বকীয়ভাবে) অসমর্থ। এমতাবস্থায় কতো বিষয়-ই যে আল্লাহর অধিকার হিসেবে আমাদের ধর্মশাস্ত্রলিপিতে বর্ণিত হয়েছে, অথচ তিনি একই সময়ে সেগুলোকে মহানবী (দ:)-এর প্রতি এবং অন্যান্যদের প্রতিও মঞ্জুর করেছেন!

অতএব, রাসূলুল্লাহ (দ:)-কে এসব গুণাবলীসহ বর্ণনা করা তাঁকে খোদায়িত্বের মক্বামে উন্নীত করে না, কিংবা তাঁকে আল্লাহর শরীক-ও করে না। এসব গুণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে:

শাফাআত (সুপারিশ): শাফাআত মূলতঃ আল্লাহরই অধিকারে, যেমনটি তিনি ঘোষণা করেন – “(হে রাসূল) আপনি বলুন: সুপারিশ তো সবই আল্লাহর হাতে” [সূরা যুমার, ৪৪ আয়াত]।  আর এর পাশাপাশি দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে রাসূলে খোদা (দ:) ও অন্যান্য পুণ্যাত্মাবৃন্দ (নবী-ওলী)-ও আল্লাহরই অনুমতিক্রমে শাফাআতকারী, যেমনটি এসেছে মহানবী (দ:)-এর হাদীসে – “আমাকে শাফাআত দান করা হয়েছে।” তিনি অন্যত্র এরশাদ ফরমান, “আমি-ই সর্বপ্রথম শাফাআত করবো এবং তা প্রথমেই গৃহীত হবে।”

অদৃশ্য জ্ঞান: এলমে গায়ব (তথা অদৃশ্য জ্ঞান) আল্লাহরই কর্তৃত্বাধীন। তিনি এরশাদ ফরমান, “(হে রাসূল) আপনি বলুন, নিজ হতে অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান রাখে না যারা আসমানসমূহ ও জমিনে রয়েছে, আল্লাহ ছাড়া” [সূরা নামল, ৬৫ আয়াত]।  তবে এ বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত যে মহান আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় রাসূল (দ:)-কে এলমে গায়ব শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি এরশাদ ফরমান, “অদৃশ্যের জ্ঞাতা, সুতরাং আপন অদৃশ্যের ওপর কাউকেও ক্ষমতাবান করেন না, আপন মনোনীত রাসূলবৃন্দ ব্যতিরেকে” [সূরা জ্বিন, ২৬-২৭ আয়াত]।  [অনুবাদকের নোট: পূর্বোক্ত সূরা নামলের আয়াতটির ব্যাখ্যায় মুফতী আহমদ এয়ার খাঁন সাহেব তাঁর বিখ্যাত ‘নূরুল এরফান’ তাফসীরগ্রন্থে লেখেন, “প্রকাশ্য অর্থে এ আয়াত ওহাবীদেরও বিপক্ষে। কেননা হুযূরের জন্যে আংশিক ইলমে গায়ব তারাও মানে। সুতরাং আয়াতের অর্থ দাঁড়ালো – ‘বাস্তবিকপক্ষে গায়ব শধু মহান রব্ব-ই জানেন। অতঃপর তিনি যাঁকে বলে দেন, তাঁর (খোদার) বলে দেয়ার ফলে তিনি-ও জানেন।’ যেমন মহান রব্ব ফরমান, ‘প্রকৃত শাসক (হাকিম) কেবল মহান রব্ব’ (আল-ক্বুরআন, ১২:৪০)। তাঁর দানের ফলে অন্যান্যরাও হাকিম হন। এর পরবর্তী রুকূ’তে আছে, ‘আসমান ও জমিনে এমন কোনো বস্তু নেই, যা এক সুস্পষ্ট কিতাবে নেই’ (আল-ক্বুরআন, ২৭:৭৫)। সমস্ত গায়ব-ই এক ব্যক্তকারী কিতাবে রয়েছে। বস্তুতঃ সেটা হচ্ছে বর্ণনাকারী সুস্পষ্ট কিতাব। অর্থাৎ, তা মাহবূব (তথা প্রিয়) বান্দাদের কাছে সমস্ত গায়বকে প্রকাশকারী। এ থেকেই নবী ও ওলীবৃন্দের জ্ঞান প্রমাণিত হয়”]

হেদায়াত: মহান আল্লাহতা’লার অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে হেদায়াত তথা সঠিক পথপ্রদর্শন। তিনি এরশাদ ফরমান: “নিশ্চয় এটা নয় যে আপনি যাকেই নিজ থেকে চান হেদায়াত করবেন; হ্যাঁ, আল্লাহ-ই হেদায়াত করেন যাকে চান” [আল-ক্বুরআন, ২৮:৫৬; মুফতী আহমদ এয়ার খাঁন সাহেব কৃত ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’]। তবে ধর্মশাস্ত্রলিপিতে এ-ও বর্ণিত হয়েছে যে, এই বিষয়টিতে মহানবী (দ:)-এর (খোদাপ্রদত্ত) অংশ বা হিস্যা আছে। মহান আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “এবং অবশ্যঅবশ্য আপনি সোজা পথ (সিরা’তে মুসতাক্বীম) বাতলিয়ে (হেদায়াত) দেন” [আল-ক্বুরআন, ৪২:৫২]। ওপরে উল্লেখিত হেদায়াতের প্রথম ধরনটি দ্বিতীয়টির মতো নয়। ঈমানদার মুসলমানদের মধ্যে প্রত্যেক বুদ্ধিমান ব্যক্তিমাত্র-ই এই বিষয়টি অনুধাবন করতে পারেন, যাঁরা স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যকার পার্থক্য সম্পর্কে সচেতন। তা না হলে (আল্লাহর পক্ষে) এ কথা বলা জরুরি হতো, “নিশ্চয় আপনি (অন্যদের) হেদায়াত দেন (আমার) নির্দেশ মোতাবেক তথা নির্দেশিত হেদায়াত দ্বারা।” অথবা, বলতে হতো, “নিশ্চয় আপনি এমন উপায়ে (অন্যদের) হেদায়াত দেন, যা আমার হেদায়াত হতে ভিন্ন।” কিন্তু এগুলোর কোনোটাই ঘটেনি। বরঞ্চ আল্লাহতা’লা মহানবী (দ:)-এর ক্ষেত্রে সার্বিক হেদায়াতের কথা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেছেন এবং তাতে কোনো রকম শর্তারোপ বা তাকে সীমাবদ্ধও করেননি। কেননা আমাদের মধ্যে আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসী মুসলমান সমাজ (মুওয়াহহেদীন) যাঁদেরকে এই আয়াতে সম্বোধন করা হয়েছে, তাঁরা আল্লাহতা’লার প্রতি ও রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর প্রতি আরোপিত এসব অভিব্যক্তির অর্থ এবং সেগুলোর নিদের্শিত পার্থক্য সম্পর্কে ভালে্াই জানেন ও বোঝেন।

এই বর্ণনারই অনুরূপ আল-ক্বুরআনে বর্ণিত মহানবী (দ:)-এর দয়ার্দ্র ও দয়ালু হওয়ার বিষয়টি-ও। আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “মুসলমানদের প্রতি (রাসূল) পূর্ণ দয়ার্দ্র ও দয়ালু” [আল-ক্বুরআন, ৯:১২৮, মুফতী আহমদ এয়ার খাঁন সাহেবের রচিত ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’]। অার আল্লাহ পাক নিজের সম্পর্কেও ক্বুরআন মজীদের একাধিক স্থানে একই বর্ণনা দিয়েছেন: “তিনি (আল্লাহ) পূর্ণ দয়ার্দ্র ও দয়ালু”

এ কথা ভালোভাবেই জ্ঞাত যে দয়ার্দ্র ও দয়ালুর (বৈশিষ্ট্যের) দ্বিতীয় কিসিমটি প্রথমটির মতো নয়। আল্লাহতা’লা তাঁর রাসূল (দ:)-এর ক্ষেত্রে ওই বর্ণনা দেয়ার সময় তা সার্বিকভাবে ঘোষণা করেছেন, যা কোনো সীমাবদ্ধতা বা শর্ত দ্বারা আবদ্ধ নয়। এটা এ কারণে যে এখানে যাঁকে সম্বোধন করা হয়েছে, তিনি আল্লাহতা’লার একত্বে বিশ্বাসী, আর আল্লাহতা’লায় বিশ্বাসী ব্যক্তি জানেন স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যকার পার্থক্য। তা যদি না হতো, তবে রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহকে বলতে হতো – “রাসূল (দ:) এমন কিসিমের পূর্ণ দয়ার্দ্র ও দয়ালু যা আমার দয়ার্দ্র ও দয়ালু হওয়া থেকে পৃথক।” কিংবা এ কথা বলতে হতো, “পূর্ণ দয়ার্দ্র ও দয়ালু, যে দয়ার্দ্র হওয়াটা সেটার এক বিশেষ পার্থক্যপূর্ণ রূপ, আর যে দয়ালু হওয়াটা-ও সেটার এক বিশেষ পার্থক্যপূর্ণ রূপ।” অথবা এ কথা বলতে হতো, “পূর্ণ দয়ার্দ্র যা মানবের জন্যে যথাযথ এবং দয়ালু-ও যা মানবের জন্যে যথাবিহিত।” কিন্তু এ রকম কোনোটাই ঘটেনি। আল্লাহতা’লা তাঁর রাসূল (দ:)-এর জন্যে এমন দয়ার্দ্র গুণ দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেছেন যা সীমাবদ্ধ নয়, আর তাঁর দয়ালু গুণ-ও সীমাবদ্ধ করা হয়নি; এগুলোর প্রতি কোনো রকম সীমা নির্ধারণ বা শর্তারোপ করা হয়নি। আল্লাহতা’লা স্রেফ এরশাদ ফরমান: “মুসলমানদের প্রতি (রাসূল) পূর্ণ দয়ার্দ্র ও দয়ালু”

যৌক্তিক উপমা ও এর ব্যবহার

কিতাবুল্লাহ (আল-ক্বুরআন) ও সুন্নাহ’তে আলঙ্কারিক (মানে আক্ষরিক নয়) ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এরকম-ই হচ্ছে আল্লাহতা’লার বাণী: “এবং যখন তাদের (ঈমানদারদের) কাছে আমার আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়, তখন তাদের ঈমানের উন্নতি হয় (’বৃদ্ধি পায়’)” [আল-ক্বুরআন, ৮:২]। এই বৃদ্ধি বা উন্নতিকে আয়াতে করীমাসমূহের সাথে সম্বন্ধযুক্ত করাটা আলঙ্কারিক, কেননা (বাস্তবে) আয়াতগুলো ওই উন্নতির একটি কারণস্বরূপ। অথচ একমাত্র আল্লাহতা’লা-ই ঈমানের প্রকৃত উন্নয়ন সাধনকারী। 

উপরন্তু, অনুরূপ দৃষ্টান্ত হচ্ছে আরেকটি খোদায়ী কালাম: “ওই দিন, যা শিশুদেরকে বৃদ্ধ (সাদা চুলবিশিষ্ট) করে ফেলবে” [আল-ক্বুরআন, ৭৩:১৭]। সেই দিনের সাথে ‘বৃদ্ধে পরিণত করার’ বিষয়টিকে সম্বন্ধযুক্ত করাটা আলঙ্কারিক; কারণ দিনটি এমন এক স্থল যেখানে তাদেরকে সাদা চুলবিশিষ্ট করা হবে। অতএব, এখানে উল্লেখিত ‘পরিণত করা’ ওই দিনটিতেই ঘটবে। অথচ যিনি প্রকৃতপক্ষে ‘পরিণত করেন’, তিনি হলেন স্বয়ং আল্লাহতা’লা। 

অধিকন্তু, এরশাদ হয়েছে খোদায়ী কালামে: “বর্জন করো না (মূর্তি) ওয়াদ্দ, সুওয়া, ইয়াগুস, ইয়া’উক্ব ও নাসরকে; এবং নিশ্চয় তারা অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে” [আল-ক্বুরআন, ৭১:২৩/২৪]। গোমরাহী বা পথভ্রষ্টতাকে মূর্তির সাথে সম্বন্ধযুক্ত করাটা এখানে আলঙ্কারিক; কেননা তারা পথভ্রষ্টতার একটি মাধ্যম ছিল। অথচ যিনি হেদায়াত দেন বা গোমরাহ করেন, তিনি খোদ আল্লাহতা’লা। 

এছাড়াও ফেরাউনের ঘটনা বর্ণনা প্রসঙ্গে এরশাদ হয়েছে পাক কালামে: “ফেরাউন বল্লো, ‘হে হামান! আমার জন্যে সুউচ্চ প্রাসাদ নির্মাণ করো” [আল-ক্বুরআন, ৪০:৩৬]।” প্রাসাদ ভবন নির্মাণের কাজটিকে হামানের সাথে সম্বন্ধযুক্ত করাটা আলঙ্কারিক; কেননা সে স্রেফ এর একটি অসীলা ছিল এ মর্মে যে, সে সেটা নির্মাণের আদেশ-দাতা ছিল, আর নিজে নির্মাণ করছিল না। নির্মাণকারীরা কর্ম সংঘটন করছিল; আর এক্ষেত্রে তারা ছিল নির্মাণ শ্রমিক।

অপরদিকে, আলঙ্কারিক কথাবার্তা বিদ্যমান এমন হাদীস শরীফের সংখ্যা অনেক। এগুলোর সাথে পরিচিত (মুহাদ্দীস) উলামাবৃন্দ ভালোভাবে জানেন এগুলোতে নিহিত আক্ষরিক ও আলঙ্কারিক সম্বন্ধকৃত বিষয়াদির মধ্যকার পারস্পরিক পার্থক্য। তাই এগুলো উদ্ধৃত করে সময় ব্যয় করার প্রয়োজন নেই। 

উলামামণ্ডলী বলেন: “আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসী কোনো মুসলমানের মুখে উচ্চারিত এরকম সম্বন্ধযুক্ত বাক্য-ই এটাকে আলঙ্কারিক সম্বন্ধ হিসেবে গ্রহণের জন্যে যথেষ্ট বলে বিবেচিত হবে। কেননা সঠিক আক্বীদা-বিশ্বাস হলো, বান্দা ও তাঁদের কর্মসমূহের সৃষ্টিকারী হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহতা’লা। তিনি ছাড়া স্বকীয় ও স্বাধীনভাবে তাসাররুফ তথা ঘটনাবলীর পরিচালনাকারী আর কেউই নেই, হোন তাঁরা জীবিত অথবা বেসালপ্রাপ্ত।” 

এই আক্বীদা-বিশ্বাসটি খাঁটি/নির্ভেজাল তওহীদ, যার বিরোধী আক্বীদা পোষণকারী শেরক তথা অংশীবাদী দর্শনে বিশ্বাসী বলে সাব্যস্ত হবে।  

ঈমান ও কুফরের মানদণ্ডে আলঙ্কারিক অংশ উপলব্ধির প্রয়োজনীয়তা

নির্দিষ্ট কিছু গোমরাহ/পথভ্রষ্ট গোষ্ঠী এমন একটি সন্দেহের লেজকে আঁকড়ে ধরে আছে, যার ভিত্তি হচ্ছে দৃশ্যতঃ বাহ্যিক ও আক্ষরিক অভিব্যক্তিসমূহ; আর এর জন্যে ‘ক্বারা’ঈন’ তথা অবস্থাগত উপাদান ও উদ্দেশ্যকে বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না; অধিকন্তু, (মূললিপির মধ্যে) পরস্পর-সাংঘর্ষিক কোনো কিছুতে যাতে উপনীত হতে না হয়, সেজন্যে সামঞ্জস্য বা সঙ্গতি বিধানের উপায় খোঁজাও এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, সেসব লোক যারা বিশ্বাস করে ক্বুরআন মজীদ একটি সৃষ্টি, তারা একগুঁয়েভাবে ধরে আছে নিম্নের ক্বুরআনের আয়োতের মতো দলিলগুলোকে: “আমি সেটাকে আরবী ক্বুরআন অবতীর্ণ করেছি” [সূরা যুখরুফ, ৩ আয়াত]। একইভাবে যারা একেবারে স্বাধীন/স্বকীয় ইচ্ছায় বিশ্বাস করে, তারা আঁকড়ে ধরে আছে খোদায়ী কালাম: “যা তোমাদের হাতগুলো উপার্জন করেছে” [সূরা শূরা, ৩০ আয়াত] এবং “অতঃপর আল্লাহ তোমাদেরকে বলে দেবেন যা তোমরা করেছিলে” [সূরা মা-ইদাহ্, ১০৫]।  এছাড়া আছে পূর্ণ অদৃষ্টবাদে বিশ্বাসী (জাবরীয়া) দল যারা আঁকড়ে ধরে আছে আল্লাহর কালাম: “অথচ আল্লাহ তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের কর্মগুলোকেও” [সূরা সোয়াফফাত, ৯৬ আয়াত] এবং “হে মাহবূব! ওই মাটি যা আপনি নিক্ষেপ করেছেন, তা আপনি নিক্ষেপ করেননি, বরং আল্লাহ-ই নিক্ষেপ করেছেন” [সূরা আনফাল, ১৭ আয়াত]

এসব বিষয়ের সাথে জড়িত সমস্ত তথ্য-উপাত্ত খুঁজে বের করে সামঞ্জস্য বিধানের জন্যে তাই বলা হয়: ক্বদরীয়্যা গোষ্ঠী বাদে সমগ্র উম্মত-এ-মুহ্ম্মদীয়্যা বিশ্বাস করেন যে বান্দাদের যাবতীয় কর্ম মহান আল্লাহতা’লাই সৃষ্টি করে থাকেন, যেমনটি এরশাদ হয়েছে নিম্নে: “অথচ আল্লাহ তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের কর্মগুলোকেও” [সূরা সোয়াফফাত, ৯৬ আয়াত]। অন্যত্র তিনি এরশাদ ফরমান: “হে মাহবূব! ওই মাটি যা আপনি নিক্ষেপ করেছেন, তা আপনি নিক্ষেপ করেননি, বরং আল্লাহ-ই নিক্ষেপ করেছেন” [সূরা আনফাল, ১৭ আয়াত]। এটাই মূল বিষয়, এমন কি যদি তা বান্দাদের ওই ধরনের কর্মের ক্ষেত্রে আরেক কিসিমের সম্বন্ধ, যাকে ‘কাসব’ (অর্জন/উপার্জন) বলে, সে হিসেবে বর্ণনা করা হয়েও থাকে, ঠিক যেমনটি এরশাদ করেন আল্লাহ পাক: “তার (সে ব্যক্তির) জন্যে কল্যাণ, যে পুণ্য সে উপার্জন করেছে; আর তার (সে ব্যক্তির) জন্যে ক্ষতি, যে মন্দ সে উপার্জন করেছে” [সূরা বাক্বারা, ২৮৬ আয়াত]।  তিনি অন্যত্র এরশাদ ফরমান: “যা তোমাদের হাতগুলো উপার্জন করেছে” [সূরা শূরা, ৩০ আয়াত]। বান্দাদের অর্জনের প্রতি আরোপকারী এরকম আরো অনেক স্পষ্ট আয়াত বিদ্যমান। কর্ম সংঘটন-ক্ষমতা যাকে দেয়া হয়েছে তার সাথে সেটার সম্বন্ধ স্রেফ স্বাধীন/স্বকীয় সৃষ্টির (এখতিরা’র) মাধ্যমে হওয়াটা প্রয়োজনীয় (শর্ত) নয়; কেননা আল্লাহর ক্ষমতা প্রাক-অনন্তকাল হতেই এ বিশ্বজগতের (মানে তিনি ব্যতিরেকে সকল বস্তুর) সাথে সম্বন্ধযুক্ত, বস্তুতঃ তিনি এটা (বিশ্বজগত) সৃষ্টি করার আগে থেকেই সম্বন্ধযুক্ত। তিনি এ বিশ্বজগতকে সৃষ্টি করার পর আরেক ধরনের সম্বন্ধ দ্বারা এটা তাঁর সাথে সম্বন্ধযুক্ত।

বান্দাদের প্রতি কর্মের দায় আরোপের বাস্তবতা

এ থেকে এটা স্পষ্ট হচ্ছে যা কিছু (খোদায়ী) বিধান করা হয়েছে তা অর্জনের মধ্যেই ক্বুদরত তথা (ঐশী) ক্ষমতার সম্বন্ধ সীমাবদ্ধ নয়। প্রিয় বান্দাদের কর্ম বা ক্রিয়া তাঁদের প্রতি অরোপিত হয় (খোদাতা’লা হতে) অর্জনের সূত্রে, আর তা স্বাধীন/স্বকীয় সৃষ্টি নয়। এগুলো একমাত্র আল্লাহতা’লা-ই সৃষ্টি করেন, ডিক্রী তথা আদেশ করেন এবং ইচ্ছা করে থাকেন। এতে কারো আপত্তি উত্থাপন করা অসম্ভব এ কথা বলে যে, “আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন, তা কীভাবে তিনি ইচ্ছা করতে পারেন?” এটা এ কারণে যে তাঁর ইচ্ছা হতে তাঁর আদেশ পৃথক, যেমনটি প্রমাণিত হয় এ বাস্তবতা হতে যে তিনি সকল মানুষকে ঈমান আনতে আজ্ঞা করেছেন, কিন্তু একই সময়ে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্যে ঈমানদারি গ্রহণের পক্ষে এরাদা বা ইচ্ছা করেননি। যথা – আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “এবং অধিকাংশ লোক, আপনি যতোই চান না কেন, ঈমান আনবে না” [সূরা ইঊসুফ, ১০৩ আয়াত]।

আল্লাহর প্রিয়বান্দাদের প্রতি কর্মের দায় আরোপ করা আর কিছু নয়, কারণ অথবা অসীলার মধ্যে যে প্রভাব সন্নিবেশিত হয়েছে তা-ই আরোপ করা; আর এতে কোনো মতপার্থক্য নেই। যিনি এসব কারণ/প্রভাব সৃষ্টি করেন, তিনি একমাত্র আল্লাহতা’লা-ই, যিনি অসীলা/মধ্যস্থতাকারী সৃষ্টি করেছেন এবং তার মধ্যে ‘অসীলা’ হওয়ার অর্থবহ প্রভাবও সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ যদি ওতে প্রভাব সৃষ্টি না করতেন, তাহলে তা অসীলা হওয়ার যোগ্য হতো না, হোক তা মেধা/বুদ্ধিশূন্য শক্ত জড় পদার্থ, নক্ষত্র, বৃষ্টি ও আগুন, কিংবা হোন বুদ্ধি-বিবেচনাশীল ফেরেশতা, মানব বা জ্বিন। 

বিভিন্ন দায় আরোপের ভিত্তিতে এর অর্থের পার্থক্য   

আপনারা হয়তো প্রতিবাদ করতে পারেন এই বলে: “একটি কর্মকে দু’জন পৃথক কর্তার প্রতি আরোপ করা অর্থবোধক নয়; কেননা কোনো কর্মের সাথে দুইজন কর্তাকে মোটেও সংযুক্ত করা যায় না।” আমরা (জবাবে) বলি: হ্যাঁ, এটা তা-ই যেভাবে আপনারা বলেছেন। তবে এটা সেক্ষেত্রেই কেবল প্রযোজ্য, যেখানে ’কর্তা শব্দটি একটি অর্থে ব্যবহৃত হয়। পক্ষান্তরে, যদি এর দুটি অর্থ হয়, তাহলে শব্দটি সার্বিক হবে এবং উভয় ক্ষেত্রেই আরোপের প্রকাশে ব্যবহৃত হবে। 

এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে একটি সার্বিক প্রসঙ্গে তা প্রকাশ করা সম্ভব, যেমনিভাবে করা হয় সুপরিচিত সমোচ্চারিত ভিন্নার্থবোধক শব্দগুলোতে এর প্রয়োগ বা ব্যবহার; অথবা আক্ষরিক বা আলঙ্কারিক বাক্যে এর প্রযোগ। এটা ঠিক এ কথা বলার মতোই, যা ব্যক্ত করে: “আমির (শাসক) অমুককে হত্যা করেছেন” এবং “জল্লাদ তাকে হত্যা করেছে।” এখানে আমিরের ক্ষেত্রে প্রয়োগকৃত ‘হত্যা’ শব্দটি জল্লাদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ‘হত্যা’ শব্দটি হতে সম্পূর্ণ আলাদা। আমরা যখন বলি, “মহান আল্লাহ হলেন কর্তা/কর্ম সংঘটনকারী”, তখন এর অর্থ বোঝায় তিনি-ই স্রষ্টা এবং অস্তিত্ব দানকারী। আর অমরা যখন বলি, “সৃষ্ট সত্তা হলেন কর্তা/কর্ম সংঘটনকারী”, তখন এর মানে দাঁড়ায় তিনি সেই কেন্দ্রবিন্দু, যাঁর মাঝে আল্লাহতা’লা ইচ্ছে ও জ্ঞান সৃষ্টি করার পর সক্ষমতা/সামর্থ্য-ও সৃষ্টি করে দিয়েছেন। ইচ্ছের সাথে সামর্থ্যকে সম্বন্ধযুক্ত করা এবং ইচ্ছের সাথে নড়াচড়াকে সম্বন্ধযুক্ত করা হচ্ছে কারণ বা অসীলার সাথে সংঘটিত প্রভাবকে সম্বন্ধযুক্ত করা, আর সৃষ্টির সাথে সৃষ্ট বস্তুকে সম্বন্ধযুক্ত করা। 

এটা এরকম হবে যদি কেন্দ্রবিন্দু জীবিত সত্তা হন, অন্যথায় এটা অসীলাসমূহের কার্যাদি সাধনের উপায়বিন্যাসভুক্ত শ্রেণিকরণ হতে নিঃসৃত হবে। অতএব, সামর্থ্য/সক্ষমতার সাথে সম্বন্ধ আছে এমন সব কিছুকে ‘কর্তা’ বলা সঠিক, সেই সম্বন্ধ যা-ই হোক না কেন। অনুরূপভাবে, জল্লাদকে এক অর্থে হত্যাকারী বলা এবং আমিরকে আরেক অর্থে হত্যাকারী বলা-ও সঠিক। এটা এই কারণে যে হত্যাকে উভয়েরই সাথে সম্বন্ধযুক্ত করা হয়েছে। যদিও এই সম্বন্ধ দুটি ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে হয়েছে, তবুও উভয়কেই ‘কর্তাদ্বয়’ বলা অনুমতিপ্রাপ্ত হবে। এটা আজ্ঞাকৃত বিষয়াদিকে দুটি সক্ষমতায় বিবেচনা করার মতোই ব্যাপার। 

এই আরোপ করার অনুমতি/বৈধতার এবং এর যথার্থতার প্রমাণ পাওয়া যায় তখন-ই, যখন মহান আল্লাহতা’লা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফেরেশতাদের প্রতি কর্ম সংঘটন ক্ষমতা আরোপ করেন, অপরদিকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেগুলো তাঁর প্রিয় বান্দাদের প্রতিও আরোপ করেন; আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেগুলো নিজের প্রতিও আরোপ করেন।

মহান আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “আপনি বলুন, ‘তোমাদেরকে মৃত্যু প্রদান করে মৃত্যুর ফেরেশতা, যে তোমাদের জন্যে নিযুক্ত রয়েছে” [সূরা সাজদাহ, ১১ আয়াত; মুফতী আহমদ এয়ার খাঁন কৃত ‘নূরুল এরফান’]। তিনি অন্যত্র আরো ঘোষণা করেন: “আল্লাহ প্রাণগুলোকে ওফাত প্রদান করেন তাদের মৃত্যুর সময়” [সূরা যুমার, ৪২ আয়াত]। তিনি আরো এরশাদ ফরমান: “সুতরাং ভালো, বলো তো যা তোমরা বপন করছো….” [সূরা ওয়া-ক্বি’আহ, ৬৩ আয়াত]। আল্লাহতা’লা এই কর্মকে আমাদেরই প্রতি আরোপ করেছেন, অথচ তিনি অন্যত্র এরশাদ ফরমান: “আমি (খোদা) পানি বর্ষণ করেছি; অতঃপর ভূমিকে খুব বিদীর্ণ করেছি; অতঃপর তাতে উৎপন্ন করেছি শস্য” [সূরা ‘আবাসা, ২৫-২৭ আয়াতসমূহ]। 

আল্লাহতা’লা আরো এরশাদ করেন: “তারপর তার (মরিয়মের) প্রতি আমি আপন ‘রূহানী’ (জিবরীল ফেরেশতা) প্রেরণ করেছি, সে তার সামনে একজন সুস্থ মানুষ রূপে আত্মপ্রকাশ করলো” [সূরা মরিয়ম, ১৭ আয়াত]। 

অতঃপর আল্লাহ পাক অন্যত্র এরশাদ ফরমান: “এবং ওই নারীকে (মরিয়মকে), যে নিজের সতীত্বকে রক্ষা করেছে, অতঃপর তার মধ্যে আমার ‘রূহ’ ফুঁকে দিয়েছি” [সূরা আম্বিয়া, ৯১ আয়াত]। অথচ যিনি মরিয়মের মধ্যে (বাহ্যিকভাবে) ফুঁকেছিলেন, তিনি হচ্ছেন ফেরেশতা জিবরীল (আ:)। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অন্যত্র এরশাদ ফরমান: “সুতরাং আমি (খোদা) যখন সেটা পাঠ করে নেই, তখন সেই পঠিতের (আল-ক্বুরআনের) অনুসরণ করুন” [সূরা আল-ক্বিয়া-মাহ্, ১৮ আয়াত]। অথচ মহানবী (দ:) যাঁর তেলাওয়াত শুনেছিলেন, তিনি ফেরেশতা জিবরীল (আ:)। আল্লাহতা’লা আরো এরশাদ ফরমান: “অতঃপর তাদেরকে তোমরা হত্যা করো নি, বরং আল্লাহ-ই তাদেরকে হত্যা করেছেন” [সূরা আনফাল, ১৭ আয়াত]। তিনি আরো এরশাদ করেন: “(হে মাহবূব!) ওই মাটি যা আপনি নিক্ষেপ করেছেন, তা আপনি নিক্ষেপ করেননি, বরং আল্লাহ-ই নিক্ষেপ করেছেন” [সূরা আনফাল, সূরা ১৭]। 

আল্লাহতা’লা তাঁদের দ্বারা হত্যা করার বিষয়টি নাকচ করে দিয়ে নিজেই তা সম্পাদন করার সুদৃঢ় ঘোষণা দিয়েছেন উক্ত আয়াতটিতে। তিনি মহানবী (দ:) কর্তৃক নিক্ষেপ করার বিষয়টিও একইভাবে নাকচ করে দিয়ে নিজেই তা করার ঘোষণা দেন। এখানে যা উদ্দেশ্য করা হয়েছে তা ইন্দ্রিয়-সম্বন্ধী দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁদের দ্বারা (মক্কার) কুফফারদের হত্যা বা কুফফারদের দিকে মহানবী (দ:) কর্তৃক মাটি নিক্ষেপকে নাকচ করা নয়, বরং এর মানে হলো তাঁরা যে অর্থে হত্যা করেছেন বা মাটি নিক্ষেপ করেছেন, তা আল্লাহ নিজের বেলায় ঘোষণা দিয়ে যে অর্থে বুঝিয়েছেন, তা হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন; আর এটা তাঁর সৃষ্টি করা ও বিধান জারির অর্থেই তিনি বুঝিয়েছেন। এগুলো হচ্ছে দুটি পৃথক অর্থ। কখনো কখনো কর্ম উভয়ের সাথেই সম্বন্ধযুক্ত হয়, যেমনটি দৃশ্যমান আল্লাহতা’লার কালামে পাকে: “এবং কতোই ভালো হতো যদি তারা তাতেই সন্তুষ্ট হতো, যা আল্লাহ ও রাসূল (দ:) তাদেরকে দিয়েছেন এবং বলতো, আল্লাহ-ই আমাদের জন্যে যথেষ্ট; এখন আল্লাহ আমাদেরকে দিচ্ছেন আপন করুণা থেকে এবং আল্লাহর রসূল-ও (দান করছেন)” [সূরা তাওবা, ৫৯ আয়াত]। 

হযরত মা অয়েশাহ (রা:) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন: “মহান আল্লাহতা’লা যখন মাতৃগর্ভে কোনো শিশুকে সৃষ্টি করতে চান, তখন তিনি একজন ফেরেশতাকে প্রেরণ করেন। ওই ফেরেশতা মাতৃগর্ভে প্রবেশ করে রক্তপিণ্ডকে হাতে নিয়ে দেহের আকৃতি দেন এবং আরয করেন, ‘হে প্রভু, এটা কি পুরুষ হবে, না নারী? সোজা হবে, না বাঁকা?’ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের যা মর্জি হয় তা-ই নির্দেশ দেন, আর ওই ফেরেশতা তখন সে মোতাবেক সৃষ্টি করেন।”

অন্য এক রওয়ায়াতে বিবৃত হয়: “অতঃপর ফেরেশতা (বাচ্চাটিকে) আকৃতি দেন এবং (ঐশী) আজ্ঞানুযায়ী তার আত্মার মধ্যে (পুণ্যময়) সুখ-কল্যাণ অথবা মন্দ ফুঁকেন।”

আপনারা যদি এ বিষয়টি বুঝতে পারেন, তাহলে আপনাদের কাছে স্পষ্ট হবে যে কোনো কর্মকে বিভিন্ন উপায়ে প্রকাশ করা যায় এবং এগুলোর কোনোটির মাঝেই পরস্পরবিরোধিতা বিরাজ করে না। এ কারণে কখনো কখনো কর্মকে প্রাণহীন শক্ত জড় পদার্থের প্রতিও আরোপ করা যায়, যেমনটি বিবৃত হয়েছে আল্লাহতা’লার পাক কালামে: “(পবিত্র বৃক্ষ) সর্বদা তার ফল দান করে আপন রব্বের নির্দেশক্রমে।” [সূরা ইবরাহীম, ২৫ আয়াত; মুফতী আহমদ এয়ার খাঁন সাহেব কৃত ’নূরুল এরফান’ তাফসীরগ্রন্থ]  

বৃক্ষ (আক্ষরিকভাবে) এসে ফল দান করে না। এরকম আরেকটি উদাহরণ মিলে মহানবী (দ:)-এর বক্তব্যে, যিনি এক ব্যক্তিকে একটি খেজুর দিয়ে তাকে বলেন: “এটা গ্রহণ করো। তুমি যদি এটার কাছে না আসো, তবে এটা তোমার কাছে আসবে।” এই হাদীস সংকলিত হয়েছে আল-তাবারানী ও ইবনে হিব্বান গ্রন্থগুলোতে। এখানে প্রয়োগের ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তির প্রতি আরোপিত ’আসা’ শব্দটি খেজুরের প্রতি আরোপিত ‘আসা’ শব্দটি হতে পৃথক। খেজুরের আসা মানুষের আসা থেকে আলাদা। ’আসা’ শব্দটি (মানুষ ও খেজুর উভয়ের বেলাতেই) আলঙ্কারিক প্রকাশভঙ্গি এবং এগুলোর আরোপের ক্ষেত্রেও বিভিন্নতা বিদ্যমান। মানুষের ক্ষেত্রে ’আসা’র আলঙ্কারিক প্রকাশের মানে হলো, আল্লাহ তার মধ্যে ‘আসা’র মতো সামর্থ্য ও ইচ্ছে পয়দা করেছেন। অপরদিকে, ফলের ‘আসা’র অর্থ, আল্লাহ কাউকে অসীলা/মাধ্যম বানিয়েছেন, যিনি তা আনেন; অথচ বাস্তবে (তথা হাক্বীক্বী অর্থে) উভয় ক্ষেত্রে ‘আসা’ আল্লাহরই প্রতি আরোপিত হয়।

আংশিকভাবে অসীলা তথা মাধ্যমগুলোকে বিবেচনার বিভিন্ন পন্থা/উপায়ের কারণে কখনো কখনো কর্মের বেলায় অসীলার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি অবিশ্বাস হয়ে যায়। এটা উল্লেখিত হয়েছে পয়গম্বর মূসা (আ:)-এর প্রতি প্রদত্ত পয়গম্বর হারূন (আ:)-এর উত্তরে, যেখানে তিনি বলেন: “এ তো আমি এক জ্ঞান থেকে লাভ করেছি যা আমার কাছে রয়েছে।” [সূরা ক্বাসাস, ৭৮ আয়াত]                         

উপরন্তু, একটি হাদীসে ক্বুদসীতে ঘোষিত হয়: “আমার (খোদার) কতিপয় বান্দা/সেবক আমার প্রতি বিশ্বাস নিয়ে জাগ্রত হয়েছেন; আরো (কিছু) আমার প্রতি অবিশ্বাস নিয়ে জেগেছে। এমতাবস্থায় যেসব ব্যক্তি বলেন, ‘আমরা আল্লাহরই নেআমত (আশীর্বাদ) ও করুণা হতে বারিধারা লাভ করেছি’, তাঁরা আমাতে বিশ্বাসী ও গ্রহ-নক্ষত্রে অবিশ্বাসী হন। (কিন্তু) যারা বলে, ‘আমরা বৃষ্টি অমুক তারকা ও তমুক নক্ষত্রের (কক্ষপথে) পরিক্রমণের ফলশ্রুতিতে লাভ করেছি’, তারা আমাতে অবিশ্বাসী ও তারকায় বিশ্বাসী হয়।”

এটাই হচ্ছে অবিশ্বাস – যদি কারো বিবেচনায় গৃহীত হয় যে মাধ্যমটি (তারকাগুলো) স্বাধীন-স্বকীয় প্রভাব ও সৃষ্টিক্ষমতা ধারণ করে থাকে।           

ইমাম নববী (রহ:) বলেন: 

যে লোক ব্যক্ত করে, ‘অমুক তারকা বা তমুক নক্ষত্রের কারণে আমাদের প্রতি বৃষ্টি প্রেরণ করা হয়েছে’, তার এই অবিশ্বাসের ব্যাপারে উলামাবৃন্দ পারস্পরিক ভিন্নমত পোষণ করেছেন। এক্ষেত্রে দুটি পৃথক দৃষ্টিভঙ্গি বিরাজমান: ১/ – এটা স্বয়ং আল্লাহতা’লার প্রতি অবিশ্বাস, যেটা ঈমানের মূলভিত্তি অপসারণ করে এবং কাউকে দ্বীন-ইসলাম হতে খারিজ করে দেয়। উলামাবৃন্দ বলেন, “এটা এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যে ওই কথা বলার সময় বিশ্বাস করে যে তারকা/নক্ষত্র আপনাআপনি এক কর্তা, যেটা বৃষ্টি আনতে পারে এবং বর্ষণ করতে পারে; ঠিক যেমনটি দাবি করেছিল জাহেলীয়্যা (অন্ধকার) যুগের কিছু লোক। যে কেউ এতে বিশ্বাস করলে তার অবিশ্বাস সম্পর্কে কোনো সন্দেহ-ই থাকে না।” এই অভিমত সংখ্যাগরিষ্ঠ উলামাদের, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম শাফেঈ (রহ:); আর এটা ওই হাদীসের স্পষ্ট অর্থ-ও। উলামাবৃন্দ (আরো) বলেন, ”এরই ভিত্তিতে কেউ যদি বলেন: ‘অমুক তারকা বা তমুক নক্ষত্রের দ্বারা আমাদেরকে বৃষ্টি এনে দেয়া হয়েছিল’, কিন্তু তিনি যদি বিশ্বাস করেন যে এটা আল্লাহতা’লা ও তাঁরই করুণা হতে নিঃসৃত, অার প্রথানুসারে এটার জন্যে ওই তারকা/নক্ষত্র একটি নিদর্শন এবং (বৃষ্টি আরম্ভের ইঙ্গিতবহ) এক নির্ধারিত সময়, তাহলে ওই কথা দ্বারা যেনো তিনি ব্যক্ত করেছেন: ‘বৃষ্টি আমাদের প্রতি বর্ষিত হয়েছে অমুক সময়ে।’ বস্তুতঃ এ ব্যক্তি অবিশ্বাস করেননি।” এই বিষয়টি নিন্দনীয় কি না, তা নিয়ে উলামামণ্ডলী মতভেদে জড়িয়েছেন। তবে এটা মূলতঃ মকরূহ তানযিহী (অপছন্দনীয়) বলে সাব্যস্ত, যা’তে কোনো গুনাহ/পাপ নেই। এটা অছন্দনীয় হওয়ার কারণ হলো, এতে এমন কথা রয়েছে যা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝে টলটলায়মান; হয়তো এর দরুন বক্তার প্রতি কারো মনে মন্দ ধারণা আসতে পারে, কেননা এটা ইসলাম-পূর্ব যুগের প্রবচন এবং সেসব লোকের কথা যারা ওই (জাহেলীয়্যা যুগের) পথের পথিক।

২/ – এই হাদীসের মৌলিক ব্যাখ্যাসম্পর্কিত দ্বিতীয় মতটি হলো: “এখানে আল্লাহতা’লার আশীর্বাদের প্রতি অস্বীকৃতিকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে, যেহেতু বৃষ্টি বর্ষণের বিষয়টিকে স্রেফ তারকার প্রতি আরোপ করা হয়েছে। এটা সেই ব্যক্তির প্রসঙ্গের (মোকাবেলায়), যিনি তারকা/নক্ষত্রের স্বাধীন/স্বকীয় নিয়ন্ত্রণে বিশ্বাস করেন না।” এই ব্যাখ্যাটিকে সমর্থন করেছে এ অনুচ্ছেদের শেষ বর্ণনা, যেটা ব্যক্ত করে: ““আমার (খোদার) কতিপয় বান্দা/সেবক আমার প্রতি বিশ্বাস নিয়ে জাগ্রত হয়েছেন; আরো (কিছু) আমার প্রতি অবিশ্বাস নিয়ে জেগেছে (অর্থাৎ, কাফের হিসেবে)।”

অন্য এক রাওয়ায়াতে এসেছে: “আল্লাহতা’লা আসমান/বেহেশত্ থেকে নেআমত বা আশীর্বাদময় কোনো কিছু অবতীর্ণ করেন না এ ছাড়া যে, এক দল লোক সেগুলোর ব্যাপারে অবিশ্বাসী (কা-ফিরূন) হিসেবে জেগে ওঠে।” তাঁর মন্তব্য – ‘সেগুলোর ব্যাপারে’ – প্রমাণ করে যে এটা কুফর আল-নি’মা’ তথা আশীর্বাদের প্রত্যাখ্যান। আর আল্লাহতা’লাই সবচেয়ে ভালো জানেন। [ইমাম নববী (রহ:)-এর উদ্ধৃতির সমাপ্তি]     

আপনারা এখানে দেখতে পেলেন যে ইমাম নববী (রহ:) উলামাদের সেই ঐকমত্যের কথা-ই উল্লেখ করেছেন, যা’তে বিবৃত হয়েছে যে কেউ কোনো মাধ্যম বা মধ্যস্থতাকারীর প্রতি কোনো কর্ম আরোপ করলে তিনি অবিশ্বাসী হবেন না, যদি না তিনি বিশ্বাস করেন যে ওই মাধ্যম/মধ্যস্থকারী হচ্ছে (সৃষ্টি)-কর্তা, পরিচালক ও উৎস। মধ্যস্থতাকারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এরকম না হলে, কোনো বস্তুর সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতাকারীকে কোনো আলামত/চিহ্ন বা কেন্দ্রবিন্দু জ্ঞান করা না হলে তা কুফর বা শিরক হবে না। পক্ষান্তরে, কখনো কখনো বিধাতা (আল্লাহ) অসীলার প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, যেমনটি বিধৃত হয়েছে মহানবী (দ:)-এর বাণীতে, যা’তে তিনি এরশাদ করেন: “যে কেউ তোমাদের উপকার/ভালাই করলে তার প্রতিদান দাও। তোমরা অক্ষম হলে তার জন্যে দুআ করো, যতোক্ষণ না তোমরা জানতে পারো তোমরা ওর প্রতিদান দিয়েছো।” তিনি অন্যত্র এরশাদ ফরমান: “যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞ নয়, সে আল্লাহর প্রতিও কৃতজ্ঞ নয়।” 

অসীলা তথা মাধ্যমের প্রতি এ পন্থায় মনোযোগ দেয়ায় আল্লাহর নেআমত/আশীর্বাদ প্রার্থনাকে নাকচ করে দেয় না। আল্লাহ প্রশংসা করেছেন, বরঞ্চ (ক্বুরআন মজীদের) কোনো কোনো জায়গায় পুরস্কৃত করেছেন তাঁর প্রিয় বান্দাদেরকে তাঁদেরই ওই (ধরনের) কর্মের দরুন, আর তিনি-ই হলেন তাঁদের ওই কর্ম সংঘটনের ইচ্ছা পোষণের (আসল) কারণ এবং এতে তাঁদের সামর্থ্যের স্রষ্টাও তিনি। 

আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “আমি দাউদকে দান করেছি সুলায়মান। কতোই উত্তম বান্দা! নিশ্চয় সে অতিশয় (ক্ষমা প্রার্থনায়) প্রত্যাবর্তনকারী” [সূরা সোয়া-দ, ৩০ আয়াত, নূরুল এরফান বাংলা সংস্করণ]। তিনি অন্যত্র এরশাদ ফরমান: “ঈমান গ্রহণের পরে যারা সৎ/উত্তম কাজ করেছে, তাদের ঈমানদারির কারণে আল্লাহ তাদেরকে সঠিক পথ প্রদর্শন করবেন; তাদের নিচে নহরসমূহ প্রবাহিত হবে নেআমতের বাগানগুলোতে” [সূরা ইঊনুস, ৯ আয়াত]। তিনি আরো এরশাদ করেন: “নিশ্চয় লক্ষ্যস্থলে পৌঁছেছে (সে ব্যক্তি), যে সেটাকে (নিজ অন্তরকে) পবিত্র করেছে” [সূরা আল-শামস্, ৯ আয়াত]। যখন আপনাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে একটি ক্রিয়াপদকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা সম্ভব, তখনই আপনারা দেখতে পাবেন যে এসব অর্থ পরস্পরবিরোধী নয়। অবশ্য তা নির্ভর করছে আপনাদেরই সঠিক উপলব্ধির ওপর। 

বাহ্যিক অভিব্যক্তির চেয়ে অর্থগুলো আরো বিস্তৃত বা ব্যাপক; আর মানুষের বক্ষগুলোও বইপত্র ও অন্যান্য লেখনী হতে অধিক বিস্তৃত/ব্যাপক। আমরা যদি স্রেফ লিখিত অভিব্যক্তিগুলোকে বিবেচনা করি এবং আলঙ্কারিক (অর্থ) গ্রহণ না করি, তাহলে (মৌলিক) শাস্ত্রলিপিগুলোকে সংযুক্ত বা আলাদা করাও আমাদের জন্যে অনুমতিপ্রাপ্ত হবে না। 

আপনারা কি আল-ক্বুরআনে পাঠ করেননি আল্লাহ পাক আমাদের যা জানিয়েছিলেন পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:) সম্পর্কে? তিনি আরয করেন: “হে আমার রব্ব! নিশ্চয় প্রতিমাগুলো বহু লোককে পথভ্রষ্ট করেছে” [সূরা ইবরাহীম, ৩৬ আয়াত]। আপনারা কি এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করবেন যে পয়গম্বর ইবরাহীম (আ:) আল্লাহতা’লার সাথে শক্ত জড় পদার্থকে শরীকদার স্থাপন করেছিলেন, যেখানে তিনি নিজে এ কথাও বলেছেন: “তোমরা কি নিজেদের হাতের গড়া (মূর্তি)-গুলোর পূজা করছো? অথচ আল্লাহ তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের কর্মগুলোকেও” [সূরা সোয়াফ-ফা-ত, ৯৫-৬]

এই বিষয়টির ব্যাপক অর্থ হলো, কেউ মহান আল্লাহর সাথে স্বাধীন/স্বকীয় সৃষ্টিক্ষমতা ও প্রভাবসম্পন্ন শরীকদার – হোক তা জড় পদার্থ অথবা হোন নবী কিংবা অন্য কিছু – স্থাপন করলে মুশরিকে পরিণত হবে। অপরদিকে, কেউ যদি বিশ্বাস করেন যে নবী-ওলীবৃন্দ হচ্ছেন মাধ্যম (অসীলা), অার জড় পদার্থগুলোও সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় কারণস্বরূপ, তা প্রকাশিত হোক বা না-ই হোক, অধিকন্তু এ-ও যদি বিশ্বাস করেন আল্লাহতা’লাই কাঙ্ক্ষিত বস্তু (মুসাবাবা-ত) অর্জনের জন্যে এঁদেরকে মাধ্যম হিসেবে সৃষ্টি করেছেন এবং আল্লাহতা’লাই হলেন কোনো শরীক ব্যতিরেকে একমাত্র (সৃষ্টি)-কর্তা, তাহলে তিনি একজন ঈমানদার (বিশ্বাসী)। এমন কি যদি তিনি প্রকৃতপক্ষে মাধ্যম নয় এমন বস্তুকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করার ভ্রান্তিতেও পড়েন, তবুও তিনি ঈমানদার (বলে বিবেচিত হবেন)। এটা এ কারণে যে তাঁর ভ্রান্তি স্রেফ অসীলার ব্যাপারেই, কিন্তু যিনি অসীলাটিকে সহজে লভ্য করেছেন সেই মহান স্রষ্টা ও পরিচালনাকারী আল্লাহর ব্যাপারে নয়।

প্রশংসা: এবাদত ও আদব/শিষ্টাচারের মধ্যকার পার্থক্য                

অনেক মানুষ এবাদত-বন্দেগীর হাক্বীক্বত তথা বাস্তবতা ও প্রশংসার বাস্তবতা উপলব্ধি করতে ভুল করেন এবং ফলশ্রুতিতে এই দুইয়ের মাঝে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। তারা মনে করেন, কারো যে কোনো ধরনের গুণকীর্তন করা প্রকৃতপ্রস্তাবে তারই এবাদত বা পূজো করার সামিল। তাদের দৃষ্টিতে সম্মানার্থে দাঁড়ানো, হস্তচুম্বন, মহানবী (দ:)-এর শানে ‘সাইয়্যেদ’ (মালিক) বা ‘মাওলানা’ (মনিব) লক্বব/খেতাবগুলো ব্যবহার করে তাঁকে সম্বোধন, তাঁর রওযা মোবারক যেয়ারতের সময় তা’যিম/সম্মান, আদব ও বিনয়স্বরূপ দাঁড়ানো ইত্যাদি কাজ এমন-ই সীমা লঙ্ঘন, যা আল্লাহতা’লাকে ছেড়ে অন্য কারো এবাদত-বন্দেগীতে পরিণত হয়। অথচ বাস্তবতা হলো, এটা নিরেট মূর্খতা যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দ:)-এর অপছন্দের সীমাকে চরম পর্যায়ে লঙ্ঘন করে থাকে। এটা মহা বিচ্যুতি আর তাই পবিত্র ইসলাম ধর্মীয় বিধানের মূলনীতি কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত।

পয়গম্বর আদম (আ:)-এর কথাই ধরুন, যিনি মানবজাতির প্রথম এবং এই জাতি হতে আল্লাহতা’লার প্রথম পুণ্যবান বান্দা। আল্লাহতা’লা তাঁর ফেরেশতাকুলকে পয়গম্বর আদম (আ:)-এর প্রশংসা ও সম্মানার্থে তাঁকে সেজদা করতে আদেশ করেন (স্রেফ) এই কারণে যে, তিনি (আল্লাহ) তাঁকে (আদমকে) নিজ জ্ঞান হতে জ্ঞান দান করেছিলেন, আর এ বিষয়টিও তাঁদেরকে জানাতে যে তাঁরই সৃষ্টিকুলের মাঝে তিনি (আদম) ছিলেন মনোনীত পয়গম্বর।

আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “এবং স্মরণ করুন, যখন আমি ফেরেশতাবর্গকে নির্দেশ দিলাম, ‘আদমকে সেজদা করো!’ তখন তারা সবাই সেজদা করলো, ইবলীস ব্যতিরেকে। সে বললো, ‘আমি কি তাঁকেই সেজদা করবো যাঁকে আপনি মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন?’ সে বললো, ‘দেখেন তো, আপনি কি তাঁকে আমার চেয়ে অধিক মর্যাদাবান করেছেন’?” [সূরা বনূ ইসরাঈল, ৬১-৬২ আয়াত]। আল্লাহ পাক অন্যত্র এরশাদ ফরমান: “(ইবলীস) বললো, আমি তাঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠ, আপনি আমাকে আগুন হতে সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁকে মাটি হতে” [সূরা আ’রাফ, ১২ আয়াত]। আল্লাহতা’লা অন্য আরেক আযাতে ঘোষণা করেন: “তখন যতো ফেরেশতা ছিলো, সবাই একত্রে সেজদাবনত হলো, ইবলীস ছাড়া। সে সেজদাকারীদের সাথী হতে অস্বীকার করলো” [সূরা হিজর, ৩০-৩১ আয়াত]।   

আল্লাহতা’লা যে মহান সত্তার মহিমা প্রকাশ করেছেন, ফেরেশতামণ্ডলী-ও তাঁরই গুণকীর্তন করেছেন। অপর পক্ষে, ইবলীস (শয়তান) মাটি হতে সৃষ্ট পয়গম্বর আদম আলাইহিস্ সালামের সম্মানার্থে সেজদা করার ক্ষেত্রে দম্ভ প্রদর্শন করেছিলো। দ্বীনের মধ্যে মিথ্যে উপমা প্রয়োগের ক্ষেত্রে সে-ই ছিলো প্রথম। সে বলেছিলো: “আমি তাঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠ।” ইবলীসের এই অপযুক্তির পেছনে প্রদর্শিত কারণ ছিলো সে আগুনের সৃষ্টি, আর আদম (আ:) মাটির। হযরত আদম (আ:)-কে যে তার চেয়ে সম্মানিত করা হয়েছিলো, এ সত্যটুকু স্বীকার করার বেলায় সে অহঙ্কারী ছিলো এবং তাঁকে সেজদা না করার ক্ষেত্রে সে দম্ভ প্রদর্শন করেছিলো। আল্লাহতা’লা যাঁকে সম্মানিত করেছিলেন, তাঁকে সম্মান প্রদর্শন না করার ক্ষেত্রে সে-ই ছিলো প্রথম, আর তাই আল্লাহতা’লার পুণ্যবান বান্দা আদম (আ:)-এর প্রতি অহমিকা প্রদর্শনের দায়ে তাকে আল্লাহতা’লার করুণা হতে বঞ্চিত ও বিতাড়িত করা হয়েছিলো। এটা ছিলো চরম পর্যায়ের দাম্ভিকতা, কেননা ওই সেজদা ছিলো স্রেফ আল্লাহরই খাতিরে এবং তাঁরই নির্দেশক্রমে। পয়গম্বর আদম (আ:)-কে ফেরেশতাদের চেয়ে উচ্চতর সম্মান ও মাহাত্ম্য দানের উদ্দেশ্যেই আল্লাহ পাক তাঁদেরকে সেজদা করতে বলেছিলেন। অতএব, ইবলীস (শয়তান) এক আল্লাহ’তে বিশ্বাসী (তওহীদপন্থী/‘মুওয়াহহেদ’) হওয়া সত্ত্বেও তার ওই একত্ববাদ নিজের জন্যে উপকারী বা ফায়দাপূর্ণ হয়নি।

পুণ্যবানদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ব্যাপারে পয়গম্বর ইঊসুফ (আ:) প্রসঙ্গে আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “এবং ইঊসুফ আপন পিতা ও মাতাকে তার সিংহাসনে বসালো এবং সবাই তার প্রতি সেজদায় পড়লো” [সূরা ইঊসুফ, ১০০ আয়াত]। এটা করা হয়েছিলো তাঁদের সবার চেয়ে তাঁকে বেশি বন্দনা, মাহাত্ম্য, শ্রদ্ধা ও প্রশংসা করার খাতিরেই। তাঁর ভাইদের কৃত এই প্রণিপাত খোদাতা’লার বাণীতেই বিধৃত হয়েছে: “(সেজদায়) পড়লো হয়তো এটা তাঁদের বিধানে অনুমতিপ্রাপ্ত ছিলো; কিংবা তাঁর পিতা-মাতা যে সেজদা করেছিলেন, তা পয়গম্বর আদম (আ:)-এর প্রতি ফেরেশেতাদের কৃত সেজদার মতোই ছিলো, যা পয়গম্বর ইঊসূফ আলাইহিস সালামকে সম্মান প্রদর্শন ও তাঁরই গুণকীর্তনের খাতিরে করা হয়েছিলো, আর  আল্লাহরই আদেশ পালনার্থে ছিলো এবং তা ইঊসুফ (আ:)-এর স্বপ্নেরই বাস্তবায়নস্বরূপ হয়েছিলো; কেননা আম্বিয়া (আ:)-বৃন্দের স্বপ্ন-ও ঐশী প্রত্যাদেশ (ওহী) বটে। 

হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে মহান আল্লাহতা’লা ঘোষণা করেন: “(হে রাসূল) নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি হাযির-নাযির (উপস্থিত প্রত্যক্ষকারী) এবং সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী করে, যাতে, হে লোকেরা, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনো এবং রাসূলের মহত্ত্ব বর্ণনা ও (তাঁর প্রতি) সম্মান প্রদর্শন করো” [সূরা ফাতহু, ৮-৯ আয়াত; নূরুল এরফান তাফসীরগ্রন্থ]। তিনি আরো ফরমান: “হে ঈমানদারবর্গ! আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আগে বাড়বে না” [সূরা হুজুরা’ত, ১ নং আয়াত]। আরো ফরমান: “হে ঈমানদারবর্গ! নিজেদের কণ্ঠস্বরকে উঁচু করো না ওই অদৃশ্যের সংবাদদাতা (নবী)-এর কণ্ঠস্বরের ওপর” [সূরা হুজুরা’ত, ২ নং আয়াত]। তিনি আরো ফরমান: “এবং তাঁর (রাসূলের) সামনে চিৎকার করে কথা বলো না, যেভাবে একে অপরের সাথে চিৎকার করে কথা বলো” [সূরা হুজুরা’ত, ২ নং আয়াত]। 

রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর কণ্ঠস্বরের চেয়ে উঁচু কণ্ঠস্বরে তাঁর সামনে কথা বলতে এবং অশিষ্ট আচরণ করতে আল্লাহতা’লা বারণ করেছেন। হযরত সাহল ইবনে আব্দিল্লাহ (রা:) বলেন, “তিনি কথা বলার আগে কথা বলো না।” এর মানে হলো, রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর সামনে কারো কথা বলা উচিত নয়, আর তিনি কথা বল্লে মনোযোগসহ শোনা উচিত। সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-কে তাঁর চেয়ে অগ্রসর হয়ে তিনি সূত্রপাত করার আগেই কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে; কিংবা তাঁর আদেশ ব্যতিরেকে (পারস্পরিক) ঝগড়া-বিবাদ ও নিজেদের অন্যান্য ধর্মীয় বিষয়ে ফতোওয়া জারি করতেও বারণ করা হয়েছে; অথবা এসব ক্ষেত্রে মহানবী (দ:)-এর চেয়ে বেশি অগ্রসর হতেও নিষেধ করা হয়েছে। আর আল্লাহতা’লা এ বিষয়টির বিরোধিতা করার ব্যাপারে তাঁদেরকে সতর্ক হওয়ার উপদেশও দিয়েছেন। তিনি এরশাদ ফরমান: “এবং আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় তিনি শুনেন, জানেন” [সূরা হুজুরা’ত, ১ নং আয়াত]।  হযরত আল-সুলামী (রা:) বলেন, “আল্লাহকে ভয় করো পাছে তোমরা মহানবী (দ:)-এর অধিকারের প্রতি অবহেলা/অবজ্ঞা করো এবং তাঁর প্রাপ্য সম্মান যথাযথভাবে প্রদর্শন না করো। নিশ্চয় তিনি (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) তোমাদের কথাবার্তা শুনতে পান এবং তোমাদের কর্মগুলোও (ভালোভাবে) জানেন।” 

অতঃপর আল্লাহতা’লা তাঁদেরকে (সাহাবাবৃন্দকে) নিজেদের মধ্যে উচ্চস্বরে তাঁরা যেভাবে কথা বলেন, সেভাবে মহানবী (দ:)-এর সামনে তাঁর চেয়েও উচ্চস্বরে কথা বলতে বারণ করেছেন। একথা বর্ণিত হয়েছে, “যেমনটি তাঁরা একে অপরকে নামের মূল অংশ উচ্চারণ করে ডেকে থাকেন (সেভাবে ডাকা যাবে না)।” হযরত আবূ মুহাম্মদ আল-মক্কী (রহ:) বলেন, “এর মানে হলো, কথা বলার সময় তাঁর আগে কথা বলো না, অথবা তাঁর প্রতি অসম্মানজনক পন্থায় তাঁকে সম্বোধন করো না। তোমরা একে অপরকে যেভাবে নাম ধরে ডাকো, সেভাবে ডাকবে না; বরং তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে তাঁরই মহত্ত্ব বর্ণনা করো এবং তাঁরই পছন্দনীয় শ্রদ্ধাপূর্ণ লক্বব/খেতাব ব্যবহার করে তাঁকে সম্বোধন করো; যেমন – ‘এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)’, ‘এয়া নবী-ইয়্যাল্লাহ (দ:)’ ইত্যাদি।”

এটা মহান আল্লাহতা’লার বাণীর অনুরূপ, যেমনটি তিনি এরশাদ ফরমান: “এবং তাঁর (রাসূলের) সামনে চিৎকার করে কথা বলো না, যেভাবে একে অপরের সাথে চিৎকার করে কথা বলো” [সূরা হুজুরা’ত, ২ নং আয়াত]। অন্যান্য ইমামবৃন্দ বলেন, “তাঁকে সম্বোধন করো না, স্রেফ জানার বা বোঝার চেষ্টারত কারো (দৃষ্টিভঙ্গি) ছাড়া।” আল্লাহতা’লা স্বয়ং সাহাবাবৃন্দ (রা:)-কে ভয় করতে বলেছেন পাছে একে অপরকে ডাকার মতো রাসূলুল্লাহ (দ:)-কে আহ্বানের কারণে তাঁদের সমস্ত আমল (পুণ্যদায়ক কর্ম) বরবাদ হয়ে যায়।

এই আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছিলো একটি দল (নজদী বনূ তামীম গোত্র) সম্পর্কে, যারা মহানবী (দ:)-এর হুজরাহ শরীফের বাইরে থেকে চিৎকার করে বলেছিলো, “হে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম), আমাদের সামনে বেরিয়ে আসুন।” আল্লাহতা’লা তাদের এই (মূর্খতাপ্রসূত) আচরণের জন্যে তাদেরকে তিরস্কার করেন এ কথা বলে যে তাদের অধিকাংশই নির্বোধ। 

হযরত আমর ইবনে আল-’আস্ (রা:) বলেন: “আমার কাছে রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর চেয়ে প্রিয় আর কেউই ছিলেন না এবং আমার দৃষ্টিতে তাঁর চেয়ে মহৎ-ও কেউ ছিলেন না। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার কারণে আমি তাঁকে নয়ন জুড়িয়ে দেখতে সক্ষম হইনি। তাঁর ব্যাপারে বর্ণনা দিতে গেলে আমি তা দিতে পারবো না, কেননা আমি কখনো তাঁকে চোখ জুড়িয়ে দেখতে পারিনি।” [মুসলিম শরীফ, ‘কিতাবুল ঈমান’]

ইমাম তিরমিযী (রহ:) হযরত আনাস (রা:) হতে বর্ণনা করেন যে মোহাজির ও আনসার সাহাবা (রা:)-বৃন্দ যখন বসা অবস্থায় থাকতেন, তখন তাঁদের মাঝে রাসূলুল্লাহ (দ:) যেতেন; আর তখন তাঁদের মাঝে সর্ব-হযরত আবূ বকর (রা:) ও উমর (রা:)-ও থাকতেন। এঁরা দু জন ছাড়া অন্য কেউই তাঁর দিকে চোখ তুলে তাকাতেন না। এই দুই সাহাবী (রা:) মহানবী (দ:)-এর দিকে তাকাতেন এবং তিনিও তাঁদের দিকে তাকাতেন; আর তাঁরা তাঁর দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসতেন, এবং তিনিও তাঁদের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসতেন।” হযরত উসামা বিন শুরাইক (রা:) বলেন: “আমি মহানবী (দ:)-এর দরবারে উপস্থিত হই, যখন তাঁর সাহাবা (রা:)-বৃন্দ তাঁর চারপাশ ঘিরে অবস্থান করছিলেন। এ যেনো তাঁদের মাথার ওপরে পাখি বসেছিলো (এমন মনে হয়েছে)।” (তাঁর বিবরণে তিনি আরো বলেন): “…..হুযূর পাক (দ:) কথা বল্লে সাহাবা (রা:)-বৃন্দ সামনের দিকে এমনভাবে মাথা ঝুঁকাতেন যেনো তাঁদের মাথায় পাখি বসেছিলো।”

হযরত উরওয়া ইবনে মাসউদ (রা:)-কে ক্বুরাইশ গোত্র সংঘাতের বছরে মহানবী (দ:)-এর সাথে দেখা করার নির্দেশ দেয়। তিনি সেখানে গিয়ে দেখতে পান কীভাবে সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) রাসূলূল্লাহ (দ:)-এর প্রশংসা করেন এবং তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন; আর কীভাবে তিনি পানি দ্বারা অযূ করার সময় সাহাবাবৃন্দ (রা:) তাঁরই অযূতে ব্যবহৃত পানির জন্যে কাড়াকাড়ি করেন; আর কীভাবে তিনি থুতু ফেলতে নিলে তাঁরা তা হাতের তালুতে নিয়ে নিজেদের মুখমণ্ডলে ও শরীরে মাখেন।

ওই সাহাবী (রা:) আরো দেখতে পান যে মহানবী (দ:)-এর কোনো চুল পড়লে সাহাবাবৃন্দ (রা:) তা নেয়ার জন্যে ছুটে যাচ্ছেন; আর তিনি তাঁদেরকে কোনো আদেশ করলে তাঁরা অবিলম্বে তা পালন করছেন; আর তিনি কথা বল্লে তাঁরা নিজেদের কণ্ঠস্বর তাঁর সামনে নিচু রাখছেন; আর ভক্তি-শ্রদ্ধার কারণে তারা হুযূর পাক (দ:)-এর দিকে সরাসরি তাকাচ্ছেন না। অতঃপর ওই সাহাবী (রা:) এসব কিছু প্রত্যক্ষ করে ক্বুরাইশ গোত্রের কাছে ফিরে যান এবং তাদেরকে বলেন: “ওহে ক্বুরাইশ গোত্র! নিশ্চয় আমি পারসিক রাজ খসরুদের দরবারে গিয়েছি, রোমান বাদশাহ সিজারদের রাজ দরবারেও গিয়েছি, এবং আফ্রিকী সুলতান নাজ্জাশীর দরবারেও গিয়েছি। আল্লাহর কসম, হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবা (রা:)-বৃন্দের মাঝে যেমন (শ্রদ্ধেয়), কোনো রাজা-বাদশাহকেই তার প্রজাদের মাঝে তেমনিভাবে আমি দেখতে পাইনি।”

আরেকটি বর্ণনায় বিবৃত হয়েছে: “আমি কখনো দেখিনি কোনো রাজার গুণকীর্তন এমনিভাবে হতে, যেমনটি মহানবী (দ:)-এর সাহাবাবৃন্দ (রা:) তাঁর প্রশংসা করে থাকেন। আমি এমন এক জাতিকে দেখে এলাম, যাঁরা কখনোই আত্মসমর্পণ করবেন না।” 

সর্ব-ইমাম আল-তাবারানী (রহ:) ও ইবনে হিব্বান (রহ:) দু জন-ই হযরত উসামা ইবনে শুরাইক (রা:) হতে বর্ণনা করেন; তিনি বলেন: “আমরা একবার মহানবী (দ:)-এর দরবারে বসেছিলাম এমনভাবে যেনো আমাদের মাথার ওপরে পাখি বসেছিলো। আমাদের মধ্যে কেউই কোনো কথা বলছিলেন না। এমতাবস্থায় মানুষেরা এসে হুযূর পূর নূর (দ:)-কে জিজ্ঞেস করেন, ‘আল্লাহতা’লার কাছে তাঁর বান্দাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় কারা?’ তিনি উত্তর দেন, ‘তাদের মধ্যে যারা চরিত্রে সর্বোত্তম’।”  [‘তারগিব’ শীর্ষক পুস্তকেও বর্ণিত (৪:১৮৭), আর তাতে বলা হয়: “সহীহ হাদীসের সংকলকবৃন্দের কাছ থেকে গ্রহণ করে ইমাম তাবারানী (রহ:) এটা রওয়ায়াত করেন]   

ইমাম আবূ এয়া’লা’ (রহ:) নিজ ‘সহীহ’ গ্রন্থে হযরত আল-বারাআ বিন আল-আ’যিব (রা:) হতে বর্ণনা করেন; তিনি বলেন: “আমি রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর কাছে (কখনো) কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করলে তা দুই বছরের জন্যে বিলম্বিত করতাম স্রেফ তাঁর প্রতি আমার হায়বা তথা সশ্রদ্ধ সমীহ ও ভক্তির কারণেই।”

ইমাম আল-বায়হাক্বী (রহ:) বর্ণনা করেন হযরত আল-যুহরী (রা:) হতে, যিনি বলেন: “আনসার সাহাবাবৃন্দের (রা:) মধ্যে এমন একজন যাঁকে আমি কোনো কিছুর জন্যে দোষারোপ করি না, তাঁর কাছ থেকে অবগত হয়েছি এই মর্মে যে, রাসূলুল্লাহ (দ:) যখন অযূ করতেন বা কফ/থুতু নিক্ষেপ করতেন, তখন সাহাবাবৃন্দ ওই কফ/থুতু গ্রহণ করতে ছুটে যেতেন এবং তা দ্বারা নিজেদের মুখমণ্ডল ও ত্বক মুছতেন। এমতাবস্থায় নবী করীম (দ:) প্রশ্ন করতেন, ‘তোমরা এ কাজ কেন করছো?’ তাঁরা উত্তর দিতেন, ‘এর থেকে তবাররুক নিতে (এ কাজ করছি)।’ অতঃপর মহানবী (দ:) বলতেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দ:)-এর ভালোবাসা পাওয়াকে পছন্দ করে, সে যেনো (সর্বদা) সত্য কথা বলে, (তার প্রতি আরোপিত) বিশ্বাস ও আস্থা পূরণ করে এবং নিজের প্রতিবেশিদের ক্ষতি না করে’।”  [‘কানয আল-উম্মা’ল’, ৮:২২৮] 

এসব দলিল পেশের পরে দুটো বড় বিষয় এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথমটি হলো, মহানবী (দ:)-এর প্রশংসা ও মাহাত্ম্য বর্ণনা এবং অন্যান্য সৃষ্টির ঊর্ধ্বে তাঁর পদমর্যাদাকে সমুন্নত করার বাধ্যবাধকতা। দ্বিতীয়টি হলো, আল্লাহর প্রভুত্বকে পৃথক করে নেয়া এবং এই বিশ্বাস পোষণ করা যে মহান আল্লাহতা’লা তাঁর সকল সৃষ্টি হতে আপন যাত/সত্তা মোবারক, গুণাবলী ও কর্মে একেবারেই অনন্য। যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে যে সৃষ্টিকুল এগুলোর কোনোটিতে স্রষ্টার সাথে শরীকদার, সে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই সাথে শির্ক করবে – ঠিক যেমনটি (মক্কার) মূর্তিপূজারী কুফফারবর্গ বিশ্বাস করতো তাদের মূর্তিগুলোর প্রভুত্বে এবং সেগুলোর অর্চনাযোগ্য হওয়ার বিষয়টিতে। অপরদিকে, যে ব্যক্তি মহানবী (দ:)-এর উচ্চমর্যাদাকে অবমূল্যায়ন বা হেয় করে, সে হয় (আনুগত্য) অমান্যকারী, নতুবা অবিশ্বাসী (কাফের)।

আর যে ব্যক্তি বিভিন্ন ধরনের প্রশংসা দ্বারা প্রিয়নবী (দ:)-এর শান-মান সমুন্নত করেন, অথচ স্রষ্টার কোনো খাস/স্বকীয় বৈশিষ্ট্যসহ হুযূর পাক (দ:)-এর গুণ বর্ণনা করেন না, তিনি বাস্তবিকই সত্যে উপনীত হয়েছেন এবং খোদার প্রভুত্ব ও রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর রেসালাতের অধিকার উভয়কেই একযোগে সুরক্ষিত করেছেন। এটা এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি যা’তে নেই কোনো সীমা লঙ্ঘন অথবা অবহেলা।

পক্ষান্তরে, কোনো ঈমানদার মুসলমানের কথায় যদি আল্লাহ ভিন্ন অন্য কোনো সত্তার প্রতি কিছু আরোপের আভাস পাওয়া যায়, তাহলে সেটাকে আলঙ্কারিক ভাষণ হিসেবে গণ্য করা বাধ্যতামূলক; অধিকন্তু, এক্ষেত্রে বক্তার প্রতি তাকফির/অবিশ্বাসের ফতোয়া জারি করা কোনোক্রমেই উচিত নয়। কেননা ক্বুরআন ও সুন্নাহতে এরকম আলঙ্কারিক ভাষা (নিত্য) ব্যবহৃত হয়েছে।

শির্ক (অংশীবাদ)-এর মাধ্যম    

অনেক মানুষ অসীলা তথা মাধ্যমগুলোর বাস্তবতা সম্পর্কে ভুল বুঝে থাকে আর তারা বেপরোয়াভাবে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, যে কোনো ধরনের অসীলা-ই শির্ক; অতএব, যে কোনো কিসিমের অসীলা গ্রহণকারী ব্যক্তি-ই আল্লাহর সাথে শরীককারী, আর তার অবস্থা হলো (মক্কার) কুফফারদের মতোই, যারা বলেছিলো: “আমরা তো তাদেরকে (মূর্তিগুলোকে) এতোটুকু কথার জন্যে পূজা করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর সান্নিধ্যে এনে দেবে।” [সূরা যুমার, ৩ নং আয়াত]   

বস্তুতঃ এই বক্তব্য প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, আর এখানে এই আয়াতটিকে দলিল হিসেবে পেশ করার চেষ্টা করাটাও অপ্রাসঙ্গিক। এটা এ কারণে যে (মক্কার) কুফফারদের দ্বারা তাদের মূর্তিগুলোর পূজা, সেগুলোকে খোদাতা’লা ছাড়া অন্যান্য উপাস্য সত্তা হিসেবে গ্রহণ এবং তাঁর খোদায়িত্বের সাথে সেগুলোকে শরীক স্থাপন এই দাবি সহকারে যে সেগুলোর পূজা করার দরুন সেগুলো আল্লাহ পাকের নৈকট্য এনে দেবে, এই পবিত্র আয়াতটি এসবেরই প্রতি স্পষ্ট সমালোচনা ব্যক্ত করেছে। তাদের শেরেকী (অংশীবাদী) ধ্যান-ধারণা ও কুফর (অবিশ্বাস) নিঃসৃত হয়েছে এ জাতীয় মূর্তির পূজা এবং এগুলোকে আল্লাহ ছাড়া উপাস্য সত্তা হিসেবে ধারণা করার উভয় ভ্রান্তি হতেই। এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা দরকার তা হলো, এই আয়াতটি নিশ্চিত করেছে যে কুফফারদের দ্বারা মূর্তিপূজার পক্ষে যে অজুহাত দেখানো হয়েছে এই মর্মে যে মূর্তিগুলো (মধ্যস্থতা করে) তাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেবে, তা মোটেও আন্তরিক নয়। কেননা এ দাবিতে তারা যদি সত্যবাদী হতো, তাহলে তাদের মূর্তিগুলোর চেয়ে তারা আল্লাহকে আরো বড় বিবেচনা করতো বা বেশি মূল্যায়ন করতো; আর তারা আল্লাহ ভিন্ন কারোরই উপাসনা করতো না। 

আল্লাহতা’লা কুফফারদের মূর্তিগুলোর প্রতি অপমানজনক কোনো কিছু করতে মুসলমানদেরকে নিষেধ করেছেন। তিনি এরশাদ ফরমান: “এবং তোমরা ওই সব (মূর্তিকে) গালি দেবে না, যেগুলোর তারা আল্লাহকে ছেড়ে পূজা করছে; কেননা তারা আল্লাহর শানে বেয়াদবি করবে সীমালঙ্ঘন ও মূর্খতাবশতঃ। এভাবে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিতে আমি তাদের কার্যকলাপকে সুশোভন করেছি; অতঃপর তাদের রব্বের নিকট তাদেরকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে; এবং তিনি তাদেরকে বলে দেবেন যা তারা করতো।” [সূরা আল-আন’আম, ১০৮ আয়াত]       

হযরত ক্বাতাদা (রা:) হতে সর্ব-ইমাম আবদুর রাযযাক্ব (রহ:), আবদ ইবনে হামীদ (রহ:), ইবনে জারীর তাবারী (রহ:), ইবনে আল-মুনযির (রহ:), ইবনে আবী হা’তিম (রহ:) ‍ও আবূ আল-শায়খ (রহ:) বর্ণনা করেন; তিনি (হযরত ক্বাতাদা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন: “মুসলমানবৃন্দ (মক্কার) কুফফারদের মূর্তিগুলোকে (ইতিপূর্বে) গালাগালি করতেন এবং অভিসম্পাত দিতেন, আর মক্কার কুফফারবর্গ-ও মহান আল্লাহতা’লাকে পাল্টা গালিগালাজ করতো এবং অভিসম্পাত দিতো। এমতাবস্থায় আল্লাহ আয়াত নাযেল করেন, ‘তোমরা ওই সব (মূর্তিকে) গালি দেবে না, যেগুলোর তারা আল্লাহকে ছেড়ে পূজা করছে; কেননা তারা আল্লাহর শানে বেয়াদবি করবে সীমালঙ্ঘন ও মূর্খতাবশতঃ’।”

এটা-ই এ আয়াতটির অবতীর্ণ হওয়ার কারণ; এতে মুসলমানদেরকে দৃঢ়ভাবে নিষেধ করা হয়েছে মক্কার কুফফারদের উপাসনাকৃত মূর্তিগুলোর প্রতি যেনো তাঁরা অপমানজনক কিছু না করেন। কেননা যারা অন্তরে বিশ্বাস করতো ওইসব মূর্তি আল্লাহ ভিন্ন অন্যান্য উপাস্য সত্তা, আর সেগুলোর রয়েছে উপকার ও অপকার করার ক্ষমতা, তারা এতে অত্যন্ত রাগান্বিত হতো। ফলে তারা ক্রোধের কারণে অনুরূপ পন্থায় ঈমানদারদের উপাস্য রাব্বুল আলামীন মহান আল্লাহতা’লাকেও গালিগালাজ করতো; আর তারা তাঁর প্রতি ত্রুটি-বিচ্যুতির অভিযোগ উত্থাপন করতো, যদিও তিনি সমস্ত ধরনের দোষত্রুটি ও ভুলভ্রান্তির ঊর্ধ্বে। 

এতদসত্ত্বেও কুফফারবর্গ যদি তাদের দাবিতে আন্তরিক হতো এই মর্মে যে তারা তাদের উপাস্য মূর্তিগুলোকে আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করে থাকে, তাহলে সেগুলোর প্রতি বিদ্রূপের প্রতিশোধস্বরূপ তারা তাঁকেই হেয় করার দুঃসাহস দেখাতো না। এ বিষয়টি একদম স্পষ্ট যে কুফফারবর্গ আল্লাহতা’লার চেয়ে নিজেদের মূর্তিগুলোকে বেশি উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন বলে বিবেচনা করতো। একই ভাষ্য পাওয়া যায় আল্লাহতা’লার আরেকটি পাক কালামে, যেখানে তিনি ফরমান: “এবং যদি আপনি (হে রাসূল) তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কে সৃষ্টি করেছেন আসমান ও জমিন এবং কাজে লাগিয়েছেন সূর্য ও চন্দ্রকে?’ তবে তারা অবশ্যই বলবে, ‘আল্লাহ’।” [সূরা আনকাবুত, ৬১ আয়াত]    

(মক্কার) কুফফার-বর্গ যদি সত্যি মহান আল্লাহতা’লায় বিশ্বাস করতো এ মর্মে যে তিনি-ই একমাত্র স্রষ্টা এবং তাদের উপাস্য মূর্তিগুলো কোনো কিছুই সৃষ্টি করেনি, তাহলে তারা নিজেদের মূর্তিগুলোর পূজা বাদ দিয়ে আল্লাহরই এবাদত-বন্দেগী করতো; অথবা অন্ততঃ নিজেদের মূর্তি ও পাথরের প্রতি লালিত ভক্তি-শ্রদ্ধার চেয়ে আল্লাহর প্রতি ভয় ও ভক্তি অন্তরে বেশি রাখতো। মহান আল্লাহ পাকের প্রতি প্রদর্শিত তাদের অমর্যাদা, যা নিজেদের মূর্তিগুলোর পক্ষে তাঁরই বিরুদ্ধে লালিত হিংসা হতে নিঃসৃত ছিলো, তার সাথে কি এর (মানে আয়াতে উক্ত তাদের তওহীদের সমর্থনসূচক কথার) কোনো সঙ্গতি আছে? এটা যে ন্যূনতম সামঞ্জস্য-ও রাখে না, তা একেবারেই স্পষ্ট। অধিকন্তু, কুফফার-চক্রের দৃষ্টিতে আল্লাহতা’লাকে হীন জ্ঞান করার পক্ষে আমাদের বিবেচনাধীন এই আয়াতটি-ই একমাত্র প্রামাণিক দলিল নয়; বরঞ্চ অনুরূপ আরো উদাহরণ বিদ্যমান। সেগুলোর মধ্যে একটি হলো আল্লাহতা’লার পাক কালাম: 

“এবং তারা বললো, ‘এসব গবাদি পশু ও ক্ষেত নিষিদ্ধ; এগুলোকে সে-ই খাবে, যাকে আমরা ইচ্ছা করি’, তাদেরই মিথ্যা ধারণা অনুসারে। এবং কতেক গবাদি পশু রয়েছে, যেগুলোর পৃষ্ঠে আরোহণ করা হারাম সাব্যস্ত করেছে; আর কতেক পশু যবেহ (জবাই) করার সময় তারা আল্লাহর নাম বলে না (মানে উচ্চারণ করে না); এসবই হচ্ছে আল্লাহর নামে মিথ্যা রচনা করা। তিনি অবিলম্বে তাদেরকে প্রতিফল দান করবেন তাদের মিথ্যা রচনাদির।” [সূরা আন’আম, ১৬৮ আয়াত, তাফসীরে নূরুল এরফান] 

(মক্কার) কুফফার গোষ্ঠী যদি আল্লাহতা’লাকে নিজেদের মূর্তির তুলনায় খাটো করে না-ই দেখতো, তাহলে এভাবে বিচার-বিবেচনা করতো না, যেটা এই আয়াতে করীমায় উল্লেখিত হয়েছে এবং যার দরুন আল্লাহতা’লার ফায়সালা তাদের জন্যে বিহিত হয়েছে – ’তিনি অবিলম্বে তাদেরকে প্রতিফল দান করবেন তাদের মিথ্যা রচনাদির।’

হযরত আবূ সুফিয়ান (রা:) ইসলাম ক্ববূল করার আগে অনুরূপভাবে আহ্বান করেন – ‘হুবাল মহিমান্বিত হোন!’ এই বর্ণনাটি বুখারী শরীফে উদ্ধৃত হয়েছে। তিনি তাঁর মূর্তি ‘হুবাল’কে ডাকছিলেন যাতে ওই সঙ্কটের মুহূর্তে আসমান ও জমিনের প্রভু আল্লাহতা’লা ও তাঁর ওপর বিশ্বাস স্থাপনকারী ঈমানদারদের বাহিনী, যাঁরা কুফফারদের মূর্তিগুলোর ওপর আধিপত্য বিস্তার করার ব্যাপারে ছিলেন আগ্রহী, তাঁদের বিরুদ্ধে মূর্তিটি বিজয় ছিনিয়ে আনে। এটা-ই হলো কুফফার-বর্গের  (মনের) অবস্থার একটি পরিমাপ; আর তারা কীভাবে বিশ্বজগতের প্রভু আল্লাহতা’লার মোকাবেলায় নিজেদের মূর্তিগুলোকে মূল্যায়ন করতো তারও একটি মানদণ্ড। 

এই বিষয়টি ভালোভাবে বোঝা খুবই জরুরি। কেননা লোকেরা এতদসংক্রান্ত বিষয়ে না বুঝেই ভ্রান্ত (তর্ক) সূত্রের ভিত্তিতে নিজেদের যুক্তি খাড়া করে থাকে। 

আপনারা কি দেখেননি, আল্লাহতা’লা যখন মুসলমানদের জন্যে নামাযের ক্বিবলা কা’বা শরীফকে নির্ধারণ করে দেন, তখন তাঁরা এবাদত করতে কা’বা শরীফের দিকেই মুখ ফেরান? কিন্তু এবাদত-বন্দেগী তো কা’বা শরীফের উদ্দেশ্যে ছিলো না; আর হাজরে আসওয়াদ তথা কালো পাথরকে চুমো খাওয়াও আল্লাহ ভিন্ন অন্য কারো এবাদত এবং মহানবী (দ:)-এর পদাঙ্ক অনুসরণ ছাড়া অন্য কিছু ছিলো না। মুসলমানবৃন্দ যদি ওই দুটি বস্তুর মধ্যে কোনোটির পূজা করার নিয়্যত করতেন, তাহলে তাঁরা মক্কার মূর্তিপূজারী কুফফার-বর্গের মতোই কুফফার হয়ে যেতেন।

অসীলা তথা মাধ্যমসমূহ অপরিহার্য এবং এগুলোকে মূর্তিপূজা হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। এ কথা বলা যায় না, যে ব্যক্তি তাঁর ও আল্লাহর মাঝে অসীলা তথা মধ্যস্থতাকারীর শরণাপন্ন হন, তিনি মুশরিক তথা মূর্তিপূজারীতে পরিণত হন। অন্যথা প্রত্যেক মানুষ-ই মুশরিক হয়ে যেতেন; কেননা আমাদের সকল কর্মেই মাধ্যমের একান্ত প্রয়োজন। মহানবী (দ:) ক্বুরআন মজীদের বাণী লাভ করেন ফেরেশতা জিবরাঈল (আ:)-এর মধ্যস্থতায়, আর তাই হযরত জিবরাঈল (আ:) রাসূল (দ:)-এর জন্যে মাধ্যম। আর মহানবী (দ:) হলেন তাঁর সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-এর জন্যে সবচেয়ে বড় মধ্যস্থতাকারী; কেননা তাঁরা সঙ্কটের মুহূর্তগুলোতে তাঁর কাছেই ছুটে যেতেন, নিজেদের প্রয়োজনের ব্যাপারে আর্জি পেশ করতেন এবং তাঁরই শাফাআত (সুপারিশ) ও দু’আ কামনা করতেন।

সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) যখন মহানবী (দ:)-এর মধ্যস্থতা গ্রহণের জন্যে তাঁর শরণাপন্ন হতেন, তখন তিনি তাঁদেরকে কখনোই বলেননি: “তোমরা শিরক (মূর্তি পূজা) ও কুফর (অবিশ্বাস) সংঘটন করেছো! আমার কাছে আর্জি পেশ করার বা কোনো কিছু চাওয়ার অনুমতি-ই নেই। বরঞ্চ তোমাদের উচিত আল্লাহর কাছে নিজেরাই দুআ’ (প্রার্থনা) করা, কেননা নিশ্চয় আমার চেয়ে আল্লাহ তোমাদের সন্নিকটে অবস্থান করেন।” পক্ষান্তরে, তিনি দাঁড়িয়ে তাঁদের জন্যে দুআ’ প্রার্থনা করতেন, যদিও তাঁরা ভালোভাবেই জানতেন যে প্রকৃত নেআমত দাতা, নিবারক, প্রসারকারী ও প্রদানকারী হলেন খোদ আল্লাহতা’লা, আর তাঁরা এ-ও জানতেন যে মহানবী (দ:) আল্লাহর অনুমতিক্রমে এবং রহমত-বরকত দ্বারাই কেবল তাঁদেরকে সেগুলো মঞ্জুর করতে সক্ষম। রাসূলূল্লাহ (দ:) স্বয়ং ঘোষণা করেন: “আনা ক্বাসিমুন, ওয়াল্লাহু ইউতি” – অর্থাৎ, আমি বণ্টনকারী, আল্লাহ পাক দাতা” [বঙ্গানুবাদকের নোট: ‘দান করার’ ক্রিয়াটি ‘মোযারে’ তথা বর্তমান ও ভবিষ্যতকালে ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ দান করছেন, করতে থাকবেন, রাসূল (দ:)-ও বণ্টন করছেন, করতে থাকবেন]  

অতএব, এতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, যে কাউকেই ‘মুশকিল আসানকারী’ বা ‘প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম’ বলাটা অনুমতিপ্রাপ্ত ও সঠিক; অর্থাৎ, তিনি মানুষের জন্যে মধ্যস্থতাকারী বলা বৈধ। এমতাবস্থায় মহানতম সাইয়্যেদ ও সবচেয়ে সম্মানিত পয়গম্বর, মানব ও জ্বিন জাতির মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ সত্তা এবং সৃষ্টিকুলের মাঝে অবিসম্বাদিত সেরা সৃষ্টি মহানবী (দ:) সম্পর্কে কী বলা যায়?

সহীহ বুখারী শরীফে উদ্ধৃত একখানি হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ (দ:) কি এরশাদ করেননি – “যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানকে দুঃখকষ্ট/মুশকিল থেকে মুক্তি দেয়, তাকে আল্লাহ পাক পুনরুত্থান দিবসের দুর্দশা থেকে মুক্তি দেবেন?” অতএব, এতে বোঝা যায় মো’মেন (বিশ্বাসী) মুসলমান হলেন দুঃখকষ্ট ও সঙ্কট হতে মুক্তিদাতা। মহানবী (দ:) কি আরো ঘোষণা করেননি – “যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করে, (শেষ বিচার দিবসে) আমি তার মীযান তথা পাল্লার পাশে দাঁড়াবো, আর যদি তার সৎ কাজগুলো মন্দগুলোর চেয়ে ওজনে ভারী না হয়, তাহলে আমি-ই তার জন্যে শাফাআত (সুপারিশ) করবো?” অতএব, এতে বোঝা যায় একজন মো’মেন মুসলমান প্রয়োজন পূরণকারী-ও। হুযূর পাক (দ:) কি আরো ঘোষণা করেননি – “যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানকে আশ্রয় দেয়, আল্লাহতা’লা তাকে পুনরুত্থান দিবসে আশ্রয় দেবেন?” তিনি কি আরো বলেননি – “নিশ্চয় আল্লাহর সৃষ্টিকুলের মাঝে এমন অনেকে আছেন, প্রয়োজনের সময় যাঁদেরকে খোঁজা হয়?” সহীহ হাদীসে কি মহানবী (দ:) আরো বলেননি – “আল্লাহতা’লা তাঁর ওই বান্দাকে সহায়তা ততোক্ষণ করবেন, যতোক্ষণ সে তারই (দ্বীনী) ভাইয়ের সহায়তা করতে থাকবে?” আর তিনি কি একথাও বলেননি – “যে ব্যক্তি কারো প্রয়োজনের সময় সাহায্য করে, আল্লাহতা’লা তার পক্ষে ৯৩ (তিরানব্বই)-টি নেকি তথা পুণ্য/সওয়াব লেখেন।” [আবূ এয়ালা, আল-বাযযার ও আল-বায়হাক্বী] 

অতএব, মো’মেন মুসলমান দুঃখকষ্ট দূর করেন, সাহায্য করেন, সুরক্ষা দেন, প্রয়োজন পূরণ করেন এবং (অন্যান্যদের) প্রয়োজনের মুহূর্তে অন্বেষণকৃত-ও হন; যদিও বাস্তবতা হলো আল্লাহতা’লা-ই প্রকৃত সাহায্যকারী, প্রয়োজন পূরণকারী এবং রক্ষাকারী। তবে মো’মেন মুসলমান যেহেতু এসব ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী, সেহেতু এ ধরনের কাজগুলো তাঁর প্রতি আরোপ করা বৈধ ও সঠিক। 

রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর কাছ থেকে এমন অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে, যেগুলো প্রমাণ করে যে আল্লাহতা’লা তাঁর ক্ষমাপ্রার্থী বান্দা ও মসজিদ রক্ষণাবেক্ষণকারী খেদমতগারদের অসীলায় তথা মধ্যস্থতায় দুনিয়াবাসী মানুষদের শাস্তি ফিরিয়ে নেন, আর ওই প্রিয় বান্দাদের মাধ্যমেই তিনি পৃথিবীবাসীদের রিযক্ব দান করেন ও সাহায্য করেন এবং বালা-মসিবত ও পানিতে ডোবা হতেও সুরক্ষা প্রদান করেন। 

আল-তাবারানী (রহ:) নিজ ‘আল-মু’জাম আল-কবীর’ গ্রন্থে এবং আল-বায়হাক্বী (রহ:) আপন ‘আল-সুনান’ পুস্তকে হযরত মা’নী’ আল-দায়লামী (রা:) হতে বর্ণনা করেন যে মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান: “আল্লাহর ওই সব বান্দা যাঁদেরকে তিনি তাঁরই সেজদায় অবনত করান, শিশু যাদেরকে ‍তিনি (মায়ের) বুকের দুধ পান করান এবং গরু-মোষ যেগুলোকে তিনি চারণ করান, এ সকলের ওয়াস্তে বা খাতিরে যদি না হতো, তাহলে তিনি তোমাদের সবার ওপর তাঁর (প্রদত্ত) শাস্তি বিধান করতেন, আর তোমাদেরকে পুরোপুরিভাবে বিনাশ সাধন করতেন।”

আল্-বুখারী (রহ:) হযরত সা’আদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রা:) হতে বর্ণনা করেন যে হযরত রাসূলুল্লাহ (দ:) এরশাদ ফরমান: “তোমাদেরকে কি বিজয় ও রিযক্ব তোমাদেরই মাঝে দুর্বলদের অসীলায় দান করা হয় না?” আল-তিরমিযী (রহ:) হযরত আনাস (রা:) হতে বর্ণনা করেন যে হুযূর পাক (দ:) এরশাদ ফরমান: “এটা হতে পারে যে তোমাদের রিযক্ব তার মাধ্যমেই দান করা হয়।” আল-হাকীম (রহ:) এই হাদীসকে সহীহ বলেছেন। 

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা:) বর্ণনা করেন যে মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান: “নিশ্চয় আল্লাহর এমন (পুণ্যবান পুরুষ) বান্দাবৃন্দ আছেন যাঁদেরকে তিনি মানুষের প্রয়োজন মেটাতে সৃষ্টি করেছেন এবং যাঁরা সঙ্কটের মুহূর্তে মানুষের কাছে ছুটে যান। তাঁরা সেই সব বান্দা যাঁরা আল্লাহর শাস্তি হতে নিরাপদ।”

হযরত জাবের ইবনে আবদিল্লাহ (রা:) বর্ণনা করেন যে রাসূলে খোদা (দ:) এরশাদ ফরমান: “নিশ্চয় আল্লাহতা’লা কোনো মুসলমানের ধার্মিকতা ও ন্যায়পরায়ণতার অসীলায় তাঁর সন্তান, নাতি ও তাঁরই পরিবারবর্গ এবং তাঁরই প্রতিবেশিদের পরিবার-পরিজনের প্রতি ধর্মপরায়ণতা মঞ্জুর করেন; আর তিনি যতোক্ষণ তাদের মাঝে থাকেন, ততোক্ষণ তারা আল্লাহতা’লার সুরক্ষায় অবস্থান করেন।”

হযরত ইবনে উমর (রা:) বলেন: “নিশ্চয় আল্লাহতা’লা কোনো পুণ্যবান মুসলমানের মাধ্যমে তাঁরই এক শ জন প্রতিবেশিকে তকলিফ/ক্লেশ ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত হতে রক্ষা করেন।” অতঃপর হযরত ইবনে উমর (রা:) নিম্নের আয়াতটি তেলাওয়াত করেন: “আর যদি আল্লাহ মানুষের মধ্য থেকে এককে অন্যের দ্বারা প্রতিহত না করেন, তবে অবশ্যই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে” [আল-ক্বুরআন, ২:২৫১]। আল-তাবারানী (রহ:) হযরত সাওবান (রা:) হতে ওপরের বর্ণনার একটি সংস্করণ রওয়ায়াত করেন এবং তা মহানবী (দ:)-এর প্রতি আরোপ করে তাতে আরো যোগ করেন: “তোমাদের মধ্যে অবস্থান করবেন সাতজন পুণ্যবান পুরুষ যাঁদের মাধ্যমে তোমাদেরকে (যুদ্ধে) বিজয়, বৃষ্টি ও রিযক্ব দান করা হবে, যতোক্ষণ না আল্লাহর (শেষ বিচার দিবসের) বিধান আবির্ভূত হয়।”

হযরত উবাদা ইবনে সা’মিত (রা:) বর্ণনা করেন যে রাসূলে পাক (দ:) এরশাদ ফরমান: “আমার উম্মতের আবদাল-বৃন্দ (মনোনীত প্রিয় বান্দা) ত্রিশজন; তাঁদের মাধ্যমেই তোমাদেরকে রিযক্ব, বৃষ্টি ও (যুদ্ধে) বিজয় দান করা হয়।” হযরত উবাদা (রা:) বলেন, “আমি আশা করি (ইমাম) হাসান (রা:) তাঁদের একজন।”

এই চারটি হাদীস হাফেয ইবনে কাসীর কর্তৃক “যদি আল্লাহ মানুষের মধ্য থেকে এককে অন্যের দ্বারা প্রতিহত না করেন” – ক্বুরআনের ওপরোক্ত আয়াতটি ব্যাখ্যাকালে উদ্ধৃত হয়েছে এবং এগুলো প্রামাণ্য দলিল হিসেবে ব্যবহারের জন্যে যথাযথ; আর যখন এগুলো একত্রে নেয়া হয়, তখন সহীহ হাদীস হওয়ার পর্যায়ে উন্নীত হয়। 

হযরত আনাস বিন মালিক (রা:) বর্ণনা করেন যে নবী করীম (দ:) এরশাদ ফরমান: “এই দুনিয়া কখনোই চল্লিশ জন ব্যক্তি হতে বঞ্চিত হবে না, যাঁরা আল্লাহর খলীল তথা ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো হবেন। তাঁদেরই মাধ্যমে তোমাদেরকে পানি (বৃষ্টি) ও সাহায়্য প্রদান করা হবে। তাঁদের কেউ বেসালপ্রাপ্ত হলে আল্লাহতা’লা আরেকজনকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করবেন।”

সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম

পুনরুত্থান, ঐশী একত্ববাদ প্রকাশ, ঈমানদারি ও (খোদার) আরশের বহিঃপ্রকাশের দিনে সর্বশ্রেষ্ঠ মধ্যস্থতাকারীর উপকার আলোতে চলে আসবে; ‘আল-মাক্বা’ম আল-মাহমূদ’ তথা সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ স্থানের অধিকারী, যাঁর শাফাঅাত/সুপারিশ কখনোই প্রত্যাখ্যাত হয় না, আর যাঁর নিশ্চয়তা তাঁর মহান প্রভু (আল্লাহ) কর্তৃক কখনোই নাকচ হয় না, যিনি তাঁকে ওয়াদা করেছেন তাঁরই উম্মতের খাতিরে কখনোই তিনি তাঁকে নিরাশ, হীন, আতঙ্কিত অথবা বেদনার্ত করবেন না – সেই মহান সত্তাকে যখন সমস্ত সৃষ্টিকুল খুঁজে বের করে তাঁর কাছে তাঁরই শাফাআত প্রার্থনা করবে, তখন তিনি তাঁর মহান প্রভু খোদাতা’লার সামনে গিয়ে দাঁড়াবেন এবং ফিরবেন না উচ্চমর্যাদা ও সম্মান ব্যতিরেকে, যা আমাদের কাছে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রতি আল্লাহরই বাণী দ্বারা: “হে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)! আপনার শির মোবারক উত্তোলন করুন, এবং সুপারিশ করুন, আপনার সুপারিশ গৃহীত হবে; আর প্রার্থনা করুন, প্রার্থনা মঞ্জুর হবে!” আল্লাহতা’লার আশীর্বাদ ও শান্তি সেই মহান সত্তার প্রতি, আর তাঁরই পরিবারসদস্যবৃন্দ ও সাথীমণ্ডলী এবং শেষ বিচার দিবস পর্যন্ত (আগত) তাঁদেরই অনুসারীদের প্রতি বর্ষিত হতে থাকুক, আমীন। 

এক মিথ্যের বস্ত্রাবরণ

বাস্তবতার অনেক মিথ্যে দাবিদার রয়েছে, আবার অনেকেই আছে ছেলেমানুষিতে ভরা, যদিও বাস্তবতা তাদের থেকে একদম মুক্ত। কবি বলেন: 

“লায়লা’র প্রতি প্রেমের দাবি সবাই করে ব্যক্ত,

তবে লায়লা’র সমর্থন দ্বারা তা নয়কো পাকাপোক্ত।”

অধিকন্তু, তারা ইসলামের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করে এবং এর প্রতি কলঙ্ক-ও লেপন করে। তাদের সম্পর্কে একটি হাদীস শরীফ যথাযথ বর্ণনা দেয়। রাসূলুল্লাহ (দ:) ওই হাদীসটিতে এরশাদ ফরমান: “কাউকে যে জিনিস দান করা হয়নি তা নিয়ে যদি সে ব্যক্তি তৃপ্তি বোধ করে, তবে সে ওই লোকের মতোই হবে, যে মিথ্যের বস্ত্র পরিধান করে।” 

আমরা মুসলমান সমাজ এধরনের অনেক লোকের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছি। তারা উম্মতের পবিত্রতাকে অপবিত্র করেছে, দলবিভক্ত হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, আর ভাইয়ে ভাইয়ে এবং পিতা-মাতা ও সন্তানের মাঝে শত্রুতা-ও সৃষ্টি করেছে। 

এসব লোক ইসলামী আক্বীদা-বিশ্বাসের জগতে সংস্কার সাধনের জন্যে ‘উক্বূক্ব’ তথা অসম্মান বা বেয়াদবির দরজা দিয়ে প্রবেশ করে থাকে; আর সালাফ (আস্ সালেহীন)-বৃন্দের রওয়ায়াত/বর্ণনাগুলোকে আঁকড়ে ধরে থাকার চেষ্টার কথা বলে তারা (সব কিছু) অস্বীকার করার পথ মাড়ায়। তারা জ্ঞান-প্রজ্ঞা, সৎ পরামর্শ, নরম অন্তর ও করুণার পরিবর্তে অভব্যতা, রূঢ়তা, অসভ্য আচার-আচরণ এবং রুচিহীনতার চর্চা করে। এসব ভণ্ড দাবিদারদের মধ্যে কেউ কেউ আছে যারা নিজেদেরকে সূফীবাদী বলে পরিচয় দেয়, অথচ তারাই এর (মরমী দর্শনের) অন্তঃসার ও বাস্তবতা হতে সবচেয়ে দূরে অবস্থানকারী।

তারা সূফীবাদের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছে এবং এর মান-সম্মানকে খাটো করেছে, আর এর গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের ধারাকেও করেছে প্রশ্নবিদ্ধ; অতঃপর তারা এর প্রতি এবং তাসাউফ-তরীকতের মহান ইমামবৃন্দের প্রতিও কঠোর সমালোচনার পথ সুগম করে দিয়েছে। 

আমরা সূফীবাদকে কুসংস্কার, মিথ্যে, প্রতারণা ও হাতের ভোজবাজিপূর্ণ কৌশল হিসেবে জানি না। এটাকে দার্শনিক তত্ত্ব, বিদেশি ধ্যান-ধারণা ও মুশরেকি বিশ্বাস, কিম্বা অন্তর্যামী বা খোদার সাথে মিলে যাওয়া বলেও জানি না। আমরা আল্লাহর সামনে নিজেদেরকে এসব থেকে মুক্ত ঘোষণা করছি, আর কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা ব্যতিরেকে ক্বুরআন-সুন্নাহের বিরোধী সব কিছুকেই মিথ্যে ও বিদেশি ধ্যান-ধারণা মনে করছি, আর পাপী-তাপীদের অনুশীলিত প্রথা হিসেবেও মনে করছি। 

আমরা বিশ্বাস করি, সূফীবাদ হচ্ছে (ইসলামী) জ্ঞানের পাঠশালাসমূহের একটি সংকলন – যার সবগুলোই আপন আপন ভিন্ন পদ্ধতি, কর্মসূচি ও পথ-মত নিয়ে ইসলামী চিন্তা-চেতনার সর্বোচ্চ শিখরের ও সবচেয়ে সুন্দর আচার-আচরণের প্রতিনিধিত্ব করছে। এটা প্রতিফলন করছে আক্বীদা-বিশ্বাসে পূর্ণতা এবং জীবনের সব ক্ষেত্রে পূর্ণতা-ও। এটা প্রতিটি খোদায়ী আহ্বানের নিখুঁত সারমর্মেরও প্রতিনিধিত্ব করছে।

অভ্রান্ত ও ন্যায়পরায়ণ চরিত্রের প্রতিনিধিত্ব করে যেসব বৈশিষ্ট্য, সেগুলো হচ্ছে সত্যবাদিতা, আস্থা পূরণ, আনুগত্য, নিজের চেয়ে অন্যদের অগ্রাধিকার দান, উদারতা, দুর্বলকে সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান, বিপদগ্রস্তদের তা হতে উদ্ধার, পুণ্য ও ধার্মিকতায় একে অপরকে সহায়তা দান, সত্য ও ধৈর্যধারণে পরস্পর পরস্পরকে উৎসাহ দান, এবং উত্তম কাজ করার জন্যে ছুটে যাওয়া। 

এই সুরভিত ইতিহাস ও খাঁটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়েই (ইসলামের) প্রথম প্রজন্ম, এর ইমামমণ্ডলী ও সকল বীর/আদর্শপুরুষ পূর্ণবিকশিত হয়েছিলেন। আর এ দ্বারাই ইসলামী ব্যক্তিত্বের স্পষ্ট প্রকাশ ঘটেছিলো নিজস্ব সর্বোচ্চ মর্যাদা, আচরণগত পূর্ণতা ও সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণের মহিমাসহ। ইসলামী সভ্যতার শৌর্য-বীর্য, গৌরব, নেতৃত্ব, সম্মান, সংগ্রাম, প্রতিরোধ ও শিক্ষা আমাদের কাছে বর্ণনা করেছে ইতিহাসশাস্ত্র। 

অতএব, এই বিষয় হতে আমরা নিশ্চিতভাবে উপলব্ধি করতে পারি যে বৃহত্তর প্রতিরোধ শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক বাণী/বার্তা ও বিশ্বাসের অনুপ্রেরণার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠেছে। এটা অন্য কোনো কিছুর ওপর ভিত্তিশীল নয়, স্রেফ উন্নত নৈতিক চরিত্র ছাড়া, যার উৎসমূল হচ্ছে পূতঃপবিত্র বিশ্বাস। নৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক ও আত্মিক বৈশিষ্ট্যগুলো মানুষের মূলধন এবং সর্ববৃহৎ রত্নভাণ্ডার যা জাতিসমূহকে গঠন করে আর মানবজাতিকে আপন সর্বোত্তম সম্ভাবনার দিশেও দিয়ে থাকে। কেউ ধার্মিক ‘সালাফ’-বৃন্দের (অর্থাৎ, ইসলামী প্রাথমিক যুগের তিন প্রজন্মের) এবং তাঁদের মধ্যে মহৎ সূফী/দরবেশমণ্ডলীর জীবনীর দিকে নজর দিলেই দেখতে পাবেন কীভাবে এসব উদাহরণ ও ভিত্তিস্তম্ভ ইসলামী ইতিহাসে প্রত্যক্ষকৃত ও সর্বজনবিদিত প্রতিরোধের স্পষ্ট কর্মগুলোর প্রত্যক্ষ কারণ ও প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিলো। তাঁদের ছিলো না কোনো প্রভাব ও ক্ষমতা কেবল ঈমানদারি বা বিশ্বাস ব্যতিরেকে – যেটা ঈমানদারির সেরা নমুনা-ই বটে; বস্তুতঃ সেটা এমনই এক আক্বীদা-বিশ্বাস যা স্বাধীন ও জীবন্ত এবং যার দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিলো (খোদাকে পাবার) আকাঙ্ক্ষা ও (তাঁরই) ভালোবাসার প্রতি। অন্তরের বিশ্বাস-ই সেই উজ্জ্বল স্ফুলিঙ্গ ছড়ায় যা আল্লাহতা’লার অন্বেষণ করে, আর এ-ও প্রতীয়মান করে তাঁদের মধ্য থেকে কোনো সিদ্ধপুরুষ সব কিছুর মাঝে আল্লাহকে প্রত্যক্ষ করে, তাঁর (জামাল/সৌন্দর্য) দর্শন করে এবং প্রতিটি পদক্ষেপে, এমন কি তাঁর প্রতিটি নিঃশ্বাসেও তৎপর থেকে কীভাবে ‘এহসান’ মক্বামে তথা আধ্যাত্মিক পূর্ণতায় প্রতিনিয়ত বাস করতে পারেন – আর এসবই কোনো ঐশী অন্তর্যামী, সৃষ্টির সাথে (ঐশী সত্তার) তালগোল পাকানো, অথবা নাস্তিকতা ব্যতিরেকে হয়ে থাকে। জীবন সম্পর্কে সর্বদা সচেতনতা ধর্মবিশ্বাস-ই গড়ে তোলে, আর বিশ্বজগতের খোদায়ী ব্যবস্থাপনা সম্পর্কেও গভীর সচেতনতা এটা সৃষ্টি করে; এই সচেতনতা আত্মার মাঝে বসতি করে এবং এটা অন্তরের কূজন, চোখের ধোকা ও বক্ষের অভ্যন্তরে লুকোনো বিষয় সম্পর্কেও জানে।

উত্তম নতুন প্রচলন ও মন্দ নতুন প্রচলনের মধ্যকার পার্থক্য   

মিথ্যে দাবিদার লোকদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে তারা, যারা নিজেদেরকে পুণ্যবান সালাফবৃন্দের (তথা ইসলামী প্রাথমিক যুগের পুণ্যাত্মামণ্ডলীর) অনুসারী বলে দাবি করে থাকে। তারা অশিষ্টতা, অন্ধ গোষ্ঠীস্বার্থ, ক্ষয়প্রাপ্ত বুদ্ধি, অসুস্থ উপলব্ধি ও সংকীর্ণ অন্তরসহ সালাফিয়্যা পথের দিকে (সবাইকে) আহ্বান করে। তারা প্রতিটি নতুন বিষয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং প্রতিটি উদ্ভাবিত উপকারী বস্তুকে প্রত্যাখ্যান করে এই দাবি নিয়ে যে সেটা দোষারোপযোগ্য নতুন প্রচলন, আর প্রতিটি নতুন প্রচলন-ই তাদের মতে গোমরাহী বা পথভ্রষ্টতা; এই কাজে তারা বেদআত তথা নতুন প্রচলনের কিসিম বা প্রকারভেদ সম্পর্কে কোনো পার্থক্য-ই করে না, যদিও ইসলামের পবিত্র বিধান আমাদের প্রতি তা করার পক্ষে বাধ্যবাধকতা আরোপ করে এবং (আমাদেরকে) নির্দেশ দেয়: এগুলোর কিছু কিছু দোষারোপযোগ্য, আবার কিছু কিছু উত্তম বেদআত। আর এটা বোঝার জন্যে প্রয়োজন প্রখর ধীশক্তি ও তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি। 

এই বিষয়টি উম্মতের সালাফ আস্ সালেহীনের মধ্যে ফেক্বাহ-শাস্ত্রের তত্ত্বজ্ঞানী উলামাবৃন্দ কর্তৃক সামগ্রিকভাবে অনুসন্ধানকৃত হয়েছে – আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট হোন, আমীন। এঁদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন সর্ব-ইমাম আল-’এযয ইবনে আবদ্ আল-সালাম (রহ:), আল-নববী (রহ:), আল-সৈয়ূতী (রহ:), আল-মহল্লী (রহ:) ও ইবনে হাজর মক্কী (রহ:)। 

মহানবী (দ:)-এর আহাদীস তথা বাণীসমূহ (একত্রিত করা হলে সেগুলো) নিজেদের সম্পর্কেই ব্যাখ্যা দেয় এবং একে অপরকেও পরিপূর্ণতা দান করে। আহাদীসের সবগুলোর প্রতি একবারেই নজর দেয়া প্রত্যেকের জন্যে বাধ্যতামূলক; আর তাঁকে এটাও নিশ্চিত করতে হবে যে সেগুলো পবিত্র বিধান ও সেটার উপলব্ধির মূলনীতি, যা গবেষকদের মাঝে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত, তার আলোকেই ব্যাখ্যা করা হবে।

এই কারণেই আমরা দেখতে পাই যে অনেক পবিত্র আহাদীস ব্যাখ্যা করার জন্যে এমন সুযোগ্য/সুদক্ষ ব্যক্তির ধীশক্তি প্রয়োজন হয়, যিনি তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি, যথাযথ উপলব্ধি এবং সুরুচিসম্পন্ন অন্তরের অধিকারী, যে অন্তর পবিত্র ঐশী বিধানের মহাসাগর হতে (মর্মবাণী) গ্রহণ করতে সক্ষম এবং উম্মতের অবস্থা ও চাহিদাকেও বিবেচনায় নিতে এবং উম্মাহ’কে নেতৃত্ব দিতেও সক্ষম; অধিকন্তু, এটা করার সময় পবিত্র ঐশী বিধানের মূলনীতি ও অবহেলার ঊর্ধ্বে ক্বুরআনী ও আহাদীসের মূললিপির সীমারেখা লঙ্ঘন না করতেও সক্ষম।

এরকম একটি উদাহরণ হচ্ছে নিম্নের হাদীস শরীফ: “কুল্লু বেদআতিন দালালাতুন,” মানে সকল নতুন প্রচলন-ই পথভ্রষ্টতা। এখানে বলা আবশ্যক যে এই বেদআত হচ্ছে এমন নতুন প্রচলন, পবিত্র বিধানে যার কোনো ভিত্তি-ই নেই। এই বিশেষ বাধানিষেধ আরেকটি হাদীসে আরোপিত হয়েছে যা ঘোষণা করে: “যে ব্যক্তি মসজিদের পাশে বসবাস করে, তার জন্যে কোনো নামায নেই মসজিদের অভ্যন্তর ব্যতিরেকে।” যদিও দৃশ্যতঃ এই হাদীসটি মসজিদের পাশে বসবাসকারী ব্যক্তির নামাযের প্রতি সাধারণ বাধানিষেধ ইঙ্গিত করে, তবুও (এ বিষয়ে পুরো) হাদীসের সার্বিক দিকগুলো এটাকে সীমাবদ্ধ করে দেয়; আর তাই এর সিদ্ধান্ত হলো, এটা পূর্ণ নামায নয়।

আরেকটি নমুনা হচ্ছে নিম্নবর্ণিত হাদীসখানি: “যখন খাবার পরিবেশিত হয়, তখন কোনো নামায নেই।” উলামাবৃন্দ ব্যাখ্যায় বলেন, “এর মানে পূর্ণ নামায নয়।” এছাড়াও আরেকটি হাদীসে ঘোষিত হয়েছে: “তোমাদের মধ্যে কেউই প্রকৃত ঈমানদার হবে না, যতোক্ষণ না সে নিজের জন্যে যা পছন্দ করে তা তার (দ্বীনী) ভাইয়ের জন্যেও পছন্দ করে।” উলামাবৃন্দ ব্যাখ্যায় বলেন, “এর মানে পূর্ণ ঈমান।” অপর একটি হাদীস বিবৃত করে: “আল্লাহর নামে শপথ, ওই ব্যক্তি ঈমানদার নয়, আল্লাহর নামে শপথ, ওই ব্যক্তি ঈমানদার নয়, আল্লাহর নামে শপথ, ওই ব্যক্তি ঈমানদার নয়।” জিজ্ঞাসা করা হয়, “এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! সে কে?” তিনি উত্তর দেন, “যার কাছ থেকে তার প্রতিবেশিরা নিরাপদ বোধ করে না।” আরেকটি হাদীস এরশাদ করে: “কুৎসা রটনাকারী বেহেশতে প্রবেশ করবে না।” এছাড়া একটি হাদীসে ঘোষিত হয়, “আত্মীয়তার বন্ধন যে ব্যক্তি ছিন্ন করে, সে বেহেশতে প্রবেশ করবে না।” অপর এক হাদীসে বিবৃত হয়: “যে ব্যক্তি তার পিতামাতার প্রতি অসম্মান করে (সেও প্রবেশ করবে না)।” উলামাবৃন্দ ব্যাখ্যায় বলেন, “এই ব্যক্তি সর্বাগ্রে যারা বেহেশতী হবেন, তাদের সারিতে থাকবে না; অথবা, সে বেহেশ্তে প্রবেশ করবে না, যদি সে (এরকম কাজকে) জায়েয বলে।”

অতএব, উলামাবৃন্দ এসব (রওয়ায়াত)-কে সেগুলোর বাহ্যিক অর্থে গ্রহণ করেননি; বরঞ্চ তাঁরা এক ধরনের ব্যাখ্যা-পদ্ধতি প্রয়োগ করেছেন। বেদআত-সংক্রান্ত হাদীসটি এই কিসিমের; কেননা (অন্যান্য) হাদীসের সার্বিক দিকগুলো এবং আসহাব (রা:)-বৃন্দের হাল-অবস্থা ইঙ্গিত করে যে এটা প্রকৃতপক্ষে দূষণীয় নতুন প্রচলনকে উদ্দেশ্য করে, যে বেদআত সামগ্রিকভাবে (বৈধতার) বিধানিক ভিত্তির আওতায় পড়ে না। এছাড়াও রয়েছে আরেকটি হাদীস যা ঘোষণা করে: “যে ব্যক্তি উত্তম কোনো সুন্নাহ’র প্রচলন করেন, তিনি এর পুরস্কার পান; আর যারা শেষ বিচার দিবস অবধি এর অনুশীলন করবেন, তাদের সওয়াব-ও তিনি অর্জন করবেন।” উপরন্তু, একটি হাদীস বিবৃত করে: “আমার সুন্নাহ’কে আঁকড়ে ধরো এবং আমার সঠিক পথপ্রাপ্ত খলীফাদের সুন্নাহ’কেও।” হযরত উমর ফারূক্ব (রা:) জামাআতে তারাবীহ’র নামায সম্পর্কে বলতেন, “এটা কতোই না উত্তম বেদআত/নতুন প্রচলন!” আর আল্লাহতা’লারই অধিকারে সর্বপ্রকারের সাফল্য।                 

ঐশী বিধানভিত্তিক নতুন প্রচলন ও ভাষাগত নতুন প্রচলনের মধ্যকার পার্থক্য নির্ণয়ের প্রয়োজনীয়তা

কিছু লোক বেদআতে হাসানাহ তথা উত্তম নতুন প্রচলন ও বেদআতে সাইয়্যেয়াহ তথা মন্দ নতুন প্রচলনের মধ্যকার পার্থক্য নির্ণয় করার প্রতি এবং যাঁরা বেদআতে হাসানা’র পক্ষাবলম্বন করেন তাঁদেরও প্রতি কড়া সমালোচনা করে থাকে। বরঞ্চ তাদের কেউ কেউ এই (বেদআতে হাসানাহ) পক্ষীয় মতের সমর্থকদের প্রতি বাতেলপন্থা অবলম্বন ও গোমরাহ-পথভ্রষ্টতার অভিযোগ উত্থাপন করে। কেননা তাদের মতে এটা মহানবী (দ:)-এর সুস্পষ্ট বাণীর লঙ্ঘন, যা’তে তিনি এরশাদ করেছিলেন: “প্রত্যেক নতুন প্রচলন-ই পথভ্রষ্টতা।” তাই (তাদের দৃষ্টিতে) এই বাণী এর সার্বিকতার ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট এবং সব নতুন প্রচলন-ই যে বিভ্রান্তি, তা প্রকাশের বেলায়ও এটা সুস্পষ্ট। এই সূচনা-বক্তব্য হতেই আপনারা ওই ধরনের লোকদের বলতে শুনবেন: “অতএব, শরঈ বিধানদাতা (শারেউন) ও ঐশীবাণী বাহকের হাদীস শ্রবণ দ্বারা যেখানে সঠিক বলে প্রমাণিত হচ্ছে যে প্রতিটি নতুন প্রচলন-ই গোমরাহী, সেখানে কোনো মুজতাহিদ ইমামের পদমর্যাদা যতো বড়ই হোক না কেন, তাঁর পক্ষে কি এই কথা বলা সাজে, ‘না, প্রতিটি নতুন প্রচলন গোমরাহী নয়; বরঞ্চ এগুলোর কিছু কিছু দালালাত/পথভ্রষ্টতা, কিছু কিছু মোস্তাহাব/প্রশংসনীয়, আর কিছু কিছু দোষারোপযোগ্য’?”

এই প্রারম্ভিক যুক্তি-ই অনেক লোককে ধোকা দেয়; অতঃপর তারাও চিৎকারকারীদের দলে ভিড়ে যায় এবং কট্টর সমালোচকদের পর্যায়ভুক্ত হয়; আর তারা সেই বিভ্রান্তদের দলকেই ভারী করে, যারা পবিত্র বিধানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বুঝতে কিংবা ইসলাম ধর্মের মর্ম উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ ধরনের ব্যক্তি বাস্তব জীবনের পরিস্থিতিতে যে সমস্যাবলীর মুখোমুখি হয়, তা হতে নিস্তারপ্রাপ্তি ও সমাধান লাভের উপায় অগত্যা খুঁজে বের করার সময় তার হাতে খুব কমই থাকে। তাই সে বাধ্য হয়ে আরেকটি পন্থা অবলম্বন করে, যেটা ছাড়া তার পক্ষে সম্ভব হতো না পানাহার করা, জীবনধারণ করা, কিংবা এমন কি বস্ত্র পরিধান করা, নিঃশ্বাস নেয়া, বিয়ে-শাদী করা অথবা নিজের, পরিবারের, ভাই-বোনের বা সমাজের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করাও। তার গৃহীত এই পদ্ধতিটি হলো এ কথা বলা: “বেদআত দু ভাগে বিভক্ত – ধর্মীয় ও  ‍দুনিয়াবী তথা পার্থিব/বৈষয়িক।” সত্যি, আল্লাহতা’লা দোষত্রুটি হতে কতোই না ঊর্ধ্বে! এই অনবধান লোকটি নিজের জন্যে এই বিষয়ের নতুন একটি শ্রেণিকরণ বানিয়ে নিয়েছে; কিংবা অন্ততঃপক্ষে নতুন সংজ্ঞা প্রবর্তন করেছে।

আমরা যদি যুক্তিতর্কের খাতিরে ধরেও নেই যে এই অর্থ মহানবী (দ:)-এর জমানায় বর্তমান ছিলো, তবুও ‘পার্থিব’ ও ‘ধর্মীয়’ সংজ্ঞাগুলো তাঁর বিধান জারির সময়ে স্পষ্টভাবে চালু ছিলো না; অতএব, এই লোক এ শ্রেণিকরণ কোথায় পেলো? আর কোত্থেকেই বা এই নতুন প্রবর্তিত সংজ্ঞা উড়ে এলো? “প্রশংসনীয় বেদআত ও দূষণীয বেদআত, এই দুই বেদআতের শ্রেণিকরণ শরঈ বিধানদাতা (মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) চালু করেননি” মর্মে যে লোক দাবি করে থাকে, আমরা তাকে জবাবে বলি: “একইভাবে (আপনার দাবিকৃত) ধর্মীয়ভাবে অগ্রহণযোগ্য বেদআত, আর দুনিয়াবীভাবে গ্রহণযোগ্য বেদআতের শ্রেণিকরণ নিজেই এক মহা বেদআতের (পর্বত-) চূড়ো!” “প্রত্যেক বেদআত-ই গোমরাহী” – শারেউন (দ:)-এর এই বাণী সার্বিক; অথচ এ লোকটি বলছেন, “না, সব বেদআত-ই সামগ্রিকভাবে পথভ্রষ্টতা নয়; এতে রয়েছে দু ভাগ: পথভ্রষ্টতাপূর্ণ ধর্মীয় বেদআত, আর নির্দোষ পার্থিব/বৈষয়িক বেদআত।”

এই কারণে আমাদেরকে এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় খোলাসা করতে হবে, যাতে এর দরুন বিভ্রান্তি কিছুটা হলেও দূর হবার আশা করা যায়, ইনশা’আল্লাহ। এখানে বক্তা হলেন বিজ্ঞ বিধানকর্তা, আর তাই তাঁর কথা-ই আইন। এমতাবস্থায় এটা অত্যাবশ্যক যে তাঁর বাণী তাঁরই নিয়ে আসা আইনি মানদণ্ড অনুযায়ী বুঝতে হবে। সুতরাং আপনারা যদি জানেন যে (নতুন) উদ্ভাবন বা প্রবর্তন হলো এমন সব কিছু যা পূর্ব-নজির ছাড়াই আবিষ্কৃত ও উদ্ভাবিত, তাহলে এটা আপনাদের থেকে গোপন থাকবে না যে দূষণীয় বা দোষারোপযোগ্য (নতুন) প্রবর্তন বা সংযোজন হলো ধর্মের মধ্যে সেসব সংযোজন যেগুলো ধর্মের অংশে পরিণত হওয়ার জন্যে করা হয়, কিংবা অনুসরণীয় পবিত্র (ঐশী) বিধানের অংশে রূপান্তরের এবং বিধানকর্তার প্রতি আরোপের জন্যে করা হয়। এটাই আমাদের আকা ও মওলা রাসূলুল্লাহ (দ:) আমাদেরকে সতর্ক করার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন: “যে ব্যক্তি আমাদের এই (ধর্ম) বিষয়ে এমন (নতুন) কোনো কিছু প্রচলন করে যা এতে নেই, তবে তা প্রত্যাখ্যাত হবে।” এখানে বিষয়টির পার্থক্যকারী দিকটি হলো তাঁরই বাণী, “…আমাদের এই (ধর্ম) বিষয়ে…।” এর ওপর ভিত্তি করে আমাদের কৃত বেদআত তথা নতুন প্রবর্তিত বিষয়াদির দুটি শ্রেণিকরণ – প্রশংসনীয় বেদআত ও দূষণীয় (মন্দ) বেদআত – আমাদেরই উপলব্ধি অনুসারে ভাষাতত্ত্বগত উদ্ভাবনের চেয়ে বেশি কিছু নয়, যা স্রেফ কোনো কিছু উদ্ভাবন করে তার প্রচলন করে থাকে। পবিত্র ঐশী বিধানে বর্ণিত বেদআত যে দোষারোপযোগ্য, প্রত্যাখ্যাত ও ঘৃণিত পথভ্রষ্টতা ও দুর্দশা ছাড়া অন্য কিছু নয়, সে ব্যাপারে আমরা কেউই সন্দেহ পোষণ করি না। যারা অন্যদের সমালোচনা করেন তারা যদি এই অর্থ বুঝতে সক্ষম হতেন, তাহলে তাদের সামনে এটা পরিষ্কার হয়ে যেতো যে বাস্তবে মতৈক্যের স্থানটি অতি কাছে আর মতানৈক্যের জায়গাটি অতি দূরে অবস্থিত।

সবার সামনে বিষয়টি আরো স্পষ্টভাবে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে আমি বলতে চাই, আমার দৃষ্টিতে যারা এই বিভক্তির সমালোচনা করেন তারা কেবল পবিত্র বিধানে ব্যাখ্যাকৃত বেদআতের বিভক্তিরই সমালোচনা করেন; এর প্রমাণ হলো এই যে তারা বেদআতকে ধর্মীয় ও দুনিয়াবী তথা পার্থিব নব প্রচলন হিসেবে বিভক্ত করেন এবং এটাকে একটা প্রয়োজন হিসেবে বিবেচনা করেন। আর যাঁরা এই মত পোষণ করেন যে বেদআত তথা নতুন প্রচলন প্রশংসনীয় ও দূষণীয় দুটি ভাগে বিভক্ত, তাঁরা এটাকে স্রেফ ভাষাতত্ত্বগত বেদআত হিসেবেই দেখে থাকেন; কেননা তাঁরা বলেন, “ধর্ম ও পবিত্র ঐশী বিধানে সংযোজন ও এর দ্বারা ধর্মের বৃদ্ধি সাধন (নিশ্চয়) গোমরাহী এবং মহা এক পাপ।” এ বিষয়ে তাঁদের মনে কোনো সন্দেহ-ই নেই। তাই মতপার্থক্যটি শব্দার্থগত।

অতঃপর আমি বলবো, আমাদের মুসলমান ভাইদের মধ্যে যারা প্রশংসনীয় ও দূষণীয় বেদআতের বিভক্তিকে অস্বীকার করেন, বরঞ্চ এ কথা বলেন যে এটা ধর্মীয় ও পার্থিব বিভক্তি, তারা নিজেদের অভিব্যক্তিতে সঠিক হওয়ার বেলায় মোটেও সৌভাগ্যবান নন। এটা এ কারণে যে একবার যখন তারা ধর্মীয় উদ্ভাবনকে পথভ্রষ্টতা বলে রায় দেন, যা অবশ্য সত্য, আবার এর পরপরই পার্থিব উদ্ভাবনকে নিরপেক্ষ বলে রায় দেন, তৎক্ষণাৎ তাদের নিজেদের রায় ভ্রান্ত সাব্যস্ত হয়। কেননা এ রায় দ্বারা প্রতিটি পার্থিব নতুন প্রচলনকেই তারা জায়েয বা অনুমতিপ্রাপ্ত বিবেচনা করেন। এটা খুবই বিপজ্জনক একটি বিষয় যা দুর্দশা ও সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। অতএব, এই বিষয়ে কিছু বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যুক্ত থাকা অতি জরুরি ও বাধ্যতামূলক। বরঞ্চ তাদের বলা উচিত, “পার্থিব উদ্ভাবনের মধ্যে এমন কিছু বিষয় আছে যেগুলো উত্তম, আর কিছু আছে মন্দ।” বর্তমানে এটা সবাই প্রত্যক্ষ করেন এবং অন্ধ মূর্খ লোক ছাড়া একে কেউই অস্বীকার করেন না। এই সংযোজনটুকু অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে। 

এই অর্থের যথাযথ ও সঠিক প্রতিফলন হলো সেই ব্যক্তির কথাতে, যিনি বলেন: “বেদআত তথা নতুন প্রচলন দু ভাগে বিভক্ত – প্রশংসনীয় ও দোষারোপযোগ্য।” এটা জ্ঞাত যে এ কথাটি ভাষাতত্ত্বগত উদ্ভাবনকেই উদ্দেশ্য করে, যার অস্বীকারকারীরা এটাকে পার্থিব উদ্ভাবন বলে চিহ্নিত করেন। ওপরে উদ্ধৃত এই বক্তব্যটি সঠিক ও নীতিপরায়ণ হওয়ার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত পর্যায়ের এবং এটা প্রতিটি নতুন বিষয়কে যথাযথ নীতিমালা অনুসারে ও পবিত্র বিধানের আওতায় এবং ধর্মের মর্মবাণীর নিরিখে শ্রেণিকরণের পক্ষে দাবি পেশ করে। এটা মুসলমানদেরকে বাধ্য করে নিজেদের সামাজিক ও ব্যক্তিগত উভয় জীবনে মুখোমুখি হওয়া প্রতিটি নতুন ও উদ্ভাবিত বিষয়কে ইসলামের পবিত্র বিধানের সামনে উপস্থাপন করতে, যাতে নতুন প্রবর্তনটি যা-ই হোক না কেন, সেটা সম্পর্কে দ্বীন ইসলাম কী রায় দেয় তা তাঁরা দেখতে পান। (প্রশংসনীয় ও দূষণীয় বেদআতের) এই উত্তম বিভক্তি, যাকে ‘উসূল আল-ফিক্বাহ’ তথা ইসলামের বিধানিক মৌলনীতিশাস্ত্রের উলামাবৃন্দ যথাযথভাবে বিবেচনা করেছেন, তা ব্যতিরেকে এটা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। অতএব, আল্লাহতা’লা যেনো উসূলের ইমামমণ্ডলীর প্রতি রাজি হন এবং তাঁদের সঠিক অভিব্যক্তির বিবরণগুলোর প্রতিও খুশি হন, যেগুলো ঘাটতি, রদ-বদল বা ভুল ব্যাখ্যা ছাড়াই সঠিক অর্থের দিকে পরিচালনা করে। 

ঐশী বিধানানুযায়ী অনুশীলনের প্রতি সূফীবাদী ইমামবৃন্দের আহ্বান          

সূফীবাদের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে এবং অন্যায্যভাবে একে দোষারোপও করা হয়েছে। এর প্রতি ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিদের সংখ্যা কতো যে কম! বরঞ্চ কিছু লোকের ধৃষ্টতা ও রূঢ়তা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তারা এর প্রতি মানহানিকর ও নিন্দনীয় শব্দ ব্যবহার করছে যা দ্বারা কারো সাক্ষ্য বাতিল হয়ে যেতে পারে এবং তাঁর ন্যায়পরায়ণতাকেও হেয় প্রতিপন্ন করা হতে পারে। এ ধরনের লোকেরা বলে: “অমুক নির্ভরযোগ্য নন এবং তাঁর বর্ণনাগুলোও গৃহীত নয়।” কেন? কারণ তিনি একজন সূফী। 

তবে যে বিষয়টি আজব তথা তাজ্জবের ব্যাপার তা হলো, আমরা কিছু লোককে দেখতে পাচ্ছি যারা সূফীবাদের সমালোচনা করছে, এর অনুসারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে এবং বৈরীভাবাপন্নও হচ্ছে; তারা নিজেদের মনগড়া কথা বলছে এবং কাজও করছে; অথচ তারাই আবার জুমুআ’র খুতবা পাঠ করতে মিম্বরে উঠে বা শিক্ষকতার কুর্সিতে বসে নিজেদের ভাষণে বা আলোচনায় নির্লজ্জভাবে সূফী ইমামবৃন্দেরই বাণী উদ্ধৃত করছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ চরম ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করে বলছে: “আল-ফুদায়ল ইবনে আয়াজ বলেন…জুনায়দ আল-বাগদাদী বিবৃত করেন….হাসান আল-বসরী ব্যক্ত করেন….সাহল আল-তুসতরী মন্তব্য করেন….আল-মুহা’সেবী বলেন….এবং বিশর আল-হাফী ফরমান…।” এঁরা হলেন সূফী ইমামমণ্ডলী, যাঁরা সূফীবাদের খুঁটি, ভিত্তিস্তম্ভ ও (ইমারতের) কাঠামো। সূফীবাদের (অর্থাৎ তাসাউফের) বইপত্র তাঁদের বাণী, আধ্যাত্মিক হালত-অবস্থা ও বৈশিষ্ট্যাবলী দ্বারা পরিপূর্ণ। এমতাবস্থায় বিরোধিতাকারীরা কি নিরেট মূর্খ না গণ্ডমূর্খের ভান করছে তা আমার বোধগম্য নয়। এটা কি অন্ধত্ব, না অন্ধত্বের ছল?

আমার ইচ্ছা দ্বীন-ইসলামের ইমামবৃন্দের বক্তব্য তুলে ধরা, যাঁরা সূফী মতাদর্শের এবং সূফীবাদীদের মূল ভিত্তি। পবিত্র ইসলামী বিধান সম্পর্কে তাঁদের বাণী উদ্ধৃত করার ক্ষেত্রে আমার আকাঙ্ক্ষার উদ্রেক হয়েছে এই কারণে যে, কারো সম্পর্কে জানতে হলে তাঁর বক্তব্য আমাদেরকে শুনতে হবে; কেননা তিনি-ই নিজের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি, আর তাঁর অন্তস্তলে তিনি কী জিনিসের মালিক, তা প্রকাশে তিনি-ই অধিকতর বিশ্বাসভাজন। ইমাম জুনায়দ আল-বাগদাদী (রহ:) বলেন: “সৃষ্টিকুলের জন্যে এই পথ (তরীক্বত) অবরুদ্ধ, ব্যতিক্রম শুধু সেই পুণ্যাত্মা যিনি সতর্কতার সাথে (বা সযত্নে) মহানবী (দ:)-এর বর্ণনাগুলো ও তাঁর সুন্নাহকে অনুসরণ করেন তথা মেনে চলেন এবং তাঁরই পথ ও মতকে আঁকড়ে ধরেন। এটা এ কারণে যে ভালাইয়ের যাবতীয় পথ রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর জন্যে উন্মুক্ত এবং তাঁদের জন্যেও উন্মুক্ত, যাঁরা তাঁকে এবং তাঁর বিবরণগুলোকে অনুসরণ করেন।”

বর্ণিত আছে যে হযরত আবূ এয়াযীদ আল-বিসতা’মী (বায়েযীদ বোস্তামী রাহমতুল্লাহে আলাইহে) একদিন তাঁর মুরীদানকে বলেন: “চলো, এমন কারো কাছে যাই যিনি নিজের দরবেশির জন্যে প্রসিদ্ধ।” বর্ণনাকারী বলেন, “আমরা বেরিয়ে পড়লে জনৈক ব্যক্তিকে দেখতে পাই, যে মসজিদে প্রবেশ করছিলো। সে (অকস্মাৎ) ক্বিবলার দিকে থুতু নিক্ষেপ করে। এতে আবূ এয়াযীদ বিসতা’মী (রহ:) তাকে সালাম না জানিয়ে ওই স্থান ত্যাগ করেন। অতঃপর তিনি বলেন: ‘এই লোক রাসূলে খোদা (রহ:)-এর আদব-কায়দাসমূহের মধ্য হতে (স্রেফ) একটির ব্যাপারেই নিষ্ঠাবান নয়; এমতাবস্থায় সে কীভাবে সূফী-দরবেশমণ্ডলীর এবং সোয়ালেহীন তথা পুণ্যাত্মাবৃন্দের মাক্বাম (উচ্চপর্যায়) সম্পর্কে নিজের দাবির ব্যাপারে সত্যনিষ্ঠ হবে?’ “

একবার হযরত যূন্নূন মিসরী (রহ:) বলেন: “ভাষণ চারটি বিষয়কে ঘিরে আবর্তমান: যা মহান তাকে ভালোবাসা, জঘন্য বিষয়কে ঘৃণা করা, ঐশী বিধানের অনুসরণ, আর অন্তরের পরিবর্তনকে ভয় করা। আল্লাহকে মহব্বত করার নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে মাহবূব (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর আচার-আচরণ, কর্ম, আদেশ-নিষেধ ও সুন্নাহের অনুসরণ।”

হযরত সিররী আল-সাক্বাতী (রহ:) বলেন, “সূফীবাদ শব্দটির তিনটি অর্থ: এমন পুণ্যাত্মা যাঁর আধ্যাত্মিকতার জ্যোতি তাঁর নীতিপরায়ণতার জ্যোতিকে নিভিয়ে দেয় না; এমন পুণ্যাত্মা যিনি (ঐশী) জ্ঞানের সেসব (ভেদের) রহস্য সম্পর্কে আলোচনা করেন না, যেগুলো ক্বুরআন ও সুন্নাহ’র প্রকাশ্য বিধানের খেলাফ তথা পরিপন্থী; এবং এমন পুণ্যাত্মা যাঁর কারামত তথা অলৌকিক কর্ম আল্লাহতা’লার নিষেধকৃত পর্দা অনাবৃত করে না।”

হযরত আবূ নাসর বিশর বিন আল-হা’রিস আল-হা’ফী (রহ:) বলেন, “আমি রাসূলূল্লাহ (দ:)-কে স্বপ্নে দেখি যিনি আমায় বলেন, ‘ওহে বিশর, তুমি কি জানো কেন আল্লাহতা’লা তোমার সঙ্গীদের মাঝে তোমাকে সমুন্নত করেছেন?’ আমি আরয করি, ‘এয়া রাসূলে খোদা (দ:), না, (আমি জানি না)।’ তিনি বলেন, ‘এই কারণে যে তুমি আমার সুন্নাহকে অনুসরণ করছো, ধার্মিকদের প্রতি সেবা দিচ্ছো, তোমারই ভাইদেরকে সদোপদেশ দান করছো, আর আমার সাহাবা (সাথীবৃন্দ) ও আহলে বায়ত (আত্মীয়স্বজন)-এর প্রতি এশক্ব-মহব্বত (অন্তরে) রেখেছো। এটাই পুণ্যবানদের সারিতে তোমার স্থান পাওয়ার কারণ’।”

হযরত আবূ এয়াযীদ বিন তাইফূর বিন ঈসা’ আল-বিসতা’মী (রহ:) বলেন: “একবার আমি ইচ্ছা পোষণ করি এ মর্মে যে আল্লাহর কাছে আরয করবো তিনি যেনো আমায় খাদ্যগ্রহণ ও নারীসঙ্গের চাহিদা হতে মুক্তি দেন; কিন্তু এরপর আমি (নিজেকে) বলি, ‘আল্লাহর কাছে এ রকম চাওয়াটা আমার জন্যে কীভাবে অনুমতিপ্রাপ্ত (জায়েয) হতে পারে, যেখানে (খোদ) মহানবী (দ:)-ই আল্লাহর কাছে এটা চাননি।’ এই ভেবে আমি মহান প্রভুর কাছে তা প্রার্থনা করিনি। অতঃপর আল্লাহ আমাকে এমনই পর্যাপ্ত (নেআমত) দেন যে আমি কোনো নারী-সঙ্গ পাওয়ার চাহিদা হতে সে পর্যায়ে মুক্ত হই যার দরুন আমার সামনে নারী নাকি দেয়াল – এ ব্যাপারে আমি পরোয়াই করিনি।” তিনি আরো বলেন, “তোমরা যদি কাউকে আকাশে উড়ার মতো অলৌকিকভাবে প্রদত্ত ক্ষমতাসম্পন্ন দেখতেও পাও, তবুও তার দ্বারা প্রতারিত হয়ো না, যতোক্ষণ না আল্লাহতা’লার আদেশ-নিষেধ, (আল্লাহর নির্দেশিত) সীমানাগুলোর সুরক্ষা ও ঐশী বিধানের প্রতি আনুগত্যের ব্যাপারে তার আচরণ তোমরা প্রত্যক্ষ করো।”

হযরত সুলাইমা’ন বিন আব্দির-রাহমা’ন বিন ‘আতিয়্যা আল-দা’রা’নী (রহ:) বলেন: “সূফী মতবাদীদের জ্ঞানের একটি অংশ হয়তো আমার অন্তরে কখনো কখনো প্রবেশ করে থাকতে পারে; কিন্তু আমি আল-ক্বুরআন ও সুন্নাহ, এই দুই সাক্ষী ছাড়া তা গ্রহণ করি না।”

আদব নিজের মাঝে সুরক্ষিত রাখা।”

হযরত আবূল হাসান আহমদ বিন আবী আল-হাওয়া’রী (রহ:) বলেন: “কোনো ব্যক্তি প্রিয়নবী (দ:)-এর সুন্নাহকে অনুসরণ না করে কোনো কাজ করলে তা ভ্রান্ত (বলে সাব্যস্ত হবে)।”

হযরত আবূ হাফস ‘উমর বিন সালামা আল-হাদ্দা’দ (রহ:) বলেন: “কোনো ব্যক্তি প্রতিটি ক্ষণে তার সব কাজকে ক্বুরআন ও সুন্নাহর মাপকাঠিতে না মাপলে এবং তার বিবেকের ভাবনাকে দায়ী না করলে তাকে পুণ্যাত্মাদের তালিকায় গণনা করা হয় না।”

হযরত আবূল ক্বা‘সেম জুনায়দ বিন মুহাম্মদ (রহ:) বলেন: “যে ব্যক্তি ক্বুরআন মজীদ মুখস্থ (হেফয) করেনি বা হাদীস লিপিবদ্ধ করেনি, তাকে এই (ধর্মীয়) বিষয়ে অনুসরণ করা উচিত হবে না; কেননা আমাদের জ্ঞান কিতাবুল্লাহ (ঐশীগ্রন্থ) ও সুন্নাহ দ্বারা সংরক্ষিত।” তিনি আরো বলেন, “আমাদের এই (সূফী) পথটি ক্বুরআন ও সুন্নাহ’র ওপর ভিত্তিশীল, আর আমাদের এ (আধ্যাত্মিক) জ্ঞানের পথপ্রদর্শক রাসূলুল্লাহ (দ:)-এরই পবিত্র আহাদীস (বাণী)।” 

শায়খ আবূ উসমা’ন সা’ঈদ বিন ইসমা’ঈল আল-হীরী (রহ:) জীবন সায়াহ্নে পৌঁছুলে তাঁর পুত্র আবূ বকর নিজের জামা ছিঁড়ে ফেলেন; এমতাবস্থায় হযরত আবূ উসমা’ন (রহ:) চোখ মেলে বলেন, “ওহে বৎস আমার! বাহ্যিক সুন্নাহ হলো অভ্যন্তরীণ পূর্ণতারই চিহ্ন।” তিনি আরো বলেন, “আল্লাহতা’লার সঙ্গ/সান্নিধ্য পেতে হয় বিনয়/উত্তম আচরণ ও অটল/অবিচল আকাঙ্ক্ষা দ্বারা; রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর সান্নিধ্য লাভ করতে হয় তাঁরই সুন্নাহের অনুসরণ করে এবং বাহ্যিক জ্ঞানকে আঁকড়ে ধরে; মহান আল্লাহর আউলিয়া তথা বন্ধুদের সঙ্গ লাভ করতে হয় ভক্তি-শ্রদ্ধা/আদব প্রদর্শন ও সেবার মাধ্যমে; পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের সাহচর্য পেতে হয় উত্তম আচার-ব্যবহারের দ্বারা; (দ্বীনী) ভ্রাতৃবৃন্দের নৈকট্য লাভ করতে হয় অবিরত নিষ্পাপ স্মিতহাস্যের মাধ্যমে (মানে যতোক্ষণ তা পাপযুক্ত না হয়); আর অজ্ঞদের সঙ্গ পেতে হয় প্রার্থনা ও করুণা দ্বারা।”

শায়খ আল-হীরী (রহ:) আরো বলেন, “যে ব্যক্তি নিজের কথা ও কাজে সুন্নাহ’র চর্চা করেন, তিনি জ্ঞান-প্রজ্ঞাপূর্ণ বাণী উচ্চারণ করেন; আর যে ব্যক্তি কথা ও কাজে কুপ্রবৃত্তির চর্চা করে, সে বেদআতী কথাবার্তার অনুশীলনকারী। মহান প্রভু তাঁর পাক কালামে ঘোষণা করেন: “আর যদি রাসূল (দ:)-এর আনুগত্য করো, তবে সৎপথ পাবে।” [সূরা আল-নূর, ৫৪ আয়াত; তাফসীরে নূরুল এরফান]

শায়খ আবূল হাসান আহমদ বিন মুহাম্মদ আল-নূরী (রহ:) বলেন: “যে ব্যক্তি আল্লাহতা’লার সান্নিধ্যপূর্ণ আধ্যাত্মিক অবস্থাপ্রাপ্তির দাবিদার অথচ শরঈ জ্ঞানের সীমালঙ্ঘনকারী, (তোমরা) তার কাছে যাবে না।”

শায়খ আবূল ফাওয়া’রিস শা’হ বিন শুজা’য়া আল-কিরমা’নী (রহ:) বলেন: “যে ব্যক্তি হারামকৃত বস্তু হতে নিজ দৃষ্টিকে অবনমিত করেন, নফসানী খায়েশ হতে নিজেকে দমন করেন, আপন অন্তস্তলকে সর্বদা সতর্ক রাখেন এবং বহির্ভাগকে সুন্নাহ’র অনুসরণে রাখেন ব্যস্ত, আর জায়েয তথা অনুমতিপ্রাপ্ত বিষয়াদির ব্যবহারে নিজেকে অভ্যস্ত করে তোলেন, তাঁর অন্তর্দৃষ্টি কখনোই তাঁকে ব্যর্থ হতে দেবে না।”

শায়খ আবূল আব্বা’স আহমদ বিন মুহাম্মদ বিন সাহল বিন ‘আতা’আ আল-আদামী (রহ:) বলেন: “যে ব্যক্তি পবিত্র ঐশী বিধানানুগ আচারের সাথে নিজেকে দৃঢ়ভাবে খাপ খাইয়ে নেন, আল্লাহতা’লাও আপন মা’রেফতের এলম তথা আধ্যাত্মিক জ্ঞানের আলো দ্বারা তাঁর অন্তরকে আলোকিত করেন, যা দ্বারা প্রিয়নবী (দ:)-কে তাঁর আদেশ-নিষেধ, আমল-আখলাক্বে অনুসরণের মক্বাম/উচ্চমর্যাদা ওই ব্যক্তির প্রতি মঞ্জুর করা হয়।” তিনি আরো বলেন: “তোমরা যা কিছু জানতে আগ্রহী, তা জ্ঞানের রাজ্যে খোঁজ করো। সেখানে না পেলে প্রজ্ঞার মাঝে খোঁজো। এতদসত্ত্বেও না পেলে তা খোদায়ী একত্বের নিক্তিতে ওজন দাও। এই তিনটি ক্ষেত্রে খোঁজার পরও যদি তা না পাও, তাহলে এটাকে শয়তানের মুখের ওপর পাল্টা ছুঁড়ে মারো।”

শায়খ আবূ হামযা আল-বাগদা’দী আল-বাযযা’য (রহ:) বিবৃত করেন: “যে ব্যক্তি হাক্বীক্বত তথা মহান আল্লাহর রাস্তার বাস্তবতা সম্পর্কে জানেন, তাঁর জন্যে ওই পথ পার হওয়া সহজ। সর্বশক্তিমানের রাস্তায় কোনো পথপ্রদর্শক নেই, স্রেফ মহানবী (দ:)-এর আহওয়াল তথা হালত-অবস্থা, আমল ও বাণী সহকারে তাঁরই সুন্নাহ’র অনুসরণ ব্যতিরেকে।”

শায়খ আবূ এসহা’ক্ব ইবরা’হীম বিন দা’ঊদ আল-রাক্বী (রহ:) ঘোষণা করেন: “আল্লাহতা’লাকে ভালোবাসার চিহ্নগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে – তাঁর আনুগত্য বা বাধ্যতা এবং তাঁরই রাসূল (দ:)-এর অনুসরণ।” শায়খ মিমশা’দ আল-দায়নূরী (রহ:) বলেন: “মুরীদান তথা শিষ্যদের আদব ও আচার-আচরণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে তাদের মাশায়েখদের পবিত্রতার প্রতি যত্নবান হওয়া, দ্বীনী ভাইদের খেদমত/সেবা করা, অসীলার ওপর নির্ভর করা এবং পবিত্র খোদায়ী বিধানের 

শায়খ আবূ মুহাম্মদ আবদুল্লা’হ বিন মানা’যিল (রহ:) বলেন: “কেউই ফরয (বাধ্যতামূলক) আমলগুলোর মধ্য হতে কোনো ফরয ছেড়ে যায় না এই ব্যতিক্রম ছাড়া যে আল্লাহতা’লা তাকে সুন্নাহগুলো পরিত্যাগের অবস্থায় (অধঃ)-পতিত করেন। আর কেউই সুন্নাহগুলো পরিত্যাগের মতো উদাসীন হয় না এই ব্যতিক্রম ছাড়া যে অতিসত্বর তাকে বেদআতের দায়ে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।”

আশ’আরী ইমামবৃন্দ         

মুসলমানদের সন্তানেরা অনেকেই আশ’আরী মযহাব সম্পর্কে জানে না; এটা কাদের প্রতিনিধিত্ব করে এবং ধর্মীয় মতাদর্শগত বিষয়াদিতে এর দৃষ্টিভঙ্গি কী তাও তারা জানে না। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এতোটুকু পর্যাপ্ত খোদাভীরুতাও ধারণ করতে পারেনি যে তারা এই মযহাবকে গোমরাহী, দ্বীন হতে খারিজ ও আল্লাহতা’লার সিফাত তথা গুণাবলী-সংক্রান্ত ইসলামী বিশ্বাস হতে বিচ্যুতির অভিযোগে অভিযুক্ত করা হতে নিবৃত্ত নয়। আশ’আরী মযহাব সম্পর্কে এই অজ্ঞতা আহলে সুন্নাতের ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি করছে এবং মুসলমানদেরকে সুন্নীয়তের কাতার হতে বিচ্ছিন্ন করছে। মুসলমান সন্তানদের কেউ কেউ এতো দূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছে যে তারা আশ’আরী ইমামবৃন্দকে গোমরাহ/পথভ্রষ্ট সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত বিবেচনা করছে, যদিও আমি জানি না ঈমানদার সর্বসাধারণকে কীভাবে ভ্রান্ত/বাতেল আক্বীদায় বিশ্বাসী লোকদের সাথে সম্বন্ধযুক্ত করা যায়; কিংবা আহলে সুন্নাতকে কীভাবে মো’তাযেলা ও জাহমিয়্যা গোষ্ঠীগুলোর মতো চরমপন্থীদের সাথে তুলনীয় বিবেচনা করা যায়। আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন: “আমি কি মুসলমানদেরকে অপরাধীদের মতো করে দেবো? তোমাদের কী হয়েছে, কেমন মন্তব্য করছো?” [সূরা ক্বালাম, ৩৫-৩৬ আয়াত; মুফতী আহমদ এয়ার খাঁন সাহেব প্রণীত ‘তাফসীরে নূরুল এরফা’ন’]  

আশ’আরী মযহাবের ইমামমণ্ডলী হলেন মুসলমান জ্ঞান বিশারদদের মাঝে হেদায়াত তথা সঠিক পথের দিক-নির্দেশনাদাতা প্রখ্যাত আলেম-উলামা, যাঁদের জ্ঞান পৃথিবীকে তার পূর্ব হতে পশ্চিম পর্যন্ত পূর্ণতা দিয়েছে; আর যাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব, পাণ্ডিত্য ও ধার্মিকতা সম্পর্কে মানুষেরা সর্বসম্মতভাবে একমত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন আহলে সুন্নাতের প্রথম সারির বিদ্বান ও উন্নত নৈতিকতাসম্পন্ন গণ্যমান্য জন; এঁরা মো’তাযেলা গোষ্ঠীর কৃত বাড়াবাড়ির সফল মোকাবেলা করেন। ইবনে তাইমিয়া এঁদের সম্পর্কে বলেন: “উলামামণ্ডলী হলেন ধর্মীয় জ্ঞানের সাহায্যকারী, আর আশ’আরী ইমামবৃন্দ হলেন ধর্মের মৌলিক বিষয়াদির সাহায্যকারী” [আল-ফাতা’ওয়া’, ৪র্থ খণ্ড]। এই ইমামমণ্ডলী হলেন প্রথম সারির মুহাদ্দীস/হাদীসবেত্তা, ফক্বীহ/ফেক্বাহ-তাত্ত্বিক ও তাফসীরবিদদের সমষ্টি। শায়খুল ইসলাম ইমাম আহমদ ইবনে হাজর আসক্বালা’নী (রহ) যিনি হাদীসবেত্তাদের শিক্ষক ও ‘ফাতহুল বা’রী ফী শরহে সহীহ আল-বুখারী’ শীর্ষক গ্রন্থপ্রণেতা, যে বইটি ছাড়া কোনো হাদীসবেত্তা আলেম চলতে পারেন না, তিনি আশ’আরী মযহাবের অন্তর্গত ছিলেন। সুন্নী উলামাদের শায়খ ইমাম আল-নববী (রহ:), যিনি ‘শরহে সহীহ মুসলিম’ ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থপ্রণেতা, তিনিও ছিলেন আশ’আরী। তাফসীরবিদকুল শিরোমণি ইমাম কুরতুবী (রহ:) যিনি ‘আল-জা’মে লি-আহকা’মিল-ক্বুরআন’ শীর্ষক তাফসীরগ্রন্থের প্রণেতা, তিনিও আশ’আরী ছিলেন। ’আল-যাওয়া’জির ‘আন্ এক্বতেরা’ফ-ইল-কাবা’ইর’ শিরোনামের গ্রন্থপ্রণেতা শায়খুল ইসলাম ইবনে হাজর হায়তামী মক্কী (রহ:)-ও ছিলেন আশ’আরী মযহাবের অনুসারী। ফেক্বাহ ও হাদীস-শাস্ত্র বিশারদ, নির্ভরযোগ্য হুজ্জাত তথা প্রামাণ্য দলিল শায়খ যাকারিয়্যা আল-আনসা’রী-ও আশ’আরী ছিলেন। এছাড়া আশ‘আরী মযহাবের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন সর্ব-ইমাম আবূ বকর অাল-বা’ক্বিল্লানী, আল-আসক্বালা’নী, নাসাফী, আল-শিরবীনী, ‘আল-বাহর আল-মুহীত’ শীর্ষক তাফসীরগ্রন্থ প্রণেতা আবূ হাইএয়্যা’ন আল-তাওহীদী, ’আল-তাসহীল ফী উলূমিত্ তানযীল’ শিরোনামের বই ও অন্যান্য পুস্তক রচয়িতা ইবনে জুযাঈ ও অন্যান্য পুণ্যাত্মাবৃন্দ।

আমরা যদি হাদীস, তাফসীর ও ফেক্বাহ তথা শরীয়তের বিধানশাস্ত্র বিষয়ে সেরা বিদ্বান সকল আশ’আরী ইমামের নাম বর্ণনা করতে চাইতাম, তাহলে আমাদের জন্যে তা কষ্টসাধ্য হতো এবং এসব পুণ্যাত্মা যাঁদের জ্ঞান-প্রজ্ঞা জগতের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলকে পূর্ণ করেছে, স্রেফ তাঁদের নামের তালিকা পেশের জন্যেই প্রয়োজন পড়তো বড় বড় বইপত্রের। সর্বশ্রেষ্ঠ পয়গম্বর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের আনা ঐশী বিধানের খেদমতগার/সেবাদাতা এই মহাত্মাদের জ্ঞান ও গুণের মূল্যায়ন করা এবং গুণী ব্যক্তিদের কদর করা আমাদের জন্যে বাধ্যতামূলক। আমাদের পূর্বসূরী জ্ঞান বিশারদ ও পুণ্যাত্মাদের বিরুদ্ধে যদি আমরা গোমরাহী তথা পথভ্রষ্টতার অভিযোগ-ই উত্থাপন করি, তাহলে আমাদের কাছ থেকে আর কী-ই বা ভালাই আশা করা যায়?

আল্লাহতা’লা-ই বা কীভাবে উল্লেখিত উলামাবৃন্দের পাণ্ডিত্যের সুফল আমাদের প্রতি নসীব করবেন, যদি আমরাই ধারণা করি যে তাঁদের ওই জ্ঞান-প্রজ্ঞা ইসলাম হতে খারিজ? আমি আপনাদের প্রশ্ন করছি, প্রিয়নবী (দ:)-এর খাঁটি ও নির্মল সুন্নাহের প্রতি সর্ব-ইমাম ইবনে হাজর আসক্বালা’নী (রহ:) ও নববী (রহ:) যে খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন, তা কি বর্তমান যুগের সমস্ত পি,এইচ,ডি ও প্রতিভাধর আলেমদের মধ্য হতে একজন-ও যোগান দিতে পেরেছেন? এই দু জন এবং সকল আশ’আরী ইমামকে আমরা অভিযুক্ত করার দুঃসাহস দেখাই কীভাবে, যেখানে তাঁদের জ্ঞানের মুখাপেক্ষী আমরা নিজেরাই? তাঁরা যদি ভ্রান্ত-ই হতেন, তাহলে আমরা-ই বা কীভাবে তাঁদের কাছ থেকে জ্ঞান আহরণ করছি? কেননা ইমা’ম আয্ যুহরী (রহ:) বলেন: “এই জ্ঞান হচ্ছে ধর্ম; অতএব, কাদের কাছ থেকে তোমরা দ্বীন/ধর্ম শিখছো তা ভালোভাবে লক্ষ্য করো।”

আশ’আরী ইমামবৃন্দের বিরোধিতাকারী কারো পক্ষে এ কথা বলা কি যথেষ্ট নয়, “আল্লাহ তাঁদের (মানে ইমামদের) প্রতি রহম/দয়া করুন; তাঁরা ঐশী গুণাবলী রূপকভাবে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাঁদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন, যা তাঁদের জন্যে না করাটাই (হয়তো) শ্রেয়তর হতো।” বস্তুতঃ তাঁদের প্রতি গোমরাহীর অভিযোগ উত্থাপন কিংবা তাঁদেরকে সু্ন্নী হিসেবে যাঁরা গ্রহণ করেন তাঁদের প্রতি উষ্মা প্রকাশের পরিবর্তে এ রকম আচরণ-ই বিহিত হতো। সর্ব-ইমাম নববী (রহ:), আল-’আসক্বালা’নী (রহ:), আল-ক্বুরতুবী (রহ:), আল-বা’ক্বিল্লা’নী (রহ:), ফখরুদ্দীন আল-রা’যী (রহ:), আল-হায়তামী (রহ:), যাকারিয়্যা আনসা’রী (রহ:) ও অন্যান্য উলামাবৃন্দ যদি সেরা ও প্রসিদ্ধ ইসলামী পণ্ডিত কিংবা আহলে সুন্নাতের জ্ঞান বিশারদ না হতেন, তাহলে আহলে সুন্নাহ তথা সুন্নী কারা বলে সাব্যস্ত হতো?

ইসলাম ধর্মের প্রতি মানুষকে আহ্বানকারী (দাঈ) সবার প্রতি আমি অনুরোধ জানাই তাঁরা যেনো উম্মতে মুহাম্মদী (দ:)-এর সম্মানের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করেন; বিশেষ করে এই উম্মতের মহান উলামা ও মনোনীত ফক্বীহমণ্ডলীর সম্মানের ব্যাপারে। উম্মতে মুহাম্মদী (দ:) পৃথিবীর শেষ সময় পর্যন্ত ধার্মিকতার ওপর অটল থাকবেন; আর আমাদের জ্ঞানী-গুণীজনকে মূল্যায়ন করতে যদি ব্যর্থ হই, তাহলে কোনো প্রকার মঙ্গল বা ভালাই হতে আমরাই হবো বঞ্চিত ও রিক্ত।          

গবেষণায় যেসব তথ্য হারিয়ে গিয়েছে                     

কালাম তথা আক্বীদা-বিশ্বাস সংক্রান্ত শাস্ত্রের উলামাবৃন্দ কর্তৃক গবেষণা করার এমন কিছু বিষয় আছে, যেগুলো মহান আল্লাহতা’লা আমাদেরকে (চর্চা) করার আদেশ দেননি। আমার মতে, এ সম্পর্কে গবেষণা দ্বারা এগুলোর বাস্তবতার শ্রেষ্ঠত্ব ও জৌলুস অপসারিত বা তিরোহিত হয়। এগুলোর একটির উদাহরণ হলো, রাসূলুল্লাহ (দ:) কর্তৃক মহান আল্লাহকে দেখা এবং তা কীভাবে সম্ভব হয়েছিলো সে সম্পর্কে মতপার্থক্য। এ ব্যাপারে উলামাদের মধ্যকার মতবিভেদ দীর্ঘ ও ব্যাপক। কেউ কেউ বলেন নবী (দ:) আল্লাহকে অন্তরের চোখ দিয়ে দেখেছিলেন; অপর দিকে অন্যান্যরা বলেন তিনি আপন চোখ দ্বারা আল্লাহর দর্শন লাভ করেন। প্রত্যেক অালেমই নিজের প্রামাণিক দলিল পেশ করে যুক্তিকে শক্তিশালী করার প্রয়াস পান, কোনো ফায়সালা ব্যতিরেকে। আমার দৃষ্টিতে এগুলোর সবই পণ্ডশ্রম যার কোনো ফায়দা-ই নেই। বরঞ্চ ফায়দার চেয়ে এতে ক্ষতি-ই বেশি; বিশেষ করে সাধারণ মানুষ এ বিষয়ে জানতে পারলে নিঃসন্দেহে তাঁদের অন্তরে এর দরুন সন্দেহ দানা বাঁধে। আমরা যদি এসব বিষয়ে গবেষণা বাদ দিয়ে এগুলোর বাস্তবতা যেভাবে (শাস্ত্রলিপিতে) আছে সেভাবেই ছেড়ে দিতাম, তাহলে এগুলোর সম্মান বজায় থাকতো এবং মানুষের আত্মা এগুলোর মহিমা গাইতো; আর আমরাও শুধু বলতাম: প্রিয়নবী (দ:) আল্লাহকে দেখেছেন – অতঃপর এই আলোচনা এখানেই ক্ষান্ত দিতাম।

আল্লাহ পাক পয়গম্বর মূসা (আ:)-এর সাথে কথা বলেন 

এ ধরনের একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে উলামাদের মাঝে আল্লাহর ভাষণের (মানে কালামের) বাস্তবতা নিয়ে গবেষণা এবং এটাকে ঘিরে প্রধান মতপার্থক্য। কারো কারো ভাষ্য হলো আল্লাহর ভাষণ কালা’মে নাফসী তথা অভ্যন্তরীণ/অন্তঃস্থ বাণী; পক্ষান্তরে, অন্যান্যরা বলেন তাঁর ভাষণ অক্ষর ও শব্দ সহকারে (বিবৃত)। আমি বিশ্বাস করি, একে অপরের বিরোধিতাকারী এই দুটো দল-ই আল্লাহতা’লার ঐশী উৎকর্ষের বাস্তবতা অন্বেষণকারী এবং উভয়-ই সর্বপ্রকারের পৌত্তলিকতা হতে বহু দূরে অবস্থানরত। (আল্লাহর) ভাষণের এই বিষয়টি বাস্তব ও দৃঢ়ভাবে ঘোষিত, আর একে অস্বীকার করারই কোনো জো নেই; কেননা এর অস্বীকার একটি দৃষ্টিকোণ থেকে খোদায়ী পূর্ণতার সাথে সাংঘর্ষিক। আরেকটি দৃষ্টিকোণ থেকে আল্লাহর সিফাত বা গুণাবলীতে বিশ্বাস করা এবং আল-ক্বুরআনে বিধৃত এর প্রতি দৃঢ় ঘোষণা ব্যক্ত করা বাধ্যতামূলক (ফরয)। কেননা কেউই আল্লাহকে জানেন না, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া। অতএব, এক্ষেত্রে আমার দৃষ্টিভঙ্গি, যার প্রতি আমি আহ্বান জানাই তা হলো, আল্লাহর ভাষণ সম্পর্কে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা উচিত এবং এটা কীভাবে হতে পারে বা এর সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ কী, অতোসব আলোচনাও পরিহার করা উচিত। এমতাবস্থায় আমরা আল্লাহর ভাষণ সম্পর্কে দৃঢ়ভাবে ঘোষণা দেই এবং বলি যে এটা আল্লাহরই ভাষণ, আর তিনি কথা বলেন। এর বাইরে এটা অভ্যন্তরীণ না বাহ্যিক বচন, অক্ষর ও শব্দবিশিষ্ট না তা ব্যতিরেকে, সে অসত্য ব্যাপারটির দিকে আমরা ফিরেও তাকাই না। এগুলোর সবই চরম পন্থা যা তৌহীদের বাণী প্রচারক মনোনীত জন (মানে মহানবী-দ:) উচ্চারণও করেননি। তাহলে কেন আমরা তাঁর নিয়ে আসা বাণীর সাথে এই অতিরিক্ত বিষয় জুড়ে দেবো? এটা কি সবচেয়ে কুৎসিত বেদআত/নব উদ্ভাবন নয়? এয়া আল্লাহ, আপনারই সমস্ত মহিমা! এ নিশ্চয় এক প্রকাশ্য কুৎসা রটনা! বাস্তবিকপক্ষে, প্রিয়নবী (দ:) শেষ বিচার দিবসে আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন, যেদিন আল্লাহর সামনে আমরা হুযূরের (দ:) সাথে একত্রিত হবো। আমাদের আলাপ-আলোচনা যেনো সর্বদা এই বাস্তবতা ও অনুরূপ বিষয়গুলোর আলোকে হয়, আর এগুলোর সূক্ষ্মতা, ধারণা ও আকারের গভীরে আমরা যেনো ডুব না দেই, সেটার প্রতি আমরা আহ্বান জানাই।

’আমি পেছনেও তোমাদের দেখতে পাই’

উলামাবৃন্দের মাঝে এ ধরনের গবেষণার আরেকটি নমুনা হলো প্রিয়নবী (দ:)-এর একটি হাদীসের বাণীর বাস্তবতা, যা’তে তিনি এরশাদ ফরমান: “নিশ্চয় আমি পেছনেও তোমাদের দেখতে পাই, যেমনিভাবে সামনে তোমাদেরকে দেখি।” কতিপয় আলেম বলেন: “আল্লাহ পাক মহানবী (দ:)-কে তাঁর শির মোবারকের পেছনেও দুটি চোখ মঞ্জুর করেছেন।” (উলামাদের) কেউ কেউ (আবার) বলেন: “আল্লাহতা’লা রাসূলুল্লাহ (দ:)-কে সামনের দু চোখে পেছনে দেখার ক্ষমতাও মঞ্জুর করেছিলেন।” আবার কোনো কোনো আলেম বলেন: “আল্লাহতা’লা হাবীব (দ:)-এর পেছনে সব কিছুর প্রতিবিম্বকে তাঁরই চোখের সামনে এনে দেন।” এসব চরম পন্থা (এ হাদীসের) সৌন্দর্য ও চমৎকারিত্বকে অপসারণ করে এবং অন্তরগুলো হতে এর প্রতি ভক্তিশ্রদ্ধা কমিয়ে দেয়। মহানবী (দ:) কর্তৃক সামনে দেখার মতো পেছনেও দেখার (তথা দিব্যদৃষ্টির) ব্যাপারে এটা একটা প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতা, যা তিনি নিজেই সহীহ/নির্ভরযোগ্য হাদীসে বর্ণনা করেছেন। অতএব, একে অস্বীকার করার কোনো অবকাশ-ই নেই। আমরা যেটা বলতে চাই এবং যা’তে বিশ্বাস করি তা হলো, এই বর্ণনাটি যেভাবে এসেছে ঠিক সেভাবেই সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে না যেয়ে বর্ণনা করতে হবে। এই (অলৌকিক) বিষয়টি সম্ভব মর্মে বিশ্বাস পোষণ করাটা বাধ্যতামূলক। এর ফলাফল হলো, আমরা রাসূলে খোদা (দ:)-এর বিভিন্ন মো’জেযা (অলৌকিকত্ব) হতে এমন একটি মো’জেযা দেখতে পাই যা সাধারণ কার্যকারণের উপলব্ধিকে অগ্রাহ্য করে, আর তাই এটা এক ও অনন্য সত্তার (মানে খোদার) পরাক্রমের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় এবং (তাঁরই) মনোনীত রাসূল (দ:)-এর গুণগত উৎকর্ষ-ও প্রদর্শন করে। 

জিবরীল (আ:) মানুষের আকৃতি গ্রহণ করেন 

উলামা-এ-কেরামের মধ্যকার মতপার্থক্যের এ রকম আরেকটি নমুনা হলো ওহী বহনের সময় হযরত জিবরীল (আ:)-এর নেয়া মানুষের আকৃতির বিষয়টি। কতিপয় উলামা বলেন, আল্লাহ পাক ওই ফেরেশতার অবশিষ্ট অংশগুলোকে অদৃশ্য করে দেন। আবার কেউ কেউ অভিমত ব্যক্ত করেন যে ফেরেশতা তাঁর কিছু অংশকে বাকি অংশের মধ্যে গুটিয়ে নেন, যতোক্ষণ না তিনি খর্বাকৃতিতে পরিণত হন। আমার দৃষ্টিতে এসব কথা সময়ের অপচয় ছাড়া কিছু নয়; আর এ গবেষণা ফায়দাবিহীন ও স্রেফ পণ্ডশ্রম। আমরা বিশ্বাস করি, আল্লাহতা’লা এটা করতে সক্ষম, আর এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে এবং তা প্রত্যক্ষ-ও করা হয়েছে। অনেক মানুষ আসহাবে কেরাম (রা:)-কে ওইভাবে ওরকম সুরতে দেখেছেন; অধিকন্তু ফেরেশতাকে যে পদ্ধতিতে মানুষের সুরতে পরিণত করা হয়েছে, তা আমাদের মাথাব্যথা নয়। আমরা ইসলামী জ্ঞানান্বেষী আমাদের দ্বীনী ভাইদের প্রতি আরয করি তাঁরা যেনো এই বাস্তবতাকেই তুলে ধরেন এবং এর বাইরে অন্যান্য মতপার্থক্যের গভীরে ডুব না দেন। এই হাদীস যাতে সমস্ত নির্মল আত্মার কাছে প্রশংসিত ও মহৎ হিসেবে বজায় থাকে, সে জন্যে এ কাজটা অবশ্যই করতে হবে।

তাওয়াসসুল  (অসীলা গ্রহণ) সম্পর্কে উপলব্ধি 

তাওয়াসুসুল হচ্ছে কোনো অসীলা/মধ্যস্থতাকারীর সহায়তায় আল্লাহর কাছে কোনো কিছু প্রার্থনা করা এই (ধরনের) কথা বলে, ‘এয়া আল্লাহ, আমি আপনার প্রিয়নবী (দ:)-এর উচ্চমর্যাদার ওয়াস্তে প্রার্থনা করি।’ তাওয়াসসুলের এ বাস্তবতা উপলব্ধির ক্ষেত্রে অনেক মানুষ ভুল করে থাকেন। এই কারণেই আমাদের দৃষ্টিতে তাওয়াসসুলের সঠিক সমঝদারি সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত আলোকপাত করবো। তবে তার আগে আমাদেরকে কিছু প্রকৃত বিষয় সম্পর্কে অবশ্যঅবশ্য ব্যাখ্যা করতে হবে:

এক: তাওয়াসসুল হচ্ছে প্রার্থনার (দুআ’র) বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে একটি এবং এটা আল্লাহর দিকে ফেরার বিভিন্ন দরজার মধ্যে একটি। এ ধরনের প্রার্থনার প্রকৃত ও মূল উদ্দেশ্য হলেন আল্লাহ পাক। যাঁর মাধ্যমে তাওয়াসসুল পালন করা হয়, তিনি শুধু একজন মধ্যস্থতাকারী এবং আল্লাহর সান্নিধ্যপ্রাপ্তির মাধ্যম/অসীলা। এর পরিপন্থী আক্বীদা-বিশ্বাস কেউ পোষণ করে থাকলে তিনি নিজেকে পৌত্তলিকতায় জড়িয়েছেন বলে সাব্যস্ত হবে। 

দুই: যে ব্যক্তি নির্দিষ্ট কারো তাওয়াসসুল পালন করেন, তিনি তাঁকে ভালোবেসেই তা পালন করেন এবং অন্তরে বিশ্বাস পোষণ করেন যে আল্লাহ তাঁকে (মানে ওই মহান সত্তাকে) ভালোবাসেন। যদি এর উল্টোটা সত্য বলে প্রতীয়মান করা হয়, তাহলে এই ব্যক্তি মানুষের মাঝে এ বিষয়টি হতে সবচেয়ে দূরে অবস্থানকারী এবং তার এর প্রতি সবচেয়ে বেশি ঘৃণা থাকবে।

তিন: তাওয়াসসুল পালনকারী যদি বিশ্বাস করেন যে আল্লাহর কাছে তাঁর জন্যে মধ্যস্থতাকারী (পুণ্যবান) সত্তা নিজে নিজেই উপকার বা ক্ষতি সাধন করতে সক্ষম, যেমনটি আল্লাহতা’লা স্বকীয়ভাবে করে থাকেন, অথবা আল্লাহর চেয়েও কম মাত্রায় তিনি তা করতে সক্ষম, তাহলে তিনি নিজেকে পৌত্তলিকতায় জড়িয়েছেন। 

চার: তাওয়াসসুল কোনো বাধ্যবাধকতা নয় কিংবা জরুরি বিষয়ও নয়; আর প্রার্থনা ক্ববূল বা গৃহীত হওয়ার বিষয়টিও এর শর্তাধীন নয়। বরঞ্চ দুআ’র ভিত্তি হলো মহান আল্লাহর প্রতি প্রার্থনা জানানো, যেমনটি তিনি এরশাদ করেছেন: “এবং হে মাহবূব! যখন আপনাকে আমার বান্দারা আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, তবে আমি তো নিকটেই আছি” [সূরা বাক্বারা, ১৮৬]  এবং “আল্লাহকে ডাকো বা আর্ রাহমা’নকে – যে নামেই ডাকো না কেন, সুন্দরতম নামগুলো (সব) আল্লাহরই অধিকারে।” [সরাসরি অনুবাদ]  

তাওয়াসসুল সম্পর্কে ঐকমত্যের বিষয়াদি 

মুসলমানদের মাঝে কেউই নেক আমল (পুণ্যদায়ক কর্ম) সহকারে আল্লাহর (নৈকট্যের) দিকে তাওয়াসসুল পালনের বৈধতার ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেন না। অতএব, যে ব্যক্তি রোযা রাখেন, নামায পড়েন, ক্বুরআন তেলাওয়াত করেন, কিংবা দান-সদকাহ করেন, তিনি তাঁর রোযা, নামায, ক্বুরআন তেলাওয়াত ও দান-সদকাহ’র তাওয়াসসুল পালন করতে পারেন। বস্তুতঃ এটা ক্ববূল হওয়ার ক্ষেত্রে বেশি উপযুক্ত, আর এটা অন্বেষণকৃত বস্তু প্রাপ্তির বেলায়ও অধিকতর মোক্ষম। কেউই এতে দ্বিমত পোষণ করেন না। এর প্রমাণ হলো, হাদীসে বর্ণিত গুহায় আটকে পড়া তিনজন ব্যক্তির ঘটনাটি। তাঁদের একজন আপন পিতামাতার প্রতি দয়ার খাতিরে আল্লাহর কাছে গুনাহ মাফ চান। দ্বিতীয়জন সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও অবৈধ যৌনাচার হতে নিজেকে নিবৃত্ত রাখার দোহাই দিয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানান। তৃতীয়জন আস্থা পূরণ করে অন্যের সম্পদ আমানতদারির সাথে দেখভাল করে তাঁকে তা ফেরত দেয়ার অসীলায় আল্লাহর কাছে প্রার্থী হন। এমতাবস্থায় তাঁদের তাওয়াসসুলের জওয়াবে আল্লাহতা’লা তাঁদের মসীবত দূর করে দেন। এ ধরনের তাওয়াসসুলের পক্ষে ইবনে তাইমিয়া দলিল-প্রমাণ পেশ করেছেন তাঁর বইপত্রে, বিশেষ করে ‘তাওয়াসসুল ও মাধ্যম-সংক্রান্ত এক মহৎ নীতি’ শীর্ষক পুস্তকে।

মতপার্থক্যের কেন্দ্রবিন্দু

তাওয়াসসুল তথা অসীলা গ্রহণের বিষয়ে মানুষেরা এর যে দিকটি নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন তা হলো, তাওয়াসসুল পালনকারীর নিজস্ব আমল ছাড়া অন্য কারো মাধ্যমে এটা পালন করা যায় কি না; যেমন বিভিন্ন জিনিস বা (পবিত্র) সত্তার

মধ্যস্থতা গ্রহণের সময় এ রকম বলা: “হে আল্লাহ! আমি আপনারই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের অসীলায় আপনার নৈকট্য অন্বেষণ করি”; অথবা, “সর্ব-হযরত আবূ বকর (রা:), বা উমর (রা:), বা উসমান (রা:), বা আলী (ক:)-এর মধ্যস্থতায় তা কামনা করি।” কিছু লোকের মতানুযায়ী এই ধরনের তাওয়াসসুল পালন শরীয়তে নিষিদ্ধ। 

তবে আমাদের দৃষ্টিতে এই মতপার্থক্য আকার-আকৃতিগত, ভাবার্থগত নয়। এটা এই কারণে যে, বাস্তবে কোনো ব্যক্তির দ্বারা পালিত তাওয়াসসুল তাঁরই আমলের ওপর ভিত্তি করে করা হয়, যার অনুমতির ব্যাপারে সর্বসম্মতি প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। যে ব্যক্তি এটাকে নিষেধ করেন তিনি যদি বিষয়টিকে সূক্ষ্মদৃষ্টিতে বিবেচনা করতেন, তাহলে তা তাঁর কাছে পরিষ্কার হয়ে যেতো; আর এতে দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে মুসলমানদের প্রতি পৌত্তলিকতা ও পথভ্রষ্টতার দোষারোপ করতে যারা পরিচালিত হয়েছেন, তারাও তা থেকে ক্ষান্ত হতেন।

আমি এক্ষণে ব্যাখ্যা করবো কীভাবে অন্য কারো তাওয়াসসুল পালনকারী ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে তাঁর নিজের প্রতি আরোপিত ও তাঁরই অর্জিত আমলের মধ্যস্থতায় তাওয়াসসুল পালন করেন। 

আমি ঘোষণা করছি: জেনে রাখুন, যে ব্যক্তি বিশেষ কারো মাধ্যমে তাওয়াসসুল পালন করেন, তিনি ওই মহান সত্তাকে ভালোবাসার কারণেই তা করে থাকেন, এবং তিনি বিশ্বাস করেন ওই পবিত্র সত্তা নেককার/পুণ্যাত্মা যিনি ক্বুরবাতে এলাহী তথা আল্লাহতা’লার সান্নিধ্যপ্রাপ্ত ও উন্নত বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত; ওই মহান বান্দার প্রতি তিনি সু-ধারণা পোষণ করেন – কিংবা এই কারণেও হতে পারে যে তিনি বিশ্বাস করেন আল্লাহ ওই নেককার বান্দাকে ভালোবাসেন, যেমনটি তিনি ঘোষণা করেছেন (পাক কালামে):

يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ

“তিনি (খোদা) তাদেরকে ভালোবাসেন, তারাও তাঁকে ভালোবাসেন” [সূরা মায়েদাহ, ৫৪ আয়াত]; অথবা, তাওয়াসসুল পালনকারী ওই পবিত্র সত্তার বেলায় এগুলোর সবই বিশ্বাস করেন।

আপনারা যদি এই বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন, তাহলে দেখতে পাবেন যে এই ভালোবাসা ও বিশ্বাস তাওয়াসসুল পালনকারী ব্যক্তির নিজের আমল হতে নিঃসৃত; কেননা এটা তাঁরই বিশ্বাস যা তাঁর অন্তরে সুদৃঢ় হয়েছে। এটা তাঁরই প্রতি আরোপিত, আর এ সম্পর্কে তাঁকেই জিজ্ঞেস ও পুরস্কৃত করা হবে। এ যেনো তিনি-ই বলছেন: “হে প্রভু, নিশ্চয় আমি আপনাকে ভালোবাসি এবং বিশ্বাস করি যে ওই মহান বান্দা আপনাকে ভালোবাসেন এবং আপনার প্রতি তিনি নিষ্ঠাবান, আর তিনি আপনার পথেই সাধনারত। আমি বিশ্বাস করি, আপনিও তাঁকে ভালোবাসেন এবং তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট (রাজি) আছেন; অতএব, আমি আপনার কাছে পৌঁছুনোর জন্যে তাঁকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করছি – তাঁর প্রতি আমারই মহব্বতের খাতিরে এবং তিনি যে নেক আমল পালন করেন তাতে আমারই বিশ্বাসের ওয়াস্তে এটা করছি আমি।” এ-ই হলো মূল বিষয়, যদিও অধিকাংশ তাওয়াসসুল পালনকারী ব্যক্তি স্পষ্টভাবে তা প্রকাশ করেন না। তাঁরা স্রেফ আল্লাহর জ্ঞানের ওপর আস্থা রাখেন এ মর্মে যে, আসমান ও জমিনে কোনো কিছুই তাঁর জানা হতে আড়াল নয়; তিনি চোখের ধোকা সম্পর্কেও জানেন এবং অন্তরের গভীরে লুকোনো ফেরেব তথা ছলচাতুরি সম্পর্কেও সম্যক অবগত।

যে ব্যক্তি বলেন: “হে আল্লাহ, আমি আপনারই প্রিয়নবী (দ:)-এর অসীলায় আপনার নৈকট্যপ্রার্থী”, আর অপর পক্ষে যে ব্যক্তি বলেন: “এয়া আল্লাহ, আপনার প্রিয়নবী (দ:)-এর প্রতি আমার মহব্বতের খাতিরে আমি আপনার সান্নিধ্যপ্রার্থী” – তাঁরা দু জন একই কথা বলছেন। এটা এ কারণে যে, প্রথম জন প্রিয়নবী (দ:)-এর প্রতি ভালোবাসা ও বিশ্বাসের ওয়াস্তে যা করেছেন স্রেফ ওই কথাই বলেছেন; আর তাঁর এই বিশ্বাস ও মহব্বত না থাকলে তিনি মহানবী (দ:)-এর তাওয়াসসুল পালন করতেন না। উম্মতের মধ্যে আউলিয়া তথা আল্লাহর বন্ধুদের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা হয়েছে। 

এই ব্যাখ্যা দ্বারা এ কথা স্পষ্ট যে বাস্তবে ওই মতপার্থক্য আকৃতিগত এবং ওতে প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায় না এই বিভক্তি সৃষ্টির, চরম শত্রুতার এবং তাওয়াসসুল পালনকারীদের প্রতি কুফর তথা অবিশ্বাসের দোষারোপের; তাঁদেরকে ইসলাম থেকে খারিজের। [আয়াতে করীমা: “মহিমা আপনারই, হে প্রভু। এ তো স্পষ্ট কুৎসা!” (সরাসরি অনুবাদ)]

মুসলমানদের পালিত তাওয়াসসুলের প্রামাণ্য দলিল

মহান আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “হে ঈমানদার সকল, আল্লাহকে ভয় করো এবং তাঁরই দিকে (তথা নৈকট্য লাভের জন্যে) মাধ্যম তালাশ করো” [সূরা মা-ইদাহ্, ৩৫ আয়াত, তাফসীরে নূরুল এরফা’ন]। এখানে (আরবী) ‘অসীলা’ (শব্দটি) হচ্ছে সমস্ত মাধ্যম, যা আল্লাহতা’লা কাউকে তাঁর নৈকট্য লাভের ও নিজের চাহিদাগুলো পূরণের জন্যে সৃষ্টি করে দিয়েছেন। যাঁর মধ্যস্থতায় তাওয়াসসুল পালিত হয়, ‘অসীলা’ শব্দটি তাঁর (উচ্চ) পদমর্যাদা ও পবিত্রতার বাস্তবতা নির্দেশক হওয়ার সাথে এ বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আয়াতে করীমায় উদ্ধৃত ‘অসীলা’ অভিব্যক্তিটি, আপনারা যেমনটি প্রত্যক্ষ করছেন, তা একটি সার্বিক শব্দ, যা’তে অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন পুণ্যবান আম্বিয়া (আ:) ও আউলিয়া (রহ:)-বৃন্দ, হোন তাঁরা প্রকাশ্য জীবনে কিংবা বেসালপ্রাপ্ত (আল্লাহর সাথে পরলোকে মিলিত); আরো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সেসব আদিষ্ট আমল তথা পুণ্যদায়ক কর্ম, যেগুলো পালনের পরে সেগুলোর মধ্যস্থতা গ্রহণ করা হয়। 

আপনারা এক্ষণে দেখবেন কিছু আহাদীস (মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহেওয়া সাল্লামের বাণী) যা এই সার্বিকতাকে স্পষ্ট করে তুলবে। অতএব, মনোযোগ সহকারে শুনুন, যাতে আপনারা উপলব্ধি করতে পারেন যে প্রিয়নবী (দ:)-এর মাধ্যমে তাওয়াসসুল তাঁর ধরাধামে শুভাগমনের আগে, তাঁর যাহেরি/প্রকাশ্য জিন্দেগীতে এবং তাঁর বেসালের পরে বরযখ জীবনে পালিত হয়েছে, আর শেষ বিচার দিবসে হাশরের ময়দানেও তা পালিত হবে।

মহানবী (দ:)-এর শুভাগমনের আগে তাঁর তাওয়াসসুল

একটি হাদীসে ঘোষিত হয়েছে যে পয়গম্বর আদম (আ:) আমাদের রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর তাওয়াসসুল পালন করেছিলেন। আল-হা’কিম নিজ ‘আল-মুসতাদরাক’ পুস্তকে হযরত ইবনে উমর (রা:)-এর সূত্রে এই হাদীসটি বর্ণনা করেন, যা’তে মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান:

روى سيدنا عبد الله بن عمر رضي الله عنهما قال: قال رسول الله صلى الله عليه وآله وسلم (لما اقترف آدم الخطيئة قال: يا رب أسألك بحق محمد إلا غفرت لي فقال الله تعالى يا آدم كيف عرفت محمدا ولم أخلقه؟ قال: يا رب إنك لما خلقتني رفعت رأسي فرأيت علي قوائم العرش مكتوبا لا إله إلا الله محمد رسول الله فعلمت أنك لم تضف إلى اسمك إلا أحب الخلق إليك فقال الله تعالى صدقت يا آدم إنه لأحب الخلق إلى وإذ سألتني بحقه فقد غفرت لك ولولا محمد ما خلقتك

“যখন আদম (আ:) গন্দুম খাওয়ার কাজটি সংঘটন করেন, তখন তিনি আরয করেন: ‘হে আমার প্রভু! আমি মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর হক্ব তথা অধিকারের দোহাই দিয়ে আপনার কাছে পানাহ্ চাই।’ আল্লাহ এমতাবস্থায় বলেন: ‘ওহে আদম (আ:)! তুমি মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে কীভাবে জানলে, যাঁকে আমি এখনো সৃষ্টি করিনি?’ পয়গম্বর আদম (আ:) উত্তর দেন: ‘হে আমার প্রভু! আপনি যখন আমায় সৃষ্টি করেন এবং আমার মাঝে রূহ ফুঁকে দেন, তখন আমি আমার মাথা তুলে দেখতে পাই আরশের (উচ্চ) সীমায় লেখা আছে – লা’ ইলা’হা ইল্লা’ল্লা’হু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লা’হ। আমি বুঝতে পারি, আপনি আপনার সবচেয়ে প্রিয় কারো নাম (মোবারক)-ই আপনার পবিত্র নামের পাশে স্থাপন করতে পারেন।’ অতঃপর আল্লাহতা’লা বলেন, ‘ওহে আদম (আ:)! আমি তোমায় ক্ষমা করলাম; মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) না হলে আমি তোমাকে সৃষ্টি করতাম না’।”

এই হাদীসটি আল-হা’কিম বর্ণনা করেন এবং তিনি এটাকে সহীহ বলেছেন [আল-মুসতাদরাক, ২:৬১৫]। এছাড়া একে সহীহ বলেছেন ইমাম হাফেয আল-সৈয়ূতী (রহ:) নিজ ‘খাসা’ইস’ পুস্তকে এবং জাল হাদীসের বর্ণনা পরিহারকারী ইমাম বায়হাক্বী (রহ:) আপন ‘দালা’য়েল আল-নুবুওয়্যা’ গ্রন্থের ভূমিকায়। এ হাদীসকে সহীহ ঘোষণা করেছেন ইমাম ক্বসতলা’নী (রহ:) তাঁর ‘আল-মাওয়া’হিবুল লাদুনিয়া’ বইয়ে এবং যুরক্বা’নী মালেকী নিজের ‘শরহে মাওয়া’হিব’ পুস্তকে। এছাড়া একে সহীহ বলেছেন ইমাম তক্বীউদ্দীন সুবকী তাঁর ‘শেফাউস সেক্বা’ম বইয়ে। হাফেয ইবনে হাজর আল-হায়তামী মক্কী (রহ:) বলেন, “এ হাদীসটি ইমাম তাবারা’নী (রহ:) আপন ‘আল-আওসাত’ পুস্তকে বর্ণনা করেন এবং এতে এমন একজন (রাবী) আছেন, যাঁকে আমি চিনি না।” [মজমা’উল যাওয়া’ঈদ’, ৮:২৫৩] 

হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) হতে আরেকটি সনদে এই অভিব্যক্তিসহ বর্ণিত হয়েছে: “যদি মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) না হতেন, তাহলে আমি (আল্লাহ) আদম (আ:) কিংবা বেহেশত বা দোযখ সৃষ্টি করতাম না।” এটা আল-হা’কিম নিজ ‘আল-মোস্তাদরাক’ পুস্তকে উদ্ধৃত করেন এবং তিনি বলেন: “এর এসনাদ তথা সনদ (একদম) সহীহ। এটাকে শায়খুল ইসলাম আল-বুলক্বীনী তাঁর ফাতা’ওয়া’য় সহীহ বলেন এবং এই বর্ণনা ইবনে জাওযী নিজ ‘আল-ওয়াফা’ গ্রন্থের প্রারম্ভে লিপিবদ্ধ করেন; আর ইবনে কাসীর-ও আপন ‘আল-বেদা’য়া’ কিতাবে উদ্ধৃত করেন। [১:১৮০]        

কিছু উলামা এই রওয়ায়াতের বিরোধিতা করেন এবং হাদীসটির ভিত্তি সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেন। এটাকে ইমাম যাহাবী ও অন্যান্যের মতো উলামাবৃন্দ প্রত্যাখ্যান করেন এবং বানোয়াট-ও বলেন। কিছু উলামা আবার যয়ীফ/দুর্বল বলে আখ্যা দেন; অন্য আরো কিছু উলামা এটাকে ‘ মুনকার’ তথা প্রত্যাখ্যাত ঘোষণা করেন। এতে আমরা দেখতে পাই যে তাঁরা এ বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তের ওপর ঐক্যবদ্ধ হননি। অতএব, এই হাদীস সম্পর্কে উলামাদের মতপার্থক্যের ভিত্তিতে গৃহীত, প্রত্যাখ্যাত, এর পক্ষে দৃঢ়োক্তি, একে নাকচ ও এর ব্যাপারে নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ-সংক্রান্ত ইত্যাদি গবেষণাকে ঘিরেই এই বিষয়টি আবর্তিত হবে। এটা বর্ণনার এসনাদ ও হাদীসের সহীহ হওয়ার দিকটির ক্ষেত্রে (প্রযোজ্য)। তবে এর অর্থের দিক থেকে জানতে আমরা ইবনে তাইমিয়ার ভাষ্য শুনবো।

পয়গম্বর আদম (আ:)-এর পালিত তাওয়াসসুল-সম্পর্কিত হাদীসের সমর্থনকারী অন্যান্য হাদীস

ইবনে তাইমিয়া এই বিষয়ে দুটি হাদীস বর্ণনা করেন এবং সেগুলোকে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহারের জন্যে নিয়মবদ্ধ করেন। তিনি বলেন: আবূল ফারাজ বিন আল-জাওযী সহীহ সনদে বর্ণনা করেন মায়সারা হতে, যিনি বলেন: “আমি জিজ্ঞেস করি, ‘এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! আপনি কখন (প্রথম) নবী হন?’ তিনি উত্তর দেন, ‘আল্লাহ যখন দুনিয়া সৃষ্টি করেন – [অতঃপর তিনি আসমানের দিকে ইস্তিওয়া (ইচ্ছা) করলেন, তখন ঠিক সাত-আসমান সৃষ্টি করলেন (সূরা বাক্বারা, ২৯)] – আর সৃষ্টি করেন আরশ। (ওই) আরশের পায়ায় তিনি লেখেন, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হলেন নবীকুলের সীলমোহর; অতঃপর আল্লাহতা’লা সৃষ্টি করেন বেহেশত, যেখানে তিনি আদম (আ:) ও হাওয়া’কে বসতি করতে দেন; আর বেহেশতের দ্বারে, গাছের পাতায়, গুম্বজে ও তাঁবুতে তিনি আমার (মহানবীর) নাম (মোবারক) লিখেন; সেটা ওই সময় যখন আদম (আ:) ছিলেন রূহ ও শরীরের মধ্যবর্তী অবস্থানে। যখন মহান আল্লাহ তাঁর মাঝে রূহ ফুঁকে দেন, তখন তিনি আরশের দিকে তাকিয়ে আমার নাম (মোবারক) দেখতে পান, যার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ পাক তাঁকে জানান: তিনি (মহানবী-দ:) তোমার বংশধরদের ইমাম। অতঃপর যখন শয়তান আদম (আ:) ও হাওয়া’কে ধোকা দেয়, তাঁরা তওবা করেন এবং আমার (মোবারক) নামের অসীলায় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন’।” 

আবূ নু‘য়াইম ‘দালা’ইল আল-নুবুওয়া’ পুস্তকে শায়খ আবূল ফারাজ (রহ:)-এর সূত্রে হযরত উমর ইবনে আল-খাত্তা’ব (রা:)-এর বাণী উদ্ধৃত করেন, যিনি বলেন: “রাসূলুল্লাহ (দ:) এরশাদ করেন, ‘পয়গম্বর আদম (আ:) গন্দুম খাওয়ার পরে আরয করেন: হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু অালাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর ওয়াস্তে। আল্লাহ বলেন: ওহে আদম (আ:)! তুমি মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু অালাইহে ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে কীভাবে জানলে, যাঁকে আমি এখনো সৃষ্টি করিনি? পয়গম্বর আদম (আ:) উত্তর দেন: হে আমার প্রভু! আপনার হাতে (মানে নিজে) যখন আপনি আমাকে সৃষ্টি করেন এবং আমার মাঝে আপনার রূহ ফুঁকে দেন, তখন আমি আমার শির (মোবারক) তুলে আরশের সীমায় ‘লা’ ইলা’হা ইল্লা’ল্লা’হা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ লেখা দেখতে পাই। আমি অনুধাবন করি যে আপনি আপনার সৃষ্টিকুলের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় কারো নাম মোবারক ছাড়া আপনার পবিত্র নামের পাশে আর কারো নাম লিখবেন না। এমতাবস্থায় আল্লাহ বলেন: ওহে আদম (আ:)! আমি তোমায় ক্ষমা করলাম। মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) যদি না হতেন, তাহলে আমি তোমায় সৃষ্টি করতাম না’।” এই হাদীসটি এর আগের হাদীসটিকে সমর্থন দেয় এবং উভয় হাদীস-ই মূল/সহীহ হাদীসটিকে ব্যাখ্যা করে। [আল-ফাতা’ওয়া’, ২:১৫০] 

আমি (শায়খ আলাউয়ী) বলি: এটা প্রমাণ করে যে ইবনে তাইমিয়ার মতানুসারে হাদীসটি দলিল হিসেবে ব্যবহারের উপযোগী এবং বিবেচনাযোগ্য-ও। মুহাদ্দীসীন উলামাদের দৃষ্টিতে যা কিছু বানোয়াট বা মিথ্যে, তা উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা যায় না; অথচ এখানে আপনারা দেখতে পাচ্ছেন যে ইবনে তাইমিয়া এটাকে একটা ব্যাখ্যা/বিশ্লেষণ হিসেবে ব্যবহার করেছেন।

এই অনন্যতার অর্থের ব্যাপারে ইবনে তাইমিয়ার সংশোধনী

ইবনে তাইমিয়া এ বিষয়ে এমন ভালো কথা বলেন ও সুন্দরভাবে আলোচনা করেন, যা বুদ্ধিমত্তা, সূক্ষ্মদৃষ্টি ও ভারসাম্যপূর্ণতা প্রতিফলন করে। যদিও তিনি মহানবী (দ:) হতে এই মর্ম জ্ঞাপনকারী একটি হাদীস শরীফের অস্তিত্ব (ইতিপূর্বে) অস্বীকার করেছিলেন (তখনকার নিজস্ব জ্ঞান অনুযায়ী), তবুও তিনি (অতঃপর) ওই অর্থের প্রতি জোর দেন এবং এটাকে বোধগম্য পন্থায় ব্যাখ্যা দেন, আর এই বক্তব্যের নির্ভুলতাকে দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেন। এর দ্বারা তিনি এ বিষয়টিকে যারা কুফর/অবিশ্বাস ও শির্ক/অংশীবাদ বলে দাবি করেছিলেন, তাদেরকে স্পষ্টভাবে খণ্ডন করেন; আর যারা খোদায়ী শ্রেষ্ঠত্ব ও তাঁর তওহীদ তথা একত্বের প্রতি আঘাত হিসেবে দাবি করে এর অর্থকে দূষণীয় ও মিথ্যে বলে অভিহিত করেছিলেন, তাদেরকেও তিনি রদ করে দেন। এটা আর কিছু নয়, স্রেফ নিরর্থক কামনা, গোঁড়ামি, উপলব্ধির অভাব ও কূপমণ্ডূকতা। আল্লাহতা’লা আমাদের অন্তর্দৃষ্টিকে আলোকিত করুন এবং যা সত্য ও সঠিক তার দিকে পরিচালিত করুন (আমীন)। একমাত্র তিনি-ই সঠিক পথের দিকে হেদায়াত দেন। ইবনে তাইমিয়া তার ‘ফাতা’ওয়া’য় লেখেন: 

(হযরত) মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হচ্ছেন বনূ আদম (মানবজাতি)-এর ইমাম, সৃষ্টিকুলশ্রেষ্ঠ এবং আল্লাহর দৃষ্টিতে সবচেয়ে মহৎ সত্তা। এ কারণে বলা হয়ে থাকে: আল্লাহতা’লা তাঁরই কারণে বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন; অথবা তিনি না হলে আরশ-কুর্সি, লওহ-ক্বলম, আসমান-জমিন, চাঁদ-সূর্য কিছুই সৃষ্টি করা হতো না। এটা কোনো হাদীসে রাসূল (দ:) নয়, তা সহীহ বা যয়ীফ-ই হোক। হাদীসশাস্ত্রে পারদর্শী কোনো আলেম মহানবী (দ:)-এর সূত্রে এটা বর্ণনা করেননি। কোনো সাহাবী (রা:)-এর সূত্রেও এটা বর্ণিত হয়নি। বস্তুতঃ এ কথা কে উচ্চারণ করেছিলেন তাও জানা যায় না [বঙ্গানুবাদকের নোট: এই বাণীটি প্রসিদ্ধ উলামাবৃন্দ বর্ণনা করেছেন। শায়খ আলাউয়ী (রহ:) সৌদি রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়াতে পুরো বিষয়টি খোলাসা করতে অপারগ ছিলেন। তাঁর জানের ওপর খতরা ছিলো। একবার সৌদি বাদশাহ ফাহাদ তাঁকে আটক করার আদেশ জারি করেন। ওই সময় বিশ্বের সেরা কয়েকজন সুন্নী আলেম সম্মিলিতভাবে বাদশাহকে চ্যালেঞ্জ করেন। তাঁরা শায়খ আলাউয়ীকে (রহ:) সমর্থন করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন কুয়েতের শায়খ রেফাঈ সাহেব (রহ:), যাঁর সাথে আলাপকালে আমি এ ব্যাপারে জানতে পেরেছিলাম। হাদীসটির পক্ষে বহু আগেকার একটি লেখার লিঙ্ক এখানে দেয়া হলো: https://www.pdf-archive.com/2018/04/23/allah-created-the-world-for-the-prophet/]। 

তবে এটাকে সঠিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব; যেমনিভাবে বলা হয়েছে আল্লাহর কালামে পাকে: “আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে, সবই তোমাদের জন্যে (সৃষ্টি) করা হয়েছে” [সরাসরি অনুবাদ]; এবং “তিনি জাহাজগুলোকে তোমাদের জন্যে (সৃষ্টি) করেছেন যাতে সেগুলো তাঁরই আদেশে ভেসে বেড়াতে পারে; আর তিনি নদ-নদীকেও তোমাদের জন্যে (সৃষ্টি) করেছেন। তিনি চাঁদ ও সূর্যকে তোমাদের জন্যে (সৃষ্টি) করেছেন, যাতে সেগুলো নিজেদের কক্ষপথে অবিরত থাকতে পারে; এবং তিনি রাত ও দিনকেও তোমাদের (জন্যে) সৃষ্টি করেছেন। আর তোমরা তাঁর কাছে যা প্রার্থনা করো সবই তোমাদেরকে মঞ্জুর করেছেন; আর তোমরা যদি আল্লাহর নেআমত/আশীর্বাদ গণনা করতে চাও, গণনা করতে পারবে না” [সরাসরি অনুবাদ][বঙ্গানুবাদকের নোট: ওপরের দুটো আয়াতের অনুবাদ যথাযথ না হলে রেফারেন্স কাম্য। আমি সংশোধন করে নেবো] 

আল-ক্বুরআনে এ রকম অনেক আয়াত আছে যেগুলো স্পষ্ট ব্যাখ্যা করে যে আল্লাহতা’লা মানবজাতির খাতিরে সৃষ্টিকুলকে পয়দা করেছেন; যদিও এটা জ্ঞাত যে আল্লাহতা’লা এ কাজটি করার সময় এর পাশাপাশি মহা হেকমত তথা জ্ঞান-প্রজ্ঞা পরিকল্পনা করেছিলেন, এমন কী এর চেয়েও বড় কোনো (সুদূর প্রসারী) পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে এখানে মানবজাতির জন্যে সৃষ্টিকুলের ধারণকৃত ফায়দাগুলো তিনি তাদের কাছে ব্যাখ্যা করছেন এবং তারা কতোখানি ঐশী নেআমত/আশীর্বাদের সাগরে অবগাহন করছে, তাও তিনি তাদের কাছে খোলাসা করছেন। এমতাবস্থায় যদি বলা হয়: ‘তিনি অমুক অমুক কাজ করেছেন এই কারণে বা ওই কারণে,’ তাহলে এর দ্বারা কাজটির পেছনে অন্যান্য (খোদায়ী) হেকমত বা জ্ঞান-প্রজ্ঞা থাকার সম্ভাবনা বাদ পড়ে না। একইভাবে, ‘অমুক-অমুক না হলে এটা বা ওটা সৃষ্টি হতো না’ – মর্মে বক্তব্যটি কাজটির পেছনে আরেকটি বৃহত্তর হেকমত থাকার সম্ভাবনাকে নাকচ করে না। বরঞ্চ এতে বোঝায়, যেহেতু মানবজাতির মাঝে সবচেয়ে বেশি পুণ্যবান হচ্ছেন হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম, সেহেতু তাঁকে সৃষ্টি করাটা ছিলো সুগভীর (ঐশী) হেকমতের কাঙ্ক্ষিত পরিণতি, যা অন্য কাউকে সৃষ্টির চেয়েও বেশি (কাম্য) ছিলো; আর তাবৎ সৃষ্টিজগতের সুসম্পন্নকরণ এবং খোদ সেটার পূর্ণতার মুকুট একমাত্র হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের সৃষ্টি দ্বারাই বাস্তবায়িত হয়েছিলো।

ইবনে তাইমিয়ার মতামতের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ যা তার অনুসারীদের মস্তিষ্কে অনুপস্থিত   

আল্লাহ আপনাদের প্রতি করুণাশীল হোন (আমীন)। ইবনে তাইমিয়ার কথা ও দূরদৃষ্টি এবং সর্বজনজ্ঞাত ও সর্বত্র প্রসার লাভকৃত এই অনন্যতাকে ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে তার উপলব্ধির দিকে লক্ষ্য করুন। 

এতদসংক্রান্ত বিষয়ে পয়গম্বর আদম আলাইহিস্ সালামের তাওয়াসসুল/অসীলা গ্রহণের হাদীসটি মুহাদ্দীস আল-হা’কিম কর্তৃক বর্ণিত ও ‘হাসান সহীহ’ বলে ঘোষিত হয় এবং (ওপরে) উল্লেখিত মুহাদ্দীসীন ইমামদের দ্বারা গৃহীতও হয়। এখানে ইবনে তাইমিয়া বলেন যে এসব কথার একটা সঠিক মর্ম রয়েছে। এমতাবস্থায় যে ব্যক্তি হট্টগোল বাধিয়ে এর (মানে ইবনে তাইমিয়ার কথার) সাথে ঐকমত্য পোষণকারীদেরকে ইসলাম ধর্ম থেকে খারিজ করে দেয় এবং তাঁদেরকে গোমরাহ/পথভ্রষ্ট, পৌত্তলিক বা বেদআতী ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন বলে বর্ণনা করে, তার (বক্তব্যের) সাথে (ইবনে তাইমিয়ার) এ কথার তুলনা কীভাবে হতে পারে – যেখানে পরবর্তী পর্যায়ে সে নিজেই দাবি করে সে ইবনে তাইমিয়ার একজন সালাফী অনুসারী? বস্তুতঃ সে ইবনে তাইমিয়া ও সালাফিয়্যা হতে যোজন যোজন দূরে। তার আচার-আচরণ এই বিষয়টির ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। বরঞ্চ এটা লক্ষ্য করা গিয়েছে সে প্রতিটি বিষয়ে ইবনে তাইমিয়ার সাথে একাত্ম হলেও প্রিয়নবী (দ:)-এর সানা-সীফাত তথা প্রশংসাস্তুতি ও মো’জেযা/অলৌকিক ঘটনাবলী, মাহাত্ম্য ও উচ্চমর্যাদার মতো বিষয়গুলোতে ইবনে তাইমিয়ার খেলাফ দৃষ্টিভঙ্গি সে লালন করছে। এই বিষয়টিতে সে দ্বিধাগ্রস্ত ও ভাবনারত এবং অনুসন্ধানে ব্যস্ত, অথচ সে এখানেই তওহীদ (অর্থাৎ, আল্লাহর একত্ব) রক্ষার ভান করছে। হে প্রভু, আপনি-ই মহিমান্বিত, আর এটা তো একটা প্রকাশ্য কুৎসা রটনা বৈ কিছু নয়! 

পয়গম্বর আদম (আ:)-এর কৃত তাওয়াসসুল-বিষয়ক হাদীসের পক্ষে তৃতীয় দলিল: এতদসংক্রান্ত হাদীসের পক্ষ সমর্থনকারী তৃতীয় দলিলটি ইবনে আল-মুনযির নিজ তাফসীরগ্রন্থে বর্ণনা করেন হযরত মুহাম্মদ বিন আলী বিন হুসাইন বিন আলী (রহ:) হতে, যিনি বলেন: “পয়গম্বর আদম (আ:) গন্দুম খাওয়ার পর দুঃখভারাক্রান্ত ও অনুতপ্ত হন। জিবরীল ফেরেশতা (আ:) তাঁর কাছে এসে বলেন, ‘হে আদম (আ:), আমি কি আপনাকে আপনার তওবার দরজা পর্যন্ত পরিচালিত করবো না, যাতে তার মধ্য দিয়ে আল্লাহতা’লা আপনার প্রতি ক্ষমাশীল হয়ে ফেরেন?’ পয়গম্বর আদম (আ:) বলেন, ‘ওহে জিবরীল (আ:), অবশ্যই (চাই)।’ এমতাবস্থায় ফেরেশতা (আ:) বলেন, ‘আপনার মক্বামে দাঁড়ান, যেখানে আপনি আপনার প্রভুর কাছে প্রার্থনা ও মহিমা বর্ণনা করবেন এবং তাঁর প্রশংসাও করবেন; আল্লাহর কাছে তাঁর প্রশংসার মতো প্রিয় আর কোনো কিছুই নেই।’ পয়গম্বর আদম (আ:) জিজ্ঞেস করেন, ‘ওহে জিবরীল (আ:), আমি কী বলে প্রশংসা করবো?’ ফেরেশতা জিবরীল (আ:) উত্তরে বলেন, ‘বলুন: নিশ্চয় আল্লাহ ছাড়া উপাসনা পাবার যোগ্য কেউ নেই; তাঁর কোনো অংশীদারও নেই; তাঁরই অধিকারে সমস্ত বিশ্বজগৎ ও যাবতীয় প্রশংসা; একমাত্র তিনি-ই জীবন ও মৃত্যু দেন। তাঁরই ক্ষমতাধীন সকল ধরনের ভালাই, আর তিনি সমস্ত কিছুর ওপর ক্ষমতাবান – অতঃপর আপনার (হযরত আদম আলাইহিস্ সালামের) নিজের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলুন: এয়া আল্লাহ, আপনি মহিমান্বিত এবং সকল প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য; আপনি ছাড়া উপাসনার যোগ্য কেউই নেই। নিশ্চয় আমি আপন সত্তার প্রতি অবিচার করেছি, অতএব, আমায় মাফ করে দিন। আপনি ছাড়া কেউই মাফ করার নেই। এয়া আল্লাহ, আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করি আপনারই প্রিয় বান্দা হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সালাম)-এর উচ্চমর্যাদার খাতিরে এবং আপনার দৃষ্টিতে তাঁরই মাহাত্ম্যের ওয়াস্তে, যাতে আপনি আমায় ক্ষমা করে দেন।’ 

“অতঃপর হযরত আদম (আ:) তাই করেন, আর আল্লাহতা’লা তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, ‘ওহে আদম, তোমায় কে এটা শিখিয়েছে?’ তিনি আরয করেন, ‘হে আমার প্রভু, আপনি যখন আমার মাঝে রূহ ফুঁকেন এবং আমাকে দর্শন, শ্রবণ ও চিন্তাভাবনা করে উপলব্ধি করার ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষে রূপদান করেন, তখন আমি দেখতে পাই আরশের উঁচু সীমায় লেখা আছে – ’আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, শরীকও নেই; আর হযরত ‍মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হলেন আল্লাহর রাসূল। আমি লক্ষ্য করি যে আপনি তাঁর নাম মোবারক ছাড়া কোনো ফেরেশতা বা পয়গম্বরের নাম আপনার সাথে লেখেননি। আমি বুঝতে পারি, তিনি আপনার সৃষ্টিকুলের মাঝে সবচেয়ে মহান কোনো সত্তা হবেন।’ অতঃপর আল্লাহ পাক উত্তর দেন, ‘তুমি সত্য বলেছো, ওহে আদম (আ:)। আর আমিও তোমার দিকে ফিরে তোমায় ক্ষমা করে দিয়েছি’।” [ইমাম সৈয়ূতী (রহ:) কৃত ‘আল-দুর্র আল-মানসূর’, ১:১৪৬]

হযরত মুহাম্মদ বিন আলী বিন হুসাইন হচ্ছেন আবূ জা’ফর আল-বা’ক্বের (রহ:) এবং তিনি ইসলামী দ্বিতীয় প্রজন্মের বিশ্বস্ত অসুসারী ও পুণ্যাত্মাবৃন্দের মধ্য হতে আগত। সিহাহ সিত্তাহ তথা নির্ভরযোগ্য ছয়টি বিশুদ্ধ হাদীসগ্রন্থের সব কয়টিতেই তাঁর বর্ণিত হাদীস শরীফ সংকলিত হয়েছে, আর তিনি বিশিষ্ট সাহাবা সর্ব-হযরত জা’বের (রা:), আবূ সাঈদ খুদরী (রা:), ইবনে উমর (রা:) ও অন্যান্যদের থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন।

পয়গম্বর আদম (আ:)-এর কৃত তাওয়াসসুল-বিষয়ক হাদীসের পক্ষে চতুর্থ দলিল: হযরত আদম আলাইহিস্ সালামের তাওয়াসসুল-সম্পর্কিত হাদীসের পক্ষে চতুর্থ দালিলিক প্রমাণ হলো আবূ বকর আল-আজূরী (রহ:)-এর প্রণীত ‘আল-শরীআ’ পুস্তকে তাঁরই (নিজস্ব) বর্ণনা, যা তিনি আবদুর রহমা’ন বিন আবী যিনা’দ হতে, তিনি তাঁর পিতা হতে রওয়ায়াত করেন; তাঁর পিতা তাতে বলেন, “আল্লাহ পাক যে কথার দ্বারা হযরত আদম (আ:)-এর প্রতি দয়াপরবশ হন, তাতে (আরয করা) ছিলো: ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করি আপনারই ওপর মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর হক্কের (তথা অধিকারের) দোহাই দিয়ে।’ মহান আল্লাহ এমতাবস্থায় প্রশ্ন করেন: ‘মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে তুমি কীভাবে জানলে?’ পয়গম্বর আদম (আলাইহিস্ সালাম) উত্তর দেন: ‘হে প্রভু! আমি আমার শির তুলে আপনার আরশে দেখতে পাই এ কথা লেখা আছে – আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো মা’বূদ/উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রাসূল। আমি বুঝতে পারি যে তিনি আপনার সৃষ্টিকুলের মাঝে সবচেয়ে মহান সত্তা’।”

অতএব, এই রওয়ায়াতটিকে আবদুর রহমা’ন বিন যায়দ (রা:)-এর বর্ণিত হাদীসটির সাথে যুক্ত করলে সেটা (আরো) সুদৃঢ় হয়, যেহেতু এটা লুকোনো নয়।

রাসূলুল্লাহ (দ:) প্রবেশ না করা পর্যন্ত বেহেশত নিষিদ্ধ

মহানবী (দ:)-এর পবিত্র সত্তা মোবারকের প্রতি এই খোদায়ী নেআমতের আরেকটি নিদর্শন হচ্ছে সেই হাদীসটি, যা’তে বিবৃত হয়েছে যে প্রিয়নবী (দ:) জান্নাতে প্রবেশ না করা পর্যন্ত পয়গম্বরবৃন্দের (আলাইহিমুস্ সালাম) বেহেশতে প্রবেশ করা নিষেধ। হযরত উমর ইবনে আল-খাত্তা‘ব (রা:) বর্ণনা করেন যে রাসূলুল্লাহ (দ:) এরশাদ করেন: “আমি বেহেশতে প্রবেশ না করা পর্যন্ত আম্বিয়াবৃন্দের (আ:) তাতে প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়েছে, আর আমার উম্মত তাতে প্রবেশ না করা পর্যন্ত অন্যান্য উম্মতেরও তাতে প্রবেশ করা নিষিদ্ধ হয়েছে।” [আল-তাবারা’নী কৃত ‘আল-আওসাত;’ আল-হায়তামী বলেন, ‘এর সনদ সহীহ/বিশুদ্ধ।’ (মজমাউল যাওয়া’ঈদ, ১:৬৯)] 

বিশ্বজগতের সাথে হুযূর পাক (দ:)-এর নাম মোবারকের সংশ্লিষ্টতা

এই ঐশী আশীর্বাদের অতিরিক্ত নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সেসব বর্ণনা, যা’তে বিবৃত হয়েছে যে মহানবী (দ:)-এর নাম মোবারক উচ্চতর সমাবেশে প্রচার-প্রসার করা হয়। হযরত কাআব আল-আহবার (রহ:) বলেন: “আল্লাহতা’লা নবী-রাসূল (আলাইহিমুস সালাম)-বৃন্দের সংখ্যার সমান (সংখ্যক) যষ্টিসমূহ হযরত আদম (আ:)-এর কাছে প্রেরণ করেন। অতঃপর হযরত আদম (আ:) তাঁর পুত্র শীষ (আ:)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন: ‘ওহে আমার বৎস! তুমি আমার পরে আমারই উত্তরাধিকারী হবে; অতএব এগুলো (মানে যষ্টিগুলো) পুণ্যতাসহ সুদৃঢ় হাতে গ্রহণ করো। প্রতিবার অাল্লাহকে স্মরণ করার সময় সাথে সাথে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর নাম মোবারক-ও স্মরণ করবে; কেননা আমি যখন মাটি ও আত্মার মাঝামাঝি অবস্থায় ছিলাম, তখন আরশের উঁচু সীমায় তাঁরই নাম মোবারক লেখা দেখতে পেয়েছিলাম। আমি আসমানে ভ্রমণ করার সময় এমন কোনো জায়গা দেখিনি যেখানে তাঁর নাম মোবারক লিপিবদ্ধ ছিলো না। আমি মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর নাম মোবারক বেহেশতী হূর (আল-হূর আল-’ঈন/রমনী)-দের গলায়, জান্নাতের বৃক্ষের পাতায়, তূবা’ বৃক্ষের পত্রে, সিদরাতুল মুনতাহা’ বৃক্ষের পল্লবে, পর্দাগুলোর সীমানায় এবং ফেরেশতাদের দু চোখের মাঝখানে দেখতে পেয়েছি। তাঁকে তোমার ঘনঘন স্মরণ করা উচিত, কেননা বাস্তবিকই ফেরেশতামণ্ডলী তাঁকে নিজেদের সকল মুহূর্তে স্মরণ করে থাকেন।” [’আল-মাওয়া’হিবুল লাদূনিয়া,’ ১:১৮৬]

আয্ যুরক্বা’নী (রহ:) বলেন, “এটা ইবনে আসা’কির (রহ:) বর্ণনা করেছেন।” আমি (শায়খ আলাউয়ী) বলি: অনুরূপ একটি বর্ণনা ইবনে তাইমিয়া উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন: “বর্ণিত আছে যে আল্লাহ পাক তাঁর হাবীব (দ:)-এর নাম মোবারক আরশের ওপর এবং বেহেশতের সমস্ত দরজা, গুম্বজ ও বৃক্ষ পল্লবে লিপিবদ্ধ করেন। মহানবী (দ:)-এর নাম মোবারক ও তাতে তাঁর স্মরণের মাহাত্ম্য প্রতীয়মানকারী এসব প্রতিষ্ঠিত হাদীসের সমর্থনে অনেক বর্ণনা এসেছে।”

ইবনে আল-জাওযী বর্ণনা করেন হযরত মায়সারা (রা:) হতে, যিনি বলেন: “আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! আপনি (প্রথম) কবে থেকে নবী ছিলেন?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘আল্লাহ যখন দুনিয়া সৃষ্টি করেন [তখন তিনি আসমানের দিকে ইস্তিওয়া (ইচ্ছা) করেন, অতঃপর ঠিক সাতটি আসমান সৃষ্টি করেন- সূরা বাক্বারা, ২৯], এবং আরশ সৃষ্টি করেন; তিনি আরশের পায়ায় লেখেন – মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হলেন আম্বিয়া-মণ্ডলীর সীলমোহর; এরপর আল্লাহতা’লা সৃষ্টি করেন বেহেশত, যেখানে আদম (আ:) ও মা হাওয়া’কে তিনি বসতি করতে দেন; আর তিনি আমার নাম (মোবারক) লেখেন বেহেশতের দরজাগুলোতে, এর গাছ-গাছালি ও লতা-পাতায়, এর বিভিন্ন গুম্বজ ও তাঁবুগুলোতে, ঠিক এমন-ই একটি সময়ে যখন পয়গম্বর আদম (আ:) আত্মা ও দেহের মধ্যবর্তী অবস্থানে ছিলেন। 

“মহান আল্লাহ যখন তাঁর (পয়গম্বর আদমের) মধ্যে রূহ ফোঁকেন, তখন তিনি আরশের দিকে তাকান এবং আমার নাম (মোবারক) দেখতে পান; এমতাবস্থায় আল্লাহতা’লা তাঁকে জানান যে ‘তিনি (মানে মহানবী দ:) তোমার সকল বংশধরেরই সরদার।’ তাঁদের দু জনকেই যখন শয়তান ধোকা দেয়, তাঁরা দু জনই তওবা করেন এবং আল্লাহ’র কাছে আমার নামের অসীলায় (সুপারিশ) অন্বেষণ করেন’।” [‘ফাতাওয়া,’ ২:১৫০]

পয়গম্বর আদম (আ:)-এর তাওয়াসসুল-বিষয়ক হাদীস হতে গৃহীত গুরুত্বপূর্ণ ফায়দা: প্রিয়নবী (দ:)’র উপস্থিতি দ্বারা এ দুনিয়াকে ধন্য করার আগে তাঁর তাওয়াসসুল/অসীলা-গ্রহণ পালিত হয়েছে। উপরন্তু; তাওয়াসসুলের বৈধতা সে পুণ্যাত্মাকেই ঘিরে, তাঁর প্রভুর কাছে তাঁর উচ্চমর্যাদাকেই ঘিরে আবর্তিত, যাঁর তাওয়াসসুল পালন করা হয়; আর এই দুনিয়ার জীবনে তাঁর জীবিত থাকাটা সেটার জন্যে কোনো শর্ত নয়।

এ থেকে আরো যা গৃহীত তা হলো, এই দুনিয়ার জীবনে জীবিতদেরই কেবল তাওয়াসসুল পালন করা যায় মর্মে যারা দাবি করে, তারা আল্লাহতা’লার হেদায়াত-বঞ্চিত হয়ে নিজেদেরই (নফসানী) খায়েশকে অনুসরণ করে চলেছে।

সিদ্ধান্ত: এই হাদীসটি এর সমস্ত সমর্থনকারী বর্ণনাসহ সহীহ/বিশুদ্ধ এবং এটা একদল উচ্চশিক্ষিত আলেম ও মুহাদ্দীসীন (হাদীসশাস্ত্র বিশারদ) এবং প্রসিদ্ধ ও উচ্চস্তরের হুফফায-বৃন্দ (হাফেয/মুখস্থকারী) বর্ণনা করেছেন। তাঁরা মহানবী (দ:)’র সুন্নাহ’র আস্থাভাজন অভিভাবক। এঁদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন: আল-হা’কিম নিশাপুরী (রহ:), আল-সৈয়ূতী (রহ:) ও আল-বুলক্বীনী।

আল-বায়হাক্বী (রহ:) হতে তাঁর কেতাবে বর্ণিত হয়েছে যে তিনি শর্তারোপ করেছিলেন তিনি কোনো জাল বিবরণ লিপিবদ্ধ করবেন না। এটা সেই একই বই, যা সম্পর্কে আল-যাহাবী বলেন: “এই বইটিকে আঁকড়ে ধরো, কেননা অবশ্যঅবশ্য এর সমস্তটুকুই হেদায়াত তথা সঠিক পথ-নির্দেশনা ও নূর/জ্যোতি।” 

ইবনে কাসীর নিজ আল-বেদা‘য়া পুস্তকে এটাকে উল্লেখ করেন এবং ইবনে তাইমিয়া নিজ ‘ফাতাওয়া’ গ্রন্থে এ থেকে সিদ্ধান্ত নেন। উলামা-মণ্ডলী যে এ হাদীসটি নিয়ে মতভেদ করেছেন – কেউ কেউ একে প্রত্যাখ্যান করেছেন, আবার অন্যরা গ্রহণ করেছেন – এই বাস্তবতা মোটেও আশ্চর্যের কিছু নয়; কেননা এর চেয়ে ঢের বেশি রাসূলুল্লাহ (দ:)’র অনেক হাদীস নিয়েই মতপার্থক্য হয়েছে এবং আলোচনা-সমালোচনাও হয়েছে। 

এই কারণেই এসব বড় বড় (শাস্ত্রীয়) কীর্তি রচনা করা হয়েছে, যা’তে বিধৃত হয়েছে দালিলিক প্রমাণ, বিচার-বিশ্লেষণাত্মক মন্তব্য, পর্যালোচনা ও আলোচনা-সমালোচনা। কোনো নির্দিষ্ট হাদীসের নির্ভরযোগ্যতার ব্যাপারে এ মতপার্থক্য হতে কখনোই এই অভিযোগ ওঠেনি যে ইসলাম ধর্ম হতে খারিজ হয়ে গোমরাহী, শির্ক ও কুফর সংঘটন করা হয়েছে। আলোচ্য এই হাদীসটি তারই এক (উজ্জ্বল) নমুনা বটে।

মহানবী (দ:)-এর মাধ্যমে ইহুদীদের তাওয়াসসুল

মহান আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান:

وَلَمَّا جَآءَهُمْ كِتَابٌ مِّنْ عِندِ ٱللهِ مُصَدِّقٌ لِّمَا مَعَهُمْ وَكَانُواْ مِن قَبْلُ يَسْتَفْتِحُونَ عَلَى ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ فَلَمَّا جَآءَهُمْ مَّا عَرَفُواْ كَفَرُواْ بِهِ فَلَعْنَةُ ٱللهِ عَلَى ٱلْكَافِرِينَ    

অর্থ: আর যখন তাদের কাছে আল্লাহর ওই কিতাব (ক্বুরআন) এসেছে, যা তাদের সাথে রয়েছে এমন কিতাব (তাওরীত)-এর সত্যায়ন করে এবং এর পূর্বে তারা ওই নবী (দ:)’র অসীলা ধরে কাফিরদের ওপর বিজয় প্রার্থনা করতো; অতঃপর যখন তাদের কাছে ওই পরিচিত সত্তা তাশরীফ আনলেন, তখন তাঁকে অস্বীকারকারী হয়ে বসলো। অতএব, অস্বীকারকারীদের ওপর আল্লাহর লা’নত। [আল-ক্বুরআন ২:৮৯; তাফসীরে নূরুল এরফান বাংলা সংস্করণ]

ইমাম আল-ক্বুরতুবী (রহ:) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন:

“আর যখন তাদের (মানে ইহুদীদের) কাছে আল্লাহর ওই কিতাব (মানে ক্বুরআন) এসেছে, যা তাদের সাথে রয়েছে এমন ঐশীগ্রন্থের সত্যায়ন করে” – আল্লাহর এই বাণীতে রয়েছে একটি ঐশীগ্রন্থের বর্ণনা যা আল-ক্বুরআন ভিন্ন অন্য কিতাব হওয়ার সম্ভাবনাময়। এটা ‘মানসূব (কর্মকারক) যার ওপর ভিত্তিশীল ‘হাল’ (কর্ম সংঘটিত হওয়ার সময়কালীন অবস্থা বা পরিস্থিতি); আর উবাঈ’র মুশাফ তথা কপিতে কর্মকারক হিসেবেই যেমনটি বর্ণিত হয়েছে – “যা তাদের সাথে রয়েছে এমন কিতাব (তাওরীত)-এর সত্যায়ন করে” – অর্থাৎ, তৌরীত যা’তে তাদেরকে জ্ঞাত করানো হয়েছে সেটার অন্তর্নিহিত বাণী। “এবং এর পূর্বে তারা ওই নবী (দ:)’র অসীলা ধরে কাফিরদের ওপর (এয়াসতাফতিহূন) বিজয় প্রার্থনা করতো” – অর্থাৎ, তারা সাহায্য প্রার্থনা করতো। আল-এসতেফতাহ’র মানে সাহায্য প্রার্থনা। একটি হাদীসে বিবৃত হয়, প্রিয়নবী (দ:) মুহাজেরীনের মধ্যে গরিব/দুঃস্থদের অসীলায় এয়াসতাফতিহ/বিজয় প্রার্থনা করতেন। অর্থাৎ, তিনি তাঁদের দোয়ার মাধ্যমে সাহায্য চাইতেন। এর আরেকটি উদাহরণ হলো নিম্নের আয়াতে করীমা: “অতএব, হয়তো আল্লাহতা’লা তাঁর নিজের কাছ থেকে কোনো বিজয় (ফাতহুন) বা বিষয় এনে দেবেন” [সরাসরি অনুবাদ]। সাহায্য হলো বন্ধ কোনো কিছুকে উন্মুক্ত করা বা খুলে দেয়া। ফলে এই শব্দটি (আরবী ভাষায়) কথিত প্রবাদে ফেরত যায়: “আমি (ফাতাহ-তু) দরজা খুলেছি।”

আল-নাসাঈ (রহ:) বর্ণনা করেন হযরত আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রা:) হতে, যিনি রাসূলুল্লাহ (দ:)’র বাণী উদ্ধৃত করেন: “আল্লাহ পাক কেবল এই উম্মতের (মাঝে) দুর্বলদের অসীলায় বিজয় দান করেন – তাদের দু’আ, নামায ও আন্তরিকতা/নিষ্ঠার মাধ্যমে।” আল-নাসাঈ (রহ:) আরো বর্ণনা করেন হযরত আবূ আল-দারদা (রা:) হতে, যিনি বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ (দ:)’কে বলতে শুনেছি: “আমাকে খুঁজো তোমাদের দুর্বল জনের মাঝে; কেননা তোমাদেরকে বিজয় ও রিযক্ব দেয়া হয় শুধু তোমাদেরই (মাঝে) দুর্বলদের ওয়াস্তে।”

হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন: খায়বার অঞ্চলের ইহুদীরা গাতফান গোত্রের বিরুদ্ধে লড়ছিলো। যুদ্ধে ইহুদীরা পরাজিত হলে তারা প্রার্থনা করে এই বলে: “হে আল্লাহ, আমরা আপনার কাছে প্রার্থনা করি উম্মী নবী (দ:)’র অধিকারবলে যাঁকে আপনি আখেরী জমানায় প্রেরণ করবেন বলে ওয়াদা করেছেন, যাতে এই প্রার্থনার সূত্রে আপনি আমাদেরকে শত্রুর বিরুদ্ধে বিজয় দান করেন।” অতঃপর তারা আবার যুদ্ধে গাতফান গোত্রের মুখোমুখি হলে ওই প্রার্থনা করে তারা শত্রুদেরকে পরাজিত করে। কিন্তু যখন মহানবী (দ:)’কে প্রেরণ করা হয়, তখন তারা তাঁকে অবিশ্বাস করে বসে, আর আল্লাহ পাক-ও অবতীর্ণ করেন আয়াতে পাক: অতঃপর যখন তাদের কাছে ওই পরিচিত সত্তা তাশরীফ আনলেন, তখন তাঁকে অস্বীকারকারী হয়ে বসলো। অতএব, অস্বীকারকারীদের ওপর আল্লাহর লা’নত (আল-ক্বুরআন ২:৮৯; তাফসীরে নূরুল এরফান বাংলা সংস্করণ)। [তাফসীর আল-ক্বুরতুবী, ২:২৬-২৭]  

নবী করীম (দ:)-এর যাহেরী জিন্দেগীতে ও বেসাল শরীফে পালিত তাওয়াসসুল

সাহাবী হযরত উসমান বিন হুনাইফ (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: “একবার এক অন্ধ ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (দ:)’এর কাছে এসে নিজের অন্ধত্বের ব্যাপারে আরয করেন এই বলে, ‘এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! আমাকে পথ দেখাবার কেউ নেই এবং আমার জন্যে সব বিষয়-ই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ প্রিয়নবী (দ:) তাঁকে বলেন, ‘যাও অযূ করো; এরপর দু রাকআত নফল নামায পড়ো এবং দু’আ করো: হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করি আপনার নবী (দ:)’র মাধ্যমে যিনি রহমতের পয়গম্বর। হে রাসূল (দ:), আমি আপনার প্রভুর দিকে ফিরছি আপনারই মধ্যস্থতায় যাতে তিনি আমার দৃষ্টিশক্তি অামাকে ফিরিয়ে দেন। হে আল্লাহ, আমাকে মহানবী (দ:)’র শাফায়াত নসীব করুন, আর আমাকে আমার জন্যে সুপারিশ মঞ্জুর করুন।’” হযরত উসমান ইবনে হুনাইফ (রা:) বলেন: “আল্লাহর শপথ, আমরা (হুযূরের) সাহচর্য ত্যাগ করিনি, কিংবা বেশিক্ষণ কথাও বলিনি, ঠিক এমনি সময়ে ওই ব্যক্তি আবার আমাদের মাঝে ফিরে আসেন এভাবে যেনো তাঁর কোনো অসুস্থতা-ই (কখনো) ছিলো না।”

আল-হা’কিম (রহ:) বলেন: “এই হাদীস সহীহ, (যদিও) দু জন মুহাদ্দীস শায়খ (সর্ব-ইমাম বুখারী ও মুসলিম) এটা বর্ণনা করেননি।” এই হাদীস সম্পর্কে ইমাম যাহাবী (রহ:) বলেন: “এটা সহীহ হাদীস” [সিয়ার ‘আলম অাল-নুবালা’, ১:৫১৯]। ইমাম তিরমিযী (রহ:) নিজের ‘সুনান’ পুস্তকের শেষে দু’আ অনুচ্ছেদে বলেন: “এই হাদীসটি হাসান সহীহ গরীব; আমরা এটাকে অন্য কোনো সনদে তথা সূত্রে বর্ণিত হতে জানি না শুধু আবূ জা’ফরের হাদীস-সূত্র ব্যতিরেকে, আর তিনি আল-খাতমী নন।” আমি (শায়খ আলাউয়ী) বলি, যা সত্য তা হলো আবূ জা’ফর প্রকৃতপক্ষে আল-খাতমী আল-মাদানী, যেমনটি স্পষ্টভাবে বিবৃত হয়েছে সর্ব-ইমাম তাবারানী (রহ:), আল-হা’কিম (রহ:) ও আল-বায়হাক্বী (রহ:)’র বর্ণনায়। ইমাম তাবারানী (রহ:) নিজ ‘আল-মু’জাম আল-কবীর’ গ্রন্থে যোগ করেন যে তাঁর নাম ছিলো ‘উমাইর বিন এয়াযীদ এবং তিনি নির্ভরযোগ্য। আল্লামা ও মুহাদ্দীস আল-গোমারী তাঁর লিখিত ‘বুদ্ধিমানের উপহার’ শিরোনামের প্রবন্ধে বলেন: 

”হুফফায (মুহাদ্দেসীন)’বৃন্দ কোনো হাদীসকে সহীহ বলার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করাটা অর্থহীন হতো, যদি সেটার সনদে কোনো অপরিচিত ব্যক্তি থাকতো; বিশেষ করে সর্ব-ইমাম যাহাবী (রহ:), আল-মুনযিরী (রহ:), আল-হাফেয (ইবনে হাজর) প্রমুখের ক্ষেত্রে।”

আল-মুনযিরী (রহ:) বলেন: “এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন সর্ব-ইমাম আল-নাসাঈ (রহ:), ইবনে মা’জাহ (রহ:) ও ইবনে খুযায়মা তাঁর ‘সহীহ’ পুস্তকে।” [যেমনটি পাওয়া গিয়েছে ‘আল-তারগীব ওয়াল-তারহীব’ গ্রন্থের নফল এবাদত বইয়ে, প্রয়োজন পূরণের দু’আ অনুচ্ছেদে; ১:৪৩৮]

রাসূলুল্লাহ (দ:)’এর যাহেরী জিন্দেগীতেই কেবল এই দু’আটি সীমাবদ্ধ নয়, বরঞ্চ কতিপয় সাহাবী (রা:) তাওয়াসসুলের এ পদ্ধতিকে তাঁর বেসাল (পরলোকে আল্লাহর সাথে মিলন)-প্রাপ্তির পরও প্রয়োগ করেছেন। ইমাম তাবারানী (রহ:) এই হাদীসটি বর্ণনা করেন এবং এর প্রারম্ভে একটি ঘটনার উল্লেখ করেন, যা’তে জনৈক ব্যক্তি খলীফা হযরত উসমান ইবনে আফফান (রা:)’এর কাছে বারংবার আরয করছিলেন, কিন্তু খলীফা (রা:) তার প্রতি বা তার প্রয়োজনের প্রতি কোনো মনোযোগ দিচ্ছিলেন না। এমতাবস্থায় ওই ব্যক্তি সাহাবী হযরত উসমান ইবনে হুনাইফ (রা:)’এর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং এই বিষয়ে আর্জি পেশ করেন। অতঃপর তিনি (ইবনে হুনাইফ) ওই ব্যক্তিকে বলেন: “অযূ করার স্থানে যাও এবং অযূ করে এসো; এরপর মসজিদে (নববীতে) দু রাকআত নফল নামায পড়ে দু’আ করো, ‘হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করি এবং আপনার দিকে ফিরি আমাদের রাসূল (দ:)’এর মধ্যস্থতায়, যিনি করুণার নবী। হে রাসূল (দ:), আমি আমার প্রভুর দিকে ফিরছি আপনারই মধ্যস্থতায়, যাতে তিনি আমার প্রয়োজন পূরণ করেন’ – এমতাবস্থায় তোমার প্রয়োজনের কথা উল্লেখ কোরো।”

(খলীফা’র কাছে আরযকারী) ওই ব্যক্তি প্রস্থান করেন এবং তাঁকে যা বলা হয়েছিলো, সেই অনুযায়ী আজ্ঞা পালন করে তিনি খলীফা উসমান ইবনে আফফান (রা:)’এর দ্বারে ফেরত যান। দ্বাররক্ষী এসে তাঁর হাত ধরে তাঁকে খলীফা (রহ:)’র সামনে উপস্থিত করেন এবং তাঁর (খলীফার) পাশে একটি ফরাশে বসিয়ে দেন। খলীফা উসমান (রা:) জিজ্ঞেস করেন: “তোমার কী প্রয়োজন?” ওই ব্যক্তি নিজের চাহিদার কথা উল্লেখ করেন, আর খলীফা উসমান (রা:) তাঁর জন্যে তা মঞ্জুর তথা পূরণ করেন। অতঃপর খলীফা (রা:) বলেন, “আমি এতোক্ষণ পর্যন্ত তোমার (প্রার্থিত) আর্জির কথা স্মরণ করতে পারছিলাম না। অতএব, যখন-ই তোমার কোনো কিছু প্রয়োজন হবে, স্রেফ উল্লেখ করবে।” ওই ব্যক্তি খলীফা (রা:)’র দরবার থেকে বিদায় নিয়ে সাহাবী হযরত উসমান ইবনে হুনাইফ (রা:)’এর সাথে দেখা করেন এবং তাঁকে বলেন, “আল্লাহ যেনো আপনাকে পুরস্কৃত করেন! তিনি (খলীফা) আমার প্রয়োজন বা আমার প্রতি মনোযোগই দেননি, যতোক্ষণ না আপনি তাঁর সাথে কথা বলেছেন।” হযরত উসমান ইবনে হুনাইফ (রা:) উত্তর দেন: “আল্লাহর শপথ! আমি তাঁর সাথে কথা বলিনি; তবে আমি (ইতিপূর্বে) এক অন্ধ ব্যক্তিকে রাসূলুল্লাহ (দ:)’এর দরবারে এসে নিজের অন্ধত্ব সম্পর্কে আর্জি পেশ করতে দেখেছিলাম। মহানবী (দ:) জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তুমি কি এটা সহ্য করতে পারবে না?’ অন্ধ ব্যক্তি উত্তর দিয়েছিলো, ‘এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:), আমাকে পথ দেখাবার কেউই নেই এবং এটা আমার জন্যে ভীষণ কষ্টসাধ্য ব্যাপার।’ অতঃপর প্রিয়নবী (দ:) তাঁকে বলেন, ‘তাহলে অযূর জায়গায় গিয়ে অযূ করো; এরপর দুই রাকআত (নফল) নামায পড়ো এবং দু’আ করো’।” হযরত ইবনে হুনাইফ (রা:) আরো বলেন, “আল্লাহর শপথ, আমরা বিদায় নেইনি বা বেশিক্ষণ কথাও বলিনি, তার আগেই ওই (অন্ধ) ব্যক্তি আমাদের কাছে ফিরে আসেন এমনভাবে যেনো ইতিপূর্বে কখনোই তাঁর কোনো রকম (অন্ধত্বজনিত) অসুবিধা ছিলো না।”

আল-মুনযিরী (রহ:) বলেন: “এই হাদীসটি ইমাম তাবারা’নী (রহ:) কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে এবং তিনি এর শেষে উল্লেখ করেন, ‘এটা হাসান সহীহ’” [আল-তারগীব, ১:৪৪০; এবং মজমা’ আল-যাওয়াঈদ, ২:২৭৯]। ইবনে তাইমিয়া বলেন, “অাল-তাবারা’নী (রহ:) বলেছেন, ‘এটা শু’বা বর্ণনা করেন আবূ জা’ফর হতে; তাঁর নাম উমর ইবনে এয়াযীদ; তিনি নির্ভরযোগ্য। শু’বা হতে এই বর্ণনায় উসমান বিন উমর ছিলেন একা।’ আবূ আবদিল্লাহ মাক্বদিসী (রহ:) বলেন, ‘এই হাদীস সহীহ’।” আমি (শায়খ মুহাম্মদ আলাউয়ী মালেকী) বলি, ইবনে তাইমিয়া ওই রাবী’র একক বর্ণনা (তাফার্রুদ) উল্লেখ করেছেন নিজের জ্ঞানের সীমা অনুসারে, আর শু’বা হতে রূহ বিন উবা’দার বর্ণনাটি তাঁর কাছে পৌঁছে নি; অধিকন্তু সেটার এসনাদ (সনদ) সহীহ, যা স্পষ্ট করেছে যে হাদীসটি স্রেফ উসমান বিন উমর হতে (এককভাবে) বর্ণিত নয়। [আল-তাওয়াসসুল ওয়াল-অসীলা, ১০১ পৃষ্ঠা]

অতএব, এই ঘটনার ফলাফল হলো, এ হাদীসের বর্ণনাকারী/রাবী হযরত উসমান ইবনে হুনাইফ (রা:) যিনি ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তিনি খলীফা (উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র দরবারে আর্জি পূরণে খলীফা (রা:)’র দেরির প্রতি অনুযোগকারী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ওই দু’আ শিখিয়ে দেন। এই দু’আটিতে রাসূলে পাক (দ:)’এর তাওয়াসসুল তথা মধ্যস্থতা গ্রহণ করা হয়েছে এবং তাঁর বেসাল তথা পরলোকে খোদার সাথে মিলনপ্রাপ্তির পরে তাঁরই সুপারিশ প্রার্থনা ও  অসীলায় সাহায্য প্রার্থনা করা হয়েছে। ওই ব্যক্তি যখন ধারণা করেন যে তাঁর প্রয়োজন সাহাবী উসমান ইবনে হুনাইফ (রা:) কর্তৃক খলীফা (রা:)’র সাথে কথা বলার কারণে পূরণ হয়েছিলো, হযরত উসমান ইবনে হুনাইফ (রা:) তৎক্ষণাৎ তা নাকচ করে দেন এবং তাঁকে ইতিপূর্বেকার (অন্ধ ব্যক্তির) ঘটনায় নিজের চাক্ষুস ও শ্রুতি সাক্ষ্য সম্পর্কে জানান এই বিষয়টি নিশ্চিত করতে যে, (খলীফার দরবারে আরযকারী) ব্যক্তির চাহিদা/প্রয়োজন পূরণ হয়েছে খোদ রাসূলুল্লাহ (দ:)’এর তাওয়াসসুল পালন ও সুপারিশ প্রার্থনা এবং হুযূরের (দ:) মধ্যস্থতায় সাহায্য চাওয়ারই কারণে। তিনি আল্লাহর নামে শপথ করে এর ওপর গুরুত্বারোপ করেন এই মর্মে যে তিনি খলীফা (রা:)’র সাথে (কখনো) কথা বলেননি।

আরেকটি উদাহরণ এবং ইবনে তাইমিয়ার এটাকে সমর্থন দান استعمال آخر وتأييد ابن تيمية له

روى ابن أبي الدنيا في كتاب مجابي الدعاء قال : حدثنا أبو هاشم سمعت

كثير بن محمد بن كثير بن رفاعة يقول : جاء رجل إلى عبد الملك بن سعيد ابن

أبجر فجس بطنه فقال : بك داء لا يبرأ ، قال : ما هو ؟ قال : الدبيلَة ، وهي

خراج ودمل كبير تظهر في الجوف فتقتل صاحبها غالباً ، قال : فتحول الرجل

فقال : الله الله ، الله ربي لا أشرك به شيئاً ، اللهم إني أتوجه إليك بنبيك محمد نبي الرحمة

يا محمد إني أتوجه بك إلى ربك وربي يرحمني مما بي . قال : فجس ،  

بطنه فقال : قد برئت ، ما بك علة 

অর্থ: ইমাম ইবনে আবিদ্ দুনইয়া (রহ:) নিজ ‘মুজা’বী আল-দু’আ’ পুস্তকে বর্ণনা করেন: “আবূ হাশিম আমাদের কাছে বর্ণনা করেন যে তিনি কাসীর বিন মুহাম্মদ বিন কাসীর বিন রাফা’আ’কে বলতে শুনেছেন: ‘এক ব্যক্তি আবদুল মালেক বিন সাঈদ বিন আবজারের কাছে আসেন এবং আবদুল মালেক তার পেট (হাত দ্বারা) আঁকড়ে ধরে তাকে বলেন, তোমার রয়েছে এক দুরারোগ্য ব্যাধি। ওই ব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, সেটা কী? তিনি উত্তর দেন, এটাকে বলা হয় ‘অাল-দুবায়লাহ’ (এমন এক ক্ষতিকর জীবাণু যা মানুষের অন্ত্রে প্রবেশ করে এবং রোগীর মৃত্যু ঘটায়)। এমতাবস্থায় ওই ব্যক্তি একপাশ ফিরে আরয করেন: হে আল্লাহ! হে আল্লাহ! আল্লাহতা’লা হলেন আমার প্রভু, যাঁর সাথে আমি কাউকে শরীক/অংশীদার করি না। হে আল্লাহ, আমি আপনার দিকে ফিরলাম আপনারই প্রিয়নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের মধ্যস্থতায়, যিনি করুণার নবী। এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! আমি আপনার ও আমার প্রভুর দিকে ফিরলাম আপনারই মধ্যস্থতায় যাতে আমার এই ব্যাধির ক্ষেত্রে খোদাতা’লা আমার প্রতি দয়াপরবশ হন (মানে অসুখ দূর করে দেন)। অতঃপর আবদুল মালেক (আবারো) তার পেট (হাত দিয়ে) আঁকড়ে ধরেন এবং তাকে বলেন, তোমার অসুখ ভালো হয়ে গেছে, আর কোনো সমস্যা নেই।”    

ইবনে তাইমিয়া বলেন: “আমি বলি, এই দুআ’ ও এ রকম প্রার্থনাগুলো (পুণ্যাত্মা) ’সালাফ’-বৃন্দেরই দুআ হিসেবে বর্ণিত হয়েছে” (আল-তাওয়াসসুল ওয়াল-অসীলা, ৯৩ পৃষ্ঠা) [قال الشيخ ابن تيمية : قلت : فهذا الدعاء ونحوه قد روي أنه دعا به السلف]। এটা জ্ঞাত যে ইবনে তাইমিয়া এ বিবরণটি উল্লেখ করেছেন যাতে নিজের উদ্দেশ্য ও চাওয়া অনুযায়ী এর ব্যাখ্যা করা যায়; তবে যে বিষয়টি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে তা হলো, তিনি নিশ্চিত করেছেন যে সালাফ আস সালেহীন এ ধরনের দুআ/প্রার্থনা অনুশীলন করতেন এবং আরোগ্যও এভাবে অর্জিত হতো। বিষয়টির এতোটুকু পরিমাণ নিশ্চিতকরণই আমাদের প্রতিপাদ্য। এই বিবরণের ব্যাপারে তাঁর নিজস্ব যেসব মন্তব্য, তা একান্তই তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। এখানে শুধু আমাদের যা প্রয়োজন তা হচ্ছে প্রামাণ্য দলিলটির সত্যায়ন, যাতে আমরা যা চাই তা সাধনের জন্যে তা ব্যবহার করতে পারি। তিনি যা পছন্দ করেন তার জন্যে দলিল হিসেবে এর ব্যবহার করার অধিকার তিনি সংরক্ষণ করেন।

নিষ্ফল অপচেষ্টা  محاولات يائسة    

কিছু লোক পয়গম্বর আদম (আ:) ও সাহাবী উসমান বিন হুনাইফ (রা:) এবং অন্যান্যদের তাওয়াসসুল-সংক্রান্ত হাদীসগুলো নিয়ে আচ্ছন্ন; আর তারা এ নিয়ে প্যানপ্যান করে থাকে এমন-ই এক পর্যায়ে, যা দ্বারা এগুলোকে প্রত্যাখ্যান করার জন্যে তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করে সর্বাত্মক অপচেষ্টা চালায়। এই বিষয়ে তারা তর্ক-বিতর্ক করে, লম্ফঝম্প দেয় এবং তেলেবেগুনেও চটে থাকে। কিন্তু এতে কোনো ফায়দা-ই হয়নি; কেননা বিষয়টি সম্পর্কে বর্ণিত হাদীস প্রত্যাখ্যান করার যতো চেষ্টা-ই তারা করুক না কেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেম-উলামার নেতৃস্থানীয় বিদ্বানমণ্ডলী এ ব্যাপারে তাঁদের রায় দিয়েছেন; আর তাঁরা আপত্তি উত্থাপনকারীদের চেয়ে মেধা-মনন, জ্ঞান-প্রজ্ঞা, গভীর উপলব্ধি ও সমঝদারি এবং (খোদায়ী) নূর/জ্যোতি, পুণ্য ও (ধর্মের প্রতি) আন্তরিকতায় অনেক শ্রেষ্ঠতর। এ রকম (আলেমের) উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলেন ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:) যিনি তাওয়াসসুলের পক্ষে রায় দিয়েছেন, যেমনটি ইবনে তাইমিয়া তাঁর উদ্ধৃতি দিয়েছেন; এক্ষেত্রে ইমাম আল-’ইযয আল-দ্বীন ইবনে জামা’আ (রহ:)’র কথা উল্লেখ করতেও ভোলা উচিৎ হবে না। মহানবী (দ:)’র মধ্যস্থতায় তাওয়াসসুল পালনের পক্ষে ইবনে তাইমিয়ার নিজেরও একটি সুনির্দিষ্ট অভিমত বিদ্যমান। মুহাম্মদ ইবনে আবদিল ওয়াহহাব নজদী সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এই যে তিনি তাঁদের সমালোচনা করেছিলেন যাঁরা তার প্রতি এ অভিযোগ করেছিলেন যে তিনি তাওয়াসসুল পালনকারীদের প্রতি কুফর/অবিশ্বাসের ফতোয়া আরোপ করেছিলেন। না, মোটেও তা নয়; বরং তিনি তার শরঈ ফতোয়াগুলোতে স্পষ্ট বিবৃত করেছিলেন যে তাওয়াসসুল (ধর্মের) আনুষাঙ্গিক বিষয়াদি হতে নিঃসৃত ব্যাপার, আসল বা মূল হতে নিঃসৃত নয়, যা এই বইয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করা হবে ইনশা’আল্লাহ –

ثم نهاية المطاف عند الشيخ محمد بن عبد الوهاب الذي أنكر على من نسب القول

إليه بتكفير المتوسلين ، بل وصرح في فتاواه بأن التوسل من الفروع ، لا من

الأصول وكل ذلك سيأتي مفصلاً إن شاء الله في هذا الكتاب .

অধিকন্তু, আল্লামা ও মুহাদ্দিস শায়খ আবদুল্লাহ গোমারী সাহেব এই হাদীসটি সম্পর্কে একটি পুস্তিকা লিখেছেন যার নাম তিনি দিয়েছেন: مصباح الزجاجة في صلاة الحاجة ‘প্রয়োজন পূরণের নামাযে কাঁচের প্রদীপ’। তিনি এটা থেকে পেয়েছেন ফায়দা (ও শ্রেষ্ঠত্ব) এবং এনেছেন ব্যাধি হতে আরোগ্যের দাওয়াই ও প্রাচুর্য এবং ঐশ্বর্য-ও। جزاه الله خير الجزاء আল্লাহ তাঁকে সেরা প্রতিদান দিন, (আমীন)। [বঙ্গানুবাদকের নোট: শায়খ নজদী সম্পর্কে এখানে যা বলা হয়েছে, তা সৌদি নাগরিক হিসেবে শায়খ আলাউয়ী (রহ:) বলতে বাধ্য হয়েছেন। এটা ওহাবী সরকারি নীতি। কিন্তু আমরা শায়খ নজদী রচিত ‘কাশফুশ শুবহাত’ পুস্তিকার খণ্ডনে প্রমাণ করেছি যে তাকফিরের অভিযোগটি সত্য।]

শেষ বিচার দিবসের ময়দানে মহানবী (দ:)-এর মাধ্যমে তাওয়াসসুল التوسل به (ص) في عرصات يوم القيامة

রাসূলে পাক (দ:)’এর মাধ্যমে আখেরাতের ময়দানে তাওয়াসসুল প্রসঙ্গে বিস্তারিত বিবরণে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই; কেননা শাফাআত/সুপারিশের আহাদীস তাওয়াতুর তথা জনশ্রুতির পর্যায়ে পৌঁছেছে। সবগুলো বিবরণেই স্পষ্ট প্রামাণ্য দলিল বিদ্যমান এ মর্মে যে মানুষেরা দীর্ঘ সময়ের জন্যে (আখেরাতের বিচার ময়দানে) দাঁড়িয়ে থাকবেন এবং কষ্ট বৃদ্ধি পেতে থাকবে; এমতাবস্থায় তাঁরা আম্বিয়া (আ:)’র সাহায্যপ্রার্থী হবেন। তাঁরা প্রথমে পয়গম্বর আদম (আ:)’এর শরণাপন্ন হবেন; এরপর সর্ব-পয়গম্বর নূহ (আ:), ইবরাহীম (আ:), মূসা (আ:) ও ঈসা (আ:)’র কাছে যাবেন। অতঃপর তাঁরা সবাই নবীকুল শিরোমণি রাসূলে পাক (দ:)’এর শরণাপন্ন হবেন, যিনি তাঁদের সাহায্যে ও অনুরোধ পুরো করতে এগিয়ে আসবেন। তিনি বলতে থাকবেন: أنا لها أنا لها  “আমি শাফাআতের জন্যে, আমি শাফাআতের জন্যে [মানে শাফাআত আমারই অধিকারে]।” এরপর তিনি সেজদায় পড়ে যাবেন এবং সেই অবস্থাতেই থাকবেন যতোক্ষণ না ঘোষণা করা হবে: ارفع رأسك واشفع تشفع “(হে রাসূল) আপনার শির মোবারক তুলুন এবং সুপারিশ করুন; কেননা আপনার শাফাআত গৃহীত হবে।”

অতএব, এই হাদীসটি নবী-রাসূলবৃন্দ (আ:) ও এর পাশাপাশি ঈমানদারদের সকলেরও (এতদসংক্রান্ত) ঐকমত্য ব্যক্ত করে; আর এটা সারা জাহানের প্রভুরও মৌন অনুমতি/সম্মতি ব্যক্ত করে এই মর্মে যে কষ্টের সময়ে খোদার নৈকট্যপ্রাপ্তদের সাহায্য প্রার্থনা করা বিপদ-আপদ ও দুঃখকষ্ট অপসারণের সেরা চাবিকাঠি; আর তা সারা জাহানের প্রভুর সন্তুষ্টিও বিধান করে থাকে।

ইবনে তাইমিয়ার গৃহীত পদ্ধতির নিরিখে তাওয়াসসুলের বৈধতা مشروعية التوسل على طريقة الشيخ ابن تيمية

ইবনে তাইমিয়া তাঁর قاعدة جليلة في التوسل والوسيلة ‘তাওয়াসসুল ও অসীলা গ্রহণবিষয়ক মহৎ পদ্ধতি’ শীর্ষক পুস্তকে আল্লাহতা’লার কালাম ‘ওহে ঈমানদাররা, আল্লাহকে ভয় করো এবং তাঁর নৈকট্য লাভের জন্যে অসীলা/মাধ্যম তালাশ করো’ [সূরা মায়েদা, ৩৫] – আয়াতটি ব্যাখ্যাকালে বলেন: 

فابتغاء الوسيلة إلى الله سبحانه وتعالى إنما يكون لمن توسل إلى الله بالإيمان بمحمد 

واتباعه، وهذا التوسل بالإيمان به وبطاعته فرض على كل أحد في كل حال باطناً

وظاهرًا في حياة رسول الله صلى الله عليه وسلم وبعد موته في مشهده ومغيبه لا

يسقط التوسل بالإيمان به وبطاعته عن أحد من الخلق في حال من الأحوال بعد

قيام الحجة عليه ولا يعذر من الأعذار ولا طريق إلى كرامة الله ورحمته والنجاة من

هوانه وعذابه إلا بالتوسل به وبطاعته وهو صلى الله عليه وسلم شفيع الخلائق

صاحب المقام المحمود الذي يغبطه به الأولون والآخرون فهو أعظم الشفعاء قدرًا

 وأعلاهم جاهاً عند الله،

অর্থ: কারো দ্বারা আল্লাহতা’লার নৈকট্য অন্বেষণের অসীলা তালাশ কেবল অর্জিত হয় আল্লাহর দিকে তাঁরই ফেরার মুহূর্তে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র প্রতি আপন ঈমান বা বিশ্বাস ও এতাআত/তাবেদারি তথা আনুগত্যের মাধ্যমে। প্রিয়নবী (দ:)’র প্রতি এই বিশ্বাস ও আনুগত্য প্রত্যেকের জন্যে ফরয তথা বাধ্যতামূলক সব সময় – প্রকাশ্যে (যাহেরীভাবে) ও অপ্রকাশ্যে (বাতেনীভাবে), রাসূলে পাক (দ:)’এর যাহেরী জিন্দেগীতে বা বেসাল শরীফের পরে, এবং তাঁরই যাহেরী উপস্থিতিতে ও যাহেরী অনুপস্থিতিতে। সৃষ্টিকুলের কারোরই জন্যে, কোনো অবস্থাতেই, হুযূরে পূর নূর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের প্রতি ঈমানদারি ও আনুগত্যের (ঐশী) বিধান রহিত হবে না – যখনই (এর সত্যতার) প্রামাণিকতা তার সামনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। এই বিধান রহিত করার কোনো ওজর/অজুহাত নেই। আল্লাহতা’লার অনুগ্রহ ও দয়াপ্রাপ্তি, তাঁর তিরস্কার ও শাস্তি থেকে পরিত্রাণ লাভের আর অন্য কোনো পন্থা নেই, একমাত্র প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র তাওয়াসসুল/অসীলা গ্রহণ ও তাঁরই আনুগত্য ব্যতিরেকে। তিনি-ই সৃষ্টিকুলের জন্যে শাফাআত/সুপারিশকারী, সুউচ্চ ‘আল-মাক্বাম আল-মাহমূদের’ অধিকারী, যাঁর শান-মানের প্রতি প্রথম ও শেষ সবারই ঈর্ষা হবে। তিনি-ই শাফাআতকারীদের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ, আর আল্লাহতা’লার কাছে মর্যাদায় সবার শীর্ষে। 

আল্লাহতা’লা পয়গম্বর মূসা (আলাইহিস সালাম) সম্পর্কে বলেন – وكَانَ عند الله وجِيهاً ‘মূসা আল্লাহর কাছে মর্যাদাবান’ [সূরা আহযাব, ৬৯]। তিনি পয়গম্বর ঈসা (আলাইহিস সালাম) সম্পর্কে বলেন – وجِيهاً في الدنيا والآخرة ‘মর্যাদাবান হবে দুনিয়া ও আখিরাতে’ [সূরা আলে ‘ইমরান, ৪৫]। প্রিয়নবী (দ:) সকল নবী-রাসূল (আলাইহিমুস্ সালাম) হতে উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন। তবে তাঁর শাফাআত ও দুআ স্রেফ ওই ব্যক্তির জন্যেই উপকারী হবে, যাঁর জন্যে তিনি শাফাআত ও দুআ করবেন। অতএব, যে ব্যক্তির জন্যে প্রিয়নবী (দ:) শাফাআত ও দুআ করবেন, তিনি আল্লাহর দিকে ফেরার সময় হুযূর পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর শাফাআত ও দুআর মধ্যস্থতা গ্রহণ করতে পারেন (মানে জায়েয), যেমনটি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর অসীলা গ্রহণ করেছিলেন মহানবী (দ:)’র সাহাবা-এ-কেরাম (রা:), আর যেমনটি গ্রহণ করবেন মনুষ্যকুল, আখেরাত তথা শেষ বিচার দিবসে। 

‘ফতোয়া আল-কুবরা’ শীর্ষক গ্রন্থে হাফেয ইবনে তাইমিয়াকে জিজ্ঞেস করা হয়: মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’র মাধ্যমে তাওয়াসসুল/অসীলা গ্রহণের অনুমতি আছে কি? ইবনে তাইমিয়া উত্তর দেন:

فأجاب: الحمد لله، أما التوسل بالإيمان به ومحبته وطاعته والصلاة وسلام عليه وبدعائه وشفاعته ونحو ذلك مما هو من أفعاله وأفعال العباد المأمور بها في حقه فهو مشروع باتفاق المسلمين ـ

অর্থ: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই (প্রাপ্য)। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর মাধ্যমে তাওয়াসসুল পালনের ক্ষেত্রে (বলবো), তাঁর প্রতি ঈমান, মহব্বত ও আনুগত্য এবং তাঁর প্রতি সালাত-সালাম প্রেরণ, আর তাঁরই দুআ ও শাফাআত/সুপারিশ প্রার্থনার মতো তাঁরই আমল/অনুশীলনী এবং আদিষ্ট তাঁরই সত্য-সঠিক পথের আনুগত্যকারী প্রিয় বান্দাদের আমল অনুযায়ী তা ( মানে তাওয়াসসুল) পালন করলে মুসলিম উম্মাহ’র (উলামাবৃন্দের) ঐকমত্য অনুসারে তা (ইসলামে) বৈধ। [আল-ফাতাওয়া আল-কুবরা, ১:১৪০]

আমি (শায়খ আলাউয়ী মালেকী) বলি: ইবনে তাইমিয়ার কথা থেকে এখানে দুটো বিষয় বোধগম্য হয়। প্রথমতঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর প্রতি যে মুসলমান-ব্যক্তি অনুগত ও মহব্বতশীল এবং তাঁর অনুসরণকারী, আর তাঁরই শাফাআতে বিশ্বাসী, ওই ব্যক্তির জন্যে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র আনুগত্য, এশক্ব-মহব্বত ও তাতে আপন ঈমানদারির ভিত্তিতে তাওয়াসসুল পালন করার অনুমতি রয়েছে। বস্তুতঃ আমরা মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র মাধ্যমে তাওয়াসসুল পালন করলে আল্লাহ-ই হচ্ছেন আমাদের সাক্ষী এই মর্মে যে, আমরা হুযূর পূর নূর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর তাওয়াসসুল স্রেফ তাঁর প্রতি আমাদের বিশ্বাস, ভক্তি-মহব্বত ও তাঁরই (অনুপম) গুণগত বৈশিষ্ট্যাবলী এবং মাহাত্ম্য-শ্রেষ্ঠত্বের ভিত্তিতে পালন করে থাকি। এটাই তাওয়াসসুলের মুখ্য উদ্শ্যে। কেউ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর মাধ্যমে (এ ছাড়া) অন্য কোনো উদ্দেশ্যে তাওয়াসসুল পালন করতে পারে বলে ধারণাই করা যায় না। অন্য সব মুসলমান যেভাবে তাওয়াসসুল পালন করেন, তার থেকে ভিন্ন কিছু হওয়াটা এক্ষেত্রে একেবারেই অসম্ভব। এখানে শুধু এই বিষয়টি-ই লক্ষণীয় যে, তাওয়াসসুল পালনকারী হয়তো তা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করতে পারেন, নতুবা তিনি স্পষ্টভাবে বলতে না-ও পারেন; কিন্তু তাঁরা তাওয়াসসুলের মুখ্য উদ্দেশ্য ধারণ করেই তা পালন করে থাকেন। অর্থাৎ, প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র প্রতি ঈমান/বিশ্বাস ও মহব্বত অন্তরে পোষণ করেই তা পালিত হয়; এর বেশি কিছু নয়।

দ্বিতীয়তঃ ইবনে তাইমিয়ার কথা থেকে আরেকটি বিষয় বোঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) যার জন্যে দুআ করেন, ওই ব্যক্তির পক্ষে তাঁরই দুআর মধ্যস্থতায় আল্লাহর দিকে তাওয়াসসুল (তথা প্রার্থনা) করা সহীহ/বৈধ। হুযূর পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) যে তাঁর উম্মতের জন্যে এরকম দুআ করেছেন, তা বহু হাদীসে সাবেত তথা প্রতিষ্ঠিত। উদাহরণস্বরূপ: 

عن عائشة رضي الله عنها أنها قالت لما رأيت من النبي (صلى الله عليه وسلم) طيب النفس، قلت: يا رسول الله! أدع الله لي، فقال: اللهم اغفر لعائشة ما تقدم من ذنبها وما تأخر وما أسرت وما أعلنت فضحكت عائشة حتى سقط رأسها في حجرها من الضحك، فقال لها رسول الله (صلى الله عليه وسلم) أيسرك دعائي، فقالت: وما لي لا يسرني دعاؤك، فقال (صلى الله عليه وسلم): إنها لدعائي لأمتي في كل صلاة    

অর্থ: হযরত মা আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) বলেন: একবার আমি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’কে উৎফুল্লচিত্তে দেখতে পাই; তাই আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করি: “এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! (অনুগ্রহ করে) আল্লাহর কাছে আমার জন্যে দুআ করুন।’ তিনি তখন দুআ করেন: ‘এয়া আল্লাহ, আয়েশা’র অতীত ও ভবিষ্যৎ গুনাহ মাফ করেন দিন, যা সে প্রকাশ্যে করেছে এবং যা গোপন রেখেছে।’ মা আয়েশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) এমতাবস্থায় এমন হাসি হাসেন যার দরুন তাঁর শির মোবারক তাঁরই কোলে পড়ে যায়। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) তাঁকে জিজ্ঞেস করেন: ‘আমার দুআ কি তোমায় খুশি করেছে?’ তিনি উত্তর দেন: ‘আপনি আমাকে খুশি না করে পারেন কীভাবে?’ অতঃপর প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) বলেন: ‘নিশ্চয় এটা আমার উম্মতের জন্যে প্রতিটি নামাযে আমারই দুআ।’ 

এই হাদীসটি আল-বাযযার হতে বর্ণিত এবং এর বর্ণনাকারীবৃন্দ হচ্ছেন সহীহ (তথা নির্ভরযোগ্য বুখারী ও মুসলিমেরই রাবী); ব্যতিক্রম শুধু আহমদ ইবনে মনসূর আল-রামাদী যিনি নিজেও নির্ভরযোগ্য (যেমনটি বিবৃত হয়েছে ‘মজমাউল যাওয়াইদ’ গ্রন্থে)। এই কারণে প্রত্যেক মুসলমানের জন্যে আল্লাহর দিকে ওইভাবে তাওয়াসসুল পালন করার সময় এ কথা বলা বৈধ হবে: ‘হে আল্লাহ! আপনার প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) তাঁর উম্মতের জন্যে দুআ করতেন; আমি তাঁরই একজন (গুনাহগার) উম্মত। তাই আমি আপনার দিকে তাওয়াসসুল পালন করার সময় (তাঁরই মধ্যস্থতায়) দুআ করছি, যাতে আপনি আমার গুনাহ মাফ করে দেন এবং আমার প্রতি আপনার করুণা বর্ষণ করেন।’ এই ধরনের দুআ-গুলো করা যেতে পারে। যদি ওই মুসলমান এ রকম দুআ করেন, তাহলে তিনি শরঈ বিধান লঙ্ঘন করবেন না, যে বিষয়টির ওপর ঐকমত্য পোষণ করেছেন মুসলিম উলামাবৃন্দ। যদি তিনি (মুখে) বলেন: ‘হে আল্লাহ, আমি আপনার দিকে তাওয়াসসুল পালন করছি আপনারই প্রিয়নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর মধ্যস্থতায়,’ তাহলে তিনি তাঁর অন্তরের নিয়্যত/উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেননি এবং খোলাসাও করেননি তাঁর অন্তরের মক্বসূদ/অভিলাষ কী, যেটা সকল মুসলমানেরই নিয়্যত বটে এবং এর বেশি কিছু নয়। কেননা প্রিয়নবী (দ:)’র মাধ্যমে যাঁরা তাওয়াসসুল পালন করেন, তাঁদের আর অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকে না প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র সত্তা মোবারকের সাথে সংশ্লিষ্ট তাঁরই ভালোবাসা, ঘনিষ্ঠতা, উচ্চমর্যাদা, মক্বাম, উন্নত গুণাবলী, দুআ ও শাফাআত/সুপারিশ (লাভ) ব্যতিরেকে; (এটা বৈধ) বিশেষ করে যখন তাঁর বরযখী/পারলৌকিক জীবনে (তাঁর প্রতি প্রেরিত) সালাত-সালাম তিনি শুনতে পান এবং এমন পন্থায় প্রত্যুত্তর দেন যা যথাযথ: যেমন – সালামের জবাব ও মাগফেরাত কামনা, যা হাদীসে তিনি ব্যক্ত করেছেন এভাবে:

حياتي خير لكم ومماتي خير لكم تحدثون ويحدث لكم، تعرض أعمالكم عليَّ فإن وجدتُّ خيراً حمدت الله، وإن وجدت شراً استغفرت الله لكم

অর্থ: আমার (যাহেরী) জিন্দেগী তোমাদের জন্যে উপকারী; আমার বেসাল (শরীফ)-ও তোমাদের জন্যে উপকারী; তোমরা তা বলবে এবং তোমাদেরও তা বলা হবে। তোমাদের আমলনামা আমাকে প্রদর্শন করা হবে; তাতে ভালো দেখলে আমি আল্লাহর প্রশংসা করবো, আর মন্দ দেখলে তোমাদের জন্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা তথা সুপারিশ করবো।

এই হাদীসটি হাফেয ইসমাঈল কাজী তাঁর جزء الصلاة على النبي صلى الله عليه وسلم (মহানবী’র প্রতি সালাত-সালাম) শীর্ষক পুস্তকে বর্ণনা করেছেন। আল-হায়তামী এটাকে ‘মজমাউল যওয়াইদ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন এবং সহীহ সাব্যস্ত করেন এ কথা বলে: “এটা আল-বাযযার বর্ণনা করেন এবং এর বর্ণনাকারীবৃন্দ সবাই সহীহ (যাঁরা বুখারী ও মুসলিমের নির্ভরযোগ্য রাবী)।”

(ওপরের) বর্ণনাটি স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে যে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) তাঁর বরযখী তথা পারলৌকিক জীবনে উম্মতের (গুনাহ মাফের) জন্যে এসতেগফার তথা সুপারিশ করে থাকেন। (তাঁর ওই) দুআ-এ-এসতেগফার দ্বারা উম্মত উপকার লাভ করছেন। অপর এক হাদীসে তিনি এরশাদ করেন:

ما من أحد يسلم عليَّ إلا رد الله عليَّ روحي حتى أرد السلام

অর্থ: কেউ আমার প্রতি সালাম প্রেরণ করলে আল্লাহ আমার রূহ’কে ফিরিয়ে দেন এবং আমি তার সালাম গ্রহণ করি। 

এই হাদীসটি হযরত আবূ হুরায়রা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে ইমাম আবূ দাউদ (রহমতুল্লাহে আলাইহে) বর্ণনা করেন। ইমাম নববী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) বলেন: 

إسناده صحيح                                                               

অর্থ: এই হাদীসের সনদ সহীহ/বিশুদ্ধ। 

হাদীসটি স্পষ্টভাবে বিবৃত করে যে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) মুসলমানদের সালামের প্রত্যুত্তর দেন। শান্তিময় সালাম হচ্ছে আমা’ন তথা নিরাপত্তাসূচক। অতএব, (প্রিয়নবীর) সালাম বাস্তবে মুসলমানদের জন্যে নিরাপত্তাবাচক দুআ/প্রার্থনা; আর মুসলমান সাধারণ তা হতে উপকার লাভ করেন। [বঙ্গানুবাদকের নোট: বাতেল ওহাবী/সালাফী/মওদূদীপন্থীরা দাবি করে থাকে যে মাযারস্থ আম্বিয়া-আউলিয়ামণ্ডলী মানুষের উপকার করতে অক্ষম; তাই তাঁদের কাছে শাফাআত প্রার্থনা না করে তাঁদেরই (উপকারের) জন্যে দুআ করতে হবে! নাউযুবিল্লাহ! শায়খ আলাউয়ী (রহ:)’এর ওপরের এ বক্তব্য বাতেলপন্থীদের দাবিকে সমূলে উৎপাটিত করেছে]

মহানবী (দ:)-এর তাওয়াসসুলের বৈধতা সম্পর্কে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:) ও ইবনে তাইমিয়ার সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি – مشروعية التوسل بالنبي (صلى الله عليه وسلم) خاصة عند الإمام أحمد بن حنبل وابن تيمية

এই বিষয়টি এ বাস্তবতার আলোকে গৃহীত যে, ইবনে তাইমিয়া তাঁর বইপত্রে তাওয়াসসুলের বৈধতার পক্ষে ঘোষণা দিয়েছেন; আর তিনি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র প্রকাশ্য হায়াতে জিন্দেগী বা বেসাল শরীফ অথবা হাজির/উপস্থিতি বা গায়ব/অনুপস্থিতির মাঝে কোনো পার্থক্যই করেননি। তাঁর ‘আল-ফাতাওয়া আল-কুবরা’ পুস্তকে বিষয়টির বৈধতার পক্ষে তিনি সর্ব-ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:) ও আল-ইযয্ বিন আবদ্ আল-সালা’ম (রহ:)’কে উদ্ধৃত করেন। 

ইবনে তাইমিয়া বলেন: 

وكذلك مما يشرع التوسل به صلى الله عليه وسلم في الدعاء كما في الحديث الذي رواه الترمذي وصححه: أن النبي (ص) علم شخصاً أن يقول: اللهم إني أسألك وأتوسل إليك بنبيك محمد (صلى الله عليه وسلم) نبي الرحمة يا محمد إني أتوجه بك إلى ربك فيجلي حاجتي ليقضيها فشفعه فيَّ، فهذا التوسل به حسن  

অর্থ: অনুরূপভাবে, দুআ’র মধ্যে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হতে তাওয়াসসুলের শরঈ বৈধতা পাওয়া যায়, যেমনটি ইমাম তিরমিযী (রহ:) হতে বর্ণিত ও সহীহ হিসেবে সত্যায়িত একখানি হাদীস শরীফে বিবৃত হয়: হুযূর পাক (দ:) জনৈক ব্যক্তিকে শিক্ষা দিয়েছিলেন (দুআ’র মধ্যে এ কথা) বলতে: “হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে চাই এবং তাওয়াসসুল পালন করি আপনারই প্রিয়নবী (দ:)’র মধ্যস্থতায়, যিনি রহমতের নবী। হে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)! আমি আপনারই মধ্যস্থতায় আপনার প্রভুর দিকে ফিরলাম যাতে তিনি আমার প্রয়োজন পূরণ করেন এবং আমার পক্ষে আপনাকে সুপারিশকারী করে দেন।” এই তাওয়াসসুল (পদ্ধতিটি) উত্তম। [আল-ফাতাওয়া আল-কুবরা, ১:১০৫]

ইবনে তাইমিয়া আরো বলেন: 

আল্লাহতা’লার কাছে আমাদের রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) ছাড়া অন্য কারো মাধ্যমে তাওয়াসসুল পালন, তা ইস্তেগাসাহ (সাহায্য প্রার্থনা) নামে অভিহিত হোক বা না-ই হোক, আমরা জানি না পুণ্যবান সালাফবৃন্দের কেউ তা পালন করেছিলেন কি-না; এ মর্মে কোনো বর্ণনাও নেই [বঙ্গানুবাদকের নোট: এ মর্মে বর্ণনা বিদ্যমান, যা আমার ‘ওহাবীদের সংশয় নিরসন’ শীর্ষক প্রকাশিত বইটিতে সন্নিবেশিত হয়েছে]। আমরা এ বিষয়ে (কিছুই) জানি না, স্রেফ শায়খের (ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহমতুল্লাহে আলাইহে’র) নিষেধসূচক ফতোয়াটি ছাড়া। আর প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র মাধ্যমে তাওয়াসসুলের ব্যাপারে সর্ব-ইমাম নাসাঈ (রহ:), তিরমিযী (রহ:) ও অন্যান্যদের বর্ণিত সুনানে একটি হাদীস এসেছে, যা’তে জনৈক বেদুঈন আরব মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র কাছে এসে আরয করেন: “এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! আমার দৃষ্টিশক্তি ব্যাধিগ্রস্ত; অতএব, আমার জন্যে অনুগ্রহ করে আল্লাহর দরবারে দুআ’ করুন।” হুযূর পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) তাঁকে বলেন:

توضأ وصل ركعتين، ثم قال: اللهم أسألك وأتوجه إليك بنبيك محمد (صلى الله عليه وسلم) يا محمد إني أتشفع بك في رد بصري اللهم شفع نبيك فيَّ، وقال: فإن كانت لك حاجة فمثل ذلك ـ فرد الله بصره 

অর্থ: অযূ করো এবং দুই রাকআত (নফল) নামায পড়ো। অতঃপর দুআ’ করো – ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি এবং আপনার দিকে ফিরছি আপনারই নবী (দ:)’র মাধ্যমে। এয়া রাসূলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)! আমি আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবার ক্ষেত্রে আপনারই শাফাআত/সুপারিশ কামনা করছি। হে আল্লাহ! প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’কে আমার জন্যে শাফাআতকারী করে দিন।’ মহানবী (দ:) আরো বলেন: ‘তোমার অন্য কোনো প্রয়োজন থাকলে এভাবে দুআ কোরো।’ এমতাবস্থায় আল্লাহতা’লা ওই বেদুঈনের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেন।

অতএব, এই হাদীসের ওপর ভিত্তি করে শায়খ (ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহমতুল্লাহে আলাইহে) প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র মধ্যস্থতায় তাওয়াসসুলকে পৃথক করেন (ওই সব হতে যা তিনি নিষেধ করেছিলেন)। [আল-ফাতাওয়া, ১ম খণ্ড, ১০৫ পৃষ্ঠা]

ইবনে তাইমিয়া অন্যত্র বলেন:

এই কারণেই ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহমতুল্লাহে আলাইহে) তাঁর ‘মানাসিক’ (হজ্জ্বের রীতিনীতি) বইয়ে নিজ সহযোগী মার্রূযী’কে লিখেছিলেন ‘প্রত্যেকের উচিৎ আপন দুআ’য় প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র তাওয়াসসুল পালন করা।’ তবে ইমাম আহমদ (রহ:) ছাড়া অন্যরা বলেন: “এটা আল্লাহর প্রতি ক্বসম/শপথ করার মতোই; আর কোনো সৃষ্টির মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি ক্বসম করা যায় না।” একটি বর্ণনায় এসেছে যে ইমাম আহমদ (রহমতুল্লাহে আলাইহে) এটার অনুমতি দিয়েছেন এবং সে কারণেই তিনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর মাধ্যমে তাওয়াসসুলকে জায়েয/বৈধ বলেছেন। [আল-ফাতাওয়া, ১ম খণ্ড, ১৪০ পৃষ্ঠা]

শওকানীর দৃষ্টিতে তাওয়াসসুলের বৈধতা

সালাফী ইমাম ও মুহাদ্দীস মুহাম্মদ ইবনে আলী আল-শওকানী নিজ ‘আল-দুর্র আল-নাদীদ ফী এখলাসে কালেমা আল-তৌহীদ’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেন:

আল্লাহর নৈকট্যের উদ্দেশ্যে তাঁর যে কোনো সৃষ্টির মাধ্যমে তাওয়াসসুল পালন এমন একটি বিষয়, যা বান্দা তাঁর প্রভুর কাছে অন্বেষণ করেন। ইমাম আল-ঈযয বিন আবদ্ আল-সালাম (রহমতুল্লাহে আলাইহে) এই প্রসঙ্গে বলেন: “যদি তাওয়াসসুলের ব্যাপারে হাদীসটি সহীহ হয়, তাহলে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) ছাড়া অন্য কারো মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্যের উদ্দেশ্যে তা পালন করা জায়েয নেই।” হয়তো এখানে ইমাম আল-ঈযয (রহ:) ওই হাদীসটির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, যা বর্ণনা করেছিলেন ইমাম নাসাঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহে) তাঁরই ‘সুনান’ পুস্তকে ও আল-তিরমিযী (রহমতুল্লাহে আলাইহে), আর যেটাকে সহীহ হিসেবে সত্যায়ন করেছিলেন ইমাম ইবনে মাজাহ (রহমতুল্লাহে আলাইহে) ও অন্যান্য মুহাদ্দেসীনবৃন্দ; এতে বর্ণিত হয়েছিলো যে এক অন্ধ ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর কাছে এসেছিলেন (হাদীসটি স্মর্তব্য)। ইমাম আল-ঈযয (রহমতুল্লাহে আলাইহে) অতঃপর বলেন:

وللناس في معنى هذا قولان: أحدهما أن التوسل هو الذي ذكره عمر بن الخطاب لما قال: كنا إذا أجدبنا نتوسل بنبينا إليك فتسقينا، وإنا نتوسل إليك بعم نبينا

অর্থ: “এই হাদীসের মানে মানুষেরা দু ভাবে করে থাকেন: প্রথমটি হচ্ছে হযরত উমর ফারূক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর স্মরণে যখনই তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা খরাকালীন সময়ে আমাদের রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর মধ্যস্থতায় আপনার (আল্লাহর) উদ্দেশ্যে তাওয়াসসুল পালন করতাম, আর আপনিও আমাদেরকে বৃষ্টি দিতেন; এক্ষণে আমরা তাঁর (সম্মানিত) চাচাজানের মাধ্যমে আপনার দিকে তাওয়াসসুল পালন করছি।’

“এই সহীহ বর্ণনাটি ইমাম বুখারী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) ও অন্যান্য মুহাদ্দেসীনের দ্বারা সংকলিত। খলীফা উমর ফারূক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এতে উল্লেখ করেন যে তাঁরা প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র যাহেরী জিন্দেগীর সময়ে (আল্লাহর দরবারে) বৃষ্টি প্রার্থনাকালে তাঁর তাওয়াসসুল পালন করতেন; আর তাঁর বেসাল শরীফের পরে তাঁরই শ্রদ্ধেয় চাচাজানের মাধ্যমে তাঁরা তাওয়াসসুল পালন করতেন। এই তাওয়াসসুল ছিলো (আল্লাহর দরবারে) তাঁদের বৃষ্টি কামনার পন্থা; কেননা প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) দুআ করতেন এবং তাঁরাও তাঁর সাথে দুআ করতেন। এভাবে তিনি ছিলেন আল্লাহর নৈকট্য লাভের ক্ষেত্রে তাঁদের জন্যে অসীলাস্বরূপ; আর এই অর্থে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হলেন তাঁদের জন্যে শাফাআতকারী/সুপারিশকারী; তাঁদের জন্যে দুআ/প্রার্থনাকারীও। 

ইমাম ঈযয (রহমতুল্লাহে আলাইহে) অতঃপর বলেন:

وقول الثاني: أن التوسل به (صلى الله عليه وسلم) يكون في حياته وبعد موته وفي حضرته ومغيبه، ولا يخفاك أنه قد ثبت التوسل به (صلى الله عليه وسلم) في حياته، وثبت التوسل بغيره بعد موته بإجماع الصحابة إجماعاً سكوتياً لعدم إنكار أحد منكم على عمر رضي الله عنه في توسله بالعباس  رضي الله عنه  

অর্থ: দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গি হলো, প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র মধ্যস্থতায় তাওয়াসসুল যেমনটি তাঁরই প্রকাশ্য জিন্দেগীর সময় পালন করা হয়েছিলো, তেমনটি তাঁর বেসাল শরীফের পরও তা পালন করা যেতে পারে; তাঁর উপস্থিতিতে যেমনটি পালিত হয়েছিলো, তেমনটি তাঁর (প্রকাশ্য) অনুপস্থিতিতেও পালন করা যেতে পারে। তাঁর জাহেরী জিন্দেগীতে তা পালনের প্রমাণিত বিষয়টি তোমার কাছে গোপন নয়; আর তাঁর বেসাল শরীফের পরে অন্যদের মধ্যস্থতায় তাওয়াসসুল পালিত হওয়ার বিষয়টিও সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন)’এর এজমা’য়ে সুকূতী তথা মৌন সমর্থনসূচক ঐকমত্য দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। কেননা তাঁরা কেউই খলীফা উমর ফারূক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’কে হযরত আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর মধ্যস্থতায় তাওয়াসসুল পালন করার জন্যে এনকার/সমালোচনা করেননি।”

আমার (আশ্ শওকা’নী) দৃষ্টিতে তাওয়াসসুল তথা অসীলা গ্রহণের অনুমতি/বৈধতাকে স্রেফ প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়া সাল্লাম)’র বেলাতেই সীমাবদ্ধ বা সুনির্দিষ্ট করার কোনো যথার্থতা নেই, যেমনটি দাবি করেছিলেন শায়খ ঈযয আল-দ্বীন বিন আবদ্ আল-সালাম। এর দুটো কারণ বিদ্যমান: প্রথমতঃ সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন)’এর এজমা’ বা ঐকমত্য যা সম্পর্কে আমরা আপনাকে (ইতোমধ্যে) জানিয়েছি; এবং দ্বিতীয়তঃ পুণ্যবান ও জ্ঞানীদের অসীলায় আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা প্রকৃতপক্ষে তাঁদেরই নেক আমল ও উন্নত গুণাবলীর মধ্যস্থতা ছাড়া কিছু নয়। কেননা কেউই নিজের নেক আমল ছাড়া গুণগত শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী নন [বঙ্গানুবাদকের নোট: শওকানী সালাফীদের ইমাম, সুন্নীদের নন। সালাফী/ওহাবীদের বিপরীতে সুন্নী আক্বীদা-বিশ্বাস হচ্ছে পুণ্যাত্মাবৃন্দের যাত/সত্তা মোবারক-ই অসীলা। আল্লাহ বলেন তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম’কে জগতের জন্যে রহমত করে পাঠিয়েছেন (আল-আয়াত)। এই প্রেরণের পরিকল্পনা তো আমলের আগে নেয়া হয়েছিলো! মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম ফরমান, “কেউই তার আমলের জন্যে নাজাত/পরিত্রাণ পাবে না।” তাঁর ক্ষেত্রেও কি একই ব্যাপার হবে মর্মে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “হ্যাঁ, আমার ক্ষেত্রেও তাই হবে; আমি আমার প্রভুর রহমত/করুণা দ্বারা নাজাত পাবো (আল-হাদীস)।” বলা বাহুল্য যে, তাঁর যাত মোবারক-ই খোদায়ী করুণা! অন্যান্য পুণ্যাত্মাবৃন্দের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম, কেননা তাঁরা তাঁরই ওয়ারিস/উত্তরাধিকারী হিসেবে ওই গুণের হিস্যা পেয়েছেন]। অতএব, কেউ যদি প্রার্থনাকালে বলেন, ‘হে আল্লাহ! আমি অমুক আলেমের মধ্যস্থতায় আপনার দরবারে তাওয়াসসুল পালন করছি,’ তাহলে এটা ওই আলেমের কাছে নিহিত জ্ঞানকেই বিবেচনা করা হবে। সহীহাইন তথা বুখারী ও মুসলিম এবং অন্যান্য গ্রন্থে লিপিবদ্ধ একটি হাদীসে বিবৃত হয়:

و قد ثبت في الصحيحين وغيرهما أن النبي صلى الله عليه وسلم حكى عن الثلثة الذين انطبقت عليهم الصخرة أن كل واحد منهم توسل إلى الله بأعظم عمل عمله فارتفعت الصخرة 

অর্থাৎ, প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) তিনজন (পূর্ববর্তী যুগের) পুণ্যাত্মা সম্পর্কে জানিয়েছিলেন যাঁরা একটি গুহায় পাথর দ্বারা আটকা পড়েছিলেন। তাঁদের প্রত্যেকে নিজ নিজ সেরা আমলের দোহাই দিয়ে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করলে গুহার মুখ হতে পাথরটি সরে যায়।

নেক আমলের দোহাই দিয়ে তাওয়াসসুল পালন যদি অবৈধ বা শির্ক হতো, যেমনটি দাবি করেছিলেন আবদুস সালামের মতো কট্টরপন্থীরা এবং তাঁরই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণকারীরা, তাহলে ওই গুহায় আটকে পড়া পুণ্যাত্মাদের দুআ’ ক্ববূল হতো না এবং প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-ও তাঁদের ওই ঘটনা বর্ণনার পরে তাঁদেরকে সমালোচনা না করে নিশ্চুপ থাকতেন না। এর দ্বারা আপনি জানতে পারেন যে, আম্বিয়া (আলাইহিমুস্ সালাম) ও সুলাহা’ (রহমতুল্লাহে আলাইহিম)’র তাওয়াসসুলের প্রতি বিরোধিতাকারীদের উদ্ধৃত দলিলাদি অপ্রাসঙ্গিক; যেমনটি হচ্ছে আল্লাহতা’লার পাক কালাম:

 مَا نَعْبُدُهُمْ إِلاَّ لِيُقَرِّبُونَآ إِلَى ٱللهِ زُلْفَىۤ 

অর্থ: ‘আমরা তো তাদেরকে শুধু এতোটুকু কথার জন্যে পূজা করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর সান্নিধ্যে এনে দেবে’ [সূরা যুমার, ৩ আয়াত; নূরুল এরফান]। আরেকটি ঐশীবাণী:

  فَلاَ تَدْعُواْ مَعَ ٱللهِ أَحَداً

অর্থ: সুতরাং আল্লাহর সাথে অন্য কারো এবাদত করবে না [সূরা জ্বিন, ১৮ আয়াত]। আরেকটি আয়াতে করীমা:

 لَهُ دَعْوَةُ ٱلْحَقِّ وَٱلَّذِينَ يَدْعُونَ مِن دُونِهِ لاَ يَسْتَجِيبُونَ لَهُم بِشَيْءٍ

অর্থ: তাঁরই আহ্বান (তথা এবাদত) সত্য; এবং তিনি ছাড়া যাদেরকে তারা আহ্বান/এবাদত-বন্দেগী করে, সেগুলো তাদের (প্রার্থনার) কিছুই শুনে না [সূরা রা’দ, ১৪ আয়াত]।

ওপরে উদ্ধৃত আয়াতগুলো আলোচ্য বিষয়টির ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক; আর এগুলোকে দলিল হিসেবে ব্যবহার করা হয় এমন কিছু ক্ষেত্রে যা বিতর্কের বিষয়বস্তুর সাথে মোটেও সংশ্লিষ্ট নয়।  مَا نَعْبُدُهُمْ إِلاَّ لِيُقَرِّبُونَآ إِلَى ٱللهِ زُلْفَىۤ  – “আমরা তো তাদেরকে শুধু এতোটুকু কথার জন্যে পূজা করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর সান্নিধ্যে এনে দেবে” মর্মে সূরা যুমারের ৩ নং আয়াতটি স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে যে, তারা (মক্কার কুফফার) মূর্তিগুলোকে পূজা করতো ওই উদ্দেশ্যেই। অথচ যে ব্যক্তি, দৃষ্টান্তস্বরূপ, কোনো আলেমে (হক্কানী/রব্বানী)’র মাধ্যমে তাওয়াসসুল পালন করেন, তিনি তো তাঁর পূজা-অর্চনা করেন না; বরঞ্চ তিনি জানেন ওই আলেমে (হক্কানী) আপন জ্ঞান-প্রজ্ঞার ধারক-বাহক হওয়ার দরুন আল্লাহর দরবারে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী, আর সে কারণেই তিনি তাঁর তাওয়াসসুল পালন করেন। একইভাবে, আলোচ্য বিষয়টির সাথে অপ্রাসঙ্গিক হলো আল্লাহতা’লার পাক কালা’ম:  فَلاَ تَدْعُواْ مَعَ ٱللهِ أَحَداً – অর্থ: সুতরাং আল্লাহর সাথে অন্য কারো এবাদত করবে না [সূরা জ্বিন, ১৮ আয়াত]। এই আয়াতটি আল্লাহর পাশাপাশি অন্য কোনো উপাস্যের প্রতি আহ্বান (তথা পূজা) করার বিষয়টি নিষেধ করে। যেমন এ কথা বলা, “হে আল্লাহ এবং অমুক/তমুক।” কিন্তু যে ব্যক্তি কোনো আলেমে (হক্কানী/রব্বানী)’র তাওয়াসসুল পালন করেন, তিনি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে এ ধরনের আহ্বান জানান না। তিনি কেবল আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্যে অসীলার তালাশ করেন ওই পুণ্যবান বান্দার মহৎ কাজ তথা অর্জনের মধ্যস্থতায়, ঠিক যেমনটি গুহায় আটক ওই তিনজন পুণ্যাত্মা নিজেদের নেক আমলের দোহাই দিয়ে দুআ ক্ববূল করাতে পেরেছিলেন। 

আলোচ্য বিষয়ের সাথে অনুরূপ অপ্রাসঙ্গিক দলিল হলো আল্লাহতা’লার পাক কালাম: وَٱلَّذِينَ يَدْعُونَ مِن دُونِهِ – “ তিনি ছাড়া যাদের তারা আহ্বান/এবাদত-বন্দেগী করে..” [সূরা রা’আদ, ১৪ আয়াত]। কেননা এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ওইসব লোক (মক্কার কুফফার), যারা মূর্তিগুলোকে আহ্বান/পূজা করে অথচ সেগুলোর ক্ষমতা নেই প্রার্থনা মঞ্জুর করার; পক্ষান্তরে, তারা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে না যিনি তা মঞ্জুর করতে সক্ষম। কিন্তু যে ব্যক্তি কোনো আলেমে (হক্কানী/রব্বানী)’র তাওয়াসসুল পালন করেন, তিনি আল্লাহ ছাড়া আর কারো পূজা করেন না; তাঁর সাথে কাউকে শরীকও করেন না।

ওপরে উদ্ধৃত দৃষ্টান্তগুলো পাঠকের সামনে এটা স্পষ্ট করে যে, তাওয়াসসুলের প্রতি যারা আপত্তি উত্থাপন করেন তারা বিতর্কের বিষয়বস্তুর সাথে অপ্রাসঙ্গিক দালিলিক প্রমাণাদি উপস্থাপন করে থাকেন। এর চেয়েও অপ্রাসঙ্গিক হলো তাদের দ্বারা নিম্নোক্ত কালা’মুল্লাহ শরীফের উদ্ধৃতি: يَوْمَ لاَ تَمْلِكُ نَفْسٌ لِنَفْسٍ شَيْئاً وَٱلأَمْرُ يَوْمَئِذٍ لِلهِ – অর্থ: যেদিন কোনো আত্মা অপর কোনো আত্মার ওপর কোনো অধিকারই রাখবে না এবং সেদিন সমস্ত হুকুম আল্লাহরই হবে” [সূরা ইনফিতোয়া’র, ১৯ আয়াত]। এই আয়াতে করীমায় স্রেফ এ বাস্তবতা বিবৃত হয়েছে যে শেষ বিচার দিবসে শুধু আল্লাহ-ই সমস্ত সিদ্ধান্ত দেবেন; আর সে দিন অন্য কেউই হুকুম দেবেন না। কিন্তু যে ব্যক্তি কোনো পয়গম্বর (আলাইহিস্ সালাম) অথবা আলেমে (হক্কানী/রব্বানী)’র তাওয়াসসুল পালন করেন, তিনি তো এ কথা বিশ্বাস করেন না যে মধ্যস্থতাকারী পুণ্যাত্মা শেষ বিচার দিবসে আল্লাহর শরীকদার হবেন! কেউ কোনো পয়গম্বর বা অ-পয়গম্বর সম্পর্কে ওরকম বিশ্বাস অন্তরে পোষণ করে থাকলে সে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে পতিত বলে সাব্যস্ত হবে।  

একই রকম অপ্রাসঙ্গিক হলো তাওয়াসসুলের প্রতি তাদের (বিরোধীদের) আপত্তির সমর্থনে নিচের দুটো আয়াতে করীমা পেশ। প্রথমটি: 

لَيْسَ لَكَ مِنَ ٱلأَمْرِ شَيْءٌ

অর্থ: এ বিষয় (তথা সিদ্ধান্ত) আপনার হাতে নয়। [সুরা আলে ইমরান, ১২৮] এবং অপরটি:

 قُل لاَّ أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعاً وَلاَ ضَرّاً

অর্থ: (হে রাসূল) আপনি বলুন, আমি আমার নিজের ভালো-মন্দের মধ্যে খোদ-মুখতার নই। [সূরা আ’রাফ, ১৮৮]

এই দুটো আয়াতে স্পষ্ট ব্যক্ত হয় যে, আল্লাহতা’লার সিদ্ধান্তে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) খোদ-মুখতার নন এবং অন্যরা পরে, তাঁর নিজের উপকার বা ক্ষতি সাধনের ক্ষেত্রেও তিনি খোদ-মুখতার নন। কিন্তু এই দুটো আয়াতে এমন কিছু নেই, যা তাঁর মাধ্যমে অথবা অন্যান্য আম্বিয়া (আলাইহিমুস সালাম), আউলিয়া (রহমতুল্লাহে আলাইহিম) ও (হক্কানী/রব্বানী) উলামা (রহমতুল্লাহে আলাইহিম)’র মধ্যস্থতায় তাওয়াসসুলকে রহিত করে। 

আল্লাহতা’লা তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’কে المقام المحمود (মাক্বামে মাহমূদ/সর্বোচ্চ মর্যাদা), الشفاعة العظمى (শাফাআতে উযমা’/সুপারিশের সর্বোচ্চ মর্যাদা) দান করেছেন এবং তিনি সৃষ্টিকুলকে (দুআ’র মধ্যে) প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র জন্যে ওই মাক্বাম চাইতে নির্দেশ দিয়েছেন; আর তাঁর সুপারিশও প্রার্থনা করতে বলেছেন। আল্লাহ পাক মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলােইহে ওয়া সাল্লাম)’কে বলেন:

سل تعطه واشفع تشفع   

অর্থ: প্রার্থনা করুন, আপনার প্রার্থনা মঞ্জুর করা হবে; সুপারিশ করুন, সুপারিশ গৃহীত হবে! 

পবিত্র ঐশীগ্রন্থ আল-ক্বুরআনে আল্লাহতা’লা এই বিষয়টিকে এ বাস্তবতার ওপর নির্ভরশীল করেছেন যে, তাঁর অনুমতি ছাড়া কোনো সুপারিশ নেই; আর তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন যাঁরা করেছেন, তাঁরা ছাড়া কেউই তার অধিকারী হবে না।

তাওয়াসসুলের বিরোধিতাকারীদের দ্বারা উপস্থাপিত একই ধরনের অপ্রাসঙ্গিক দলিল হচ্ছে নিচের আয়াতটি: 

 وَأَنذِرْ عَشِيرَتَكَ ٱلأَقْرَبِينَ  

অর্থ: এবং হে মাহবূব! আপন নিকটাত্মীয়বর্গকে সতর্ক করুন। [সূরা শু’আরা, ২১৪ আয়াত]

এমতাবস্থায় প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) ফরমান:

يا فلان بن فلن لا أملك لك من الله شئاً، يا فلان بنت فلان لا أملك لك من الله شئاً 

অর্থ: ওহে অমুকের পুত্র তমুক! আমি আল্লাহর সামনে তোমার উপকার/ফায়দার ব্যাপারে খোদ-মুখতার নই; ওহে অমুকের কন্যা তমুক! আমি আল্লাহর সামনে তোমার উপকার/ফায়দার ব্যাপারে খোদ-মুখতার নই।

ওপরের এ বর্ণনায় স্রেফ এই সহজ ঘোষণা ছাড়া অন্য কিছু নিহিত নেই যে, তিনি এমন ব্যক্তির জন্যে উপকার/ফায়দা আনবেন না যার জন্যে আল্লাহতা’লা ক্ষতি বিধান করে রেখেছেন; আর এমন ব্যক্তির জন্যেও ক্ষতিসাধন করবেন না যার জন্যে আল্লাহতা’লা উপকার বিধান করে রেখেছেন। আর তাঁর নিকটাত্মীয়দের জন্যেও আল্লাহর পক্ষ থেকে তিনি কোনো ফযল/গ্যারান্টী দেবেন না, যেমনিভাবে অন্যদের জন্যেও নয়। এটা সমস্ত মুসলমানেরই জানা। তবে এতে এমন কিছু নিহিত নেই যা প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র মধ্যস্থতায় আল্লাহর কাছে তাওয়াসসুল পালনের প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কেননা তাওয়াসসুল হচ্ছে একটি আরজি ওই মহান ক্ষমতাধর সত্তা (আল্লাহ)’র বরাবর, যিনি সমস্ত আরজি মঞ্জুর বা প্রত্যাখ্যানের সর্বময় ক্ষমতা সংরক্ষণ করেন। তাওয়াসসুল পালনকারী নিবেদক তাঁর আরজির সম্মুখে এমন কিছু পেশ করার আকাঙ্ক্ষী যা হয়তো মঞ্জুর বা মানা’ করার একক ক্ষমতাবান পবিত্র সত্তার দরবারে তাঁর আরজিটি গৃহীত হবার সাবাব তথা কারণ হতে পারে; আর ওই পবিত্র সত্তা শেষ বিচার দিবসের (একমাত্র) মালিক। [শওকানীর বক্তব্য এখানে শেষ হলো]   

মুহাম্মদ ইবনে আব্দিল ওয়াহহাব তাওয়াসসুলের অনুমতি দেন

মুহাম্মদ ইবনে আব্দিল ওয়াহহাব নজদী সাহেবকে ‘এসতেসক্বা’ (الاستسقاء) তথা বৃষ্টির জন্যে প্রার্থনাবিষয়ক ফিক্বাহবিদমণ্ডলীর একটি বক্তব্য সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়, যা’তে তাঁরা বলেছিলেন: 

لا بأس بالتوسل بالصالحين

অর্থ: “পুণ্যাত্মাবৃন্দের মধ্যস্থতায় তাওয়াসসুল পালনে কোনো সমস্যা নেই।” উপরন্তু, ইমাম আহমদ (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’এর একটি বাণী বিবৃত করে: 

يتوسل بالنبي صلى الله عليه وسلم خاصة 

অর্থ: “তাওয়াসসুল প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র জন্যে খাস তথা সুনির্দিষ্ট।” এমতাবস্থায় إنه لا يستغاث بمخلوق – “সৃষ্টিকুলের কাছে সাহায্য প্রার্থনা নিষেধ” মর্মে ফক্বিহমণ্ডলীর বক্তব্যের সাথে ওই দুটো বাণীকে কীভাবে সমন্বয় করা যায়?

শায়খ নজদী উত্তর দেন: 

فقال: فالفرق ظاهر جدًا ، وليس الكلام مما نحن فيه ، فكون بعض يرخص بالتوسل بالصالحين ، وبعضهم يخصه بالنبي صلى الله عليه وسلم ، وأكثر العلماء ينهى عن ذلك ويكرهه ، فهذه المسألة من مسائل الفقه ، وإن كان الصواب عندنا قول الجمهور من أنه مكروه ، فلا ننكر على من فعله ، ولا إنكار في مسائل الاجتهاد ، ولكن إنكارنا على من دعا لمخلوق أعظم مما يدعو الله تعالى ويقصد القبر يتضرع  عند ضريح الشيخ عبد القادر أو غيره يطلب فيه تفريج الكربات وإغاثة اللهفات وإعطاء الرغبات ، فأين هذا ممن يدعو الله مخلصاً له الدين لا يدعو مع الله أحدًا ولكن يقول في دعائه : أسألك بنبيك أو بالمرسلين أو بعبادك الصالحين، أو يقصد قبرًا معروفاً أو غيره يدعو عنده ، لكن لا يدعو إلا الله مخلصاً له الدين فأين هذا مما نحن فيه 

অর্থ: (এই দুটোর মধ্যে) পার্থক্য একদম স্পষ্ট এবং আমরা যা বলছি তার সাথে এর কোনো সম্পর্কই নেই। কেউ কেউ পুণ্যাত্মাবৃন্দের মধ্যস্থতায় তাওয়াসসুল পালনের পক্ষে রায় দেন, আর কেউ কেউ প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র মাধ্যমে তাওয়াসসুলের পক্ষে বলেন। (তবে) অধিকাংশ উলামা এটাকে নিষেধ করেন এবং মকরুহ/অপছন্দনীয় হিসেবে দেখেন। এই বিষয়টি অবশ্য ফেক্বাহ-শাস্ত্রসংশ্লিষ্ট, যদিও আমাদের দৃষ্টিতে সঠিক সিদ্ধান্ত হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ উলামার দৃষ্টিভঙ্গি। এটা যেহেতু মকরূহ, সেহেতু আমরা তাওয়াসসুল পালনকারীদের নিষেধ করি না। কেননা এজতেহাদ তথা গবেষণামূলক বিষয়াদিতে নিষেধাজ্ঞা নেই। 

কিন্তু আমাদের নিষেধাজ্ঞা ওই ব্যক্তির প্রতি, যে আল্লাহর কাছে প্রার্থনার চেয়ে সৃষ্টিকৃলের প্রতি প্রার্থনাকে প্রাধান্য দেয় বেশি; আর (গাউসুল আযম বড় পীর) হযরত শায়খ আবদুল ক্বাদের জিলানী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) বা অন্যান্য মাশায়েখবৃন্দের মাযারে গিয়ে নিজেকে সমর্পণ করে এবং অসুবিধা দূর করার, কিংবা বিপদ হতে রক্ষা পাওয়ার, অথবা আপন মনোবাঞ্ছা পূরণের আবেদন-নিবেদন জানায়। এমতাবস্থায় এই ব্যক্তির সাথে সেই মানুষটির তুলনা হয় কীভাবে, যিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন, তাঁরই (প্রেরিত) দ্বীনের প্রতি আন্তরিক ও একনিষ্ঠ থাকেন এবং আল্লাহর সাথে অন্য কারো এবাদত করেন না, অথচ পাশাপাশি প্রার্থনাকালে বলেন: “আমি আপনার কাছে কামনা করি আপনারই নবী (দ:)’র অসীলায়,” অথবা “আম্বিয়া (আ:)-মণ্ডলীর কিংবা  “পুণ্যাত্মাবৃন্দের (রহ:) অসীলায়;” অথবা যিনি কোনো প্রসিদ্ধ (বুযর্গের) মাযারে বা অন্য কোথাও গিয়ে তাওয়াসসুল পালনকালে দ্বীনের প্রতি আন্তরিক হয়ে আল্লা্হ ছাড়া অন্য কারো এবাদত করেন না? সেটা কীভাবে আমাদের আলোচিত বিষয়ের সাথে তুলনীয় হতে পারে (মানে মিশ্রিত হতে পারে)? [মুহাম্মদ ইবনে আবদিল ওয়াহহাব নজদী সাহেবের ফতোয়া, যা মুহাম্মদ বিন সৌদ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক মুহাম্মদ ইবনে আবদিল ওয়াহহাব সপ্তাহ পালনকালে প্রকাশিত ‘মজমুয়া’ আল-মু’আল্লাফা’ত’ শীর্ষক পুস্তকে সংকলিত হয়েছিলো]

শায়খ নজদীর ওপরে প্রদত্ত মতানুসারে তাওয়াসসুল জায়েয/বৈধ প্রমাণিত হয়। এখানে যতোটুকু বলা চলে তা হলো, তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী অধিকাংশ উলামার দৃষ্টিতে এটা মকরূহ/অপছন্দনীয়। والمكروه ليس بحرام فضلاً عن أن يكون بدعة أو شركاً – (কিন্তু আমি বলি), মকরূহ তো হারাম/অবৈধ নয়, যা বেদআত/মন্দ প্রচলন বা শির্ক/অংশীবাদের চেয়েও অনেক লঘুতর (বিষয়)। [বঙ্গানুবাদকের নোট: শায়খ নজদী চরম মিথ্যুক। তাওয়াসসুল সংখ্যাগরিষ্ঠ উলামার দৃষ্টিতে বৈধ ও প্রশংসনীয় কাজ। আমার অনূদিত ‘ওহাবীদের প্রতি নসীহত’ বইটি দেখুন]

ইবনে আবদিল ওয়াহহাব কর্তৃক তাওয়াসসুল পালনকারীদের প্রতি কুফরীর দোষারোপকারীদের অস্বীকৃতিমূলক ঘোষণা

শায়খ মুহাম্মদ ইবনে আব্দীল ওয়াহহাব নজদী সাহেব ক্বাসীম এলাকার জনগণকে লেখা একটি পত্রে সেসব ব্যক্তির তীব্র সমালোচনা করেন, যাঁরা পুণ্যাত্মাদের তাওয়াসসুল/অসীলা পালনকারী মুসলমানদেরকে তাকফির তথা কাফির/অবিশ্বাসী ঘোষণার দোষ তাঁর প্রতি আরোপ করেছিলেন। তিনি (তাতে) বলেন: 

إن سليمان بن سحيم افترى عليَّ أموراً لم أقلها، ولم يأت أكثرها على بالي، فمنها: أني أكفر من توسل بالصالحين، وأني أكفر البوصيري لقوله: يا أكرم الخلق، وأني أحرق دلائل الخيرات. وجوابي عن هذه المسائل: أني أقول سُبْحَانَكَ هَـٰذَا بُهْتَانٌ عَظِيمٌ

“শায়খ সোলায়মান  ইবনে সুহায়ম আমার বিরুদ্ধে বানোয়াট কথা বলেছেন যা আমি বলিনি, এবং যার অধিকাংশই আমার চিন্তাতেও আসেনি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে (এই অভিযোগ যে), আমি নাকি পুণ্যাত্মাবৃন্দের তাওয়াসসুল পালনকারী মুসলমানদেরকে কাফির ফতোয়া দিয়েছি; ইমাম বুসীরী (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’কেও তাঁর ‘হে সৃষ্টিকুলশ্রেষ্ঠ (প্রিয়নবী)’ কথাটির জন্যে কাফির অভিহিত করেছি এবং তাঁর ‘দালায়েল আল-খায়রাত’ কাব্যগ্রন্থটি পুড়িয়েছি। এই বিষয়ে আমার জবাব হলো (আল্লাহর কালাম): হে আল্লাহ! আপনারই পবিত্রতা! এ তো গুরুতর অপবাদ [সূরা নূর, ১৬ আয়াত]!”

শায়খ নজদীর এ কথার সমর্থনে তাঁর আরেকটি বক্তব্য পাওয়া যায় অপর এক প্রবন্ধে, যা তিনি আল-মজমা’আ অঞ্চলের মানুষের কাছে পাঠিয়েছিলেন; তাতে তিনি বলেন: 

 إذا تبين هذا فالمسائل التي شنع بها، منها ما هو من البهتان الظاهر، وهو قوله:  أني أكفر من توسل بالصالحين، وأني أكفر البوصيري إلى آخر ما قال، ثم قال:  وجوابي فيها أن أقول سبحانك هذا بهتان عظيم   

“এটা স্পষ্ট হলে, এসব বিষয় যেগুলোর জন্যে তিনি (শায়খ সোলায়মান) আমাদেরকে তীব্র ভর্ৎসনা করেছেন, সেগুলোর কিছু কিছু পরিষ্কার অপবাদ; যেমন – তিনি বলেছেন আমি নাকি পুণ্যাত্মাদের তাওয়াসসুল পালনকারী মুসলমানদের প্রতি কুফরের ফতোয়া দিয়েছি; ইমাম বুসীরী (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’এর প্রতিও কুফরের ফতোয়া দিয়েছি…।” অতঃপর শায়খ নজদী বলেন: “এর প্রতি আমার জবাব হলো (আল্লাহর কালাম): হে আল্লাহ! আপনারই পবিত্রতা! এ তো গুরুতর অপবাদ [সূরা নূর, ১৬ আয়াত]।” (’রাসা’য়েল আল-শায়খ মুহাম্মদ বিন আবদীল ওয়াহহাব’, ১ ও ১১ নং প্রবন্ধ, ৫:১২ ও ৬৪ দ্রষ্টব্য) [বঙ্গানুবাদকের নোট: শায়খ নজদীর এ আত্মপক্ষ সমর্থনের অপচেষ্টা ধোকাবাজি ছাড়া কিছু নয়। তিনি ‘কাশফুশ শুবহাত’ শিরোনামে লিখিত তাঁর পুস্তিকায় ওই উগ্র মতবাদ ব্যক্ত করেছেন, যার খণ্ডন আমি করেছি আমারই ‘ওহাবীদের সংশয় নিরসন’ শীর্ষক পুস্তকে। শায়খ মুহাম্মদ আলাউয়ী মালেকী আল-হাসানী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) সৌদি আরবের নাগরিক হওয়ায় সরাসরি রাষ্ট্রীয় নীতির বিরোধিতা করতে পারেননি।] 

মহানবী (দ:)-এর ব্যক্তিগত পবিত্র স্মৃতিচিহ্নগুলোর তাওয়াসসুল 

এ বিষয়টি সাবেত তথা প্রতিষ্ঠিত যে, আসহাব-এ-কেরাম (رضي الله عنهم) প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর রেখে যাওয়া (ব্যক্তিগত) স্মৃতিচিহ্নগুলো হতে বরকত আদায় করতেন। বরকত আদায়ের বা আশীর্বাদ লাভের এই তালাশ একটি অর্থই বহন করে, আর তা হচ্ছে তাঁরই (ব্যক্তিগত) স্মৃতিচিহ্নগুলোর মাধ্যমে আল্লাহতা’লার সান্নিধ্যের উদ্দেশ্যে তাওয়াসসুল পালন। 

এটা এ কারণে যে, তাওয়াসসুল বহু উপায়ে হয়ে থাকে এবং সেটা কেবল একটা (পন্থা) নয়। তারা (মানুষ) যে তাঁর (দ:) ব্যক্তিগত স্মৃতিচিহ্নগুলোর দ্বারা তাওয়াসসুল পালন করেন অথচ তাঁরই মধ্যস্থতায় তা পালন করেন না, আপনারা কি সেটাকেই (একমাত্র) সাধ্য বলে মনে করেন? শাখার (তথা তাঁর স্মৃতিচিহ্নের) মাধ্যমে তাওয়াসসুল পালন ও শেকড়ের (তথা তাঁরই সত্তা মোবারকের) মাধ্যমে তা পালন না করা কি (কখনোই) সঠিক হতে পারে? ওই রেখে যাওয়া স্মৃতিচিহ্ন যার (আপনা হতে) নেই কোনো মহত্ত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব, কিংবা সম্মান, স্রেফ সেটার মালিক/অধিকারী প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর খাতির ব্যতিরেকে; এমতাবস্থায় কেউ যদি এসে “রাসূল (দ:)’এর মধ্যস্থতায় তাওয়াসসুল পালন জায়েয নেই” – এ কথা বলে, তাহলে কি তা সঠিক হতে পারে? –  سبحانك هذا بهتان عظيم – হে আল্লাহ! আপনারই পবিত্রতা! এ তো গুরুতর অপবাদ [সূরা নূর, ১৬ আয়াত]!

তাওয়াসসুলের সমর্থনে উদ্ধৃত এতদসংক্রান্ত মৌলিক নস/প্রামাণ্য দলিল অজস্র। আমরা এখানে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ঘটনাটির দিকে আলোকপাত করবো। ঈমানদারবৃন্দের আমীর তথা আদেশকর্তা হযরত উমর ফারূক্ব (رضي الله عنه)’এর শাহাদাৎ আসন্ন হলে তিনি প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর (রওযার) পাশে দাফন হবার প্রবল আগ্রহ নিয়ে তাঁর পুত্র হযরত আবদুল্লাহ (رضي الله عنه)’কে হযরত মা আয়েশাহ (رضي الله عنها)’এর কাছে অনুমতি চাইতে প্রেরণ করেন। এ কথা শুনে তিনি ঘোষণা করেন যে, ওই স্থানটি তিনি নিজের জন্যে চেয়েছিলেন – فتقول كنت أريده لنفسي ولأوثرنه على نفسي – অতঃপর তিনি বলেন, “আমি নিজের জন্যে এটা চেয়েছিলাম; আর আমার চেয়ে তাঁকে (হযরত উমরকে) আমি প্রাধান্য দেবো।” হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (رضي الله عنه) তাঁর পিতার কাছে এই মহা খোশ-খবরী পৌঁছে দিতে যান, যার পরিপ্রেক্ষিতে হযরত উমর (رضي الله عنه) বলেন –  الحمد لله ما كان شيء أهم إليَّ نم ذلك – “সমস্ত প্রশংসা আল্লাহতা’লার! আমার কাছে এর চেয়ে আর কিছুই বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না।” এই ঘটনার বিস্তারিত জানার জন্যে আল-বুখারী (সংকলন) দেখুন।

সর্ব-হযরত উমর ও আয়েশাহ (رضي الله عنهما) হতে এই আগ্রহের কী মানে ছিলো? প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর কাছে দাফন হওয়াটা হযরত উমর ফারূক্ব (رضي الله عنه)’এর দৃষ্টিতে এতো পছন্দনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কেন ছিলো? এর কোনো ব্যাখ্যা-ই নেই, স্রেফ এ কথা বলা ছাড়া যে রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)’এর বেসাল শরীফের পরে তাঁর ঘনিষ্ঠতা দ্বারা তাঁরই বরকত লাভের অন্বেষণে তাঁর তাওয়াসসুল পালন করা ছিলো এর (একমাত্র) উদ্দেশ্য। 

হযরত উম্মে সুলায়ম (رضي الله عنها)’এর কথাই ধরুন, যিনি রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) যে জলপাত্র হতে পানি পান করতেন তার মুখটি কেটে রেখেছিলেন। হযরত আনাস (رضي الله عنه) বলেন – يقول أنس فهو عندنا – “এটা এখন আমাদের সাথে আছে।” সাহাবাবৃন্দ (رضي الله عنهم) একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করতেন হুজূর (صلى الله عليه وسلم)’এর পবিত্র শির হতে একটি চুল মোবারক নেয়ার উদ্দেশ্যে, যখন-ই তিনি তা কাটতেন। হযরত আসমা’ বিনতে আবী বকর (رضي الله عنها)’এর কথাই ধরুন, যিনি প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর জুব্বা শরীফ সংরক্ষণ করেছিলেন এবং বলেছিলেন – وتقول: فنحن نغسلها للمرضى نستشفي بها – “আমাদের অসুস্থদের ফায়দার জন্যে আমরা এটাকে ধুয়ে থাকি এবং এটার মাধ্যমে আরোগ্য অন্বেষণ করি।” প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর আংটির কথাই ধরুন; সেটা পাহারা দিয়ে রেখেছিলেন (একে একে) সর্ব-হযরত আবূ বকর, উমর ও উসমান (رضي الله عنهم) – যতোক্ষণ না সেটা হযরত উসমান (رضي الله عنه)’এর কাছ থেকে কুয়োতে পড়ে গিয়েছিলো।

এসব হাদীস সাবেত/প্রতিষ্ঠিত ও সহীহ/বিশুদ্ধ, যা আমরা বরকত-আশীর্বাদ অন্বেষণের বিষয়টির জন্যে নির্ধারিত অধ্যায়ে উল্লেখ করবো (ইন-শা-আল্লাহ)। এখানে আমরা প্রশ্ন করতে ইচ্ছুক: তাঁরা (رضي الله تعالى عنهم) কেন প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর ব্যক্তিগত স্মৃতিচিহ্ন – জলপাত্রের মুখ, চুল, ঘাম, জুব্বা, আংটি, নামাযের স্থান ইত্যাদিকে পাহারা দিতে/সংরক্ষণে এতোখানি যত্নবান হয়েছিলেন?? এর পেছনে তাঁদের উদ্দেশ্য কী ছিলো? এটা কি কেবল আবেগময় স্মৃতিচারণ? নাকি ওই সব ব্যক্তিগত স্মৃতিচিহ্ন পাহারা দেয়া, যাতে সেগুলোকে জাদুঘরে স্থাপন করা যায়? উত্তর যদি হয় পূর্ববর্তীটি, তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে তাঁরা বিপদগ্রস্ত বা রোগে আক্রান্ত হওয়ার সময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনার মধ্যে সেগুলোকে কেন এতোখানি যত্নসহ মাধ্যম হিসেবে নিয়েছিলেন? উত্তর যদি হয় পরবর্তীটি, তাহলে ওই জাদুঘরটি কোথায় ছিলো এবং এই বেদআতী/নতুন উদ্ভাবিত ধারণাটি এলো কোত্থেকে? – سبحانك هذا بهتان عظيم – হে আল্লাহ! আপনারই পবিত্রতা! এ তো গুরুতর অপবাদ [সূরা নূর, ১৬ আয়াত]! এর কোনো উত্তরই নেই শুধু এ কথা বলা ছাড়া যে, প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর ব্যক্তিগত স্মৃতিচিহ্ন দ্বারা বরকত-আশীর্বাদ অন্বেষণ-ই ছিলো (একমাত্র) উদ্দেশ্য, যাতে আল্লাহর কাছে দুআ’য় সেগুলোর মাধ্যমে তাওয়াসসুল পালন করা যায়। কেননা আল্লাহ হলেন দাতা এবং তাঁর কাছেই চাওয়া হয়ে থাকে। সবাই তাঁর বান্দা এবং তাঁরই আজ্ঞার অধীন। আল্লাহর অনুমতি ব্যতিরেকে কেউই নিজ হতে (মানে স্বকীয়ভাবে) কোনো কিছুর অধিকারী নন, অন্যদের ব্যাপার তো দূরে।

আম্বিয়া (আ:)-বৃন্দের ব্যক্তিগত পবিত্র স্মৃতিচিহ্নগুলোর তাওয়াসসুল

মহাসম্মানিত আল্লাহতা’লা বলেন: 

وَقَالَ لَهُمْ نِبِيُّهُمْ إِنَّ آيَةَ مُلْكِهِ أَن يَأْتِيَكُمُ ٱلتَّابُوتُ فِيهِ سَكِينَةٌ مِّن رَّبِّكُمْ وَبَقِيَّةٌ مِّمَّا تَرَكَ آلُ مُوسَىٰ وَآلُ هَارُونَ تَحْمِلُهُ ٱلْمَلاۤئِكَةُ إِنَّ فِي ذَلِكَ لآيَةً لَّكُمْ إِن كُنْتُم مُّؤْمِنِينَ

অর্থ: এবং তাদেরকে তাদের নবী বল্লেন, ‘তার বাদশাহীর নিদর্শন এই যে, তোমাদের কাছে তাবূত আসবে, যার মধ্যে তোমাদের রব্বের পক্ষ থেকে চিত্ত-প্রশান্তি রয়েছে এবং অবশিষ্ট বস্তু – সম্মানিত মূসা ও সম্মানিত হারূনের পরিত্যক্ত; সেটাকে ফেরেশতাবর্গ বহন করে আনবে। নিঃসন্দেহে এর মধ্যে মহান নিদর্শন রয়েছে তোমাদের জন্যে , যদি ঈমান রাখো। [আল-ক্বুরআন, ২:২৪৮; নূরুল এরফান]

হাফেয ইবনে কাসীর নিজ ‘তারীখ’ (ইতিহাস)-গ্রন্থে লেখেন: 

قال الحافظ ابن كثير في التاريخ :  قال ابن جرير عن هذا التابوت : وكانوا إذا قاتلوا أحداً من الأعداء يكون معهم تابوت الميثاق الذي كان في قبة الزمان كما تقدم ذكره ، فكانوا ينصرون ببركته وبما جعل الله فيه من السكينة والبقية مما ترك آل موسى وآل هارون ، فلما كان في بعض حروبهم مع أهل غزة وعسقلان غلبوهم وقهروهم على أخذه فانتزعوه من أيديهم اهــ.

অর্থ: ইমাম ইবনে জারীর তাবারী (رحمة الله عليه) ওই তাবূত (বাক্স) সম্পর্কে বলেন, “তারা কখনো কোনো শত্রুর সাথে লড়াই করার সময় তাদের কাছে ‘তাবূতে মীসা’ক্ব’ থাকতো, যা ওই ‘ক্বুব্বা আল-যামা’ন’-এর ভেতরে ছিলো, যেমনটি ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। তারা বিজয়ী হতো এর বরকত-আশীর্বাদ ও প্রশান্তির সুবাদে, যা আল্লাহ তাতে নিহিত রেখেছিলেন এবং (আরো) নিহিত রেখেছিলেন (সর্ব-পয়গম্বর) মূসা ও হারূন (عليهما السلام)’এর নিজ নিজ উম্মতের রেখে যাওয়া স্মৃতিচিহ্ন। একবার গাযা ও আশকালন অঞ্চলের লোকদের সাথে যুদ্ধে তারা হেরে যায় এবং তাদের শত্রু পক্ষ তাদের কাছ থেকে তা দখল করে নেয়।” 

ইবনে কাসীর আরো বলেন: 

وقد كانوا ينصرون على أعدائهم بسببه ، وكان فيه طست من ذهب كان يغسل فيه صدور الأنبياء اهــ (البداية ج٢ ص٨)

অর্থ: “তারা শত্রুদের ওপর বিজয় লাভ করতো এটার কারণে। এতে ছিলো একটি স্বর্ণের পাত্র, যা ব্যবহৃত হতো আম্বিয়া (عليهم السلام)’এর বক্ষ ধৌতকরণে।”  [‘আল-বেদায়া ওয়ান্ নেহায়া’, ২:৮]

ইবনে কাসীর নিজ ‘তাফসীর’গ্রন্থে বলেন:

كان فيه عصا موسى وعصا هارون ولوحان من التوراة وثياب هارون ومنهم من قال : العصا والنعلان اهــ. [ تفسير ابن كثير ج١ ص٣١٣ ]

অর্থ: “এতে ছিলো সর্ব-পয়গম্বর মূসা ও হারূন (عليهما السلام)’এর ‘আসা’ (লাঠি)-দ্বয়, তৌরীতের দুটো লিপি ও হারূন (عليه السلام)’এর বস্ত্র। কেউ কেউ বলেন, ওতে একটি লাঠি ও চপ্পলসমূহ ছিলো।” [তাফসীরে ইবনে কাসীর, ১:৩১৩]

ইমাম আল-ক্বুরতুবী (رحمة الله عليه) বলেন: 

وقال القرطبي:  والتابوت كان من شأنه فيما ذكر أنه أنزله الله على آدم عليه السلام فكان عنده إلى أن وصل إلى يعقوب عليه السلام فكان في بني إسرائيل يغلبون به من قاتلهم حتى عصوا فغلبوا على التابوت غلبهم عليه العمالقة وسلبوا التابوت منهم . اهـ . (تفسير القرطبي ج٣ ص٢٤٧ .) 

অর্থ: “যা উল্লেখ করা হয়েছে, তাবূত হযরত আদম (عليه السلام)’এর প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিলো এবং তা তাঁরই সাথে ছিলো – যতোক্ষণ না হযরত এয়াক্বূব (عليه السلام)’এর কাছে পৌঁছেছিলো; অতঃপর বনূ ইসরাঈলের কাছে তা পৌঁছে যায়। সেটার (বরকত) দ্বারা তারা যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে পরাভূত করতো, যে পর্যন্ত না তারা আল্লাহকে অমান্য করেছিলো; এরই ফলশ্রুতিতে তারা যুদ্ধে পরাজিত হয় এবং ওই তাবূত তাদের শত্রু, যারা আমালিক্বাত গোত্রভুক্ত ছিলো, তাদের করায়ত্তে চলে যায়।”

বাস্তবে এটা ওই সকল পয়গাম্বরের (عليهم السلام)’এর ব্যক্তিগত স্মৃতিচিহ্নগুলোর মাধ্যমে তাওয়াসসুল পালন ছাড়া কিছু নয়। যুদ্ধের ময়দানে বনূ ইসরাঈলীদের সেগুলো নিজেদের সাথে নিয়ে আসার পেছনে আর কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা নেই। মহান আল্লাহতা’লারই সন্তুষ্টি তাতে ছিলো; আর এর প্রমাণ ছিলো এই বাস্তবতা যে তিনি তাদেরকে তা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন এবং এটাকে তা’লূতের রাজ্য ও রাজত্বের একটা আলামত ও নিদর্শন (আয়াত) বানিয়েছিলেন।

হুযূর পূর নূর (দ:) ও আম্বিয়া (আ:) এবং পুণ্যবান বান্দাদের হক্ক (অধিকার) দ্বারা তাওয়াসসুল 

হযরত ফাতিমা বিনতে আসাদ উম্মে আলী বিন আবী তালেব (رضي الله عنها)’এর গুণগত বৈশিষ্ট্যাবলীর সংকলনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি যখন বেসালপ্রাপ্ত হন তখন মহানবী (صلى الله عليه وسلم) নিজ পবিত্র হাতে মাটিতে যথাযোগ্য স্থানে কবর খনন করেন এবং ময়লা অপসারণ করেন। তিনি এ কাজ সুসম্পন্ন করার পর তাতে নামেন এবং (কিছুক্ষণ) বিশ্রাম নেয়ার পর বলেন: 

(( الله الذي يحي ويميت وهو حي لا يموت اغفر لأمي فاطمة بنت أسد ولقنها حجتها ووسع عليها مدخلها بحق نبيك والأنبياء الذين من قبلي فإنك أرحم الراحمين . وكبر عليها أربعاً وأدخلوها اللحد هو والعباس وأبو بكر الصديق رضي الله عنهم))

অর্থ: “এয়া আল্লাহ, যিনি জীবন ও মৃত্যু দান করেন; চিরঞ্জীব সত্তা, যিনি মৃত্যুবরণ করেন না! আমার মা ফাতিমা বিনতে আসাদকে ক্ষমা করুন। তাঁর প্রমাণ (ঈমানের সাক্ষ্য) তাঁকে প্রদান করুন এবং তাঁর (পরকালীন জীবনে) প্রবেশদ্বার প্রশ্বস্ত করে দিন আপনারই এই নবী (صلى الله عليه وسلم) ও আমার পূর্ববর্তী আম্বিয়া (عليهم السلام)’বৃন্দের অধিকারের খাতিরে; নিশ্চয় আপনি-ই করুণাশীলদের মাঝে সেরা করুণাশীল।” এরপর তিনি তাঁর জানাযা পড়ান এবং তিনি, সর্ব-হযরত আব্বাস ও আবূ বকর (رضي الله عنهما) হযরত ফাতিমা বিনতে আসাদ (رضي الله عنها)-কে কবর শরীফে দাফন করেন। 

এটা ইমাম আল-তাবারানী (رحمة الله عليه) বর্ণনা করেন আপন ‘আল-মু’জাম আল-কবীর’ ও ‘আল-আওসাত’ গ্রন্থ দুটোতে। এতে রাবী/বর্ণনাকারীদের মধ্যে আছেন রাওহ ইবনে সালা’হ, যাঁকে সর্ব-ইমাম ইবনে হিব্বান ও হাকিম (رحمة الله عليهما) সিক্বাত/বিশ্বস্ত ঘোষণা করেছেন, যদিও তাঁর দুর্বলতা রয়েছে; অবশিষ্ট রাবীবৃন্দকে সহীহ সংকলন (বুখারী ও মুসলিম) দুটোতে পাওয়া যায়। [মজমাউল যাওয়াইদ ৯:২৫৭ অনুযায়ী]

রাওহ বিন সা’লাহ’ কর্তৃক রওয়ায়াত/বর্ণনার অবস্থা সম্পর্কে কতিপয় উলামা ভিন্নমত পোষণ করেছেন, তবে ইমাম ইবনে হিব্বান (رحمة الله عليه) তাঁকে বিশ্বস্তদের একজন হিসেবে উল্লেখ করেন। ইমাম হাকিম (رحمة الله عليه) বলেন – وقال الحاكم : ثقة مأمون – ‘তিনি নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত।’ এই দু জন মুহাদ্দিস আলেম এটাকে সহীহ সাব্যস্ত করেন; এর পাশাপাশি ইমাম আল-হায়তামী (رحمة الله عليه)-ও নিজ ‘মজমাউয-যাওয়াইদ’ পুস্তকে এটাকে সহীহ সাব্যস্ত করেন; আর এতে (এসনাদের) অন্যান্য রাবী হলেন (দুটো) সহীহ সংকলনের বর্ণনাকারী।

এই হাদীসটি হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন ইমাম ইবনে আব্দিল বার্র (رحمة الله عليه); আর হযরত জাবের (رضي الله عنه) হতে ইমাম ইবনে আবী শায়বা (رحمة الله عليه)। এ ছাড়াও এটা বর্ণনা করেন সর্ব-ইমাম আল-দায়লামী ও আবূ নুয়াইম (رحمة الله عليهما)। বিবরণের পরম্পরাগুলো একে অপরকে মজবুত ও শক্তিশালী করে থাকে – فطرقه يشد بعضه بعضاً بقوة وتحقيق  

শায়খ হাফেয আল-গোমা’রী সাহেব নিজ ‘ইতহা’ফ আল-আযকিয়্যা’ (বিচক্ষণদের উদ্দেশ্যে উপহার) পুস্তকে বলেন:

وروح هذا ضعفه خفيف عند من ضعفه كما يستفاد من عباراتهم، ولذا عبر الحافظ الهيثمي بما يفيد خفة الضعف كما لا يخفى على من مارس كتب الفن . فالحديث لا يقل عن رتبة الحسن بل هو على شرط ابن حبان صحيح .

অর্থ: (ওপরে বর্ণিত হাদীসটির) এসনাদের মধ্যে এই রাওহ (বিন সালা’হ)-এর দুর্বলতা তাঁকে যাঁরা দুর্বল ভেবেছেন তাঁদেরই মতানুসারে (তাঁর) হাল্কা একটি দুর্বলতা, যেমনটি বোঝা যায় তাঁদের অভিব্যক্তি হতে। এই কারণেই হাফেয ইবনে হাজর আল-হায়সামী (رحمة الله عليه) এমনভাবে এটাকে ব্যক্ত করেছেন যার দরুন এই দুর্বলতার ছোটখাটো প্রকৃতিরই প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, যে বিষয়টি হাদীস-শাস্ত্রে পারদর্শী মুহাদ্দেসীনবৃন্দের অজ্ঞাত নয়। এই হাদীসটির শ্রেণি ‘হাসান’ (নির্ভরযোগ্য); বরঞ্চ ইমাম ইবনে হিব্বান (رحمة الله عليه)’এর শর্তানুযায়ী এটা সহীহ। [‘ইতহা’ফ আল-আযকিয়্যা’, ২০ পৃষ্ঠা]

আমরা এ হাদীসে এবং অন্যান্য আহাদীসে আরো দেখতে পাই যে, প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) আম্বিয়া (আ:)’এর হক্ব/অধিকারের দোহাই দিয়ে তাওয়াসসুল পালন করেছেন; অথচ তাঁরা তখন সবাই ছিলেন বেসালপ্রাপ্ত। অতএব, এতে আহলে হক্ব তথা সত্যপন্থী পুণ্যাত্মাবৃন্দের মধ্যস্থতায় আল্লাহর দরবারে তাওয়াসসুল পালন করার বৈধতা সাবেত/প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর কৃত তাওয়াসসুল সেসব বান্দাদের হক্কের খাতিরে যাঁরা প্রার্থনা করেন

হযরত আবূ সাঈদ আল-খুদরী (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন রাসূল (صلى الله عليه وسلم)’এর বাণী যিনি ফরমান:

 قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: من خرج من بيته إلى الصلاة ، فقال : اللهم إني أسألك بحق السائلين عليك وبحق ممشاي هذا فإني لم أخرج أشراً ولا بطراً ولا رياء ولا سمعة ، خرجت اتقاء سخطك وابتغاء مرضاتك ، فأسألك أن تعيذني من النار ، وأن تغفر لي ذنوبي ، إنه لا يغفر الذنوب إلا أنت ، أقبل الله بوجهه واستغفر له سبعون ألف ملك.  

অর্থ: যে ব্যক্তি ঘর থেকে নামাযের উদ্দেশ্যে বের হয়ে বলে: ‘হে আল্লাহ়্, আমি আপনার কাছে প্রার্থী হচ্ছি আপনার ওপর তাঁদের হক্বের ভিত্তিতে যাঁরা আপনার কাছে চাইতেন; আর আমার এই (সালা’তের দিকে) হাঁটার হক্বের ভিত্তিতেও। কেননা আমি ঔদ্ধত্য, বেয়াদবি, প্রদর্শনী বা (মনুষ্য)-শ্রুতি তালাশের খাতিরে বের হই নি। আমি বের হয়েছি আপনার না-রাজির ভয় হতে এবং আপনারই রেযামন্দির অন্বেষণে। আমি জাহান্নামের আগুন হতে আপনার মাঝে আশ্রয় চাচ্ছি এবং আমার পাপসমূহের জন্যে ক্ষমাও চাচ্ছি। নিশ্চয় আপনি ছাড়া কেউই গুনাহ ক্ষমাকারী নেই।’ যে ব্যক্তি এই কথা বলবে আল্লাহতা’লা তার প্রতি তাঁরই দয়াপূর্ণ চেহারা দেখাবেন এবং সত্তর হাজার ফেরেশতা তার জন্যে মাফ চাইবেন। (আল-হাদীস)

হাদীসবেত্তা আল-মুনযিরী (رحمة الله عليه) নিজ ‘আল-তারগীব ওয়াত্ তারহীব’ গ্রন্থে বলেন:

قال المنذري في الترغيب والترهيب ج٣ ص١١: رواه ابن ماجه بإسناد فيه مقال ، وحسنه شيخنا الحافظ أبو الحسن.

অর্থ: এটা কিছুটা বিতর্কপূর্ণ এসনাদ-সহ বর্ণনা করেন ইমাম ইবনে মাজাহ (رحمة الله عليه)। আর এটাকে হাসান (নির্ভরযোগ্য) ঘোষণা করেন আমাদের শায়খ হাফেয আবূল হাসান (رحمة الله عليه)। [আল-তারগীব ওয়াত্ তারহীব, ৩:১১৯]

হাফেয ইবনে হাজর (رحمة الله عليه) আপন ‘নাতা’ইজুল আফকা‘র’ পুস্তকে বলেন:

وقال الحافظ ابن حجر في نتائج الأفكار ج١ ص٢٧: هذا حديث حسن ، أخرجه أحمد وابن خزيمة في كتاب التوحيد،  وأبو نعيم وابن السني .

অর্থ: এই হাদীসটি হাসান/নির্ভরযোগ্য। এটা বর্ণনা করেন সর্ব-ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, ইবনে খুযায়মা ‘কিতা’বুত্ তওহীদ পুস্তকে, এবং আবূ নুয়াইম ও ইবনে আল-সুন্নী (رحمة الله عليهم)। [নাতা’ইজ আল-আফকা’র, ১:২৭২]

ইমাম আল-ইরাক্বী (رحمة الله عليه) ইমাম গাজ্জালী (رحمة الله عليه)’এর ‘এহইয়া’ পুস্তকে প্রাপ্ত আহাদীসের শ্রেণিকরণে এই হাদীসটি সম্পর্কে বলেন:

وقال العراقي في تخريج أحاديث الإحياء ج١ ص٣٢٣ عن الحديث:  بأنه حسن .

অর্থাৎ, এই হাদীস অবশ্যই হাসান (শ্রেণিভুক্ত)। [আল-মুগনী ‘আন হামল আল-আসফা’র ফীল-আসফা’র’, ১:৩২৩]

ইমাম আল-বুসীরী (رحمة الله عليه) ইমাম ইবনে মাজাহ (رحمة الله عليه)’এর ‘যওয়াঈদ’ কিতাবের ব্যাখ্যায় লেখা ‘মিসবা’হ আল-যুজা’জা’ শিরোনামের গ্রন্থে লেখেন:

وقال الحافظ البوصيري في زوائد ابن ماجه المسمى ((بمصباح الزجاجة)) ج١ ص٩٨ : رواه ابن خزيمة في صحيحه. 

অর্থ: ইবনে খুযায়মা (رحمة الله عليه) কর্তৃক তাঁর সহীহ পুস্তকে বর্ণিত। [মিসবা’হ আল-যুজা’জা, ১:৯৮]

হাফেয শরফ আল-দ্বীন আল-দিমইয়া’তী (رحمة الله عليه) নিজ ‘আল-মুত্তাজির আল-রা’বি’ কিতাবে বলেন:

وقال الحافظ شرف الدين الدمياطي في المتجر الرابع ص٤٧١ : إسناده حسن إن شاء الله .

অর্থ: এর এসনাদ/পরম্পরা হাসান (নির্ভরযোগ্য), আল্লাহতা’লার মর্জিতে। [আল-মুত্তাজির আল-রা’বি’, ৪৭১ পৃষ্ঠা] 

হাদীস-শাস্ত্র বিশারদ আল্লামা সাইয়্যেদ আলী বিন ইয়াহইয়া আল-আলাউয়ী সাহেব নিজের চমৎকার ‘হেদা’য়াতুল্ মুতাখাব্বিতীন’ পুস্তিকায় বলেন:

 أن الحافظ عبد الغني المقدسي حسّن الحديث، وقبله ابن أبي حاتم، وبهذا يتبين لك أن هذا الحديث صححه وحسنه ثمانية من كبار حفاظ الحديث وأئمته، وهم: ابن خزيمة والمنذري وشيخه أبو الحسن والعراقي والبوصيري وابن حجر وشرف الدين الدمياطي وعبد الغني المقدسي وابن أبي حاتم، 

অর্থ: “হাফেয আবদুল গনী আল-মাক্বদেসী (নাবলূসী) এই হাদীসটিকে হাসান (নির্ভরযোগ্য) ঘোষণা করেছেন, যেমনটি তাঁর আগে ঘোষণা করেছিলেন ইবনে আবী হা’তিম; এ থেকে তোমার কাছে স্পষ্ট হয় যে, হাদীস-শাস্ত্রের প্রধান প্রধান আট জন হাফেয ও ইমাম এই হাদীসটিকে সহীহ বা হাসান ঘোষণা করেছেন। আর তাঁরা হলেন: সর্ব-ইমাম ইবনে খুযায়মা, আল-মুনযিরী, তাঁর শায়খ আবূল হাসান, আল-ইরাক্বী, আল-বূসীরী, ইবনে হাজর, শরফউদ্দীন দিমইয়াতী, আবদুল গনী মাক্বদেসী/নাবলূসী ও ইবনে আবী হা’তিম (رحمة الله عليهم)।”

ইমামবৃন্দের এ বিষয়ে কথা বলার পর কি আর কারো পক্ষে কথা বলার অবকাশ আছে? এ সকল হাদীস-শাস্ত্রের বিশারদের সিদ্ধান্তকে পাশ কাটিয়ে ছেলেমানুষিপূর্ণ অসংলগ্ন কথার বক্তাদের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা কি কোনো বিচক্ষণ ব্যক্তির পক্ষে হাদীস-শাস্ত্রের ভাণ্ডারের ক্ষেত্রে সঠিক হবে? – أَتَسْتَبْدِلُونَ ٱلَّذِي هُوَ أَدْنَىٰ بِٱلَّذِي هُوَ خَيْرٌ – “তোমরা কি নিকৃষ্টতর বস্তুকে উৎকৃষ্টতর বস্তুর পরিবর্তে চাচ্ছো?” [আল-ক্বুরআন, ২:৬১] – فَإِنَّهَا لاَ تَعْمَى ٱلأَبْصَارُ وَلَـٰكِن تَعْمَىٰ ٱلْقُلُوبُ ٱلَّتِي فِي ٱلصُّدُورِ – “তবে (ব্যাপার) এই যে, চোখগুলো অন্ধ হয় না, বরং ওই সমস্ত অন্তর অন্ধ হয়, যেগুলো বক্ষসমূহে রয়েছে।” [আল-ক্বুরআন, ২২:৪৬]

মা আয়েশা (রা:)-এর নির্দেশে মহানবী (দ:)-এর রওযার মাধ্যমে তাওয়াসসুল

ইমাম দা’রিমী (رحمة الله عليه) নিজ ‘সুনান’ পুস্তকের ‘আল্লাহ কর্তৃক তাঁর নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর বেসালের পরে তাঁকে সম্মানিতকরণ’ শীর্ষক অধ্যায়ে বলেন:

حدثنا أبو النعمان حدثنا سعيد بن زيد حدثنا عمرو بن مالك النكري حدثنا أبو الجوزاء أوس بن عبد الله قال: قحط أهل المدينة قحطاً شديداً فشكوا إلى عائشة، فقالت: أنظروا قبر النبي صلى الله عليه وسلم فاجعلوا منه كوا إلى السماء حتى لا يكون بينه وبين السماء سقف، قال: ففعلوا، فمطرنا مطراً حتى نبت العشب وسمنت الإبل (تفتقت من الشحم فسمى عام الفتق،  ومعنى كوا أي نافذة). اهـ سنن الدارمي ج١ ص٤.  

অর্থ: আমাদের কাছে বর্ণিত হয়েছে হযরত আবূল জাওযা আওস্ বিন আবদিল্লাহ (রহ:) হতে; তিনি বলেন: “মদীনাবাসী মুসলমানবৃন্দ (একবার) তীব্র খরাপীড়িত হন। এমতাবস্থায় তাঁরা মা আয়েশা (رضي الله عنها)’এর কাছে গিয়ে আরজি পেশ করেন, যিনি বলেন: ‘রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)’এর রওযা পাকে যাও এবং আসমানের দিকে একটি জানালা এমনভাবে খুলে দাও, যাতে তাঁর ও আসমানের মাঝে কোনো ছাদ না থাকে।’ তাঁরা তাই করেন, আর তাতে এতো বর্ষণ হয় যে উদ্ভিদ ও গাছপালা জন্মায় এবং উট হৃষ্টপুষ্ট হয়। ওই বছরকে ‘প্রাচুর্যের সাল’ আখ্যা দেয়া হয়।” [সুনানে দা’রিমী, ১:৪৩]

এই তাওয়াসসুল ছিলো প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর রওযা পাকের মাধ্যমে। এটা স্রেফ রওযা হওয়ার কারণে (তাওয়াসসুল) নয়, বরং এতে সৃষ্টিকুল সেরা ও রাব্বুল আলামীনের প্রেমাস্পদ (صلى الله عليه وسلم)’এর জিসম/দেহ মোবারক ধারণকৃত হওয়ার কারণেই (তা পালিত হয়েছে)। রওযা পাক এ রকম উচ্চমর্যাদা ও মাহাত্ম্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়েছে (একমাত্র) ওই পরম ঘনিষ্ঠতার কারণেই।

তাখরীজুল হাদীস/হাদীসটির অবস্থা:

(বর্ণনাকারীদের মধ্যে একজন) আবূল নু’মান সম্পর্কে বলা যায়, তিনি হচ্ছেন মুহাম্মদ বিন ফযল যাঁর ডাকনাম আল-’আরিম; তিনি ইমাম বুখারী (রহ:)’এর শায়খ। হাফেয (ইবনে হাজর) তাঁর সম্পর্কে ‘আল-তাক্বরীব’ গ্রন্থে বলেন:

ثقة ثبت – تغير في آخر عمره.

অর্থ: “তিনি বিশ্বস্ত/নির্ভরযোগ্য ছিলেন, তবুও শেষ বয়সে তিনি পরিবর্তিত হন।”

قلت: وهذا لا يضره ولا يقدح في روايته لأن البخاري روى له في صحيحه أكثر من مائة حديث وبعد اختلاطه لم تحمل عنه رواية، قاله الدارقطني، ولا ينبّئك مثل خبير.

অর্থাৎ, আমি (শায়খ মুহাম্মদ আলাউয়ী মালেকী হাসানী) বলি: এতে তাঁর কোনো ক্ষতি নেই বা তাঁর বর্ণনাকে এটা অগ্রহণযোগ্যও করে না, কেননা ইমাম বুখারী (رحمة الله عليه) নিজ ‘সহীহ’ গ্রন্থে তাঁর কাছ থেকে এক শ’রও বেশি হাদীস বর্ণনা করেছেন; আর পরবর্তী জীবনে তিনি হাদীস মিশিয়ে ফেল্লে ইমাম বুখারী (رحمة الله عليه) তাঁর কাছ থেকে হাদীস বর্ণনা করেন নি। এ কথা বিবৃত করেছেন ইমাম আদ্ দারুক্বূতনী (رحمة الله عليه); আর কেউই আপনাকে অতো ভালোভাবে জানাতে পারবেন না, যেমনটি জানাতে সক্ষম ওয়াকিফহাল ব্যক্তি।

ইমাম যাহাবী ইমাম ইবনে হিব্বান (رحمة الله عليه)’এর বক্তব্য খণ্ডন করেন, যখনই তিনি বলেন – بأنه وقع له أحاديث منكرة – “তাঁর বর্ণিত অনেক হাদীস প্রত্যাখ্যাত”। ইমাম যাহাবী বলেন – ولم يقدر ابن حبان أن يسوق له حديثاً منكراً فأين ما زعم؟ – “ইমাম ইবনে হিব্বান (রহ:) তাঁর কাছ থেকে বর্ণিত এমন কী একটি প্রত্যাখ্যাত হাদীসও দেখাতে পারেন নি; এমতাবস্থায় তাঁর দাবিটির আর কী রইলো?” [মীযানুল এ’তেদা’ল, ৪:৮]

আর সাঈদ বিন যায়দ (যিনি অপর এসনাদের বর্ণনাকারী) হলেন বিশ্বস্ত/গ্রহণযোগ্য, যদিও কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি বিদ্যমান (صدوق له أوهام), যা ‘আমর বিন মালিক আল-নাকরী’রও হাল-অবস্থা, ঠিক যেমনটি হাফেয ইবনে হাজর নিজ ‘তাক্বরীব’ পুস্তকে উভয়ের ব্যাপারে বিবৃত করেছেন।

উলামাবৃন্দ – صدوق يهم – ‘কিছু ত্রুটিসহ গ্রহণযোগ্য’ মর্মে এই অভিব্যক্তিকে ‘নির্ভরযোগ্যতা বাচক অভিব্যক্তি’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন, আর সেটাকে ‘দুর্বলতা জ্ঞাপক অভিব্যক্তি’ হিসেবে বলেন নি। [দেখুন – ‘তাদরীব আল-রাউয়ী’ গ্রন্থটি]

আর আবূ আল-জাওযা হলেন আউস বিন আবদিল্লাহ আল-রুব’ঈ। তিনি সিক্বাহ তথা বিশ্বস্ত এবং দুটি সহীহ হাদীসগ্রন্থের (বুখারী ও মুসলিম) বর্ণনাকারীদের মধ্য হতেই একজন; অতএব, এই এসনাদে কোনো সমস্যা নেই (لا بأس به)। বরঞ্চ আমার (শায়খ মুহাম্মদ আলাউয়ী মালেকী হাসানী) কাছে তিনি উত্তম; কেননা (হাদীসবিদ) উলামামণ্ডলী তাঁর মতো এবং তাঁর চেয়েও কম যোগ্যতাসম্পন্ন অনেককে গ্রহণ করেছেন এবং দলিলের সূত্র হিসেবে উদ্ধৃত করেছেন।

মা আয়েশা (রা:) এবং হুযূর (দ:)-এর রওযা শরীফ সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি 

কিছু লোক দাবি করে, এই বিবরণটি মা আয়েশাহ (رضي الله عنها)’এর প্রতি আরোপিত এবং তিনি হলেন একজন সাহাবী; আর সাহাবা (رضي الله عنهم)’বৃন্দের কোনো কাজ প্রামাণ্য দলিল নয়। এই আপত্তির প্রতি আমাদের জবাব হলো: এটা যদিও মা আয়েশা (رضي الله عنها)’এর রায়/সিদ্ধান্ত ছিলো, তবুও তিনি ছিলেন তাঁর অসামান্য জ্ঞানের জন্যে সুপরিচিত। তিনি মদীনায় উলামা সাহাবা (رضي الله عنهم)’মণ্ডলীর মাঝেই এই কাজটি করেছিলেন। এই ঘটনা আমাদের জন্যে দলিল এই মর্মে যে, ঈমানদার মুসলমানবৃন্দের মা হযরত আয়েশাহ (رضي الله عنها) জানতেন প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) বেসালপ্রাপ্তির পরও রহমত-বিহীন হন নি এবং উম্মতের জন্যে তাঁর শাফাআত/সুপারিশও বন্ধ হয় নি; আর যে ব্যক্তি তাঁর রওযা মোবারক যেয়ারত করে শাফাআত প্রার্থনা করবে, তার জন্যে তিনি সুপারিশ করবেন। এটা শির্ক (মূর্তিপূজা) নয় কিংবা শির্কের দিকে পরিচালনাকারী কোনো মাধ্যমও নয়, যেমনটি ধারণা করে থাকে ওই সব লোক যারা অন্যদের প্রতি কুফর/অবিশ্বাস ও দলালাত/পথভ্রষ্টতার দোষারোপ করে। মা আয়েশা (رضي الله عنها) বা তাঁর (এ কাজে) সাক্ষী যাঁরা হয়েছিলেন, তাঁরা শির্ক বা শির্কের দিকে পরিচালনাকারী মাধ্যমের ব্যাপারে অজ্ঞ ছিলেন না।

এই বৃত্তান্ত ওই ধরনের লোকদের (অপযুক্তিকে) সমূলে উৎপাটিত করে এবং প্রমাণ করে যে রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) বেসালপ্রাপ্তির পরও নিজ রওযা মোবারকে উম্মতের ব্যাপারে যত্নবান। এটাও প্রতিষ্ঠিত একটা বিষয় যে ঈমানদারবৃন্দের মা আয়েশাহ (رضي الله عنها) বলেছেন: 

كنت أدخل بيتي الذي فيه رسول الله صلى الله عليه وسلم وأضع ثيابي، وأقول إنما هو زوجي وأبي، فلما دفن عمر معهما فوالله ما دخلت إلا وأنا مشدودة حياء من عمر 

অর্থ: আমি আমার ঘরে প্রবেশ করতাম যেখানে রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) শায়িত ছিলেন, আর আমি আমার বহিঃবস্ত্র অপসারণ করে বলতাম: “এখানে আছেন স্রেফ আমার স্বামী ও আমার পিতা;” কিন্তু হযরত উমর (رضي الله عنه)’এর দাফন হওয়ার পরে, আল্লাহর কসম, আমি আর প্রবেশ করতাম না পুরোপুরি বস্ত্রাবরণ ছাড়া, কেননা হযরত উমর (رضي الله عنه)’এর সামনে আমি লজ্জা বোধ করতাম। [ইমাম আহমদ বর্ণিত]

হাফেয আল-হায়সামী (রহ:) বলেন:  

رجاله رجال الصحيح  

অর্থ: এর বর্ণনাকারীবৃন্দ হলেন সহীহ (হাদীসগ্রন্থ দুটোর) বর্ণনাকারী। [মজমাউয্ যওয়াঈদ, ৮:২৬]

ইমাম হাকিম (রহ:)-ও নিজ ‘মুসতাদরাক’ পুস্তকে এটা বর্ণনা করেন এবং তিনি বলেন:

ورواه الحاكم في المستدرك، وقال: صحيح على شرط الشيخين، ولم يعترضه الذهبي بشيء

অর্থ: দু জন শায়খ (বুখারী ও মুসলিম)’এর শর্তানুযায়ী এটা সহীহ এবং ইমাম যাহাবী (রহ:) কোনো কিছু দ্বারা এর বিরোধিতা করেন নি। [আল-মুস্তাদরাক, ৪:৭]

হযরত আয়েশাহ (رضي الله عنها) এটাকে মিথ্যে জানতেন না, বরং তিনি জানতেন প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) ও তাঁর দুই  ঘনিষ্ঠ সাহাবা (সর্ব-হযরত আবূ বকর ও উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা) তাঁদের রওযায় আগমনকারী মানুষদের চিনতে ও জানতে পারেন।   

রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) হযরত মুয়ায বিন জাবাল (رضي الله عنه)’কে ইয়েমেন রাজ্যে (গভর্নর হিসেবে) প্রেরণের সময় বলেন:

فلعلك تمر بقبري ومسجدي.

অর্থ: “হয়তো তুমি আমার রওয়া শরীফ ও মসজিদ (নববী) অতিক্রম করবে।” [সর্ব-ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল ও তাবরানী (رحمة الله عليهما) কর্তৃক বর্ণিত; এর রাবী/বর্ণনাকারীবৃন্দ বিশ্বস্ত একমাত্র এয়াযীদ ছাড়া যিনি (সরাসরি) হযরত মুয়ায (رضي الله عنه) হতে শোনেন নি, যেমনটি বিবৃত হয়েছে ‘মজমুয়ায্ যওয়াঈদ’ পুস্তকে, ১০:৫৫]

প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) বেসাল তথা পরলোকে খোদার সাথে মিলনপ্রাপ্ত হলে হযরত মুয়ায (رضي الله عنه) তাঁর রওযায়ে আক্বদসে যান এবং কান্নাকাটি করেন। হযরত উমর ফারূক্ব (رضي الله عنه) তাঁকে ওই অবস্থায় দেখতে পান। নিম্নের কথপোকথন তাঁদের মধ্যে হয়, যেমনটি বর্ণনা করেন যায়দ বিন আসলাম তাঁরই পিতা হতে, যিনি বলেন: 

خرج عمر إلى المسجد فوجد معاذ بن جبل عند قبر النبي صلى الله عليه وسلم يبكي، قال: ما يبكيك؟ قال: حديث سمعته عن رسول الله صلى الله عليه وسلم : (( اليسير من الرياء شرك )).

অর্থ: হযরত উমর (رضي الله عنه) মসজিদ হতে বের হয়ে হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (رضي الله عنه)’কে রওযায়ে আক্বদসে ক্রন্দনরত অবস্থায় পান। তিনি জিজ্ঞেস করেন: ‘তুমি কাঁদছো কেন?’ হযরত মুয়ায (رضي الله عنه) উত্তর দেন: ‘একটি হাদীসের ব্যাপারে, যা আমি শুনেছি রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)’এর কাছ থেকে এই মর্মে – “রিয়া তথা প্রদর্শনীমূলক কর্মের সামান্য অংশও শির্ক (খফি তথা পাপ; এটা শির্কে জলী বা প্রকাশ্য অংশীবাদ/মূর্তিপূজা নয় – বঙ্গানুবাদক)।” 

আল-হাকিম (رحمة الله عليه) বলেন: 

صحيح ولا يعرف له علة،

অর্থ: এটা সহীহ (বিশুদ্ধ) এবং এর (এসনাদের) মধ্যে জ্ঞাত কোনো ত্রুটি নেই।

আল-যাহাবী (রহ:)-ও তাঁর সাথে একমত হয়ে বলেন:

صحيح ولا علة له.

অর্থ: এটা সহীহ (বিশুদ্ধ), ত্রুটিবিহীন। [আল-মুস্তাদরাক, ১:৪]

ইমাম আল-মুনযিরী (رحمة الله عليه) ‘আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব’ পুস্তকে বলেন:

 رواه ابن ماجه والبيهقي والحاكم وقال: صحيح لا علة له، وأقره أعني المنذري  (ج١ ص٣٢) . 

অর্থ: এটা বর্ণনা করেছেন সর্ব-ইমাম ইবনে মাজাহ, আল-বায়হাক্বী ও আল-হাকিম, যিনি (মানে শেষোক্ত জন) বলেন: ‘এটা সহীহ, ত্রুটিবিহীন (সনদের ক্ষেত্রে)।’ আল-মুনযিরী (رحمة الله عليه) তাঁর (এ কথার) সাথে একমত হন। [আল-তারগীব ওয়াল-তারহীব, ১:৩২]

হযরত উমর (রা:)-এর খেলাফত আমলে নবী করীম (দ:)-এর রওযার তাওয়াসসুল  

وقال الحافظ أبو بكر البيهقي: أخبرنا أبو نصر بن قتادة وأبو بكر الفارسي قال: حدثنا أبو عمر بن مطر حدثنا إبراهيم بن علي الذهلي حدثنا يحيى بن يحيى حدثنا أبو معاوية عن الأعمش عن أبي صالح عن مالك قال: أصاب الناس قحط في زمن عمر بن الخطاب فجاء رجل إلى قبر النبي صلى الله عليه وسلم فقال:  يا رسول الله استسق الله لأمتك فإنهم قد هلكوا، فأتاه رسول الله صلى الله عليه وسلم في المنام فقال: ((ائت عمر فأقرئه مني السلام وأخبرهم أنهم مسقون،  وقل له: عليك بالكيس الكيس)) .. فأتى الرجل فأخبر عمر، فقال:  يارب! ما آلو إلا ما عجزت عنه. وهذا إسناد صحيح. 

অর্থ: হাফেয আবূ বকর আল-বায়হাক্বী (رحمة الله عليه) বলেন, “হযরত মা’লিক (رحمة الله عليه) হতে বর্ণিত, যিনি বলেন: “খলীফা উমার ফারূক্ব (رضي الله عنه)’এর শাসনামলে জনসাধারণ খরাপীড়িত হলে জনৈক ব্যক্তি রাসূলূল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)’এর রওযা শরীফে আসেন এবং আরয করেন: ‘হে আল্লাহর রাসূল (صلى الله عليه وسلم)! আপনার উম্মতের খাতিরে বৃষ্টির জন্যে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করুন। ‍নিশ্চয় তাঁরা বিধ্বস্ত-প্রায়।’ অতঃপর প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) তাঁকে স্বপ্নে দেখা দেন এবং বলেন, ‘উমরের কাছে যাও এবং আমার সালাম জানাও, আর তাকে বোলো, তাদেরকে বৃষ্টি প্রদান করা হবে। তাকে (আরো) বোলো, বিচক্ষণ হতে, বিচক্ষণ হতে।’ ওই ব্যক্তি খলীফা (رضي الله عنه)’এর দরবারে গমন করে সব খুলে বলেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে খলীফা উমর (رضي الله عنه) বলেন: ‘হে আমার প্রভু! আমি (বিষয়াদিতে) চেষ্টার ত্রুটি করি না, স্রেফ যা আমার ক্ষমতার বাইরে (তা ছাড়া)’।” এ বিবরণের এসনাদ/পরম্পরা সহীহ তথা বিশুদ্ধ। [হাফেয ইবনে কাসীর নিজ ‘আল-বেদায়া’ (১:৯১) গ্রন্থে ১৮ হিজরী সালের ঘটনা সম্পর্কে যেমনটি বর্ণনা করেছেন সে মোতাবেক]

ইমাম ইবনে আবী শায়বা (رحمة الله عليه) কর্তৃক সহীহ সনদে (আরো) বর্ণিত হয়েছে সালিহ আল-সিমা’ন হতে, তিনি মা’লিক আল-দা’র হতে, যিনি খলীফা উমর ফারূক্ব (رضي الله عنه)’এর খা’যিন/কোষাধ্যক্ষ ছিলেন, এই মর্মে যে তিনি বলেন:

أصاب الناس قحط في زمن عمر رضي الله عنه فجاء رجل إلى قبر النبي صلى الله عليه وسلم فقال: يا رسول الله! استسق لأمتك فإنهم قد هلكوا فأتى الرجل في المنام فقيل له: ائت عمر، الحديث. 

অর্থ: খলীফা উমর (رضي الله عنه)’এর শাসনামলে মানুষেরা খরাপীড়িত হন। এমতাবস্থায় জনৈক ব্যক্তি প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর রওযা পাকে আসেন এবং আরয করেন: “এয়া রাসূলাল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)! আপনার উম্মতের খাতিরে বৃষ্টি চান (আল্লাহর দরবারে)। নিশ্চয় তারা বিলুপ্ত-প্রায়।” নবী পাক (صلى الله عليه وسلم) তাঁকে স্বপ্নে দেখা দেন এবং বলেন: “উমরের কাছে যাও…।” [আল-হাদীস]

وقد روى سيف في الفتوح:  أن الذي رأى في المنام المذكور هو بلال ابن الحارث المزني أحد الصحابة.  قال ابن حجر:  إسناده صحيح اهــ.

অর্থ: সাইফ নিজ ‘আল-ফুত্তুহ’ পুস্তকে বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি স্বপ্নটি দেখেছিলেন তিনি সাহাবী হযরত বিলাল ইবনে হা’রিস্ আল-মুযানী (رضي الله عنه)। ইমাম ইবনে হাজর (رحمة الله عليه) বলেন: “এই হাদীসের সনদ সহীহ।” [সহীহ বুখারী, বাবু ইসতিসক্বা; ‘ফাতহুল বারী’, ২:৪১৫]

এই হাদীস বর্ণনাকারী ইমামবৃন্দের কেউই অথবা তাঁদের এই গবেষণাকর্মের (চুলচেরা) বিশ্লেষণকারী পরবর্তী যুগে আগত ইমামবৃন্দও এটাকে কুফর/অবিশ্বাস/বেঈমানী বা গোমরাহী/পথভ্রষ্টতা বলে আখ্যা দেননি। হাদীসের মতন বা লিপিরও কোনো সমালোচনা তাঁদের কেউ-ই করেন নি। এ হাদীসটি ইমাম ইবনে হাজর আসক্বালানী (رحمة الله عليه) উদ্ধৃত করেছেন এবং তিনি এটাকে সত্যায়ন করেন যা ওপরে বিবৃত হয়েছে। আর তিনি মুহাদীস ইমামমণ্ডলীর মাঝে তাঁর জ্ঞান, উন্নত গুণাবলী ও গ্রহণযোগ্যতার জন্যে সুবিদিত, যা বিস্তারিত ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না।

এয়ামা-মা দিবসে রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর মাধ্যমে মুসলমানদের তাওয়াসসুল   

ذكر الحافظ ابن كثير إن شعار المسلمين في موقعة اليمامة كان: [ محمـــداه ] ..

হাফেয ইবনে কাসীর উল্লেখ করেন যে এয়ামামা’র যুদ্ধে মুসলমানদের রণ-হুংকার ছিলো ‘এয়া মুহাম্মাদা’ (صلى الله عليه وسلم)।

ইবনে কাসীর আরো বলেন:

قال ما نصه: وحمل خالد بن الوليد حتى جاوزهم وسار لجبال مسيلمة وجعل يترقب أن يصل إليه فيقتله ثم رجع ثم وقف بين الصفين ودعا البراز وقال: أنا ابن الوليد العود أنا ابن عامر وزيد، ثم نادى بشعار المسلمين، وكان شعارهم يومئذ [يا محمداه].. 

অর্থ: হযরত খালিদ বিন ওয়ালীদ (رضي الله عنه) তাদের (বিদ্রোহী সেনাদের) সারিবদ্ধ ব্যূহ ভেদ করে মুসায়লামা (কাযযাব)’এর পাহাড় অবধি পৌঁছে যান। তিনি কাছ থেকে নজর রাখছিলেন, তাকে (মুসায়লামাকে) খুঁজে পেয়ে হত্যার অপেক্ষায়। অতঃপর তিনি ফিরে যান আগের অবস্থানে এবং দুটো মুখোমুখি বাহিনীর মাঝে গিয়ে দাঁড়ান, আর একক দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান জানিয়ে বলেন: “আমি ইবনে ওয়ালীদ, যে ফিরে আসে; আমি ইবনে আ’মির এবং যায়দ।” অতঃপর তিনি মুসলমানদের রণ-হুংকার দেন, আর তাঁদের সেদিনের রণ-হুংকার ছিলো ‘এয়া মুহাম্মাদা’ (صلى الله عليه وسلم)! [আল-বেদায়া ওয়ান্ নেহায়া, ৬:৩২৪]

রোগ-ব্যাধি ও কঠিন পরিস্থিতিতে নবী পাক (দ:)-এর তাওয়াসসুল

عن الهيثم بن خنس قال:  كنا عند عبد الله بن عمر رضي الله عنهما فخدرت رجله فقال له رجل:  أذكر أحب الناس إليك، فقال:  يا محمد، فكأنما نشط من عقال. 

আল-হায়সাম ইবনে খানা’স (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, যিনি বলেন: “আমরা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (رضي الله عنه)’এর সাথে ছিলাম যখন তাঁর পা মোবারক ভীষণ অবশ অনুভূত হতে থাকে। জনৈক ব্যক্তি তাঁর কাছে এসে বলেন, ‘আপনার সবচেয়ে প্রিয়ভাজন কারো কথা স্মরণ করুন।’ এমতাবস্থায় হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه) বলেন, ‘এয়া মুহাম্মদ (صلى الله عليه وسلم)।’ পরবর্তী পর্যায়ে এটা (পা মোবারক) যেনো ওর শেকল থেকে মুক্ত হয়ে যায়।” 

وعن مجاهد قال:  خدرت رِجل رَجُل عند ابن عباس رضي الله عنهما، فقال له ابن عباس:  أذكر أحب الناس إليك، فقال: محمد صلى الله عليه وسلم، فذهب خدره.  

অর্থ: হযরত মুজাহিদ (رضي الله عنه) বলেন: “হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه)’এর কাছে উপস্থিত জনৈক ব্যক্তির পা অবশ হয়ে যায়। তিনি ওই ব্যক্তিকে বলেন, ‘তোমার সবচেয়ে প্রিয়ভাজন কারো কথা স্মরণ করো।’ ওই ব্যক্তি বলেন, ‘মুহাম্মদ (صلى الله عليه وسلم)।’ অতঃপর তাঁর পায়ের অবশ অনুভূতি সম্পূর্ণভাবে দূর হয়ে যায়।” [ইবনে তাইমিয়া কর্তৃক নিজ ‘আল-কালিমুত্ তাইয়্যেব’, ৪৭:১৬৫ গ্রন্থে উল্লেখিত]

মহানবী (দ:) ছাড়াও অন্যান্যদের তাওয়াসসুল

عن عتبة بن غزوان عن نبي الله صلى الله عليه وسلم قال: ((إذا أضل أحدكم شيئاً أو أراد عوناً وهو بأرض ليس بها أنيس فليقل: يا عباد الله أعينوني، فإن لله عباداً لا نراهم. وقد جرب ذلك))..

رواه الطبراني ورجاله وثقوا على ضعف في بعضهم إلا أن يزيد بن علي لم يدرك عتبة.

অর্থ: হযরত উতবা বিন গাযওয়া’ন (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন যে রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) এরশাদ ফরমান: “তোমাদের কেউ কিছু হারালে, অথবা কোনো দূর রাজ্যে সঙ্গী-সাথীহীন অবস্থায় সাহায্যের প্রয়োজন হলে (উচ্চস্বরে) বোলো, ‘হে আল্লাহর বান্দাবৃন্দ, আমায় সাহায্য করুন।’ কেননা নিশ্চয় আল্লাহর এমন বান্দা-মণ্ডলী আছে, যাদের আমরা দেখতে পাই না।” এটা চেষ্টা (প্রয়োগ) করা হয়েছে। হাদীসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম তাবরানী (رحمة الله عليه); আর এর বর্ণনাকারীবৃন্দকে সিকা/বিশ্বস্ত ঘোষণা করা হয়েছে, যদিও তাঁদের মাঝে কিছু দুর্বলতা বিদ্যমান; ব্যতিক্রম শুধু এয়াযীদ ইবনে আলী যিনি হযরত উতবা (رضي الله عنه)’এর সাক্ষাৎ পান নি।

হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন যে মহানবী (صلى الله عليه وسلم) ঘোষণা করেছেন:

(( إن لله ملائكة في الأرض سوى الحفظة يكتبون ما يسقط من ورق الشجر، فإذا أصاب أحدكم عرجة بأرض فلاة فليناد أعينوني يا عباد الله ))..

অর্থ: “নিশ্চয় আল্লাহতা’লার রয়েছেন হাফাযা (অভিভাবক ফেরেশতা) ছাড়াও ফেরেশতা-মণ্ডলী, যাঁরা গাছ-গাছালি থেকে পাতা পড়লেও তা লিখে রাখেন। অতঃপর তোমাদের কেউ অপরিচিত রাজ্যে আঘাতগ্রস্ত হলে সে যেনো বলে: ‘হে আল্লাহর বান্দাবৃন্দ, আমায় সাহায্য করুন’।” এ হাদীসটি ইমাম আল-তাবারানী (رحمة الله عليه) বর্ণনা করেন এবং এর সকল বর্ণনাকারী বিশ্বস্ত।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) বলেন যে প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) এরশাদ ফরমান:

(( إذا انفلتت دابة أحدكم بأرض فلاة فليناد : يا عباد الله احبسوا. يا عباد الله احبسوا ، فإن لله حاضراً في الأرض سيحبسه )) .

অর্থ: “তোমাদের কেউ অপরিচিত এলাকায় সওয়ারের প্রাণি হারালে সে যেনো উচ্চস্বরে বলে: ‘হে আল্লাহর বান্দা-বৃন্দ, (সওয়ারকে) সামাল দেন; হে আল্লাহর বান্দা-বৃন্দ, (সওয়ারকে) সামাল দেন।’ কেননা নিশ্চয় আল্লাহতা’লা সারা দুনিয়ায় ফেরেশতামণ্ডলী হাজির রেখেছেন, যাঁরা সেটাকে সামলাবেন।” এই হাদীসটি সর্ব-ইমাম আবূ এয়ালা ও তাবারানী (رحمة الله عليهما) বর্ণনা করেন; শেষোক্তজন  এ কথা যোগ করেন – سيحبسه عليكم – “তাঁরা (ফেরেশতাবৃন্দ) তোমাদের জন্যে সেগুলোকে সামলাবেন।” এতে (এসনাদে) রয়েছেন মা’রূফ বিন হাসান যিনি দুর্বল [মজমাউয্ যওয়াঈদ, ১০:১৩২]। এটা নেদা বা আহ্বান সহকারে তাওয়াসসুল-ও বটে। 

আরেকটি হাদীসে বিবৃত হয় যে, রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) ফজরের নামাযের দু রাকআত আদায় শেষে দু’আ করেন:

(( اللهم رب جبريل وإسرافيل وميكائيل ومحمد النبي صلى الله عليه وسلم أعوذ بك من النار )).

অর্থ: “হে আল্লাহ – জিবরীল, ইসরা’ফীল, মিকা’ঈল ও মহানবী (صلى الله عليه وسلم)’এর প্রভু – আমি আপনার কাছে জাহান্নামের আগুন থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি।” ইমাম নববী (رحمة الله عليه) ‘আল-আযকার’ পুস্তকে বলেন – رواه ابن السن – অর্থাৎ, ‘এই হাদীসটি বর্ণনা করেন ইবনে আল-সুন্নী (رحمة الله عليه)।’ হাফেয ইবনে হাজর (رحمة الله عليه) হাদীসটির উৎস উল্লেখ করার পর বলেন – هو حديث حسن – মানে “হাদীসটি হাসান (নির্ভরযোগ্য)।” [ইবনে আল্লাআ’ন কৃত শরহে আযকার, ২:১৩৯]

হাদীসে ফেরেশতাদের নাম আলাদা আলাদা করে উল্লেখ করা তাঁদের মধ্যস্থতায় তাওয়াসসুলের ইঙ্গিতবহ, যেনো রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) আরয করছিলেন:

اللهم إني أسألك وأتوسل إليك بجبريل إلخ ..

অর্থ: “হে আল্লাহ, আমি আপনার দরবারে প্রার্থনা করি এবং এতে তাওয়াসসুল করি জিবরীল…প্রমুখের।” ইবনে আল্লা’আন (رحمة الله عليه) নিজ শরাহ/ব্যাখ্যামূলক পুস্তকে এ বিষয়ে ইশারা করেন এই বলে:

 التوسل إلى الله بربوبية هذه الأرواح العظيمة. 

অর্থ: “আল্লাহর দরবারে তাওয়াসসুল তাঁরই প্রভুত্বের ওয়াস্তে – এ সকল মহান সত্তার দোহাই দিয়ে…।” 

ইবনে আল্লা’আন (رحمة الله عليه) তাওয়াসসুলের বৈধতার পক্ষে স্পষ্ট সমর্থন ব্যক্ত করেন, যখন তিনি – ((اللهم إني أسألك بحق السائلين)) – “হে আল্লাহ, আমি আপনার দরবারে প্রার্থী হচ্ছি প্রার্থনাকারীদের হক্বের ওয়াস্তে” মর্মে হাদীসটির ব্যাখ্যায় বলেন:

فيه التوسل بحق أرباب الخير على سبيل العموم من السائلين ومثلهم بالأولى الأنبياء والمرسلون.

অর্থ: “এতে বিরাজমান সার্বিকভাবে প্রার্থনাকারীদের মাঝে পুণ্যবানদের অধিকারের ভিত্তিতে তাওয়াসসুল; আর তাঁদের মধ্যে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত উদাহরণ হলেন আম্বিয়া ও রাসূল-বৃন্দ (عليهم السلام)।” [প্রাগুক্ত শরহে আযকার, ২:১২৯]

হযরত আব্বাস (রা:)-এর মাধ্যমে খলীফা উমর (রা:)-এর তাওয়াসসুলের অর্থ

أخرج البخاري في صحيحه عن أنس أن عمر بن الخطاب رضي الله عنه ـ كانوا إذا قحطوا ـ استسقى بالعباس بن عبد المطلب فقال: [ اللهم إنا كنا نتوسل إليك بنبينا فتسقينا وإنا نتوسل إليك بعم نبينا فاسقنا ]. 

অর্থ: ইমাম বুখারী (رحمة الله عليه) নিজ ‘সহীহ’ পুস্তকে বর্ণনা করেন হযরত আনাস (رضي الله عنه) হতে, যিনি বলেন যে খরা দেখা দিলে খলীফা উমর ফারূক্ব (رضي الله عنه) হযরত আব্বাস ইবনে আবদিল মুত্তালিব (رضي الله عنه)’এর মধ্যস্থতায় বৃষ্টি প্রার্থনা করতেন এ কথা বলে: “হে আল্লাহ, আমরা আপনার রাসূল (صلى الله عليه وسلم)’এর মধ্যস্থতায় তাওয়াসসুল পালন করতাম, আর আপনি বৃষ্টি মঞ্জুর করতেন; এখন আমাদের প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর সম্মানিত চাচাজানের মধ্যস্থতায় তাওয়াসসুল পালন করছি; অতএব, বৃষ্টি মঞ্জুর করুন।”

আল-যুবায়র বিন বাককার (رحمة الله عليه) ‘আল-ইনসা’ব’ গ্রন্থে এই একই বিবরণটি সংক্ষিপ্ত আকারে অন্য আরেক এসনাদ/বর্ণনাকারীদের পরম্পরা হতে বর্ণনা করেন, যার সংক্ষিপ্ত-সার নিম্নরূপ:

عن عبد الله بن عمر قال:  استسقى عمر بن الخطاب عام الرمادة [بفتح الراء وتخفيف الميم] سميت بذلك لكثرة تطاير الرماد لاحتباس المطر بالعباس ابن عبد المطلب، فخطب الناس فقال: يا أيها الناس إن رسول الله صلى الله عليه وسلم كان يرى للعباس ما يرى الولد للوالد ـ فاقتدوا أيها الناس برسول الله صلى الله عليه وسلم في عمه العباس، واتخذوه وسيلة إلى الله:  أدع يا عباس فكان من دعائه رضي الله عنه: اللهم إنه لم يترل بلاء إلا بذنب ولم يكشف إلا بتوبة ـ وقد توجه القوم بي إليك لمكاني من نبيك وهذه أيدينا أيدينا إليك بالذنوب ونواصينا إليك بالتوبة فاسقنا الغيث واحفظ اللهم نبيك في عمه، فأرخت السماء مثل الجبال حتى أخصبت الأرض وعاش الناس وأقبل الناس على العباس يتمسحون به، ويقولون له: هنيئاً لك يا ساقي الحرمين، وقال عمر ـ رضي الله عنه ـ ذلك: هذا والله الوسيلة إلى الله والمكان منه ـ 

অর্থ: হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন: খলীফা উমর ফারূক্ব (رضي الله عنه) অঙ্গারের বছর (অনাবৃষ্টি জনিত মাত্রাতিরিক্ত মরুঝড়ের কারণে নামকরণকৃত) হযরত আব্বাস ইবনে আবদিল মুত্তালিব (رضي الله عنه)’এর অসীলায় বৃষ্টি প্রার্থনা করেন। তিনি (খলীফা) মানুষদের উদ্দেশ্যে বলেন: “ওহে মানব সকল, রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) হযরত আব্বাস (رضي الله عنه)’এর দিকে তাকাতেন যেভাবে কোনো পুত্র তাঁর পিতার দিকে তাকান। অতএব, প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’কে অনুসরণ করুন তাঁর চাচাজান হযরত আব্বাস (رضي الله عنه)’এর ব্যাপারে; আর আল্লাহর দিকে তাঁকেই অসীলা হিসেবে গ্রহণ করুন।” অতঃপর খলীফা (রা:) হযরত আব্বাস (رضي الله عنه)’কে বলেন: “আল্লাহ কাছে দুআ’ করুন, হে হযরত আব্বাস (رضي الله عنه)।” এমতাবস্থায় হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) দুআ’ করেন: “এয়া আল্লাহ, নিশ্চয় কোনো দুর্দশা এসে পড়ে না একমাত্র গুনাহ/পাপ ছাড়া; আর কেউই তা থেকে মুক্ত হতে পারে না একমাত্র তওবা (অনুতপ্ত হওয়া) ছাড়া। আপনার দিকে মানুষেরা ফিরেছে আমারই মধ্যস্থতায়, কেননা আমি আপনার প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর সাথে সম্পর্কে আত্মীয় হই; আর এই আমাদের হাতগুলো (দুআ’য় উত্তোলিত) আপনারই দিকে, (অনেক) পাপ থাকা সত্ত্বেও; আর আমাদের চূর্ণকুন্তল (সেই) গুনাহের তওবারত। অতএব, আমাদের জন্যে বৃষ্টি দান করুন এবং আপনার প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’কে তাঁরই চাচার সত্তা মাঝে হেফাযত/সংরক্ষণ করুন।” সহসা আকাশ হতে পর্বতসম বারিধারা নামে এবং পৃথিবী তাতে সিক্ত হয়, আর মানুষেরা জীবন ফিরে পান এবং হযরত আব্বাস (رضي الله عنه)‘এর কাছে এসে তাঁর (মোবারক শরীরে) হাত বুলিয়ে বলেন, “আপনার প্রতি অভিনন্দন, হে হারামােইন শরীফাইন (মক্কা ও মদীনা)’এর জল সরবরাহকারী।” এমতাবস্থায় খলীফা উমর (رضي الله عنه) বলেন: “আল্লাহর শপথ! তিনি আল্লাহর নৈকট্যের অসীলা এবং আল্লাহরই সান্নিধ্যের মক্বাম তথা মর্যাদাময় স্তরের অধিকারী সত্তা।” 

এই ঘটনা প্রসঙ্গে হযরত আব্বাস (رضي الله عنه)’এর ভাতিজা হযরত আব্বাস বিন উতবা (رضي الله عنه) গানের কলি (কণ্ঠে) ধরেন:

بعمي سقى الله الحجاز وأهله :: عشية يستسقى بشيبته عمر

আল্লাহতা’লা আমার চাচার অসীলায় হিজায ও তার অধিবাসীদের প্রতি করেন বারি বর্ষণ,

অন্ধকার রাত্রিকালে, এবং উমর (রা:) যবে তাঁর মুরব্বির মাধ্যমে করেন বৃষ্টি অন্বেষণ। 

(ভাবানুবাদ)      

ইমাম ইবনে আবদিল বার্র (رحمة الله عليه) বলেন: 

 وفي بعض الروايات فارخت السماء عزاليها فجاءت بأمثال الجبال حتى استوت الحفر بالآكام وأخصبت الأرض وعاش الناس، فقال عمر رضي الله عنه: هذا والله الوسيلة إلى الله عز وجل، والمكان منه.

অর্থ: এবং কিছু কিছু রওয়ায়াত তথা বিবরণে বিবৃত হয়, আসমান হতে ভারী বর্ষণ হয়েছিলো পর্বতসদৃশ, যতোক্ষণ না জমিনের গর্তগুলো পাহাড়গুলোর সমান হয়ে যায়, আর জমিন ভিজে যায় এবং মানুষের মাঝেও পুনরায় প্রাণের সঞ্চার হয়। খলীফা উমর ফারূক্ব (رضي الله عنه) বলেন: “আল্লাহর শপথ, এটা আল্লাহর নৈকট্যের অসীলা এবং তাঁরই ঘনিষ্ঠতার মাকান/স্থান তথা মর্যাদাময় স্তর।”

হযরত হাসসান বিন সাবিত (رضي الله عنه) কাব্যাকারে বলেন:

سأل الإمام وقد تتابع جدبنا  فسقى الغمام بغرة العباس

عم النبي وصنو والده الذي  ورث النبي بذاك دون الناس

أحيا الإله به البلاد فأصبحت  مخضرة الأجناب بعد الياس 

“ইমাম, আমাদের খরাজনিত ভোগান্তি যাঁর জানা,

তিনি (আল্লাহর দরবারে) করেছিলেন যাচ্ঞা,

ফলে জমিনকে সিঞ্চন করেছিলো ঘন মেঘমালা, 

হযরত আব্বাস (রা:)’এর দোহাই দ্বারা,

প্রিয়নবী (দ:)’এর সম্মানিত চাচা,

যিনি নবী পাকের (দ:) পিতার প্রতিচ্ছায়া,

নবী (দ:)’এর ওয়ারিশ যে মহান সত্তা,

মানুষের মাঝে আর কেউ না,

তাঁরই অসীলায় জমিনে প্রাণ সঞ্চার করেন আল্লা,

অতঃপর পাথুরে পর্বত হয়েছে সবুজ, কাটিয়ে হতাশা।”

[ভাবানুবাদ]

হযরত ফযল ইবনে আব্বাস ইবনে উতবা (رضي الله عنه) বলেন:

بعمي سقى الله الحجاز وأهله  عشية يستسقى بشيبته عمر

توجه بالعباس في الجدب راغباً  فماكر حتى جاء بالديمة المطر

“আল্লাহ করেছেন মোর চাচার অসীলা দ্বারা,

হিজায ও তৎ অধিবাসীদের প্রতি সিঞ্চন ক্রিয়া,

যবে রাত্রি ছিলো তমসায় ভরা,

আর হযরত উমর (রা:) করেছিলেন বৃষ্টি প্রার্থনা,

নিয়ে তাঁরই জ্যেষ্ঠ সত্তার অসীলা,

তিনি আব্বাস (রা:)’এর কাছে করেন প্রত্যাশা,

আর ওই সত্তা দু’বারও ব্যক্ত করেননি নিজ দুআ,

যখন ভারী বর্ষণে সিক্ত হয়েছিলো মদীনা মোনাওয়ারা।” 

[ভাবানুবাদ]

وفي رواية: وطفق الناس بالعباس يمسحون أركانه ويقولون: هنيئاً لك ساقي الحرمين. كذا في الاستيعاب لابن عبد البر في ترجمة العباس.

অর্থ: একটি বর্ণনায় এসেছে এ মর্মে যে, মানুষেরা হযরত আব্বাস (رضي الله عنه)’এর কাছে এসে তাঁর পবিত্র গায়ে হাত বুলিয়ে বলেন: “আপনার প্রতি অভিনন্দন, হে মক্কা ও মদীনার সিঞ্চনকারী।” [ইমাম ইবনে আবদিল বার্র (رحمة الله عليه) কৃত ‘আল-ইস্তিয়াব’ পুস্তক, হযরত আব্বাস (رضي الله عنه)’এর জীবনী অধ্যায়]

’এসতেস্কা’ (মানে বৃষ্টি প্রার্থনামূলক) নামাযে মানুষদের (সামনে) ইমামতি করার হক্ব ছিলো খলীফা উমর ফারূক্ব (رضي الله عنه)’এর; কিন্তু তিনি সেই অধিকার প্রত্যাহার করে হযরত আব্বাস (رضي الله عنه)’কে নামাযে ইমামতি করতে সামনে দেন; এটা তিনি করেন প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর মহিমা বিবেচনায়; তাঁরই পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ হতে; আর তাঁরই চাচাকে (খলীফা কর্তৃক) নিজের ওপরে প্রাধান্য দানস্বরূপ এবং খলীফার সাধ্য অনুসারে গুরুত্বারোপিত রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)’এর তাওয়াসসুলের একটি আকার হিসেবে। তিনি হযরত আব্বাস (رضي الله عنه)’কে মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার সময় অসীলা-স্বরূপ গ্রহণ করার জন্যে মানুষের প্রতি উৎসাহ জোগান, ঠিক যেমনটি তিনি নিজে হযরত আব্বাস (رضي الله عنه)’কে অসীলা করেন যাতে তিনি (হযরত আব্বাস) প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর পক্ষে ওই মকাম বা অবস্থানটিতে গিয়ে দাঁড়ান, যেভাবে রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) আপন যাহেরী জিন্দেগীতে ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) ওই নামাযের স্থানে মানুষের জন্যে বৃষ্টি প্রার্থনা করতেন, যাতে তা মহিমায় উচ্চতর হয় ও তাঁরই আহলে বায়তের (রা:) গুণগত বৈশিষ্ট্যের বহিঃপ্রকাশও হয়। 

খলীফা হযরত উমর (رضي الله عنه) এটা স্পষ্ট ব্যাখ্যা করেন নিজের দোয়ায় যখন-ই তিনি বলেন: 

[اللهم إنا كنا نتوسل إليك بنبينا تسقينا وإنا نتوسل إليك بعم نبيك فاسقنا]  

অর্থ: হে আল্লাহ, আমরা আমাদের রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)’এর মধ্যস্থতায় তাওয়াসসুল পালন করতাম, আর এখন আমরা আমাদের প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর (সম্মানিত) চাচার মধ্যস্থতায় তাওয়াসসুল পালন করছি; অতএব, আমাদের বৃষ্টি দিন।

এর মানে হলো: “আমরা আপনার দরবারে বৃষ্টি প্রার্থনার সময় রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)’এর মাধ্যমে তাওয়াসসুল পালন করতাম, যিনি মানুষদেরকে নামাযের স্থানে বের করে নিয়ে যেতেন, তাদের জন্যে দোয়া করতেন এবং নামাযে ইমামতি করতেন; আর যেহেতু তাঁর বেসাল-প্রাপ্তির কারণে এটা আমাদের দ্বারা এখন সম্ভব নয়, সেহেতু আমি তাঁরই পরিবারের একজনকে (আপনার সামনে) পেশ করছি, যাতে এ দোয়া গৃহীত ও (আপনার) সাড়া পাবার ক্ষেত্রে অধিকতর সম্ভাবনাময় হয়ে ওঠে।”

হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) দোয়া করার সময় মহানবী (صلى الله عليه وسلم)‘এর তাওয়াসসুল পালন করেন তাঁর এ কথা দ্বারা: 

وقد تقرب القوم بي لمكاني من نبيك أي لقرابتي منه فاحفظ اللهم نبيك في عمه، يعني اقبل دعائي لأجل نبيك.

অর্থাৎ, “মানুষেরা আপনার কাছে প্রার্থী হয়েছে আমারই মধ্যস্থতায়, যা আপনার নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর সাথে আমার (আত্মীয়তার) বন্ধনের মর্যাদাসূত্রে – মানে তাঁর সাথে আমার ঘনিষ্ঠতার সূত্রে – অতএব, হে আল্লাহ, আপনার নবী (صلى الله عليه وسلم)’কে তাঁরই চাচার সত্তায় হেফাযত/সংরক্ষণ করুন।” মানে “আমার এ দুআ আপনার রাসূল (صلى الله عليه وسلم)’এর গুণগত বৈশিষ্ট্যের ওয়াস্তে গ্রহণ করুন।”

অতএব, এই বিষয়টি বৃষ্টি প্রার্থনার (মানে এস্তেসক্বা’র নামাযের) সাথে সম্পৃক্ত, আর এর সাথে আমাদের আলোচ্য তাওয়াসসুলের কোনো সম্পর্ক নেই, যা নিয়ে মতপার্থক্য বিদ্যমান। প্রত্যেক চক্ষুষ্মান ব্যক্তিরই এটা জানা, কেননা ঘটনাটি তা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে। তাঁরা (মুসলমানবৃন্দ) খরাপীড়িত ছিলেন এবং তাঁরা এস্তেস্কা’র (তথা বৃষ্টির) নামায দ্বারা সাহায্যের মুখাপেক্ষী ছিলেন। এর জন্যে প্রয়োজন ছিলো একজন ইমামের, যিনি মানুষের নামাযের ইমামতি করতে সক্ষম; যিনি মানুষের জন্যে দুআ করতে পারবেন এবং এই ইসলামী রীতিটি প্রতিষ্ঠা করবেন – যে রীতিটি প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) তাঁর দুনিয়াবী (প্রকাশ্য) হায়াতে জিন্দেগীতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ঠিক যেমনটি তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন (প্রাত্যহিক পাঁচ) ওয়াক্তিয়া ও জুমুআ’র নামাযে ইমামতি, খুতবা প্রদানের মতো অন্যান্য রীতিনীতি। এ সব শরঈ কর্তব্য আদিষ্ট হয়েছে তাঁদেরই প্রতি, যাঁরা দায়িত্বপ্রাপ্ত; আর এগুলো বরযখ তথা পারলৌকিক জগতের মানুষের দ্বারা পালন করা সম্ভব নয়, কেননা শরঈ দায়িত্ব হতে তাঁদেরকে মুক্তি দেয়া হয়েছে এবং তাঁরা এর চেয়েও বড় বা মহৎ কাজে ব্যস্ত আছেন। 

ومن فهم من كلام أمير المؤمنين أنه إنما توسل بالعباس ـ ولم يتوسل برسول الله صلى الله عليه وسلم لأن العباس حي والنبي ميت ـ فقد مات فهمه وغلب عليه وهمه ونادى على نفسه بحالة ظاهرة ـ أو عصبية لرأيه قاهرة، فإنما عمر لم يتوسل بالعباس إلا لقرابته من رسول الله صلى الله عليه وسلم تلمح ذلك في قوله وإنا نتوسل إليك بعم نبينا فاسقنا ـ  وهو بذلك قد توسل برسول الله صلى الله عليه وسلم على أبلغ الوجوه. 

যে ব্যক্তি এই বর্ণনা থেকে এ কথা বুঝে নেয় যে আমিরুল মু’মেনীন হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’এর তাওয়াসসুল পালন করেছেন এবং বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তাওয়াসসুল করেন নি, কেননা হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু জীবিত এবং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘মৃত’, তবে ওই ব্যক্তির উপলব্ধি ক্ষমতা-ই মৃত, আর তার নিজস্ব ভ্রান্ত ধারণাগুলো তাকে গ্রাস করেছে। সে তার শোচনীয় মানসিক অবস্থা বা সর্বগ্রাসী ধর্মীয় একগুঁয়েমি প্রদর্শন করেছে। এটা এ কারণে যে, খলীফা উমর (رضي الله عنه) হযরত আব্বাস (رضي الله عنه)’এর মাধ্যমে তাওয়াসসুল পালন করেছিলেন স্রেফ রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)’এর সাথে তাঁরই ঘনিষ্ঠ (আত্মীয়তার) সম্পর্কের সূত্রে, যা খলীফা (রা:)’এর এ কথা থেকে পরিস্ফুট হয় – “আর এখন আমরা আমাদের প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর (সম্মানিত) চাচার মধ্যস্থতায় তাওয়াসসুল পালন করছি; অতএব, আমাদের বৃষ্টি দিন।” এভাবে তিনি প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর তাওয়াসসুল সর্বোৎকৃষ্ট পন্থায় পালন করেন।

যে ব্যক্তি মুসলমানদেরকে এ পদ্ধতিতে তাওয়াসসুল পালেনের কারণে শির্ক তথা মূর্তি পূজার দোষারোপ করে, অথচ একই সময়ে বলে জীবিতদের মাধ্যমে তাওয়াসসুল পালন জায়েয/বৈধ, সে হক্ক তথা সত্য হতে আরো দূরে অবস্থানরত। নিশ্চয় তাওয়াসসুল শির্ক হলে জীবিত কী মৃত কোনো ক্ষেত্রেই তা জায়েয হতো না। যে ব্যক্তি আল্লাহ ভিন্ন অন্য কোনো নবী (আ:), ওলী (রহ:) বা ফেরেশতা (রহ:)’এর রাবূবিয়াত/প্রভুত্বে বিশ্বাস করে কিংবা তাঁদেরকে অর্চনা পাওয়ার হক্কদার বিবেচনা করে, আপনি কি দেখেন না তার জন্যে তা শির্ক ও কুফর এবং অবৈধ – চাই তা হোক (অসীলাকৃত পুণ্যাত্মাবৃন্দের) ইহ-জাগতিক অথবা পারলৌকিক জীবনে? কখনো কি আপনি শুনেছেন কাউকে এ কথা বলতে –  إن اعتقاد الربوبية لغير آلله جائز إذا كان حياً أما بعد وفاته فشرك – “আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো রাবূবিয়াত তথা প্রভুত্বে বিশ্বাস করা জায়েয, যদি তিনি হন জীবিত; তবে তাঁর বেসালপ্রাপ্তির পর তা শির্ক/মূর্তিপূজা?” 

অতএব, আপনি জানতে পেরেছেন যে আল্লাহতা’লার নৈকট্যের জন্যে অসীলা গ্রহণ শির্ক নয়, যদি না কেউ বিশ্বাস করে ওই মাধ্যম একজন রব্ব/প্রভু, ঠিক যেমনটি অবস্থা ছিলো (জাহেলীয়া যুগের) মূর্তি পূজারীদের, তাদের নিজেদের মূর্তিগুলোর ব্যাপারে। আল্লাহতা’লা আমাদের প্রতি অসীলা গ্রহণের আদেশ দিয়েছেন মর্মে কেউ বিশ্বাস করলে (প্রভুর নৈকট্য লাভে) এই অসীলা গ্রহণ আদেশদাতা আল্লাহতা’লারই এবাদত-বন্দেগী বলে সাব্যস্ত হবে।

আল-’উতবী (রা:)’এর বর্ণিত তাওয়াসসুলের ঘটনা 

হাফেয ইমাদউদ্দীন ইবনে কাসীর বলেন: 

ذكر جماعة منهم الشيخ أبو منصور الصباغ في كتابه الشامل (( الحكاية المشهورة )) عن العتبى قال: كنت جالساً عند قبر النبي صلى الله عليه وسلم فجاء أعرابي فقال السلام عليك يا رسول الله سمعت الله يقول: { وَلَوْ أَنَّهُمْ إِذ ظَّلَمُوۤاْ أَنْفُسَهُمْ جَآءُوكَ فَٱسْتَغْفَرُواْ ٱللهَ وَٱسْتَغْفَرَ لَهُمُ ٱلرَّسُولُ لَوَجَدُواْ ٱللهَ تَوَّاباً رَّحِيماً } وقد جئتك مستغفرً لذنبي مستشفعاً بك إلى ربي   

অর্থ: তাঁদের মধ্যে একটি জামা’আত, যেমন শায়খ আবূ মনসূর আল-সাব্বাগ (রহ:) তাঁর ‘আল-শামিল’ পুস্তকে, উল্লেখ করেন হযরত ’উতবী (রা:) হতে বর্ণিত প্রসিদ্ধ ঘটনাটি, যা’তে তিনি বলেন: আমি প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর পবিত্র রওযা শরীফের কাছে উপবিষ্ট ছিলাম; এমন সময় এক আরবীয় বেদুঈন আগমন করেন এবং বলেন, ‘এয়া রাসূলাল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) আপনার প্রতি শান্তিময় সালাম বর্ষিত হোক! আমি আল্লাহকে (তাঁর পাক কালামে) বলতে শুনেছি: আর যদি কখনো তারা (মো’মেন মুসলমানবৃন্দ) নিজেদের আত্মার প্রতি যুলূম করে, তখন হে মাহবূব, (তারা) আপনার দরবারে হাযির হয়, অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে, আর রাসূল-ও তাদের পক্ষে সুপারিশ করেন, তবে অবশ্যই তারা আল্লাহকে পরম তওবা কবূলকারী, দয়ালু পাবে [সূরা নিসা, ৬৪ আয়াত; তাফসীরে নূরুল এরফান]। এমতাবস্থায় আমি আপনার কাছে এসেছি আমার পাপের জন্যে মাফ চাইতে, আমার প্রভুর দরবারে আপনার সুপারিশ চাইতে।’ অতঃপর ওই বেদুঈন গান গাইতে লাগলেন – :ثم أنشد يقول

يا خير من دفنت بالقاع أعظمه :: فطاب من طيبهن القاع والأكم 

نفسي الفداء لقبر أنت ساكنه :: فيه العفاف وفيه الجود والكرم

হে মাটির গভীরে দাফন হওয়া সেরা পুণ্যাত্মা,

যাঁর সুঘ্রাণে গভীরতা ও উচ্চতা পেয়েছে সুমিষ্টতা,

আপনার রওযাস্থ আবাসের জন্যে উৎসর্গিত মোর আত্মা,

যেথা নিহিত শুচিতা, দানশীলতা ও বদান্যতা। [ভাবানুবাদ] 

ثم انصرف الأعرابي فغلبتني عيني فرأيت النبي صلى الله عليه وسلم في النوم فقال: [ إلحق الأعرابي فبشره أن الله قد غفر له ].

অর্থ: (’উতবী বলেন), বেদুঈন ব্যক্তি চলে যাওয়ার পরে আমায় নিদ্রা আচ্ছন্ন করে, আর আমি প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’কে স্বপ্নে দেখি, যিনি আমায় বলেন: “হে ‘উতবী, বেদুঈনের কাছে ছুটে যাও এবং তাকে সুসংবাদ দাও যে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।”

এই ঘটনাটি ইমাম নববী (رحمة الله عليه) তাঁর বিখ্যাত ‘আল-ঈদা’হ’ পুস্তকের ৬ষ্ঠ অধ্যায়ের ৪৯৮ পৃষ্ঠায় বর্ণনা করেছেন। এটা হাফেয ইবনে কাসীর কর্তৃক তাঁর প্রসিদ্ধ তাফসীরগ্রন্থে “(মো’মেন মুসলমানবৃন্দ) নিজেদের আত্মার প্রতি যুলূম করে” (সূরা নিসা, ৬৪) – আয়াতটির ব্যাখ্যায়ও উদ্ধৃত হয়েছে। এটা আরো বর্ণনা করেন ইমাম আবূ ক্বুদামা নিজ ‘আল-মুগনী’ (৩:৫৫৬) কিতাবে, শায়খ আবূল ফারাজ ইবনে ক্বুদামা তাঁর ‘আল-শরহুল কবীর’ (৩:৪৯৫) গ্রন্থে এবং শায়খ মানসূর ইবনে ইঊনুস আল-বাহূতী তাঁর রচিত হাম্বলী মাযহাবের অন্যতম প্রসিদ্ধ ‘কাশশাফুল ক্বিনা’ (৫:৩০) শীর্ষক পুস্তকে।

ক্বুরআন তাফসীরকারকদের মধ্যে নির্ভরযোগ্য ইমাম ক্বুরতুবী (رحمة الله عليه) নিজ ‘আল-জামে’ শীর্ষক সুপরিচিত তাফসীরগ্রন্থে আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করেন যা (আল-’উতবীর) এই ঘটনার অনুরূপ। হযরত ইমাম বলেন:

روى أبو صادق عن علي قال: قدم علينا أعرابي بعد ما دفنَّا رسول الله صلى الله عليه وسلم بثلاثة أيام فرمى بنفسه على قبر رسول الله صلى الله عليه وسلم وحثا على رأسه من ترابه فقال: قلت يا رسول الله فسمعنا قولك، ووعيت عن الله فوعينا عنك وكان فيما أنزل الله عليك (( وَلَوْ أَنَّهُمْ إِذ ظَّلَمُوۤاْ أَنْفُسَهُمْ ))..الآية، وقد ظلمت نفسي وجئتك تستغفر لي فنودي من القبر: إنه قد غفر لك.   

অর্থ: আবূ সাদিক্ব (রা:) বর্ণনা করেন যে হযরত আলী (كرّم الله وجهه) বলেছেন: রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)’কে (রওযা শরীফে) দাফনের তিন দিন পরে জনৈক বেদুঈন আরব আগমন করেন। তিনি প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর রওযা পাকে নিজেকে (মাটিতে) ছুঁড়ে সমর্পিত হন; আর রওযার ধুলো আপন শিরে মাখেন এবং বলেন: “এয়া রাসূলাল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)! আপনি বলেছেন আর আমরা আপনার বাণী শ্রবণ করেছি। আপনি আল্লাহতা’লার কাছ থেকে উপলব্ধি/সমঝদারি লাভ করেছেন, আর আমরা উপলব্ধি লাভ করেছি আপনার কাছ থেকে। আল্লাহতা’লা আপনার কাছে অবতীর্ণ করেছেন তাঁর পাক কালাম: ‘তারা যখন নিজেদের সত্তার প্রতি জুলূম করে’ – আমি নিজের প্রতি জুলুম করেছি এবং তাই আপনার দরবারে এসেছি যাতে আপনি আমার পক্ষে সুপারিশ করেন (আল্লাহর ক্ষমার জন্যে)।” অতঃপর রওযা পাকের ভেতর থেকে বেদুঈনকে উত্তর দেয়া হয়: “তোমাকে ক্ষমা করা হয়েছে।” [তাফসীরে ক্বুরতুবী, ৫:২৬৫]

অতএব, এই হচ্ছে আল-’উতবীর ঘটনা এবং এ ঘটনা এই সকল (আলেম-উলামা) উদ্ধৃত করেছেন। এ রওয়ায়াত/বিবরণটি বিশুদ্ধ না দুর্বল তা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। বর্ণনাকারী বিদ্বানমণ্ডলী কি এমন বিষয় উদ্ধৃত করেছেন যা শির্ক/অংশীবাদ ও পথভ্রষ্টতা? তাঁরা কি এমন কিছু উদ্ধৃত করেছেন যা মূর্তিপূজা ও মাযারপরস্তিকে আমন্ত্রণ করে আনে? তা-ই যদি সত্যি হতো, তাহলে তাঁদের বা তাঁদের বইপত্রের মাঝে কী নির্ভরযোগ্যতা খুঁজে পাওয়া যেতো? হে প্রভু, মহিমা আপনারই, (কেননা) এ তো এক স্পষ্ট অপবাদ!

রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর রওযার বাইরে ধাতুর গ্রিলের ওপর আল-’উতবী’র কাব্যের ছত্র

প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর রওযা শরীফ যেয়ারতকালে আরব বেদুঈন ব্যক্তি কাব্যের যে সব শ্লোক গেয়েছিলেন, সেগুলো আল-’উতবী উল্লেখ ও বর্ণনা করেছেন। সেগুলো হলো:

يا خير من دفنت بالقاع أعظمه :: فطاب من طيبهن القاع والأكم 

نفسي الفداء لقبر أنت ساكنه :: فيه العفاف وفيه الجود والكرم

হে মাটির গভীরে দাফন হওয়া সেরা পুণ্যাত্মা,

যাঁর সুঘ্রাণে গভীরতা ও উচ্চতা পেয়েছে সুমিষ্টতা,

আপনার রওযাস্থ আবাসের জন্যে উৎসর্গিত মোর আত্মা,

যেথা নিহিত শুচিতা, দানশীলতা ও বদান্যতা। [ভাবানুবাদ]

আল্লাহর ফযল তথা অনুগ্রহে এ কয়টি ছত্র রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)’এর পবিত্র হুজরাহ বা ঘরে অবস্থিত রওযা মোবারকের বাইরে ধাতুর গ্রিল ও পবিত্র স্তম্ভের মধ্যবর্তী কাঠামোতে লিপিবদ্ধ আছে। এটা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সবাই এবং প্রত্যেকেই দেখেছেন – এমন কী বাদশাহ আবদুল আযীয, রাজা সৌদ, বাদশাহ ফায়সাল ও রাজা খালিদ নিজ নিজ শাসনামলে দেখেছেন; আর এখন বাদশাহ ফাহদ যিনি হারামাইন শরীফাইনের খাদিম তথা রক্ষণাবেক্ষণকারী, তিনিও দেখছেন। আল্লাহতা’লার অনুমতিক্রমে এটা এখানেই থাকবে, যেমনিভাবে হারামাইন শরীফাইনের খাদেমদার পবিত্র মসজিদে নববীতে অবস্থিত সমস্ত কিছুর রক্ষণাবেক্ষণ করার নির্দেশ দেন এবং এর কোনো পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন হতে কোনো কিছু অপসারণ না করেন।

সংক্ষিপ্তসার

والخلاصة أنه مما لا شك فيه أن النبي صلى الله عليه وسلم له عند الله قدر علِيّ ومرتبة رفيعة ، وجاه عظيم ، فأي مانع شرعي أو عقلي يمنع التوسل به فضلاً عن الأدلة التي تثبته في الدنيا والآخرة ــ ولسنا في ذلك سائلين غير الله تعالى ولا داعين إلا إياه فنحن ندعوه بما أحب أياً كان ، تارة نسأله بأعمالنا الصالحة لأنه يحبها وتارة نسأله بمن يحبه من خلقه كما في حديث آدم السابق ، وكما في حديث فاطمة بنت أسد الذي ذكرناه ، وكما في حديث عثمان بن حنيف المتقدم ، وتارة نسأله بأسمائه الحسنى كما في قوله ــ صلى الله عليه وسلم ــ [أسألك بأنك أنت الله] أو بصفته أو فعله كما في قوله في الحديث الآخر : [أعوذ برضاك من سخطك وبمعافاتك من عقوبتك] ، وليس مقصورًا على تلك الدائرة الضيقة التي يظنها المتعنتون .

অর্থ: সংক্ষেপে (বলতে গেলে), এতে কোনো সন্দেহ নেই যে প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) উচ্চ মর্তবা-মর্যাদার অধিকারী এবং আল্লাহর কাছে রয়েছে তাঁর সর্বোচ্চ মক্বাম। অতঃপর এরই পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর মধ্যস্থতায় তাওয়াসসুল/অসীলা গ্রহণে কী (শরঈ) বিধানগত নিষেধাজ্ঞা অথবা যৌক্তিক বাধা থাকতে পারে? ইহকালীন ও পরকালীন জীবনে এর সপক্ষে ঘোষণা দানকারী প্রামাণিক দলিলের উল্লেখ না-ই বা করা হলো। এক্ষেত্রে আমরা তো মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে চাচ্ছি না; তিনি ছাড়া অন্য কারো কাছে প্রার্থনাও করছি না। আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি তাঁরই মহব্বত-প্রাপ্তের মাধ্যমে – তা যা-ই হোক না কেন। কখনো কখনো আমরা তাঁর কাছে চাই আমাদের নিজেদের পুণ্যকর্মের খাতিরে, কেননা তিনি সেগুলোকে পছন্দ করেন। আর কখনো কখনো আমরা তাঁর সৃষ্টিকুলের মাঝে তাঁরই প্রিয়ভাজন কারো মধ্যস্থতায় যাচ্ঞা করি, যেমনটি (দেখা যায়) পয়গাম্বর আদম (আলাইহিস্ সালাম)’এর তাওয়াসসুল-সম্বলিত (ইতিপূর্বে উদ্ধৃত) হাদীস শরীফে; অথবা (আমাদের উদ্ধৃত) হযরত ফাতিমা বিনতে আসাদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’এর বিবরণসম্বলিত হাদীস শরীফে; কিংবা (আমাদের উদ্ধৃত) হযরত উসমান বিন হুনাইফ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর বিবরণসম্বলিত হাদীস শরীফেও। কখনো কখনো আমরা আল্লাহতা’লার সুন্দরতম নাম মোবারকের মাধ্যমেও যাচ্ঞা করি, যেমনটি রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) ফরমান – أسألك بأنك أنت الله – “আমি আপনার দরবারে চাই এ বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে যে, আপনি হলেন আল্লাহতা’লা।” অথবা (আমরা যাচ্ঞা করি) তাঁরই সীফাত/গুণাবলী বা কর্মের মাধ্যমে, যেমনটি বিবৃত হয়েছে রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)’এর অপর এক হাদীস শরীফে – أعوذ برضاك من سخطك وبمعافاتك من عقوبتك – “আমি আপনার সন্তুষ্টি অন্বেষণ করি আপনারই রাগ হতে (বেঁচে); এবং আপনার ক্ষমা প্রার্থনা করি আপনারই শাস্তি হতে (বেঁচে)।” কতিপয় উগ্রবাদীর ধারণাকৃত সংকীর্ণ বৃত্তে এই বিষয়টি (মোটেও) আবদ্ধ নয়।            

এই বিষয়টির পেছনে গোপন রহস্য হলো, আল্লাহতা’লার পছন্দনীয় সব কিছুকেই তাওয়াসসুলের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে, আর এর পাশাপাশি আম্বিয়া (আলাইহিমুস্ সালাম) বা আউলিয়া (রহমতুল্লাহি আলাইহিম)’বৃন্দের যাঁরা আল্লাহকে ভালোবাসেন তাঁদেরকেও অসীলা করা সিদ্ধ। এ বিষয়টি এমন প্রত্যেক ব্যক্তির কাছে স্পষ্ট, যাঁদের বিবেক/সুবিবেচনা বিদ্যমান (فطرة سليمة)। এটাকে মানা বা নিষেধ করার মতো কোনো যৌক্তিক বা নক্বলী/শরঈ দলিল নেই, বরঞ্চ আক্বলী/যৌক্তিক ও নক্বলী/শরঈ দলিল এটার জায়েয বা বৈধ হওয়ার পক্ষে সমর্থন জোগায়। এক্ষেত্রে যাঁর কাছে চাওয়া হয়, তিনি খোদ আল্লাহতা’লা-ই, যিনি এক এবং যাঁর কোনো অংশীদার নেই; কোনো নবী বা ওলী অথবা জীবিত কিংবা মৃত ব্যক্তির কাছে চাওয়া হয় না। (যেমনটি আল্লাহতা’লা ফরমান) – 

قُلْ كُلٌّ مِّنْ عِندِ ٱللهِ فَمَالِ هَـٰؤُلاۤءِ ٱلْقَوْمِ لاَ يَكَادُونَ يَفْقَهُونَ حَدِيثاً

অর্থ: হে রাসূল বলুন, ‘সব কিছু আল্লাহর কাছ থেকেই (আগত)। কাজেই ওই সব লোকের কী হলো? তারা কোনো কথা বুঝছে বলে মনে হয় না।’ [আল-ক্বুরআন, ৪:৭৮; নূরুল ইরফান]

কারো আমল তথা পুণ্যকর্মের অসীলায় যদি চাওয়া জায়েয হয়, তাহলে নবী করীম (صلى الله عليه وسلم)’এর মধ্যস্থতায় চাওয়া (অবশ্যই) জায়েয এই মুখ্য কারণে যে, তিনি সৃষ্টিকুল শিরোমণি এবং তাঁর আমলগুলো ওই সূত্র হতে নিঃসৃত। আল্লাহতা’লা আমাদের আমলসমূহ বা অন্য যে কোনো জিনিসের চেয়ে তাঁকে বেশি ভালোবাসেন (والله أعظم حبَّاً له ــ صلى الله عليه وسلم ــ من الأعمال وغيرها)। এটাকে কোন্ বিষয়টি নিষেধ করে তা আমি অনুধাবন করতে পারি না, যেখানে (ওপরে) ব্যবহৃত অভিব্যক্তিটি আর কিছুকে ইঙ্গিত করে না স্রেফ এই বিবৃতি ছাড়া যে আল্লাহর কাছে প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর কদর বা মর্যাদা রয়েছে? তাওয়াসসুল পালনকারী ব্যক্তি এ ছাড়া আর অন্য কোনো অর্থে এটাকে উদ্দেশ্য করেন না। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর দরবারে প্রিয়নবী ((صلى الله عليه وسلم)’এর মর্যাদাকে অস্বীকার করে সে একজন অবিশ্বাসী, যেমনটি আমরা ইতিপূ্র্বে বিবৃত করেছি।

وبعد: فمسألة التوسل تدل على عظمة المسؤول به ومحبته، فالسؤال بالنبي إنما هو لعظمته عند الله أو لمحبته إياه وذلك مما لاشك فيه على أن التوسل بالأعمال متفق عليه، فلماذا لا نقول: إن من يتوسل بالأنبياء أو الصالحين هو متوسل بأعمالهم التي يحبها الله، وقد ورد حديث أصحاب الغار فيكون من محل الاتفاق؟ .

অর্থ: পরিশেষে (বলবো), তাওয়াসসুলের বিষয়টি সেই পুণ্যাত্মার শ্রেষ্ঠত্ব ও তাঁর প্রতি ভালোবাসা ইঙ্গিত করে, যাঁর খাতিরে (আল্লাহর কাছে) চাওয়া হয়। আল্লাহর দরবারে প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর অসীলায় চাওয়া হয় স্রেফ তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব/মাহাত্ম্যের খাতিরে, অথবা তাঁর প্রতি আল্লাহর ভালোবাসার ওয়াস্তে; আর এতে কোনো সন্দেহ-ই নেই, কেননা আমলের (পুণ্যকর্মের) মাধ্যমে তাওয়াসসুল পালনের ব্যাপারটিতে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত। তাহলে আমরা কেন এ কথা বলি না যে, আম্বিয়া (আলাইহিমুস্ সালাম) ও আউলিয়া (রহমতুল্লাহি আলাইহিম)’মণ্ডলীর মাধ্যমে তাওয়াসসুল পালনকারী ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে তাঁদেরই নেক আমল/পুণ্যদায়ক কর্ম যা আল্লাহ ভালোবাসেন, তার মাধ্যমে তাওয়াসসুল পালন করছেন? গুহায় (আটক) ব্যক্তিবৃন্দ সংক্রান্ত হাদীসটি তো ইতিপূর্বে উল্লেখিত হয়েছে, যার ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত।

ولا شك أن المتوسل بالصالحين إنما يتوسل بهم من حيث أنهم صالحون فيرجع الأمر إلى الأعمال الصالحة المتفق على جواز التوسل بها، كما قلنا في صدر هذا البحث.

অর্থ: এতে কোনো সন্দেহ নেই, যে ব্যক্তি পুণ্যাত্মা/আউলিয়া কেরাম (রহমতুল্লাহে আলাইহিম)’মণ্ডলীর মধ্যস্থতায় তাওয়াসসুল পালন করেন, তিনি তা করেন কেবল তাঁদেরই পুণ্যবান হওয়ার কারণে। অতএব, এই বিষয়টি পুণ্যদায়ক কর্মের বিধানের দিকেই ফিরে যায়, আর পুণ্যদায়ক আমল তথা কর্মের মাধ্যমে তাওয়াসসুল পালন জায়েয বা বৈধ, যেমনটি আমরা এই গবেষণামূলক আলোচনার প্রারম্ভে উল্লেখ করেছি।

এক প্রত্যাখ্যাত সন্দেহ

এসব হাদীস ও আ’সার/বাণী তাওয়াসসুল তথা অসীলা গ্রহণকে সাবেত (প্রতিষ্ঠা) করে এবং সমর্থন যোগায়। অতঃপর কেউ যদি আপত্তি ‍উত্থাপন করে এ কথা বলে, “এটা তাঁর (মানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের) হায়াতে জিন্দেগীর জন্যে খাস বা সুনির্দিষ্ট,” তাহলে এর জবাব হলো: এই (আরোপকৃত) সীমাবদ্ধতার পক্ষে কোনো (শরঈ) দালিলিক প্রমাণ নেই; বিশেষ করে যখন (এ কথা) ঘোষিত হয়েছে যে রূহ অস্তিত্বশীল থেকে যায়, আর এরই দ্বারা অনুভূতি, উপলব্ধি ও সংবেদনশক্তির উদ্ভব হয়। আহলুস্ সুন্নাহ’র মাযহাব তথা পথ ও মত অনুসারে, বেসাল-প্রাপ্তজন শ্রবণ, অনুভব, উত্তম বিষয় হতে ফায়দা গ্রহণ ও আনন্দ লাভ করতে পারেন; আর মন্দ বিষয় দ্বারা তিক্ত-বিরক্ত ও দুঃখভারাক্রান্ত হতে পারেন। এটা প্রত্যেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এ কারণেই প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) বদরের যুদ্ধের দিনে অবিশ্বাসী ক্বুরাইশ গোত্রের মধ্যে ক্বুলাইব গোষ্ঠীকে সম্বোধন করে বলেন – يا عتبة يا شيبة يا ربيعة – “ওহে উতবাহ, ওহে শায়বাহ, ওহে রাবি’আহ।” এমতাবস্থায় তাঁকে বলা হয় – كيف تناديهم وقد جيفوا؟ – “আপনি কীভাবে তাদেরকে আহ্বান করছেন, যেখানে তারা ইতোমধ্যেই মারা গিয়েছে?” তিনি এর উত্তরে বলেন – ما أنتم بأسمع منهم لكنهم لا يستطيعون الجواب – “তোমরা তাদের মতো এতো ভালোভাবে শুনতে পাও না, কিন্তু তারা জবাব প্রদানে অক্ষম।”

যদি এ ব্যাপারটি সর্বসাধারণের বেলাতেই প্রযোজ্য হয়, তাহলে মনুষ্যকুলশ্রেষ্ঠ ও তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত এবং সেরা সত্তার ক্ষেত্রে কী অবস্থা হবে? এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, তিনি অধিকতর পূর্ণতাপ্রাপ্ত ও নিখুঁত – অনুভব করার বেলায়, উপলব্ধির ক্ষেত্রে, আর অনুভূতির ক্ষেত্রেও। অসংখ্য হাদীস শরীফে এ কথা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে যে তিনি (মানুষের) কথাবার্তা শোনেন, সালাম-সম্ভাষণের প্রত্যুত্তর দেন এবং উম্মতের আমলনামা তাঁর সামনে পেশ/উপস্থাপন করা হয়; আর তিনি তাঁদের মন্দ আমলের কারণে (আল্লাহর দরবারে তাঁদের পক্ষে) সুপারিশ করেন এবং তাঁদের নেক আমলের জন্যে আল্লাহর প্রশংসা করেন।

মানবের প্রকৃত মূল্য তাঁর ইন্দ্রিয়গুলো, অনুভূতি ও উপলব্ধির ওপর নির্ভরশীল, স্রেফ তাঁর হায়াতে জিন্দেগীর ওপর নির্ভরশীল নয়। এ কারণেই আমরা অনেক জিন্দা লোককে দেখতে পাই যাদের মানবিক অনুভূতি ও আবেগগুলো আল্লাহতা’লা কর্তৃক নিরুদ্ধ হয়েছে; এর পাশাপাশি তাদের রয়েছে আহাম্মকিপূর্ণ স্বভাব ও রুচির অভাব; অতএব, তারা উপকার লাভ করেনি; বরঞ্চ, তারা মৃতদের শ্রেণিভুক্ত; আর আল্লাহরই কাছে আশ্রয় যাচিত।

মহানবী (দ:) শোনেন না, দেখেন না এবং আমাদের জানেনও না মর্মে অজ্ঞ লোকদের দাবি

ومن هؤلاء الموتى من زعم أن النبي صلى الله عليه وسلم لا يسمع ولا يرى ولا يعرف عنا ولا يدعو الله تعالى لنا، فأي جراءة أعظم من هذا ؟ وأي جهل أقبح من هذا ؟ إضافة إلى سوء الأدب والانتقاص لقدر النبي صلى الله عليه وسلم، ولقد تضافرت الأحاديث والآثار التي تثبت أن الميت يسمع ويحس ويعرف سواء أكان مؤمناً أم كافرًا .

قال ابن القيم في كتاب الروح : والسلف مجمعون على هذا وقد تواترت الآثار عنهم .

অর্থ: আর ওপরে উল্লেখিত মৃত লোকদের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যে দাবি করে প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) কিছুই শোনেন না, দেখেন না, অথবা আমাদের সম্পর্কে জানেন না, কিংবা আমাদের পক্ষে আল্লাহর দরবারে দুআ তথা সুপারিশ-ও করেন না। অতএব, এর চেয়ে বড় গোস্তাকি আর কী হতে পারে এবং এর চেয়ে কুৎসিত অজ্ঞতা আর কী-ই বা হতে পারে, যা মন্দ আচরণের সাথে সম্বন্ধযুক্ত এবং প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর উচ্চমর্যাদাকে হেয় প্রতিপন্নকারী? নিশ্চয় প্রচুর পরিমাণে আহাদীস (হাদীসসমূহ) ও আ’সার (বাণী) বিদ্যমান রয়েছে, যেগুলো সাবেত/প্রমাণ করে যে ইন্তেক্বাল-প্রাপ্তজন শোনেন, অনুভব করেন এবং জানেন – চাই তিনি হোন মুসলমান, অথবা অমুসলমান। ইবনে ক্বাইয়্যেম আল-জাওযিয়্যা নিজ ‘কিতাবুর রূহ’ পুস্তকে বলেন: “সালাফ আস-সালেহীন (প্রাথমিক যুগের পুণ্যাত্মাবৃন্দ) এই বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেছিলেন এবং এরই ভিত্তিতে ‘তাওয়াতুর’ তথা ব্যাপক জনশ্রুতিমূলক বিবরণ তাঁদের কাছ থেকে এসেছে।”

এ বিষয়ে ইবনে তাইমিয়্যাকেও জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো এবং তিনি এর সমর্থনে শরঈ ফতোয়া জারি করেছিলেন (রেফারেন্স: ‘আল-ফাতাওয়া’, ২৪:৩৩১-৩৬২)।

فإذا كان هذا في حق عامة البشر فما بالك بعامة المؤمنين بل بخاصة عباد الله الصالحين بل بسيد الأولين والآخرين سيدنا محمد صلى الله عليه وسلم ، وقد فصلنا هذه المسألة في مبحث خاص بها في كتابنا هذا بعنوان : (( الحياة البرزخية حياة حقيقية )) بعنوان (( حياة خاصة بالنبي صلى الله عليه وسلم )) . 

অর্থ: অতঃপর এই যদি প্রকৃত ব্যাপার হয় মানবের আ’ম তথা সাধারণতার ক্ষেত্রে, তাহলে ঈমানদারবৃন্দের (প্রকৃত) সাধারণতা আপনি কী বলে মনে করেন? না, বরঞ্চ আল্লাহর খাস/বিশেষ পুণ্যাত্মা বান্দা-বৃন্দের, না, বরঞ্চ মনুষ্যজাতির প্রথমজন ও তাঁদের সর্বশেষজনের সাইয়্যেদ/ইমাম আমাদের মনিব মহানবী (صلى الله عليه وسلم)’এর (প্রকৃত) সাধারণতা কী বলে আপনি মনে করেন? আমরা এই বইয়ের মধ্যে একটি সুনির্দিষ্ট গবেষণায় এ বিষয়ে আলোকপাত করেছি, যার শিরোনাম: ‘বরযখ/পরকালীন জীবন-ই প্রকৃত জীবন’ এবং ‘প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর খাস্/সুনির্দিষ্ট জীবন।’

তাওয়াসসুল সমর্থক মুসলমানদের ইমামবৃন্দ (রহ:)            

আমরা এখানে সেসব সুপ্রসিদ্ধ শীর্ষস্থানীয় ইমামবৃন্দ ও সুন্নাতের হেফাজতকারীদের নাম উল্লেখ করবো, যাঁরা তাওয়াসসুলের প্রবক্তা, কিংবা এর পক্ষে প্রামাণ্য দলিল পেশ করেছেন। 

১/ – ইমাম হাফেজ আবূ আবদিল্লাহ হাকিম (রহ:) প্রণীত ‘আল-মুসতাদরাক আ’লাল সহীহাইন’ (المستدرك على الصحيحين) পুস্তক; এতে তিনি পয়গাম্বর আদম (আলাইহিস্ সালাম) কর্তৃক প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর মধ্যস্থতায় পালিত তাওয়াসসুলের হাদীসটি উদ্ধৃত করেন এবং তা সহীহ মর্মে নিশ্চিত করেন। 

২/ – হাফেজ আবূ বকর আল-বায়হাক্বী (রহ:) রচিত ‘দালায়েলুন্ নুবূওয়্যাহ’ (دلائل النبوة) গ্রন্থ; তিনি এতে পয়গাম্বর আদম (আলাইহিস্ সালাম)’এর হাদীসটি ও অন্যান্য বিবরণও উল্লেখ করেন। তিনি (বইটিতে) প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন কোনো জাল বর্ণনা উদ্ধৃত করবেন না। 

৩/ – ইমাম হাফেজ জালালউদ্দীন সৈয়ূতী (রহ:) লিখিত ‘আল-খাসায়েসুল কু্বরা’ (الخصائص الكبرى) কিতাব; তিনি এতে পয়গাম্বর আদম (আলাইহিস্ সালাম)’এর তাওয়াসসুলের হাদীসটি উদ্ধৃত করেন।

৪/ – ইমাম হাফেজ আবূল ফারাজ ইবনিল জাওযী কৃত ‘আল-ওয়াফা’ (الوفاء) বই; এতে তিনি (আদম আলাইহিস্ সালামের) হাদীসটি এবং অন্যান্য বিবরণও উদ্ধৃত করেন।

৫/ – ইমাম হাফেজ ক্বাজী আয়াজ (রহমতুল্লাহে আলাইহে) রচিত ‘আশ্ শিফা ফীত্ তা’রিফে বি-হুক্বূক্বিল মুস্তফা’ (الشفا في التعريف بحقوق المصطفى) গ্রন্থ; তিনি এ বইয়ের মধ্যে মহানবী (صلى الله عليه وسلم)’এর যেয়ারত ও তাঁর গুণগত বৈশিষ্ট্য শীর্ষক অধ্যায়গুলোতে এসব (বিবরণ) হতে অনেকগুলো উদ্ধৃত করেন। 

৬/ – ইমাম শায়খ নূরুদ্দীন আল-ক্বারী, যিনি মোল্লা আলী ক্বারী নামে সুপরিচিত, তিনি নিজ লিখিত ‘শরহে শিফা’ (شرح الشفا) শিরোনামের ব্যাখ্যামূলক পুস্তকে ওপরে উল্লেখিত একই বিষয়ে (বিবরণগুলো) উদ্ধৃত করেন।

৭/ – আল্লামা আহমদ শিহাবউদ্দীন খাফফাজী (রহ:) নিজ প্রণীত ’শিফা শরীফ’ পুস্তকের ব্যাখ্যামূলক ‘নাসীম আল-রিয়্যাদ’ (نسيم الرياض) বইয়ে একই বিষয়গুলো উল্লেখ করেন।

৮/ – ইমাম হাফেজ আল-ক্বসতলানী (রহ:) তাঁর লিখিত ‘আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া’ (المواهب اللدنية) পুস্তকের প্রথম অংশে (এ বিষয়ে উল্লেখ করেন)।

৯/ – আল্লামা শায়খ মুহাম্মদ আবদুল বাক্বী আল-যুরক্বানী (রহ:) ‘আল-মাওয়াহিব’ (১:৪৪) গ্রন্থের নিজ ব্যাখ্যামূলক কিতাবে (شرح المواهب)।

১০/ – ইমাম শায়খুল ইসলাম আবূ জাকারিয়্যা ইয়াহইয়া আল-নববী (রহ:) আপন ‘আল-ইদাহ’ (الإيضاح) বইয়ে (৬:৪৯৮)।

১১/ – আল্লামা ইবনে হাজর আল-হায়সামী (রহ:) ‘আল-ইদাহ’ পুস্তকের ওপর লেখা নিজ হাশিয়া/পার্শ্বটীকায়, ৪৯৯ পৃষ্ঠায়। তাঁর এতদসংক্রান্ত আরেকটি বই আছে যার শিরোনাম ‘আল-জওহারুল মুনাযযাম’ (الجوهر المنظم)।

১২/ হাফেজ শিহাবউদ্দীন ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আল-জাওযী আল-দিমাশক্বী নিজের রচিত ‘আল-হিসন আল-হাসিন’ (الحصن الحصين) গ্রন্থে, দুআ’র আদব-সংক্রান্ত ফযীলত অংশে। 

১৩/ – আল্লামা ইমাম মুহাম্মদ ইবনে আলী আল-শওকানী আপন ‘তোহফাতুয্ যা’কিরীন’ (تحفة الذاكرين) পুস্তকের ১৬১ পৃষ্ঠায়।

১৪/ – আল্লামা ইমাম ও মুহাদ্দিস আলী ইবনে আবদিল কাফী আল-সুবকী (রহ:) তাঁর ‘শিফাউস্ সিক্বাম ফী যিয়ারাতি খায়রিল আনাম’ (شفاء السقام في زيارة خير الأنام) কিতাবে।

১৫/ – হাফেজ ইমাদুদ্দীন ইবনে কাসীর কালামুল্লাহ শরীফ তথা ঐশীবাণী – وَلَوْ أَنَّهُمْ إِذ ظَّلَمُوۤاْ أَنْفُسَهُمْ – ‘যদি তারা নিজেদের সত্তার প্রতি জুলুম করার পরে…’ (সূরা নিসা, ৬৪) মর্মে আয়াতটির তাফসীরে আল-উতবী বর্ণিত সেই বেদুঈনের ঘটনার কথা উল্লেখ করেন, যিনি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর কাছে শাফাআত চাইবার নিয়্যতে তাঁর রওযা শরীফ যিয়ারত করেছিলেন; আর তিনি (ইবনে কাসীর) কোনো বিষয় দ্বারা এর বিরোধিতা করেননি। তিনি পয়গাম্বর আদম (আলাইহিস্ সালাম) কর্তৃক মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর তাওয়াসসুল পালনের (মানে অসীলা গ্রহণের) ঘটনাও আপন ‘আল-বিদায়া ওয়ান্ নিহায়া’ (البداية والنهاية) পুস্তকে উল্লেখ করেন এবং এ বিবরণকে জাল বলে হুকুম দেননি (১:১৮০)। ইবনে কাসীর সেই ব্যক্তির ঘটনাও বর্ণনা করেন যিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর রওযা পাকে যেয়ে তাঁর মধ্যস্থতায় তাওয়াসসুল পালন করেছিলেন। ইবনে কাসীর (এ প্রসঙ্গে) বলেন: “এর এসনাদ (তথা বর্ণনাকারীদের পরম্পরা) সহীহ (إن إسنادها صحيح)” [১:৯১]। ইবনে কাসীর আরো উল্লেখ করেন যে মুসলমানবৃন্দের রণহুঙ্কার ছিলো “হে মুহাম্মদ (يا محمداه – صلى الله عليه وسلم) [৬:৩২৪]!”

১৬/ – ইমাম হাফেজ ইবনে হাজর আসক্বালানী (রহ:) যিনি প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর রওযা পাকে গমনকারী ব্যক্তির দ্বারা তাঁর তাওয়াসসুল পালনের ঘটনাটি উল্লেখ করেন এবং নিজ ‘ফাতহুল বারী’ (فتح الباري) গ্রন্থে (২:৪৯৫) উক্ত রওয়ায়াত/বিবরণের এসনাদ বিশুদ্ধ বলে সিদ্ধান্ত দেন।

১৭/ – ইমাম ও তাফসীরবিদ আবূ আবদুল্লাহ ক্বুরতূবী (রহ:) নিজ তাফসীরগ্রন্থে (৫:২৬৫) আল্লাহতা’লার পাক কালাম – وَلَوْ أَنَّهُمْ إِذ ظَّلَمُوۤاْ أَنْفُسَهُمْ – ‘যদি তারা নিজেদের সত্তার প্রতি জুলুম করার পরে…’ (সূরা নিসা, ৬৪) মর্মে আয়াতটির ব্যাখ্যায় (এ বিষয়ে লেখেন)।

মহানবী (দ:)-এর শাফায়াত অন্বেষণ করেন সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)

কেউ কেউ দাবি করেছেন যে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর (প্রকাশ্য) হায়াতে জিন্দেগীতে তাঁর কাছে শাফাআত বা সুপারিশ চাওয়া না-জায়েয; না, বরঞ্চ সীমালঙ্ঘনকারীদের মধ্যে অন্যরা এতোদূর গিয়েছে যে তারা এটাকে শির্ক ও পথভ্রষ্টতা পর্যন্ত আখ্যা দিয়েছে। তারা এটা প্রমাণ করতে আল্লাহর বাণী উদ্ধৃত করেছে, যেখানে মহান প্রভু ফরমান – قُل لِلهِ ٱلشَّفَاعَةُ جَمِيعاً – “(হে রাসূল) আপনি বলুন, সুপারিশ তো সবই আল্লাহর হাতে” [সূরা যুমার, ৪৪; নূরুল এরফান]। আয়াতটি হতে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ মিথ্যে/ভ্রান্তি, আর এ আয়াত তাদের ত্রুটিপূর্ণ উপলব্ধিকে সমর্থন করে না নিম্নের দুটি কারণে:

প্রথমতঃ ক্বুরআন বা সুন্নাহ’তে এমন নস্ বা প্রামাণ্য দলিল বিদ্যমান নেই, যা প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর যাহেরী/প্রকাশ্য জিন্দেগীতে তাঁর কাছে শাফাআত অন্বেষণ করাকে নিষেধ করে।

দ্বিতীয়তঃ উক্ত আয়াত এটাকে (অর্থাৎ, ভ্রান্তদের দাবিকে) মোটেও প্রতিষ্ঠা বা প্রমাণ করে না। বরঞ্চ এর প্রকৃতি অন্যান্য আয়াতে করীমার মতোই, যেগুলোতে আল্লাহতা’লার খাস্ তথা সুনির্দিষ্ট/একক মালিকানা ব্যক্ত হয়েছে সেসব বিষয়ে, যা স্রেফ তাঁরই, অন্য কারোর নয়। এর মানে তিনি-ই এগুলোর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখেন। কিন্তু এর দ্বারা তিনি যাঁকে ইচ্ছা তাঁকে তা দান করার ব্যাপারটি নাকচ হয়ে যায় না, যদি তিনি দানের ইচ্ছা/এরাদা করেই থাকেন। তিনি হলেন শাহেনশাহ বা রাজাধিরাজ (বাদশাহদের বাদশাহ)। তিনি যাঁকে চান রাজত্ব দান করেন; আবার যাকে ইচ্ছা তার থেকে রাজত্ব কেড়েও নেন। এটা তাঁরই ঐশীবাণীর প্রতিধ্বনি – لَهُ ٱلْمُلْكُ وَلَهُ ٱلْحَمْدُ – “রাজ্য তাঁরই এবং তাঁরই জন্যে সমস্ত প্রশংসা” [সূরা তাগাবুন, ১ আয়াত; নূরুল এরফান]। 

আল্লাহ পাক নিজেকে বর্ণনা করতে যেয়ে বলেছেন তিনি ‘মালিকুল মুলক্’ বা ’বাদশাহর বাদশাহ,’ আবার একই সময়ে ঘোষণা করেছেন – تُؤْتِي ٱلْمُلْكَ مَن تَشَآءُ وَتَنزِعُ ٱلْمُلْكَ مِمَّنْ تَشَآءُ – “আপনি (আল্লাহ) যাঁকে চান সাম্রাজ্য প্রদান করেন এবং যার থেকে চান সাম্রাজ্য ছিনিয়ে নেন” [সূরা আলে ইমরান, ২৬ আয়াত; নূরুল ইরফান]। আর তিনি (অন্যত্র) ঘোষণা করেন – مَن كَانَ يُرِيدُ ٱلْعِزَّةَ فَلِلَّهِ ٱلْعِزَّةُ جَمِيعاً – “যে কেউ সম্মান চায়, তবে সম্মান তো সব আল্লাহরই হাতে” [সূরা ফাতির, ১০ আয়াত; নূরুল ইরফান]। তিনি আরো ঘোষণা করেন – وَلِلهِ ٱلْعِزَّةُ وَلِرَسُولِهِ وَلِلْمُؤْمِنِينَ – “আর সম্মান তো আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মু’মিনদের জন্যেই” [সূরা মুনাফিক্বূন, ৮ নং আয়াত; নূরুল ইরফান]। 

অনূরূপভাবে, শাফাআত/সুপারিশ সম্পর্কে আল্লাহ ফরমান – قُل لِلهِ ٱلشَّفَاعَةُ جَمِيعاً – “(হে রাসূল) আপনি বলুন: সুপারিশ তো সবই আল্লাহর হাতে” [সূরা যুমার, ৪৪ আয়াত; নূরুল ইরফান]। আর তিনি (অন্যত্র) ঘোষণা করেন – لاَّ يَمْلِكُونَ ٱلشَّفَاعَةَ إِلاَّ مَنِ ٱتَّخَذَ عِندَ ٱلرَّحْمَـٰنِ عَهْداً – “লোকেরা সুপারিশের মালিক নয়, কিন্তু ওই সব লোক (মালিক), যারা পরম দয়াময়ের কাছে অঙ্গীকার করে রেখেছে” [সূরা মরিয়ম, ৮৭; নূরুল ইরফান]। তিনি আরো ফরমান – وَلاَ يَمْلِكُ ٱلَّذِينَ يَدْعُونَ مِن دُونِهِ ٱلشَّفَاعَةَ إِلاَّ مَن شَهِدَ بِٱلْحَقِّ وَهُمْ يَعْلَمُونَ – “এবং এরা (মানে কুফফার) আল্লাহ ছাড়া যেগুলোর পূজা করছে, সেগুলো সুপারিশের ক্ষমতা রাখে না। হ্যাঁ, সুপারিশের ক্ষমতা তাদেরই রয়েছে যারা সত্যের সাক্ষ্য দিয়েছে এবং জ্ঞান রাখে” [সূরা যুখরুফ, ৮৬ আয়াত; নূরুল ইরফান]।

অতএব, আল্লাহ যেমন যাঁকে ইচ্ছা দান করেন, যা ইচ্ছা তা-ই দান করেন, ঠিক তেমনিভাবে তিনি আপন ইচ্ছানুযায়ী তাঁর (প্রিয়) পয়গাম্বর (আলাইহিমিস সালাম)’বৃন্দ ও ঈমানদার-মণ্ডলীকেও সম্মান দান করে থাকেন – আর এ ক্ষেত্রে সুপারিশের মর্যাদা দান করে থাকেন। এটা তাঁর মালিকানাধীন বটে, তবু তিনি তাঁরই আম্বিয়া-বৃন্দ (আলাইহিমুস্ সালাম) ও পুণ্যবান বান্দা-মণ্ডলী (রহমতুল্লাহি আলাইহিম), না, বরঞ্চ সাধারণ ঈমানদার মুসলমানদের মধ্যে অনেককেই তা মঞ্জুর করেছেন, ঠিক যেমনটি সহীহ হাদীসসমূহে সেগুলোর অর্থগত দিক দ্বারা ব্যাপকভাবে বর্ণিত হয়েছে (كذلك الشفاعة كلها له وقد أعطاها للأنبياء وعباده الصالحين بل وكثير من عامة المؤمنين كما نطقت به صحاح الأحاديث المتواترة معنوياً)।                      

বাদশাহর কাছে তাঁরই মালিকানাধীন বিষয়াদির মধ্য হতে কোনো কিছু চাওয়া মানুষের (জন্যে) ক্ষতিকর হতে পারে কীভাবে? বিশেষতঃ যে সত্তার কাছে চাওয়া হয় তিনি যখন মহৎ এবং প্রার্থনাকারীরও আপন প্রার্থিত বস্তুর ভীষণ প্রযোজন। শাফা’আত কি দুআ’ নয়? আর শাফা’আত তথা সুপারিশ কি অনুমতিপ্রাপ্ত, সম্ভাব্য ও গৃহীত নয়, বিশেষ করে আম্বিয়া (আলাইহিমুস্ সালাম) ও সুলাহা (পুণ্যাত্মা)’বৃন্দের কাছ থেকে – এ (দুনিয়ার) জীবনে ও পরলোকে, কবরে ও শেষ বিচার দিবসে? শাফা’আত (ক্ষমতা) তাঁকেই দান করা হয়ে থাকে যিনি আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার করে রেখেছেন; আর তা আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লা কর্তৃক গৃহীত (মক্ববূল) প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই (প্রযোজ্য) যিনি তওহীদ (আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস)’এর ওপর দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত থেকে ইন্তেক্বাল করেছেন।

এই বিষয়টি সাবেত/সুপ্রতিষ্ঠিত যে কতিপয় সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর কাছে শাফা’আত প্রার্থনা করেছিলেন, আর তিনি এ কথা বলেননি – إن طلبك الشفاعة مني شرك فاطلبها من الله ولا تشرك بربك أحدًا – “তোমার দ্বারা আমার কাছে শাফা’আত চাওয়া শির্ক (অংশীবাদ), তাই তা আল্লাহর কাছে চাও! তোমার প্রভুর সাথে কাউকে শরীক/অংশীদার কোরো না!” এ ব্যাপারে হয়রত আনাস বিন মালিক (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর কথাই ধরুন, যিনি আরজ করেছিলেন – يا نبي الله اشفع لي يوم القيامة – “হে আল্লাহর রাসূল (দ:), শেষ বিচার দিবসে আমার জন্যে সুপারিশ করবেন।” তিনি এর উত্তরে বলেন – (( أنا فاعل إن شاء الله )) – “আল্লাহর ইচ্ছায় আমি তা করবো।” এই হাদীসটি ইমাম তিরমিযী (রহ:) নিজ ‘সুনান’ পুস্তকের ‘সীরাত’ অধ্যায়ে বর্ণনা করেন। হযরত আনাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ছাড়াও অন্যান্যরা তাঁর কাছে শাফা’আত চেয়েছিলেন।

হযরত সাওয়াদ ইবনে ক্বা’রিব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর কথা ধরুন, তিনি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর সামনে (কাব্যাকারে) বলেছিলেন:

وأشهد أن الله لا رب غيره  : :  وأنك مأمون على كل غائب

وأنك أدنى المرسلين وسيلة : :  إلى الله يا ابن الأكرمين الأطايب

আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, নেই কোনো প্রভু আল্লাহ ছাড়া,

আর আপনার কাছে অদৃশ্যের সমস্ত জ্ঞান সংরক্ষিত তাঁরই দ্বারা,

নিশ্চয় আল্লাহর সান্নিধ্য লাভে আম্বিয়াকুলে আপনি-ই অসীলা-সেরা,

হে দু জন মহৎ ও পুতঃপবিত্র সত্তার তনয়, (স্নেহে ভরা)! (ভাবানুবাদ)

এরপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর উদ্দেশ্যে কবি আরো আবৃত্তি করেন:

فكن لي شفيعا يوم لا ذو شفاعة : : سواك مغن عن سواد بن قارب 

অতএব, (ক্বিয়ামতের) সেদিনটিতে আমার পক্ষে হোন আপনি সুপারিশকর্তা,

যেদিন সওয়াদ বিন ক্বা’রিবের জন্যে থাকবে না কোনো সুপারিশকারী, আপনি ছাড়া (ভাবানুবাদ)

এই বিবরণটি ইমাম আল-বায়হাক্বী (রহ:) উদ্ধৃত করেন নিজ ‘দালায়েলুন্ নুবূয়্যত’ গ্রন্থে; আরো বর্ণনা করেন ইবনে আবদিল বার্র (রহ:) ‘আল-ইসতিয়াব’ পুস্তকে; হাফেয ইবনে হাজর আসক্বালানী (রহ:)-ও তাঁর ‘ফাতহুল বারী’ (৫:১৮০) কিতাবে ‘হযরত উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর ইসলাম’ সম্পর্কিত অধ্যায়ে এই বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেন। 

وأقره رسول الله صلى الله عليه وسلم ولم ينكر طلب الشفاعة منه.

অর্থ: প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হযরত সওয়াদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর এই আরজির প্রতি সম্মতি জানিয়েছিলেন এবং তাঁর কাছে উক্ত সাহাবী (রা:) কর্তৃক শাফাআত প্রার্থনাকে তিনি নিষেধ করেননি।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর কাছে হযরত মা’যিন ইবনে আদূব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-ও মুসলমান (হিসেবে ধর্মান্তরিত) হয়ে আসার পরে শাফাআত কামনা করেছিলেন গান গেয়ে গেয়ে:

إليك رسول الله خبت مطيتي : : تجوب الفيافي من عمان إلى العرج

لتشفع لي يا خير من وطئ الحصا : : فيغفر لي ربي فأرجع بالفلج

(رواه أبو نعيم في دلائل النبوة ص ٧٧)

হে রাসূল (দ:), আপনার উদ্দেশ্যে আমি আমার সওয়ারি প্রাণিতে চড়ে হয়েছি রওয়ানা,

ওমান হতে ‘আরজ অঞ্চলের সরু পাহাড়ি টিলার ওপর দিয়ে পেরিয়ে সীমানা,

যাতে আমার জন্যে করেন শাফাআত আপনি, সেরা জন ‍যিনি পৃথিবীতে করছেন পদচারণা,

মোর প্রভু যেনো এতে আমায় ক্ষমা করেন এবং আমিও ফিরতে পারি নিয়ে পূরণকৃত প্রার্থনা। (ভাবানুবাদ)

[আবূ নু’য়াইম কৃত ‘দালায়েলুন্ নুবূওয়্যত’, ৭৭ পৃষ্ঠা]

প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর কাছে হযরত উকাশা বিন মিহসান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-ও শাফা’আত চেয়েছিলেন যখনই তিনি (রাসূল-দ.) সত্তর হাজার পুণ্যাত্মার বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশের কথা উল্লেখ করেছিলেন। হযরত উকাশা বলেন:

أدع الله أن يجعلني منهم،

অর্থ: “আল্লাহর কাছে দুআ’ করুন আমাকে যেনো তাঁদের (৭০,০০০) একজন করা হয়।”

নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোনো দ্বিধা ছাড়াই তৎক্ষণাৎ তাঁকে খোশখবরী দেন:

(أنت منهم).

অর্থ: “তুমি তাদের মধ্যে একজন।”

এই বিষয়টি জ্ঞাত যে, আখেরাতের ময়দানে (অপেক্ষারত) মানুষের জন্যে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর শাফা’আতে কুবরা (তথা মহা সুপারিশ) না হওয়া পর্যন্ত কেউই (সুপারিশের) এ মর্যাদা লাভ করবেন না – তিনি যে-ই হোন না কেন। এটা ব্যাপকভাবে বর্ণিত আহাদীস (মুতাওয়াতির হাদীসসমূহ) দ্বারা সুপ্রতিষ্ঠিত। আর এটা শাফা’আত চাওয়ার অর্থ বিষয়ক।

সুন্নাহের বিভিন্ন কিতাব শরীফে এর বহু নজির বিদ্যমান। এগুলোর সবই পার্থিব জীবনে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর কাছে শাফা’আত/সুপারিশ অন্বেষণের অনুমতি সপ্রমাণ করে। তাঁদের কেউ কেউ চেয়েছেন স্পষ্ট এ কথা বলে – إشفع لي – “আমার জন্যে সুপারিশ করুন, (এয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)।” অথবা তাঁরা জান্নাতে প্রবেশের জন্যে সুপারিশ চেয়েছেন; কিংবা ‘সাবিক্বুন’ তথা প্রথম সারিতে অবস্থানের জন্যে শাফা’আত চেয়েছেন; বা (আখেরাতে নবী পাকের) হাউজ/জলাশয়ের (ধারের) মানুষ হবার জন্যে সুপারিশ প্রার্থনা করেছেন; অথবা বেহেশতে তাঁরই সাহচর্যে থাকবার জন্যে শাফা’আত চেয়েছেন, যেমনটি হযরত রাবিআহ আল-আসলামী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) চেয়েছিলেন যখন তিনি এ কথা বলেছিলেন – أسألك مرافقتك في الجنة – “বেহেশতে আপনার সাহচর্যে থাকতে চাই।” রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আ’লিহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর প্রতি এর উপায় বাতলে এরশাদ করেন – أعنّي على نفسك بكثرة السجود – “আমাকে সহায়তা করো তোমার নফস-এর বিরুদ্ধে অধিক পরিমাণে সুজূদ তথা সেজদা দ্বারা।” যাঁরা বেহেশত চেয়েছেন, বা তাঁর সান্নিধ্য অন্বেষণ করেছেন, কিংবা বেহেশতবাসী হবার আশা করেছেন, অথবা হাউজের (ধারের) মানুষদের অন্তর্ভুক্ত হতে চেয়েছেন, বা মাগফিরাত-প্রাপ্তি কামনা করেছেন, তাঁদের কাউকেই তিনি এ কথা বলেন নি – إن هذا حرام – ‘নিশ্চয় এটা (মানে এ রকম চাওয়াটা) হারাম।’ আর এ মর্মেও বলেননি যে (ইহ-জীবনে) এটা চাওয়ার অনুমতি নেই, কেননা এর সময় এখনো আসেনি। তিনি বলেননি এ কথা – وانتظر حتى يأذن الله في الشفاعة، أو في دخول الجنة، أو في الشرب من الحوض – “অপেক্ষা করো যতোক্ষণ না আল্লাহ পাক সুপারিশ করার অনুমতি দিচ্ছেন; কিংবা বেহেশতে প্রবেশের, অথবা (বেহেশতে) হাউজের পানি পানের অনুমতি দিচ্ছেন” – এমন কী যদিও অন্বেষণকৃত এসব বিষয় – الشفاعة العظمى – তথা বৃহত্তর সুপারিশের আগে সংঘটিত হবে না। এটাই হচ্ছে শাফা’আত প্রার্থনার অর্থ এবং প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁদেরকে সেটার খোশ-খবরী দিয়েছেন; আর তাঁদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যেনো তাঁরা নিশ্চিন্ত হন এবং নিজেদের চোখকে (প্রশান্তিতে) শীতল করেন। আল্লাহ নিষেধ করেন যে এটা নিষিদ্ধ হতে পারে, তবু প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মিথ্যে ভদ্রতা ও চাটুক্তির ভিত্তিতে সেটা খোলাসা করেননি, যখন তিনি নিজেই সত্যের খাতিরে দোষারোপকারীর দোষারোপকে পরোয়া করেন না। নিশ্চয় তিনি সাহাবা (রা:)’বৃন্দের দুশ্চিন্তা দূর ও তাঁদের চিত্তকে উৎফুল্ল করতে পারেন তা-ই দ্বারা, যা সত্যকে ঘিরে আবর্তিত এবং যার উৎস ধর্মের ভিত্তি হতে আগত, আর যা প্রতিটি মিথ্যে ও কপটতা হতে যোজন যোজন দূরে অবস্থিত।

প্রিয়নবী (সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর কাছে পরকালের আগে (তাঁর) এই দুনিয়ার জীবনে শাফা’আত অন্বেষণ করা যখন সহীহ/সঠিক (প্রমাণিত), তখন এর মানে হলো তিনি শেষ বিচার দিবসে যথাযথ সময়ে বাস্তবিকই তা (মানে সুপারিশের অনুমতি) পাবেন – আল্লাহতা’লা সুপারিশকারীদেরকে সুপারিশের অনুমতি দেবার পরপরই; এটা নয় যে তিনি সে সময়ের আগে (রোজ হাশরে) তা পাবেন।

বাস্তবে এটা অনেক ঈমানদার মুসলমানকে রাসূল (সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর দেয়া সুসংবাদেরই অনুরূপ বিষয়। এর মানে হলো, তাঁরা শেষ বিচার দিবসে বেহেশতে প্রবেশ করবেন ঠিক যখনই আল্লাহতা’লা নির্ধারিত সময়ে (তাঁদেরকে) প্রবেশের অনুমতি দেবেন। এর মানে এ নয় যে তাঁরা দুনিয়ার জীবনে বা বরযখে (মানে ক্ববর জীবনে) তাতে প্রবেশ করবেন। আমি (শায়খ মুহাম্মদ আলাউয়ী মালেকী আল-হাসানী রহমতুল্লাহি আলাইহি) মনে করি না যে মুসলমান সমাজের মধ্যে বুদ্ধিমান/বিচক্ষণ কেউই এর বিপরীত ধারণা পোষণ করেন (ولا أظن أن عاقلاً من عوام المسلمين يعتقد خلاف ذلك)।

মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর কাছে (তাঁর) দুনিয়ার জীবনে শাফা’আত অন্বেষণ সহীহ/সঠিক হলে আমরা (শায়খ আলাউয়ী মালেকী) বলি: তাঁর (দ:) বেসালপ্রাপ্তির পরেও সুপারিশ চাওয়ার মধ্যে কোনো ক্ষতি নেই ওই (দালিলিক) তথ্যেরই ভিত্তিতে, যা’তে আহলে সুন্নাতের কাছে প্রত্যয়ন করা হয়েছে যে আম্বিয়া (আলাইহিমুস্ সালাম) তাঁদের বরযখ-জীবনে জীবিত। এক্ষেত্রে আমাদের নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হলেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে পূর্ণতাপ্রাপ্ত জন ও শ্রেষ্ঠতম সত্তা; কেননা তিনি (দুনিয়ার মানুষের) কথাবার্তা শোনেন এবং উম্মতের সমস্ত কর্ম তাঁর সামনে পেশ করা হয়ে থাকে, যার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি হয় তাদের জন্যে আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করেন, না হয় আল্লাহর প্রশংসা করেন। যাঁরা তাঁর প্রতি সালাত-সালাম পেশ করেন, তাঁদের সালাওয়াত-ও তাঁর কাছে পৌঁছে যায়, যদিও বা তাঁরা দুনিয়া সবচেয়ে দূরতম প্রান্তে অবস্থান করেন, ঠিক যেমনটি বর্ণিত হয়েছে এক দল হুফফাযের তথা হাদীসবিদের প্রমাণীকৃত একটি হাদীস শরীফে:

حياتي خير لكم تحدثون وتحدث لكم، ومماتي خير لكم تعرض أعمالكم عليَّ فإن وجدت خيرًا حمدت الله، وإن وجدت شرًا استغفرت الله لكم.

অর্থ: “আমার (যাহেরী) হায়াতে জিন্দেগী তোমাদের জন্যে খায়র/কল্যাণকর; তোমরা তা বলবে, তোমাদেরকেও তা বলা হবে। আমার বেসাল শরীফ-ও তোমাদের জন্যে মঙ্গলজনক; তোমাদের আমল/কর্ম আমাকে প্রদর্শন করা হবে; তাতে মঙ্গলজনক বিষয় দেখলে আমি আল্লাহর প্রতি প্রশংসা জ্ঞাপন করবো, অপর দিকে তাতে মন্দ কিছু দেখলে আমি আল্লাহর দরবারে তোমাদের পক্ষে ইসতিগফার (মানে সুপারিশ) করবো।” এই হাদীসটি নিম্নের মুহাদ্দেসীন-বৃন্দ প্রমাণীকরণ করেছেন: সর্ব-ইমাম (যাইনউদ্দীন) আল-ইরাক্বী, (ইবনে হাজর) আল-হায়সামী, (শিহাবউদ্দীন) আল-ক্বসতলানী, (জালালউদ্দীন) আস্-সৈয়ূতী ও ইসমাঈল আল-কাজী (রহমতুল্লাহি আলাইহিম)। আমরা এ হাদীসটির তাখরীজ/উৎস-বৃত্তান্ত অন্যত্র লিপিবদ্ধ করেছি।

অতঃপর আপনি যদি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর শাফা’আত তথা সুপারিশ অন্বেষণ করেন, তবে তিনি আল্লাহর কাছে দুআ’ করতে পারেন এবং (আপনার পক্ষে) চাইতে পারেন, ঠিক যেমনটি তিনি তাঁর দুনিয়ার (প্রকাশ্য) হায়াতে জিন্দেগীতে করতে পারতেন। এমতাবস্থায় বান্দা তা (মানে প্রার্থিত বস্তু) যথাস্থানে প্রাপ্ত হবেন, যখন মহান আল্লাহতা’লা অনুমতি দেবেন, ঠিক যেমনিভাবে কেউ বেহেশত হাসিল করবেন, যাঁকে এ জীবনে সেটার খোশ-খবরী/সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। তিনি যথাসময়ে বেহেশত প্রাপ্ত হবেন, আল্লাহ পাক যখনই তাঁকে তাতে প্রবেশের অনুমতি দেবেন। এ দুটো বিষয় একই। – هذا ما نعتقده ونعقد عليه قلوبنا – এতেই আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী এবং আমাদের অন্তরও এ বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে আছে।

ইবনে তাইমিয়া কর্তৃক শাফায়াত-সংক্রান্ত আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা ও এ জীবনে মহানবী (দ:)-এর শাফায়াত কামনার অনুমতি প্রদান

ইবনে তাইমিয়া তাঁর ‘ফাতাওয়া’ পুস্তকে একটি সুন্দর যুক্তি তুলে ধরেছেন সেসব ক্বুর’আনী আয়াতের ব্যাপারে, যেগুলো উদ্ধৃত করা হয় শাফা’আত নিষিদ্ধ হবার প্রমাণস্বরূপ এ মর্মে যে এতে কোনো উপকার নিহিত নেই; আর শাফা’আত অন্বেষণের নিষেধাজ্ঞাস্বরূপও (এগুলো উদ্ধৃত করা হয়); এসব আয়াত ওই লোকদের দ্বারা ব্যবহৃত হয় যাঁরা মনে করেন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর কাছে এই পার্থিব জীবনে শাফা’আত অন্বেষণ করা নিষেধ। এসব আয়াতের অর্থ সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়ার কথা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, যাঁরা নিজেদের দাবির পক্ষে প্রমাণস্বরূপ এগুলোকে ব্যবহার করেন তাঁরা ভুল স্থানে এগুলোর প্রয়োগ করে থাকেন, আর তাঁরা (ক্বুর’আনের) বাণীরও মৌলিকত্বে পরিবর্তন সাধন করে থাকেন। [বঙ্গানুবাদকের নোট: মুহাম্মদ ইবনে আবদিল ওয়াহহাব নজদীর রচিত ‘কাশফুশ শুবহাত’ পুস্তিকাটি এর জাজ্বল্যমান প্রমাণ। আমার রচিত ‘ওহাবীদের সংশয় নিরসন’ পুস্তকে আমি নজদীকে খণ্ডন করেছি]    

ইবনে তাইমিয়া বলেন:

যে সকল ব্যক্তি শাফা’আত অস্বীকারকারী, তাঁরা আল্লাহতা’লার নিম্নোক্ত বাণীকে দলিল হিসেবে ব্যবহার করেছেন – وَٱتَّقُواْ يَوْماً لاَّ تَجْزِي نَفْسٌ عَن نَّفْسٍ شَيْئاً وَلاَ يُقْبَلُ مِنْهَا شَفَٰعَةٌ وَلاَ يُؤْخَذُ مِنْهَا عَدْلٌ – অর্থাৎ, এবং ভয় করো ওই দিনকে, যেদিন কোনো আত্মা অন্য কারো বিনিময় হতে পারবে না, আর না কাফিরের পক্ষে কোনো সুপারিশ গ্রহণ করা হবে এবং না কোনো কিছু নিয়ে তার আত্মাকে মুক্তি দেয়া হবে (সূরা বাক্বারা, ৪৮; নূরুল ইরফা’ন)। আর আল্লাহর (আরেকটি) কালাম/বাণী – وَلاَ يُقْبَلُ مِنْهَا عَدْلٌ وَلاَ تَنفَعُهَا شَفَاعَةٌ – অর্থাৎ, এবং (সেদিন) না তাকে কিছু বিনিময় নিয়ে ছেড়ে দেয়া হবে, আর না কাফিরদেরকে কোনো সুপারিশ উপকার করবে (সূরা বাক্বারা, ১২৩; নূরুল ইরফা‘ন)। আর আল্লাহর অপর একটি বাণী – مَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ حَمِيمٍ وَلاَ شَفِيعٍ يُطَاعُ – অর্থাৎ, এবং যালিমদের না কোনো বন্ধু আছে, না এমন কোনো সুপারিশকারী, যার সুপারিশ গ্রাহ্য হবে (সূরা আল-মু’মিন/গা’ফির, ১৮; নূরুল ইরফা’ন)। আর আল্লাহর বাণী – فَمَا تَنفَعُهُمْ شَفَاعَةُ ٱلشَّافِعِينَ – অর্থাৎ, সুতরাং তাদেরকে সুপারিশকারীদের সুপারিশ কোনো কাজ দেবে না (সূরা মুদ্দাসসির, ৪৮; নূরুল ইরফা’ন)। 

আহলুস্ সুন্নাহ’র জবাব হলো, উদ্ধৃত এসব আয়াতে করীমা দুটো বিষয় ইঙ্গিত করে:

প্রথমতঃ শাফা’আত মূর্তিপূজারীদের উপকারে আসবে না, যেমনটি আল্লাহতা’লা তাদের বর্ণনায় ঘোষণা করেন – مَا سَلَكَكُمْ فِي سَقَرَ، قَالُواْ لَمْ نَكُ مِنَ ٱلْمُصَلِّينَ، وَلَمْ نَكُ نُطْعِمُ ٱلْمِسْكِينَ، وَكُنَّا نَخُوضُ مَعَ ٱلُخَآئِضِينَ، وَكُنَّا نُكَذِّبُ بِيَوْمِ ٱلدِّينِ، حَتَّىٰ أَتَانَا ٱلْيَقِينُ، فَمَا تَنفَعُهُمْ شَفَاعَةُ ٱلشَّافِعِينَ – অর্থাৎ, তোমাদেরকে কিসে দোযখে নিয়ে গেছে? তারা বলে, ‘আমরা নামায পড়তাম না; এবং মিসকীনকে আহার্য দিতাম না; এবং অনর্থক চিন্তাভাবনাকারীদের সাথে অনর্থক চিন্তা করতাম; এবং আমরা বিচার-দিবসকে অস্বীকার করতাম; শেষ পর্যন্ত, আমাদের কাছে মৃত্যু এসে পড়েছে।’ সুতরাং তাদেরকে সুপারিশকারীদের সুপারিশ কোনো কাজ দেবে না (সূরা মুদ্দাসসির, ৪২-৪৮ আয়াত; নূরুল ইরফা’ন)। অতএব, তারা অবিশ্বাসকারী; তাই সুপারিশকারীদের সুপারিশের উপকারিতা থেকে তারা বঞ্চিত।

দ্বিতীয়তঃ এটা শাফা’আত নাকচ হবার ঘোষণা, যা মূর্তিপূজারী লোকদের ক্ষেত্রে সাবেত/প্রমাণিত এবং তাদের সদৃশ বিদ’আতী তথা নতুন প্রচলনকারী আহলে কিতাব বা ঐশীগ্রন্থসম্পন্ন (ইহুদী ও খৃষ্টান) লোকদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, আরো প্রযোজ্য সেসব মুসলমানের বেলায় যারা বিশ্বাস করে (কিছু কিছু) সৃষ্টি খোদাপ্রদত্ত ক্ষমতাধর, যার দরুন তাঁরা আল্লাহর অনুমতি ছাড়াই সুপারিশ করতে সক্ষম, ঠিক যেমনটি মানুষেরা পারস্পরিক সুপারিশ করে থাকেন, যা দ্বারা সুপারিশ যাঁর কাছে চাওয়া হয় তিনি সুপারিশের অন্বেষণকারীর আরজি গ্রহণ করেন, কেননা ওই ব্যক্তিকে তাঁরও প্রয়োজন রয়েছে, চাই তা হোক ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, ঠিক যেমনটি সৃষ্টিকুল নিজেদের মধ্যে আপন আপন স্বার্থে আচরণ করে থাকে। মূর্তিপূজারীবর্গ আল্লাহ ছাড়া (তথা মোকাবিলায়) ফেরেশতা, আম্বিয়া (আলাইহিমুস্ সালাম) ও সালেহীন/পুণ্যবান বুযূর্গবৃন্দকে সুপারিশকারী হিসেবে গ্রহণ করতো। তারা তাঁদের ছবি (মূর্তি) বানিয়ে তাঁদের মধ্যস্থতায় সুপারিশ অন্বেষণ করতো। আর তারা বলতো – هؤلاء خواص الله – অর্থাৎ, ‘তাঁরা হচ্ছেন আল্লাহর খাস্ বান্দা।’ [বঙ্গানুবাদকের নোট: ইবনে তাইমিয়ার এ কথাটি-ই ওহাবীগুরু ইবনে আবদিল ওয়াহহাব গ্রহণ করেছিলেন সাড়ে চার শ বছর পরে। বাস্তবতা হলো, কোনো মুসলমানই বিশ্বাস করেন না যে আম্বিয়া-আউলিয়া আল্লাহর ওপরে চাপ প্রয়োগ করে সুপারিশ করবেন; এ কথা বাতিল। দ্বিতীয়তঃ আমি আমার ‘ওহাবীদের সংশয় নিরসন’ গ্রন্থে প্রমাণ করেছি যে আল-ক্বুর’আনে উদ্ধৃত মক্কার কুফফার-বর্গের সুপারিশের পক্ষে বক্তব্যটি মিথ্যে ও ব্যঙ্গাত্মক। পাঠকমণ্ডলীকে আমার উক্ত বইটি পড়ার অনুরোধ জানাই]               

قلت هذا كلام الشيخ ابن تيمية بلفظه، ومنه يظهر جلياً حقيقة هذه الآيات التي يستدل بها المنكرون لطلب الشفاعة من النبي صلى الله عليه وسلم في الدنيا، أو القائلون بأنها شرك وضلال.

আমি (শায়খ মুহাম্মদ আলাউয়ী মালেকী আল-হাসানী-রহ.) বলি, এ কথা তো হুবহু ইবনে তাইমিয়ারই বাণী। এ বক্তব্য থেকে এই সব আয়াতে করীমার বাস্তবতা স্পষ্ট প্রকাশ পায়; এগুলোই সেসব আয়াত যেগুলোকে দুনিয়ার জীবনে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর শাফা’আত অন্বেষণের অস্বীকারকারীবর্গ (নিজেদের পক্ষে) দলিল হিসেবে উপস্থাপন করে থাকেন, অথবা যাঁরা বলে থাকেন যে এর অন্বেষণ মূর্তিপূজা ও পথভ্রষ্টতা।

ইবনে তাইমিয়ার ভাষ্যের সারমর্ম হলো, এসব আয়াতের উদ্দেশ্য মুশরিকদের জন্যে শাফা’আত বা সুপারিশ উপকারী হবে না। আয়াতগুলো (স্রেফ) ওই বিষয় সংক্রান্ত। অথবা, আয়াতগুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে মুশরিক তথা মূর্তিপূজারীদের দ্বারা ঘোষিত শাফা’আতের (ধারণার) প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন বা তা নাকচ করণ; মুশরিকদের এ ধারণাটিতে সুপারিশকারী আল্লাহর অনুমতি ছাড়াই সুপারিশ করার অধিকার সংরক্ষণ করেন। এখানে ইবনে তাইমিয়া যা উল্লেখ করেছেন, আমরাও তা-ই বিশ্বাস করি, আল্লাহর ফজল তথা অনুগ্রহে। আমরাও বলি: কেউ কারো সুপারিশ অন্বেষণ করার সময় সুপারিশকারী আল্লাহর অনুমতি ব্যতিরেকে সুপারিশ করতে সক্ষম মর্মে বিশ্বাস পোষণ করলে তা হবে নিঃসন্দেহে শির্ক বা পথভ্রষ্টতা। আল্লাহ মাফ করুন, আল্লাহ মাফ করুন, আমি আবারো বলছি, আল্লাহ মাফ করুন আমাদের তা বিশ্বাস করা বা চিন্তা করা হতে। আল্লাহর দরবারে তা থেকে আমরা আমাদের সরলতা (এক্ষণে) ব্যক্ত করছি।

আমরা যখন শাফা’আত অন্বেষণ করি, আমরা পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস পোষণ করি যে আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউই সুপারিশ করতে পারবেন না; আর এটা একমাত্র তাঁরই রেজামন্দি/সন্তুষ্টি ও সমর্থন দ্বারা সংঘটিত হতে পারে। এটা অনেকটা বেহেশতে প্রবেশ করতে চাওয়া, অথবা হাউজে (কাউসার)-এর পানি পান করতে চাওয়া, কিংবা পুল সীরাত পার হতে চাওয়ার মতোই ব্যাপার। এগুলোর কোনোটাই অর্জন করা সম্ভব নয় আল্লাহর অনুমতি ব্যতিরেকে, আর তাঁর বিধানকৃত উপযুক্ত সময় অনুসারেই তা সংঘটিত হবে। বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন কেউ কি এতে সন্দেহ করেন? এটা কি এমন কোনো অজ্ঞাত বিষয় ন্যূনতম জ্ঞানসম্পন্ন কারো কাছে, অথবা প্রাথমিক যুগের সালাফ/পুণ্যাত্মাবৃন্দের বইপত্র পাঠকারী পবিত্র (ধর্মীয়) জ্ঞানের শিক্ষানবীশদের মাঝে?

اللهم افتح مسامع قلوبنا ونور أبصارنا.

অর্থ: হে আল্লাহ, আমাদের অন্তরের কান খুলে দিন এবং আমাদের দৃষ্টিকে (আপনার ঐশী জ্যোতি দ্বারা) আলোকময় করে দিন (আমীন)।

’আপনারই এবাদত করি ও আপনার কাছেই সাহায্য চাই’ 

(إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ আল-আয়াতের ব্যাখ্যা)

আমরা স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনভাবে এ আক্বীদা-বিশ্বাস নিঃসন্দেহে পোষণ করি যে, সাহায্য প্রার্থনা (ইস্তি’আনাহ استعانة), সহায়তা গ্রহণ (ইস্তিগাসাহ استغاثة), অন্বেষণ/তালাশ (তলব طلب), আহ্বান (নেদা نداء), চাওয়া (সওয়াল سؤال) ইত্যাদি বিষয় অবশ্যঅবশ্য আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালার ওপরই নির্ভরশীল, কেননা তিনিই সাহায্যকারী (معين) ও সহায়তাকারী (مغيث) এবং প্রার্থনার জবাবদাতা তথা দুআ’ ক্ববূলকারী (مجيب)। 

আল্লাহ এরশাদ করেন: 

وَلاَ تَدْعُ مِن دُونِ ٱللهِ مَا لاَ يَنفَعُكَ وَلاَ يَضُرُّكَ فَإِن فَعَلْتَ فَإِنَّكَ إِذاً مِّنَ ٱلظَّالِمِينَ، وَإِن يَمْسَسْكَ ٱللهُ بِضُرٍّ فَلاَ كَاشِفَ لَهُ إِلاَّ هُوَ..

অর্থ: এবং আল্লাহ ছাড়া সেটার বন্দেগী কোরো না যা না তোমার উপকার করতে পারে, না অপকার; অতঃপর যদি এমন করো তখন তুমি যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে। এবং আল্লাহ যদি তোমাকে কোনো দুঃখকষ্ট দেন, তবে তিনি ছাড়া সেটা মোচনকারী কেউ নেই…। [সূরাহ ইঊনুস, আয়াত ১০৬-৭; নূরুল ইরফান]

আর আল্লাহ পাক অন্যত্র ঘোষণা করেন: 

فَٱبْتَغُواْ عِندَ ٱللهِ ٱلرِّزْقَ وَٱعْبُدُوهُ… 

অর্থ: সুতরাং তোমরা আল্লাহর কাছে জীবিকা তালাশ করো এবং তাঁরই ইবাদত করো…। [সূরাহ আনকাবূ’ত, আয়াত ১৭, নূরুল ইরফান]

তিনি আরো ফরমান:

وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّن يَدْعُواْ مِن دُونِ ٱللهِ مَن لاَّ يَسْتَجِيبُ لَهُ إِلَىٰ يَوْمِ ٱلْقِيَامَةِ..

অর্থ: এবং তার চাইতে বড় পথভ্রষ্ট আর কে, যে আল্লাহ ছাড়া এমন সবের পূজা করে, যেগুলো ক্বিয়ামত পর্যন্ত তাদের প্রার্থনা শুনবে না…। [সূরা আহক্বাফ, ৫ আয়াত, নূরুল ইরফান]

আর আল্লাহ পাক বলেন:

أَمَّن يُجِيبُ ٱلْمُضْطَرَّ إِذَا دَعَاهُ وَيَكْشِفُ ٱلسُّوۤءَ..

অর্থ: না তিনি, যিনি আর্তের আহ্বানে সাড়া দেন যখন তাঁকে আহ্বান করে এবং দূরীভূত করে দেন বিপদাপদ…। [সূরাহ নামল, ৬২ আয়াত, নূরুল ইরফান]

অতএব, সর্বপ্রকারের এবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্যেই পরিচালিত হওয়া আবশ্যক; এর অংশ বিশেষও অন্য কারো জন্যে, তিনি যে-ই হোন না কেন, পরিচালিত হওয়া চলবে না; (যেমনটি আল্লাহ ফরমান) – 

قُلْ إِنَّ صَلاَتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلهِ رَبِّ ٱلْعَالَمِينَ، لاَ شَرِيكَ لَهُ وَبِذٰلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَاْ أَوَّلُ ٱلْمُسْلِمِينَ.

অর্থ: আপনি বলুন, ‘নিঃসন্দেহে আমার নামায, আমার ক্বুরবানীগুলো, আমার জীবন ও আমার মরণ – সবই আল্লাহর জন্যে, যিনি রব সমগ্র জাহানের; তাঁর কোনো শরীক নেই; আমার প্রতি এটাই হুকুম হয়েছে এবং আমি সর্বপ্রথম মুসলমান।’ [সূরাহ আন’আম, ১৬২-১৬৩ আয়াত, নূরুল ইরফান]

অতএব, (হাকীকী তথা প্রকৃত অর্থে) আল্লাহর উদ্দেশ্যে ছাড়া কোনো নজর/মানত নেই, তাঁর বরাবর ছাড়া কোনো দুআ’ নেই; নেই কোনো পশু কুরবানী, সাহায্য ও সহায়তা প্রার্থনা, কিংবা পরিত্রাণ লাভ (তাঁকে ছাড়া)। তাঁকে ছাড়া কোনো শপথ নেই আর তিনি ছাড়া কোনো ভরসাও নেই। মুশরিকবর্গ তাঁর সাথে যে মূর্তিগুলোকে শরীকদার বানায়, তা হতে তিনি একেবারে পুতঃপবিত্র। আমরা এ আক্বীদা-বিশ্বাস পোষণ করি যে আল্লাহতায়ালা বান্দাদের ও তাঁদের কর্মগুলোর স্রষ্টা। তিনি ছাড়া জীবিত বা মৃত কেউই আপনাআপনি তা’সীর তথা প্রভাব বিস্তার করতে পারেন না। কেউই আল্লাহর সাথে অংশীদার হতে পারেন না কোনো কর্ম সংঘটনের বা তা পরিহারের সক্ষমতায় তথা সামর্থ্যে, রিযক্ব/আহার্য, জীবন দান বা মরণ ডেকে আনার সামর্থ্যে। সৃষ্টিকুলে এমন কেউ নেই যাঁর স্বকীয়ভাবে সক্ষমতা রয়েছে, অথবা আল্লাহর সাথে শরীকদারি রয়েছে, বা এর বাইরে ক্ষমতা রয়েছে কোনো কর্ম সংঘটনের কিংবা তা পরিহারের। সারা জগতের পরিচালনা করেন একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা, আর কারোরই কোনো সামর্থ্য নেই, যদি না আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রতি তা দান করেন এবং তাঁকে তা সদ্ব্যবহারের অনুমতি দেন। কেউই তাঁদের নিজেদের উপকার, ক্ষতি, জীবন, মৃত্যু, অথবা পুনরুত্থানের ওপর ক্ষমতা রাখেন না, অন্যদের কথা তো বাদই – যদি না আল্লাহ তায়ালা এরকম ইচ্ছা করেন এবং এর অনুমতি দেন (فالمتصرف في الكون هو الله سبحانه وتعالى ولا يملك أحد شيئاً إلا إذا ملكه الله ذلك وأذن له في التصرف فيه ، ولا يملك أحد لنفسه فضلاً عن غيره نفعاً ولا ضرًا ولا موتاً ولا نشورًا إلا ما شاء الله بإذن الله)। সেক্ষেত্রে উপকার বা ক্ষতি করার ক্ষমতার সীমা এই সীমাবদ্ধতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে, আর সৃষ্টিকুলের প্রতি এটা আরোপিত হবে ‘সাবাব’ তথা মাধ্যম ও অর্জনের ভিত্তিতে; সৃষ্টি বা অস্তিত্বশীল করার, তা’সীর/প্রভাব বিস্তার বা ক্রিয়া সংঘটন কিংবা ক্ষমতা প্রয়োগ পন্থার ভিত্তিতে এটা নয়। সুতরাং এই নিসবত, অর্থাৎ সম্বন্ধ আরোপ মাজাযী তথা রূপক অর্থে এবং হাকীকী/চূড়ান্ত সত্যের অর্থে নয়। কিন্তু মানুষ এসব হাকীকত ব্যক্ত করার সময় পারস্পরিক ভিন্নমত পোষণ করেন। তাঁদের কেউ কেউ সরাসরি মাজায তথা রূপক পরিভাষাকে এমন উপায়ে প্রকাশ করেন যে তা সীমাছাড়া স্বাধীনতায় পরিণত হয়; যার দরুন তাঁরা সন্দেহজনক অভিব্যক্তি ব্যবহারে আটকে যান, অথচ যার বাহ্যিক উদ্দেশ্য হতে তাঁরা নির্দোষ ও নিষ্কলুষ, আর তাঁদের অন্তর প্রশান্তভাবে অটুট এবং সুদৃঢ়ভাবে আবদ্ধ আল্লাহতায়ালার পরিপূর্ণ তওহীদ (একত্ব) ও খোদায়ী শ্রেষ্ঠত্বেরই প্রতি।

আক্ষরিক অর্থকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে থাকা লোকদের মধ্যে আবার কেউ কেউ আছে, যারা এমন পর্যায়ে তা নিয়ে থাকে যার দরুন ভারসাম্যের সীমা তারা ছাড়িয়ে যায়; আর এর ফলশ্রুতিতে তারা উগ্রতা ও কঠিনতার (অতল) গহ্বরে পতিত হয়; এবং (এভাবে) মানুষ যা বিশ্বাস করেন ঠিক তার উল্টোটা বিশ্বাসের দোষ তাঁদের প্রতি আরোপ করে তাঁদের ক্ষতি সাধন করে থাকে; অতঃপর তাঁরা যা বিশ্বাস করেন না, তা তাঁদের ওপর এসব সীমালঙ্ঘনকারী জোরজবরদস্তি চাপিয়ে দেয়; মানুষেরা (নিজেদের কথায়) যা উদ্দেশ্য করেননি, তার অন্তর্নিহিত অর্থ তা-ই মর্মে জোরাজুরি করে থাকে এরা; আর তাঁরা যেসব বিষয়ে নিরপরাধ, সেগুলো দ্বারাই বিচার করে থাকে এসব উগ্রবাদী। এক্ষেত্রে প্রত্যেকর জন্যে ওয়া’জিব তথা আবশ্যক হলো ভারসাম্য রক্ষা করা এবং এসব কিছু থেকে দূরে সরে থাকা, কেননা এটা তাঁর ধর্মের জন্যে নিরাপদ এবং তওহীদের মাক্বাম রক্ষার বেলায়ও অধিকতর সাবধানতাপূর্ণ; আর আল্লাহ-ই সবচেয়ে ভালো জানেন।

ইবনে তাইমিয়া উপকারী সারমর্মের (খোলাসা) এক বয়ান দিয়েছেন, যা’তে হক্ব সোবহানাহু ওয়া তায়ালার অনন্য বৈশিষ্ট্যাবলী স্পষ্ট হয়েছে এবং আমরাও তাতেই বিশ্বাস করি, আর সে মোতাবেক মহান আল্লাহর এবাদত-বন্দেগী করি। আমাদের এই আক্বায়েদ/আক্বীদা-বিশ্বাস হচ্ছে সালাফ-এ-সালেহীন (মানে প্রাথমিক যুগের পুণ্যাত্মাবৃন্দ)-এর (আক্বীদার) ভিত্তিমূলে প্রতিষ্ঠিত, আল্লাহরই ফজলে (অনুগ্রহে); আর আমাদের তরীক্বা হচ্ছে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এরই পথ ও মত; তাই ইবনে তাইমিয়ার এ কথার মতো আমরাও এ ব্যাপারে একই কথা বলে থাকি।

ইবনে তাইমিয়া বলেন:

আল্লাহতায়ালা নিজের জন্যে এমন হক্ব তথা অধিকার নির্ধারণ করেছেন যার মধ্যে সৃষ্টিকুলের কেউই (তাঁর সাথে) শরীকদার নন; অতএব, এবাদত-বন্দেগী তিনি ছাড়া আর কারোরই জন্যে বিহিত নয়, কিংবা দোয়াও তিনি ছাড়া কারো জন্যে নয়। তাওয়াক্কুল তথা নির্ভরতা একমাত্র তাঁরই ওপরে রাখা বাঞ্ছনীয়; তাঁরই দিকে কেবল বন্দেগীর অন্তর রুজু থাকা চাই; তিনি ছাড়া কোনো বন্দেগীগত ভয় নেই; আর তিনি ছাড়া কোনো নিরাপত্তা ও সাহায্যের আশ্রয়স্থল নেই। তিনি ছাড়া কেউই উপকারী কিছু নিয়ে আসতে পারেন না, আর মন্দ কিছু অপসারণও করতে পারেন না। তাঁর (প্রদত্ত) ক্ষমতা ছাড়া কোনো ক্ষমতা ও শক্তি নেই:

وَلاَ تَنفَعُ ٱلشَّفَاعَةُ عِندَهُ إِلاَّ لِمَنْ أَذِنَ لَهُ.

অর্থ: এবং তাঁর (আল্লাহর) নিকট সুপারিশ কাজে আসে না, কিন্তু যাঁকে তিনি অনুমতি দেন….[আল-ক্বুর’আন, ৩৪/২৩; নূরুল ইরফান]।

مَن ذَا ٱلَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلاَّ بِإِذْنِهِ.

অর্থ:..সে কে, যে তাঁর সম্মুখে সুপারিশ করবে, তাঁরই অনুমতি ব্যতিরেকে? [আল-ক্বুর’আন, ২/২৫৫; নূরুল ইরফান]

إِن كُلُّ مَن فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلأَرْضِ إِلاَّ آتِي ٱلرَّحْمَـٰنِ عَبْداً، لَّقَدْ أَحْصَاهُمْ وَعَدَّهُمْ عَدّاً، وَكُلُّهُمْ آتِيهِ يَوْمَ ٱلْقِيَامَةِ فَرْداً. 

অর্থ: আসমানসমূহ ও জমিনের মধ্যে যতো কিছু আছে সবই তাঁর সামনে বান্দারূপে হাজির হবে; নিশ্চয় তিনি তাদের সংখ্যা জানেন এবং তাদেরকে একেকটি করে গণনা করে রেখেছেন; আর তাদের মধ্যে প্রত্যেকে ক্বিয়ামত-দিবসে তাঁরই সম্মুখে একাকী হাজির হবে। [আল-ক্বুর’আন, ১৯/৯৩-৯৫; নূরুল ইরফান]

আল্লাহতায়ালা আরো ফরমান:

وَمَن يُطِعِ ٱللهَ وَرَسُولَهُ وَيَخْشَ ٱللهَ وَيَتَّقْهِ فَأُوْلَـٰئِكَ هُمُ ٱلْفَآئِزُون.

অর্থ: এবং যারা নির্দেশ মান্য করে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের এবং আল্লাহকে ভয় করে আর সাবধানতা অবলম্বন করে, তবে এসব লোকই সফলকাম। [আল-ক্বুর’আন, ২৪/৫২; নূরুল ইরফান]

فجعل الطاعة لله وللرسول، وجعل الخشية والتقوى لله وحده،

(ইবনে তাইমিয়া এরপর বলেন) – সুতরাং, আল্লাহ আনুগত্যকে তাঁর ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর জন্যে নির্ধারণ করেছেন, আর ভয় ও সাবধানতাকে স্রেফ তাঁর নিজের জন্যে নির্ধারণ করেছেন। যেমনটি তিনি এরশাদ ফরমান:

 وَلَوْ أَنَّهُمْ رَضُوْاْ مَآ آتَاهُمُ ٱللهُ وَرَسُولُهُ وَقَالُواْ حَسْبُنَا ٱللهُ سَيُؤْتِينَا ٱللهُ مِن فَضْلِهِ وَرَسُولُهُ إِنَّآ إِلَى ٱللهِ رَاغِبُونَ.  

অর্থ: এটা কতোই ভালো হতো যদি তারা তাতেই সন্তুষ্ট হতো, যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তাদেরকে দান করেছেন এবং বলতো, ‘আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট, এখন আল্লাহ আমাদেরকে দান করছেন আপন করুণা থেকে এবং আল্লাহর রাসূলও (দান করছেন); আমরা আল্লাহরই প্রতি আসক্ত।’ [আল-ক্বুর’আন, ৯/৫৯; নূরুল ইরফান]

فالإيتاء لله والرسول، وأما التوكل فعلى الله وحده، والرغبة إلى الله وحده. 

(ইবনে তাইমিয়া এরপর বলেন) – এখানে (আমরা দেখছি যে) দান করার বিষয়টি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর জন্যে নির্ধারিত; আর তাওয়াক্কুল (নির্ভর) করা ও বন্দেগীর প্রতি অন্তর রুজু রাখা কেবল আল্লাহরই জন্যে (নির্ধারিত)। [ইবনে তাইমিয়া কৃত ফাতাওয়া, ১১/৯৮]

সাহায্য প্রার্থনা ও মহানবী (দ:)-এর কাছে আবেদন পেশ

আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি যে আমরা স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনভাবে কোনো রকম সন্দেহ ছাড়াই এ মর্মে বিশ্বাস করি, সাহায্য ও সহায়তা অন্বেষণ (الاستعانة والاستغاثة), আবেদন জানানো (الطلب), আহ্বান করা (النداء), চাওয়া (السؤال) ইত্যাদি বিষয়গুলোর ভিত্তি হলো, এগুলো আল্লাহরই জন্য (সুনির্দিষ্ট); কেননা একমাত্র তিনিই সাহায্যকারী ও সহায়তাদাতা (المعين والمغيث) এবং প্রার্থনা গ্রহণকারী (المجيب)। আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন:

وَقَالَ رَبُّكُـمُ ٱدْعُونِيۤ أَسْتَجِبْ لَكُمْ.

অর্থ: এবং তোমাদের রব/প্রভু বলেছেন, আমার নিকট প্রার্থনা করো, আমি গ্রহণ করবো [আল-ক্বুর’আন, ৪০/৬০; নূরুল ইরফান]। অতএব, কেউ যদি সৃষ্টিকুলের মধ্যে জীবিত অথবা বেসালপ্রাপ্ত কাউকে আল্লাহ ছাড়া স্বকীয়ভাবে উপকার ও ক্ষতি করার সামর্থ্যবান জেনে তাঁর কাছে সাহায্য ও সহায়তা চান, অথবা আহ্বান করেন কিংবা (কোনো কিছু) প্রার্থনা বা অন্বেষণ করেন, তাহলে নিশ্চয় ওই ব্যক্তি শির্কে অধঃপতিত হয়েছেন। তবে আল্লাহতায়ালা আবার সৃষ্টিকুলকে একে অপরের সাহায্য ও সহায়তা চাওয়ার অনুমতিও দিয়েছেন। তিনি এও আদেশ করেছেন, সাহায্য যাঁর কাছে চাওয়া হয়েছে তিনি যেনো সাহায্যপ্রার্থীকে সাহায্য করেন; সহায়তা তলবকারীকে সহায়তা দেন; আর নেদা-দাতা তথা আহ্বানকারীকে তাঁর আহ্বানে সাড়া দেন। এ কথা ব্যক্তকারী হাদীসসমূহ অসংখ্য এবং এগুলো বিপদে কাউকে সহায়তা করা, কারো প্রয়োজনের মুহূর্তে তাঁকে সাহায্য করা এবং তাঁর অসুবিধা দূর করার মতো প্রশংসনীয় গুণের পক্ষে প্রমাণ পেশ করে। প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হলেন হাজত-মাক্বসূদ/প্রয়োজন পূরণে আল্লাহর দরবারে পৌঁছুনোর জন্য সাহায্য চাওয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ মধ্যস্থতাকারী।       

ক্বিয়ামত দিবসের কঠিন সময়ের চেয়ে আর কী কঠিনতর হতে পারে, যখন দাঁড়িয়ে থাকা দীর্ঘায়িত হবে, লোকের ভিড় হবে কষ্টদায়ক, উত্তাপ/উষ্ণতা হবে বর্ধিত এবং আল্লাহ যেখানে চান সেখানে ঘাম ঝরবে? ওই সময় কঠিন পরিস্থিতি তুঙ্গে উঠলে মানুষেরা আল্লাহর দরবারে তাঁরই শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির (মানে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর) মধ্যস্থতায় সহায়তা চাইবেন, যা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর ভাষ্যানুযায়ী – وبينما هم كذلك استغاثوا بآدم – ‘ওই পরিস্থিতিতে তারা পয়গাম্বর আদম (আলাইহিস্ সালাম)’এর সহায়তা চাইবে’ (আল্ হাদীস)। তিনি এ হাদীসে ‘ইস্তিগাসাহ’/সহায়তা অন্বেষণ (الاستغاثة) অভিব্যক্তিটি প্রয়োগ করেছেন, আর এ কথাটি সহীহ আল-বুখারী হাদীসের গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) হযরতে রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর সাহায্য ও সহায়তা চাইতেন, আর তাঁর মধ্যস্থতায় শাফা’আত প্রার্থনা করতেন। উপরন্তু, তাঁরা নিজেদের অভাব-অনটন, জরা-ব্যাধি, দুঃখ-দুর্দশা, দায়-দেনা ও অক্ষমতার ব্যাপারে তাঁর বরাবর ফরিয়াদ পেশ করতেন। কঠিন পরিস্থিতিতে তাঁরা তাঁর কাছে ছুটে আসতেন এবং তাঁর বরাবর আবেদন-নিবেদন জানাতেন নিজেদের অন্তরে এই দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করে যে, তিনি উপকার ও ক্ষতির এক মধ্যস্থতাকারী (واسطة) ও মাধ্যম (سبب) মাত্র। অথচ হাক্বীক্বতে তথা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ-ই হলেন এ সবের কর্তা (الفاعل)।

আবূ হোরায়রা (রা:) কর্তৃক বিস্মরণ-প্রবণতার ব্যাপারে আবেদন পেশ

আল-বুখারী ও অন্যান্য হাদীসবিদ হযরত আবূ হুরায়রাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনা করেন যে একবার তিনি মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর কাছে তাঁর পবিত্র হাদীসগুলো শ্রবণের পরে ভুলে যাওয়ার তথা মনে রাখতে না পারার ব্যাপারে আরজি পেশ করেছিলেন। তিনি এর সুরাহা চেয়েছিলেন, তাই তিনি বলেন:

يا رسول الله! إني أسمع منك حديثاً كثيرًا فأنساه فأحب أن لا أنسى.

অর্থ: হে আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! নিশ্চয় আমি আপনার কাছ থেকে অনেক হাদীস শ্রবণ করি, কিন্তু এগুলো ভুলে যাই। আমি এগুলো কখনোই ভুলে না যেতে পছন্দ করবো।

প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উত্তরে বলেন:

((ابسط رداءك)). 

অর্থ: তোমার চাদর মেলে ধরো।

فبسطه فقذف بيده الشريفة من الهواء في الرداء ثم قال ضمه فضمه.

হযরত আবূ হুরায়রাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) চাদর মেলে ধরলে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজ হাত মোবারক দ্বারা (খাবল দিয়ে ধরে) ওই চাদরের মধ্যে বাতাস ঝেড়ে বলেন: ‘(এবার) চাদর বন্ধ করো।’ হযরত আবূ হুরায়রাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) চাদরটি গুটিয়ে নেন।

হযরত আবূ হুরায়রাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) পরবর্তীকালে বলেন:

فما نسيت شيئاً بعد.

অর্থ: এরপর আমি আর কোনো কিছু বিস্মৃত হইনি।[আল-বুখারী, ‘কিতাবুল ইলম’, ‘জ্ঞানের হেফাযত’ শীর্ষক অধ্যায়, #১১৯]

অতএব, এ ঘটনায় পরিস্ফুট হচ্ছে হযরত আবূ হুরায়রাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর কাছে বিস্মৃতি থেকে সমাধান চেয়েছিলেন। এটা এমন এক বিষয় যা আল্লাহ ছাড়া মঞ্জুর করা সম্ভব নয়। নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তো এই মহান সাহাবী (রা.)-কে নিষেধ করেননি, অথবা তাঁকে শির্কের দোষারোপও করেননি। কেননা সবাই জানেন, যখন কোনো মু’ওয়াহহেদ (তওহীদ/আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসী মুসলমান) আল্লাহর দরবারে মর্যাদাবান কারো কাছে কোনো কিছুর জন্য আবেদন জানান, তখন তিনি তা দ্বারা এই উদ্দেশ্য করেন না যে ওই মর্যাদাবান পুণ্যাত্মা তা সৃষ্টি করে দেবেন; আর তিনি ওই পুণ্যাত্মা সম্পর্কে এ রকম কিছু বিশ্বাসও করেন না। তিনি শুধু এই আকাঙ্ক্ষা করেন ওই পুণ্যাত্মা আল্লাহতায়ালা তাঁকে দুআ’ করার ও অন্যান্য ব্যাপারে যে সামর্থ্য দিয়েছেন, তা দিয়েই তিনি তাঁর পক্ষে মাধ্যম/মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করবেন। (পাঠক) আপনি এখানে দেখতে পাচ্ছেন প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওই মহান সাহাবী (রা.)’এর আবেদন/আর্জির জবাব দিয়েছিলেন, আর এই বর্ণনায় এ কথা বলা হয়নি যে তিনি তাঁর জন্য দুআ’ করেছিলেন। যেটুকু বর্ণিত হয়েছে তা হলো, তিনি ওই সাহাবী (রা.)’এর চাদরের মধ্যে বাতাস ঝেড়েছিলেন এবং তা তাঁর বুকের কাছে বেঁধে রাখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। আল্লাহতায়ালা এটা নিজ পক্ষ থেকে ফজল বা অনুগ্রহ হিসেবে সংঘটিত করেন, আর তিনি হযরত আবূ হুরায়রাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর প্রয়োজন মেটানোর বেলায় এটাকে মাধ্যম বানিয়েছিলেন। 

অনুরূপভাবে, প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবী আবূ হুরায়রাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-কে বলেন নি এ কথা:

مالك تسألني والله أقرب إليك مني؟

অর্থ: “তুমি আমার কাছে কেন চাচ্ছো, যখন আল্লাহতায়ালা আমার চেয়েও তোমার নিকটতর?” 

এ ব্যাপারটি সবারই ভালোভাবে জ্ঞাত যে প্রয়োজন পূরণের সিদ্ধান্তকারী বিষয়টি তাঁরই (মানে আল্লাহরই) হাতে, যাঁর কাছে রয়েছে সব বিষয়ের রাস/লাগাম এবং যাঁর সাথে এ সিদ্ধান্ত অন্বেষণকারী তথা সুপারিশকারীর ঘনিষ্ঠতা ও কামালাত/পূর্ণতার ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে থাকে।

ক্বাতাদা (রা.) চোখ সারাবার জন্য প্রিয়নবী (দ.)’এর সহায়তা চান

এটা সাবেত তথা প্রতিষ্ঠিত যে হযরত ক্বাতা’দা বিন নু’মান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর চোখে একবার আঘাত লেগেছিলো যার দরুন তাঁর চোখ আপন কোটর থেকে বের হয়ে এসেছিলো। তাঁরা (সাহাবা) তা কেটে ফেলতে চেয়েছিলেন। এমতাবস্থায় তিনি বলেন:

لا حتى أستأمر رسول الله صلى الله عليه وسلم.

অর্থ: “না, যতোক্ষণ পর্যন্ত না রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর সিদ্ধান্ত আমি অন্বেষণ করি (ততোক্ষণ পর্যন্ত নয়)।” অতঃপর তিনি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর কাছে এ ব্যাপারে তাঁর সিদ্ধান্ত চান, আর তিনি বলেন – لا – মানে “না।” 

ثم وضع راحته على حدقته ثم غمزها فعادت كما كانت فكانت أصح عينيه.

অর্থ: এরপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপন হাতের তালু ওই সাহাবীর চক্ষুতারার ওপরে রাখেন এবং আলতোভাবে সেটাকে চাপ দেন আর সেটা নিজ স্থানে আবার দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়; উপরন্তু ওই চোখ অধিকতর তীক্ষ্ণদৃষ্টিসম্পন্ন হয়। এটা বর্ণনা করেছেন সর্ব-ইমাম বাগাভী (রহ.) ও আবূ ইয়ালা (রহ.); আর আদ্ দারুক্বুতনী (রহ.), ইবনে শা’হীন (রহ.) ও আল-বায়হাক্বী (রহ.) কর্তৃক নিজ ‘আদ্ দালায়েল’ গ্রন্থেও উদ্ধৃত হয়েছে; উপরন্তু, এটা হাফেয ইবনে হাজর (রহ.) কর্তৃক ‘আল-ইসা’বা’ (৩/২২৫) পুস্তকে এবং আস্ সৈয়ূতী (রহ.) কর্তৃক ‘আল-খাসাইসুল কুবরা’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়েছে। 

আরেকজন সাহাবী (রা.) বিশাল পুঁজকোষ অপসারণে নবী পাক (দ.)’এর সাহায্য চান

বর্ণিত হয়েছে হযরত মুহাম্মদ ইবনে উক্ববা বিন শুরায়হীল (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে, তিনি বর্ণনা করেন তাঁর দাদা হযরত আবদুর রহমান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে, তিনি তাঁর পিতা হতে, যিনি বলেন:

أتيت رسول الله صلى الله عليه وسلم وبكفي سلعة فقلت: يا نبي الله! هذه السلعة قد أورمتني لتحول بيني وبين قائم السيف أن أقبض عليه وعن عنان الدابة، فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم: ((أدن مني)).. قال: فدنوت ففتحها فنفث في كفي ثم وضع يده على السلعة فما زال يطحنها بكفه حتى رفع عنها وما أرى أثرها. 

অর্থ: আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর দরবারে আমার হাতে একটি বিশাল আকৃতির পুঁজকোষ নিয়ে উপস্থিত হলাম। অতঃপর আরজ করলাম, ‘এয়া রাসূলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমার এ পুঁজকোষ ফুলেছে এবং আমাকে আমার তরবারি ও ঘোড়ার লাগাম শক্তভাবে ধরতে বাধাগ্রস্ত করছে।’ প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বল্লেন, ‘আমার কাছে এসো।’ আমি তাঁর নিকটবর্তী হলে তিনি তা খোলেন, এরপর তাঁর থুতু মোবারক আমার হাতের তালুতে ফেলেন এবং তাঁর হাত মোবারক ওই পুঁজকোষের ওপরে স্থাপন করেন। তিনি বারংবার (হাত দ্বারা) ঘষতে থাকেন, যতোক্ষণ না তা (মানে পুঁজকোষ) অপসারিত হয় এবং আমি সেটার লেশচিহ্নও আর দেখতে পাই নি। [আত্ তাবরানী (রহ.) এটা বর্ণনা করেন এবং হাফিয আল-হায়তামী (রহ.) ‘মজমাউয্ যাওয়াঈদ’ (৮/২৯৮) কিতাবে এর উল্লেখ করেন]

প্রিয়নবী (দ.)’এর কাছে বদরের জ্বিহাদে মু’য়ায (রা.) নিজের হাতের ব্যাপারে সাহায্য চান

বদর জ্বিহাদের দিন ইকরিমা বিন আবী জাহিল হযরত মু’য়ায ইবনে ‘আমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর কাঁধে (তরবারির) আঘাত করে। হযরত মু’য়ায (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন: 

فضرب يدي فتعلقت بجلدة من جنبي وأجهضني القتال عنه فلقد قاتلت عامة يومي وإني لأسحبها خلفي فلما آذتني وضعت عليها قدمي ثم تمطيت عليها حتى طرحتها.

অর্থ: সে (ইকরিমা) আমার হাতে আঘাত করে এবং তা স্রেফ চামড়ার সাথে (সংযোগের দরুন) ঝুলে ছিলো। আর আমি যুদ্ধের কারণে এর প্রতি মনোযোগ দিতে পারিনি। বস্তুত দিনের বেশির ভাগ সময়ই আমি এটাকে বয়ে নিয়ে চলেছিলাম (যতোক্ষণ না এটা আমাকে অস্বস্তি দিয়েছিলো)। অতঃপর আমি এর ওপরে আমার পা রেখে এটাকে টেনে বিচ্ছিন্ন করে দেই।

আল-মাওয়াহিব গ্রন্থে (প্রণেতা: ইমাম ক্বসতলানী) বিবৃত হয়:

وجاء معاذ بن عمرو يحمل يده، وضربه عليها عكرمة، إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم، كما ذكر القاضي عياض عن ابن وهب، فبصق عليه الصلاة والسلام عليها فلصقت. 

অর্থ: হযরত মু’য়ায ইবনে ‘আমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) নিজ হাতটি বহন করে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর কাছে যান – যে হাতটির ওপর ইকরিমা আঘাত হেনেছিলো, যেমনটি উল্লেখ করেছেন ইমাম কাজী আয়াজ (রহমতুল্লাহি আলাইহি) ইবনে ওয়াহব (রহমতুল্লাহি আলাইহি)’এর সূত্রে; অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাতে নিজ থুতু মোবারক নিক্ষেপ করেন এবং তা ওই সাহাবী (রা.)’এর পবিত্র দেহে জোড়া লেগে যায়। 

ذكر هذه القصة الزرقاني وأسندها إلى ابن إسحاق ومن طريقه الحاكم.

অর্থ: এই ঘটনা বর্ণনা করেন ইমাম যুরক্বানী মালেকী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) এবং এর ইসনাদ তিনি ইমাম ইবনে ইসহাক্ব (রহমতুল্লাহি আলাইহি)’এর প্রতি আরোপ করেন, যা আল-হাকিম (রহমতুল্লাহি আলাইহি)’এর তরীক্ব তথা সূত্রে বর্ণিত হয়েছিলো।

প্রিয়নবী (দ.)’এর মাধ্যমে আল্লাহর দরবারে সাহায্য ও সহায়তা অন্বেষণ

খরা ও অনাবৃষ্টির কোনো ঘটনা ঘটলে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) যে আল্লাহর বরাবর পৌঁছুতে রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর দরবারে ছুটে যেতেন এবং তাঁর শাফা’আত প্রার্থনা করতেন, তাওয়াসসুল পালন করতেন, আবেদন (তলব) জানাতেন, সহায়তা চাইতেন, এর প্রচুর ও অসংখ্য সহীহ বর্ণনা বিদ্যমান। তাঁরা তাঁর কাছে নিজেদের সমস্যাদি উপস্থাপন করতেন এবং তাঁরা যেসব বালা-মসীবত ও মন্দ দ্বারা আক্রান্ত হতেন সে ব্যাপারে আরজিও পেশ করতেন।

সেই বেদুঈন আরব ব্যক্তির দৃষ্টান্তই ধরুন, যিনি রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক জুমুআ’র খুতবা দানকালে তাঁর প্রতি নেদা/আহ্বান জানিয়েছিলেন এই বলে:

يا رسول الله هلكت الأموال وانقطعت السبل فادع الله أن يغيثنا.  

অর্থ: ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! সমস্ত সম্পদের বিনাশ হয়েছে এবং সব পথ (মানে উপায়) কাটা পড়েছে। (অনুগ্রহ করে) আল্লাহর কাছে দুআ’ করুন যাতে তিনি বৃষ্টি মঞ্জুর করেন।

فدعا الله وجاء المطر إلى الجمعة الثانية، 

অর্থ: অতঃপর নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দুআ’ করলেন এবং বৃষ্টি আরম্ভ হলো, যা পরবর্তী সাপ্তাহিক জুমুআ’র দিন পর্যন্ত চল্লো।

فجاء وقال: يا رسول الله تهدمت البيوت وتقطعت السبل وهلكت المواشي.. يعني من كثرة المطر

এরপর ওই বেদুঈন আরব (উক্ত পরের সাপ্তাহিক জুমুআ’তে) ফিরে এলেন এবং আরজ করলেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে এবং পথ/উপায়ও কাটা পড়েছে; আর চারণরত প্রাণিও ধ্বংস হয়েছে।… মানে অতিবৃষ্টির কারণে।

فدعا صلى الله عليه وسلم فانجاب السحاب وصار المطر حول المدينة ..

অর্থ: অতঃপর আল্লাহর দরবারে নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দুআ’ করেন এবং মেঘমালা এরপর বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, আর বৃষ্টি মদীনা মোনাওয়ারার উপকণ্ঠে পড়তে থাকে। [আল-বুখারী বর্ণিত; কিতাবুল ইসতেসক্বা/বৃষ্টির নামাযসম্পর্কিত বই; ‘খরাপীড়িত মানুষের দ্বারা ইমামের কাছে বৃষ্টির নামাযের জন্য আবেদন’ শীর্ষক অধ্যায়]

ইমাম আবূ দাউদ (রহমতুল্লাহি আলাইহি) হযরত মা আয়েশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) হতে শক্তিশালী সনদে বর্ণনা করেন যে তিনি বলেন:

قالت شكا الناس إلى رسول الله قحوط المطر.

অর্থ: প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর দরবারে মানুষেরা মুষলধারায় বৃষ্টিপাতের ব্যাপারে অভিযোগ করেছিলেন। [আবূ দাউদ, কিতাবুস্ সালাত, বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা অধ্যায়; এটা আল-বায়হাকী (রহ.)-ও ‘দালায়েলুন্ নুবূওয়্যাত’ গ্রন্থে হযরত আনাস (রা.) হতে এমন এক এসনদে বর্ণনা করেছেন যাঁদের বিরুদ্ধে জাল/বানোয়াট হাদীস বর্ণনার কোনো অভিযোগ নেই; দেখুন ‘ফাতহুল বারী,’ ২/৪৯৫]

হযরত আনাস বিন মালিক (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত যে একবার প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর দরবারে এক বেদুঈন আরব ব্যক্তি এসে আরজ করেন: 

يا رسول الله! أتيناك ومالنا بعير يئط، ولا صبي يغط،

অর্থ: “ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমি আপনার দরবারে এসেছি, কেননা আমাদের নেই এমন কোনো উট যার ওপরে সওয়ার হওয়া যায়; কিংবা নেই এমন কোনো শিশু যার খিদে মিটেছে।” এরপর তিনি নিম্নের কয়েক ছত্র কবিতা গেয়ে শোনান:

أتيناك والعذراء يدمى لبانها

وقد شغلت أم الصبي عن الطفل

وألقى بكفيه الفتى استكانة

من الجوع ضعفاً ما يمر ولا يحلي

ولا شيء مما يأكل الناس عندنا

سوى الحنظل العامي و العلهز الغسل

وليس لنا إلا إليك فرارنا

وأين فرار الناس إلا إلى الرسل.

আমরা এমন সময়ে হয়েছি আপনার দ্বারে শরণাপন্ন,

যবে আমাদের কুমারীদের স্তনবৃন্ত হয়েছে শুকিয়ে বিপন্ন,

এবং মা তাঁর শিশুর চেয়েও আপন জীবনের চিন্তায় নিমগ্ন,

ওই শিশু ক্ষুধায় হাত নামিয়ে বসে আছে বিষন্ন,

কেননা এ খিদে জ্বালাময় এবং অবিরত করছে নিশ্চিহ্ন,

আমাদের জনগোষ্ঠীর কাছে আর নেই আহারের মতো অন্ন,

কেবল তেতো শশা ও উটের রক্তমিশ্রিত পশমজাত খাদ্যপণ্য।

আপনি ছাড়া আমাদের নেই আর কোনো অভয়ারণ্য,

মানুষ কোথায় পাবে আশ্রয় প্রিয়নবী পাক (দ.) ভিন্ন?

(ভাবানুবাদ)

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উঠে দাঁড়ান এবং তাঁর চাদর টানতে টানতে মিম্বরে আরোহণ করেন। অতঃপর তিনি মোবারক দু হাত তুলে দোয়া করেন:

((اللهم اسقنا غيثاً مغيثاً مريئاً مريعاً غدقاً طبقاً نافعاً غير ضار عاجلاً غير رائث تملأ به الضرع، وتنبت به الزرع، وتحيي به الأرض بعد موتها. قال فما رد رسول الله صلى الله عليه وسلم يديه حتى ألقت السماء بأردافها، وجاء الناس يضجون الغرق، فقال صلى الله عليه وسلم: حوالينا ولا علينا)). فانجاب السحاب عن المدينة.

অর্থ: “হে আল্লাহ! আমাদেরকে পুনরুজ্জীবনকারী বৃষ্টি মঞ্জুর করুন, যা (হোক) প্রচুর ও ছড়ানো-ছিটানো উঁচু ও নিচু উপত্যকায়; আর যা (হোক) উপকারী ও অক্ষতিকর। (আপনার অনুগ্রহে) এই বারিপাত অনতিবিলম্বে মঞ্জুর করুন, যা ক্ষেতকে ঊর্বর করে ফসলকে বেড়ে তুলবে, আর এ বিরাণ মাটিকে জীবনদান করবে।”

বর্ণনাকারী হয়রত আনাস বিন মালিক (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, “তিনি (দ.) দু হাত তখনো (দুআ’ থেকে) নামান নি, যখন মেঘমালা জড়ো হয়ে যায় (এবং বৃষ্টি নামে); আর মানুষেরা বেরিয়ে এসে প্রবল বর্ষণের ব্যাপারে তাঁর কাছে অভিযোগ করেন। অতঃপর তিনি বলেন, ‘আমাদের (শহরের) উপকণ্ঠে (বর্ষণ) হোক, আমাদের ওপরে নয়।’ এর পরপরই মেঘমালা মদীনা হতে চলে যায়।”

লক্ষ্য করুন কীভাবে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রূপকার্থে সহায়তা ও কল্যাণ এবং এর অনুরূপ বিষয়াদিকে বৃষ্টির সাথে তুলনা করেছেন; আর কীভাবে তিনি মৌন অনুমোদন দিয়েছেন ওই (বেদুঈন আরব) কবির নিম্নোক্ত কথাকে – وليس لنا إلا إليك فرارنا – “আপনি ছাড়া আমাদের নেই আর কোনো অভয়ারণ্য, মানুষ কোথায় পাবে আশ্রয় প্রিয়নবী পাক (দ.) ভিন্ন?” রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বেদুঈন আরব কবিকে মুশরিক তথা অংশীবাদী বিবেচনা করেননি, কেননা তাঁর কথাটি ছিলো (রূপক) বর্ণনা-সম্বন্ধীয়। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর কাছে কি আল্লাহতায়ালার নিম্নোক্ত কালাম/বাণীটি আড়াল ছিলো, যদিও ক্বুর’আনী আয়াতগুলো তাঁরই কাছে অবতীর্ণ হয়েছিলো – فَفِرُّوۤاْ إِلَى ٱللهِ – “সুতরাং আল্লাহর প্রতি ছুটে যাও (আশ্রয় হিসেবে)” [আল-ক্বুর’আন, ৫১/৫০, নুরুল ইরফান]?

এর মানে হলো এ কথা বলা, যে আশ্রয়ের দিকে ছুটে যাওয়ায় উপকার/কল্যাণপ্রাপ্তির জোরালো আশা তা আপনিই (হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং আপনি ছাড়া অন্য কিছু নয় (إليك لا إلى من دونك); আর অন্যান্য রাসূল (আলাইহিমুস্ সালাম)-ও, তাঁরা ছাড়া অন্য কিছু নয়। অতএব, মুরসালীন তথা রাসূল (আলাইহিমুস্ সালাম)-বৃন্দই হলেন আল্লাহর বরাবর তাওয়াসসুল পালনের সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম এবং তাঁদের মধ্যস্থতায় ও তাঁদেরই হাত দ্বারা আল্লাহ পাক আবেদনকারীদের ও সহায়তা অন্বেষণকারীদের প্রয়োজন পূরণ করে থাকেন। 

গভীরভাবে ভাবুন, প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বেদুঈন আরব কবির গাওয়া শ্লোকগুলোর দ্বারা কতোখানি প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং তাঁর সহায়তা অন্বেষণ ও আবেদনে সাড়া দিতে কতো দ্রুত উঠে দাঁড়িয়েছিলেন এমনই পর্যায়ে যে, তিনি মিম্বরে উঠেছিলেন চাদর টানতে টানতে, তা যথাযথভাবে গোছাতে একটুও থামেননি; এটা স্রেফ এ কারণে যাতে যাঁরা তাঁর প্রতি নেদা/আহ্বান জানান তাঁদের প্রতি তাড়াতাড়ি তিনি সাড়া দিতে পারেন। 

عليه وعلى آله أفضل الصلاة والسلام.

প্রিয়নবী ও তাঁর পরিবারসদস্যদের প্রতি বর্ষিত হোক সর্বোত্তম সালাত ও সালাম।

রাসূলুল্লাহ (দ:) আমাদের ভিত্তিস্তম্ভ, আশ্রয়ের কেন্দ্রবিন্দু ও সাহায্য

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর প্রতি সাহাবী কবি হযরত হাসসান বিন সা’বিত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) নেদা তথা আহ্বান জানান এবং তাঁকে বর্ণনা করেন এক স্তম্ভ হিসেবে, যাঁর ওপরে কবি নির্ভর করেন, আর আশ্রয়ের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবেও, যাঁর মাধ্যমে কবি সাহায্য অন্বেষণ করেন। কবি বলেন: 

يا ركن معتمد وعصمة لائذ

وملاذ منتجع وجار مجاور

يا من تخيره الإله لخلقه

فحباه بالخلق الزكي الطاهر

أنت النبي وخير عصبة آدم

يا من يجود كفيض بحر زاخر

ميكال معك وجبرئيل كلاهما

مدد لنصرك من عزيز قادر

أنظر الإصابة: (٢٦٤/١) والروض الأنف: (٩١/٢)

আপনি হন মজবুত স্তম্ভ, হে আল্লাহর রাসূল,

আর সাহায্য অন্বেষণকারীর ভরসার কেন্দ্রবিন্দুস্থল,

আপনি হন উপকারী আশ্রয় ও ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী সরল,

হে পুণ্যাত্মা, যাঁকে খোদা তাঁরই সৃষ্টিকুলের তরে করেছেন মনোনীত,

আর পবিত্র ও নির্মল চরিত্র মঞ্জুর দ্বারা যাঁকে করেছেন পুরস্কৃত,

আপনিই হন নবী ও পয়গাম্বর আদম (আ.)’এর সেরা আশ্রয়স্থল,

আপনি সত্যি মহৎ, যেনো রত্নখচিত সাগরের মতো উজ্জ্বল,

আপনার সাথে রয়েছেন ফেরেশতা মীকাঈল ও জিবরীল,

আর তাঁরা দু জন হলেন আপনারই সাহায্যের বল,

যা এসেছে হতে সর্বময় ক্ষমতাধর সত্তা – পুতঃ ও নির্মল।

(ভাবানুবাদ) 

[দেখুন – আল্ ইসা’বা, ১:২৬৪; এবং আল-রওদুল্ আ’নিফ, ২:৯১]

হামযা (রা:) সৎকর্মশীল ও মুসিবত দূরকারী

ইবনে শা’যা’ন (রহ.) হতে বর্ণিত একটি হাদীস আছে, যা বর্ণনা করেছেন হযরত ইবনে মাস’উদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)। তিনি বলেন: আমরা প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে এতো বেশি কাঁদতে আর কখনো দেখিনি, যেমনটি দেখেছি হযরত হামযাহ ইবনে আবদিল মুত্তালিব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর শাহাদাত বরণে। তিনি তাঁকে ক্বিবলার দিক করে শায়িত করেন; অতঃপর জানাযার নামায পড়ান এবং চোখের পানিতে সিক্ত না হওয়া পর্যন্ত কাঁদেন। এরপর তিনি বলেন:

يا حمزة يا عم رسول الله صلى الله عليه وسلم وأسد الله وأسد رسوله يا حمزة يا فاعل الخيرات يا حمزة يا كاشف الكربات يا ذاب عن وجه رسول الله ــ من المواهب اللدنية (ج ١ ص ٢١). 

অর্থ: হে হামযাহ! হে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর (মহাসম্মানিত) চাচা! আল্লাহতায়ালার আসাদ/সিংহ এবং তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এরও আসাদ/সিংহ! হে হামযাহ! হে উত্তম কর্ম সংঘটনকারী! হে হামযাহ! হে কষ্ট দূরকারী! হে হামযাহ! হে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’কে প্রতিরক্ষাকারী! [ইমাম আহমদ বিন মুহাম্মদ শিহাবউদ্দীন ক্বাসতালানী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) বিরচিত ‘আল-মাওয়া’হিবুল লাদূন্নিয়্যাহ’, বাংলা সংস্করণ ২০১৯ খ্রীষ্টাব্দ, সাকলাইন প্রকাশন, ২য় খণ্ড, ১৩৮ পৃষ্ঠা]

(প্রকাশ্য) হায়াতে জিন্দেগী ও বেসাল শরীফের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই:

কেউ যদি আপত্তি উত্থাপন করে এ কথা বলে, ‘তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাধ্যমে ইস্তিগাসাহ তথা সহায়তা চাওয়া, আর্জি পেশ করা, শাফা’আত তথা সুপারিশ কামনা করা এবং এখানে উল্লেখিত যাবতীয় কিছু কেবল তখনই সঠিক হতে পারে, যদি তা হয় তাঁর (জাহেরী/প্রকাশ্য) হায়াতে জিন্দেগীতে। কিন্তু এগুলো তাঁর বেসাল শরীফের পরে করা হলে তা হবে কুফর/অবিশ্বাস।’ কিংবা আপত্তিকারী হয়তো আরো চিন্তাভাবনাহীন হয়ে বলতে পারে, ‘এটা বে-শরীয়তী (غير مشروع)’ অথবা ’না-জায়েয (لا يجوز)।’ 

এই আপত্তির জবাবে আমরা বলি:

সহায়তা কামনা ও তাওয়াসসুল তথা অসীলা গ্রহণের প্রসঙ্গে দুনিয়াবী জীবনই যদি হয় এর বৈধতার প্রভাববিস্তারকারী, যেমনটি তারা (মানে আপত্তিকারীরা) দাবি করছে, তাহলে সেক্ষেত্রে আম্বিয়ায়ে কেরাম (আলাইহিমুস্ সালাম) তাঁদের মাযার-রওযায় জীবিত, যেমনটি জীবিত আল্লাহর ইবাদতকারীবৃন্দ যাঁদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট ও খুশি – إن الاستغاثة والتوسل إن كان المصحح لطلبها هو الحياة كما يقولون فالأنبياء أحياء في قبورهم وغيرهم من عباد الله المرضيين। প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর জাহেরী জিন্দেগীতে তাওয়াসসুল/অসীলা তালাশ ও সহায়তা অন্বেষণ ছাড়া তাঁর বেসাল শরীফের পরে তাওয়াসসুল পালন ও সহায়তা চাওয়ার পক্ষে অন্য কোনো ক্বিয়াস বা গবেষণালব্ধ দলিল ফিক্বাহবিদবৃন্দের কাছে যদি নাও থাকতো, তথাপিও এই দলিলই যথেষ্ট হতো (মানে মাযার-রওয়ায় তাঁরা জীবিত হবার দলিল)। তিনি উভয় লোকে (অতুলনীয় ও বর্ণনাতীত এক জীবনে) জীবিত এবং তাঁর উম্মতের জন্য সর্বদা যত্নবান (فإنه حيي الدارين دائم العناية بأمته)। আল্লাহর অনুমতিক্রমে তিনি দুনিয়ার বিষয়াদিকে তাসার্রূফ তথা পরিচালনা করতে পারেন এবং উম্মতের খবরাখবর সম্পর্কেও তিনি সম্যক অবগত। উম্মতের মধ্যে যাঁরা তাঁর প্রতি সালাওয়াত পাঠ করেন, তাঁদের সালাওয়াত তাঁর সামনে পেশ করা হয়, আর তাঁদের সংখ্যা অগণিত হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের সালাম তাঁর কাছে পৌঁছে থাকে।

যে ব্যক্তি রূহ তথা আত্মাসমূহের (মর্যাদাপূর্ণ) অবস্থা সম্পর্কে অধিক জানেন, আর রূহসমূহকে, বিশেষ করে তাঁদের মধ্যে সুউচ্চ মর্যাদার অধিকারীদেরকে আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ গুণাবলী সম্পর্কে যাঁর জানা রয়েছে, তাঁর অন্তর এতে (মানে ওপরে বর্ণিত বিষয়াদিতে) বিশ্বাস স্থাপনে উন্মুক্ত হবে। অতঃপর সমস্ত রূহের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ রূহ, সমস্ত নূরের (জ্যোতির) মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ নূর, আমাদের প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর শান-মান কী (তা ভাবুন)! 

যদি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর কাছে শাফা’আত কামনা, সহায়তা অন্বেষণ ও তাওয়াসসুল পালন শির্ক (অংশীবাদ) ও কুফর (অবিশ্বাস) হতো, যেমনটি আপত্তিকারীরা কল্পনা করে থাকে, তাহলে তা কোনো অবস্থাতেই জায়েয হতো না; এই দুনিয়ার জীবনে যেমন নয়, বেসালপ্রাপ্তির পরেও নয়, শেষ বিচার দিবসে বা তার আগেও নয়। অবশ্যঅবশ্য আল্লাহর দরবারে শির্ক সর্ব অবস্থাতেই ঘৃণিত।

একটি মিথ্যে দাবি

বেসাল তথা আল্লাহর সাথে পরলোকে মিলনপ্রাপ্ত (আউলিয়া) কোনো কিছু করার ক্ষমতা বা সামর্থ্য রাখেন না মর্মে দাবির ব্যাপার হলো এই যে, এটা একটা মিথ্যে দাবি। কেননা তাদের (মানে ভ্রান্তদের) এই ধারণাটি যদি বেসালপ্রাপ্ত (আউলিয়া) মাটিতে পরিণত হয়েছেন মর্মে তাদের ধারণারই ফলশ্রুতিতে হতো, তাহলে আমাদের রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে যা বর্ণিত হয়েছে তার আলোকে এটা হতো মূর্খতার চূড়ান্ত হদ্দ (অজ্ঞতার নয়নমণি – عين الجهل)। বরঞ্চ এটা আল্লাহতায়ালা কর্তৃক (ক্বুর’আনে) উল্লেখিত দেহ হতে বিচ্ছিন্ন রূহের বেসাল-পরবর্তী জীবন সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং বদর দিবসে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর প্রদত্ত ওই ভাষণ সম্পর্কেও অজ্ঞতা, যেখানে তিনি ফরমান:

((يا عمرو بن هشام ويا عتبة بن ربيعة ويا فلان ابن فلان إنا وجدنا ما وعدنا ربنا حقاً فهل وجدتم ما وعد ربكم حقاً)) ..

অর্থ: “ওহে ’আমর ইবনে হিশা’ম, ওহে ’উতবা ইবনে রাবি’আ, ওহে অমুকের পুত্র তমুক, আমাদের রব খোদাতায়ালা আমাদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা আমরা পেয়েছি। তোমাদের প্রতি তিনি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা তোমরা পেয়েছো কি?”

নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস করা হয়:

ما ذلك؟

অর্থ: এটা কেমন করে (যে তারা আপনাকে শুনতে পাচ্ছে)?

তিনি উত্তরে বলেন:

((ما أنتم بأسمع لما أقول منهم)) ..

অর্থ: “আমি যা বলি তা তোমরা তাদের চেয়ে ভালো শুনতে পাও না।”

এই বিষয়ের পক্ষে আরেকটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে যখন তিনি কবরস্থ মানুষদেরকে সালাম সম্ভাষণ জানিয়েছিলেন এ কথা বলে:

((السلام عليكم يا أهل الديار)) ..

অর্থ: তোমাদের প্রতি সালাম, ওহে এই স্থানের অধিবাসীবর্গ!

এর আরেকটি উদাহরণ হলো দ্বীন-ইসলামের পেশকৃত কবরের শাস্তি (আযাব) ও স্বস্তি (নে’আমত), রূহসমূহের আগমন ও প্রস্থানের পক্ষে প্রমাণ এবং এর পাশাপাশি অন্যান্য দলিলও, যা অতীত ও বর্তমান উভয় কালের দার্শনিকবৃন্দ সমর্থন করেছেন। 

আমাদের পক্ষ হতে এই প্রশ্নই যথেষ্ট হবে: শহীদানবৃন্দ যে তাঁদের প্রভুর দরবারে জীবিত, যেমনটি ক্বুর’আন মজীদে ঘোষিত হয়েছে, তাতে তোমরা বিশ্বাস করো কি-না? যদি তারা বিশ্বাস না করে, তাহলে তাদেরকে আর আমাদের কিছুই বলার নেই। কেননা তারা আল-ক্বুর’আনকে অস্বীকার করেছে, যা’তে ঘোষিত হয়েছে:

وَلاَ تَقُولُواْ لِمَنْ يُقْتَلُ فِي سَبيلِ ٱللهِ أَمْوَاتٌ بَلْ أَحْيَاءٌ وَلَكِن لاَّ تَشْعُرُونَ.

অর্থ: এবং যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তাদেরকে মৃত বোলো না, বরং তারা জীবিত; হ্যাঁ, তোমাদের খবর নেই। [আল-ক্বুর’আন, ২:১৫৪; নূরুল ইরফান]

এবং অন্যত্র বিবৃত হয়:

وَلاَ تَحْسَبَنَّ ٱلَّذِينَ قُتِلُواْ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ أَمْوَاتاً بَلْ أَحْيَاءٌ عِندَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ.

অর্থ: এবং যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে, কখনো তাদেরকে মৃত বলে ধারণা কোরো না; বরং তারা নিজ রবের নিকট জীবিত রয়েছে, জীবিকা পায়। [আল-ক্বুর’আন, ৩:১৬৯; নূরুল ইরফান]

যদি তারা এতে বিশ্বাস করে, তবে আমরা তাদের বলি: হযরতে আম্বিয়ায়ে কেরাম (আলাইহিমুস্ সালাম) ও অনেক পুণ্যাত্মা মুসলমান যেমন – আকাবের/বুযূর্গ সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলী শহীদ নন, আর তাঁরা শহীদানের চেয়ে নিঃসন্দেহে আফযাল বা শ্রেষ্ঠ। অতএব, শহীদানের ইন্তিক্বাল-পরবর্তী জীবন যদি (দলিলে) প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে তাঁদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ পুণ্যাত্মা (আউলিয়া)-বৃন্দের বেসাল-পরবর্তী জীবনও (ইসলামী জ্ঞান-প্রজ্ঞার ভিত্তিতে) প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়; আর বাস্তবতা হলো, আম্বিয়ায়ে কেরাম (আলাইহিমুস্ সালাম)-মণ্ডলীর বেসাল-পরবর্তী জীবনের পক্ষে সহীহ হাদীসসমূহে স্পষ্ট বর্ণনা এসেছে।

আমরা বলি: যেহেতু রূহসমূহের জীবন ফায়সালাকারী দলিল দ্বারা সাবেত/প্রতিষ্ঠিত, সেহেতু এর অনন্য গুণাবলীকে হ্যাঁ-সূচক বলে স্বীকার করা ছাড়া আমাদের আর কোনো অবকাশ নেই। এটা এ কারণে যে, কোনো কিছুকে হ্যাঁ-সূচক বলে স্বীকার করার দরুন তার নিহিতার্থকে স্বীকারও বাধ্যবাধকতা হয়ে দাঁড়ায়; ঠিক যেমনটি কোনো কিছুর নিহিতার্থকে নাকচ করার দরুন তার নাকচও আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। এ বিষয়টি সর্বজনজ্ঞাত।

আল্লাহর কাছে (আম্বিয়া/আউলিয়ার) রূহসমূহের মাধ্যমে সহায়তা বা মদদ চাওয়াতে বাদ সাধে কোন্ বুদ্ধি-বিবেচনা, যেখানে কোনো ব্যক্তি হয়তো তাঁর চাহিদা পূরণে ফেরেশতাকুলের কাছে সাহায্য চাইতে পারেন, অথবা অপর কারো কাছেও সাহায্য চাইতে পারেন (যেমনটি কবি বলেছেন: “তুমি মানুষ তোমার আত্মা দ্বারা, নয়কো তা তোমার শরীর ও চেহারা”)? রূহের তাসার্রুফ (কর্ম সংঘটন) ফেরেশতাকুলের কর্ম সংঘটনের মতোই এবং তা এমন পর্যায়ে যে, এতে কোনো স্থানিক যোগাযোগ বা হাতিয়ারের প্রয়োজন নেই (لا تحتاج إلى مماسة ولا آلة)। রূহসমূহ আমাদের পার্থিব জীবনের জ্ঞাত যোগাযোগের নিয়ম-কানুন দ্বারা আবদ্ধ নন, বরঞ্চ (তাঁদের) এই জীবন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পারলৌকিক বস্তু। (আল্লাহ ঘোষণা করেন) – 

وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ ٱلرُّوحِ قُلِ ٱلرُّوحُ مِنْ أَمْرِ رَبِّي.

অর্থ: এবং (তারা) আপনাকে ‘রূহ’ সম্পর্কে প্রশ্ন করে। আপনি বলুন, ‘রূহ আমার রবের আদেশ থেকে একটা বস্তু।’ [আল-ক্বুর’আন, ১৭/৮৫; নূরুল ইরফান]

আর ফেরেশতাকুল ও জ্বিন জাতির তাসার্রুফ ক্ষমতা সম্পর্কে তারা কী-ই বা বোঝে? 

এতে কোনো সন্দেহ নেই যে রূহসমূহ চলাফেরা করার স্বাধীনতা ও সামর্থ্যের অধিকারী, যা দ্বারা তাঁদের কাছে ফরিয়াদকারীর আহ্বানে তাঁরা সাড়া দিতে সক্ষম হন এবং যারা তাঁদের সহায়তা চান তাঁদেরকে তা দিতে পারেন, ঠিক যেমনটি জীবিত লোকেরা তা করতে পারে; বরঞ্চ জীবিতদের চেয়েও অধিক (শক্তিশালী) মাত্রায় তাঁরা তা করতে পারেন। 

অতএব, যদি এর বিরোধিতাকারীরা (এতদসংক্রান্ত) কিছুই না জানে কেবল ইন্দ্রিয় দ্বারা অনভূত বিষয়াদি ছাড়া, আর যদি তারা কোনো কিছুই স্বীকার না করে স্রেফ বাহ্যিকভাবে প্রত্যক্ষকৃত বিষয়াদি ছাড়া, তাহলে এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রকৃতিবাদীদের (মানে প্রকৃতি সব কিছুর মূলে এ মর্মে ধারণা পোষণকারীদের) এবং ঈমানদার মুসলমানবৃন্দের দৃষ্টিভঙ্গি এটা নয়।

চলুন, আমরা বিরোধীদের প্রতি ছাড় দিয়ে স্বীকার করে নিই যে রূহসমূহ নিজ নিজ দেহ থেকে পৃথক হওয়ার পরে কোনো কিছু করতে পারেন না। কিন্তু আমরা তাদেরকে বলি: যদি আমরা এটা ধরে নিই এবং তর্কের খাতিরে একমত হই, তাহলেও আমরা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করতে সক্ষম যে আম্বিয়ায়ে কেরাম (আলাইহিমুস্ সালাম) ও আউলিয়ায়ে কেরাম (রহমতুল্লাহি আলাইহিম)-বৃন্দের কাছে মদদ অন্বেষণকারীদের প্রতি প্রদত্ত তাঁদের সহায়তা ও সাহায্য পার্থিব জগতে রূহসমূহের তাসার্রূফ ও যোগাযোগের শ্রেণিভুক্ত নয়। বরঞ্চ তাঁদের যেয়ারতকারী ও সাহায্যপ্রার্থীদের প্রতি তাঁদেরই সাহায্য হচ্ছে প্রার্থীদের জন্য দুআ’ করা, ঠিক যেমনটি কোনো সালেহ/পুণ্যবান বান্দা অন্যের জন্য দুআ’ করেন। অতএব, এটা কোনো ফযীলত-সম্পন্ন ব্যক্তির দুআ’ তাঁর চেয়ে কম ফযীলত-সম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য। অথবা অন্ততঃপক্ষে কোনো (দ্বীনী) ভাইয়ের দুআ’ তাঁরই (দ্বীনী) ভাইয়ের জন্য। এ বিষয়টি ইতোমধ্যে জ্ঞাত হয়েছে যে তাঁরা (মাযার/রওযায়) জীবিত এবং তাঁরা অনুভব করেন, জানেন ও বোঝেন। নিশ্চয় দেহ হতে রূহের আলাদা হওয়ার পরে (তাঁদের) অনুভূতি অধিকতর পূর্ণ, আর জ্ঞানও অধিকতর ব্যাপক। কেননা এ দেহত্যাগের ফলে মাটির পর্দা উঠে গিয়েছে এবং মানব শরীরের হীন কামনাগুলো (الشهوات البشرية) বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না।

একটি হাদীস শরীফে এসেছে যে আমাদের আমলনামা (কর্ম) প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সামনে পেশ করা হয় [ذكرنا هذا الحديث في غير موضع من هذا الكتاب مع تخريجه]। যদি তিনি তাতে ভালো দেখেন, তবে আল্লাহর প্রশংসা করেন। আর যদি তিনি তাতে এর ব্যতিক্রম দেখতে পান, তবে আমাদের পক্ষে আল্লাহর দরবারে ইস্তিগফার/সুপারিশ করেন। আমরা এ কথাও বলি: সাহায্য-সহায়তা যাঁর কাছ থেকে চাওয়া হয় তিনি আল্লাহ তায়ালা। তবে সাহায্যপ্রার্থী ব্যক্তি রাসূলূল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মধ্যস্থতায় আল্লাহর কাছে তাওয়াসসুল পালন করেন, যাতে তাঁর হাজত/প্রয়োজন মিটে যায়। অতএব, কর্তা (فاعل) আল্লাহ পাকই; কিন্তু প্রার্থী উদ্দেশ্য করে তাঁর কাছে চাইছেন (আল্লাহর) নৈকট্যপ্রাপ্ত ও করীম/মহৎ কারো খাতিরে। এ যেনো প্রার্থী আরজ করছেন:

أنا من محبيه [أو محسوبيه] فارحمني لأجله.

অর্থ: “ হে আল্লাহ, আমি তাঁর আশেক্ব-ভক্তদের মধ্য হতে একজন, তাই আমার প্রতি করুণা বর্ষণ করুন তাঁরই খাতিরে।” আল্লাহতায়ালা অসংখ্য মানুষের প্রতি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও আম্বিয়া-আউলিয়া-উলামা (হক্কানী/রব্বানী)-বৃন্দের খাতিরে তাঁর করুণা বর্ষণ করবেন।

সার্বিকভাবে এটা জ্ঞাত যে আল্লাহতায়ালা প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর খাতিরে তাঁরই আশেক্ব/ভক্তবৃন্দের প্রতি আপন অনুগ্রহ করেন; বরঞ্চ তিনি কিছু বান্দার প্রতি তাঁর অন্যান্য বান্দাদের ওয়াস্তেও নিজ অনুগ্রহ করেন। এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন সেসব মানুষ যাঁরা বেসালপ্রাপ্ত প্রিয় বান্দাবৃন্দের প্রতি সালাত-সালাম জানান এবং তাঁদের ওয়াস্তে আল্লাহর দরবারে ক্ষমা ও অনুগ্রহ চান এ আর্জি সহকারে:

وقد جئناك شفعاء فشفعنا.

অর্থ: “আমরা (আপনার) সুপারিশপ্রার্থী হয়ে আপনার কাছে এসেছি, অতঃপর আপনি আমাদের জন্য সুপারিশ করুন।”

যে জিনিস একমাত্র আল্লাহ মঞ্জুর করতে পারেন তা কারো কাছ থেকে চাওয়া কি শির্ক?

প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মাধ্যমে তাওয়াসসুল পালনকারীদের অথবা তাঁর কাছে (সরাসরি প্রার্থিত বস্তু/বিষয়) অন্বেষণকারীদের প্রতি কুফর/অবিশ্বাসের দোষারোপকারী লোকদের দ্বারা আঁকড়ে ধরে থাকা মিথ্যে দাবীগুলোর মধ্যে একটি হলো তাদের (নিম্নোক্ত) কথা:

إن الناس يطلبون من الأنبياء والصالحين الميتين ما لا يقدر عليه إلا الله وذلك الطلب شرك.

অর্থ: “মানুষেরা বেসালপ্রাপ্ত আম্বিয়া (আলাইহিমুস্ সালাম) ও সোয়ালেহীন/আউলিয়া (রহমতুল্লাহি আলাইহিম)-মণ্ডলীর কাছে এমন কিছু অন্বেষণ করে যা একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই মঞ্জুর করতে সক্ষম, আর এই অন্বেষণ করাটা শির্ক/অংশীবাদ।”   

এর জওয়াব হলো, মুসলমানবৃন্দ আদি যুগ হতে আজ পর্যন্ত যে পথ ও মতের ওপর দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত, সে ব্যাপারে এটা একটা ত্রুটিপূর্ণ/ভ্রান্ত ধারণা। নিশ্চয় মানুষেরা তাঁদেরকে (মানে আম্বিয়া-আউলিয়াকে) নিজেদের মহান রব্ব তায়ালার দরবারে কেবল মাধ্যম হবার জন্যই আবেদন জানিয়ে থাকেন, যাতে মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর দরবারে আম্বিয়া-আউলিয়ার শাফা’আত/সুপারিশ, দুআ’ ও আর্জির ফলশ্রুতিতে তাঁদের আকাঙ্ক্ষা আল্লাহ কর্তৃক পূরণ হয়, ঠিক যেমনটি সহীহ হিসেবে বর্ণিত হয়েছে এক অন্ধ সাহাবী (রা.) ও অন্যান্য আসহাব (রা.)-বৃন্দের ঘটনাবলী, যাঁরা মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সহায়তা চেয়েছিলেন এবং তাওয়াসসুল পালন করেছিলেন আল্লাহর নৈকট্য অন্বেষণে, আর তিনি (দ.)-ও পাল্টা তাঁদের আবেদনে সাড়া দিয়েছিলেন, তাঁদের দুশ্চিন্তাকে প্রশমিত করেছিলেন এবং আল্লাহরই অনুমতিক্রমে তাঁদের ইচ্ছাগুলোকে বাস্তবে পরিণত করেছিলেন। তিনি তাঁদের কাউকেই বলেননি এ কথা – أشركت – “তুমি শির্ক করেছো।” এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে তাঁর কাছে আবেদনকৃত অতিপ্রাকৃত/অলৌকিক বস্তু/বিষয়াদি, যেমন ওষুধ ছাড়া দুরারোগ্য (মরণ) ব্যাধি নিরাময়, প্রয়োজনের সময় মেঘমালা ছাড়া আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ, ঝর্নাধারার প্রবাহিতকরণ, নিজ আঙুলের ডগা থেকে পানি প্রবাহিতকরণ এবং খাদ্যে (অলৌকিক) বৃদ্ধি ও অনুরূপ মো’জেযাসমূহ। এসব বিষয় পার্থিব বিবেচনায় মানব-ক্ষমতার আওতাধীন নয়, তথাপিও তিনি (এ জাতীয় আবেদনে) সাড়া দিতেন এবং তাঁদেরকে বলতেন না এ কথা:

إنكم أشركتم فجددوا إسلامكم فإنكم طلبتم مني ما لا يقدر عليه إلا الله.

অর্থ: “নিশ্চয় তোমরা শির্ক করেছো, তাই নতুনভাবে তোমাদের ঈমান-ইসলামকে ঢেলে সাজাও; কেননা তোমরা আমার কাছে এমন বস্তু/বিষয় চেয়েছো যা মঞ্জুর করার ব্যাপারে আল্লাহ ছাড়া আর কেউই ক্ষমতা রাখেন না।”

এ সকল (বিরোধী) লোকেরা কি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীর চেয়েও তওহীদ ও ইসলাম-ধর্ম থেকে খারিজ হওয়ার বিষয়ে বেশি জানে? কোনো আলেম/জ্ঞান বিশারদ তো দূরে, একজন অজ্ঞ ব্যক্তিও এরকম চিন্তা বা কল্পনা করতে পারবেন না!

‘যখন তুমি চাইবে আল্লাহর কাছেই চাও, আর যখন সাহায্য প্রার্থনা করবে তখন তাঁর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা কোরো’

(إِذَا سَأَلْتَ فَاسْأَلْ اللهَ، وإِذَا اسْتَعَنْتَ فَاسْتَعِنْ بِاللهِ)   

এটা একটা প্রসিদ্ধ হাদীস শরীফের অংশবিশেষ যা ইমাম তিরমিযী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) মারফ’ঊ হিসেবে হযরত ইবনে আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনা করেছেন এবং যা সহীহ হিসেবে ঘোষিত হয়েছে [তিরমিযী, ২৫১৬ (বাংলা); ইমাম নববী, হাদীসে আরবাঈন, ১৯]। এই হাদীসটি বুঝতে অনেক লোক ভুল করে (এর থেকে) এই সিদ্ধান্ত নিয়ে যে, সামগ্রিকভাবে (مطلقاً) আল্লাহ ছাড়া (কারো কাছে) কোনো কিছু চাওয়ার বা সাহায্য প্রার্থনা করার বিধান নেই, তা যে কোনো দিক হতেই অথবা উপায়/পন্থা/পদ্ধতিতেই হোক না কেন; আর তারা এও দাবি করে যে, আল্লাহ ভিন্ন কারো কাছে চাওয়া বা সাহায্য প্রার্থনা করা শির্ক/অংশীবাদ, যা কাউকে মিল্লাত তথা ধার্মিক সমাজ থেকে খারিজ/বের করে দেবে। এই (ভ্রান্ত বুঝ) নিয়ে তারা সাবাব/কারণ/মাধ্যম (أسباب)-সমূহের সদ্ব্যবহার ও সাহায্য গ্রহণের বৈধতাকে অস্বীকার করে থাকে; আর এরই দ্বারা এক্ষেত্রে উদ্ধৃত অসংখ্য নস (كثيرًا من النصوص) বা শরঈ দলিলকে তারা নষ্ট করে দেয়। 

সত্য (কথা) হলো, এই হাদীস শরীফের উদ্দেশ্য এ নয় যে আল্লাহ ভিন্ন কারো কাছে চাওয়া বা সাহায্য প্রার্থনা করা যাবে না, যেমনটি আক্ষরিক/প্রকাশ্য বচনে এসেছে। এতে নিহিত (আসল) উদ্দেশ্য হলো, যা কিছু উত্তম তা যে আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকেই এসে থাকে তার ভিত্তিতে গাফলাত তথা অনবধানতাকে নিষেধ করা। এই হাদীসটি আদেশ করে এ বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য করতে যে, মাখলূক্বের মাধ্যমে যা কিছু নেয়ামত/দান পাওয়া যায়, তা আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে আগত এবং আল্লাহ কর্তৃক দানকৃত। এই হাদীসের অর্থ:

فالمعنى: وإذا أردت الاستعانة بأحد من المخلوقين، ولابد لك منها فاجعل كل اعتمادك على الله وحده ولا تحجبنك الأسباب عن رؤية المسبب جل جلاله، ولا تكن ممن يعلمون ظاهرًا من هذه الارتباطات والعلاقات بين الأشياء المترتب بعضها على بعض، وهم عن الذي ربط بينها غافلون.

অর্থ: যদি আপনি কোনো সৃষ্টির কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতে চান এবং তা আবশ্যক হয়, তবে আপনাকে শুধু আল্লাহরই ওপর নির্ভর করতে হবে, আর কোনোক্রমেই ওই মাধ্যম/কারণ যেনো বাধা না হয়ে দাঁড়ায় আপনাকে এ (বাস্তবতা) দর্শনে যে আল্লাহ (জাল্লা জালালুহু)-ই সমস্ত মাধ্যম/কারণের সুব্যবস্থা করেন। আপনি সেসব লোকের মধ্য হতে কেউ হবেন না, যারা এ পারস্পরিকভাবে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর কারণ ও প্রভাব স্রেফ এগুলোর বাহ্যিক সংযোগ ও সম্পর্কের ভিত্তিতেই (এগুলোকে) জানে, অথচ এগুলোর মধ্যকার সংযোগ স্থাপনকারী সেই মহান সত্তা সম্পর্কে যারা অনবধান/গাফেল।

আলোচ্য হাদীসটি নিজেই এই অর্থ ইঙ্গিত করেছে যখন প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পবিত্র বাণীর শেষাংশে উল্লেখিত হয়েছে:

وَاعْلَمْ أَنَّ الْأُمَّةَ لَوْ اجْتَمَعَتْ عَلَى أَنْ يَنْفَعُوك بِشَيْءٍ لَمْ يَنْفَعُوك إلَّا بِشَيْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللهُ لَك، وَإِنْ اجْتَمَعُوا عَلَى أَنْ يَضُرُّوك بِشَيْءٍ لَمْ يَضُرُّوك إلَّا بِشَيْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللهُ عَلَيْك.

অর্থ: “আর এ কথা জেনে রাখো যে, যদি সমস্ত উম্মত তোমার উপকার করার জন্য একত্রিত হয়ে যায়, তবে ততোটুকুই উপকার করতে পারবে, যতোটুকু আল্লাহ তোমার (ভাগ্যে) লিখে রেখেছেন। আর তারা যদি তোমার ক্ষতি করার জন্য একত্রিত হয়ে যায়, তবে ততোটুকুই ক্ষতি করতে পারবে যতোটুকু আল্লাহ তোমার (ভাগ্যে) লিখে রেখেছেন” [তিরমিযী, ২৫১৬ (বাংলা); ইমাম নববী, হাদীসে আরবাঈন, ১৯]। এতে (মানে এ হাদীসে) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁদের কাছে নিশ্চিত করেছেন যে আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক তাঁরই বান্দার জন্য যা তাক্বদীরের বিধান করেছেন তাতে উপকার এবং ক্ষতি নিহিত রয়েছে। 

فهذا منه صلى الله عليه وسلم يوضح مراده.

অর্থ: অতঃপর এই ভাষ্য প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উদ্দেশ্য স্পষ্ট করেছে।

আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে সাহায্য প্রার্থনাকে আমরা কীভাবে নিষেধ/অবজ্ঞা করতে পারি, যেখানে ক্বুর’আন মজীদ ও সুন্নাহর অসংখ্য স্থানে এর প্রতি আদেশ দেওয়া হয়েছে? আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন:

وَٱسْتَعِينُواْ بِٱلصَّبْرِ وَٱلصَّلَٰوةِ.

অর্থ: এবং ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো। [সূরাহ বাক্বারা, ৪৫ আয়াত; নূরুল ইরফান]

অন্যত্র ফরমান:

وَأَعِدُّواْ لَهُمْ مَّا ٱسْتَطَعْتُمْ مِّن قُوَّةٍ.

অর্থ: আর তাদের (মোকাবিলার) জন্য প্রস্তুত রাখো যে শক্তি তোমাদের সাধ্যে রয়েছে। [সূরাহ আনফাল, ৬০ আয়াত; নূরুল ইরফান]

আল্লাহ পাক তাঁর পুণ্যবান বান্দা হযরত যুলক্বারনাঈন (আলাইহিস সালাম)-এর বক্তব্য উদ্ধৃত করেন:

فَأَعِينُونِي بِقُوَّةٍ. 

অর্থ: “অতঃপর আমাকে সাহায্য করো শক্তি দ্বারা।” [সূরাহ কাহফ, ৯৫ আয়াত; নূরুল ইরফান]

সালাতুল খাওফ তথা ভয় হতে মুক্তির নামাযের শরঈ বৈধতা (مشروعية صلاة الخوف), যা ক্বুর’আন ও সুন্নাহ’তে সাবেত তথা সপ্রমাণিত, তাতে বিদ্যমান রয়েছে মানুষের একে অপরের কাছে সাহায্য চাওয়ার শরঈ বৈধতা। এরই অনুরূপ হচ্ছে ঈমানদারবৃন্দের প্রতি শত্রুর বিরুদ্ধে সতর্কতামূলক আত্মরক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আল্লাহর আদেশ। 

এরই অনুরূপ হলো প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক ঈমানদার মুসলমানবৃন্দকে উৎসাহ দান, যাতে তাঁরা একে অপরের প্রয়োজন পূর্ণ করতে পারেন; অসচ্ছলদের প্রতি (সচ্ছলতার) সুবিধা প্রদান এবং দুঃস্থদেরকে তা থেকে মুক্তি দান করতে পারেন। আর এর পাশাপাশি এসব (দায়িত্বের প্রতি) অবহেলার বিরুদ্ধে তাঁর (দ.) হুঁশিয়ারি উচ্চারণও। এটা তাঁরই সুন্নাহ’তে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। শাইখাইন (সর্ব-ইমাম বুখারী ও মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহিমা) বর্ণনা করেন নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাদীস:

مَنْ كَانَ في حَاجَة أخيه كَانَ اللهُ في حَاجَته.

অর্থ: যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূর্ণ করবেন, আল্লাহ (প্রতিদানে) তার প্রয়োজন পূর্ণ করবেন। [বুখারী, ২৪৪২; মুসলিম ৬৭৪৩]

সর্ব-ইমাম মুসলিম (রহ.), আবূ দাউদ (রহ.) ও অন্যরা বর্ণনা করেন যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরশাদ ফরমান:

وَاللهُ فِى عَوْنِ الْعَبْدِ مَا كَانَ الْعَبْدُ فِى عَوْنِ أَخِيهِ.

অর্থ: আর আল্লাহ তাঁর বান্দার সহায় থাকেন, যতোক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্য করতে থাকে। [মুসলিম ৭০২৮; আবূ দাউদ ৪৯৪৮; তিরমিযী ১৪২৫; ইবনে মাজাহ ২২৫; এবং আহমদ ৭৪২৭]

প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো ঘোষণা করেন:

إن لله خلقاً خلقهم لحوائج الناس يفزع الناس إليهم في حوائجهم، أولئك الآمنون من عذاب الله.

অর্থ: “নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা কিছু বান্দাকে সৃষ্টি করেছেন মানুষের প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য; আর মানুষেরা তাদের কাছে ছুটে যায় নিজেদের প্রয়োজন পূরণের জন্য। তারাই আল্লাহর শাস্তি হতে নিরাপদ (হবে)।” তাঁর (দ.) কথার দিকে লক্ষ্য করুন – “মানুষেরা তাদের কাছে ছুটে যায় নিজেদের প্রয়োজন পূরণের জন্য।” তিনি তো তাদেরকে (মানুষকে) মুশরিক/অংশীবাদী ঘোষণা করেননি, তাদেরকে অবাধ্যও ঘোষণা করেননি।

ইমাম আবূ দাউদ (রহ.) বর্ণিত মারফু’ হাদীসে আরো ঘোষিত হয়েছে:

((إن لله عند أقوام نعما أقرها عندهم ما كانوا في حوائج المسلمين ما لم يملوهم، فإذا ملوهم نقلها إلى غيرهم)).

অর্থ: “নিশ্চয় আল্লাহর অধিকারে রয়েছে নেয়ামত/আশীর্বাদ, যা তিনি সুনির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির মাঝে স্থাপন করেছেন, যতোক্ষণ তারা মুসলমানদের প্রয়োজন পূর্ণ করে এবং এতে বিরক্ত না হয়। তারা এতে বিরক্ত হলে আল্লাহ (ওই সব নেয়ামত) অন্যদের কাছে সরিয়ে নেন।”

সর্ব-ইমাম আবূ দাউদ ও ইবনে আবিদ্ দুনইয়া (রহমতুল্লাহি আলাইহিমা) বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাদীস/বাণী:

((إن لله أقواماً اختصهم بالنعم لمنافع العباد، يقرهم فيها ما بذلوها فإذا منعوها نزعها منهم فحولها إلى غيرهم)).

অর্থ: “আল্লাহর কাছে রয়েছে এমন ব্যক্তিবর্গ যাদের তিনি নেয়ামত দান করেছেন তাঁরই (অন্যান্য) বান্দাদের উপকারার্থে/কল্যাণে; এসব নেয়ামত তাদের কাছে থাকে যতোক্ষণ তারা এগুলো (মুক্তহস্তে) দান করে; তারা এগুলো আটকে রাখলে আল্লাহ এগুলোর (মধ্যে) সেরা নেয়ামতগুলো অন্যদের কাছে সরিয়ে নেন।”

হাফিয মুনযিরী (রহ.) এই বর্ণনা সম্পর্কে বলেন:

ولو قيل بتحسين سنده لكان ممكناً.

অর্থ: “আর যদি বলা হয় যে এর সনদ হাসান (শ্রেণির), তাহলে তা সম্ভব।”

প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘোষণা করেন:

((لأن يمشي أحدكم مع أخيه في قضاء حاجته – وأشار باصبعه – أفضل من أن يعتكف في مسجدي هذا شهرين)).

অর্থ: “তোমাদের মধ্যে কেউ তার (দ্বীনী) ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণে সাহায্য করার জন্য তার সাথে গেলে” – এ সময় নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ আঙুল মোবারক দ্বারা (আপন মসজিদের দিকে) ইশারা করেন – “তা আমার মসজিদে (রাতে) ই’তিকাফ করার চেয়েও উত্তম।” [হাকিম এর বর্ণনাকারী; তিনি বলেন – “এর ইসনাদ সহীহ”]

চাইলে আল্লাহর কাছেই চাও’ (وإذا سألت فاسأل الله) 

প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন – إِذَا سَألْتَ فَاسأَلِ الله – “যখন তুমি চাইবে, তখন আল্লাহর কাছেই চাও” (তিরমিযী, ২৫১৬; হাসান-সহীহ সাব্যস্ত করেছেন ইমাম তিরমিযী রহমতুল্লাহি আলাইহি)। এই হাদীস শরীফে এমন কোনো দলিল নেই যাকে আঁকড়ে ধরে (বিরোধীরা) কোনো কিছু চাওয়াকে অথবা তাওয়াসসুল পালনকে নিষেধের চেষ্টা করতে পারে। এর আক্ষরিক/যাহেরী শব্দচয়ন হতে যে ব্যক্তি এই অর্থ বুঝে নেয় যে সামগ্রিকভাবে কারো কাছে কিছু চাওয়া অথবা তাওয়াসসুল পালন করা সামগ্রিকভাবে নিষিদ্ধ, সে ভুল পথে পা বাড়িয়েছে এবং ধোঁকা দেওয়ার জন্য ভ্রান্ত যুক্তিতর্কে নিজেকে জড়িয়েছে। (ومن فهم من ظاهره منع السؤال من الغير مطلقاً أو منع التوسل بالغير على الإطلاق فقد أخطأ الطريق وغالط نفسه كل المغالطة)             

মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছ থেকে খায়র-বরকত তথা ঐশী কল্যাণ লাভের উদ্দেশ্যে অথবা তাঁরই অনুগ্রহে মন্দ দূর করার লক্ষ্যে যে ব্যক্তি আম্বিয়া/পয়গাম্বর (আলাইহিমুস্ সালাম) ও সালেহীন/পুণ্যবান (আউলিয়া)-মণ্ডলীর মধ্যস্থতা গ্রহণ করেন, তিনি আর কিছু চান না কেবল আল্লাহরই কাছে চান যেনো প্রার্থিত বস্তু তাঁকে দান করা হয়; অথবা আল্লাহরই ইচ্ছায় কোনো মন্দ যেনো দূর করা হয়; আর তিনি আল্লাহরই বরাবর তাওয়াসসুল পালন করেন। মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালা তাঁর কাছ থেকে আপন বান্দাবৃন্দের চাহিদা সফলভাবে পূরণের জন্য যে মাধ্যমসমূহ স্থাপন করে রেখেছেন, সেগুলোকে এই ব্যক্তি আঁকড়ে ধরেছেন মাত্র। যে ব্যক্তি আল্লাহর দানশীলতার ভাগীদার হবার জন্য তাঁরই আদিষ্ট মাধ্যমগুলোকে আঁকড়ে ধরেন, তিনি খোদ মাধ্যমগুলোর কাছে চান না, বরং তিনি সেই পবিত্র সত্তার কাছেই চান, যিনি ওই মাধ্যমগুলোকে (মাধ্যম হিসেবে) স্থাপন করেছেন।

কেউ যখন বলেন এ কথা – يا رسول الله أريد أن ترد عيني – হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আমি চাই আপনি যেনো আমার (চোখের) দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেন,” অথবা – أو يزول عنا البلاء – “আপনি যেনো আমার বালা-মসীবত দূর করে দেন,” কিংবা – أو أن يذهب مرضي – “আপনি যেনো আমাকে আমার অসুস্থতা থেকে আরোগ্য দান করেন,” তখন এর মানে দাঁড়ায় তিনি আল্লাহরই দরবারে এসব চেয়েছেন প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর শাফা’আত বা সুপারিশের মধ্যস্থতায়। এটা অনেকটা তাঁর এরকম কথা বলার মতোই – ادع لي بكذا واشفع لي في كذا – “এর দ্বারা আমার জন্য দুআ’ করুন (আল্লাহর দরবারে); আর এই ক্ষেত্রে আমার জন্য শাফা’আত করুন।”এ দুটোর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, স্রেফ এতোটুকু (পার্থক্য) যে একটি অপরটির চেয়ে উদ্দেশ্য ব্যক্ত করার বেলায় অধিকতর স্পষ্ট।

এই দুটো উদাহরণের অনুরূপ এবং আরো স্পষ্টতর হচ্ছে তাওয়াসসুল পালনকারীর ওই ভাষ্য যা’তে ব্যক্ত হয় – اللهم إني أسألك بنبيك تيسير كذا مما ينفع أو دفع كذا من الشر – “হে আল্লাহ, আমি আপনার নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মধ্যস্থতায় আপনার কাছে এমন সুবিধা চাচ্ছি, যা’তে উপকার হয় অথবা অমঙ্গল দূরীভূত হয়।” অতএব, এতে (হাকীকী অর্থে) তাওয়াসসুল পালনকারী তাঁর নিজের চাহিদা পূরণে মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছেই কিছু চাননি।

প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক ব্যক্ত – إِذَا سَألْتَ فَاسأَلِ الله – “যখন তুমি চাইবে, তখন আল্লাহর কাছেই চাও” (তিরমিযী, ২৫১৬; হাসান-সহীহ সাব্যস্ত করেছেন ইমাম তিরমিযী রহমতুল্লাহি আলাইহি) – মর্মে হাদীসের বাণী প্রদর্শন করে তাওয়াসসুল পালনের প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপের অপচেষ্টা সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, এটা হাদীসটাকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য কুতর্ক জুড়ে দেওয়া যা স্পষ্ট ফাসাদ (ছাড়া কিছু নয়), যে অপব্যাখ্যায় ব্যক্ত হয় যে আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে কোনো কিছু চাওয়া সহি/সঠিক নয়। যে ব্যক্তি হাদীসটি হতে (ওপরের) এই অর্থ বুঝে নেয়, সে স্পষ্টতঃ ভ্রান্তিতে অধঃপতিত। তার ভ্রান্ত মত অপনোদনে এটা বলা যথেষ্ট হবে যে, স্বয়ং হাদীসটি ছিলো রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পক্ষ থেকে একখানা প্রশ্নের জওয়াব, যা হাদীসটির বর্ণনাকারী হযরত ইবনে আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) উত্থাপন করেছিলেন যখনই নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে প্রশ্ন করার উৎসাহ দিয়ে বলেছিলেন – يا غلام! ألا أعلمك كلمات ينفعك الله بهن – “ওহে কিশোর! আমি কি তোমাকে কিছু কথা শিক্ষা দেবো না, যা দ্বারা আল্লাহ তোমার উপকার সাধন করবেন?” প্রশ্ন করার জন্য এর চেয়ে ভালো উৎসাহ প্রদান আর কী হতে পারে? হযরত ইবনে আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন – بلى – “জি, অবশ্যই।” অতঃপর প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপরিল্লিখিত বাক্যসম্বলিত হাদীসটি উত্তরে বলেন।

আমরা যদি (উক্ত বিভ্রান্ত লোকের) এই বিভ্রমের ওপর (উদাহরণস্বরূপ) জারি/বহাল থাকি, তাহলে কোনো অজ্ঞ ব্যক্তির পক্ষে কোনো আলেম তথা জ্ঞানী পণ্ডিতের কাছে জিজ্ঞেস করা সহি বা সঠিক হবে না; কোনো মারাত্মক বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির পক্ষে তাঁর বিপদমুক্তি ও মরণের মধ্যে পার্থক্যকারী কারো কাছে সাহায্য/সহায়তা চাওয়াও সঠিক হবে না; যেমনটি সঠিক হবে না কোনো ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির পক্ষে তাঁর ধারকর্জ-দাতার কাছে দেনা মওকুফ করার জন্য আবেদন জানানো, অথবা ধারকর্জ দানে সক্ষম কারো কাছে উধার চাওয়াও; আর শেষ বিচার দিবসে মানুষের পক্ষে আম্বিয়া (আলাইহিমুস্ সালাম)-মণ্ডলীর কাছে শাফা’য়াত/সুপারিশ প্রার্থনাও সহি হবে না, যেমনটি সহি হবে না ঈসা নবী (আলাইহিস্ সালাম)-এর পক্ষে মানুষদেরকে সাইয়্যেদুল মুরসালীন তথা নবীকুল শিরোমণি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে শাফা’আত চাইতে নির্দেশ দেওয়াও। বিভ্রান্তদের কাছে এই বিভ্রমের যে দলিলাদি আছে তা আ’ম তথা সার্বিক; আর তা চাওয়ার যাবতীয় বিষয়/বস্তু সম্পর্কে আমরা যা (ওপরে) উল্লেখ করেছি এবং যা উল্লেখ করিনি, তার সবগুলোর ক্ষেত্রেই নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়। 

অতঃপর যদি তারা (বিভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গ) বলে – إن الممنوع إنما هو سؤال الأنبياء والصالحين من أهل القبور في برازخهم لأنهم غير قادرين – “যা (স্রেফ) নিষিদ্ধ তা হলো আম্বিয়া (আলাইহিমু্স্ সালাম) ও সালেহীন/আউলিয়া (রহমতুল্লাহি আলাইহিম)-মণ্ডলীর কাছে তাঁদের মাযার-রওযাসমূহে তাঁদেরই বরযখ-জীবনে কোনো কিছু চাওয়া, কেননা তাঁরা নিশ্চয় এর (জওয়াব দেবার) ক্ষমতা রাখেন না,” তাহলে এই বিভ্রমের জবাব কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে (ইতিপূর্বে)। আর সার্বিকভাবে এর জবাব হলো – 

إنهم أحياء قادرون على الشفاعة والدعاء، وحياتهم حياة برزخية لائقة بمقامهم يصح بها نفعهم بالدعاء والاستغفار، والمنكر لذلك أخف أحواله أنه جاهل بما كاد يلحق بالتواتر من سنته عليه الصلاة والسلام، الدال على أن موتى المؤمنين لهم في حياتهم البرزخية العلم والسماع والقدرة على الدعاء وما شاء الله من التصرفات فما الظن بأكابر أهل البرزخ من النبيين وسائر الصالحين. 

অর্থ: তাঁরা জীবিত এবং শাফা’আত ও দুআ’ করতে সক্ষম। তাঁদের জীবন বরযখী/পরকালীন, যা তাঁদের মক্বাম/উচ্চমর্যাদার ক্ষেত্রে যথাযোগ্য। এ দ্বারা এটা (বলা) সঠিক যে, তাঁরা তাঁদের দুআ’ ও এস্তেগফার/সুপারিশের মাধ্যমে উপকার সাধন করতে পারেন। যে ব্যক্তি এর মুনকের তথা নিষেধ/অস্বীকারকারী তার সম্পর্কে স্রেফ এতোটুকু বলা যায়, সে এমন বিষয় সম্পর্কে গণ্ডমূর্খ যা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাহ হতে তাওয়াতুর তথা ব্যাপক বর্ণনার স্তরে পৌঁছে গিয়েছে, যে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন (এ বিষয়টি যে) বরযখ-জীবনে ঈমানদার মুসলমানবৃন্দ জানেন, শোনেন এবং দুআ’ করার সামর্থ্য রাখেন। এমতাবস্থায় আল্লাহর ক্ষমতাক্রমে বরযখ-জীবনের সেরা পুণ্যাত্মা আম্বিয়া (আলাইহিমুস্ সালাম) ও অন্যান্য সালেহীন/আউলিয়া (রহমতুল্লাহি আলাইহিম)-মণ্ডলী সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করেন আপনি?

মে’রাজ রজনী-সংক্রান্ত হাদীস যা সহীহ, বরঞ্চ মশহূর/বিখ্যাত, তাতে বর্ণিত হয়েছে আম্বিয়া (আলাইহিমুস্ সালাম)-মণ্ডলী তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি কী ধরনের আচরণ করেছিলেন; যেমন – তাঁর ইমামতিতে নামায আদায়, তাঁর সাথে আলাপ-আলোচনা, তাঁর জন্যে আসমানে দুআ’। এই উম্মত নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বহুবার করা সুপারিশ সত্ত্বেও নিজেদের প্রতি প্রাত্যহিক ৫০ ওয়াক্ত নামাযের বোঝা ৫ ওয়াক্তে লাঘব করতে পারেননি, যতোক্ষণ না পয়গাম্বর ইমরান (আলাইহিস্ সালাম)-এর পুত্র ও আল্লাহর সাথে কালাম/কথপোকথনকারী পয়গাম্বর মূসা (আলাইহিস্ সালাম) তা ইশারায় বলে দেন।

এরই ভিত্তিতে হাদীসটির উদ্দেশ্য স্পষ্ট। এটা (বিরোধী পক্ষ) যা ভেবে নিয়েছে তা নয়, কেননা তাদের ওই ভাবনা ওপরের আলোচনা থেকে জাজ্বল্যমান মিথ্যে প্রতীয়মান হয়েছে। (হাদীসটির) উদ্দেশ্য আর কিছু নয় স্রেফ মানুষের কাছে তাদের ধনদৌলতের প্রতি লোভী হয়ে অপ্রয়োজনে তা চাওয়া থেকে সতর্কীকরণ; আর আল্লাহ যা ব্যবস্থা করেছেন তাতে তুষ্ট/তৃপ্ত থাকার প্রতি উৎসাহ প্রদান, যদিও তা হয় স্বল্প; (উপরন্তু এ হাদীস উৎসাহস্বরূপও) মানুষের হাতে যা আছে সেটার আকাঙ্ক্ষা পরিহারের মিতাচারের প্রতি এবং আল্লাহর কাছে তাঁর অনুগ্রহ চাওয়ার মাধ্যমে পর্যাপ্ততা লাভের প্রতি। নিশ্চয় তিনি ভালোবাসেন তাঁদের, যাঁরা নিজেদের (নামায-) দুআ’য় অটল-অবিচল, অথচ মানুষ এরই বিপরীত (অবস্থানে রয়েছে)।

কবি বলেন – 

الله يغضب إن تركت سؤاله :: وبني آدم حين يسأل يغضب

আল্লাহ হন রাগান্বিত তুমি তাঁর কাছে চাওয়ার রীতি দিলে বাদ,

অথচ আদম-সন্তানদের কাছে তুমি চাইলে তাদের পেয়ে বসে ক্রোধ। (ভাবানুবাদ)

فالمعنى ــ إنك إذا رأيت في يد أحد من المال ما أعجبك وطمحت إليه نفسك فلا تسأله ما في يده واستعن بسؤال الله من فضله ـ عن سؤال عبده فالحديث إرشاد إلى القناعة، والتتره عن الطمح، وأين هذا من سؤال الله بأنبيائه وأوليائه أو سؤال أنبيائه الشفاعة للسائلين فيما جعل الله شفاعتهم فيه الذي هو من أقوى الأسباب في النجاح، ولكن الإنسان إذا ركب الهوى شط به في مجال الأوهام، وخرج به عن جادة الأفهام. 

এই হাদীসটির মানে হলো, যদি আপনি কারো হাতে ধনসম্পদ দেখতে পান এবং এতে আপনার চমক লেগে যায়, আর আপনার নফস/কুপ্রবৃত্তি এটার প্রতি লালায়িত বোধ করে, তাহলে তা পাওয়ার জন্যে ওই ব্যক্তির কাছে চাইবেন না, বরং আল্লাহর বান্দার বিপরীতে আল্লাহরই কাছে তাঁর অনুগ্রহ চাওয়ার মাধ্যমে সহায়তা অন্বেষণ করুন। এই হাদীসটি মানুষকে তুষ্টি/তৃপ্তির দিকে (সঠিক) পথপ্রদর্শন করে এবং (বস্তুটির প্রতি) লোভ-লালসা অপসারণের উদ্দেশ্য করে। এই ব্যাপারটি আল্লাহর কাছে তাঁরই আম্বিয়া (আলাইহিমুস্ সালাম) ও আউলিয়া (রহমতুল্লাহি আলাইহিম)-মণ্ডলীর মধ্যস্থতায় চাওয়ার সাথে তুলনীয় হতে পারে কীভাবে? অথবা, (তাঁরই কাছে) যাঁরা চান তাঁদের জন্যে তাঁর পয়গাম্বর (আলাইহিমুস্ সালাম)-বৃন্দের প্রতি সুপারিশ প্রার্থনার সাথে তুলনীয় হতে পারে কীভাবে? এটা কি এমন বিষয় নয়, যা’তে আল্লাহ তাঁদের শাফা’আত স্থাপন তথা আরোপ করেছেন এবং যা নাজাত/পরিত্রাণ লাভের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যমগুলো হতে (আগত)? পক্ষান্তরে, যদি কেউ নিজ কামনা-বাসনার জাহাজে ওঠে, তাহলে তার জাহাজ প্রবাদসূচক ‘আন্দাজের দ্বীপে’ (গিয়ে) ভরাডুবি হবে এবং গভীর উপলব্ধি হারাবে।

إنه لا يستغاث بي

‘আমার কাছ থেকে সাহায্য চাওয়া যাবে না’

جاء في الحديث إنه كان في زمن النبي صلى الله عليه وسلم منافق يؤذي المؤمنين، فقال أبو بكر الصديق: قوموا بنا لنستغيث برسول الله صلى الله عليه وسلم من هذا المنافق، فقال النبي صلى الله عليه وسلم: (( إنه لا يستغاث بي وإنما يستغاث بالله )).. رواه الطبراني في معجمه الكبير. 

একটি হাদীসে এসেছে যে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগে জনৈক মোনাফেক্ব ব্যক্তি ঈমানদার মুসলমানবৃন্দের ক্ষতি করতো; অতঃপর হযরত আবূ বকর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন: ‘চলো, আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দরবারে যেয়ে এই মোনাফেক্বের বিরুদ্ধে সহায়তা চাই।’ নবী করীম (উক্ত আরজির উত্তরে) বলেন: “সহায়তা আমার কাছে চাওয়া যাবে না, বরং আল্লাহর কাছেই চাইতে হবে।” [তবরানী কৃত ‘আল-মু’জামুল কবীর]

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে সামগ্রিকভাবে সাহায্য ও সহায়তা চাওয়া নিষিদ্ধ বলে ধারণা পোষণকারী লোকেরা হয়তো এই হাদীসটি হতে (তাদের মতের অনুকূলে) কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তবে তাদের এই সিদ্ধান্তটি মূলতঃ ভ্রান্ত। কেননা, এই হাদীসটি এর বাহ্যিক/আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করলে বোঝাবে যে তাঁর (দ.) কাছ থেকে সাহায্য/সহায়তা চাওয়া সামগ্রিকভাবে (مطلقاً) নিষিদ্ধ, যেমনটি (হাদীসের) শব্দচয়নে ব্যক্ত হয় (كما هو ظاهر اللفظ)। এই (ভ্রান্ত সিদ্ধান্তটি) সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) কর্তৃক তাঁর (দ.) প্রতি আচরিত কর্মগুলো দ্বারা নাকচ হয়ে যায়; কেননা তাঁরা তাঁর (দ.) কাছে সাহায্য/সহায়তা চাইতেন, তাঁর (দ.) মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা করতেন, তাঁদের জন্য দুআ’ করতে তাঁর (দ.) প্রতি আবেদন জানাতেন, আর তিনিও এসবে সাড়া দিতেন খুশি মনে/উৎফুল্লচিত্তে। অতএব, এরই পরিপ্রেক্ষিতে এটাকে (মানে এ হাদীসকে) এমনভাবে তা’বীল তথা বিশদ ব্যাখ্যা করতে হবে, যাতে তা সার্বিক হাদীসসমূহের প্রামাণিক লিপিগুলোর সাথে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সমন্বয় সাধন করা যায়। এই ভাবনা নিয়েই আমরা (শায়খ আলূভী) বলি: 

إن المراد بقوله ذلك هو إثبات حقيقة التوحيد في أصل الاعتقاد وهو أن المغيث حقيقة هو الله تعالى والعبد ما هو إلا واسطة في ذلك أو أنه أراد أن يعلمهم أنه لا يطلب من العبد ما لا يقدر عليه كالفوز بالجنة والنجاة من النار والهداية التي هي العصمة من الغواية وضمان الختم على السعادة.

অর্থ: প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক এ কথা বলার পেছনে উদ্দেশ্য ছিলো মৌলিক আকীদা-বিশ্বাসে তওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদের বাস্তবতা প্রতিষ্ঠা করা; অর্থাৎ প্রকৃত সাহায্য-সহায়তাকারী হলেন আল্লাহ তায়ালা, আর বান্দা হলেন তাতে স্রেফ একজন ওয়াসিতাহ বা মাধ্যম/বাহন। অথবা (এর অর্থ) এও যে, তিনি চেয়েছিলেন (এই হাদীস দ্বারা) তাঁদেরকে এমর্মে শিক্ষা দিতে যে বান্দার কাছে এমন কিছু চাওয়া যাবে না যা তিনি (হাকীকী তথা স্বকীয় ক্ষমতায়) দিতে অক্ষম, যেমন – বেহেশতে সাফল্য, জাহান্নামের আগুন থেকে পরিত্রাণ, দোযখ হতে রক্ষাকারী হেদায়াত বা পথপ্রদর্শন এবং জীবনের আশীর্বাদময় পরিসমাপ্তি।

والحديث لا يدل على تخصيص الاستعانة والإغاثة بالحي دون الميت ولا يمت بصلة إلى هذا التفريق بل إن ظاهره يمنع الاستغاثة أبدًا بما سوى الله دون تفريق بين حي وميت وهذا غير مقصود لما قدمناه.

অর্থ: এই হাদীস এটা প্রমাণ করে না যে কেবল জীবিতদের কাছেই সাহায্য ও সহায়তা চাওয়ার ব্যাপারটি সীমাবদ্ধ এবং বেসালপ্রাপ্তদের কাছে (চাওয়া জায়েয) নেই; অধিকন্তু, এটা কোনোক্রমেই এই দু’য়ের মাঝে সেই পার্থক্য বিরাজমান বলে সাব্যস্ত করে না। বরঞ্চ এর আক্ষরিক অর্থ ব্যক্ত করে যে আল্লাহ ছাড়া (হাকীকী অর্থে স্বকীয়ভাবে) কারো কাছে সহায়তা চাওয়া মানা; আর এতে জীবিত ও বেসালপ্রাপ্তদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হয়নি – বস্তুতঃ (হাদীসটি) এই অর্থ ব্যক্ত করেনি।

ইবনে তাইমিয়া নিজ ফতাওয়া গ্রন্থে এই অর্থের অনুরূপ কিছু ইঙ্গিত করেছিলেন, যখনই তিনি বলেছিলেন: 

ﻗﺪ ﻳﻜﻮﻥ  في ﻛﻼﻡ  ﷲ ﻭﺭﺳﻮﻟﻪ ﻋﺒﺎﺭﺓ لها ﻣﻌنى ﺻﺤﻴﺢ ﻟﻜﻦ ﺑﻌﺾ ﺍﻟﻨﺎﺱ ﻳﻔﻬﻢ من ﺗﻠﻚ ﻏير ﻣﺮﺍﺩ ﷲ ﻭﺭﺳﻮﻟﻪ ﻓﻬﺬﺍ ﻳﺮﺩ ﻋﻠﻴﻪ ﻓﻬﻤﻪ، ﻛﻤﺎ ﺭﻭﻯ ﺍﻟﻄبرﺍني في ﻣﻌﺠﻤﻪ ﺍﻟﻜﺒير ﺃﻧﻪ ﻛﺎﻥ في ﺯﻣﻦ ﺍﻟﻨبي صلى الله عليه وسلم ﻣﻨﺎﻓﻖ ﻳﺆﺫﻱ ﺍلمؤﻣنين،  ﻓﻘﺎﻝ ﺃﺑﻮ ﺑﻜﺮ ﺍﻟﺼﺪﻳﻖ: ﻗﻮﻣﻮﺍ ﺑﻨﺎ ﻟﻨﺴﺘﻐﻴﺚ ﺑﺮﺳﻮﻝ ﷲ صلى الله عليه وسلم من هذا المنافق،  ﻓﻘﺎﻝ ﺍﻟﻨبي صلى الله عليه وسلم: ((إنه لا يستغاث بي وإنما يستغاث بالله))..         

অর্থ: আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কথার প্রকাশভঙ্গিতে সহীহ/সঠিক অর্থ বিদ্যমান রয়েছে, কিন্তু কিছু লোক আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উদ্দেশ্য হতে তা ভিন্নভাবে বুঝে থাকে। অতএব, এটা (নির্দিষ্ট ওই) ব্যক্তির উপলব্ধির ওপর নির্ভরশীল, যেমনটি বর্ণনা করেছেন ইমাম তবারানী (রহ.) নিজ ‘মু’জামুল কবীর’ পুস্তকে এ মর্মে যে, প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগে জনৈক মোনাফেক্ব ব্যক্তি ঈমানদার মুসলমানবৃন্দকে নিপীড়ন করছিলো। অতঃপর হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, “চলো যাই আমরা এই মোনাফেক্বের বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহায্য চাই।” এতে নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “সাহায্য আমার কাছে চাওয়া যাবে না; নিশ্চয় সাহায্য আল্লাহর কাছেই চাইতে হবে।”

ﻓﻬﺬﺍ ﺇنما ﺃﺭﺍﺩ ﺑﻪ ﺍﻟﻨبي صلى الله عليه وسلم ﺍلمعنى ﺍﻟﺜﺎني ﻭهو ﺃﻥ ﻳﻄﻠﺐ ﻣﻨﻪ ﻣﺎ ﻻ ﻳﻘﺪﺭ ﻋﻠﻴﻪ ﺇﻻ الله،  ﻭﺇﻻ ﻓﺎﻟﺼﺤﺎﺑﺔ ﻛﺎﻧﻮﺍ ﻳﻄﻠﺒﻮﻥ ﻣﻨﻪ ﺍﻟﺪﻋﺎﺀ ﻭﻳﺴﺘﺴﻘﻮﻥ ﺑﻪ ﻛﻤﺎ في ﺻﺤﻴﺢ ﺍﻟﺒﺨﺎﺭﻱ ﻋﻦ ﺍﺑﻦ ﻋﻤﺮ ﻗﺎﻝ: ﺭبما ﺗﺬﻛﺮﺕ ﺍﻟﺸﺎﻋﺮ وأنا أنظر إلى وجه النبي صلى الله عليه وسلم ﻳﺴﺘﺴﻘﻰ ﻓﻤﺎ ﻳترﻝ ﺣتى يجيش ﻟﻪ ﻣﻴﺰﺍﺏ:           

ﻭﺃﺑﻴﺾ ﻳﺴﺘﺴﻘﻰ ﺍﻟﻐﻤﺎﻡ ﺑﻮﺟﻬﻪ :: ثماﻝ ﺍﻟﻴﺘﺎﻣﻰ ﻋﺼﻤﺔ ﻟﻸﺭﺍﻣل 

অর্থ: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই কথা দ্বারা (কেবল) দ্বিতীয় মানেটুকু বুঝিয়েছেন আর তা হলো, তাঁর কাছে তা-ই অন্বেষণ করা যাবে যে সবের ওপর স্রেফ আল্লাহ তাঁকে ক্ষমতাবান করেছেন। নতুবা সাহাবায়ে কেরাম (রা.) তাঁর কাছে দুআ’ চাইতেন এবং তাঁরই মধ্যস্থতায় বৃষ্টি প্রার্থনা করতেন, যেমনটি লিপিবদ্ধ হয়েছে সহীহ বুখারী শরীফ গ্রন্থে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে এ মর্মে যে তিনি বলেন, “হয়তো আমি তখন স্মরণ করতে পেরেছিলাম (ওই) কবিকে যখন প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পবিত্র চেহারা মোবারকের দিকে তাকিয়েছিলাম আর তিনি বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করছিলেন এবং অনতিবিলম্বে বৃষ্টিপাত আরম্ভ হয়েছিলো:

শুভ্র সেই সত্তা যাঁর চেহারা মোবারক দ্বারা কামনা করা হয় মেঘমালা,

যিনি এতিম-অনাথদের লালনপালনকারী ও বিধবাদের রক্ষাকর্তা।” (কবির কাব্যের ভাবানুবাদ)

[ইবনে তাইমিয়া কৃত ‘ফাতাওয়া’ গ্রন্থ] 

ব্যবহৃত অভিব্যক্তিসমূহ

প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রশংসায় এমন কিছু নির্দিষ্ট অভিব্যক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, যার দরুন এমন কারো কারো জন্যে তা বিভ্রান্তির কারণ হয়েছে, যারা এরই ফলশ্রুতিতে সেসবের ব্যবহারকারীদের প্রতি কুফর তথা অবিশ্বাসের হুকুম জারি করেছে।  যেমনটি (ওই) ব্যবহারকারীদের কথা:

ليس لنا ملاذ سوى النبي صلى الله عليه وسلم.

অর্থ: আমরা কারো আশ্রয় চাই না নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছাড়া।

ولا جاء إلا هو..

অর্থ: আর কাউকেই প্রত্যাশা করা যায় না তিনি (দ.) ব্যতিরেকে।

وأنا مستجير به ..

অর্থ: আমি তাঁরই (দ.) মধ্যস্থতায় সুরক্ষা অন্বেষণ করি।

وإليه يفزع في المصائب ـ وإن توقفت فمن أسأل

অর্থ: তাঁর (দ.) কাছে (মানুষ) মসীবতের সময় ছুটে যায়, আর আমি দ্বিধান্বিত হলে কার কাছে চাইবো?

ومقصودهم ليس لنا ملاذ أي من الخلق، ولا رجاء أي من البشر، وإليه يفزع في المصائب أي من سائر الخلق لكرامته عند مولاه وليقوم هو بالتوجه إلى الله والطلب منه وإن توقفت فمن أسال أي من عباد الله.

এসব কথার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হলো, কারো আশ্রয় চাই না – মানে সৃষ্টিকুল হতে; কাউকেই প্রত্যাশা করি না – মানে মনুষ্যকুল হতে; তাঁর (দ.) কাছে মানুষ মসীবতের সময় ছুটে যায় – মানে বাকি সৃষ্টিকুলের বিপরীতে তাঁর (দ.) প্রভুর দরবারে তাঁরই উচ্চমর্যাদাহেতু তিনি আল্লাহর দিকে ফিরে তাঁর দরবারে চাইতে পারবেন; আর যদি আমি ইতস্ততঃ করি, কার কাছে চাইবো – মানে আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে কার কাছে চাইবো?

আমরা নিজেদের দোয়া বা তাওয়াসসুলে এসবের অনুরূপ অভিব্যক্তি ব্যবহার করি না; এগুলোর প্রতি আহ্ববানও জানাই না; কিংবা এগুলো ব্যবহারে উৎসাহ প্রদানও করি না, যাতে সন্দেহ দূরীকরণে মতপার্থক্যের অভিব্যক্তিগুলো হতে বহু দূরে অবস্থান করা যায় এবং যা প্রকাশ্য ও যার মধ্যে কোনো মতপার্থক্য নেই তাকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরা যায়। এতদসত্ত্বেও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, যারা এসব অভিব্যক্তি প্রয়োগ করেন, তাদের প্রতি কুফর তথা অবিশ্বাসের হুকুম দেওয়া (একদম) তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত যা (কোনোক্রমেই) প্রশংসনীয় নয়, আর এতে কোনো হেকমত বা প্রজ্ঞা নেই। আমাদের অবশ্যই এটা বিবেচনা করতে হবে যে এসব অভিব্যক্তি যাঁরা ব্যবহার করেন, তাঁরা মু’ওয়াহহেদীন তথা আল্লাহর একত্ববাদী; তাঁরা সাক্ষ্য দেন যে আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য প্রভু নেই এবং প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁরই প্রেরিত পয়গাম্বর; আর তাঁরা নামায কায়েম করেন এবং দ্বীন-ইসলামের সকল আরকান বা ভিত্তিস্তম্ভে বিশ্বাস স্থাপন করেন; আর আল্লাহকে তাঁদের রব বা প্রভু হিসেবে এবং নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে তাঁদের পয়গাম্বর বলে বিশ্বাস করেন, আর ইসলামকেও তাঁদের দ্বীন হিসেবে বিশ্বাস করেন। এর দ্বারা দ্বীনের মানুষদের জিম্মা/সুরক্ষা ও দ্বীনের পবিত্রতা তাঁরা পেয়ে থাকেন। হযরত আনাস বিন মালিক (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:

فعن أنس رضي الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: ((من صلى صلاتنا وأسلم واستقبل قبلتنا وأكل ذبيحتنا فذلك المسلم الذي له ذمة الله ورسوله فلا تخفروا الله في ذمته)).. رواه البخاري.

অর্থ: যে ব্যক্তি আমাদের সালাত আদায় করে, ইসলাম ধর্মে সমর্পিত হয়, আমাদের কেবলামুখো হয়, এবং আমাদের জবাইকৃত পশুর (হালাল) মাংস খায়, সে আল্লাহতায়ালা ও তাঁরই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জিম্মাপ্রাপ্ত মুসলমান; অতএব, আল্লাহর জিম্মাদারিকে তোমরা খেয়ানত/লংঘন কোরো না। [সহীহ বুখারী, আন্তর্জাতিক নম্বর: ৩৯১] 

ومن هنا فإن الواجب علينا أننا إذا وجدنا في كلام المؤمنين إسناد شيء لغير الله سبحانه وتعالى فإنه يجب حمله على المجاز العقلي ولا سبيل إلى تكفيرهم إذ المجاز العقلي مستعمل في الكتاب والسنة فصدور ذلك الإسناد من موحد كاف في جعله إسنادًا مجازياً لأن الاعتقاد الصحيح هو اعتقاد أن الله هو الخالق للعباد وأفعالهم لا تأثير لأحد سواه لا لحي ولا لميت فهذا الاعتقاد هو التوحيد بخلاف من اعتقد غير هذا فإنه يقع في الإشراك وليس في المسلمين إطلاقاً من يعتقد لأحد مع الله فعل أو ترك أو رزق أو إحياء أو إماتة وما جاء من الألفاظ الموهمة فإن مقصود أصحابها هو الاستشفاع إلى الله بتلك الوسيلة فالمقصود هو الله سبحانه وتعالى وليس من المسلمين رجل واحد يعتقد فيمن يطلبه أو يسأله أنه قادر على الفعل والترك دون التفات إلى الله تعالى من قريب أو بعيد أو مع التفات هو أدنى إلى الشرك بالله ونعوذ بالله أن نرمي مسلماً بشرك أو كفر من أجل خطأ أو جهل أو نسيان أو اجتهاد.

যদি আমরা ঈমানদার মুসলমানদের কথার মধ্যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ছাড়া অন্য কারোর সাথে ইসনাদ তথা যোগসূত্র খুঁজে পাই, তাহলে আমাদের প্রতি ওয়াজিব/আবশ্যক হবে এটাকে যৌক্তিক রূপক (المجاز العقلي) হিসেবে বিবেচনা করা। তাঁদের প্রতি তাকফীর বা কুফরের ফতোয়া আরোপ করার কোনো পথ নেই, কেননা যৌক্তিক রূপক কুর’আন ও সুন্নাহতে ব্যবহৃত হয়েছে। এই ইসনাদ/যোগসূত্র একজন মুওয়াহহেদ তথা আল্লাহর একত্ববাদী মুসলমানের কাছ থেকে আসাটাই এটার (যৌক্তিক) রূপকের যোগসূত্র (إسنادًا مجازياً) হবার জন্যে যথেষ্ট। কেননা সঠিক আকীদা-বিশ্বাস হলো, আল্লাহ পাক তাঁর বান্দাবৃন্দ এবং তাঁদের ক্রিয়াসমূহ উভয়েরই স্রষ্টা, আর তাঁকে ছাড়া (স্বতন্ত্র/স্বকীয়ভাবে) কেউই তা’সীর তথা প্রভাব বিস্তার করতে পারেন না, হোক তা জীবিতদের জন্যে/ক্ষেত্রে, অথবা ইন্তিকালপ্রাপ্তদের জন্যে। এই আকীদা-বিশ্বাসটি তওহীদ (মানে খোদাতায়ালার একত্ব), যার বিপরীত হচ্ছে ওই ব্যক্তি, যে এ বিশ্বাস ভিন্ন অন্য কিছু লালন করে এবং যার ফলশ্রুতিতে সে শির্ক বা অংশীবাদী হয়ে যায়। মুসলমান সমাজে এমন কেউই নেই, যিনি এ ধারণা পোষণ করেন যে আল্লাহর পাশাপাশি (স্বতন্ত্রভাবে) কেউ কর্ম সংঘটন, অথবা তা তরক মানে পরিহার/ছেড়ে যাওয়া, কিংবা রিযিক/রুজির ব্যবস্থা, বা জীবনদান, অথবা প্রাণ হরণ করতে পারেন। এসব অস্পষ্ট অভিব্যক্তির বেলায় যাঁরা এগুলো উচ্চারণ করে থাকেন, তাঁরা তা করেন আল্লাহর কাছে ওই অসীলার মাধ্যমে সুপারিশ লাভের খাতিরেই। অতএব, মকসূদ তথা উদ্দেশ্য হলেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা। দূরে হোন বা কাছে, মুসলমান সমাজে এমন কেউই নেই, যিনি বিশ্বাস করেন যে যাঁর কাছে তিনি অন্বেষণ করছেন বা চাচ্ছেন তিনি একমাত্র মহান আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতিরেকে স্বতন্ত্রভাবে কোনো ক্রিয়া সংঘটনে বা তা পরিহারে ক্ষমতাবান; অথবা তিনি আল্লাহর শরীক। আমরা আল্লাহর দরবারে কোনো ভুল, বা অজ্ঞতা, কিংবা বিস্মৃতি, অথবা (মনগড়া) নিজস্ব প্রয়াসের বশবর্তী হয়ে কোনো মুসলমানের প্রতি শির্ক বা কুফরের দোষারোপ করা থেকে পরিত্রাণ কামনা করি (আমীন)। [নোট: আমাদের এই বইটিতে এ বাস্তবতার প্রতি বারংবার উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা এ বিষয়টি সম্পর্কে একটি বিশেষ গবেষণামূলক ‘মুবাহাসা’-তে আলোকপাত করেছি, যার শিরোনাম: “যৌক্তিক রূপক।” তাতে অনেক বিভ্রান্তি ও ভুল বোঝাবুঝি স্পষ্ট ব্যাখ্যা দ্বারা নিরসন করা হয়েছে – লেখক শাইখ মুহাম্মদ আলূভী মালিকী আল-হাসানী (রহ.)]

আমরা (শাইখ মুহাম্মদ আলূভী) বলি: যদি মানুষের মধ্যে অনেকে তাঁদের নিজেদের মাগফিরাত/ক্ষমা, বেহেশত, আরোগ্য, পারলৌকিক মুক্তি/পরিত্রাণ ইত্যাদি চাওয়ার অভিব্যক্তির ক্ষেত্রে ভুল করেন, আর প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দরবারে সরাসরি (এ ব্যাপারে) আরজ করেন, তবে তাঁদের ভুলটি তওহীদের বেলায় নয়। কেননা তাঁদের উদ্দেশ্য হচ্ছে এ অসীলার মাধ্যমে আল্লাহর দরবারে শাফা’আত বা সুপারিশ লাভ, ঠিক যেমনটি কেউ বলেন:

يا رسول الله ! اسأل الله أن يغفر لي وأن يرحمني، وأنا أتوسل بك إليه في قضاء حاجتي وتفريج كربتي وتحقيق رغبتي.

অর্থ: “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর দরবারে আমার জন্যে তাঁর ক্ষমা ও অনুগ্রহ কামনা করুন। নিশ্চয় আমি আপনার মধ্যস্থতায় তাঁর দরবারে শরণাপন্ন হচ্ছি, যাতে আমার প্রয়োজন পূরণ হয়, আমার যন্ত্রণা দূর হয় এবং আমার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়।”

وقد كان الصحابة رضي الله عنهم يستعينون به صلى الله عليه وسلم ويستغيثون ويطلبون منه الشفاعة ويشكون حالهم إليه من الفقر والمرض والبلاء والدين والعجز، كما ذكرناه. 

অর্থ: সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দরবারে (সরাসরি) সাহায্য চাইতেন, তাঁর সহায়তা কামনা করতেন, তাঁর শাফা’আত অন্বেষণ করতেন, আর নিজেদের অবস্থা, যেমন – অসুস্থতা, অভাব-অনটন, বালা-মসীবত, কর্জ, অক্ষমতা ইত্যাদি থেকে মুক্তি পেতে তাঁর দরবারে আরজ করতেন, যেমনটি আমরা (ইতিপূর্বে) উল্লেখ করেছি।

ومعلوم أنه صلى الله عليه وسلم لا يفعل ذلك بنفسه استقلاًلاً بذاته أو بقوته، وإنما هو بإذن الله وأمره وقدرته وهو عبد مأمور له مقامه وجاهه عند ربه، وله كرامته التي يدخل بها على الله عامة البشر ممن يؤمنون به ويصدقون برسالته ويعتقدون فضله وكرامته.

অর্থ: এ বিষয়টি সর্বজনজ্ঞাত যে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এটা নিজ স্বতন্ত্র ক্ষমতাবলে করেন না; বরঞ্চ আল্লাহরই অনুমতি ও আদেশক্রমে এবং (তাঁরই প্রদত্ত) ক্ষমতাবলে করে থাকেন। তিনিই হলেন আল্লাহর (প্রিয়তম) বান্দা যাঁকে আল্লাহ আদেশ করেন, আর তিনি তাঁর প্রভুর দরবারে (উচ্চতম) মকাম/মর্যাদা ও স্তরের অধিকারী বটেন। তিনি নিজে এমনই মাহাত্ম্য ধারণ করেন যা দ্বারা সাধারণ মানুষ, যাঁরা তাঁকে বিশ্বাস করেন, তাঁর রিসালাতে ঈমান রাখেন এবং তাঁর ফযীলত ও মাহাত্ম্যে বিশ্বাস করেন, তাঁরা আল্লাহর দরবারে প্রবেশাধিকার পান। 

ونحن نعتقد أن من اعتقد خلاف هذا فقد أشرك بلا خلاف.

আর আমরা এ আকীদা-বিশ্বাস (দৃঢ়ভাবে) পোষণ করি, যে ব্যক্তি এর (মানে ওপরের আকীদার) খেলাফ তথা পরিপন্থী বিশ্বাস লালন করে, সে শির্ক তথা অংশীবাদে পতিত হয়েছে, যে ব্যাপারটিতে (কারো) কোনো দ্বিমত নেই।

এই কারণে আপনি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে দেখতে পান (আল্লাহর হাকীকী/প্রকৃত ক্ষমতার) এ বাস্তবতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে, যখনই তাঁর সামনে ওহী অথবা হাল-অবস্থার মাধ্যমে প্রকাশ করে দেওয়া হয়েছে যে তাঁর কাছে কোনো কিছুর প্রার্থী কিংবা তাঁর কথার শ্রোতা আকীদা-বিশ্বাসে ঘাটতিসম্পন্ন। একটি দৃষ্টান্তে (আমরা দেখি) তিনি (আমাদের) জানাচ্ছেন যে তিনিই হলেন বনী আদম তথা আদম-সন্তানদের সাইয়্যেদ/প্রধান; আবার আরেকটি দৃষ্টান্তে আমরা দেখি তিনি তাঁদেরকে জানাচ্ছেন যে (প্রকৃত) সাইয়্যেদ হলেন আল্লাহতায়ালা। একদিকে আমরা দেখতে পাই তাঁরা (মানে সাহাবাবৃন্দ) তাঁর দরবারে সাহায্য অন্বেষণ করেছেন এবং তিনি তাঁদেরকে তাঁরই মধ্যস্থতায় তাওয়াসসুল পালন করার উপায়/পন্থা শিক্ষা দিয়েছেন; আবার অন্যদিকে তিনিই তাঁদেরকে বলেছেন – إنما يستغاث بالله ولا يستغاث بي – মানে “সাহায্য কেবল আল্লাহর কাছেই চাইতে হবে, এবং আমার কাছে সাহায্য চাওয়া যাবে না।” একদিকে আমরা দেখতে পাই তাঁরা তাঁর কাছে সাহায্য চেয়েছেন, আর তাঁদের আহ্বানে সাড়া দেওয়ার জন্যে আবেদন-নিবেদন করেছেন – না, বরঞ্চ তিনি তাঁদের প্রতি দুটি উত্তম বিকল্প পন্থার মধ্যে যে কোনো একটি বেছে নেওয়ার সুযোগও দিয়েছেন, (যেমনটি এসেছে একটি হাদীস শরীফে) – الصبر على البلاء مع ضمانة الجنة أو كشف البلاء سريعاً كما خير الأعمى وخير المرأة التي تصرع، وخير قتادة الذي ذهبت عينه – অর্থ: অন্ধ সাহাবী ও খিঁচুনিসম্পন্ন জনৈকা নারীকে তিনি ধৈর্যধারণ ও বেহেশতের নিশ্চয়তা দানের পন্থাটি গ্রহণের পাশাপাশি বিকল্পস্বরূপ দ্রুত বালা-মসীবত দূর করার সুযোগও দান করেন। তিনি হযরত কাতাদা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-কেও (একই) সুযোগ দিয়েছিলেন যখন তাঁর চোখ বের হয়ে এসেছিলো। 

وفي موقف يقول: من فرج عن مؤمن كربة..وفي موقف يقول: لا يأتي بالخيرات إلا الله. 

অর্থ: একদিকে তিনি বলেছেন, “যে ব্যক্তি কোনো ঈমানদারের কষ্ট দূর করে..,” আবার অন্যদিকে বলেছেন, “আল্লাহ ছাড়া কেউই কল্যাণ/মঙ্গল সাধন করতে পারে না।”

অতএব, এতদ্বারা আপনার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেলো যে আমাদের আকীদা-বিশ্বাস, আল্ হামদু লিল্লাহ, পুতঃপবিত্র ও খাঁটি/নির্মল। বান্দা স্বতন্ত্র ক্ষমতাবলে কোনো কাজ করেন না, তাঁর মর্যাদার স্তর/রুতবাহ কিংবা পর্যায়/দরজাত যা-ই হোক না কেন। এমন কী তা সৃষ্টিকুল শিরোমণি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ক্ষেত্রেও (প্রযোজ্য) – إنما يعطي ويمنع ويضر وينفع ويجيب ويعين بالله سبحانه وتعالى – তিনি (দ.) শুধু আল্লাহ সোবহানাহু ওয়া তায়ালা (প্রদত্ত) ক্ষমতাবলে দান করেন ও (তা হতে) মানা করেন, কল্যাণ ও ক্ষতি সাধন করেন, আরজির জবাব দেন এবং সাহায্য করেন। তাঁর কাছ থেকে যখন সহায়তা বা সাহায্য চাওয়া হয়, অথবা কোনো কিছুর জন্যে আবেদন জানানো হয়, তখন তিনি মওলা জাল্লা শানুহু সোবহানাহু ওয়া তায়ালারই দিকে ফেরেন এবং তাঁর কাছে চান আর দুআ’ ও প্রার্থনা করেন, এবং শাফা’আত করেন; আর তাঁর শাফা’আত গৃহীত ও (সুপারিশের আবেদন) সাড়াপ্রাপ্ত হয়।

وما كان يقول لهم: لا تطلبوا مني شيئاً ولا تسألوني ولا تشكوا حالكم إليَّ بل توجهوا إلى الله واسألوه فبابه مفتوح وهو قريب مجيب لا يحتاج إلى أحد، وليس بينه وبين خلقه حجاب ولا بواب. 

অর্থ: প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কখনোই তাঁর সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীকে বলেন নি: “আমার কাছে কোনো কিছু অন্বেষণ করবে না, চাইবে না, অথবা তোমাদের হালত-অবস্থা সম্পর্কে অভিযোগও করবে না! বরঞ্চ তোমরা একমাত্র আল্লাহরই দিকে ফিরবে এবং তাঁর কাছেই চাইবে; কেননা তাঁর দরজা সবসময়ই খোলা রয়েছে, আর তিনিই সবচেয়ে কাছে রয়েছেন এবং প্রার্থনার জবাব দিচ্ছেন; (তিনিই ওই পবিত্র সত্তা) যাঁর কাউকেই প্রয়োজন নেই, আর যাঁর ও সৃষ্টিকুলের মাঝে কোনো পর্দা বা দ্বাররক্ষীও নেই!”

এসব অভিব্যক্তি যেটাকে তারা মূর্তিপূজা ও গোমরাহী বলে দাবি করে সে সম্পর্কে ইবনে আব্দিল ওয়াহহাব নজদীর দৃষ্টিভঙ্গি

[বঙ্গানুবাদকের নোট: শাইখ মুহাম্মদ আলূভী মালিকী আল-হাসানী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) সৌদি আরবের নাগরিক হওয়ায় তাঁকে সে দেশের রাষ্ট্রীয় নীতি ওহাবীবাদের প্রশংসা করতে হয়েছিলো। নিম্নে ইবনে আবদিল ওয়াহহাবের যে বক্তব্য লিপিবদ্ধ হয়েছে, তা তাঁর প্রণীত ‘কিতাবুত্ তওহীদ’ ও ‘কাশফুশ শুবহাত’ শিরোনামের দুটো পুস্তিকার সম্পূর্ণ খেলাফ (আমার কাছে দুটোই মওজূদ)। আল্লামা হুসাইন হিলমী তুর্কী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) প্রথমোক্ত পুস্তিকার রদ লেখেন, যা আমি অনুবাদ করেছি (লিঙ্ক: ওয়াহাবীদের প্রতি নসীহত.pdf)। আর দ্বিতীয় পুস্তিকাটির রদ লিখেছি আমি অধম (লিঙ্ক: ওহাবীদের সংশয় নিরসন.pdf)]। 

এ বিষয়ে মুহাম্মদ ইবনে আবদিল ওয়াহহাব নজদী এক শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করেন এবং জ্ঞানভিত্তিক মত ব্যক্ত করেন; বিশেষ করে এসব সুপরিচিত অভিব্যক্তি সম্পর্কে, যেগুলোকে তওহীদের (তথাকথিত) সুরক্ষাকারী ও অতি উৎসাহী নজরদারির দাবিদার ব্যক্তিবর্গ শির্ক বা মূর্তিপূজা বলে অভিযোগ করে। এখানে (কথিত) তওহীদ (?) ও মুওয়াহহিদীন (?)-দের নেতা নিজের (কথিত) সত্যভাষণ (?) এবং জ্ঞানের (?) কথা বলছেন, যা তাঁর দাওআ’কে (?) মানুষের মাঝে প্রচার-প্রসার (?) করেছিলো এবং সমাজের উচ্চ-নিম্ন (?) নির্বিশেষে সবার মাঝে জ্ঞাত হয়েছিলো। তাঁর কথা শ্রবণ করুন, যে বাণী আল-মজমা’আর মানুষদেরকে সৎ কাজে আদেশ দান ও অসৎ কাজে নিষেধকরণের দায়িত্বপ্রাপ্ত শাইখ আবদুল্লাহ সুহাইম (রহ.)-কে লেখা পত্রে পাওয়া যায়:

إذا تبين هذا فالمسائل التي شنع بها منها: ما هو من البهتان الظاهر، وهي قوله: إني مبطل كتب المذاهب، وقوله: إني أقول: إن الناس من ستمائة سنة ليسوا على شيء، وقوله: إني أدعي الاجتهاد، وقوله إني خارج عن التقليد، وقوله: إني أقول: إن اختلاف العلماء نقمة، وقوله: إني أكفر من توسل بالصالحين، وقوله: إني أكفر البوصيري لقوله: يا أكرم الخلق، وقوله: إني أكفر من توسل بالصالحين، وقوله: إني أقول: لو أقدر على هدم حجرة الرسول لهدمتها، ولو أقدر على الكعبة لأخذت ميزابها وجعلت لها ميزاباً من خشب، وقوله: إني أنكر زيارة قبر النبي صلى الله عليه وسلم، وقوله: إني أنكر زيارة قبر الوالدين وغيرهم، وإني أكفر من يحلف بغير الله، فهذه اثنتا عشرة مسألة، جوابي فيها أن أقول: (سُبْحَانَكَ هَـٰذَا بُهْتَانٌ عَظِيمٌ)، ولكن قبله من بهت النبي محمدًا صلى الله عليه وسلم أنه يسب عيسى ابن مريم، ويسب الصالحين، (لاَ يُؤْمِنُونَ بِآيَاتِ ٱللَّهِ وَأُوْلـٰئِكَ هُمُ ٱلْكَاذِبُونَ). 

অর্থ: যদি এটা স্পষ্ট করা হয়, তাহলে এগুলোই সেসব মাস’য়ালা যার জন্যে তিনি আমার সমালোচনা করেছেন: এগুলোর মধ্যে রয়েছে নেহাত কুৎসা, যেমনটি তাঁর অভিযোগ এ মর্মে যে আমি নাকি চার মাযহাবকে বাতীল করে দিয়েছি; আর আমি নাকি বলেছি যে বিগত ছয় শ বছর যাবৎ মানুষ গোমরাহীর মধ্যে ডুবেছিলো; আর আমি নাকি স্বয়ং ইজতিহাদ প্রয়োগের দাবি করেছি; আর আমি নাকি যোগ্য আলেম-উলামার অনুসরণ ত্যাগ করেছি; আর আমি নাকি বলেছি যে উলামাবৃন্দের মতপার্থক্য (খোদায়ী) শাস্তিস্বরূপ; আর আমি নাকি সোয়ালেহীন/পুণ্যবান বান্দামণ্ডলীর মাধ্যমে তাওয়াসসুলকারীদের প্রতি কুফর/অবিশ্বাসের দোষারোপ করেছি; আর আমি নাকি ইমাম বুসীরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর প্রতি কুফরের দোষারোপ করেছি তাঁরই এ কথার জন্যে: “হে সৃষ্টিকুলে মহত্তম (يا أكرم الخلق);” আর আমি নাকি বলেছি: আমার যদি ক্ষমতা থাকতো তাহলে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রওযা শরীফের ওপরে গুম্বজটি ধ্বংস করে দিতাম; আর আমার যদি ক্ষমতা থাকতো তাহলে কা’বা শরীফের (স্বর্ণনির্মিত) প্রণালী ছিনিয়ে তার স্থলে একটি কাষ্ঠনির্মিত প্রণালী স্থাপন করতাম; আর আমি নাকি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রওযা মোবারক যিয়ারত নিষেধ করেছি এবং আরো অস্বীকার করেছি (কারো) পিতা-মাতার ও অন্যান্যদের কবর যিয়ারত; আর আমি নাকি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে শপথকারীর প্রতি কুফরের দোষারোপ করেছি; আর আমি নাকি সর্ব-শাইখ ইবনুল ফরীদ ও ইবনুল আরবী (রহমতুল্লাহি আলাইহিমা)-এর প্রতিও কুফরের দোষারোপ করেছি; আর আমি নাকি ‘দালাইলুল খায়রাত’ ও ‘রাওদুর্ রায়্যা’হীন’ পুড়িয়েছে এবং এটাকে ‘রাওদুশ্ শায়্যাতীন’ আখ্যা দিয়েছি। এসব বিষয়ে আমার জবাব হলো: হে আল্লাহ! আপনারই পবিত্রতা! এটা তো গুরুতর অপবাদ (সূরা নূর, ১৬; নূরুল ইরফান)! অধিকন্তু, তাঁর (মানে আবদুল্লাহ সুহায়মের) আগে এক ব্যক্তি মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কুৎসা রটনা করেছিলো এ কথা বলে যে তিনি পয়গাম্বর ঈসা ইবনে মরিয়ম (আলাইহিস্ সালাম)-কে এবং সোয়ালেহীনকেও অপমান করেছিলেন। অতএব, এদের অন্তর মিথ্যে বানিয়ে বলার ও মিথ্যে সাক্ষ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে সাযুজ্যপূর্ণ। মহান আল্লাহ ফরমান: মিথ্যে অপবাদ তারাই রচনা করে, যারা আল্লাহর আয়াতসমূহের ওপর ঈমান রাখে না এবং তারাই মিথ্যেবাদী (সূরা নাহল্, ১০৫; নূরুল ইরফান)। তারা তাঁর প্রতি অপবাদ দিয়েছিলো এ দোষারোপ করে যে তিনি নাকি বলেছিলেন, ফেরেশতাবৃন্দ,ঈসা, উযাইর জাহান্নামের আগুনে পুড়ছেন; তাই আল্লাহ ফরমান – إِنَّ ٱلَّذِينَ سَبَقَتْ لَهُمْ مِّنَّا ٱلْحُسْنَىٰ أُوْلَـٰئِكَ عَنْهَا مُبْعَدُونَ – নিশ্চয় ওই সব লোক, যাদের জন্যে আমার প্রতিশ্রুতি কল্যাণের হয়েছে, তাদেরকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হয়েছে (সূরাহ আম্বিয়া, ১০১; নূরুল ইরফান)। [ইবনে আবদিল ওয়াহহাব নজদী]

[বঙ্গানুবাদকের নোট: ওহাবীগুরু শাইখ নজদীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত তদানীন্তন আলেম-উলামার অভিযোগ খাঁটি সত্য। তাঁর লেখা ‘কিতাবুত্ তওহীদ’ ও ‘কাশফুশ শুবহাত’ শীর্ষক দুটো পুস্তিকা এর প্রমাণবহ। সৌদি আরব দূতাবাস ও সরকার তা ব্যাপক প্রচার করেছেন। এতে কোনো সন্দেহ নেই]  

উপসংহার

সারসংক্ষেপ হলো, যে ব্যক্তি (আল্লাহ ছাড়া অন্যের) সাহায্য/সহায়তা চান তাঁকে কুফর বা অবিশ্বাসের দোষারোপ করা যাবে না, ব্যতিক্রম কেবল সে ক্ষেত্রে তিনি যখন বিশ্বাস করেন আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ স্বাধীন/স্বতন্ত্র ক্ষমতাবলে সৃষ্টি ও অস্তিত্ব দান করতে পারেন। জীবিত ও বেসালপ্রাপ্তের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ের কোনো মানে নেই, কেননা কেউ যদি বিশ্বাস করেন যে আল্লাহ ভিন্ন কোনো সত্তা স্বাধীন/স্বতন্ত্রভাবে সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখেন, তাহলে তাঁরা কুফর তথা অবিশ্বাস করেছেন; তবে কিছু মতপার্থক্য রয়েছে আফ’আল বা ক্রিয়াসমূহের সৃষ্টিবিষয়ে মু’তাযিলা সম্প্রদায় ও তাদের আকীদা-বিশ্বাস নিয়ে। যদি কেউ (ক্রিয়াসমূহের) উপার্জন ও অর্জনে বিশ্বাস করেন, তবে তাঁর প্রতি কুফরের ফতোয়া আরোপ করা যাবে না (وإن اعتقد التسبب والاكتساب لم يكفر)। 

আপনি জানেন, অধিকাংশ মানুষ বেসালপ্রাপ্তদের সম্পর্কে এ বিশ্বাস পোষণ করেন যে তাঁরা হচ্ছেন সাবাব/মাধ্যম ও কাসাব/অর্জনের বাহন, ঠিক যেমনটি জীবিতরা, যাঁরা নন এলাহী (আল্লাহ)-এর মতো স্রষ্টা কিংবা বিভিন্ন বস্তুর অস্তিত্বদাতা। এ বিষয়টি ধারণা করা যায় না যে তাঁদের (মানে বেসালপ্রাপ্তদের) সম্পর্কে মানুষের বিশ্বাস জীবিতদের সম্পর্কে বিশ্বাস হতে বেশি কিছু, স্রেফ এতোটুকু যে তাঁরা বিশ্বাস করেন না জীবিতরা অর্জন ও মাধ্যমের চেয়ে বেশি কিছু হন। যদি কোনো ভুল হয়ে থাকে, তাহলে তা হতে দিন সৃষ্ট বস্তু/বিষয়টিকে মাধ্যম ও অর্জনের আকীদা-বিশ্বাস পোষণের ক্ষেত্রে; কেননা এটাই একজন ঈমানদার মুসলমান সর্বোচ্চ যতোখানি বিশ্বাস করতে পারেন। নতুবা তিনি ঈমানদার হতে পারবেন না। এ ক্ষেত্রে ভুল করা কুফর বা শির্ক নয়। 

আমরা আপনার শ্রবণশক্তি বরাবর এ কথা পুনরাবৃত্তি করা ক্ষান্ত দেই নি যে, বেসালপ্রাপ্তদের ব্যাপারে আকীদা-বিশ্বাস জীবিতদের চেয়ে বেশি হওয়া উচিত এমনটি ধারণাই করা যায় না। ক্রিয়াসমূহ জীবিতদের ক্ষেত্রে অর্জন ও মাধ্যম হিসেবে সাবেত বা সাব্যস্ত হয়। অথচ বেসালপ্রাপ্তদের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র তা’সীর ক্ষমতাবলে ও হাকীকী (প্রকৃত) অস্তিত্বদানের সামর্থ্যের ব্যাপারটি নিঃসন্দেহে একদম ধারণার অযোগ্য।

মৃতদের কাছে যে ব্যক্তি সাহায্য-সহায়তা চান, এতোসব ছাড় দেওয়া বা রফা করার পরে তাঁর সম্পর্কে বেশিটুকু যা বলা যায় তা হলো, তিনি সেই ব্যক্তি যিনি এমন ব্যক্তির কাছে সাহায্য চান যিনি (স্বতন্ত্র ক্ষমতাবলে তা দানে) অক্ষম, অথচ তিনি জানেন না ওই ব্যক্তি (স্বতন্ত্র ক্ষমতাবলে দানে) অক্ষম। আর এটাকে শির্ক কে বলতে পারে? বরঞ্চ বেসালপ্রাপ্তদের ক্ষেত্রে জীবিতদের মতোই আমাদের জন্যে দুআ’য় মাধ্যম হওয়া ও অর্জনের সক্ষমতা লাভ ঐশী বিধানে (তাঁদেরকে) নসীব করা হয়েছে। নিশ্চয় রূহসমূহ তাঁদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনের জন্যে দুআ’ করেন।

প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে বর্ণিত হয়ে এসেছে যে তিনি ঘোষণা করেন:

إن أعمالكم تعرض على أقاربكم من الأموات فإن كان خيرًا استبشروا به وإن كان غير ذلك قالوا: اللهم لا تمتهم حتى تهديهم إلى ما هديتنا، أخرجه أحمد وله طرق يشد بعضها بعضاً، أنظر الفتح الرباني ترتيب المسند ج ٧ ص ٨٩ وشرح الصدور للسيوطي. 

অর্থ: নিশ্চয় তোমাদের আমল/কর্মসমূহ তোমাদেরই বেসালপ্রাপ্ত আত্মীয়স্বজনের কাছে পেশ করা হয়। নেক/পুণ্যময় আমল হলে তারা শুভসংবাদ হিসেবে গ্রহণ করে; আর তা না হলে তারা দুআ’ করে: “হে আল্লাহ, তাদেরকে আপনি হেদায়াত/সঠিক পথপ্রদর্শন না করে মৃত্যুবরণ করতে দেবেন না, ঠিক যেমনটি আপনি আমাদেরকে হেদায়াত দিয়েছেন।” এ হাদীসটি ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহমতুল্লাহি আলাইহি) বর্ণনা করেছেন এবং এটার সমর্থনকারী আরো ইসনাদ-সহ বর্ণনা এসেছে। দেখুন – ‘আল-ফাতহুর রাব্বানী,’ তারতীবুল মুসনাদ,’ ৫/৮৯; এবং ইমাম সৈয়ূতী প্রণীত ‘শরহুস্ সুদূর।’ 

ইমাম ইবনুল মোবারক (রহমতুল্লাহি আলাইহি) তাঁর ইসনাদ-সহ হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনা করেন, যিনি বলেন:

تعرض أعمال الأحياء على الموتى، فإذا رأوا حسناً فرحوا واستبشروا، وإن رأوا سوءًا قالوا: اللهم راجع بهم. (أنظر كتاب الروح لابن القيم).

অর্থ: জীবিতদের আমলনামা বেসালপ্রাপ্তদের সামনে পেশ করা হয়। তাঁরা তাতে উত্তম কিছু দেখলে শুভসংবাদ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং খুশি হন। কিন্তু মন্দ কিছু দেখলে তাঁরা আরজ করেন, “হে আল্লাহ, তাদেরকে ফিরিয়ে আনুন (সঠিক পথে)।” [ইবনে কাইয়েম আল-জওযিয়া কৃত  কিতাবুর রূহ গ্রন্থটি দেখুন]                       

দ্বিতীয় অধ্যায়: নবুওয়্যত-সম্পর্কিত গবেষণা

মহানবী (দ:)-এর অনন্য ও বিশেষ গুণাবলী, নবুওয়্যতের বাস্তবতা, মানবের বাস্তবতা ও বরযখ বা পরকালীন জীবনের বাস্তবতা সম্পর্কে ব্যাখ্যা

নবুওয়্যতের অনন্য গুণাবলী ও এতদসংক্রান্ত বিষয়ে উলামাবৃন্দের দৃষ্টিভঙ্গি

প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর খাসাইস তথা গুণগত বৈশিষ্ট্যাবলী নিয়ে (হক্কানী/রব্বানী) উলামায়ে কেরাম (রহ.) মহা যত্নবান হয়েছেন তাঁদেরই রচিত বইপত্রে, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণমূলক লেখনীতে এবং সঙ্কলন ও পৃথক অনুসন্ধানমূলক গবেষণায়। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ব্যাপক ও সুপ্রসিদ্ধ হচ্ছে ইমাম হাফেয জালালউদ্দীন সৈয়ূতী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর প্রণীত ‘আল-খাসা’ইসুল কুবরা’ গ্রন্থটি (বাংলা সংস্করণ – সাকলাইন প্রকাশন, চট্টগ্রাম)। 

এসব খাসাইস/গুণগত বৈশিষ্ট্যাবলী প্রচুর, যার অনেকগুলোর রয়েছে সহীহ/বিশুদ্ধ সনদ; অনেকগুলোর আবার তা নেই; আর অন্যগুলো নিয়ে উলামাবৃন্দের মাঝে মতপার্থক্য বিদ্যমান, যাঁদের অনেকে এই মত পোষণ করেছেন যে সেগুলো সহীহ, আবার অনেকের দৃষ্টিতে সেগুলো দুর্বল। এসব বিষয় (আসলে) মতপার্থক্যগত।

والكلام فيها دائر بين العلماء من قديم بين الصواب والخطأ والصحة والبطلان، لا بين الكفر والإيمان، والعلماء يختلفون في كثير من الأحاديث ويرد بعضهم على بعض في تصحيحها وتضعيفها أو ردها لاختلاف أنظارهم في تقييم أسانيدها ونقد رجالها، فمن صحح منها الضعيف أو ضعف الصحيح أو أثبت المردود أو رد الثابت بحجة أو تأويل أو شبهة دليل فقد سلك مسلك العلماء في البحث والنظر وذلك من حقه كإنسان له عقله وفهمه والمجال مفتوح والميدان فسيح والعلم مشاع بين الجميع. 

উলামা-মণ্ডলীর মাঝে এই বিষয়গুলোর আলাপ-আলোচনা অতীতকাল হতেই আবর্তমান ছিলো এ মর্মে যে এগুলো পুণ্যদায়ক না ভুল-ভ্রান্তি, এবং সহীহ না বাতীল/অবৈধ। কিন্তু কখনোই তা কুফর/অবিশ্বাস ও ঈমানদারিকে ঘিরে আবর্তিত হয়নি। উলামাবৃন্দ বহু হাদীসের ব্যাপারে (পারস্পরিক) ভিন্নমত পোষণ করেছেন, এবং সেগুলোর সহীহ, যয়ীফ, কিংবা ইসনাদের দৃঢ়তা ও (ইসনাদের মধ্যে) রাবী/বর্ণনাকারীদের সমালোচিত হওয়ার কারণে তাঁরা একে অপরকে রদ করেছেন। তাঁদের মধ্যে যদি কেউ দুর্বল হাদীসকে সহীহ হিসেবে প্রতিপাদন করেন, আর সহীহ হাদীসকে দু্র্বল হিসেবে সাব্যস্ত করেন, কিংবা প্রতিষ্ঠিত বর্ণনাকে প্রত্যাখ্যান করেন, আর যদি এসবই (উপযুক্ত) প্রমাণ অথবা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ কিংবা সাদৃশ্যপূর্ণ দলিল সহকারে তিনি করেন, তাহলে তিনি গবেষণা ও অনুসন্ধানকর্মে উলামাবৃন্দের পথই অতিক্রম করেছেন। তা মানুষ হিসেবে তাঁর অধিকার, (কেননা) তিনি আপন বুদ্ধি-বিবেচনা ও উপলব্ধির অধিকারী। এই ক্ষেত্রটি উন্মুক্ত, আর ময়দানও প্রশস্ত, এবং জ্ঞান সবার মাঝে সার্বিক। 

وقد شجع عليه إمام العقلاء وسيد العلماء النبي الأعظم والرسول الأكرم محمد صلى الله عليه وسلم إذ جعل للمجتهد المصيب أجرين وللمجتهد المخطئ أجرً.

এই বিষয়টির প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছেন বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের ইমাম ও জ্ঞানী পণ্ডিতবৃন্দের সাইয়্যেদ (খোদ) সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও মহত্তম রাসূল হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, যখনই তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত মুজতাহিদ (মানে ধর্মশাস্ত্রে গবেষক) দুটি সওয়াব পাবেন, আর গবেষণায় ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী মুজতাহিদ পাবেন একটি সওয়াব। 

ولم يزل العلماء يتسامحون في نقل الخصائص النبوية وينظرون إليها على أنها داخلة في فضائل الأعمال ولا تتعلق بالحلال والحرام وعلى هذا بنى العلماء قاعدتهم في العمل بالحديث الضعيف في فضائل الأعمال ما دام أنه ليس موضوعاً ولا باطلاً بشروطهم المعتبرة في هذا الباب ولا يشترطون فيها الصحيح بالمعنى المصطلح عليه، ولو ذهبنا إلى اشتراط هذا الشرط الشاذ لما أمكن لنا ذكر شيء من سيرة النبي صلى الله عليه وسلم قبل البعثة وبعد البعثة مع أنك تجد كتب الحفاظ الذين عليهم العمدة وعلى صنيعهم المعول، والذين منهم عرفنا ما يجوز وما لا يجوز ذكره من الحديث الضعيف نجد كتبهم مملوءة بالمقطوعات والمراسيل وما أخذ عن الكهان وأشباههم في خصائص رسول الله صلى الله عليه وسلم لأن ذلك مما يجوز ذكره في هذا المقام.

প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর খাসায়েস তথা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যাবলী (সংক্রান্ত বর্ণনাসমূহ) উদ্ধৃত করার ক্ষেত্রে উলামাবৃন্দ নমনীয় হওয়া থেকে বিরত থাকেননি। তাঁদের এতদসংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি হলো, এগুলো ফযায়েলে আমলের (মানে পুণ্যদায়ক কর্মের) শ্রেণিভুক্ত। এগুলোর সাথে হালাল ও হারামের কোনো সম্পর্ক নেই। 

এরই ভিত্তিতে উলামাবৃন্দ তাঁদের নিয়ম-কায়দা নির্ধারণ করেছেন যে, ফযায়েলে আমলের বেলায় যয়ীফ বা দুর্বল হাদীসসমূহের ওপর আমল/অনুশীলন করা যাবে, যতোক্ষণ পর্যন্ত না তা (মানে হাদীস) মওযূ/জাল কিংবা বাতিল হয়; আর এক্ষেত্রে সহীহ হাদীসসমূহকে সেগুলোর সুপরিচিত শর্তাবলী অনুসারে বিবেচনায় নেয়া হবে। বিদ্বানমণ্ডলী সহীহ শব্দের পারিভাষিক অর্থে এতে শর্তারোপ করেন না। যদি আমরা এই আজব শর্তকে অত্যাবশ্যক পূর্বশর্ত হিসেবে গ্রহণ করি, তাহলে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নবুয়্যতের আগে ও পরে তাঁর সীরাত/জীবনী মোবারক সংক্রান্ত কোনো কিছুই উল্লেখ করতে সক্ষম হবো না। 

অপর পক্ষে, আপনি খুঁজে পাবেন হুফফায তথা হাদীসবিদবৃন্দের বইপত্র, যেগুলোর ওপর নির্ভর করা হয় এবং তাঁদের শাস্ত্রে উদ্ধৃত করা হয়; তাঁদের কাছ থেকেই আমরা জানতে পারি দুর্বল হাদীসের উল্লেখ সম্পর্কে কী কী জায়েয এবং কী কী না-জায়েয। প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর খাসায়েস সম্পর্কে তাঁদের বইপত্র এমন সব হাদীসে পরিপূর্ণ যেগুলোর ইসনাদ কাটা/বিচ্ছিন্ন, মুরসাল ও গণকের সূত্রে বর্ণিত; কেননা সেটাই ওই মকাম তথা পর্যায়ে উল্লেখ করার ক্ষেত্রে জায়েয।

كتب السلف والخصائص:

সালাফ/প্রাথমিক যুগের বুযূর্গমণ্ডলীর বইপত্র ও প্রিয়নবী (ﷺ)-এর খাসাইস/চরিত্রবৈশিষ্ট্য

আমাদের যদি সালাফবৃন্দের বইপত্রের দিকে ফিরে তাকাতে হয়, তবে আমরা এ উম্মতের অনেক আলেম-উলামা এবং ফক্বীহ ইমামকে খুঁজে পাবো যাঁরা নিজেদের বইপত্রে নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর খাসাইস তথা উন্নত চরিত্রবৈশিষ্ট্য (সংক্রান্ত বর্ণনা)-সমূহের নমুনা এবং আজব ও বিস্ময়কর বিষয়াদি উল্লেখ করেছেন। যদি কোনো গবেষক স্রেফ রওয়ায়াত/বর্ণনার ইসনাদ বা সনদের সহীহ হওয়ার ভিত্তিতে বর্ণনাটিকে গ্রহণ করে নিতেন, তাহলে তাঁরা (মানে সালাফবৃন্দ) যতোগুলো রওয়ায়াত উদ্ধৃত করেছেন তার তুলনায় স্পষ্টতঃ স্বল্প সংখ্যক বর্ণনাই বিরাজমান থাকতো। এটা এ (বিদ্যার) ক্ষেত্রে আলেম-উলামার সুপ্রসিদ্ধ নিয়ম/কায়দা ও তাঁদের সুপ্রতিষ্ঠিত উসূল/নীতিমালার ভিত্তিতেই (গৃহীত সিদ্ধান্ত)।

ابن تيمية والخصائص النبوية

ইবনে তাইমিয়া ও নবুওয়্যতের বৈশিষ্ট্যাবলী

ইবনে তাইমিয়া যিনি আপন কঠোরতার জন্যে পরিচিত ছিলেন, তিনি এ বিষয়ে উদ্ধৃত করেছেন কিছু উক্তি – এমন সব বর্ণনা যেগুলোর ইসনাদ/সনদ সহীহ তথা বিশুদ্ধ নয়; আর তিনি অনেক বিষয়ে এগুলোকে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করেছেন এবং তিনি যে হাদীসটি ব্যাখ্যা করছিলেন তা স্পষ্টকরণ ও সমর্থনের উদ্দেশ্যে এগুলোকে বিশ্বস্ত বা নির্ভরযোগ্য বিবেচনা করেছেন। এরই একটি দৃষ্টান্ত হলো (তাঁর রচিত) ‘আল-ফাতাওয়া আল-কুবরা’ পুস্তকে তাঁর একটি বক্তব্য:

قد روي أن الله كتب اسمه أي النبي ﷺ على العرش وعلى ما في الجنة من الأبواب والقباب والأوراق، وروى في ذلك عدة آثار توافق هذه الأحاديث الثابتة التي تبين التنويه باسمه وإعلاء ذكره حين قال: وقد تقدم لفظ الحديث الذي في المسند عن ميسرة الفجر لما قيل له: متى كنت نبياً؟ قال: وآدم بين الروح والجسد، وقد رواه أبو الحسين بن بشران من طريق الشيخ أبي الفرج ابن الجوزي في الوفا بفضل المصطفى ﷺ: حدثنا أبو جعفر محمد بن عمرو وحدثنا أحمد بن إسحاق ابن صالح حدثنا محمد بن صالح حدثنا محمد بن سنان العوفى حدثنا إبراهيم بن طهمان عن يزيد بن ميسرة عن عبد الله بن سفيان عن ميسرة قال: قلت: يا رسول الله ! متى كنت نبياً؟ قال: ((لما خلق الله الأرض واستوى إلى السماء فسواهن سبع سموات وخلق العرش كتب على ساق العرش محمد رسول الله خاتم الأنبياء، وخلق الجنة التي أسكنها آدم وحواء فكتب اسمي على الأبواب والأوراق والقباب والخيام وآدم بين الروح والجسد، فلما أحياه الله تعالى نظر إلى العرش فرأى اسمي فأخبره الله أنه سيد ولدك، فلما غرهما الشيطان تابا واستشفعا باسمي إليه)) ..اهــ . (الفتاوى ج٢ ص١٠١) 

অর্থ: বর্ণিত হয়েছে যে আল্লাহ পাক প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নাম মোবারক আরশের ওপরে লিখেছিলেন এবং (এর পাশাপাশি) জান্নাতের বিভিন্ন দরজা, গম্বুজ ও পাতায়ও লিখেছিলেন। এ মর্মে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে যা সমর্থন দেয় এ সকল সুপ্রতিষ্ঠিত হাদীসের, যেগুলো তাঁর নাম মোবারকের উচ্চমর্যাদা ও তাঁর সমুন্নত যিকর তথা স্মরণকে প্রতীয়মান করে…। মায়সারা আল-ফজরের প্রণীত ‘মুসনাদ’ গ্রন্থে প্রাপ্ত হাদীসের শব্দচয়ন ইতিপূর্বে উল্লেখিত হয়েছে, যা’তে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো: “আপনি কখন থেকে নবী ছিলেন, (ইয়া রাসূলাল্লাহ)?” তিনি উত্তর দিয়েছিলেন: “যখন পয়গাম্বর আদম (আলাইহিস্ সালাম) রূহ/আত্মা ও দেহের মধ্যবর্তী ছিলেন।” শাইখ আবূল ফারাজ বিন জওযী (রহ.)-এর সূত্রে এটা বর্ণনা করেছেন আবূল হুসাইন বিন বুশরান ”আল-ওয়াফা বি-ফাদলিল মুস্তফা (ﷺ)” গ্রন্থে, যা এসেছে (মূল বর্ণনাকারী) মায়সারা হতে, যিনি বলেন: “আমি বল্লাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ), আপনি কখন (সর্বপ্রথম) নবী হন?” তিনি উত্তর দেন: “যখন আল্লাহ দুনিয়া/জমিন সৃষ্টি করেছিলেন এবং আসমানকে সাতটি আসমানে বিস্তৃত করেছিলেন (আল-বাকারা, ২৯); আর আরশ সৃষ্টি করেছিলেন এবং ওর কদমে লিখেছিলেন: ‘মুহাম্মাদুন্ রাসূলুল্লাহ খাতামুন আম্বিয়া।’ অতঃপর আল্লাহ বেহেশত সৃষ্টি করেন যেখানে আদম ও হাওয়া বসতি করেন; আর তিনি বেহেশতের ফটকগুলোতে, গাছের পাতাসমূহে, গুম্বজ ও তাঁবুগুলোতে আমার নাম লিখেছিলেন এমনই এক সময়ে যখন আদম (আলাইহিস্ সালাম) ছিলেন রূহ ও দেহের মধ্যবর্তী অবস্থানে; অতঃপর যখন আল্লাহতায়ালা তাঁর মাঝে রূহ/জীবন ফুঁকে দেন, তখন তিনি আরশের দিকে তাকিয়ে আমার নাম দেখতে পান; এমতাবস্থায় আল্লাহতায়ালা তাঁকে জানান, ‘নিশ্চয় তিনি (ﷺ) তোমার বংশধরদের সাইয়্যিদ তথা ইমাম।’ যখন শয়তান তাঁদের দু জনকে (মানে আদম ও হাওয়াকে) ধোঁকা দিলো, তখন তাঁরা আমারই নামে আল্লাহর কাছে তওবা ‍ও সুপারিশ কামনা করেন।” [আল-ফাতাওয়া, ২/১৫১]

ابن تيمية والكرامات

ইবনে তাইমিয়া ও (আউলিয়ার) কারামত

খাসাইস তথা (নুবূয়্যতের) অনন্য গুণাবলী/বৈশিষ্ট্যাবলী এবং (আউলিয়ার) কারামত বা অলৌকিকত্ব উভয়ই হুকুমের ক্ষেত্রে ও নকল/উদ্ধৃত করার বেলায় একই শ্রেণিভুক্ত; আর সেগুলো বর্ণনার সময় (ওই রকম) কঠোর না হওয়া উচিত, যেমন কঠোরতা আমরা অবলম্বন করে থাকি হালাল ও হারাম নির্ধারণী হুকুম (-সংক্রান্ত বর্ণনা) উদ্ধৃত করার ক্ষেত্রে। কেননা কারামত-সম্পর্কিত এসব বর্ণনা মানাক্বীব (জীবনী) ও ফযায়েল (পুণ্যদায়ক কর্ম)-এর আওতাভুক্ত।

আউলিয়া (রহমতুল্লাহি আলাইহিম)-এর কারামত সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়ার অবস্থানগত দৃষ্টিভঙ্গি আম্বিয়া (আলাইহিমুস্ সালাম)-এর খাসাইস তথা অনন্য বৈশিষ্ট্যাবলীর অনুরূপ। তিনি (ইসলামী) প্রাথমিক যুগে সংঘটিত বেশ কিছু কারামত ও অপার্থিব ঘটনার সারসংক্ষেপ বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। 

যদি আমরা সেসব বর্ণনার স্বতন্ত্র ইসনাদ, মজবুত ভিত্তি, বর্ণনার উৎস নিয়ে গবেষণা করি, তাহলে দেখতে পাবো সেগুলোর মধ্যে কিছু আছে সহীহ/বিশুদ্ধ, কিছু হাসান/নির্ভরযোগ্য, কিছু যয়ীফ বা দুর্বল, কিছু মকবূল/গৃহীত, কিছু মারদূদ/প্রত্যাখ্যাত, আরো কিছু শা’য/অস্বাভাবিক বা অনিয়মিত।

এই (গবেষণা) ক্ষেত্রে এগুলোর সবই উলামাবৃন্দের কাছে গ্রহণযোগ্য ও সহনীয় এবং তাঁরা এগুলো উদ্ধৃত করেছেন। এ ধরনের দৃষ্টান্ত ইবনে তাইমিয়া কর্তৃক কতিপয় সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের কারামত বর্ণনায় পাওয়া যায়:

(১) – خرجت أم أيمن مهاجرة وليس معها زاد ولا ماء فكادت تموت من العطش فلما كان وقت الفطر وكانت صائمة سمعت حساً على رأسها فرفعته فإذا دلو معلق فشربت منه حتى رويت وما عطشت بقية عمرها – হযরতে উম্মে আয়মান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) হিজরত করতে বের হন পানির বন্দোবস্ত ছাড়া। যাত্রাকালে তেষ্টায় তিনি প্রায় প্রাণ হারাচ্ছিলেন। তিনি রোযা ছিলেন, আর ইফতারের সময় ঘনিয়ে এলে তাঁর মাথার ওপরে এক আওয়াজ শুনতে পান। মাথা উঁচু করে তিনি দেখতে পান পানিভর্তি একটি পানপাত্র একখানি রশির সাথে যুক্ত। তিনি তা থেকে জলপান করেন। অতঃপর তাঁর বাকি জীবনে তিনি আর কখনোই তৃষ্ণার্ত হননি।

(২) – وهذا سفينة مولى رسول الله ﷺ أخبر الأسد بأنه رسول رسول الله ﷺ فمشى معه الأسد حتى أوصله مقصده – রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মুক্তিপ্রাপ্ত গোলাম সাফীনা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু (জঙ্গলে পথরোধকারী) সিংহকে জানান যে তিনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ‘রাসূল’ তথা প্রতিনিধি। অতঃপর সিংহটি তাঁর গন্তব্যে পৌঁছুনো পর্যন্ত তাঁর সাথে হেঁটে এগিয়ে দেয়। 

(৩) – وهذا البراء بن مالك كان إذا أقسم على الله تعالى أبر قسمه وكانت الحرب إذا اشتدت على المسلمين في الجهاد يقولون: يا براء! اقسم على ربك، فيقول: يا رب! أقسمت عليك لما منحتنا أكتافهم فهزم العدو، فلما كان يوم القادسية قال: أقسمت عليك يا رب لما منحتنا أكتافهم وجعلتني أول شهيد، فمنحوا أكتافهم، وقتل البراء شهيدًا – হযরত বারা’আ বিন মালিক (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) যখন আল্লাহর নামে কসম বা শপথ করতেন, আল্লাহতায়ালা তৎক্ষণাৎ তাঁর পক্ষে তা পূরণ করতেন। জ্বিহাদের ময়দানে যুদ্ধ মুসলমানদের জন্যে কঠিন হলে তাঁরা তাঁকে বলতেন, ‘ওহে বারা’আ! আপনার প্রভুর নামে কসম করুন!’ তখন তিনি আরজ করতেন, ‘হে প্রভু! আমি আপনার নামে এমন শপথ করছি যেনো আপনি তাদের (মানে শত্রুদের গর্দান থেকে) মুণ্ডপাত করেন।’ অতঃপর শত্রুপক্ষ পরাভূত হতো। আল-ক্বাদিসিয়ার লড়াইয়ে তিনি বলেন, ‘হে আল্লাহ, আমি আপনার নামে কসম করছি যেনো তাদের মুণ্ডপাতের পরে আপনি আমাকে প্রথম শহীদের মর্যাদা দান করেন।’ অতঃপর শত্রুদের পরাজয় ঘটে এবং হযরত বারা’আ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) শহীদ হন।

(৪) – وهذا خالد بن الوليد حاصر حصناً منيعاً فقالوا: لا نسلم حتى تشرب السم فشربه فلم يضره – হযরত খালিদ বিন ওয়ালীদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) একটি সুরক্ষিত দুর্গ অবরোধ করেন এবং ওতে বসবাসকারীরা চিৎকার করে বলে, ‘আমরা আত্মসমর্পণ করবো না যতোক্ষণ না আপনি (এই) বিষপান করেন।’ তিনি বিষটুকু পান করেন, কিন্তু তাঁর কোনো ক্ষতি হয়নি।

(৫) – وهذا عمر بن الخطاب لما أرسل جيشاً أمر عليهم رجلاً يسمى سارية فبينما عمر يخطب فجعل يصيح على المنبر يا سارية الجبل يا سارية الجبل، فقدم رسول الجيش فسأل فقال: يا أمير المؤمنين لقينا عدو فهزمونا فإذا بصائح: يا سارية الجبل، فأسندنا ظهورنا بالجبل فهزمهم الله – খলীফা উমর বিন খাত্তাব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হযরত সারীয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-কে সেনাপতি করে একটি সৈন্যদল (পারস্যে) প্রেরণ করেন। খলীফা (রা.) যখন মদীনা মোনাওয়ারায় অবস্থিত মসজিদে নববীতে মিম্বরে উঠে খুতবা দিচ্ছিলেন, তখন তিনি উচ্চস্বরে বলেন, ‘হে সারীয়া! পাহাড়! হে সারীয়া! পাহাড়!’ ওই সেনাদলের বার্তাবাহক যখন মদীনায় ফিরে আসেন (ফলাফলের খবর নিয়ে), তখন তাঁকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়। তিনি উত্তরে বলেন, ‘হে আমীরুল মো’মেনীন! আমরা শত্রুদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলাম, আর তারা যখন আমাদের হারিয়ে দিচ্ছিলো তখনই একটি কণ্ঠস্বর উচ্চস্বরে বলেন, ‘ওহে সারীয়া! পাহাড়!’ অতঃপর আমরা পাহাড়ে আরোহণ করি এবং আল্লাহতায়ালা শত্রুদের পরাভূত করেন।’

(৬) – وهذا العلاء بن الحضرمي كان عامل رسول الله ﷺ على البحرين وكان يقول في دعائه: يا عليم، يا حليم، يا علي، يا عظيم فيستجاب له، ودعا الله بأن يسقوا ويتوضوا لما عدموا الماء والاسقاء لما بعدهم فأجيب، ودعا الله لما اعترضهم البحر ولم يقدروا على المرور بخيولهم فمروا على الماء ما ابتلت سروج خيولهم ودعا الله أن لا يروا جسده إذا مات، فلم يجدوه في اللحد – হযরত আল-আ’লা ইবনুল হাদরামী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ছিলেন বাহরাইনে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক নিযুক্ত রাজ্যপাল। তিনি তাঁর দুআ’র মধ্যে সর্বদা আরজ করতেন, ‘হে (আল্লাহ যিনি) আলীম/সর্বজ্ঞ, হালীম/ধৈর্যশীল, আ’লা/সর্বোচ্চ মর্যাদাবান, আযীম/সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশক্তিমান!’ এভাবে তিনি যখন দোয়া করতেন, আল্লাহ তাতে সাড়া দিতেন এবং দোয়া কবূল হতো। একবার তিনি ও তাঁর সেনাবাহিনী দীর্ঘ সময়ের জন্যে পানিকষ্টে ছিলেন; এমনি এক অবস্থায় তিনি আল্লাহর কাছে আরজ করেন যেনো জলপান ও অযূর (জন্যে পানির) ব্যবস্থা করা হয়। তাঁর দোয়া কবূল হয়। (একবার) তাঁরা যখন শত্রুর পিছু ধাওয়া করছিলেন, তখন তাঁদের সামনে পড়ে একটি দরিয়া এবং ঘোড়সওয়ারে তাঁরা তা পার হতে অক্ষম হন। অতঃপর তাঁরা (ঘোড়ার পিঠে চড়ে) সেগুলোকে হাঁটিয়ে দরিয়া পার হন, অথচ পানি তাঁদের ঘোড়ার লাগাম পর্যন্তও পৌঁছে নি। তিনি আরো দোয়া করেছিলেন তিনি বেসালপ্রাপ্ত হলে তাঁর দেহ মোবারক যেনো তারা খুঁজে না পায়। অতঃপর তাঁর বেসালপ্রাপ্তির পরে তারা তাঁর দেহ মোবারক খুঁজে পায়নি (দাফনস্থলে)।

(৭) – وجرى مثل ذلك لأبي مسلم الخولاني الذي ألقي في النار، فإنه مشى هو ومن معه من العسكر على دجلة وهي ترمى بالخشب من مدها ثم التفت إلى أصحابه فقال: هل تفقدون من متاعكم شيئاً حتى أدعو الله عز وجل فيه؟ فقال بعضهم: فقدت مخلاة، فقال: اتبعني فتبعه فوجدها قد تعلقت بشيء فأخذها وطلبه الأسود العنسي لما ادعى النبوة فقال له: أتشهد أني رسول الله؟ قال: ما أسمع، قال: أتشهد أن محمدًا رسول الله؟ قال: نعم، فأمر بنار فألقي فيها فوجدوه قائماً يصلي فيها وقد صارت عليه بردًا وسلاماً، وقدم المدينة بعد موت النبي ﷺ فأجلسه عمر بينه وبين أبي بكر الصديق ـ رضي الله عنهما، وقال: الحمد لله الذي لم يمتني حتى أرى من أمة محمد ﷺ من فعل به كما فعل بإبراهيم خليل الله، ووضعت له جارية السم في طعامه فلم يضره وخببت امرأة عليه زوجته فدعا عليها فعميت، وجاءت وتابت فدعا لها الله فرد عليها بصرها – অনুরূপ একটি ঘটনা ঘটেছিলো হযরত আবূ মুসলিম আল-খাওলানী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর ক্ষেত্রে যখন তাঁকে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছিলো। তিনি এবং তাঁর সঙ্গী সৈনিকবৃন্দ দজলা/তাইগ্রিস নদীর পানির ওপর দিয়ে হেঁটে পার হন, যদিও (উত্তাল তরঙ্গে) তাতে কাঠ ও অন্যান্য পলি (পলল) ঊর্ধ্বে এদিক-ওদিক নিক্ষিপ্ত হচ্ছিলো। তিনি তাঁর সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে বলেন, “তোমরা কি ব্যক্তিগত কোনো কিছু হারিয়েছো যাতে আমি আল্লাহর দরবারে সে বিষয়ে দুআ’ করতে পারি?” তাঁদের কেউ কেউ উত্তরে বলেন, “আমার শিরস্ত্রাণ/হেলমেট হারিয়েছি আমি।” অতঃপর তিনি (আবূ মুসলিম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, “আমাকে অনুসরণ করো।” ওই ব্যক্তি তাঁর পিছু পিছু অনুসরণ করেন এবং সহসা দেখতে পান যে তাঁর শিরস্ত্রাণটি কিছু একটার সাথে জড়িয়ে গেছে, আর তিনি তা নিয়ে নেন। আসওয়াদ আল-আনসী যখন নিজের নুবূয়্যত দাবি করে, তখন সে আবূ মুসলিম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-কে ধরে আনার জন্যে লোক পাঠায়। আল-আসওয়াদ তাঁকে জিজ্ঞেস করে, “আপনি কি সাক্ষ্য দেন এ মর্মে যে আমি আল্লাহর রাসূল?” তিনি উত্তর দেন, “আমি শুনি না।” আল-আসওয়াদ এবার জিজ্ঞেস করে, “আপনি কি সাক্ষ্য দেন যে মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল?” তিনি উত্তরে বলেন, “হ্যাঁ।” এরপর হযরত আবূ মুসলিম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-কে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়। নিক্ষেপের সাথে সাথে তারা (মানে শত্রুরা) দেখতে পায় তিনি ওর ভেতরে দাঁড়িয়ে নামায পড়ছেন এবং আগুন তাঁর জন্যে পুরোপুরি শীতল ও শান্তিদায়ক হয়ে গিয়েছে। প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বেসাল শরীফের পরে হযরত আবূ মুসলিম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন। হযরত উমর ফারূক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) খলীফা আবূ বকর সিদ্দীক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ও নিজের মধ্যখানে তাঁকে বসান এবং বলেন, “সমস্ত প্রশংসা আল্লাহতায়ালারই প্রাপ্য, যিনি আমাকে ইন্তিকাল দেননি যতোক্ষণ না আমি উম্মতে মুহাম্মদী (দ.)-এর মধ্যে এমন এক পুণ্যাত্মাকে দেখেছি, যাঁর সাথে আল্লাহ সেরকম আচরণ করেছেন যা তিনি পয়গাম্বর ইবরাহীম খলীলউল্লাহ (আলাইহিস সালাম)-এর সাথে আচরণ করেছেন।” (আরো বর্ণিত হয়েছে যে) জনৈকা দাসী তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে খাবারে বিষ মিশিয়েছিলো; কিন্তু তা তাঁর কোনো ক্ষতিই করতে পারেনি। (আরো বর্ণিত হয়েছে যে) জনৈকা নারী তাঁর স্ত্রীর সাথে তাঁর ঝগড়া বাধাতে চক্রান্ত করেছিলো; তাই তিনি ওই নারীর প্রতি বদ দোয়া করেন এবং সে অন্ধ হয়ে যায় যতোক্ষণ না সে তাঁর কাছে এসে তওবা করে; অতঃপর তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেন আর আল্লাহ সেই নারীকে তার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেন।

(৮) – وكان سعيد بن المسيب في أيام الحرة يسمع الأذان من قبر رسول الله ﷺ أوقات الصلوات، وكان المسجد قد خلا فلم يبق غيره – গ্রীষ্মের মওসূমে হযরত সাঈদ বিন মুসাইয়্যেব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রওযা মোবারক হতে (ওয়াক্তিয়া) নামাযের আযান শুনতে পেতেন, যদিও মসজিদে নববী তখন ফাঁকা (মানে জনশূন্য) থাকতো।

(৯) – وكان عمرو بن عقبة بن فرقد يصلي يوماً في شدة الحر فأظلته غمامة وكان السبع يحميه وهو يرعى ركاب أصحابه لأنه كان يشترط على أصحابه في الغزو أنه يخدمهم – একবার হযরত আমর বিন উক্ববা বিন ফারক্বাদ তীব্র গরমে যখন নামায পড়ছিলেন, তখন বৃষ্টির একটি ঘন কালো মেঘ তাঁর ওপরে চলে আসে। যুদ্ধ অভিযানের সময়ে তিনি তাঁর সাথীদের গবাদি পশু চারণ দ্বারা তাঁদের প্রতি নিজ সেবা প্রদানের শর্তারোপ করতেন; ওই দায়িত্ব পালনকালে শিকারী প্রাণিরাও তাঁর সেবা করতো, তাঁর নিরাপত্তায় নজর রাখতো।

(১০) – وكان مطرف بن عبد الله بن الشخير إذا دخل بيته سبحت معه آنيته، وكان هو وصاحب له يسيران في ظلمة فأضاء لهما طرف السوط. اهــ – যখন হযরত মুতার্রিফ বিন আবদিল্লাহ বিন শিখীর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) আপন ঘরে প্রবেশ করতেন, তখন রান্নার হাঁড়ি-পাতিলও তাঁর সাথে সাথে আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করতো। আরো বর্ণিত হয়েছে যে তিনি ও তাঁর এক সাথী যখন অন্ধকারে হাঁটছিলেন, তখন তাঁদের (হাতে সওয়ারের) চাবুকের ডগাগুলো তাঁদেরই জন্যে আলো ছড়াচ্ছিলো। [ইবনু তাইমিয়া কৃত ‘ফাতাওয়া-এ-কুবরা,’ ১১/২৭১]

الشيخ ابن القيم وجلوس النبي ﷺ على العرش (١٨٨)

ইবনে কাইয়্যেম আল-জাওযিয়্যা এবং মহানবী (দ:)-এর আরশে উপবিষ্ট হওয়ার বিষয়

ইবনে কাইয়্যেম জাওযিয়্যা আশ্চর্যজনক ও অনন্য একটি খুসূসীয়্যাত তথা প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্বতন্ত্র গুণগত বৈশিষ্ট্য সালাফ আস্ সালেহীন (প্রাথমিক যুগের পুণ্যাত্মা)-মণ্ডলীর মধ্য হতে অনেক ইমাম-আইয়েম্মা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের সূত্রে উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেন:

[فائدة] قال القاضي صنف المروزي كتاباً في فضيلة النبي ﷺ وذكر فيه إقعاده على العرش قال القاضي وهو قول أبي داود وأحمد بن أصرم ويحيى ابن أبي طالب وأبي بكر بن حماد وأبي جعفر الدمشقي وعياش الدوري وإسحاق ابن راهويه وعبد الوهاب الوراق وإبراهيم الأصبهاني وإبراهيم الحربي وهارون ابن معروف ومحمد بن إسماعيل السلمي ومحمد بن مصعب العابد وأبي بكر بن صدقة ومحمد بن بشر ابن شريك وأبي قلابة وعلي بن سهل وأبي عبد الله بن عبد النور وأبي عبيد والحسن ابن فضل وهارون بن العباس الهاشمي وإسماعيل بن إبراهيم الهاشمي ومحمد بن عمران الفارسي الزاهد ومحمد بن يونس البصري وعبد الله بن الإمام أحمد المروزي وبشر الحافي، انتهى، قال الشيخ ابن القيم: [قلت]: وهو قول ابن جرير الطبري وإمام هؤلاء كلهم مجاهد إمام التفسير وهو قول أبي الحسن الدارقطني ومن شعره فيه:

حديث الشفاعة عن أحمد :: إلى أحمد المصطفى مسنده

وجاء حديث بإقعاده :: على العرش أيضاً فلا نجحده

أمرّوا الحديث على وجهه :: ولا تدخلوا فيه ما يفسده

ولا تنكروا أنه قاعد :: ولا تنكروا أنه يُقعده

اهــ (بدائع الفوائد للشيخ إبن القيم ج٤ص٤٠)

ফায়দা

আল-কাজী বলেছেন, “আল-মার্রূযী একটি বই লিখেছেন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ফযায়েল/গুণগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে এবং তিনি তাতে উল্লেখ করেছেন যে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আরশে বসানো হবে।” আল-কাজী (আরো) বলেন, “এই মত ব্যক্ত করেছেন সর্ব-ইমাম আবূ দাউদ, আহমদ ইবনু আসরাম, ইয়াহইয়া বিন আবী তালিব, আবূ বকর বিন হাম্মাদ, আবূ জা’ফর আদ্ দিমাশকী, আইয়াশ আদ্ দাওরী, ইসহাক্ব বিন রাহাওয়াইহ, আবদুল ওয়াহহাব বিন ওয়ার্রাক্ব, ইবরাহীম আল-আসবাহানী, ইবরাহীম আল-হারবী, হারূন বিন মা’রূফ, মুহাম্মদ বিন ইসমাঈল সুলামী, মুহাম্মদ বিন মুস’আব আল-আবিদ, আবূ বকর বিন সাদাক্বা, মুহাম্মদ বিন বিশর বিন শুরাইক, আবূ ক্বিলাবা, আলী বিন সাহল, আবূ আবদুল্লাহ বিন আবদীন্ নূর, আবূ উবায়দ, হাসান বিন ফযল, হারূন বিন আব্বাস আল-হাশিমী, ইসমাঈল বিন ইবরাহীম আল-হাশিমী, মুহাম্মদ বিন ইমরান আল-ফারিসী (সূফী), মুহাম্মদ বিন ইঊনুস আল-বসরী, ইমাম আহমদ হাম্বল-পুত্র আবদুল্লাহ, আল-মার্রূযী ও বিশর আল-হাফী (রহমতুল্লাহি আলাইহিম)।” 

ইবনে কাইয়্যেম বলেন, “আমি বলি: এই মত আরো ব্যক্ত করেছেন ইমাম ইবনে জারীর তাবারী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) এবং ওপরে উল্লেখিত সবার ইমাম হযরতে মুজাহিদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) যিনি তাফসীরশাস্ত্রের (মহান) ইমাম। এই দৃষ্টিভঙ্গি ইমাম আবূল হাসান দারুকুতনী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-ও ব্যক্ত করেছেন তাঁরই পদ্যের কিছু ছত্রে:

শাফায়াত-সংক্রান্ত হাদীসের সনদ আহমদ হতে আহমদে মুস্তফা (দ.) পর্যন্ত বিস্তৃত,

আরেকটি হাদীসে এসেছে তাঁকে আরশে করা হবে উপবিষ্ট, যা নয় আমাদের অস্বীকৃত,

হাদীসটি আজ্ঞাস্বরূপ করো জারি পুরোপুরি, পরিবর্তনের দ্বারা না করে তার অর্থ বিকৃত,

আর অস্বীকার কোরো না তিনি যে উপবিষ্ট, নিশ্চয় তাঁকে করানো হবে আরশে উপবিষ্ট।

(ভাবানুবাদ)

[ইবনে কাইয়্যেম কৃত বাদাঈয়ুল ফাওয়াইদ, ৩/৪০; প্রাথমিক যুগের সালাফ/পুণ্যাত্মাবৃন্দ এই মত ব্যক্ত করেছেন এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে যে আল্লাহতায়ালা প্রিয়নবী (দ.)-কে আরশে বসাবেন; তাঁরা এ বিশ্বাস করতেন না যে আল্লাহ আরশে বসেন (ইস্তিওয়া) – লেখক]

كشاف القناع و خصائص عجيبة

কাশশা’ফুল-ক্বিনা’ঈ এবং বিস্ময়কর অনন্য গুণাবলী/খাসাইস

মহান ফকীহ আল্লামা ও শাইখ মনসূর বিন ইঊনুস আল-বাহুতী (রহ.) তাঁর ‘কাশশা’ফুল ক্বিনা’আ’ গ্রন্থে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর এমন ধারাবাহিক কিছু খাসাইস তথা গুণগত বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন যা অনেক লোকের হুঁশ-আক্কল খাটো হওয়ার দরুন এসব নীতি ও মৌলভিত্তি অনুধাবন করতে তারা অপারগ। 

শাইখ (রহ.)-এর উল্লেখিত খাসাইসের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত:

فمنها قوله: والنجس منا طاهر منه ﷺ ومن سائر الأنبياء صلى الله عليهم وسلم، ويجوز أن يستشفى ببوله ودمه لما رواه الدارقطني أن أم أيمن شربت بوله، فقال: ((إذن لا تلج النار بطنك))، لكنه ضعيف، ولما رواه ابن حبان في الضعفاء (إن غلاماً حجم النبي ﷺ فلما فرغ من حجامته شرب دمه، فقال: ويحك ما صنعت بالدم؟ قال: غيبته في بطني، قال: ((اذهب فقد أحرزت نفسك من النار)). قال الحافظ ابن حجر: وكان السر في ذلك ما صنعه الملكان من غسلهما جوفه.

অর্থ: আমাদের সাধারণতঃ যা কিছু নাজাস্ তথা ময়লা/বর্জ্য (বলে বিবেচিত), তা তাঁর এবং অন্যান্য পয়গাম্বর (সাল্লাল্লাহু আলাইহিম ওয়া সাল্লাম)-বৃন্দের কাছ থেকে নির্গমন হলে তাহির তথা নির্মল। তাঁর (দ.) মূত্র ও রক্তের মধ্যস্থতায় আরোগ্য অন্বেষণ করা জায়েয, যা ইমাম আদ্ দারু কুতনী (রহ.)-এর বর্ণনার ভিত্তিতে এসেছে এ মর্মে যে, হযরত উম্মে আয়মান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) তাঁর প্রস্রাব পান করেছিলেন; অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে বলেন, “তোমার পেটকে (দোযখের) আগুন পোড়াবে না।” তবে এই বর্ণনাটি দুর্বল (যয়ীফ)। 

ইমাম ইবনে হিব্বান (রহ.) সূত্রেও তাঁর ‘দু’আফা’ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে, জনৈক ছেলে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পবিত্র শরীরে শিঙ্গা আস্ত্রোপচার (হাজামাত) করে। তা শেষ হলে (বের করা) রক্ত ছেলেটি পান করে নেয়। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি রক্তগুলো নিয়ে কী করেছো?” ছেলেটি উত্তর দেয়, “আমার পেটে গোপন করে রেখেছি।” হুজূর পূর নূর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “যাও, নিশ্চয় তুমি (দোযখের) আগুন থেকে নিজেকে রক্ষা করেছো।” 

হাফিয ইবনে হাজর (রহ.) এই ঘটনার ব্যাখ্যায় বলেন, “এর পেছনে রহস্য হলো প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর (দেহের) অভ্যন্তরভাগ দু জন ফেরেশতা গোসল দান করেছিলেন।” [বঙ্গানুবাদকের নোট: রক্ত পানকারী ছেলেটি সম্ভবতঃ হযরত মালিক ইবনে সিনান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু – যার রেফারেন্স পাওয়া যায় শাইখ দাউদ ইবনু সোলাইমান আল-বাগদাদী (রহ.) কৃত ‘আল-মিনহাতুল ওয়াহবীয়্যা ফীর্ রাদ্দিল ওয়াহহাবীয়্যাহ’ শিরোনামের পুস্তকে]

ফকীহ আল্লামা শাইখ মানসূর বিন ইঊনুস আল-বাহুতী (রহ.) তাঁর ’কাশশাফুল ক্বিনা’ঈ (كشاف القناع) গ্রন্থে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর খাসাইস্ তথা সত্তাগত গুণাবলীর মধ্যে আরেকটি গুণ সম্পর্কে বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন:

ولم يكن له ﷺ [فيء] أي ظل [في الشمس والقمر لأنه نوراني والظل نوع ظلمة]. ذكره ابن عقيل وغيره، ويشهد له أنه سأل الله أن يجعل في جميع أعضائه وجهاته نورًا وختم بقوله واجعلني نورًا، [وكانت الأرض تجتذب أثقاله] للأخبار. 

অর্থ: প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কোনো ছায়া সূর্য অথবা চাঁদের আলোতে পড়তো না, কেননা তিনি হচ্ছেন নূরানী/জ্যোতির্ময়, এবং ছায়া হচ্ছে এক প্রকারের অন্ধকার। এই বর্ণনাটি ইবনু আক্বীল এবং অন্যরা উল্লেখ করেছেন; আর এর সাক্ষ্য পাওয়া যায় অপর এক বর্ণনায়, যা’তে বিবৃত হয় এ মর্মে যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহতায়ালার দরবারে আরজ করেন তাঁর সমগ্র পবিত্র শরীর ও দিক মোবারককে যেনো একটি নূর বানিয়ে দেয়া হয়; এবং তিনি এ দোয়া সম্পন্ন করেন এই কথা বলে: “আর আমাকে নূর বানিয়ে দিন।” মাটি তাঁর মলকে নিজের অভ্যন্তরে টেনে নিতো – যেমনটি এসেছে বিভিন্ন খবরে।

শাইখ বাহুতী (রহ.) তাঁর উক্ত গ্রন্থে আরেকটি উদাহরণ বর্ণনা করেন:

المقام المحمود جلوسه ﷺ على العرش، وعن عبد الله بن سلام على الكرسي ذكرهما البغوي.

অর্থ: নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মাক্বামে মাহমূদ তথা প্রশংসিত উচ্চস্থান হচ্ছে তাঁরই দ্বারা আরশে (কুর্সিতে) উপবেশন। আবদুল্লাহ বিন সালাম (রহ.) হতে বর্ণিত হয়েছে যে তিনি কুর্সিতে বসবেন; আর এটা আল-বাগাভী (রহ.)-ও উল্লেখ করেছেন।

শাইখ বাহুতী (রহ.) আরো বলেন:

إنه كان لا يتثاءب.

অর্থ: রাসূলূল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কখনো হাই তুলতেন না।

শাইখ (রহ.) আরো বলেন:

وأنه عرض عليه الخلق من آدم إلى من بعده كما علم آدم أسماء كل شيء لحديث الديلمي: [مثلت لي الدنيا بالماء والطين فعلمت الأشياء كلها]، وعرض عليه أمته بأسرهم حتى رآهم لحديث الطبراني: [عرضت عليَّ أمتي البارحة لدى هذه الحجرة أولها وآخرها صوروا لي بالماء والطين حتى إني لأعرف بالإنسان منهم من أحدكم بصاحبه]، وعرض عليه أيضاً ما هو كائن في أمته حتى تقوم الساعة لحديث أحمد وغيره [أدريت ما تلقى أمتي بعدي وسفك بعضهم دماء بعض]. 

অর্থ: এবং হযরত আদম (আলাইহিস্ সালাম) হতে আরম্ভ করে শেষ পর্যন্ত সৃষ্টিকুলের সব কিছুকে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সামনে পেশ করা হয়, ঠিক যেমনটি আল্লাহতায়ালা পয়গাম্বর আদম (আলাইহিস্ সালাম)-কে সবকিছুর নাম শিক্ষা দিয়েছিলেন; আর এর ভিত্তি হচ্ছে ইমাম দায়লামী (রহ.) বর্ণিত হাদীস, যা’তে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘোষণা করেন, “দুনিয়াকে পানি ও মাটির মতো করে আমার কাছে পেশ করা হয় এবং আমি এর সবকিছু সম্পর্কে জানতে পারি।” তাঁর সামনে গোটা উম্মতকে দেখার জন্যে পেশ করা হয়, যেমনটি ইমাম তবারানী (রহ.) বর্ণিত হাদীসে বিবৃত হয়: “গত রাতে আমার হুজরাহ-কক্ষে আমার উম্মতের প্রথম হতে শেষজন পর্যন্ত সবাইকে আমারই সামনে পেশ করা হয়। তাদেরকে সুরতে আমার কাছে পানি ও মাটিরূপে এমনভাবে দৃশ্যমান করানো হয় যে, আমি তাদের মধ্যে প্রত্যেকের সম্পর্কে এতো বেশি জানি যা তোমরা তোমাদের সঙ্গী/সাথী কারো সম্পর্কেও জানো না।” উম্মতের ক্ষেত্রে শেষ সময় অবধি কী কী ঘটবে তা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে প্রদর্শন করা হয়েছিলো, যেমনটি ইমাম আহমদ (রহ.) ও অন্যান্যদের বর্ণিত হাদীসে বিবৃত হয়: “আমাকে জ্ঞাত করানো হয় আমার বেসাল শরীফের পরে উম্মতের ভাগ্যে যা যা ঘটবে; আর তোমাদের একে অপরের মধ্যকার হানাহানিজনিত রক্তপাত সম্পর্কেও আমাকে জানানো হয়।”

আরেকটি উদাহরণ হলো প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বাণী:

[وزيارة قبره مستحبة للرجال والنساء] لعموم ما روى الدارقطني عن ابن عمر قال: قال رسول الله ﷺ: [من حج وزار قبري بعد وفاتي فكأنما زارني في حياتي] اهــ (كشاف القناع ج ٥ ص ٣٠) 

অর্থ: (তাঁর রওযা মোবারক যিয়ারত প্রত্যেক মুসলমান নর ও নারীর জন্যে মুস্তাহাব বা প্রশংসনীয় কাজ), যা ইমাম আদ্ দারু কুতনী (রহ.) কর্তৃক হযরত ইবনে উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে গৃহীত বর্ণনার ভিত্তিতে আ’ম/সার্বিক হয়েছে; তাতে হযরত ইবনে উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আমার বেসালের পরে হজ্জ্ব করলো এবং আমার রওযা পাক যিয়ারত করলো, সে যেনো আমার (প্রকাশ্য দুনিয়াবী) হায়াতেই আমার সাক্ষাৎ লাভ করলো।” [কাশশাফুল কিনা’ঈ, ৫/৩০; মহাভ্রান্ত সৌদি ওহাবী রাজা ফায়সাল ইবনে আবদিল আযীযের আদেশে প্রকাশিত]

فهذه الخصائص التي ذكروها ونقلوها منها ما هو صحيح ومنها ما هو ضعيف ومنها ما لادليل له أصلا.

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর এসব খাসা‘ইস্ তথা অনন্য গুণগত বৈশিষ্ট্য যা ইবনে কাইয়্যেম জাওযিয়্যা তাঁর উপরোক্ত গ্রন্থে উল্লেখ ও উদ্ধৃত করেছেন, তার কিছু কিছু সহীহ, কিছু কিছু যয়ীফ/দুর্বল, আবার কিছু কিছু একেবারেই দলিলবিহীন।

فلا أدري ماذا يقول المعترض في هذه الخصائص التي نقلها كبار الأئمة من أهل السنة ولم يعترضوا عليها بشيء وسلموها وتسامحوا في نقلها اعتمادًا على قاعدة التسامح في نقل الفضائل مع أن في هذه الخصائص من الأقوال ما لو سمعه المعترض أو المنكر لحكم على قائله بما هو أعظم من الكفر وأين ما نقلناه بجانب من قال: إن سيدنا محمدًا ﷺ يجلسه الله يوم القيامة على عرشه كما نقله الإمام الشيخ ابن القيم عن كبار أئمة السلف في كتابه المعروف [بدائع الفوائد] بلا برهان ولا دليل صحيح من كتاب ولا سنة، وأين ما نقلناه من الخصائص بجانب ما جاء في كشاف القناع من أن النبي نور وأنه لا ظل له وأن ما يخرج منه من الغائط تبتلعه الأرض فلا يبقى شيء منه على وجه الأرض، وأين ما نقلناه من الخصائص بجانب ما نقله الشيخ ابن تيمية من الخصائص كقوله: إن اسمه ﷺ مكتوب على ساق العرش وعلى أوراق الجنة وأشجارها وأبوابها وثمارها وقبابها، فأين المعلقون والمحققون كيف فاتت عليهم هذه المسائل دون نقد وتمحيص.  

অতঃপর আমি (লেখক শাইখ আলূভী মালিকী হাসানী) জানি না প্রতিপক্ষ কী বলবে এসব খাসাইস তথা গুণগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যা আহলে সুন্নাতের বড় বড় ইমামবৃন্দ বর্ণনা করেছেন – যাঁরা এগুলোর বিরোধিতা তো করেনই নি, বরঞ্চ নক্বল/উদ্ধৃত করেছেন এবং বর্ণনা করার সময় উদার হয়েছেন ফযীলত তথা পুণ্যদায়ক কর্ম বর্ণনায় উদারতার নীতি গ্রহণের ভিত্তিতেই। এটা এ বাস্তবতা সত্ত্বেও যে এসব বিশেষ গুণ বর্ণনার মধ্যে এমনও কিছু আছে যা প্রতিপক্ষ বা অস্বীকারকারী যদি তা শুনতে পেতো, তবে তারা এর উচ্চারণকারীর প্রতি কুফর/অবিশ্বাসের চেয়েও বড় কিছু দ্বারা ফতোয়া আরোপ করতো। আমরা এখানে যা উদ্ধৃত করেছি তা কিয়ামত দিবসে আমাদের প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর পাশে আরশে উপবিষ্ট হবেন মর্মে বাণীর সাথে কীভাবে তুলনীয় হতে পারে, ঠিক যেমনটি সালাফ আস্ সালেহীনের মধ্যে বড় বড় ইমাম (রহ.) হতে উদ্ধৃত করেছেন শাইখ ইবনুল কাইয়্যেম আল-জাওযিয়্যাহ তাঁরই ‘বাদাঈউল্ ফাওয়াইদ’ গ্রন্থে, যা’তে কুর’আন অথবা সুন্নাহর কোনো সহীহ/বিশুদ্ধ দালিলিক প্রমাণ বিদ্যমান নেই? আমাদের উদ্ধৃত গুণগত বৈশিষ্ট্যসমূহ কীভাবে ‘কাশশাফুল কিনাঈ’ গ্রন্থে উদ্ধৃত খাসাইসের সাথে তুলনীয় হতে পারে, যেখানে বিবৃত হয়েছে যে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নূর/জ্যোতি এবং তাঁর কোনো ছায়া নেই, আর তাঁর মল জমিন এমনভাবে গ্রাস করে নেয় যার দরুন উপরিভাগে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না? আমাদের উদ্ধৃত যাবতীয় খাসাইস কীভাবে ইবনু তাইমিয়া কর্তৃক উদ্ধৃত সেসব গুণগত বৈশিষ্ট্যের সাথে তুলনীয় হতে পারে, যার একটিতে তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নাম মোবারক আরশের স্তম্ভে এবং জান্নাতের যাবতীয় বৃক্ষপল্লবে ও বৃক্ষে, দ্বারে, ফল-ফলাদিতে এবং গুম্বজে লিপিবদ্ধ আছে?” এমতাবস্থায় ওই সব (তথাকথিত) ভাষ্যকার ও গবেষকরা কোথায়, যাদেরকে এ বিষয়গুলো ফাঁকি দিয়েছে এমনিভাবে যার দরুন তারা সমালোচনা ও সম্পাদনা করতে (বেমা’লূম) ভুলে গিয়েছে?

বেহেশত যদি মায়ের পদতলে হতে পারে, তাহলে বেহেশত কেন মহানবী (দ:)-এর আজ্ঞাধীন হবে না? (الجنة تحت أقدام الأمهات فكيف لا تكون تحت أمر النبي ﷺ؟)

প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর খাসাইস্ তথা অনন্য গুণগত বৈশিষ্ট্যাবলী যা নিয়ে আলেম-উলামা গবেষণা করেছেন, তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এই বর্ণনা যে তিনি (দ.) বেহেশতের ভূমি বিলি-বণ্টন করবেন। এই অনন্য গুণটি সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন হাফিয ও ইমাম জালালউদ্দীন সৈয়ূতী, ইমাম শিহাবউদ্দীন আহমদ কসতলানী ও ইমাম যুরক্বানী মালিকী (রহমতুল্লাহি আলাইহিম) তাঁরই শরহে মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া গ্রন্থে। এ কথাও সর্বজনবিদিত যে এই বিলি-বণ্টন স্রেফ সেসব হক্বদার মানুষের জন্যেই হবে, যাঁরা তাওহীদ (ও রিসালাত)-পন্থী এবং যা (নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি) ওহী/ঐশীবাণী, অথবা ইলহাম/ঐশী প্রত্যাদেশ কিংবা (তাঁর সাথে) সুসম্পর্কের সূত্রে আল্লাহরই অনুমতিতে হবে। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর একটা হাদীসে এর প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে:

إنما أنا قاسم والله معطي.

অর্থ: নিশ্চয় আমি হলাম বণ্টনকারী, আর আল্লাহতায়ালা দাতা। (সহীহ)

যদি মায়েদের পদতলে বেহেশত্ বলাটা সঠিক/সহীহ হয়, তাহলে তা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আজ্ঞার অধীনস্থ, বরঞ্চ পদতলে অবস্থিত বলা সঠিক হবে না কেন? এর মানে তো একই; (কেননা) জ্ঞানের সবচেয়ে কাঁচা শিক্ষানবীশেরও জানা আছে যে এটা মাজাযী/রূপকার্থে এক অভিব্যক্তি এ মর্মে যে, বেহেশতে পৌঁছুনোর মাধ্যম হলো আপন পিতা-মাতার প্রতি, বিশেষ করে মায়ের প্রতি দয়া-মায়াপূর্ণ ও যত্নশীল আচরণ এবং তাঁদের খেদমত করা। প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বেলায় এর মানে হলো, তাঁর প্রতি মান্যতা ও প্রেম-ভক্তি এবং আনুগত্য। তাঁর এই অনন্য গুণগত বৈশিষ্ট্যের অনেক নজির বা উদাহরণ রয়েছে যা এর সহীহ/সঠিক হওয়ার পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করে। আমরা এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণগুলো নিচে আলোচনা করবো।

প্রিয়নবী (ﷺ) কর্তৃক বেহেশতের গ্যারান্টী প্রদান

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক কয়েকজনকে বেহেশতের গ্যারান্টী প্রদান তাঁর দ্বারা বেহেশতের (ভূমি) বণ্টনের মতোই একটি বিষয়। এই গ্যারান্টী/নিশ্চয়তা প্রদান সেসব মানুষের সাথে ঘটেছিলো, যাঁরা আল-আ’কাবা স্থানে আনুগত্যের শপথ নিয়েছিলেন। হযরত উবাদাহ ইবনুল সা’মিত (রা.) হতে বর্ণিত যে তিনি বলেন:

كنت ممن حضر العقبة الأولى وفيه فبايعنا رسول الله ﷺ على أن لا نشرك بالله شيئاً ولا نسرق ولا نزني ولا نقتل أولادنا ولا نأتي ببهتان عظيم نفتريه بين أيدينا وأرجلنا ولا نعصيه في معروف، قال: فإن وفيتم فلكم الجنة وإن غشيتم من ذلك شيئاً فأمركم إلى الله إن شاء عذب وإن شاء غفر. 

অর্থ: আমি সে সকল মানুষের একজন, যাঁরা প্রথম আ’কাবা স্থলে উপস্থিত ছিলাম এবং আমরা তাতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে আনুগত্যের অঙ্গীকার করি এই শর্তে যে, আমরা আল্লাহর সাথে শরীক করবো না, চুরি করবো না, যিনা/ব্যভিচার করবো না, আমাদের আওলাদ/সন্তানদের হত্যা করবো না, আর আমরা কোনো মহা কুৎসা/মিথ্যে অপবাদ নিয়ে আসবো না আমাদের সামনে অথবা আড়াল থেকে, এবং আমরা ভালো কোনো কিছুতে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অবাধ্য হবো না। অতঃপর প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “অতএব, যদি তোমরা এ অঙ্গীকার পুরো করো, তাহলে তোমাদের জন্যে জান্নাত (বরাদ্দ)। কিন্তু যদি তা হতে কোনো কিছু পুরো না করো, তবে তোমাদের বিষয়ের ফায়সালা আল্লাহর কাছে থাকবে। তিনি চাইলে তোমাদের শাস্তি দিতে পারেন, আবার ক্ষমাও করতে পারেন।”

ذكره ابن كثير في باب بدء إسلام الأنصار (السيرة ج٢ ص١٧٦).

এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন ইবনে কাসীর তাঁর ‘আল-সীরাত’ (২/১৮৬) গ্রন্থের ‘আনসার সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-এর ইসলাম গ্রহণের সূচনা’ শীর্ষক অধ্যায়ে।

সহীহ বুখারী হাদীসগ্রন্থে স্পষ্টভাবে বিবৃত হয়েছে যে (আ’কাবা স্থানে) আনুগত্যের এই বাই’আত তথা শপথ গ্রহণ বেহেশতে প্রবেশের শর্তানুসারে হয়েছিলো। হযরত উবাদাহ ইবনে সামিত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন: 

إني من النقباء الذين بايعوا رسول آلله صلى آلله عليه وسلم.

অর্থ: “আমি ওই প্রতিনিধিদলে ছিলাম যাঁরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে আনুগত্যের বাই’আত গ্রহণ করেছিলাম।”

হযরত উবাদাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) আরো বলেন:

بايعناه على أن لا نشرك بالله شيئاً ولا نسرق ولا نزني ولا نقتل النفس التي حرم الله إلا بالحق ولا ننهب بالجنة إن فعلنا ذلك. 

অর্থ: “প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে আমরা আনুগত্যের বাই’আত গ্রহণ করেছিলাম এ শর্তে যে আমরা আল্লাহর সাথে শরীক করবো না, চুরি করবো না, যিনা/ব্যভিচার করবো না, কিংবা আল্লাহতায়ালার নিষেধকৃত মানবহত্যা করবো না, ব্যতিক্রম শুধু সত্যের খাতিরে হবে; আর এ শপথ পূরণের প্রতিদান হবে আমাদের জান্নাতে প্রবেশ।” 

এই বর্ণনাটি আল-বুখারী গ্রন্থে ‘আনসার সাহাবাবৃন্দের (রা.) গুণাবলী’ শীর্ষক কিতাবের ‘আল-আ’কাবা স্থানের বাই’আত’ পরিচ্ছেদে উদ্ধৃত হয়েছে। আরেকটি বর্ণনায় এসেছে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:

فمن وفى فله الجنة.

অর্থ: অতঃপর যে ব্যক্তি এ অঙ্গীকার পূরণ করবে, তার জন্যে জান্নাত (বরাদ্দ)। [আল-বিদায়াহ, ৩/১৫০]

হযরত কাতাদাহ (রা.) হতে বর্ণিত যে তাঁরা (অঙ্গীকারকারীবৃন্দ) বলেছিলেন:

يا رسول آلله! فما لنا بذلك إن وفينا؟ قال: الجنة اهـ. 

অর্থ: “হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমরা এ অঙ্গীকার পূরণ করলে কী পাবো?” তিনি (ﷺ) উত্তরে বলেন, “জান্নাত।” [প্রাগুক্ত আল-বিদায়াহ, ৩/১৬২]

হযরত ইবনু মাস’উদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত যে নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:

((فإذا فعلتم ذلك فلكم على آلله الجنة وعليّ))..

অর্থ: তোমরা এ অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করলে আল্লাহ হবেন তোমাদের জান্নাত মঞ্জুরের জিম্মাদার এবং আমিও হবো। [ইমাম তবরানী (রহ.) বর্ণিত; আরো দেখুন ‘কানযুল উম্মাল,’ ১/৬৩ এবং ‘মজমুআ আয্ যাওয়াইদ,’ ৬/৪৭]

হযরত উতবাহ ইবনু ’আমর আনসারী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত যে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:

((فإذا فعلتم ذلك فلكم على آلله الجنة وعليّ))..

অর্থ: তোমরা এ অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করলে আল্লাহ হবেন তোমাদের জান্নাত মঞ্জুরের জিম্মাদার এবং আমিও হবো। [ইমাম ইবনু আবী শায়বাহ (রহ.) ও ইবনু আসাকির (রহ.) বর্ণিত; আরো দেখুন কানযুল উম্মাল, ১/৬৭]

((إن رسول الله ﷺ أعطاه نعليه، فقال له: اذهب فمن لقيت وراء هذا الحائط يشهد أن لا إله إلا الله فبشره بالجنة))..

অর্থ: হযরত আবূ হুরায়রাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত যে তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে আপন চপ্পলজোড়া দিয়ে বলেন, “যাও, আর এ দেয়ালের ওপাশে যে কোনো ব্যক্তিকে যদি সাক্ষ্য দিতে পাও যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য প্রভু নেই, তবে তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দান কোরো।” [ইমাম মুসলিম (রহ.) কর্তৃক ‘কিতাবুল ঈমান’ গ্রন্থে বর্ণিত] 

বেহেশতে প্রবেশের জন্যে সম্পত্তি-দলিল তাঁরই (দ.) হাতে ন্যস্ত

হযরত ইবনু আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:

((قـال رسول الله ﷺ: يوضع للأنبياء منابر من نور يجلسون عليها ويبقى منبري لا أجلس عليـه، أو قال: لا أقعد عليـه، قائمـاً بين يدي رب مخافة أن يبعث بي إلى الجنة وتبقى أمتي بعد، فأقول: يا رب! أمتي أمتي، فيقول الله عز وجل: يا محمد! ما تريد أن أصنع بأمتك؟ فأقـول: يا رب عجل حسابهم، فيدعى بهم فيحاسبون، فمنهم من يدخل الجنة برحمته، ومنهم من يدخل الجنة بشفاعتي، فما أزال أشفع حتى أعطى صكاكاً برجال قد بعث بهم إلى النار حتى إن مالكاً خازن النار ليقول: يا محمد! ما تركت لغضب ربك في أمتك من نقمة))..

رواه الطبراني في الكبير والأوسط والبيهقي في البعث. قال المنذري: وليس في رواته متروك.

অর্থ: “আম্বিয়া কেরাম (আলাইহিমুস্ সালাম)-বৃন্দের নূরের তৈরি মিম্বরসমূহ থাকবে যেগুলোর ওপর তাঁরা বসবেন। আমার মিম্বরটি আমি তাতে উপবিষ্ট হওয়া থেকে খালি পড়ে রইবে।” অথবা তিনি (দ.) বলেন, “আমি তাতে বসবো না; (বরঞ্চ) আমার প্রভুর সামনে দণ্ডায়মান থাকবো এই আশঙ্কায় যে (পাছে) আমাকে বেহেশতে প্রেরণ করা হবে অথচ আমার উম্মত পেছনে পড়ে রইবে। অতঃপর আমি আরজ করবো, ‘হে প্রভু! আমার উম্মত, আমার উম্মত!’ আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লা তখন বলবেন, ‘হে মুহাম্মদ (ﷺ), আপনার উম্মতের ব্যাপারে আপনি আমাকে কী করতে বলেন?’ আমি বলবো, ‘হে প্রভু! তাদের হিসেব ত্বরান্বিত করুন।’ অতঃপর তাদের ডাকা হবে এবং হিসেব নেয়া হবে। তাদের মধ্যে থাকবে সেসব ব্যক্তি যারা আল্লাহর রহমতে জান্নাতে প্রবেশ করবে; এবং থাকবে আরো কিছু মানুষ যারা আমার শাফা’আত/সুপারিশ দ্বারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। আমি শাফা’আত করা থেকে বিরত হবো না এমনই পর্যায়ে যে, আমি জাহান্নামের দিকে প্রেরিত পুরুষদেরকে (বেহেশতের সম্পত্তির) দলিল প্রদান করতে থাকবো, যার দরুন জাহান্নামের প্রহরী ফেরেশতা বলবেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আপনি আপনার উম্মতের জন্যে আপনারই প্রভুর গযব/রোষনিঃসৃত শাস্তি আর অবশিষ্ট রাখলেন না’।” 

এ হাদীসটি ইমাম তবরানী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) ‘আল-কবীর’ ও ‘আল-আওসাত’ গ্রন্থ দুটোতে বর্ণনা করেছেন; এর পাশাপাশি বর্ণনা আরো করেছেন আল-বায়হাকী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) ‘আল-বা’আস্’ পুস্তকে। আল-মুনযিরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) বলেন, “এ বর্ণনায় এমন কোনো বর্ণনাকারী নেই যিনি মাতরূক/প্রত্যাখ্যাত।”

প্রিয়নবী (ﷺ) জান্নাত দান করেন

হযরত জাবির (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে এক বর্ণনায় এসেছে যে তিনি নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে প্রশ্ন করেছিলেন:

فقلنا فعلام نبايعك؟

অর্থ: আমাদের আনুগত্যের বাই’আত আমরা কিসের ভিত্তিতে দেবো?

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উত্তরে বলেন:

((على السمع والطاعة في النشاط والكسل وعلى النفقة في العسر وعلى الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر ولكم الجنة)).. الحديث.

অর্থ: (শারীরিক) কর্মশক্তি ও মন্থরতা উভয় সময়েই শ্রবণ ও মান্যকরণ, (আর্থিক) কষ্টের সময়েও (আল্লাহর রাস্তায়) ব্যয় এবং উত্তম কাজে আদেশ দান ও মন্দ কাজে নিষেধকরণের (ওপর হবে এ বাই’আত)। আর এর প্রতিদান হবে তোমাদের জন্যে বেহেশত। [আল-হাদীস]

হাফেয ইবনে হাজর আসকালানী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) বলেন:

ولأحمد من وجه آخر عن جابر قال: كان العباس آخذاً بيد رسول الله ﷺ فلما فرغنا قال رسول الله ﷺ: ((أخذت وأعطيت)).. اهــ (فتح الباري ج٧ ص٢٢)، رواه أحمد [مجمع الزوائد ج٦ ص٤٨] أي أخذت البيعة وأعطيت الجنة.

অর্থ: ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহমতুল্লাহি আলাইহি) আরেকটি সূত্রে হযরত জাবির (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেছেন, যা’তে হযরত জাবির (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেছেন: হযরত আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাত মোবারক ধরেছিলেন এবং আমাদের (বাই’আতের) কাজ শেষ হলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “আমি (তাদের কাছ থেকে আনুগত্যের বাই’আত) নিয়েছি এবং (তাদেরকে জান্নাত) দান করেছি।” [ফাতহুল বারী, ৭/২২৩; ইমাম আহমদ হাম্বল (রহ.) বর্ণিত (মজমা’ আয্ যওয়াঈদ, ৬/৪৮)]

قلت: وقد جاء في رواية أخرى التصريح بما هو أبلغ من ذلك قال جابر: إن النبي ﷺ قال لهم: تبايعوني على السمع والطاعة إلى أن قال: ولكم الجنة، قال: فقالوا: وآلله لا ندع هذه البيعة أبداً ولا نسلبها أبداً فبايعناه فأخذ علينا وشرط ويعطينا على ذلك الجنة. قال الهيثمي روى أصحاب السنن طرفاً منه، رواه أحمد والبزار، ورجال أحمد رجال الصحيح اهـ. (مجمع الزوائد ج٦ ص٤٦). 

অর্থ: আমি (শাইখ মুহাম্মদ আলূভী হাসানী) বলি, আরেকটি বর্ণনায় আরো স্পষ্ট ও জোরালোভাবে বিষয়টি এসেছে, যা’তে হযরত জাবির (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, “প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁদেরকে বলেছিলেন, ‘আমার প্রতি আনুগত্যের বাই’আত গ্রহণ করো শ্রবণ ও মান্যকরণের শর্তে…।’ এ বক্তব্যের শেষে তিনি (দ.) বলেন, ‘এবং জান্নাত তোমাদেরই জন্যে (বরাদ্দ)।’ হযরত জাবির (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন, “তাঁরা (সবাই) বলেন, ‘আল্লাহর নামে শপথ! আমরা এ আনুগত্যের বাই’আত কখনোই পরিত্যাগ করবো না এবং এর থেকে বিচ্যুতও হবো না।’ অতঃপর আমরা তাঁর (দ.) প্রতি আনুগত্যের বাই’আত নেই এবং তিনি আমাদের প্রতি (বিভিন্ন) বিধিবিধান ও শর্তারোপ করেন যার প্রতিদানস্বরূপ তিনি আমাদের জান্নাত মঞ্জুর করেন।” ইমাম ইবনে হাজর হায়সামী মক্কী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) বলেন, “সুনান গ্রন্থসমূহের লেখকবৃন্দ এর অংশবিশেষ বর্ণনা করেছেন। এটা সর্ব-ইমাম আহমদ বিন হাম্বল ও আল-বাযযার (রহমতুল্লাহি আলাইহিমা) বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমদ (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-এর সূত্রের বর্ণনাকারীবৃন্দ সহীহ। [মজমা’ আয্ যওয়াঈদ, ৬/৪৬]       

নবী করীম (ﷺ) বেহেশত বিক্রি করেন এবং হযরত উসমান (রা.) তা কেনেন

عن أبي هريرة رضي الله عنه قال: اشترى عثمان الجنة من النبي صلى الله عليه وسلم مرتين بيع الحق حيث حفر بئر معونة وحيث جهز جيش العسرة. رواه الحاكم في مستدركه (ج٣ ص١٠٧) وصححه.

অর্থ: হযরত আবূ হুরায়রাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত যে তিনি বলেন, “হযরত উসমান বিন আফফান যিন্নূরাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে দু বার বেহেশত খরিদ করেন। একবার যখন তিনি হক্ক সোবহানাহু ওয়া তায়ালার সাথে লেনদেনকালে আল-মাউনাহ কূপ খনন করেছিলেন; আর আরেকবার যখন তিনি মুসলমান সেনাবাহিনীর কঠিন সময়ে তাঁদেরকে সুসজ্জিত করেছিলেন।” এটা বর্ণনা করেছেন আল-হাকিম নিজ ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থে (৩/১০৭), এবং তিনি এটাকে সহীহ বলেছেন।

প্রত্যেক বুদ্ধিমান ব্যক্তিই জানেন যে বেহেশত আল্লাহ সোবহানাহু ওয়া তায়ালার অধিকারে রয়েছে এবং কেউই তার মালিক বা বণ্টনকারী নন – চাই তিনি হোন উচ্চমর্যাদাবান বা উচ্চস্তরধারী ফেরেশতা অথবা নবী কিংবা রাসূল। কিন্তু আল্লাহ তাঁর রাসূল (আলাইহিমুস্ সালাম)-বৃন্দের প্রতি খোদায়ী দান/উপহার মঞ্জুর করে থাকেন যা দ্বারা তাঁরা অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হন। এটা তাঁর মহান দরবারে তাঁদের মাহাত্ম্য ও উচ্চ মকামের কারণেই। এরই ভিত্তিতে এসব (ঐশী) দান তাঁদের প্রতি আরোপিত হয় এবং এ বাচনভঙ্গি তাঁদের প্রতি ব্যবহৃত হয় তাঁদেরকে সম্মান প্রদর্শনার্থে, তাঁদের প্রতি প্রশংসা ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন এবং তাঁদেরকে অগ্রাধিকার প্রদানের খাতিরে। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর খাসাইস তথা অনন্য বৈশিষ্ট্যাবলী বর্ণিত হয়েছে এ মর্মে যে তিনি বেহেশতী জমি বণ্টন করেন, জান্নাতের নিশ্চয়তা দেন, বেহেশত বিক্রি করেন, এবং বেহেশতের সুসংবাদ দেন, যদিও বেহেশত আল্লাহ সোবহানাহু ওয়া তায়ালার অধিকারে রয়েছে; আর কেউই এতে সন্দেহ করেন না কেবল ওই অজ্ঞ লোক ছাড়া, যে ইলমী মাস’আলার ক্ষেত্রে ন্যূনতম জ্ঞানও রাখে না। 

اللهم نور بصائرنا وافتح مسامع قلوبنا وأرنا الحق حقاً وارزقنا اتباعه.

ইয়া আল্লাহ, আপনি আমাদের অন্তর্চক্ষুকে উন্মীলিত করুন, অন্তরকে শ্রবণের সামর্থ্য দিন, এবং সত্যকে সত্য হিসেবে প্রদর্শন করুন, আর তাকে ইত্তেবা’ তথা মান্য করার বা অনুসরণের সামর্থ্য দান করুন, আমীন।

[বঙ্গানুবাদকের নোট: মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওয়াদা ধ্রুব সত্য। এই সত্যও খোদাপ্রদত্ত। তাই ঈমানদার মুসলমানবৃন্দের তা ইত্তেবা’ করা জরুরি] 

মীলাদুন্নবী (ﷺ)-এর রাত সবচেয়ে ফযীলতপূর্ণ কথাটির উদ্দেশ্য কী?

উলামাবৃন্দের অনেকে উল্লেখ করেছেন যে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর খাসাইস তথা অনন্য স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের মধ্যে তাঁর মীলাদের (মানে ধরাধামে শুভাগমনের) রাতটি শবে কদরের রাতের চেয়ে আফযাল বা শ্রেষ্ঠ। এই বিষয়ে দুটি রাতের মধ্যে তুলনাগুলোর সংকলন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা উল্লেখ করতে আগ্রহী যে মীলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আসল রাতটিই এখানে উদ্দেশ্যকৃত, যা শত শত (মানে চৌদ্দ শ) বছর আগে অতিক্রান্ত হয়েছে। আর নিঃসন্দেহে এটা শবে কদর পরিচিত বা প্রকাশ হওয়ার বহু আগে ঘটেছিলো। এখানে তাঁর মীলাদ বার্ষিকীর রাতটি উদ্দেশ্যকৃত নয় যা তাঁরই আসল মীলাদ দিবসের সাথে সঙ্গতি রেখে প্রতি বছর ধারাবাহিকভাবে উদযাপিত হয়। এ বিষয়ে সত্যটি হলো, এ সম্পর্কিত গবেষণায় তেমন কোনো ফায়দা নেই। এর প্রতি অস্বীকৃতি বা সত্যায়নের সাথে কোনো ক্ষতি বা বিপদ জড়িত নেই। (কেননা) এর কোনোটাই মৌলিক আকীদাহ-বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। 

আলেম-উলামা সবচেয়ে ক্ষুদ্র বিষয়াদিতেও গবেষণা চালিয়েছেন এবং বিশেষায়িত বইপত্র লিখেছেন, যা এ বিষয়ক গবেষণার সাথে তুলনা করার সমকক্ষ কোনো কিছু নয়। সংক্ষেপে বলবো, আমরা বিশ্বাস করি যে গবেষক উলামাবৃন্দের এই পছন্দ আসল মীলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রাত ও শবে কদরের রাতের মধ্যেই (সীমাবদ্ধ)। আর ওই রাতটি তাঁর বেলাদত তথা ধরাধামে শুভাগমনের রাত, যার শ্রেষ্ঠত্ব গবেষণালব্ধ হওয়ার পর ইতোমধ্যে অতিক্রান্ত হয়েছে এবং এখন আর অস্তিত্বশীল নেই। কিন্তু শবে কদরের রাতটি বার্ষিকী হিসেবে অস্তিত্বশীল এবং এ কারণেই তা সেরা রজনী স্বয়ং আল্লাহতায়ালার পাক কালামের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত:

إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ ٱلْقَدْرِ (١) وَمَآ أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ ٱلْقَدْرِ (٢) لَيْلَةُ ٱلْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍ (٣).

অর্থ: নিশ্চয় আমি সেটা ক্বদরের রাতে অবতীর্ণ করেছি; এবং আপনি কি জানেন ক্বদর-রাত্রি কী? ক্বদরের রাত হাজার মাস থেকে উত্তম। [সূরাহ ক্বদর, ১-৩ আয়াত; নূরুল ইরফান]

এই বিষয়ে ও অন্যান্য বিষয়ে গবেষণা ধর্মীয় জ্ঞানী ইমামবৃন্দের দ্বারা পরিচালিত হয়েছে এবং সালাফ আস্ সালেহীন (প্রাথমিক যুগের পুণ্যাত্মা)-বৃন্দের মধ্যে শ্রেষ্ঠজনদের দ্বারাও আলোচিত হয়েছে। ইবনে তাইমিয়ার কথাই ধরুন, যিনি ক্বদরের রাত ও মে’রাজের রাতের মধ্যকার শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে কথা বলেছেন। তিনি নির্ভুলভাবে ও দক্ষতার সাথে এ বিষয়ে গবেষণা পরিচালনা করেছেন, যদিও তাঁর আগে সালাফ আস্ সালেহীন ইমামমণ্ডলীর মধ্যে অথবা মুসলিম প্রথম প্রজন্মের কেউই এমনভাবে এ বিষয়ে গবেষণা পরিচালনা করেছেন বা আলোচনা করেছেন কি-না তা প্রতিষ্ঠিত নয়; প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবা (রা.)-মণ্ডলী হতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা তো বাদই দেয়া গেলো। [বঙ্গানুবাদকের নোট: ওপরে বার্ষিক মীলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রাত সম্পর্কে শাইখ মুহাম্মদ আলূভী মালিকী হাসানী (রহ.) যা লিখেছেন, তা তাঁর নিজস্ব গবেষণা। এ বিষয়ে সুন্নী ইমাম ও আলেম-উলামার মাঝে মতপার্থক্য বিদ্যমান, যা আমার অনূদিত ‘ঈদে মীলাদুন্নবী (ﷺ)-এর প্রামাণ্য দলিল’ শীর্ষক গ্রন্থে ফুটে ওঠেছে {৪৪-৪৬ পৃষ্ঠায় ইমাম কসতলানী (রহ.)-এর আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া গ্রন্থের উদ্ধৃতিটি দেখুন – পিডিএফ: ঈদে মীলাদুন্নবীর প্রামাণ্য দলিল .pdf}]।

فتوى ابن تيمية في الموضوع

ইবনে তাইমিয়ার এতদসংক্রান্ত ফতোয়া 

ইবনে কাইয়্যেম আল-জাওযিয়্যাহ বলেন, “ইবনে তাইমিয়াকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো এমন এক ব্যক্তি সম্পর্কে যিনি বলেছিলেন:

ليلة الإسراء أفضل من ليلة القدر، 

অর্থাৎ, “শবে ক্বদরের রাতের চেয়ে শবে মে’রাজের রাতটি আফজাল/শ্রেষ্ঠ।”

অথচ অপর এক ব্যক্তি দাবি করেছিলেন:

بل ليلة القدر أفضل،

অর্থাৎ, “(না), বরঞ্চ শবে ক্বদরই শ্রেষ্ঠ।” 

এমতাবস্থায় – فأيهما مصيب؟ – এই দুইয়ের (বক্তব্যের) মাঝে কোনটা সঠিক? 

ইবনে তাইমিয়া উত্তর দেন:

الحمد الله، أما القائل بأن ليلة الإسراء أفضل من ليلة القدر فإن أراد به أن تكون الليلة التي أسري فيها بالنبي ﷺ ونظائرها من كل عام أفضل لأمة محمد ﷺ من ليلة القدر بحيث يكون قيامها والدعاء فيها أفضل منه في ليلة القدر فهذا باطل لم يقله أحد من المسلمين وهو معلوم الفساد بالإطراد من دين الإسلام، وإن أراد الليلة المعينة التي أسري فيها النبي ﷺ وحصل له فيها ما لم يحصل له في غيرها من غير أن يشرع تخصيصها بقيام ولا عبادة فهذا صحيح. (انظر مقدمة زاد المعاد لابن القيم).

অর্থ: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই প্রাপ্য। যে ব্যক্তি বলেছেন মে’রাজ রাত্রি শবে ক্বদরের রাত্রি অপেক্ষা শ্রেয়, তিনি যদি বুঝিয়ে থাকেন প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ঊর্ধ্বগমনের সেই আসল রাতটি এবং এর পাশাপাশি প্রতি বছর একই তারিখে (প্রত্যাবর্তনকারী) রাতগুলো উম্মতে মুহাম্মদী (ﷺ)-এর জন্যে ইবাদত ও দুআ’র ক্ষেত্রে শবে ক্বদরের রাতের (নামায ও দুআ’র) চেয়েও শ্রেষ্ঠতর, তাহলে এটা বাতিল/মিথ্যে এবং মুসলমান সমাজে কেউই এ কথা দাবি করেননি। এটা সর্বজ্ঞাত যে এ কথা মিথ্যে এবং এটা ইসলাম-বহির্ভূতও। পক্ষান্তরে, যদি তিনি এ কথার দ্বারা ওই বিশেষ মে’রাজের রাতটিকে বুঝিয়ে থাকেন এবং এও উদ্দেশ্য করে থাকেন যে ওই রাতে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এমন কিছু হাসিল করেছিলেন যা অন্যান্য রাতে হাসিল করেননি, আর যদি তিনি নামায ও দুআ’র বেলায় এ রাতকে খাস্ তথা বিশেষ বলে শরঈ বিধান ধার্য না করে থাকেন, তাহলে এটা সহীহ/সঠিক। [ইবনুল ক্বাইয়্যেম জাওযিয়্যার রচিত ‘যাদুল মা’আদ’ গ্রন্থের ভূমিকা দেখুন]

[বঙ্গানুবাদকের জরুরি জ্ঞাতব্য: আমরা সুন্নী মুসলমান সমাজ মীলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রাতকে নামায ও দুআ’র রাত বিবেচনায় ফযীলতপূর্ণ রাতগুলোর সাথে তুলনা করি না; বরং বিশ্বাস করি এটা তাঁর (দ.) ধরাধামে শুভাগমনের রাত বলে অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত অতুলনীয় একটি রাত! এ শুভক্ষণ না হলে ধর্মের কিছুই পেতাম না আমরা! অতএব, এ রাতটি তাঁরই (দ.) যিকর-তাযকিরার রাত। সূরাহ এনশেরাহ ৪ নং আয়াতে ঘোষিত হয়েছে – وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ – হে রাসূল (দ.), আপনারই খাতিরে আপনার যিকরকে আমি (খোদা) সমুন্নত করেছি [আল-কুর’আন (সরাসরি অনুবাদ)]। তাই আমাদের কৃত এ যিকর-তাযকিরাহ খোদায়ী আজ্ঞানুগ। আল্লাহ প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যিকর সমুন্নত করেছেন, আর আমরা এ যিকর জারি রেখে আল্লাহরই চূড়ান্ত ইচ্ছার বাস্তবায়নে সামিল হচ্ছি মাত্র]।

 *সংশোধনীয় ভ্রান্ত ধারণাসমূহ (পর্ব – ১৬০)*

মূল: শায়খ সাইয়্যেদ মুহাম্মদ আলূভী মালেকী আল-হাসানী (রহ:)

অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

[Bengali translation of Shaykh Muhammad Alawi Maliki al-Hasani’s book “Notions that must be corrected” as found in Suraqah Abdul Azeez’s English translation; post – 160]

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment