নবী করীম (ﷺ) এর মোজেজাসমূহের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী, উজ্জ্বল, বহুবিদিত এবং সদাবিদ্যমান মোজেজা হচ্ছে কোরআন মজীদ। এ মোজেজাখানা কিয়ামত পর্যন্ত মোজেজা থাকবে। আল্লাহ্তায়ালার বাণী, ‘ইন্না আ’ত্বইনা কাল কাউছার’—এর পরিপ্রেক্ষিতে এ মোজেজাখানা সংখ্যাধিক্যের প্রতিনিধিত্ব করে। এই সুরা কোরআন মজীদের সবচেয়ে ছোট্ট সুরা। এর মধ্যে সন্নিবেশিত মোজেজা গণনা করে শেষ করা যায় না। এ সুরা দিয়ে পরীক্ষা করলে গোটা কোরআন মজীদে ও অন্যান্য মোজেজার পরিমাণ নির্ধারণ করা কী করে সম্ভব?
কোরআন মজীদ মোজেজা হওয়ার দিকসমূহ
মোজেজা হওয়ার দিক ও দৃষ্টিকোণ কোরআন মজীদে অনেক রয়েছে। কোরআন মজীদ মোজেজা হওয়ার ব্যাপারে বিস্তারিত জ্ঞানলাভ করাটা নির্ভর করবে তার মোজেজার দিক ও দৃষ্টিকোণ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করার উপর। সাধারণতঃ তার এজাজের দিকটি হচ্ছে, রসুল (ﷺ) এই কোরআনের মাধ্যমে বিশ্বমানবতার কাছে চ্যালেঞ্জ নিয়ে হাজির হলেন। কেউ যদি পারে তাহলে যেনো এই কোরআনের মতো একটি সুরা প্রস্তুত করে আনে।
যেমন আল্লাহ্তায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘আমি যা আমার রসুলের নিকট নাযিল করেছি সে ব্যাপারে তোমরা যদি সন্দিহান হও, তাহলে এর মতো আর একখানা সুরা নিয়ে এসো।’ এই চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা কেউ করতে পারেনি। এই কালাম মৃতদের জীবিত হয়ে যাওয়া, অন্ধদের চক্ষুষ্মান হওয়া এবং বধিরদের কণ্ঠ ও শ্রবণেন্দ্রিয় খুলে যাওয়া ইত্যাদির দিক দিয়ে বিস্ময়কর ক্ষমতার অধিকারী ছিলো।
আরবের ফাসাহাত বালাগাতের পন্ডিতবর্গ এবং শীর্ষস্থানীয় ভাষাবিদেরা যে কালাম পেশ করেছিলো, সেগুলো ভাব, তাৎপর্য, শব্দ ও অর্থের দিক দিয়ে আরবদের আপন আপন জাতীয়তার গন্ধমিশ্রিত ছিলো। তাই তাদের পেশকৃত কালাম কোরআনের কাছে অক্ষম হতে বাধ্য হয়েছিলো। আর তাদের এহেন অক্ষমতা হজরত ঈসার মৃতকে জীবিত করা, অন্ধকে চক্ষুষ্মান করা এবং কুষ্ঠরোগীকে সুস্থ করে দেয়ার চেয়েও বিস্ময়কর ছিলো। কেনোনা হজরত ঈসা (عليه السلام) এর এসব মোজেজা যারা দেখেছে তাদের জন্য এগুলো ঈসা (عليه السلام) এর পক্ষ থেকে চ্যালেঞ্জ স্বরূপ ছিলো না যে, সে চ্যালেঞ্জের কাছে তারা পরাজিত হয়েছে। আর হজরত ঈসা (عليه السلام) মোজেজা প্রদর্শন করে জয়ী হয়েছেন। কিন্তু কোরআনের ব্যাপারে তো তাদেরকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। আর তারা পরাজিতও হয়েছে। আর হজরত ঈসা (عليه السلام) এর মোজেজা যারা দেখেছে, তাদের তো এ বিদ্যায় পারদর্শিতা ছিলোই না। কিন্তু নবী করীম (ﷺ) যাদেরকে চ্যালেঞ্জ করলেন, তারা ছিলো ভাষায় পারদর্শী। ফাসাহাত, বালাগাত ও সম্ভাষণযোগ্যতা ছিলো তাদের অসাধারণ। চর্চা ছিলো শাণিত। এহেন অবস্থায় তাদের অক্ষম হওয়া নবী করীম (ﷺ) এর রেসালাতের বিশুদ্ধতার সহায়ক এবং অকাট্য দলীল।
আবু সুলায়মান খাত্তাবী (رحمة الله) প্রসিদ্ধ হাদীছ বিশারদ ও ব্যাখ্যাকারগণের অন্যতম ছিলেন। তিনি বলেন, সাইয়্যেদে আলম (ﷺ) অক্ষরজ্ঞানহীন হলেও সবচেয়ে জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান ছিলেন। সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্বাধিক বিদ্যান এক্ষেত্রে তাঁর আনীত কোরআনের মতো কালাম তারা মোকাবেলা করতে পারবে না—এটাই স্বাভাবিক। তিনি এরকম মহাজ্ঞানী না হলেও তাদের পক্ষে কোরআনের চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করা সম্ভব ছিলো না। তখনও তারা জ্ঞান, বুদ্ধি ও শিক্ষার চূড়ান্তপর্যায়ের ওই পর্যন্ত পৌঁছতে পারতো না। তাদের জন্য ‘তোমরা কক্ষণও পারবে না’ এই চ্যালেঞ্জ থেকেই যেতো। মোটকথা, রসুলেপাক (ﷺ) তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করলেন এবং তারা এর মোকাবেলা করতে চরমভাবে অক্ষম হলো। খন্ডের চেষ্টার সময় বালাগাত বা ভাষালংকারে তারা ত্রুটিপূর্ণ বলে প্রমাণিত হলো। তারপর তাদেরকে সমন্বিতভাবে চেষ্টা করতে বলা হলো। কিন্তু তাদের মধ্যে এমন কোনো ভাষাবিদ, অলংকারবিদকে পাওয়া গেলো না যে, মোকাবেলার ময়দানে দ-ায়মান হয়। তাদের এহেন অবস্থা দেখে আল্লাহ্তায়ালার তরফ থেকে বলে দেয়া হলো, সমস্ত মানুষ ও জ্বীন মিলেও এই কোরআনের অনুরূপ কিছু প্রস্তুত করতে পারবে না, একে অপরের সাহায্যকারী হলেও।
হাদীছ শরীফে এসেছে, একদা নবী করীম (ﷺ) মসজিদে হারামের এক প্রান্তেএকাকী বসেছিলেন। কুরাইশদের মধ্যে সবচেয়ে মন্দ ব্যক্তি উৎবা ইবনে রবীআ কুরাইশদের মজলিশে বলতে লাগলো, হে কুরাইশ সম্প্রদায়! আমি এ মুহূর্তে ওই লোকটির (মোহাম্মদ (ﷺ)) কাছে কিছু প্রস্তাব নিয়ে যাচ্ছি। আশা করি এর মধ্যে কিছু প্রস্তাব তিনি কবুল করবেন, ধর্মপ্রচারের কাজ থেকে বিরত হবেন এবং আমাদের পিছু নেয়া ছেড়ে দিবেন। লোকেরা বললো, ঠিক আছে আবুল ওলীদ তুমি যাও। এরপর উৎবা রসুল (ﷺ) এর কাছে গিয়ে বসে পড়লো এবং তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করে দিলো।
রসুল (ﷺ) কে সে ধনদৌলতের লোভ দেখিয়ে বললো, আপনি যা চাইবেন তাই পাবেন। রসুলেপাক (ﷺ) বললেন, হে আবুল ওলীদ, তোমার কথা কি শেষ হয়েছে? সে বললো, হ্যাঁ। তিনি বললেন, এখন আমার কথা শোনো। সে বললো, বলুন। আর আপনার মনে যা চায় তাই বলুন। রসুলেপাক (ﷺ) তখন এই আয়াতখানা তেলাওয়াত করলেন ‘পরম করুণাময় ও দয়ালু আল্লাহ্তায়ালার পক্ষ থেকে অবতারিত এ কিতাবের আয়াতসমূহ বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে আরবী কোরআন রূপে ওই সম্প্রদায়ের জন্য যাদের বিবেক আছে। নাযিল করা হয়েছে সুসংবাদ দানকারী এবং ভীতি প্রদর্শনকারী হিসেবে।’
উৎবা চুপচাপ মনযোগ দিয়ে শুনছিলো। তার হাত দু’টি পিঠের পিছন দিকে নিয়ে তার উপর হেলান দিয়ে বসেছিলো সে। রসুলেপাক (ﷺ) তেলাওয়াত করতে করতে সিজদার আয়াত পর্যন্ত পৌঁছলে সেজদা করলেন। এরপর বললেন, হে আবুল ওলীদ! শুনেছো। সে বললো, শুনেছি। আপনি আপনার কাজে মশগুল থাকুন, আর কারো ব্যাপারে কোনো আশংকা করবেন না।
উৎবা তার সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গেলো। তাকে দেখে লোকেরা বলতে লাগলো, আল্লাহর কসম! উৎবা বিষন্নমুখে লাঞ্ছিত হয়ে ফিরে এসেছে। উৎবা বললো, আল্লাহর কসম! আজ আমি এমন কালামশুনেছি যা ইতোপূর্বে কখনও শুনিনি। আল্লাহর কসম! এ বাণী কোনো কাব্য নয়, যাদুও নয়। গণকের কথাও নয়। হে কুরাইশ সম্প্রদায়! তোমরা তাঁকে তাঁর কালামের মধ্যেই থাকতে দাও, কেনোনা তিনি সত্য পথেই আছেন। এই কালামের ব্যাপারে আমি কসম করে বলবো যে, এই কালাম বড়ই মর্যাদাম-িত। আল্লাহর কসম! এটা খুবই বিস্ময়কর জিনিস। তোমরা ভালো করেই জানো যে, তিনি যা বলেন, তা কখনও মিথ্যা হয় না। আর তিনি দোয়া করলে অগ্রাহ্য হয় না। আমি ভয় করছি, না জানি আযাব নাযিল হয়ে যায়। —বায়হাকী প্রমুখ ইমামগণ এই রেওয়ায়েত করেছেন।
নিম্নোক্ত হাদীছখানার মধ্যে হজরত আবু যর (رضي الله عنه) জড়িত রয়েছেন। তিনি তখনো নবী করীম (ﷺ) এর নিকট উপস্থিত হননি। একদিন তিনি তাঁর ভাই উনাইসকে রসুলেপাক (ﷺ) এর নিকট প্রেরণ করলেন তাঁর অবস্থা জানার উদ্দেশ্যে এবং তাঁকে নিরীক্ষণ করার উদ্দেশ্যে। হজরত আবু যর (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, আল্লাহর কসম! আমার ভাই উনাইসের চেয়ে বড় কবি আমি দেখিনি বা তার চেয়ে বড় কবি কেউ আছেন বলেও শুনিনি। জাহেলী যুগে বারোজন কবিকে সে পরাজিত করেছিলো। আর সে বারোজনের মধ্যে স্বয়ং আমিও একজন ছিলাম। সে একদিন মক্কা মুকাররমায় গিয়ে ফিরে এসে আমার কাছে রসুল করীম (ﷺ) এর কথা বললো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, সাধারণ মানুষ তাঁর সম্পর্কে কী মন্তব্য করে? সে বললো, কোনো কোনো মানুষ তাঁকে কবি বলে, আবার কেউ বলে গণক। আল্লাহর কসম! আমি নিজেও একজন কবি। আর গণকদের কথাও আমি শুনেছি। তিনি কবি কিছুতেই নন। গণকেরা যেরকম কথা বলে, তাঁকে সে রকমও মনে হয়নি আমার। তিনি সত্যবাদী, আর ওই মানুষগুলোই মিথ্যাবাদী।
ওলীদ ইবনে মুগীরা কুরাইশ বংশের মধ্যে সাহিত্য ও অলঙ্কারশাস্ত্রে সবচেয়ে বড় পন্ডিত ছিলো। সে একবার কোরআন করীম শ্রবণ করে বলেছিলো, আল্লাহর কসম! নিশ্চয়ই এই কোরআন মিষ্টিমধুর এবং শ্রুতি সুখকর। এই কালামের মধ্যে এমন ঔজ্জ্বল্য এবং সজীবতা রয়েছে, যা অন্য কিছুতে নেই। নিশ্চয়ই এর উপরের অংশ ফলদার আর এর নিচের অংশে সুশীতল ধারা প্রবহমান। আর এটি মানুষের কথা নয়। নিশ্চয়ই এ কোরআন বিজয়ী হবে, তাকে বিকৃত করা যাবে না।
ইবনে ওলীদ তার কাওমের লোকদের কাছে আরও বলতো, আল্লাহর কসম! তোমাদের কবিতা সম্পর্কে আমার চেয়ে অধিক ওয়াকিফহাল কেউ নেই। আর জান্নাতের কবিতা জাননেওয়ালাও কেউ নেই। আল্লাহর কসম! মোহাম্মদ (ﷺ) যা বলে থাকেন তার চেয়ে উত্তম কালাম হতেই পারে না।
অন্য একটি বর্ণনায় আছে, এক বৎসর হজের সময় কুরাইশদের সমস্ত মানুষ একত্রিত হলো। সে সময় ওলীদ ইবনে মুগীরা বললো, এ সময় আরবের সমগ্র দল এসে উপস্থিত হয়েছে। এ মুহূর্তে আশা করা যায় যে, সকলেই একটি মতের উপর ঐকমত্য স্থাপন করবে। একে অপরকে হয়তো মিথ্যা সাব্যস্ত করবে না এবং পারস্পরিক মতপার্থক্য দূর হয়ে যাবে। এ কথা শুনে সকলেই বলে উঠলো, আমরা সলেই একমত হয়ে ঘোষণা দিলাম, ওই লোকটি (মোহাম্মদ (ﷺ)) একজন গণক। ওলীদ বললো, আল্লাহর কসম! তিনি কোনো গণক নন এবং গণকদের মতো তাঁর কথার মধ্যে গুণগুণ ধরনের কোনো শব্দও নেই। তখন লোকেরা বললো, তাহলে আমরা তাকে উন্মাদ বলবো। সে বললো, আল্লাহর কসম তিনি পাগলও নন। মানুষের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে জ্ঞানবান। লোকেরা বলতে লাগলো, তাহলে আমরা তাঁকে কবি বলবো। সে বললো, তিনি কবিও নন। আমি কবিতা এবং তার প্রকারভেদ সম্পর্কে জানি। রেজেয, হেজেয, মারসুত ও মাকবুথ, কবিতার এ সমস্ত প্রকারভেদ আমার খুব ভালো করে জানা আছে। তখন লোকেরা বললো, তাহলে আমরা বলবো, সে যাদুকর। ওলীদ বললো, তিনি যাদুকরও নন। তাঁর কাছে কোনো ঝাড়-ফুঁক, তাবীয তুমার নেই। তোমরা তাঁর সম্পর্কে যা কিছুই বলো না কেনো, আমি বলবো, তিনি মিথ্যাচারী নন। এই হাদীছখানা ইবনে ইসহাক এবং বায়হাকী বর্ণনা করেছেন। কোনো কোনো বিদ্বান এরকম মন্তব্য করেছেন, এই কোরআন মজীদ যদি কোনো অরণ্যে অথবা মরুভূমিতে গ্রন্থাকারে পাওয়া যেতো এবং কেউ যদি নাও জানতো যে, এই গ্রন্থ কে রেখে গেছে, তবুও সমস্ত বিশুদ্ধ প্রজ্ঞা ও সুদৃঢ় চেতনা একথাই সাক্ষ্য দিতো যেএই কিতাব আল্লাহ্তায়ালার তরফ থেকেই অবতারিত। কোনো মানুষ এরকম গ্রন্থ রচনা করতে পারেনা। কোনো বুদ্ধিমান, সত্যবাদী এবং মুত্তাকী লোকের হাতে এই কোরআন এলে তিনি বলতে বাধ্য হবেন যে, এ কিতাব আল্লাহ্তায়ালার কালাম। এর মধ্যে মানুষকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে, তারা যেনো এর মতো একখানা সুরা রচনা করে নিয়ে আসে। কিন্তু সবাই ব্যর্থ হয়েছে। তারপরেও সংশয় সন্দেহ, দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ কেমন করে থাকতে পারে? কোরআন মজীদ যে মোজেজা তা জানবার সংক্ষিপ্ত পদ্ধতি এটাই। আর কোরআনকে মোজেজা হিসেবে বুঝবার সবচেয়ে সহজ পথ এই যে, এই কোরআন সাব্যস্ত হয়েছে নবী করীম (ﷺ) এর বাণীর মাধ্যমে। আর নবী করীম (ﷺ) যে আল্লাহর নবী, তা সাব্যস্ত হয়েছে তার মোজেজাসমূহের মাধ্যমে।
কোরআন মজীদকে মোজেজা হিসেবে বুঝবার বিস্তারিত তরিকা হচ্ছে, এর ফাসাহাত, বালাগাত, বিস্ময়কর ও সূক্ষ্ম বর্ণনাভঙ্গি, গায়েবী সংবাদ প্রদান ইত্যাদি বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করা। অবশ্য এই তরিকাটি তাঁদের জন্য সহজবোধ্য হবে, যাঁরা আলেম। তাঁরাই ফাসাহাত বালাগাতের অর্থ ভালো জানেন। তবে সাধারণের জন্য এই তরিকা চিনবার আরও ভিন্ন ভিন্ন উপায় রয়েছে। যেমন এজাজ অর্থাৎ আলফাজ। সংক্ষিপ্ত, কিন্তু ব্যাপক অর্থবোধক এবং তা অলংকারময়। যেমন আল্লাহর বাণী ‘তোমাদের জন্য কেসাসের মধ্যে রয়েছে জীবন।’ এখানে ‘আলক্বিসাসু হায়াত’ দু’টি শব্দের মধ্যে অক্ষরের সংখ্যা মাত্র দশটি কিন্তু এর মধ্যে অনেক রকম অর্থ প্রচ্ছন্ন রয়েছে।
হজরত আবু ওবায়দা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত হয়েছে— এক বেদুইন কোনো একজনকে ‘ফাসাদা বিমা তু’মার’ আয়াতখানা পাঠ করতে শুনলো। তৎক্ষণাৎ সে সেজদায় পড়ে বলতে লাগলো, আমি এই কালামের ফাসাহাতকে সেজদা করছি। আরেক বেদুইন এক ব্যক্তিকে এই আয়াতটি পাঠ করতে শোনার পর বললো, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, এই কালামের অনুরূপ কিছু সৃষ্টি করার ক্ষমতা কারো নেই। বর্ণিত আছে, হজরত ওমর ফারুক (رضي الله عنه) একদিন মসজিদে নিদ্রাভিভূত ছিলেন। অকস্মাৎ রোমের বাদশাহ্র তরফ থেকে এক দূত এসে তাঁর শিয়রের পাশে দাঁড়িয়ে গেলো। দূতটি তাঁকে দেখামাত্র সত্যের সাক্ষ্য দিতে লাগলো। দূতটির আরবী ভাষার উপর ভালো দখল ছিলো। সে বললো, আমি মুসলমান বন্দীদের মধ্যে একজন বন্দীকে তোমাদের কোরআনের একটি আয়াত পাঠ করতে শুনেছি। তারপর আমি উক্ত আয়াতখানার ব্যাপারে খুব চিন্তা করতে শুরু করলাম। তারপর দেখতে পেলাম, হজরত ঈসা ইবনে মরিয়মের উপর দুনিয়া এবং আখেরাত সংক্রান্তযা কিছু অবতীর্ণ হয়েছিলো, তার সাথে এর যথেষ্ট মিল রয়েছে। তদুপরি আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, ওই আয়াতে ওই সমস্ত কথাই অত্যন্ত সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হয়েছে। সেই আয়াতখানা হচ্ছে—‘যারা আল্লাহ্ ও তার রসুলের আনুগত্য করবে, আল্লাহ্কে ভয় করবে এবং তাকওয়া গ্রহণ করবে, তারা কৃতকার্য হবে।’
আসমায়ী (رحمة الله) থেকে একটি ঘটনা বর্ণিত আছে। তিনি একটি মেয়েকে অত্যন্ত ফাসাহাতপূর্ণ কথা বলতে শুনলেন। তার ফাসাহাতের উপর এরূপ দক্ষতা দেখে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করলেন। তখন মেয়েটি বললো, আপনি কি আমাকে কালামে এলাহীর চেয়ে অধিক ফাসাহাতবিদ মনে করে নিলেন? স্মরণ করুন আল্লাহ্তায়ালার ওই উদ্ধৃতিটি— (আল্লাহ্তায়ালা বলেন) ‘আমি মুসার মায়ের নিকট সংবাদ পাঠালাম, তাকে দুধ পান করানোর জন্য। অতঃপর তুমি তার ব্যাপারে যদি কোনোরূপ আশংকা করো তাহলে তাকে দরিয়ার ঢেউয়ের মধ্যে ছুঁড়ে দাও। তার জীবনের জন্য ভয় কোরো না। চিন্তাও কোরো না। আমি তাকে তোমার নিকট পুনরায় ফিরিয়ে দেবো এবং আমি তাকে পয়গম্বরগণের অন্তর্ভূত করবো।’—এই ছোট্ট আয়াতখানার মধ্যে দু’টি আদেশ, দু’টি নিষেধ, দু’টি বিজ্ঞপ্তি এবং দু’টি সুসংবাদ রয়েছে। আল্লাহ্তায়ালার এই বাণীটিও শুনুন, ‘তুমি তার কথার উত্তর তার চেয়ে ভালো কথা দ্বারা প্রদান করো। তখন অকস্মাৎ দেখবে, তোমার এবং তার মধ্যে যে দুশমনী রয়েছে, তা দূর হয়ে এমন হয়ে যাবে, সে হবে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু।’ এরকম আরো আয়াতে করীমা রয়েছে। যেমন ‘হে যমীন! তুমি তোমার পানি শোষণ করে নাও। আর হে আকাশ! তুমি ফেটে যাও।’ এ জাতীয় বহু আয়াত রয়েছে যার মধ্যে শব্দ সংক্ষেপণ সত্ত্বেও অর্থের আধিক্য, ভাবের বিশালতা, সুন্দর শব্দবিন্যাস ইত্যাদির সমাহার ঘটেছে। তাছাড়া দীর্ঘ ঘটনার বর্ণনা এবং পূর্ববর্তীদের ইতিবৃত্ত সম্পর্কে বর্ণনার অবস্থাও তদ্রুপ। যেমন কোরআনে করীমে হজরত ইউসুফ (عليه السلام) এর যে সুদীর্ঘ ইতিবৃত্ত আনা হয়েছে, তাতে কী সুন্দরভাবে শব্দের পারস্পরিক যোগসূত্রতা স্থাপিত হয়েছে এবং সেই ভাষ্যের মধ্যে রয়েছে কী অপূর্ব প্রাঞ্জলতা। এতে তথ্যপ্রমাণের যে প্রবাহ সৃষ্টি হয়েছে, তা অবশ্যই একজন চিন্তাশীল ও চক্ষুষ্মান ব্যক্তির জন্য শিক্ষা গ্রহণের উপকরণ। এ ধরনের এজাজের ব্যাপারে জানার স্পৃহা কেবল আরবদের ভাষারীতি এবং তাদের ভাষাতত্ত্বের প্রতি অনুরাগসম্পন্ন ব্যক্তির মধ্যেই জাগা স্বাভাবিক। আর তা বোধগম্য হওয়ার জন্য শর্ত হচ্ছে, তাদেরই মতো আরবী ভাষায় বিচক্ষণ হতে হবে। অবশ্য অনারবদের মধ্যে যাঁরা আরবী ভাষায় বিজ্ঞ ও পারদর্শী, তাঁরা এই বিষয়টির উপর গ্রন্থাদি রচনা করেছেন। তা সত্ত্বেও আরবদের সাধারণ লোক, যারা মূর্খ, সেদেশের সাধারণ নারী সমাজ, এমনকি গোলামদের মধ্যে এ ভাষার ব্যাপারে যে বিশেষ অনুরাগ অনুভূতি পরিদৃষ্ট হয়, তা কিন্তু অনারব পন্ডিত ও বুযুর্গানে মিল্লাতগণের মধ্যে পাওয়া যায় না।
কোরআন মজীদ মোজেজ হওয়ার অন্যান্য দিক হচ্ছে বিস্ময়কর নযম, সূক্ষ্ম পদ্ধতি ও ধরন যা পরস্পর বিচ্ছিন্নতার পরিপন্থী। এ বিশেষত্বটি অনারবদের ভাষায় নেই। আরবী ভাষার গদ্য, পদ্য, ভাষণ, গীতিকাব্য, ছন্দ, ছড়া ইত্যাদির রীতিগুলো সবই তাদের দৈনন্দিন ব্যবহারিক রীতির অন্তর্ভূত। উপরোক্ত বিষয়াদির পরিপ্রেক্ষিতে কোরআন মজীদের একটি অতিরিক্ত বিশেষ গুণ রয়েছে, যা আরবদের ভাষা থেকেও স্বতন্ত্র। আরবদের ভাষার সঙ্গে কোরআন মজীদ সংমিশ্রিত নয় এবং তার সদৃশও নয়, যদিও কোরআনের শব্দ এবং অক্ষর তাদের ভাষারই স্বশ্রেণীভুক্ত, যা তারা আপন গদ্য ও পদ্যে ব্যবহার করে থাকে। এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করে তাদের পন্ডিত সমাজ বিস্মিত এবং তাদের ভাষ্যকার ও ভাষা অলংকারবিদরা বিস্ময়ে অবনত। তারা বহু চেষ্টা করেছে তাদের নিজেদের কালামে এ ধরনের সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। আল্লাহ্তায়ালার কালামে যে অকাট্য দলীল ও উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তার মোকাবেলা করার মতো তাদের কোনো শক্তিই নেই।
ওলীদ ইবনে মুগীরা রসুলেপাক (ﷺ) থেকে কোরআন মজীদ শুনে বিগলিত হয়ে গেলো এবং তাকে এ কোরআনের সত্যতাকে স্বীকার করতেই হলো। আবু জাহেল এসে তাকে নরম গরম, অনেক কিছু বুঝাতে চেষ্টা করলো। তারপরও সে কোরআনের সত্যতাকে অস্বীকার করতে পারলো না। কুরাইশ বংশের সকল হতভাগ্যদের অবস্থা এরূপই ছিলো। তারা আরবী ভাষার বালাগাত ও ফাসাহাতের কায়দা কানুনে যথেষ্ট পারদর্শী হওয়া সত্ত্বেও কোরআন মজীদের বর্ণনাভঙ্গি ও উপস্থাপন পদ্ধতি দেখে হয়রান হয়ে এর সত্যতাকে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। তারপরও কিছুসংখ্যক অহংকারী ও নির্বোধ মোকাবেলা করার দুঃসাহস দেখিয়েছিলো। কিন্তু তারা লাঞ্ছিত ও অপদস্থ হয়েছে। যেমন ইয়াহইয়া ইবনে পারায়ী নিঃসন্দেহে সেই সময়ের একজন তুলনাবিহীন বালাগাত ও ফাসাহাতবিদ ছিলো। সে ভাবলো, সূরা এখলাসের অনুরূপ কোনো বাক্য প্রস্তুত করবে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও পারলো না। অবশেষে ভীত হয়ে একাজ থেকে তওবা করলো। এই লোকটি তার সময়ে বিভিন্ন ছন্দ ও কাব্য রচনা করেছিলো এবং কোরআনের সুরা সমূহের শ্রেণীগত নামকরণ করেছিলো মুফাস্সাল। একদিন সে শিশুদের এক বিদ্যাপীঠের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলো। শুনতে পেলো বিদ্যালয়ের বাচ্চারা এই আয়াতখানা তেলাওয়াত করছে ‘ক্বীলা ইয়াআরদুব লায়ী মা আকা’ তেলাওয়াত শুনে সে আর এগুলো না। সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ফিরে এসে তার লিখিত পা-ুলিপিগুলো নষ্ট করে ফেললো এবং বললো, আল্লাহর কসম! আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, এই কালামের মোকাবেলা কেউ করতে পারবে না। এটা মানুষের কালাম নয়।
কোরআনুল করীম মোজেজ হওয়ার আরেকটি দিক হচ্ছে গায়বী সংবাদ প্রদান করা। কোরআন মজীদ এমন বিষয়ের সংবাদ জগৎবাসীকে প্রদান করেছে, যা তখনও ঘটেনি। পরবর্তীতে ঘটেছে। যেমন আল্লাহ্তায়ালার এরশাদ—‘(হে রসুল!) আপনি মসজিদে হারামে ইনশাআল্লাহ্ অবশ্যই নিরাপদ অবস্থায় প্রবেশ করবেন।’ হক তায়ালা আরও এরশাদ করেছেন—‘আর তারা তাদের বিজয়ের পরে অচিরেই পরাভূত হবে।’ আরও এরশাদ করেছেন—‘তথাকথিত সমস্ত দ্বীনের উপর তাকে বিজয়ী করার জন্য।’ আরও এরশাদ রয়েছে—‘তোমাদের মধ্যে যারা ইমানদার এবং সৎকর্মশীল, আল্লাহ্তায়ালা তাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধিত্ব দান করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ আরও এরশাদ করেছেন—‘আল্লাহর সাহায্য এবং বিজয় যখন আসবে-’ আরও ঘোষণা করেছেন—‘নিশ্চয়ই আমি কোরআন নাযিল করেছি এবং অবশ্যই আমি এর হেফাযত করবো’। দেখা গেছে, অসংখ্য দুশমন, অতিরঞ্জিতকারী এবং বাতিলপন্থীরা একত্রিত হয়ে নানা রকম উপায় অবলম্বন করেছে, ষড়যন্ত্র করেছে, শক্তি খাটিয়ে চেষ্টা করেছে কোরআনের নূরকে নিভিয়ে দিতে। কিন্তু পারেনি। কোরআন মজীদের একটি শব্দেও বিকৃতি আনতে সক্ষম হয়নি। একটি অক্ষর সম্পর্কেও মুসলমানদের অন্তঃকরণে বিন্দুমাত্র সন্দেহের উদ্রেক করতে পারেনি। এ সম্পর্কে আল্লাহ্তায়ালা এরশাদ করেছেন—‘অতি তাড়াতাড়ি এই বিরুদ্ধবাদীরা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে।’ আল্লাহ্তায়ালা আরও এরশাদ করেছেন—‘তোমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করো, আল্লাহ্তায়ালা তোমাদের মাধ্যমে তাদেরকে শাস্তি প্রদান করবেন।’ বলেছেন—‘এরা আর কোনোদিন যুদ্ধের অভিলাষী হবে না।’ আরও এরশাদ করেছেন—‘তোমরা (কাফেরেরা) কক্ষণো কোরআনের সুরার মতো কিছু প্রস্তুত করতে পারবে না।’
এরকম আরও বহু আয়াতে কোরআনী এবং হাদীছ রয়েছে।
কোরআন মজীদ মোজেজ হওয়ার আরেকটি দিক হচ্ছে, এই কোরআন অতীতের অনেক ঘটনা বর্ণনা করেছে। সে সম্পর্কে কিছু কিছু লোক যৎসামান্য জ্ঞান রাখলেও অনেকেই এ ব্যাপারে কিছুই জানতো না। যেমন আসহাবে কাহাফের ঘটনা, হজরত মুসা (عليه السلام) ও খিযির (عليه السلام) এর ঘটনা, যুলকারনাইনের ঘটনা, হজরত ইউসুফ (عليه السلام) এবং তাঁর ভ্রাতৃবর্গের ইতিবৃত্ত, হজরত লুকমান (عليه السلام) এবং তাঁর পুত্রের কাহিনী এবং বহু আম্বিয়া কেরাম ও তাঁদের উম্মতগণের মধ্যে সংঘটিত ঘটনাবলী। তাছাড়া পূর্ববর্তী উম্মতগণের শরীয়ত সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। এসমস্ত ব্যাপারে যৎসামান্য জ্ঞানলাভকারীরা কোরআন মজীদে উপস্থাপিত কাহিনীর সত্যতা সম্পর্কে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছে। তারা ভালোভাবেই জানতো যে, রসুলেপাক (ﷺ) একজন উম্মী (আক্ষরিক জ্ঞানবিমুক্ত) নবী। তিনি লেখাপড়া করেননি। কোনো বিদ্যালয়ে যাননি। এ জাতীয় মজলিশের সাথে তাঁর সংশ্লিষ্টতাও ছিলো না। তিনি তাদের সামনে সারা জীবনই অক্ষরের অমুখাপেক্ষী রয়েছেন। অন্য কোনো দেশেও যাননি। অথচ তিনি তওরাত, ইঞ্জীল, ইব্রাহীম (عليه السلام) ও মুসা (عليه السلام) এর সহীফাসমূহের ঘটনাবলী বলে যাচ্ছেন অবলীলায়। কোরআনে অলৌকিকত্বের বর্ণিত দিকগুলো খুবই স্পষ্ট। এর মধ্যে আচ্ছন্নতা, সন্দেহ কিংবা মতানৈক্যের অবকাশ নেই। এছাড়া, অন্যান্য দিকগুলো হচ্ছে কোরআনের সিফাত বা বৈশিষ্ট্য। ওই সকল বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, কোরআন মজীদ শ্রবণকালে শ্রবণকারী এবং তার পাঠক উভয়েই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। এই অবস্থা কেবল মুমিনের জন্যই হয়, তা নয়। বরং কাফের ও মিথ্যাচারীদের মধ্যেও এজাতীয় ভীতির সঞ্চার হয়ে থাকে। আল্লাহর কালামের পরাক্রমশীলতা এবং জালালিয়াতের হাল তাদের উপরও প্রবল হয়ে যায়। মুমিন ও কাফেরদের মধ্যে এই ভীতিপ্রদ অবস্থার পার্থক্য এই যে, কাফেরদের জন্য এ কালাম শ্রবণ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। তখন কোরআন থেকে দূরে থাকাই তাদের জন্য হয় স্বস্তিজনক। কোরআনের আবৃত্তি শ্রবণ তারা সহ্যই করতে পারে না। অপরপক্ষে মুমিনদের অন্তরে ভীতিপ্রদ হাল পয়দা হলেও কোরআনের প্রতি তাদের আগ্রহ ও উদ্দীপনা বেড়ে যায়। মুমিনদের অন্তর্জগতে তখন প্রবাহিত হতে থাকে প্রশান্তি এবং প্রশস্ততা। তাদের এই আকৃষ্টতা মহব্বত ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে হয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ্পাক ঘোষণা করেছেন, ‘কোরআনের তেলাওয়াত শুনে ওই সকল লোকের শরীরের পশম খাড়া হয়ে যায়, যারা তাদের প্রভুকে ভয় করে।’ আল্লাহ্তায়ালা আরও বলেছেন, ‘অতঃপর তাদের দেহ এবং অন্তর আল্লাহ্তায়ালার জিকিরের দিকে বিনম্র হয়ে যায়।’ আরও বলেছেন, ‘এই কোরআনকে আমি যদি পাহাড়ের উপর অবতীর্ণ করতাম, তবে তোমরা অবশ্যই দেখতে যে, পাহাড় আল্লাহ্তায়ালার ভয়ে কম্পমান।’ এই আয়াতগুলো একথাই প্রমাণ করে যে, কোরআনে করীমের মর্যাদা, বৈশিষ্ট্য ও স্বভাব অতি মহান। কোরআনের শ্রবণকারী জ্ঞান ও চেতনার অধিকারী হোক বা না হোক, এর অর্থ ও ব্যাখ্যা বুঝুক বা নাই বুঝুক, শ্রবণকারীর মধ্যে এর প্রতিক্রিয়া হবেই। এ কথাটির যথার্থ প্রমাণ পাওয়া যায় মহিলা এবং অশিক্ষিত লোকদের মধ্যে। কোরআন শ্রবণ করা মাত্রই তাদের উপরে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তখন তারা অভিভূত হয়ে স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে, কোরআন আল্লাহর কালাম। এটি অন্য কারও কালাম বা ভাষার মতো নয়।
জনৈক খৃষ্টানের একটি ঘটনা আছে। খৃষ্টান লোকটি একদিন কোনো এক কোরআন পাঠকের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলো। কোরআনের আওয়াজ তার কানে আসা মাত্রই সে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলো। লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, কাঁদছো কেনো? তুমি তো এর অর্থ বুঝ না। লোকটি বললো, আমি এর মাধুর্য ও বাচনভঙ্গিতে অভিভূত হয়ে কাঁদছি। এই কালাম শুনে প্রাণের আস্বাদ ও আনন্দ জেগেছে। আমার কাঁদবার কারণ এটাই।
কোরআনে করীম শ্রবণের ভয়ভীতি ইসলাম গ্রহণের পূর্বে এক সম্প্রদায়ের উপর কাজ করেছিলো। যে কারণে বিনা দ্বিধা ও কালক্ষেপণে তারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলো। এ প্রসঙ্গে হজরত জুবায়ের ইবনে মুতইম (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, একবার আমি মাগরিবের জামাতে নবী করীম (ﷺ) কে সুরা তুর পাঠ করতে শুনেছি। রসুলেপাক (ﷺ) যখন ‘আমখলিকু মিন গইরি শাইয়্যিন আমহুমুল খলিকুন’ থেকে ‘আমহুমুল মুসাইতিরুন’ পর্যন্ত পাঠ করলেন তখন আমার প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। এরকম প্রতিক্রিয়া আমার মধ্যেই সর্বপ্রথম সৃষ্টি হয়েছিলো। উতবা ইবনে রবিয়া নবী করীম (ﷺ) থেকে সুরা হামিম আস্সেজদার তেলাওয়াত শুনে বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিলো। সে নিজ গোত্রের কাছে বলেছিলো, আমি মোহাম্মদের কাছ থেকে এমন এক কালাম শুনে এসেছি, যা আগে শুনিনি। তার বর্ণনা করার শক্তি আমার নেই। তারপরও সে কুফুরীর উপরেই প্রতিষ্ঠিত রয়ে গিয়েছিলো। বরং তার অস্বীকৃতি ও বিরোধিতা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছিলো।
এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, ইমান আল্লাহ্তায়ালার দেয়া বিশেষ দান। জ্ঞান ও বিদ্যা এখানে কার্যকর হয় না। যে কারণে তারা নবী করীম (ﷺ) কে আপন সন্তানের চেয়ে বেশী জেনেও তাঁর উপর ইমান আনতে ব্যর্থ হয়েছে। এজাজে কোরআনের আরেকটি দিক হচ্ছে, এর পাঠক কখনোই একঘেয়েমির সন্ধান পায় না এবং শ্রবণকারী শুনতেও অপছন্দ করে না। বরং এর তেলাওয়াতে মাধুর্য, আনন্দ, মহব্বত, সজীবতা এবং স্বাদ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। নির্জনে তেলাওয়াতের আস্বাদ বেশী অনুভূত হয়। এ অবস্থা সবসময়ই বিদ্যমান। কিন্তু অন্য কালাম এর বিপরীত। যতোই কাব্যসুষমাম-িত এবং সুন্দর হোক না কেনো, বারংবার পাঠে তা স্বাদহীন হতে বাধ্য। এই ব্যাপারটি অভিজ্ঞতা দ্বারা প্রমাণিত। এ বিষয়গুলো অবশ্য ইমান ও মহব্বতের সাথে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু কাফের, মুনাফেক ও দুশমনদের বেলায় আল্লাহ্তায়ালার চূড়ান্ত ঘোষণা, ‘এদের বেলায় ক্ষতি ছাড়া আর কিছু বৃদ্ধি পায় না।’
কোরআন মজীদ মোজেজ হওয়ার আরেকটি দিক হচ্ছে, এই কোরআনে ওই সমস্ত এলেম ও মারেফত সন্নিবেশিত করা হয়েছে, যার ব্যবহার আরবদেশে ছিলো না। তাছাড়া নবুওয়াতপ্রাপ্তির পূর্বেও ওই সমস্ত এলেম ও মারেফত সম্পর্কে রসুলেপাক (ﷺ) এর জানা ছিলো না। অতীতের উম্মতগণের আলেম সমাজের মধ্য থেকে কেউই এ ব্যাপারে কিছু রচনা করে যাননি। তাদের কোনো কিতাবে এজাতীয় এলেম ও মারেফতের উল্লেখ নেই। আল্লাহ্তায়ালা কোরআন মজীদে শরীয়তের এলেম, আদব, শিষ্টাচার, সুন্দর চরিত্র ও স্বভাব, উপদেশ ও প্রজ্ঞাবাণী পূর্ববর্তী উম্মত ও নবীগণের জীবনী, আখেরাত সম্পর্কে সংবাদ প্রদান, ইত্যাদির পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করেছেন। এগুলো আল্লাহ্তায়ালার এককত্বের এবং গুণাবলীর প্রজ্ঞাসমৃদ্ধ দলীল, বিশ্বাসগত প্রমাণ ও সুস্পষ্ট নিদর্শন। ঘোষণা করা হয়েছে, ‘আমি কোরআন মজীদে কোনো বিষয়ের আলোচনা বাকি রাখিনি।’ আল্লাহ্তায়ালা আরও বলেছেন ‘আমি আপনার উপর সর্ববিষয়ের সুস্পষ্ট বর্ণনাকারী কোরআন নাযিল করেছি।’ আরও এরশাদ করেছেন, ‘আমি এই কোরআনে মানুষের জন্য সকল উদাহরণ দিয়েছি।’ আরও ঘোষণা করেছেন, ‘এই কোরআন মজীদ বনী ইসরাইলদের ওই বিষয়াবলীর বর্ণনা প্রদান করে, যেগুলোর ব্যাপারে তাদের অধিকাংশ লোক মতানৈক্য করে থাকে।’ আল্লাহ্তায়ালা আরও বলেন ‘এই কোরআন মানুষের জন্য বয়ান ও হেদায়েত।’
সবচেয়ে আশ্চর্য এবং সূক্ষ্ম বিষয় এই যে, এই কোরআনে প্রমাণ এবং প্রমাণিত বিষয় উভয়টিকে একত্রিত করা হয়েছে। আর এজন্য কোরআন মজীদের ও তার বালাগাতগত সৌন্দর্য দলীল প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপিত হয়ে থাকে। আবার তার মধ্যে আদেশ নিষেধ, ভয়ভীতি প্রদর্শন, প্রতিশ্রুতি প্রদান ইত্যাদি বিষয়েও আলোকপাত করা হয়েছে। কোরআনের কোনো একখানা আয়াত নিয়ে চিন্তাশীল ব্যক্তি গবেষণা করলে তার প্রকৃষ্ট দলীল লাভ করতে সক্ষম হয়। তার সাথে সাথে উক্ত কালামের বিধান সম্পর্কেও ওয়াকিফহাল হয়। কোরআন মজীদের মোজেজ হওয়ার আরেকটি অন্যতম দিক হচ্ছে, এর বাণীসমূহ নযম বা পদ্যের ধারায় উপস্থাপন করা হয়েছে, গদ্যের ধারায় নয়। কেনোনা পদ্যের মধ্যে চিত্তাকর্ষণ ক্ষমতা বেশী, এটা মানুষের জন্য সহজসাধ্য, শ্রবণশক্তিকে সজাগকারী এবং অনুধাবনের ক্ষেত্রে সহায়ক। কোরআন মজীদ মোজেজ হওয়ার আরেকটি দিক হচ্ছে শিক্ষার্থী এবং হাফেজগণের জন্য কোরআন শিক্ষা অত্যন্ত সহজসাধ্য। আল্লাহ্তায়ালা ঘোষণা করেছেন, ‘আমি স্মৃতিবদ্ধ করার জন্য কোরআনাকে সহজ বানিয়ে দিয়েছি।’ অতীতের উম্মতগণ তাদের আসমানী কিতাব মুখস্থ রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। ঘটনাক্রমে দু’ একজন পারলেও অধিক সংখ্যক লোকের পক্ষে তা সম্ভব হয়নি, যদিও তারা সুদীর্ঘ আয়ু লাভ করেছিলেন। কিন্তু কোরআন মজীদ শিশু ও আলেমদের জন্য সহজ। তারা অতি অল্প সময়ের মধ্যে কোরআন আয়ত্ত করতে পারে। কোরআন মজীদের এজাজের আরেকটি দিক এই যে, এর জুয বা পারার মধ্যে পারস্পরিক মিল রয়েছে। বিভিন্ন প্রকারে আলোচ্য বিষয়গুলো পারস্পরিক সামঞ্জস্যের সাথে গ্রথিত হয়েছে। অত্যন্ত নিপুণতা ও সৌন্দর্যের মাধ্যমে এক ঘটনা থেকে অন্য ঘটনার দিকে আলোচনা নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এক বাক্য থেকে অপর বাক্যের দিকেও এভাবেই বক্তব্য প্রবাহিত হয়েছে। সুরায় অনুচ্ছেদবিন্যাস না করে, প্রসঙ্গের নামকরণ না দিয়ে আদেশ, নিষেধ, বিজ্ঞপ্তি, প্রতিশ্রুতি, সতর্ক সংকেত, নবুওয়াত সাব্যস্তকরণ, তওহীদের বর্ণনা, অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ সৃষ্টি, যাবতীয় বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। ফাসাহাত ও বালাগাত বিষয়ে কোনো সুদক্ষ পন্ডিত এ যাবতীয় বিষয়ের বর্ণনা একত্র করতে গেলে দেখবে ফাসাহাত ও বালাগাতের দুর্বলতা চলে এসেছে এবং প্রাঞ্জলতা ক্রমশ হ্রাস পেয়ে যাচ্ছে। বাক্যের মধ্যে শব্দের ধারাবাহিকতা লোপ পাচ্ছে এবং ভাষ্যের মধ্যে দোদুল্যমানতার সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু কোরআন মজীদ? যতোই প্রসঙ্গ বৃদ্ধি পাচ্ছে, বর্ণনা দীর্ঘ হচ্ছে, ততই তার মধ্যে বর্ণিত গুণাবলী উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোরআন মজীদের এজাজের আরেকটি দিক হচ্ছে, এর আয়াতসমূহ চিরস্থায়ী। আল্লাহ্তায়ালা স্বয়ং এর সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্তায়ালার ঘোষণা, ‘আমিই কোরআন নাযিল করেছি, আর আমিই এর হেফাজতকারী।’ অন্যান্য আসমানী কিতাবের হেফাজতের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিলো আহবার ও রোহবানগণের উপর। কিন্তু তারা হেফাজত করেনি। বরং তাকে পরিবর্তিত ও রূপান্তরিত করেছে। কিন্তু ওরকম অপকর্ম কোরআন মজীদের কাছে আসতেই পারে না। যেমন আল্লাহ্তায়ালা বলেছেন, ‘কোরআন মজীদের কাছে বাতিল আসতে পারবে না। সামনে থেকেও নয় পিছন থেকেও নয়।’ আম্বিয়া কেরামের মোজেজাসমূহ তাঁদের যুগ শেষ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কোরআনে করীম রসুলেপাক (ﷺ) এর এমন এক মোজেজা, যার আয়াতসমূহ সুস্পষ্ট, প্রকাশ্য এবং চিরপ্রোজ্জ্বল। প্রত্যেক যুগেই ভাষাবিদ, বালাগাতের পন্ডিত, তেজোদীপ্ত বক্তা, সীমা লংঘনকারী এবং ধর্মের শত্রু বিদ্যমান ছিলো। এখনও রয়েছে। কিন্তু কই? কোরআনে করীমেরমোকাবেলা তো কেউ করতে পারলো না? এ মহিমান্বিত কোরআনকে খন্ড করারমতো কোনো রচনাও কেউ উপস্থাপন করতে পারলো না। কেউ কোনো ত্রুটিও নিরূপণ করতে পারলো না। বরং যারা এ ধরনের ধৃষ্টতা দেখিয়েছে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অবশেষে ময়দান ছেড়ে দিয়েছে। কাযী আয়ায (رحمة الله) বলেছেন, এজাজে কোরআন সম্পর্কে উলামায়ে কেরাম বহুবিধ দৃষ্টিকোণ উল্লেখ করেছেন। অবশ্য অধিকাংশই বালাগত ও ফাসাহাত সম্পর্কিত।
➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)]