بسم الله الرحمن الرحيم
كَلَّا وَالْقَمَرِ – وَاللَّيْلِ إِذْ أَدْبَرَ – وَالصُّبْحِ إِذَا أَسْفَرَ – إِنَّهَا لَإِحْدَى الْكُبَرِ – نَذِيرًا لِلْبَشَرِ – لِمَنْ شَاءَ مِنْكُمْ أَنْ يَتَقَدَّمَ أَوْ يَتَأَخَّرَ- كُلُّ نَفْسٍ بِمَا كَسَبَتْ رَهِينَةٌ – إِلَّا أَصْحَابَ الْيَمِينِ – فِي جَنَّاتٍ يَتَسَاءَلُونَ – عَنِ الْمُجْرِمِينَ – مَا سَلَكَكُمْ فِي سَقَرَ – قَالُوا لَمْ نَكُ مِنَ الْمُصَلِّينَ – وَلَمْ نَكُ نُطْعِمُ الْمِسْكِينَ – وَكُنَّا نَخُوضُ مَعَ الْخَائِضِينَ -وَكُنَّا نُكَذِّبُ بِيَوْمِ الدِّينِ – حَتَّى أَتَانَا الْيَقِينُ – فَمَا تَنْفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشَّافِعِينَ – فَمَا لَهُمْ عَنِ التَّذْكِرَةِ مُعْرِضِينَ -كَأَنَّهُمْ حُمُرٌ مُسْتَنْفِرَةٌ – فَرَّتْ مِنْ قَسْوَرَةٍ – بَلْ يُرِيدُ كُلُّ امْرِئٍ مِنْهُمْ أَنْ يُؤْتَى صُحُفًا مُنَشَّرَةً – كَلَّا بَلْ لَا يَخَافُونَ الْآخِرَةَ – كَلَّا إِنَّهُ تَذْكِرَةٌ – فَمَنْ شَاءَ ذَكَرَهُ – وَمَا يَذْكُرُونَ إِلَّا أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ هُوَ أَهْلُ التَّقْوَى وَأَهْلُ الْمَغْفِرَةِ .
অনুবাদ: (মহান আল্লাহ্ তা’য়ালা এরশাদ করেছেন) – হ্যাঁ, হ্যাঁ, চন্দ্রের শপথ, শপথ রাত্রির, যখন পিঠ ফেরায় এবং শপথ প্রভাতকালের, যখন সে আলো বিচ্ছুরিত করে। নিশ্চয় জাহান্নাম খুব বড় বস্তুগুলোর অন্যতম, মানুষের জন্য সতর্ককারী,তাকেই যে চাই তোমাদের মধ্যে অগ্রসর হতে অথবা পেছনে থাকতে, প্রত্যেকে আপন কৃতকর্মের মধ্যে বন্ধকীকৃত, কিন্তু ডান পাশেরগণ (তারা থাকবে) জান্নাতসমূহে। পরস্পরে জিজ্ঞাসাবাদ করবে অপরাধীগণকে,(বলবে-) তোমাদেরকে কিসে জাহান্নামী করেছে? তারা বলবে; আমরা নামাজ পড়তাম না, অভাবগ্রস্তদের আহার্য দিতাম না এবং সমালোচনাকারীদের সাথে সমালোচনা করতাম। আমরা বিচার দিবসকে অস্বীকার করতাম, শেষ পর্যন্ত আমাদের নিকট মৃত্যু এসে পড়েছে। অতএব সুপারিশকারীদের সুপারিশ তাদের কোন উপকারে আসবে না। তাদের কি হল যে, তারা উপদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। যেন তারা ভীত- সন্ত্রস্ত গর্দভ, যারা বাঘ থেকে পলায়ন করেছে বরং তাদের প্রত্যেকেই চায় তাদের প্রত্যেককে একটি উম্মুক্ত গ্রন্থ দেয়া হোক। কখনো নয়, বরং তাদের মধ্যে আখিরাতের ভয় নেই। হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয় তা হচ্ছে উপদেশ। অতএব যার ইচ্ছা সে একে স্মরণ করুক এবং তারা উপদেশ মান্য করবে না। কিন্তু যখন আল্লাহ্ ইচ্ছা করেন তিনিই ভয়ের যোগ্য এবং ক্ষমার অধিকারী।
[সূরা আল – মুদ্দাস্সির, ৩২-৫৬ নম্বর আয়াত]
আনুষঙ্গিক আলোচনা
“ بَلْ يُرِيدُ كُلُّ امْرِئٍ مِنْهُمْ أَنْ يُؤْتَى صُحُفًا مُنَشَّرَةً”
এর শানে নুযূল
উদ্ধৃত আয়াতের শানে নুযূল বর্ণনায় মুফাস্সিরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন- মক্কার কাফের মুশরেকরা রাসূলে কারীম রাউফুর রাহীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে উদ্দেশ করে বলেছিল- আমরা আপনার উপর তখনই ঈমান আনয়ন করবো, যখন আমাদের মধ্যে প্রত্যেকের নিকট প্রত্যেকের নামে পৃথক পৃথক এমন গায়বী কিতাব আগমন করবে যার মধ্যে লিপিবদ্ধ থাকবে- হে অমুক! ঈমান আনায়ন করো। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সত্য নবী। মহান আল্লাহ্ তখনই উদ্ধৃত আয়াতসহ পরবর্তী আয়াত كَلَّا بَلْ لَا يَخَافُونَ الْآخِرَةَ অবতীর্ণ করে বিশ^বাসীর সম্মুখে কাফেরগণের প্রকৃত স্বরূপ উম্মোচন করে দেন। এসব কাফের মুশরিকরা তাদের প্রার্থিত দাবী পূরণ করা হলেও তারা কখনো ঈমান আনয়ন করবে না। কারণ, তাদের অন্তরে পরকালীন জীবন তথা আখেরাতের কোনরূপ ভয়-ভীতি নেই। তাদের দাবী হল মূলত অজুহাত- বাহানা মাত্র। তাদের অন্তরে যদি ভয় থাকতো তবে কখনো তারা আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর ঈমান আনয়ন করতে ইতস্ত কিংবা গড়িমসি করত না। তারা তো রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সত্যতা প্রমাণে প্রাণহীন পাথর-কংকরকে কলেমা পড়তে, আকাশের চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত হতে কিংবা অস্তমিত সূর্যকে পুনরায় আকাশে উদিত হতে দেখেছে রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ইঙ্গিতে। তারপরও তারা ঈমান আনয়ন করেনি।[তাফসিরে নূরুল ইরফান]
كُلُّ نَفْسٍ بِمَا كَسَبَتْ رَهِينَةٌ
উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন – رهينة মানে বন্ধকীকৃত। এ আয়াতের رهينة মানে প্রত্যেকের আটক ও বন্দি হওয়া। জাগতিক জীবনে ঋণের পরিবর্তে বন্ধকী দ্রব্য যেমন মহাজনের হাতে আটক থাকে মালিক তাকে কোন কাজে লাগাতে পারে না, তেমনিভাবে কিয়ামতের দিন প্রত্যেকেই তার গোনাহের বিনিময়ে খোদায়ী সাজায় আটক ও বন্দি থাকবে। কিন্তু “আসহাবুল ইয়ামিন” তথা ডানপাশর্^স্তরা তথা সৎকর্মশীলগণ এ অবস্থা থেকে মুক্ত থাকবে।
[তাফসিরে নূরুল ইরফান]
فَمَا تَنْفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشَّافِعِينَ
আল্লাহ্র পবিত্র বাণী “সুপারিশকারীদের সুপারিশ তাদের কোন উপকার করবেনা।” এর ব্যাখ্যায় মুফাসসিরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন- উদ্ধৃত আয়াতে هُمْ সর্বনাম দ্বারা সেসব অপরাধীকে বোঝানো হয়েছে পূর্ববর্তী আয়াতে যারা নিজেদের চারটি অপরাধ স্বীকার করেছে। প্রথমত তারা নামাজ পড়ত না, দ্বিতীয়ত তারা কোন অভাবগ্রস্ত ফকিরকে আহার্য দিত না, অর্থাৎ ফকিরদের প্রয়োজনে ব্যয় করত না, তৃতীয়ত ভ্রান্ত লোকেরা ইসলাম ও ঈমানের বিরূদ্ধে যেসব কথাবার্তা বলত, অথবা গুনাহ ও অশ্লীল কাজে লিপ্ত হত, তারাও তাদের সাথে তাতে লিপ্ত হত এবং সম্পর্কহীনতা প্রকাশ করত না, চতুর্থত আর তারা কিয়ামত অস্বীকার করত। এসকল অপরাধীর জন্য মূলত কিয়ামতের দিন কেউ তো সুপারিশ করবে না। আবার সকল সুপারিশকারী একত্রিত হয়ে আল্লাহ্র দরবারে তাদের জন্যে সুপারিশ করলেও তা কোন উপকার বয়ে আনবে না, যেহেতু তারা কাফের। কাফের মুশরিকদের জন্যে কিয়ামতের ময়দানে আল্লাহ্র নিকট কাউকে সুপারিশ করার অনুমতি দেয়া হবে না। এসব বিষয়কে সন্দেহাতীতভাবে বুঝানোর জন্য আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামিন شفاعة الشافعين বলে বহুবচন ব্যবহার করেছেন।
মুমিনগণের জন্য সুপারিশকারী অনেক হবেন এবং তাদের সুপারিশে গুনাহগার মুমিনদের নাজাত নিশ্চিত হবে।
উপরোক্ত আয়াতের মর্মবাণীর আলোকে প্রতীয়মান হয় যে, কাফের মুশরিকদের জন্য কারো সুপারিশ উপকারী হবে না। কিন্তু মুমিন গুনাহগার হলেও তার জন্যে সুপারিশকারী অনেক হবেন এবং তাদের সুপারিশে গুনাহগার মুমিনদের নাজাত নিশ্চিত হবে। কুরআনে কারীমের অনেক আয়াত এবং অনেক সহীহ্ হাদীসে প্রমাণিত আছে যে, নবীগণ, ওলিগণ, সৎকর্মপরায়ন কারীগণ এমনকি সাধারণ মুমিনগণও অপর মুমিনের জন্য আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করবেন এবং তা কবুল হবে। তবে কাফেরের জন্য কারো কোন সুপারিশ কাজে আসবে না। সুপ্রসিদ্ধ নির্ভরযোগ্য আকায়েদের গ্রন্থ ‘শরহে আকায়েদে নাসাফী’ তে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখিত আছে-” الشفاعة ثابتة للرسل والأخيار “অর্থাৎ আল্লাহ্র দরবারে মুমিন মুসলিমের জন্যে নবীগণ, ওলীগণ ও সর্বস্তরের সৎকর্মশীলদের সুপারিশ-শাফায়াত করার বিষয়টি কুরআন-হাদীসের অকাট্য ও নির্ভরযোগ্য দলীলের দ্বারা প্রমাণিত। এরপরও নবী-ওলির সুপারিশকে অস্বীকার অপচেষ্টা গোমরাহী বেইমানি বৈ অন্য কিছু নয়। মহান আল্লাহ্ সকল নর-নারীর উপরোক্ত দরসে কুরআনের উপর আমল করে উভয় জাহানে সফলকাম হওয়ার সৌভাগ্য নসীব করুন। আমিন বিহুরমাতে সায়্যিদিল মুরসালিন।