শিক্ষায় প্রভাব বিসত্মারকারী উপাদান
এস এম শাহ মাহমুদ
শিক্ষা একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া । একে প্রতিষ্ঠানের চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যায় না। মানুষ সারা জীবনের অভিজ্ঞতা হতে বিভিন্ন অবস্থা ও পারিপার্শ্বিক প্রেক্ষাপটে ঠকে ঠকে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করে তাকেই বলা ব্যক্তির জন্য শিক্ষা। অর্থাৎ শিক্ষা হল ব্যক্তির জীবনব্যাপী অভিজ্ঞতার সঞ্চয়ন এবং উন্নয়ন। এটা মানব জীবনের সর্বদিকে প্রসারিত। শিক্ষা কখনই সীমিত সময়ে সীমিত পরিবেশের প্রশিক্ষণ হতে পারে না। আমরা পৃথিবীতে যতদিন বেঁচে থাকি ততদিন শিক্ষা গ্রহণ করে থাকি। এজন্যই বলা হয় ‘‘দোলনা থেকে কবর পর্যমত্ম শিক্ষাকাল।’’ কাজেই শিক্ষণ বলতে শুধু ব্যক্তির প্রাতিষ্ঠানিক কিছু অর্জন এমনটি ভাবা ঠিক নয়। কারণ ব্যক্তির জীবনে শিক্ষা প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক উভয় পর্যায় হতেই আসতে পারে।
প্রভাব বিসত্মারণকারী উপাদান
শিক্ষা ব্যক্তি, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে একটি গতিশীল প্রক্রিয়া। আদিকাল হতে শুরু করে অদ্যবধি পর্যমত্ম সমাজ বিবর্তনের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে সমাজের চাহিদা, প্রকৃতি ও ইচ্ছা অনুযায়ী শিক্ষা ব্যবস্থাও পরিবর্তিত, পরিমার্জিত, সংশোধিত হয়ে আসছে। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের আচরণ, ভাবধারা এবং মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটে থাকে। আর যেকোন গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের শিক্ষা ব্যবস্থা তার জাতীয় সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক উপাদান দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। কারণ শিক্ষাধারা সব সময় কোন জাতির সামগ্রিক অবস্থাগত পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে।
শিক্ষা একটি গতিশীল সামাজিক প্রক্রিয়া বলেই এটি পর্যায়ক্রমে পরিবর্তিত হয়। শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন পরিবর্ধনের মাধ্যমেই কোন জাতির সঠিক মূল্যবোধ, মেধাপ্রবণতা এবং সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। কাজেই জাতীয় উন্নয়নের নিমিত্তে সমাজ ব্যবস্থার কাঙ্খিত পরিবর্তন আনয়নে শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্ধন অপরিহার্য। শিক্ষা ব্যবস্থার এই ক্রমপরিবর্তন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে নিম্নোক্ত উপাদান প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রভাবিত করছে। যাদেরকে যেকোন জাতির শিক্ষার প্রভাবক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ধর্ম: মানব সমাজে ধর্ম একটি মৌলিক ও সার্বজনীন প্রতিষ্ঠান। ধর্মের অসিত্মত্ব মানব সমাজে সৃষ্টির আদিলগ্ন হতেই বর্তমান ছিল। মানব সৃষ্টির শুরুতেই ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে। মানুষ স্বাভাবিকভাবেই ধর্মীয় বিধান মেনে চলে। আর এ ধর্মীয় বিশ^াসের মধ্য দিয়েই সৃষ্টি হয় শিক্ষা ধারা- যেখানে গুরুজনের ভূমিকা মুখ্য। শিক্ষাগুরু ধর্মীয় বিশ^াস বাদ দিয়ে শিক্ষাধারা চালু করতে পারে না। কাজেই শিক্ষার উন্নয়নে ধর্মীয় বিশ^াসের ভুমিকা অন্যতম। ব্যক্তির বিশ্বাস, মূল্যবোধ এবং আচরণ ধর্মকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়ে থাকে। কাজেই শিক্ষাকে প্রভাবিত করণে ধর্মের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
ভাষা ও সাহিত্য: ভাষা প্রত্যেক সমাজের নিজস্ব সংস্কৃতি। ভাষা এবং সাহিত্যের সমৃদ্ধির মাধ্যমে মানব সমাজের পরিচিতি ফুটে উঠে। এটি আধুনিক সমাজের শিক্ষার উন্নয়নের একটি বাহক। ব্যক্তির অর্জিত ভাষার মাধ্যমে তার শিক্ষার প্রসার ঘটে। শিক্ষা বাদ দিয়ে কোন জাতি তার নিজস্ব ভাষা এবং সাহিত্যের সমৃদ্ধি আনয়ন করতে পারে না। অন্যদিকে জাতি তার নিজের ভাষা ও সাহিত্যকে বাহন হিসেবে ব্যবহার করে শিক্ষা এবং জীবনযাত্রার উন্নয়ন করতে পারে।
মূল্যবোধ: ব্যক্তির একটি মানসিক সক্রিয়তা হলো মূল্যবোধ। এর মাধ্যমে ব্যক্তি এবং সমাজের কাঙ্খিত আচরণের দৃষ্টিভঙ্গি চিহ্নিত হয়ে থাকে। আর মূল্যবোধের দৃষ্টামত্ম বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। মূল্যবোধের মাধ্যমে সমাজে আচরণ অনুমোদিত হয়ে থাকে। আবার এর মাধ্যমে সামাজিক আচরণ নিন্দিত হয়ে থাকে। আর এ মূল্যবোধের মাধ্যমে ধর্মীয় রীতিতে শিক্ষাধারা প্রভাবিত হয়ে থাকে।
সংস্কৃতি: সংস্কৃতি হল একটি জীবন প্রণালী। অথাৎ যেকোন সামাজিক জীবনযাত্রার বৈশিষ্ট্যর এক অনন্য সমন্বয় হচ্ছে উক্ত সমাজের সংস্কৃতি। আমরা সমাজের সদস্য হিসেবে যা অর্জন করছি তা হলো আমাদের সংস্কৃতি। সমাজের সদস্য হিসেবে ব্যক্তির অর্জিত আচার আচরণ, ব্যবহার জ্ঞান, বিশ^াস, শিল্প কলা, নীতি-প্রথা, আইন ইত্যাদির জটিল সমাবেশই হল সংস্কৃতি। সংস্কৃতি মানুষের জীবনের একটি কাঠামো বা রূপরেখা প্রণয়ন করে। আর শিক্ষা মানুষের জীবনযাত্রার কাঠামোকে উন্নত এবং কাঙ্খিত পর্যায়ে নিয়ে আসে। সুতরাং সামাজিক সংস্কৃতি বাদ দিয়ে শিক্ষার উন্নয়ন চিমত্মা করা যায় না। সংস্কৃতির ধারক বাহক হল শিক্ষা আবার শিক্ষা সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে থাকে। কাজেই শিক্ষা ও সংস্কৃতির সম্পর্ক অতি নিবিড়।
সাংস্কৃতিক সংগঠন: মানব সমাজের সংস্কৃতি ধরে রাখার জন্য সামাজিক উদ্যোগে গঠিত হয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন। এক্ষেত্রে মসজিদ, মাদরাসা, মক্তব, স্কুল, কলেজ এবং বিভিন্ন সমাজসেবী প্রতিষ্ঠান মূখ্য ভুমিকা পালন করে। এগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শিক্ষাকে প্রভাবিত করে। এদের মাধ্যমে ভিন্ন জাতির সংস্কৃতি শিক্ষাধারা নিজের সমাজে প্রবেশ করে।
সভ্যতা: মানব সমাজে সভ্যতা বলতে বুঝায় অগ্রসরমান জটিল সংস্কৃতির একটি সত্মর বা পর্যায়। অর্থাৎ মানুষের ক্রমাগত প্রচেষ্টার ফলে অর্জিত একটি সাফল্য। নতুন নতুন আবিষ্কার প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সভ্যতাকে করেছে দিনে দিনে মাধুর্যমন্ডিত, যা মানব জীবনে এনে দিয়েছে আনন্দময় জীবনের প্রতিশ্রম্নতি। কাজেই শিক্ষা যেমন সভ্যতার বিকাশ ঘটায়, তেমনি মানব সমাজে সৃষ্ট নানামুখী সভ্যতা শিক্ষার ক্রমোন্নয়নকে প্রভাবিত করেছে। ফলে শিক্ষা আজ বহু ধারায় বিভক্ত হয়ে জ্ঞান ভান্ডারকে বহুমুখী করেছে।
সিনিয়র শিক্ষক (বিজ্ঞান)
কাদেরিয়া তৈয়্যেবিয়া কামিল মাদরাসা