শরীয়তের দৃষ্টিতে মাতা-পিতার মর্যাদা

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

শরীয়তের দৃষ্টিতে মাতা-পিতার মর্যাদা
মুহাম্মদ ইসমাঈল হোসেন

সকল প্রসংশা মহান আল্লাহর জন্য। তিনিই সর্বশক্তিমান সার্বভৌম ক্ষমতা তাঁরই। ইসলামী শরীয়তে হক তিন প্রকার। যথা- হক্কুল্লাহ, হক্কুন ওয়ালিদাইন ও হক্কুন নাস। সমত্মানের সবচেয়ে গভীর, ঘনিষ্ঠ ও নিবিড় সম্পর্ক হল তার পিতা-মাতার সাথে। কুরআন ও হাদিসে আল্লাহর পরেই পিতা-মাতার হকের কথা বলা হয়েছে। দুনিয়ায় মানব অসিত্মত্বের মূলে রয়েছে দুটো বিষয়। একটি মূল কারণ, তা হল মহান আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন বলে পৃথিবীতে মানবের অসিত্মত্ব লাভ সম্ভব হয়। দ্বিতীয়টি হলো বাহ্যিক কারণ, তা হলো পিতা-মাতা। আসল স্রষ্টা মহান আল্লাহ কিন্তু পিতা-মাতার মাধ্যমেই পৃথিবীতে জন্ম নিয়ে থাকে। এই জন্য পবিত্র কুরআন, হাদিস থেকে পিতা-মাতার মর্যাদা প্রসঙ্গে আলোকপাত করা হয়েছে।
পবিত্র কুরআনের আলোকে:
আল্লাহ তায়ালা মা-বাবার প্রতি সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিয়ে ইরশাদ করেন-
وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَاناً
অর্থাৎ- ‘‘আপনার রব নির্দেশ দিয়েছেন যেন তোমরা তিনি ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত না করো এবং যেন মা-বাবার প্রতি সদ্ব্যবহার করো’’। পিতা-মাতার সাথে সদয় ও সহানুভূতিপূর্ণ আচরণ কর, সেবা-যত্ন কর। তারা বার্ধক্যে উপনীত হলে কোন রূঢ় ও কর্কশ কথা বলো না এবং ধমক মেরো না। তাদের সেভাবে সেবা-যত্ন করা উচিত যেভাবে তারা শিশুকালে তোমার সেবাযত্ন করেছেন। তোমার মনে রাখা দরকার, প্রথমে তারা নিঃস্বার্থভাবে তোমার সেবা-যত্ন করে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন। এখন তাদের যত্ন নিলেও তুমি তাদের সমান হতে পারবে না। কারণ শৈশবে তারা নানা যন্ত্রণা ভোগ করেও সেবা-যত্ন করে তোমার দীর্ঘ জীবন ও সুস্থতা কামনা করেছেন। আল্লাহ পাক আরো বলেন-
أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيرُ
অর্থাৎ- ‘‘তুমি আমার কাছে কৃতজ্ঞ হও এবং তোমার মাতা-পিতার কাছেও কৃতজ্ঞ হও। আমারই নিকট তোমাকে ফিরে আসতে হবে’’। এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, আল্লাহ পাক কিভাবে মাতা-পিতার প্রতি কৃতজ্ঞতাকে তাঁর কৃতজ্ঞতার সাথে সংযুক্ত করেছেন।
হযরত ইবনে আববাস (রা:) বলেন- ‘‘তিনটি আয়াত তিনটি বিষয়ের সাথে পরষ্পর যুক্ত হয়ে অবতীর্ণ হয়েছে। এর একটি অন্যটি ছাড়া গ্রহণযোগ্য নয়।’’ প্রথমটি আল্লাহ পাক বলেন واطيعو الله واطيعو الرسول ‘‘তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর।’’ অতএব যে লোক আল্লাহকে মানবে অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মানবে না, আল্লাহর প্রতি তার আনুগত্য গ্রহণ করা হবে না। দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন واقيموا الصلوة واةوا الزكوة ‘‘নামায কায়েম কর এবং যাকাত প্রদান কর।’’ যে লোক নামায পড়বে কিন্তু যাকাত দেবে না, আল্লাহ তার নামায কবুল করবেন না। তৃতীয় আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন ان اشكرلى ولوالديك ‘‘সুতরাং তুমি আমার কাছে কৃতজ্ঞ হও এবং তোমার মাতা-পিতার কাছেও কৃতজ্ঞ হও।’’ যে লোক কেবল আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপন করবে, কিন্তু মাতা-পিতার প্রতি কৃতজ্ঞ হবে না (সদয় আচরণ করবে না), আল্লাহর প্রতি তার শুকরিয়া জ্ঞাপন অগ্রহণীয়- অর্থহীন। এজন্যই নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-
رضا الرب فى رضى الوالد وسخط الرب فى سخط الوالد
‘‘মাতা-পিতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি এবং মাতা-পিতার অসমেত্মাষে মহান আল্লাহর অসন্তুষ্ট নিহিত রয়েছে।
কুরআন শরীফের অন্যত্র মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার বজায় রাখার জন্য জোর তাগিদ ও নির্দেশ দেয়া হয়েছে- وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفاً এবং পৃথিবীতে তাঁদের সাথে উত্তম ব্যবহার কর।

মহান আল্লাহ তায়ালা মাতা-পিতার সীমাহীন দুঃখ-কষ্টের কথা স্মরণ করিয়ে তাঁদের প্রতি সদ্ব্যবহারের নির্দেশ প্রদান করে ইরশাদ করেন-
وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ إِحْسَانًا حَمَلَتْهُ أُمُّهُ كُرْهًا وَوَضَعَتْهُ كُرْهًا وَحَمْلُهُ وَفِصَالُهُ ثَلَاثُونَ شَهْرًا
অর্থাৎ- ‘‘আমি মানবজাতিকে নির্দেশ দিয়েছি, তারা যেন আপন মাতা-পিতার সাথে সদাচরণ করে। তার মাতা তাকে বহু কষ্টের বিনিময়ে গর্ভে ধারণ করেছেন এবং বহু কষ্ট সহ্য করে তিনি তাকে প্রসব করেছেন এবং তাকে লালন করেছেন (গর্ভাবস্থায় বোঝা বহন করে) এবং দুধ পান করান ত্রিশ মাস পর্যমত্ম’’।
পিতা-মাতার সহিত সদাচরণের ব্যাপারটা কেবল বৈধ গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ হওয়া উচিত। কারণ, এমন যাতে না হয় যেন তাঁদের মনোরঞ্জনের জন্য কোন ভুল এবং শরীয়ত বিরোধী পদক্ষেপও বৈধ মনে করা হয়।
পবিত্র হাদিসের আলোকে:
হাদিস নং ০১ঃ
আল্লাহর হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-
عن أبى امامة رضى الله عنه أن رجلا قال يا رسول الله ما حق الوالدين على ولدهما قال هما جنتك ونارك
অর্থাৎ- হযরত আবু উমামা (রা:) হতে বর্ণিত, এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! সমত্মানের উপর তাদের পিতা-মাতার অধিকার কী? উত্তরে তিনি বললেন, তারা উভয়ই হচ্ছে তোমার জান্নাত এবং জাহান্নাম।
হাদিস নং ০২ঃ
عن عبد الله بن عمرو قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من الكبائر ان يشتم الرجل والديه قالوا يا رسول الله هل يشتم الرجل والديه قال نعم يسب ابا الرجل فيسب اباه ويشتم امه (بخارى مسلم ترمذى)
অর্থাৎ- হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদন করেন, কবীরা গুনাহসমূহের মধ্যে এটাই অন্যতম যে, নিজ মাতা-পিতাকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করা। সাহাবাগণ আরয করেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! মানুষ কি নিজ মাতা-পিতাকে গালি দেয়? তিনি প্রত্যুত্তরে বলেন, হ্যাঁ। যে ব্যক্তি অন্যজনের মাতা-পিতাকে গালি প্রদান করে, সে যেন নিজ মাতা-পিতাকে গালি গালাজ করল।
হাদিস নং ০৩ঃ
عن ابى هريرة رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ثلثة دعوات مستجابات لاشك فيهن- دعوة المظلوم ودعوة المسافر ودعوة الوالد على لولده- (ترمذى)
অর্থাৎ- হযরত আবু হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- তিন প্রকারের দু’আ আল্লাহ তায়ালার দরবারে নিঃসন্দেহে গ্রহণযোগ্য। ১। মজলুমের (নির্যাতিত) বদ দু’আ, ২। মুসাফিরের বদ দু’আ, ৩। স্বীয় সমত্মান-সন্তুতির জন্য মাতা-পিতার বদ দু’আ।
সুতরাং প্রত্যেক সমত্মান-সন্তুতির পক্ষে এমন আচার-আচরণ থেকে বিরত থাকা উচিত, যার কারণে পিতা-মাতা স্বীয় ছেলে মেয়দের প্রতি বদদু’আ প্রদান করতে বাধ্য হন এবং যতদূর সম্ভব পিতা-মাতাকেও তাদের প্রতি বদদুআ করা থেকে বিরত থাকা উচিত।
হাদিস নং ০৪ঃ
عن ابن عباس رضى الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال مأ من ولد بار ينظر رحمة الا كةب الله له بكل نظرة حجة مبرورة قالوا وان كل يوم ماة مرة قال نعم الله اكبر واطيب (رواه البيهقى فى شعب الايمان ومشكوة)
অর্থাৎ- হযরত আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রা:) হতে বর্ণিত, হুজুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেছেন, যে নেক্কার ছেলে নিজ মাতা-পিতার প্রতি রহমত ও আমত্মরিকতার দৃষ্টিতে একবার তাকাবে, আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক দৃষ্টির বিনিময়ে তার জন্য একটি মাবরুর হজ্বের (মকবুল হজ্বের! ছওয়াব লিপিবদ্ধ করবেন। সাহাবাগণ আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি উক্ত ব্যক্তি দৈনন্দিন একশত বার তাকায়, তাহলে? তিনি উত্তরে বলেন, হ্যাঁ! আল্লাহ তায়ালা সুমহান ও বড় করুণাময়।
হাদিস নং ০৫ঃ
عن عبد الله بن عمرو رضى الله عنهما قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم الكبائر الاشراك بالله وعقوق الوالدين وقتل النفس واليمين الغموس- (رواه البخارى)
অর্থাৎ- হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর (রা:) হতে বর্ণিত, রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- ১. আল্লাহর সাথে অংশীদার সাব্যসত্ম করা। ২. মাতা-পিতাকে অমান্য করা। ৩. অকারণে কোন জীবকে হত্যা করা এবং ৪. মিথ্যা শপথ করা, কবীরা গুনাহসমূহের মধ্যে অন্যতম।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- لايدخل الجنة عاق ولا منان ولامدمن خمر
অর্থাৎ- মাতা-পিতার অবাধ্যচারী সমত্মান, উপকার করে খোটাদানকারী এবং মদখোর বেহেশতে যাবে না।’’ আর এক বর্ণনায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- ‘‘আহ বা উহ করার চেয়েও কম কষ্টদায়ক শব্দ যদি থাকতো, তবে আল্লাহ পাক তাও করতে বারণ করতেন। অতএব পিতা-মাতার অবাধ্যচারী যতই ভাল কাজ করুক না কেন, জান্নাতে যেতে পারবে না; আর পিতা-মাতার একামত্ম বাধ্যজন যা-ই করুক না কেন, জাহান্নামে যাবে না।’’
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন لعن الله العاق لوالديه ‘‘মাতা-পিতার অবাধ্যচারীর প্রতি আল্লাহ পাক অভিসম্পাত করেছেন।’’ তিনি আরো বলেন-
لعن الله من سب امه * لعن الله من سب اباه
‘‘যে লোক পিতাকে গালি দেয়, আল্লাহ তাকে অভিসম্পাত করেন, যে লোক মাকে গালি দেয় আল্লাহ তাকে অভিসম্পাত করেন।
আর এক হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
كل الذنوب يؤخر الله منها ما شاء الى يوم القيمة الا عقوق الوالدين فانه يجعل لصاحبه
অর্থাৎ- আল্লাহ পাক সমসত্ম গুনাহের শাসিত্ম কিয়ামত পর্যমত্ম ঝুলিয়ে (স্থগিত) রাখেন। কিন্তু পিতা-মাতার সাথে অসদাচারণ এর বিপরীত- আল্লাহ এর প্রতিফল অবিলম্বেই কার্যকর করেন। অর্থাৎ- কিয়ামতের আগে ইহজীবনেই তার শাসিত্ম দেয়া হয়। একবার হযরত ইবনে ওমর (রা:) দেখতে পেলেন, এক লোক তার মা-কে পিঠে নিয়ে আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করছে। অনমত্মর সে লোক জিজ্ঞেস করলোঃ ওহে ইবনে ওমর, আপনি কি মনে করেন, আমি মাকে নিয়ে এভাবে তাওয়াফ করায় তাঁর কিছু ঋণ পরিশোধ করতে পারলাম? ইবনে ওমর (রা:) বললেন, তোমাকে গর্ভে ধারণ করা কালীন সময়ের নানাবিধ যাতনার একটির ঋণও শোধ করতে পারনি। তবে তুমি ভাল কাজ করেছ, তোমার এ অল্প কাজেই আল্লাহ তোমাকে বহু পুণ্য দেবেন। নবীজী আরো বলেন- الجنت تحت اقدام الامهات ‘‘মায়ের পায়ের নিচে সমত্মানের বেহেশত’’।
‘‘তাবরানী’’ শরীফের মধ্যে বর্ণিত আছে, এক ব্যক্তি আরজ করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি জিহাদ করব। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার মা কি জীবিত আছে? লোকটি বলল- হ্যাঁ জীবিত আছেন। হুযুর অকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন- الزم رجليها فثم الجنة ‘‘তুমি তোমার মায়ের পদতলে পড়ে থাক (অর্থাৎ তাঁর খেদমতে নিয়োজিত থাক), এখানেই তোমার বেহশেত।
হযরত মুসা (আ:) ও এক কসাইয়ের কাহিনীঃ
একদা হযরত মুসা (আ:) আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন- ইয়া আল্লাহ! বেহেশতে যে ব্যক্তি আমার বন্ধু হবেন আপনি আমাকে তার সঙ্গে সাক্ষাত করে দিন। আল্লাহ রাববুল আলামীন বললেন, হে মুসা! অমুক শহরের অমুক বাজারে গিয়ে দেখ, এইরূপ চেহারার এক কসাই পাবে, সে ব্যক্তিই বেহেশতে তোমার বন্ধু হবেন। এই নির্দেশ পেয়ে হযরত মুসা (আ:) বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন এবং যথাসময়ে নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হয়ে মাগরিবের নামাযের সময় পর্যমত্ম দাড়িয়ে থেকে ঐ কসাইয়ের অবস্থা অবলোকন করলেন। তিনি দেখলেন, ঐ কসাই সন্ধ্যার সময় কিছু গোশত একটি বেগের ভিতরে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলেন। হযরত মুসা (আ:) ঐ কসাইকে বললেন- ওহে! তুমি কি আমাকে তোমার বাড়িতে মেহমান হিসেবে নিতে পার? তিনি বললেন হ্যাঁ, অতঃপর তিনি তার সঙ্গে তার বাড়িতে গেলেন। ঘরে পৌঁছে কসাই তার গোশত গুলি রান্না করল এবং ঘরের একস্থানে ছোট্ট একটি থলে হতে কবুতরের বাচ্চার মত অতি জীর্ণশীর্ণ এক বৃদ্ধাকে বাহির করে চামচের সাহায্যে তাকে গোশতের শুরবা তথা জোল খাওয়ালেন। হাত, পা মুছে, কাপড়-চোপর ধৌয়ে শুকিয়ে দিলেন। সেই বৃদ্ধা অন্য কেউ নন, তিনি হলেন তার মা। বৃদ্ধা মা ঠোঁট নেড়ে অস্পষ্ট স্বরে কি যেন বললেন তারপর আবার বৃদ্ধা মাকে থলের মধ্যে রেখে একটি পেরেকের সাথে ঝুলে দিলেন। হযরত মুসা (আ:) লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন- বৃদ্ধা ঠোঁট নেড়ে কি যেন বললেন, তুমি কি তা বুঝতে পেরেছো? তিনি বললেন- বৃদ্ধা তথা আমার মা এই বলে দোয়া করলেন যে, হে আল্লাহ! তুমি আমার পুত্রকে বেহেশ্তে মুসা নবীর সঙ্গী কর। হযরত মুসা (আ:) বললেন- এই বিষয়ের তাৎপর্য তো আমি কিছুই বুঝলাম না। তিনি বললেন- ইনি আমার জননী। বার্ধক্যের কারণে তিনি এত বেশি দুর্বল হয়ে পড়লেন। কোন রকম ওঠা- বসা ও চলাফেরা করার শক্তি তার নেই।
সুতরাং আমি এভাবে তার খেদমত করি এবং তাকে খাওয়াই ও পরাই থাকি। এই সব শুনে হযরত হযরত মুসা (আ:) নিজেই নিজের পরিচয় বর্ণনা করলেন। বললেন ধন্যবাদ তোমাকে, আমিই মুসা (আ:) আর তুমিই বেহেশ্তে আমার সঙ্গী হবে।
মৃত্যুর পর মাতা-পিতার হক্বঃ
একদা জনৈক আনসারী সাহাবী (রা:) নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে আরয করেন, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! মাতা-পিতার তিরোধানের পর তাঁদের সাথে সদাচরণ করার কোন পন্থা বাকী আছে কী? নবীজী বলেন- হ্যাঁ, চারটি পন্থা রয়েছে, তাঁদের জন্য নামায পড়া, তাঁদের জন্য দুআ করা ও ক্ষমা প্রার্থনা করা, তাঁদের তিরোধানের পর তাঁদের প্রতিশ্রম্নত ওসীয়ত কার্যকর করা, তাঁদের বন্ধুমহলের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান করা, শুধুমাত্র তাঁদের পক্ষ হতে যারা আত্মীয় হিসেবে মনোনীত, তাঁদের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখা, তাঁদের তিরোধানের পরও তাঁদের সাথে সদ্ভাব বহাল রাখা। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন- ‘‘যে ব্যক্তি প্রতি শুক্রবার (জুমাবার) একবার নিজ মাতা-পিতা উভয়কে কিংবা কোন একজনের কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে হাজির হবে, আল্লাহ তায়ালা তার পাপ ক্ষমা করবেন এবং তাকেও মাতা-পিতার সাথে সদাচরণকারী হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হবে’’।
উলামায়ে কেরামের মতে পিতা-মাতার হকঃ
মনীষীগণ বলেন, সমত্মানের উপর মা-বাবার প্রতি যে সকল অধিকার রয়েছে তন্মধ্যে কিছু সংখ্যক দেওয়া হলো-
1. প্রয়োজনীয় ভরণ-পোষণের সু-ব্যবস্থা করণ।
2. প্রয়োজনে তাঁদের সেবা-যত্ন করা।
3. তাঁদের আহবানে বিনয়ের সাথে সাড়া দেয়া।
4. শরী’আত সম্মত আদেশ-নিষেধ পালন করা।
5. তাঁদের সাথে বিনয় ও বিনম্র ভাষায় কথা বলা।
6. প্রয়োজনীয় পোশাক-পরিচ্ছদ সরবরাহ করা।
7. পথ চলাকালে তাঁদেরকে সামনে রেখে নিজে পেছনে চলা ।
8. নিজের পছন্দনীয় বিষয়গুলো তাঁদের জন্যও পছন্দ করা।
9. আপন অপ্রিয় বিষয়গুলো তাঁদের জন্যও অপ্রিয় মনে করা।
10. নিজের জন্য মহান আল্লাহর দরবারে মুনাজাতকালে তাঁদের পাপ মোচনের জন্যও দু’আ করা।
সামাজিক আচার-আচরণের ক্ষেত্রে ইসলামের একটি মৌলিক শিক্ষা হল, বয়সে যে ছোট সে তার বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করবে এবং বড়রা ছোটদের প্রতি স্নেহ করবে। কারণ রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-
ليس منا من لم يرحم صغيرنا ولم يوقر كبيرنا
অর্থাৎ- যারা ছোটদের প্রতি দয়া করে না এবং বড়দের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে না তারা আমাদের দলভুক্ত নয়।
উপদেশঃ পিতা-মাতা যদি অন্যায়ভাবেও কষ্ট দেয় তবুও তাঁদেরকে কষ্ট দেবে না। কথায়, কাজে এবং ব্যবহারে তথা জীবনের সর্ব অবস্থায় তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করবে। পিতা-মাতা কাফির হলেও প্রয়োজনে তাঁদের ভরণ পোষণের ব্যবস্থা করবে। পিতা-মাতা মারা গেলে তাঁদের জন্য দু’আ করবে এবং তাঁদের আত্মার প্রতি ইসালে সাওয়াব করবে। তাঁরা ঋণ করে গেলে তাঁদের ঋণ পরিশোধ করবে এবং তাঁদের জায়িয অসিয়্যত পূর্ণ করবে।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment