জিজ্ঞাসাঃ
আহলে হাদীস নামধারী লা-মাযহাবী মুসলমানদের সম্পর্কে ইসলামী শরী‘আতের রায় কি ? শরী‘আতে মাযহাব অনুসরনের গুরুত্ব কতটুকু ?
জবাবঃ
বর্তমান ইলমী কমযোরী ও প্রবৃত্তি পূজার যামানায় সকল মুসলমানদের জন্য ইমাম চতুষ্টয়ের যে কোন এক ইমামের তাক্বলীদ করা অর্থাৎ চার মাযহাব সমূহের কোন এক মাযহাবের অনুসারী হওয়া ওয়াজিব । বর্তমানে শরী‘আতের উপর চলার আর কোন বিকল্প নেই । বাস্তব প্রমাণে দেখা গিয়ছে যে, যারা কোন ইমামের অনুসরণ না করে নিজেরা সরাসরি কুরআন-হাদীস বুঝে আমল করতে তৎপর হয়েছেন, তারা শেষ পর্যন্ত আল্লাহর গোলামীর পরিবর্তে নিজের নফস বা মনের গোলামী করে শরী‘আত বিবর্জিত পথে পরিচালিত হয়েছেন । মাযহাব মানা জরুরী হওয়ার কারণ হল- পবিত্র কুরআন মানুষের হিদাআতের নিমিত্তে প্রকৃত মূল কিতাব । এর ব্যাখ্যার জন্য আল্লাহপাক রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে প্রেরণ করেছেন ।তাই রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর গোটা জীবনাদর্শ তথা তার সকল কথা ও কাজ কুরআন মাজীদের ব্যাখ্যা স্বরূপ । ঈমাম শাফি‘ঈ (রাহঃ) বলেন, “যদি রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কথা ও কাজ আমাদের মধ্যে বিদ্যমান না থাকত, তবে কারো পক্ষে কুরআন বুঝা সম্ভবপর ছিল না । উদাহরণস্বরূপ কুরআনে নামাযের নির্দেশ এসেছে । কিন্তু কোন ওয়াক্ত কত রাকা‘আত ? এর ব্যাখ্যা কুরআনে দেওয়া হয়নি । হাদীসে এর ব্যাখ্যা এসেছে । অনুরূপভাবে যাকাত প্রদানের নির্দেশ এসেছে । কিন্তু কি মালের কি পরিমাণ যাকাত কতদিন মাল হাতে থাকলে দিতে হবে ? এসবের ব্যাখ্যা কুরআনে দেওয়া হয়নি । হাদীসে এর ব্যাখ্যা এসেছে । সে ব্যাখ্যা অনুযায়ী মুসলমানগণ আমল করে আসছেন ।
তবে এখানে যে বিষয়টি লক্ষণীয়, তা হলো-আমলী হুকুমের ব্যাপারে প্রায় ক্ষেত্রেই এমন একাধিক হাদীস বিদ্যমান, যে সবের ভাবধারা বাহ্যতঃ পরষ্পর বিরোধী । এর কারণ হল- শরী‘আতের হুকুম-আহকাম সবগুলো একত্রে নাযিল হয়নি । বরং তখন মানুষের ক্রমানুগতিতে ইসলাম গ্রহণ ও আমলী দৃঢ়তা অর্জনের প্রেক্ষিতে হুকুম-আহকাম পর্যায়ক্রমে ধীরে ধীরে নাযিল হয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে । যেমন- ইসলামের প্রথম যুগে নামাজ পাঁচ ওয়াক্ত ছিল না । আবার যা ছিল তাও দু’ রাকা‘আত করে ছিল । উপরন্তু তখন নামাযের ভিতর কথা-বার্তা বলা জায়িয ছিল । অতঃপর পর্যায়ক্রমে হুকুম নাযিল হয়ে পরিবর্তিত হতে থাকে । শেষ পর্যন্ত পূর্বের হুকুম রহিত হয়ে বর্তমান স্বরূপে এসে পৌঁছে । তেমনিভা্বে হিযরতের পরে প্রথম যখন রোযার হুকুম নাযিল হয় তখন রোযা রাখা অবধারিত ফরয হিসেবে সাব্যস্ত ছিল না । বরং তখন রোযা না রেখে এক একটি রোযার পরিবর্তে একজন করে মিসকীনকে দু’বেলা খানা খাওয়ানোরও অনুমতি ছিল । অতঃপর পরবর্তীতে রোযা রাখাকেই অবধারিত ফরজ ঘোষণা করে পূর্বের হুকুম রহিত করা হয় । এমনিভাবে বিভিন্ন হুকুম-আহকামে পর্যায়ক্রমে রদবদল হলো, কোনটা আগের কোনটা পরের এবং কোন হাদীস সর্ব বিবেচনান্তে আমলের অধিক যোগ্য এ পরবর্তী যামানায় সকল বিষয়ের সমাধান করা অত্যন্ত কঠিন কাজ ও দুঃসাধ্য ব্যাপার । এসব বিষয়ে যে সকল আহলে ইলমগণ সমাধান দিয়ে গেছেন, তাদের মধ্যে অনেক মত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় ।
এ অবস্থায় এখন কি সকলেই নিজেদের ইচ্ছামাফিক মত গ্রহণ করে আমল করবে, না রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিকটবর্তী যামানার কোন বিশেষ জ্ঞানসম্পন্ন অধিক নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিত্বের গবেষণার ভিত্তিতে ফয়সালার উপর আমলকারী হবে ? নিজের ইচ্ছামত আমল গ্রহণ করলে তা তো শরী‘আত পালন হলো না বরং নিজের নফসের গোলামীই করা হয় । তাই এ সকল মতভেদ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমল করতে হবে নিশ্চই কোন যোগ্য মুজতাহিদ আহলে ইলমের গবেষণালব্ধ পথ অবলম্বন করে । তাই এখন সেই নির্ভরযোগ্য মুজতাহিদ আহলে ইলমকে বেছে বের করতে হবে । এ ব্যাপারে চার মাযহাবের মুজতাহিদ ইমামগণ উলামায়ে উম্মাতে মুহাম্মদীর নযরে সর্বসম্মতিক্রমে যোগ্য মুজতাহিদ আহলে ইলম হিসেবে গ্রহণীয় হয়েছেন । কারণ-প্রথমতঃ তারা যামানায়ে রিসালাতের নিকটতম ইলমী জোয়ারের সমসাময়িক ব্যক্তিত্ব ছিলেন । দ্বিতীয়ত তারা প্রত্যেকেই মজতাহিদে কামিল, পবিত্র কুরআন-হাদীস ও ইজমা সম্পর্কে অনন্য গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন । তাঁদের যুগে তাঁদের পরবর্তী যুগ হতে বর্তমান যুগ পর্যন্ত তাদের মত কুরআন ও হাদীসে পারদর্শী মুজতাহিদ দ্বিতীয় আর পয়দা হয়নি । তাই তাদের গবেষণা ইজতিহাদে নির্ণীত কুরআন-হাদীসের সার-আমলই পরবর্তী সকল মুসলমানদের জন্য পালনীয় সাব্যস্ত হয়েছে । তাঁরা আজীবন গবেষণা করে ইসলামের নিয়ম-নীতির যে রূপরেখা উপস্থাপন করেছেন, তা সকলের নিকট গ্রহণীয় হিসেবে স্থির পেয়েছে । তারা হুকুম-আহাকাম ও মাসায়িলের ব্যাপারে এমন কতগুলো মূলনীতি নির্ধারণ করেছেন যে, সেগুলোর নিরিখে কিয়ামত পর্যন্ত উদ্ভুত সকল মাসায়িলের সমাধান করা যেতে পারে । এজন্য মুতাআখখিরীন উলামায়ে কিরামগণ এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে, ইমাম চতু্ষ্টয়ের পরবর্তী যামানার লোকদের জন্য তাঁদের যে-কোন এক ইমামের তাক্বলীদ (অর্থাৎ তার গবেষণার ভিত্তিতে শরয়ী হুকুম-আহকাম পালন করা ওয়াজিব । এ কারণেই বর্তমান চার মাযহাবের মধ্য হতে কোন এক মাযহাবের তাক্বলীদ ও অনুসরণ ওয়াজিব।)
অতএব, বর্তমানে এরূপ যারা মাযহাব বর্জন করে সরাসরি কুরআন-হাদীস বুঝে আমল করতে তৎপর হবেন, তারা নিজ প্রবৃত্তির অনুসারী সাব্যস্ত হবেন । আহলে হাদীস নামধারী লোকেরা কিভাবে শুধু কুরআন-হাদীসের যাহিরী বিষয়বস্তুর উপরে আমলকারী হতে চান, আমাদের তা বোধগম্য নয় । কারণ- বর্তমান আধুনিক যামানায় এমন অনেক বিষয়ের উদ্ভব হয়েছে, যার হুকুমের ব্যাপারে প্রত্যক্ষ উল্লেখ কুরআন-হাদীসের কোথাও নেই । যেমন উড়োজাহাজে নামায পড়া যাবে কি-না ? বীমা ইন্সুরেন্স জায়িয হবে কি-না ? এ ধরনের প্রচুর বিষয় রয়েছে । অতএব এ সকল মাসাইলের ব্যাপারে আইম্মায়ে মুজতাহিদীনগণের উসূলভিত্তিক ও গবেষণালব্ধ ফায়সালা মেনে নেওয়া ব্যতিরেকে গত্যান্তর আছে কি ? তাই নফসানী খাহিশাতের ইত্তিবা না করে কোন এক মাযহাব গ্রহণ করে নেয়াই কর্তব্য । নতুবা শরী‘আত মানার নামে নিজের নফসের গোলামী করা হবে-যা গোমরাহীর পথ তা কখনোও কাম্য নয় । কারণ মানুষ স্বাভাবিকতঃ যেটা সহজ, যা তার স্বার্থের অনুকূলে সেটাকেই গ্রহণ করতে চেষ্টা করে । বর্তমানে আহলে হাদীসগণ তাই করে আসছে । চার মাযহাবের কোন মাযহাবের অনুসারী নন বলে তারা ওয়াজিব তরককারী হয়েছেন এবং বর্তমান যামানার আহলে হাদীসগণ আকাবীরগণকে গালী গালাজ ও মুকাল্লিদীনদের প্রতি কুধারণা রাখার কারণে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত থেকে খারিজ । তবে তারা ইসলামের গন্ডি বহির্ভূত বলে পরিগণিত হবেন না । [আহসানুল ফাতাওয়া ১ : ৪১১]
অধুনা আরেক শ্রেণীর আধুনিক আলেমের আবির্ভাব ঘটেছে । তাদের দাবী-তাক্বলীদ তো করতে হবে । কিন্তু কোন এক ইমামের তাক্বলীদ করতে হবে, এটা কোন জরুরী নয় । বরং তাদের রিসার্চ ও গবেষণা অনুযায়ী যে মাসআলায় যে ইমামের মত গ্রহণযোগ্য বলে মনে হবে, সেটাই তারা গ্রহণ করবেন । নির্দিষ্ট কোন ইমামকে তারা মানতে প্রস্তুত নন । গভীর ভাবে চিন্তা করলে এদের মধ্যে আর আহলে হাদীসদের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য দেখা যায় না । শুধু নামের পার্থক্য । কারণ, তাদের এ মতের কারণে অনেক ক্ষেত্রে শরী‘আতের ইত্তেবার নামে নফসের গোলামীর শিকার হওয়ার প্রবল আশংকা রয়েছে । যেমন ধরুন-উযু করার পরে কারোর শরীর দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হল, তিনি বললেন- যে, যদিও ইমাম আবূ হানিফার (রহঃ) মাযহাবে এতে উযু ভঙ্গ হয়ে যায় । কিন্তু এ ব্যাপারে আমার নিকট ইমাম শাফিয়ী (রহঃ)-এর মাযহাব নির্ভরযোগ্য মনে হয় । সুতরাং তিনি উযু করলেন না । কিছুক্ষণ পরে কোন কারণ বশতঃ কোন বেগানা মহিলাকে স্পর্শ করে ফেললেন এবং মন্তব্য করলেন যে যদিও এতে ইমাম শাফিয়ী (রহঃ)-এর মাযহাবে উযু নষ্ট হয়, কিন্তু এ ব্যাপারে ইমাম আবূ হানিফা (রহঃ)-এর মাযহাব আমার নিকট নির্ভরযোগ্য মনে হয় ।
সুতরাং এক্ষেত্রেও তিনি উযু না করে বেঁচে গেলেন এবং নামায আদায় করলেন । এখন যদি উভয় ইমামের নিকট এ ব্যক্তির নামায সম্পর্কে ফাতাওয়া চাওয়া হয়, তাহলে নিশ্চয় উভয় ইমাম এই ফাতাওয়া দিবেন যে, ঐ ব্যক্তি বিনা উযুতে নামায পড়েছে । সুতরাং তার নামাযই হয় নি । অথচ ঐ ব্যক্তি দাবী করছে যে, সে উভয় ইমামকে মান্য করেছে এবং মাযহাব মতে নামায পড়েছে । তাই নির্দিষ্ট কোন এক ইমামের ইকতিদাই জরুরী ।{فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ} [النحل : 43[
[প্রমাণঃ ইমদাদুল মুফতীন, ১ : ১৫১ # জাওয়াহিরুল ফিকহ, ১ : ১২৭ # কিফায়াতুল মুফতী ১ : ৩২৫]