তাজেদারে মদিনা রাহমাতুল্লিল আলামীন হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিরাজ বা নবমণ্ডলের ভ্রমণ একটি বিস্ময়কর ঘটনা। এই ঘটনা পবিত্র কোরআন ও হাদিস দ্বারা সত্য প্রমাণিত। পরিত্র কোরআনে ‘ইসরা’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। ‘ইসরা’ শব্দের অভিধানিক অর্থ রাতে ভ্রমণ। রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে ভ্রমণ করেছিলেন বলেই তাকে ‘ইসরা’ বলা হয়েছে। নবমণ্ডলের ভ্রমণকে ‘মেরাজ’ বলে রাসুলে পাক হাদিস শরীফে বর্ণনা করেছেন। মেরাজ উরুজ ধাতু হতে নির্গত। অর্থ উন্নতি বা উর্ধ্বে উঠা। আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় হাবীবকে উর্ধ্বেজাহানে আরোহণ করিয়েছেন বলেই এই ভ্রমণকে মিরাজ বলা হয়।
ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় মসজিদুল হারাম হতে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত সফরকে ‘ইসরা’ এবং মসজিদুল আকসা হতে আরশে আজিমে সফরকে মিরাজ বলা হয়। (সূত্রঃ নাদরাতুন না’ঈম আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মতে রাসুল সাল্লাল্লাহহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিরাজ স্বপ্নে বা আধ্যাত্মিকভাবে সংঘটিত হয়নি, সশরীরে জাগ্রত অবস্থায় হয়েছে। দলিল হিসেবে পবিত্র কোরআনের বর্ণিত আয়াত, “পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদুলু হারাম হতে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত” (সূরাঃ ১৭ আয়াতঃ ১)। উল্লেখিত আয়াতে পাকে ‘সোবহান’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। আরবী ভাষায় বিস্ময়কর সংবাদে ‘সোবহান’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। সশরীরে জাগ্রত অবস্থায় মিরাজ সংঘটিত হয়েছে বলেই বিস্ময়কর ঘটনা বলতে হবে। অন্যথায় নয়। আয়াতে করিমায় উল্লেখিত ‘আবদ’ (বান্দা) শব্দটি দ্বারাও আত্মা ও দেহ বুঝিয়েছেন, শুধু আত্মাকে নয়। মিরাজের ঘটনা : মহানবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তায়েফ সফরের পর কাফিরদের সীমাহীন অত্যাচার ও নির্যাতনে মুসলমানরা যখন অসহায় হয়ে পড়ে তখনই আল্লাহ তা’লা তাঁকে মিরাজের মর্যাদায় অভিষিক্ত করেন। মহানবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন হযরত উম্মে হানি (রা.)’র ঘরে শায়িত হয়ে কিছুটা তন্দ্রাভিভূত হলেন। হঠাৎ তিনি দেখলেন, ঘরের ছাদ ফাঁক হয়ে হযরত জিব্রাঈল (আ.) ও কয়েক ফেরেস্তা শুভ আগমণ করলেন। জিব্রাঈল (আ.) প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহর পক্ষ থেকে আহ্বান জানিয়ে মসজিদে হারামে নিয়ে গেলেন। সেখানে গমণের পর তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। হযরত জিব্রাঈল ও মিকাঈল (আ.) তাঁকে জাগ্রত করে যমযম কূপের নিকট নিয়ে বক্ষ মোবারক বিদীর্ণ করে ধৌত করেন। অতঃপর ঈমান ও হিকমত তাঁর সীনা মোবারকে অর্পণ করলেন এবং দুই স্কন্ধের মাঝে মহরে নবুওয়াত লাগিয়ে দিলেন। এই মহরে নবুওয়াত ছিল শেষ নবী হওয়ার একটি বাহ্যিক নিদর্শন। এই উর্ধ্বেলোকে মুবারক আরোহণ উপলক্ষে আল্লাহ পাক বেহেস্তের তত্ত্বাবধায়ক ফেরেস্তা রিদওয়ানকে নির্দেশ করলেন, অদৃশ্য জগতের মেহমানকে নতুন সাজে সজ্জিত করতে। হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালামকে আদেশ করলেন, বিদ্যুৎ ও আলোর চেয়ে দ্রুতগামী বাহন বোরাক নিয়ে মাকামে ইব্রাহীমে হাজির হতে। জড় জগতের ফেরেস্তাদের নির্দেশ দিলেন, পানি ও মাটির দেশের কাজ বন্ধ করে স্থান ও সময়কে গতিশূন্য ও স্তবির করতে। আসমানের ফেরেস্তাদের বলা হলো সকল কাজ বন্ধ করে সম্মানিত অতিথির আগমনে জুলুস বের করতে। প্রিয় নবী তাজেদারে মদিনা হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বোরাকের উপর করে বায়তুল মোক্কাদ্দিসের উদ্দেশে যাত্রা করলেন। হযরত শাদ্দাদ ইবনে আওস (রা.) হতে বর্ণিত প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাগহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, বাইতুল মোক্বাদ্দিস যাত্রাকালে বোরাক থেকে নেমে দুরাকাত নামাজ আদায় করতে অনুরোধ করলে আমি দুরাকাত নফল নামাজ আদায় করি। অতঃপর তিনি আমাকে বললেন, আপনি ইয়াসরিব তথা মদিনা মুনাওয়ারায় নামাজ আদায় করেছেন, যেখানে হিজরত করে আপনি আশ্রয় গ্রহণ করবেন। মদিনা হতে আবার যাত্রা আরম্ভ করলেন। কিছুদূর অতিক্রম করার পর হযরত জিব্রাঈল (আ.) প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বোরাক থেকে অবতরণ করে নামাজ আদায় করতে আরজ করলে তিনি নামাজ আদায় করেন। হযরত জিব্রাঈল (আ.) বললেন, এটা সিনাই পাহাড়, এখানে যে গাছ দেখছেন তার নিকট হযরত মূসা (আ.) আল্লাহর সাথে কথা বলতেন। আবার ভ্রমণ শুরু হলো। কিছুদূর পর জিব্রাঈল (আ.) বললেন, বোরাক থেকে নেমে সালাত আদায় করুন। নবীজি তাই করলেন। জিব্রাঈল (আ.) বললেন, আপনি হযরত শুয়ায়ব (আ.) এর আবাস মাঠে সালাত আদায় করলেন। আবার যাত্রা শুরু করে কিছুদূর যাওয়ার পর জিব্রাঈল (আর.) মাটিতে নেমে নামাজ পড়তে বললেন তিনি নামাজ আদায় করেন। অতঃপর জিব্রাইল (আ.) বললেন, এই জায়গার নাম বাইতুলাহম (বেথেলহাম), হযরত ঈসা (আ.) এখানেই জন্মগ্রহণ করেন। এই সফরে প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাইতুল মোকাদ্দিস পৌঁছে মহাকাশ যাত্রা আরম্ভ করেন। যাত্রাকালে ইহকাল, পরকাল, বেহেস্ত ও দোজখের বহু বিস্ময়কর ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন। শবহে মাওয়াহিব গ্রন্থে বর্ণনা আছে যে, সিদরাতুল মুনতাহায় গমন এবং জান্নাত ও জাহান্নাম পরিদর্শন করার পর তিনি যাত্রা বিরতি করেন সেখানে লেখার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। এই জায়গার নাম ‘সরীফুল আকলাম’। ভাগ্য লিপিবদ্ধকারী ফেরেস্তাগণ এই স্থানে লিখার কাজে নিয়োজিত আছেন এবং এখানেই লওহে মাহফুজ হতে প্রাপ্ত আল্লাহর আদেশ নিষেধ তারা লিপিবদ্ধ করেন। প্রিয়নবী আক্কায়ে মাওলা তাজেদারে মদিনা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম শরীফুল আকলাম হতে আরো উপরে অগ্রসর হয়ে এক নুরানী পর্দার নিকট গিয়ে পৌঁছেন। তখন এক ফেরেস্তা পর্দার অন্তরাল হতে বের হয়ে আসলে জিব্রাইল (আ.) বললেন, আমার সৃষ্টির পর এই ফেরেস্তাকে আমি কখনও দেখিনি। অথচ সৃষ্টির মধ্যে মর্যাদার দিক হতে আমি আল্লাহর নৈকট্য লাভে ধন্য। অতঃপর জিব্রাইল (আ.) থেমে গেলেন। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে জিব্রাইল! এমন স্থানে এসে কোন বন্ধু কি বন্ধুকে পরিত্যাগ করে? জিব্রাঈল (আ.) বললেন, যদি আমি আর একটু অগ্রসর হই তবে আমার ডানাগুলি জ্বলে ছাই হয়ে যাবে। শিফাউস সুদূর গ্রন্থে বর্ণনা আছে, প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইগি ওয়াসালাম বলেছেন, পর্দা উঠে যাওয়ার পর সবুজ রং-এর একটি রফরফ নামক আসনে উঠিয়ে আরও উপরে আল্লাহর আরশে তাঁকে নিয়ে যায়। অতঃপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর দর্শন লাভ করেন। পবিত্র কোরআনে নিকটবর্তী হলেন, অতি নিকটবর্তী। ফলে তাঁদের মধ্যে দুই ধনুকের অথবা তার চেয়ে কম ব্যবধান থাকলো। তখন আল্লাহ তার বান্দার প্রতি যা অহি করার তা করলেন” (৫৩:৮,৯,১০)। হযরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “মেরাজের রাতে আমি এক বিশাল জ্যোতি অর্থাৎ আল্লাহর নুর প্রত্যক্ষ করেছি। অতঃপর আল্লাহ পাক আমার প্রতি অহি অবতীর্ণ করেন। অর্থাৎ কোন মাধ্যম ছাড়া আমার সাথে কথপোকথন করেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত হাদিস দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, মহানবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাহ্যিক চোখ ও অন্তর্চোখ দ্বারা আল্লাহর দর্শন লাভ করেছেন। আল্লাহ পাক তাঁর বাহ্যিক ও অন্তর্চোখের মধ্যে এমন যোগসূত্র সৃষ্টি করে দিয়েছেন যে, তাতে কোন পার্থক্য বিদ্যমান ছিল না। মেরাজ শেষে প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৃথিবীর উদ্দেশে যাত্রা করে প্রথম বাইতুল মোক্কাদ্দিসে অবতরণ করেন। সেখান থেকে বোরাকে করে প্রভাতের পূর্বেই মক্কা মুকার্রমায় পৌঁছেন। সকালে তিনি এই বিস্ময়কর ঘটনা কুরাইশদের নিকট বর্ণনা করতে চাইলে হযরত উম্মে হানি (রা.) বললেন, এই ঘটনা বর্ণনা করলে লোকে আপনাকে মিথ্যাবাদী বলবে এবং বেআদবী করবে। আল্লাহর হাবীব কোন বাধা না মেনে মেরাজের ঘটনা কুরাইশদের নিকট বর্ণনা করলেন। কেউ বিস্মিত হলেন। কেউ নিন্দা করলেন। কয়েকজন পৌত্তলিক এই ঘটনা শুনে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) এর নিকট গিয়ে বর্ণনা করলেন। সিদ্দিকে আকবর (রা.) বললেন, তিনি যদি বলে থাকেন, তাহলে এই ঘটনা সত্য আমি তো এই ঘটনার চেয়েও কঠিন ও বিস্ময়কর বিষয়ে তাঁকে সত্য বলে বিশ্বাস করি। এই জন্যেই তাঁকে সিদ্দিক (সত্যবাদী) উপাধিতে ভূষিত করেছেন প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। যারা বাইতুল মুকাদ্দিস সম্পর্কে অবগত ছিল তারা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বায়তুল মোকাদ্দিসের বিভিন্ন নিদর্শন সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি নিখুঁত ভাবে প্রশ্নের জবাব দেন। হযরত আবদুল্লাহ (রা.) হাতে বর্ণিত হাদিসে আছে, প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, মেরাজের রাতে আল্লাহর সানি্নধ্যে যাওয়ার পর আল্লাহ পাক আমাকে তিনটি বিশেষ উপহার প্রদান করেছেন ১. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, ২. সূরা বাকারার শেষ দুই আরাফাত, ৩. যে মুসলিম আল্লাহর সাথে শরীক করবেনা তার সকল কবিরা গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে (সহীহ মুসলিম)