শবে বরাত নিয়ে প্রশ্নোত্তরঃ-
————-মুহাম্মদ সাইফুল আযম আযহারি
১| প্রশ্ন: শবে বারাত নিয়ে একটা মহল হঠাৎ করে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। কী কারণ হতে পারে বলে মনে করেন?
উত্তর: সাধামাটা ভাবে বলতে গেলে উদ্দেশ্য একটাই। আর তা হচ্ছে উম্মতে মুসলিমার নতুন প্রজম্মকে কনফিউস্ড করা এবং ফ্রাসট্রেইটেড করে ধর্মবিমুখ করে তোলা। এই আইডিওলজির কারণে আমাদের যুবশ্রেণী হয়ত ধর্মান্ব্দ হচ্ছে, নয়ত ধর্মদ্রোহী। একটা সেটেল্ড বিষয় নিয়ে এই ধরনের নেগেটিভ প্রপাগান্ডা যুব সমাজের অন্তরে শুধু শবে বারাত নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি করছেনা, বরং ইসলামের সামগ্রিক বিষয়ে তার বিশ্বাসের ভীতকে নড়েবড়ে করে দিচ্ছে। সময়টা ফিতনার এবং মুর্খতার। আমাদের উচিত আগের যুগের উলামায়ে উম্মতের পথ ও মতের অনুসরণ করা। মুসলিম শরিফে বর্ণিত সহিহ্ হাদীছে হুযুর (দঃ) এরশাদ করেনঃ
নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তায়ালা জ্ঞানকে উঠিয়ে নিবেন। তবে মানুষের অন্তর থেকে ছিনিয়ে নই, বরং বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামকে মৃত্যু দানের মাধ্যমে। শেষ পর্য্যন্ত এমন অবস্তার সৃষ্টি হবে যে সমাজের মধ্যে কোন আলেম থাকবেনা। মানুষ মুর্খদের আলেম মনে করে তাদের প্রশ্নগুলো করবে। আর ঐ মুর্খ নিজের খেয়াল খুশি অনুযায়ী জবাব দেবে। নিজেও পথভ্রস্ট হবে এবং মানুষকেও পথভ্রস্ট করবে।
অত্র হাদীছ শরীফের উপর গভীরভাবে চিন্তা করলে আমাদের না বলা এমন অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাওয়ার কথা। (ওয়াল্লাহু আ’লামু বিস্সাওয়াব)
২|প্রশ্ন: দিন বলেন, রাত বলেন, সময় বলেন সবকিছুই আল্লাহ্ তায়ালার সৃষ্টি। কোন বিশেষ সময় বা রাতকে উদযাপন বা গুরুত্ব দেওয়া কতটুকু শরিয়ত সম্মত?
উত্তর: হ্যাঁ, সবকিছুই আল্লাহ্ তায়ালার সৃষ্টি। এই ক্ষেত্রে সকল সৃষ্টি সমান হলেও ফজিলত বা মরতবার দিক থেকে সকল সৃষ্টি সমমানের নয়। ব্যক্তিকে ব্যক্তির উপর, কোন এক বিশেষ ভূখন্ডকে অন্য ভূখন্ডের উপর, বিশেষ দিনকে অন্যান্য দিনের উপর, কোন এক বিশেষ রাতকে অন্যান্য রাতের উপর, দিনের কিছু বিশেষ মুহূর্তকে অন্য অংশের উপর ফজিলত দান করা হয়েছে। যেমন: মানুষের মধ্যে আম্বিয়ায়ে কেরাম, সিদ্দিকীন, শোহাদাহ এবং আওলিয়ায়ে কিরাম বিশেষভাবে ফজিলতপূর্ণ। ভূপৃষ্ঠের সকল ভূখণ্ডের মধ্যে পবিত্র মক্কা শরিফ,
মদীনা শরীফ এবং বাইতুল মুকাদ্দাসের নগরী বিশেষ মর্য্যাদায় অধিস্টিত। সপ্তাহের সাত দিনের মধ্যে সোমবার, বৃহস্পতিবার এবং শুক্রবার বিশেষ মর্তবার অধিকারী। দিবসের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে রাতের এবং রাতের শেষভাগ বিশেষভাবে ফজিলতপূর্ণ। এই বিষয়গুলি কোরান ও হাদীছ দ্বারা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট। সুতরাং সৃষ্টির দিক থেকে সবকিছু সমমানের হলেও ফজিলত ও মর্তবার দিক থেকে সবকিছু সমমানের না।
মুসলিম শরীফে হযরত আবু হুরাইরা (রঃ) হতে বর্ণিত একটি হাদীছে রাসুলে করীম (দঃ) এরশাদ করেন: “সোমবার এবং বৃহস্পতিবার জান্নাতের দরজা সমুহ খুলে দেওয়া হয় এবং মুসরিক বৈ সকল বান্দাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়।”
(মুসলিম শরীফ, বির ও ছিলা অধ্যায়)
৩|প্রশ্ন: বলা হয়ে থাকে যে, শবে বারাত কোরান বা হাদীছের কোথাও নেয়। কী বলবেন?
উত্তর: যদি শব্দদ্বয়ের দিক থেকে বলি তাহলে না থাকারি কথা। কারণ এটি আরবী ও ফারসি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত একটি পরিভাষা যা দিয়ে আমাদের এশিয়াতে শাবানের পনের তারিখের রাতকে বুঝানো হয়। যাকে আরবী ভাষাবাসীরা “লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান” বলে থাকে। “শবে বারাত” এই পরিভাষাটি পবিত্র হাদীছের আলোকেই নির্ধারণ হয়েছে বলে মনে করি। যেমন হাদীছ শরিফে বর্ণিত হয়েছে:
“এই রাতে আল্লাহ্ তায়ালার রহমতে মানুষ জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি পাই”
(ইমাম বাইহাকি, শোয়াবুল ইমান. হাদীছটি বর্ণনা করেছেন হযরত আয়েশা (রাঃ))
অর্থাত্ এইরাত হচ্ছে জাহান্নাম থেকে মুক্তির রাত আর শবে বরাত মানেও হচ্ছে মুক্তির রাত
এই ধরনের আরো অনেক ফারসি শব্দ আমরা নিত্যদিন ব্যবহার করি। যেমন: নামাজ, রোজা, খোদা ইত্যাদি। এগুলো কোরান-হাদীছে পাওয়া যাওয়ার কথা না। কারণ শব্দ গুলো ফার্সী। এই ধরনের প্রায় ৬০০০ শব্দ বাংলাতে আমরা ব্যবহার করি।
“শবে বারাত” কোরান-হাদীছের কোথাও নেই যারা বলে তাদের অধিকাংশই কোরান-হাদীছ এবং ক্লাসিক্যাল ইসলামিক সায়েন্সেসের ব্যপারে একেবারে অজ্ঞ। আর যারা এই কথাগুলো প্রচার করে সমাজে ফিতনার সৃষ্টি করছে তারা কতিপয় মুসলিম রাস্ট্র কতৃক নিয়োজিত। এই জন্য তারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে বিভিন্ন সূযোগ-সুবিধা ভোগ করে থাকেন। একটি মুসলিম দেশের সরকার গত ৬০/৭০ বছরে ৬৭ হাজার কৌটি টাকা খরচ করেছেন অন্যান্য মুসলিম দেশ গুলোতে। এই টাকা কোথায়, কাকে কী কারণে দেওয়া হয়েছে? বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছে না রিসার্চ সেন্টার। গঠনমূলক কোনকিছুই না। শুধু শিরক্-বেদাতের প্রোডাক্ট বিক্রি করার জন্য সেইলস্ ম্যন আর সেন্টার বানানো হয়েছে। আর এই ছোট ছোট বিষয়গুলো দিয়ে মুসলিম সমাজে, মসজিদে ফিতনার সৃস্টি করা হয়েছে।
তাই দেখবেন এই ধরনের কথা বলার লোকগুলো সবাই উগ্রবাদী না হলেও সমস্ত উগ্রপন্থী সন্ত্রাসিরা এই ধরনের আকিদারই লোক।
৪| প্রশ্ন: কোরান ও হাদীছের আলোকে শবে বারাত সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত কিন্তু কম্প্রিহেন্সিভ আলোচনা করবেন যাতে সম্পুর্ন বিষয়টা সন্দেহাতীত ভাবে বুঝে আসে।
উত্তর:
ইসলামি শরিয়তের প্রাইমারি সোর্স হচ্ছে- কোরান ও হাদীছ। এর পরে রয়েছে ইজমা ও কিয়াছ। হাদীছ কোরানি আয়াতের ব্যখ্যাও করে এবং আয়াতের অর্থকে খোলাসাও করে। অনেক সময় কোরান করীম কোন একটি বিষয়কে পরোক্ষভাবে বা ভাসা ভাসা ভাবে ইংগিত করে কিন্তু হাদীছ শরীফের কল্যাণে সেই ধোয়াশে ভাবটা আয়াতের মধ্যে আর থাকেনা।
শবে বারাতের ব্যপারে পবিত্র কোরানে পাকের সুরা দোখ্খানে আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেন: “হা মীম। এই সুস্পষ্ট কিতাবের শপথ। নিশ্চয়ই আমি কোরান অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রাতে। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। উক্ত রাতে প্রতিটি প্রজ্ঞাসম্পন্ন বিষয়ের ফায়সালা করা হয়” (আয়াত ১-৪)
অত্র আয়াতে বর্ণিত “লাইলাতুম মুবারাকাহ্”র ব্যখ্যায় তাবেয়ীনদের মধ্যে তাফসীরের অন্যতম ইমাম হযরত ইকরামা (রাঃ) সহ অনেক মুফাস্সিরগণ শবে বারাতকে বুঝানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন।
তবে হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রাঃ) সহ অনেকে বলেছেন এখানে শবে কদর উদ্দেশ্য।
আয়াতের এই শব্দ দিয়ে বহুসংখ্যক তাফসিরের ইমামদের রায় সত্তেও শবে বারাত নিরংকুশভাবে প্রমাণিত না হলেও হাদীছ শরীফে অসংখ্য সাহাবায়ে কিরাম থেকে বর্ণিত অনেক হাদীছ রয়েছে যা শবে বারাতকে সন্দেহাতীত পন্থায় প্রমান করে।
শবে বরাতের ফজিলতের উপর আয়িম্মায়ে হাদীছ অসংখ্য হদীছ বর্ণনা করেছেন। শুধু যে হাদীছ বর্ণনা করেছেন তা নই, বরং স্ব-স্ব হাদীছের কিতাবে এই বিষয়ে আলাদা ‘অধ্যায়’ করেছেন। এই জিনিসটা একাডেমিক ক্ষেত্রে মেটার করে। কারণ ‘অধ্যায়’ করা মানে বিষয়টা ঐ যুগেই বহুল প্রচলিত এবং গুরুত্ববহ।
যেই সমস্ত আঈম্মায়ে হাদীছ শবে বরাত সংক্রান্ত হাদীছ স্ব-স্ব কিতাবে বর্ণনা করেছেন:
– ইমাম ইবনে মাজাহ্
– ইমাম তিরমিঝি
– ইমাম আহমদ বিন হাম্বল
– ইমাম আব্দুর রাজ্জাক
– ইমাম বাইহাকি
– ইমাম বাঝ্ঝার
– ইমাম ইবনে হিব্বান
– ইমাম তাবরানি
– ইমাম মুহাম্মদ
– ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ুতি
আমি শুধু দুয়েকটি হাদীছ আপনাদের সাথে শেয়ার করব:
– “হুজুর (দঃ) এরশাদ করেন: শবে বরাতের রাতে আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর সৃষ্টিকুলের প্রতি রহমতের দৃষ্টিতে তাকান এবং মুশরিক ও অন্যের প্রতি হিংসা পোষণকারী ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন।”
এই হাদীছটি ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা সুত্রে আটজন জলিলুল কদর সাহাবি বর্ণনা করেছেন। তাঁরা হচ্ছেন:
– হযরত আবু বলে ছিদ্দীক (রাঃ)
– হযরত আলী (রাঃ)
– হযরত আয়েশা ছিদ্দিকা (রাঃ)
– হযরত মুয়াজ বিন জাবাল (রাঃ)
– হযরত আবু মুছা আশয়ারী (রাঃ)
– হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ)
– হযরত আউফ বিন মালিক (রাঃ)
– হযরত আবু ছা’লাবা (রাঃ)
মুহাদ্দেসীন এই হাদীছকে সহিহ্ বলেছেন। এমনকি বর্তমান যুগের সলফীদের হাদীছে পাকের ক্ষেত্রে একমাত্র মুরব্বি শায়খ আলবানিও এই হাদীছকে নিঃসন্দেহে সহিহ্ বলেছেন (দেখুন: শায়খ আলাবানি কৃত “সিলসিলাতুল আহাদিসিস সাহিহা” খন্ড:৩, পৃ:১৩৫, হাদীছ নং:১১১৪)
স্বাভাবিক ভাবেই বর্ণনা সুত্র বেশি হওয়ার কারণে কোন একটা সুত্রে সমস্যা থাকলেও অন্য বর্ণনা সুত্রের সাপোর্টের কারণে তা দুরিভূত হয়ে যায়।
“হযরত আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসুল (দঃ) বলেছেন: যখন শাবানের মধ্যবর্তী রাত তথা শবে বরাত আসবে তখন তোমরা ঐ রাত জেগে ইবাদত কর এবং এর পরদিন রোজা রাখ। কেননা আল্লাহ্ তায়ালা ঐদিন সুর্যাস্তের পর (নীজ শান অনুযায়ী) দুনিয়ার আসমানে আবিভূত হয়ে আহবান করেন:তোমাদের মধ্যে কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি মাফ করে দেব। রিজিকের প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি রিজিক দিব। কোন বিপদগ্রস্ত আছে কি? আমি বিপদ থেকে মুক্তি দিব। এভাবে ফজর পর্য্যন্ত আরো বান্দাদের সম্বোধন করতে থাকেন।”
(ইবনে মাজা, শাবানের মধ্যবর্তী রাত তথা শবে বরাত অধ্যায়, হাদীছ নং:১৩৮৮)
এমনকি ইমাম মুহাম্মদের মত জলিলুল কদর ইমামও স্বীয় কিতাব “কিতাবুস সুন্নাহ্”-ই শবে বরাতের উপর অধ্যায় রচনা করে হাদীছ বর্ণনা করেছেন।
-প্রখ্যাত সাহাবি হযরত আবদুল্লাহ্ বিন উমার (রাঃ) বলেন:
“পাঁচটি রাতের দোয়া ফেরত দেওয়া হয়না।(অর্থাত্ এই রাত গুলোর দোয়া কবুল হয়)। রাতগুলো হলো জুমার রাত, রজব মাসের প্রথম রাত, শাবান মাসের মধ্যবর্তী রাত তথা শবে বরাত এবং দুই ঈদের রাত”
(ইমাম তাবরানি, মু’জামুল আওছাত, হদীছ নং ৬৭৭৬, হযরত মুয়ায বিন জাবাল
ইমাম আব্দুর রাজ্জাক, মুসান্নাফ, নং ৭৯২৭, হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন আমর (রঃ))
এছাড়াও দুনিয়া ব্যাপি বহুল পরিচিত ও নির্ভরযোগ্য হাদীছের কিতাব “মিশকাতুল মাসাবীহ্”-এ “বাবু কিয়ামে শাহরে রামাদান” অধ্যায়ে শবে বারাতের উপর চারটি হাদীছ বর্ণনা করেছেন। এই হাদীছ গুলোর মাধ্যমে হুযুর (দঃ) এর রাত্রিকালীন ইবাদতেরও বর্ণনা পাওয়া যায়।
এর পরেওকি বলবেন শবে বরাত কোথাও নেই???
৫|প্রশ্ন: এই বিষয়ে আয়িম্মায়ে উম্নতের অভিমত উল্লেখ করে এও দয়া করে জানাবেন যে, তাঁদের অভিমত জানা কতটুকু জরুরী?
উত্তরঃ
মুসলিম শরীফের একটি হাদীছে রাসুল (দঃ) এরশাদ করেন: “আমার আনীত হিদায়াত হচ্ছে বৃস্টির পানির মত…….. এই দীর্ঘ হাদীছের শেষ পর্যায়ে রাসুল (দঃ) বলেন: আর এই হিদায়তের পানির প্রকৃত ধারক, বাহক এবং প্রচারক হচ্ছে তারা যাদেরকে আল্লাহ্ তায়ালা দ্বীনের ফিকহ্ বা গভীর জ্ঞান দান করেছেন।” অন্য হাদীছে রাসুল (দঃ) উলামায়ে উম্মতকে নীজের ওয়ারিছ বলেছেন। তাই দ্বীনের
যেকোন বিষয়ে তাদের রায় জানতে চাওয়া সুপথ প্রাপ্তির পরিচায়ক।
এই ক্ষেত্রে আমি শুধু কয়েকজন ইমামের রায় আপনাদের সাথে শেয়ার করব:
– ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) (মৃত্যুকাল: ২০৪ হিজরী)
“পাঁচটি রাতের দোয়া কবুল হয়: জুমার রাত, দুই ঈদের রাত, রজব মাসের প্রথম রাত এবং শবে বরাত।”
(কিরাবুল উম্, খন্ড ১, পৃ:২৬৪)
-হুজুর গাউছুল আজম আবদুল কাদের জিলানি (র:) উনার বিখ্যাত কিতাব “গুনিয়াতুত তালেবীন”-এ শবে বরাতের ফজিলত বর্ণনা করেছেন।
-ইমাম ফাকেহী (মৃত্যুকাল ২৭২ হি:)
“মক্কাবাসি নারী-পুরুষ সেকাল থেকে আজকের দিন পর্য্যন্ত শবে বরাতের রাত্রিতে মসজিদে হারামে এসে নামাজ আদায় করে, কাবার তাওয়াফ করে এবং রাত জেগে কোরান শরিফ খতম করে।”
(আখবারে মক্কা: শাবানের মধ্য রাত তথা শবে বরাতে মক্কাবাসীর আমল)
-ইমাম মৌল্লা খসরু হানাফি (মৃত্যুকাল ৮৮৫ হি:)
“রমজানের শেষ দশ রাত, দুই ঈদের রাত, জিলহজ্ব মাসের প্রথম দশরাত এবং শাবানের পনের তারিখের রাতে রাত জেগে ইবাদত করা মোস্তাহাব।”
(দুরারুল হিকাম শরহে গুরারুল আহকাম)
– ইমাম ইবনে নাজীম আল-মিছরি আল- হানাফি (মৃত্যুকাল ৯৭০ হি:)
উনি উনার বিখ্যাত কিতাব ‘বাহরুর রায়েকে’ উপরোল্লিখত মৌল্লা খসরুর ন্যয় একি অভিমত ব্যক্ত করেন।
-উপমহাদেশের প্রখ্যাত হাদীছ বিশারদ ইমামুল মুহাদ্দিছীন শাইখ আবদুল হক্ব মুহাদ্দেছে দেহলভী উনার বিখ্যাত কিতাব ‘মা ছাবাতা বিছ্ছুন্নাহ্ ফি আইয়্যামিছ ছানাহ্’ -তে একটা অধ্যায় করেছেন শবে বরাতের উপর এবং এই রাতের ফজিলত ও ইবাদত বন্দেগি বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ কিছু হদীছ উল্লেখ করে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
-ইমাম যুহাইলী
সিরিয়ার বিশ্বখ্যাত এই হানাফি ইমাম অধ্যাপক ডঃ যুহাইলি উনার অনবদ্য সৃষ্টি বিশালাকৃতির ইসলামি ফিকাহর কিতাবে উল্লেখ করেন:
“দুই ঈদের রাত, লাইলাতুল কদর পেতে রমজানের শেষ দশ রাত এবং শবে বরাতে রাত জেগে ইবাদত করা মুস্তাহাব। এই বিষয়ে সহিহ্ হাদীছ রয়েছে। ভোর পর্য্যন্ত অধিক হারে ইসতিগফার করা উত্তম।”
(আল-ফিকহুল ইসলামি ওয়া আদিল্লাতুহু)
এভাবে সলফে সালেহীন ও সকল মাজহাবের মুহাক্কিক ওলামায়ে কেরাম এমন কি মাজহাব অমান্যকারী ওলামারাও বেশিরভাগ শবে বরাতের ফজিলত এবং রাত্রি জেগে ইবাদত করাকে ফজিলতপূর্ণ বলেছেন।
৬|প্রশ্ন: এই বিষয়ে বিশ্বের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামীক ক্লাসিক্যাল সায়েন্সের কিবলা হিসেবে গণ্য আল-আজহারের ফতওয়া জানাবেন কি?
উত্তর:
আল- আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব বিখ্যাত ইসলামি আইনবিধ মুফতি আতিয়া ছকরকে এই রাতের ফজিলতের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে উনি ফতোয়া দেন:
“এই রাতের ফজিলতের উপর যেই সমস্ত হাদীছ শরিফ বর্ণিত হয়েছে তা কোন কোন মুহাদ্দিসগণ সহিহ্ বলেছেন আবার কেউ কেউ ‘দায়ীফ’ বলেছেন। তবে কথা হচ্ছে ‘দায়ীফ’ হলেও তা ফাজায়েলে আমলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।” (আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফতোয়া নং ১৩১১১০)
৭|প্রশ্ন: কতিপয় লোক যারা হাজার বছরের সেটেল্ড এই বিষয় নিয়ে শুধু শুধু বিভ্রান্তি ছড়ান এবং মুসলিম যুব সমাজকে কনফিউজ্ড করেন তারা সাধারণত ইবনে তাইমিয়ার আইডওলজিকে আক্ষরিক অর্থেই লালন করেন। দয়া করে এই বিষয়ে ইবনে তাইমিয়ার অভিমত জানাবেন কি?
উত্তর:
আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা ইবনে তাইমিয়া থেকে না শুনা পর্য্যন্ত কোনকিছু মানতে চাননা। তাদেরকে বলছি- ইবনে তাইমিয়া বলেছেন:
“শাবানের চৌদ্দ তারিখের রাতের ফজিলত সম্পর্কিত অনেক হাদীছ ও আছার রয়েছে। ছলফে ছালেহীনের কেউ কেউ এই রাতে রাত জেগে নফল নামাজ আদায় করতেন।”
(আল ফাতওয়া আল-কুবরা, নং ৫৩৪৪)
ইবনে তাইমিয়া তার “ইকতিদাউ ছিরাতিল মুছতাকিম” কিতাবে শবে বরাত সম্পর্কে নিম্মোক্ত মতামত দিয়েছেন:
“শবে বরাতের ফজিলত সম্পর্কে অসংখ্য হাদীছে মারফু ও আছার (সাহাবা ও তাবেঈনের অভিমত) বর্ণিত হয়েছে যেগুলো প্রমাণ করে যে, এটি একটি ফজিলতপূর্ণ রাত। সলফে সালেহীনের কেউ কেউ এই রাতে এবাদত বন্দেগি করতেন। পবিত্র মদিনা নগর সহ অনেক জায়গার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অনেক ওলামা এটাকে অস্বীকার করেছেন এবং এই সংক্রান্ত বর্ণিত হাদীছের সমালোচনা করেছেন।
যেমন: হাদীছ শরিফে এসেছে:
এই রাতে আল্লাহ্ বনি কালব গোত্রের মেষপালের পশমের সংখ্যার চেয়েও বেশি সংখ্যক লোককে ক্ষমা করে দেন।
তবে আমাদের অধিকাংশ আহলে ইলম্ ওলামায়ে কেরামের মতে এই রাত ফজিলতপূর্ণ। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:) এর বর্ণিত হাদীছ এর উৎকৃস্ট প্রমাণ। তাছাড়া এই বিষয়ে আরো অসংখ্য হাদীছ বর্ণিত হয়েছে, সাথে রয়েছে সলফে সালেহীন ও আকাবিরীনে উম্মতের রায়।”
( ইকতিদাউ ছিরাতিল মুছতাকিম” পৃস্টা: ২৭৩)
৮|প্রশ্ন: বলা হয়ে থাকে শবে বারাতের উপর বর্ণিত সকল হাদীছ “দায়ীফ” বা দূর্বল বর্ণনা সুত্রের। দয়া করে এই বর্ণনা সুত্রের হাদীছ কতটুকু গ্রহণযোগ্য জানাবেন এবং এই বর্ণনা সুত্রের হাদীছ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ ওলামায়ে উম্মতের অভিমত জানাবেন।
উত্তরঃ
“দায়ীফ” উলুমে হাদীছের একটা পরিভাষা। পরিভাষা শাব্দিক অনুবাদে নই বরং সংজ্ঞা দিয়ে বুঝতে হয়। আমরা যদিও বাংলায় অনুবাদ করে “দূর্বল” বলি। কিন্তু এমনটি করা আনএকাডেমিক। হাদীছে দায়ীফ বলা হয়:
“কুল্লু হাদীছিন লাম তাজতামি’ ফীহি ছিফাতুল হাদীছিল হাছান”
অর্থাত্: যেই বর্ণনা সুত্রে “হাদীছে হাছানের” শর্তগুলো পূর্ণ হয়নি তাকে দায়ীফ বলে।
(ইমাম নববীর তাকরীব, ইমাম ইরাকীর “নুকাত”, ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ুতির “তাদরীব”)
এই বর্ণনা সুত্রের হাদীছের বিষয়ে আয়িম্মায়ে হাদীছ তথা হাদীছ বিশারদদের অভিমত হচ্ছে:
“মুহাদ্দিসীন এবং ফোকাহায়ে কেরামের মতে- ফাজায়েল, তারগীব ও তারহীবের ক্ষেত্রে হাদীছে দায়ীফ দ্বারা আমল করা জায়েজ ও মুস্তাহাব”
(ইমাম নববীর আঝকার, পৃ:২২, অধ্যায়: হাদীছে দায়ীফের উপর আমল প্রসংগ)
এটার উপরি মুহাদ্দিসীনদের ইজমা বা ঐক্যমত্য। তাই এই বিষয়ে আর কথা বাড়াচ্ছিনা।
৯|প্রশ্ন: কোন্ কোন্ প্রকারের লোক এই রাতের ফজিলত থেকে বন্চিত?
উত্তর:
এই অতিব বরকতপূর্ণ রাতেও কতিপয় লোক আল্লাহ্ তায়ালার দয়া-অনুগ্রহ থেকে বন্চিত হবে বলে বিভিন্ন হাদীছ শরীফে বর্ণিত হয়েছে:
১- যারা শির্ক করে
২- যাদের অন্তর হিংসা আর ক্রোধের আগুনে ভর্তি
৩- অহংকারী
৪- মানুষ হত্যাকারী
৫- আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী
৬- পিতামাতার অবাধ্য সন্তান
৭- মদ্যপানে নেশাগ্রস্ত
৮- গিবত বা পরচর্চাকারী অর্থাত্ যারা সারাদিন বসে বসে অন্য মানুষের দোষত্রুটি বর্ণনা করে।
তবে কেউ যদি এই রাতে তাওবা করেন তাহলে আল্লাহ্ তায়ালা অবশ্যই তাওবা কবুল করেন এবং ক্ষমা করেন।
১০|প্রশ্ন: এই রাতের আমল এবং পরিহারযোগ্য কাজগুলি দয়া করে জানাবেন কি?
উত্তরঃ মনে রাখবেন প্রত্যেক জিনিসের একটা হাকিকত বা মৌলিকত্ব থাকে। এই রাতের মৌলিকত্ব হচ্ছে- তাওবা-ইসতিগফার এবং ইবাদত-রিয়াঝতের মাধ্যমে মহান প্রভুকে সন্তুষ্ট করা। কাজেই আমাদের উচিত হবে বন্ধুদের নিয়ে হাসি-তামাশা, আড্ডাবাজি, আতশবাজি বা ঘুরাঘুরি না করে রাতটির প্রতি যতাযত সম্মান প্রদর্শন পূর্বক নিম্নলিখিত আমলগুলো করার চেষ্টা করা:
-নিকট আত্মিয়, পাড়া প্রতিবেশির কবর জিয়ারত করা
– বেশি বেশি তাওবা-ইসতিগফার করা
-কোরান তিলাওয়াত করা।
– সুরা ইয়াছিন, রহমান, মুলক্ পাঠ করা
– দোয়া ইউনুছ পাঠ করা
– বেশি বেশি দরুদ শরিফ পাঠ করা
– জিকির করা
-তাওবার নামাজ, সালাতুত তাসবীহ্
– তাহাজ্জুদ এবং ইবাদত বান্দেগীর মাধ্যমে রাত অতিবাহিত করা।
১১- প্রশ্ন: শবে বারাত উপলক্ষে আমাদের দেশে হালুয়া-রুটি তৈরি করা হয়। এটাকেও আজকাল কেউ কেউ নাজায়েয, বিদাআত বলে থাকে। কি বলবেন?
উত্তর:
এগুলো অজ্ঞতাপ্রসুত হাস্যকর কথাবার্তা। এই ধরনের কথাবার্তা ইসলামি শরিয়তের সাথে কৌতুক করার শামিল। এই জিনিসগুলো কৃস্টি-কালচারের অন্তর্ভুক্ত। ইসলাম এগুলোকে স্বাচ্ছন্দে একোমোডেইট করে যদি শরিয়ত বিরোধী কোন ফেকটর্ না থাকে। কোন জিনিসকে হালাল এবং হারাম করার ক্ষেত্রে ইসলামি শরিয়তের নিজস্ব একটা স্টাইল আছে। এই জন্য হুযুর (দঃ) ইসলামি শরিয়তের ফরমেশন পিরিয়ডে তৎকালীন সময়ের সকল রীতিনীতি তুলে আস্হাকুড়ে নিক্ষেপ করেননি। বরং যা যা নেওয়ার মত ছিল নিয়েছেন, বাকিটা বাদ দিয়েছেন।
যাকিছু হারাম তার একটা লিস্ট আমাদেরকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। হালালের লিস্ট দেওয়া হয়নি। কারণ সবকিছুই হালাল যতক্ষণ না হারাম হওয়ার ব্যপারে কোন স্পষ্ট দলিল পাওয়া যায়। রাসুল (দঃ) এরশাদ করেন: যা আল্লাহ্ ও তদীয় রাসুল (দঃ) হারাম করেছেন শুধু তাকেই হারাম জানো, বাকি যেগুলোর ব্যাপারে চুপ থেকেছেন তা বৈধ।
মনে রাখবেন প্রত্যেক জাতির কিছ স্বকীয়তা ও বিশেষত্ব থাকে। মুসলিম জাতির অনেক বিশেষত্বের একটি হচ্ছে আপ্যায়ন। আর আপ্যায়নের ক্ষেত্রে বিশেষ দিনে বিশেষ ক্ষনে হালুয়া-রুটির প্রচলন অনেক আগ্ থেকেই। ঠিক যেভাবে রমজানের ইফতারিতে ছুলা, পেয়াজু আর বেগুনির প্রচলন। তাছাড়া একটা ক্ষনকে মিনিংফুল করতে এই ধরনের আয়োজনের একটা প্রভাব থাকে। তাই এগুলো নিয়ে এই ধরনের কথা বলা মুর্খতার নামান্তর।