★ লাইলাতুল ক্বদর ★
══════❖══════✍️ইমরান বিন বদরী
নাহমাদুহু ওয়া নুসল্লি আলা রাসূলিহিল কারীম।।আম্মা বা’দঃ
সমস্ত প্রশংসা পরম করুণাময় রাব্বুল আলামীন আল্লাহ তা’য়ালার জন্য; আর সালাত ও সালাম আমার প্রিয়নবী সায়্যাদুল মুরসালীন মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি।
❖ ক্বদর রাত ➲
সুপ্রিয় পাঠক, আমাদের মাঝে প্রতি বছরের ন্যায় আবারো ফিরে এসেছে সেই মহান রাত, যে পবিত্র রাতে কুরআনে কারীম নাজিল হয়েছিলো। যে রাত গুনাহ মাফের, যে রাত আল্লাহর দরবারে দোয়া কবুল করার এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের রাত। যে রাত প্রতি বছর আসে পাপ-পঙ্কিলতায় জর্জরিত মানব জাতিকে সীমাহীন রহমতের ছায়ায় চির শান্তির আবাস জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দিতে। যে রাতটি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের রহমত ও বরকতের প্লাবনের রাত। মাগফিরাতের এ রাতটি উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য মহান আল্লাহ পাকের রহমতের উপহারের রজনী। যাকে ”লাইলাতুল ক্বদর” বলা হয়।
লাইলাতুন আরবি শব্দটির অর্থ হচ্ছে রাত বা রজনী। আর ‘ক্বদর’ শব্দের অর্থ হলো মর্যাদা বা মহিমান্বিত। সুতরাং একত্রে لیلة القدر এর অর্থ হচ্ছে মহিমান্বিত রজনী বা পবিত্র রজনী। ফার্সিতে এ রাতকে তারা শবে ক্বদর বলে যা আমাদের দেশেও ব্যবহৃত হয়।
এ রাত্রিতে আল্লাহ সুবহানআল্লাহু তা‘আলা পবিত্র কুরআন কারীমকে ”লাউহে মাহফুয” থেকে প্রথম আসমানে নাযিল করেন। তাছাড়া অন্য আরেকটি মত আছে যে, ‘লাইলাতুল কদর’ রাতে মক্কার নূর পর্বতের হেরা গুহায় সূরা আলাক্বের প্রথম পাঁচটি আয়াত প্রিয়নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট সর্বপ্রথম নাজিল হয়। অনেকের মতে এ রাতে ফেরেশতা হজরত জিব্রাঈল (আঃ) এর নিকট সম্পূর্ন কুরআন অবতীর্ন হয় যা পরবর্তিতে পর্যায়ক্রমে ২৩ বছর ধরে রহমাতুল্লীল আলামীন নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট তার বিভিন্ন প্রয়োজনীয়তা এবং ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নির্দিষ্ট আয়াত আকারে নাজিল করা হয়। আমার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেদিকে গিয়েছে জিব্রাঈল আলাইহিসালাম সেদিকে ঐশি বানী নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। মোটকথা এ রাতের গুরুত্ব অপরিসীম।
সুপ্রিয় বন্ধুরা,পবিত্র রমজান মাসের শেষ দশদিনের বেজোড় রাতে অর্থাৎ ২১. ২৩. ২৫. ২৭. ২৯ তারিখের একটি রাত । একটা মানুষ যদি জীবনে সঠিকভাবে এমন একটি রাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে রাজী করাতে পারেন তবে সে যেন জীবনের প্রায় সবটুকু সময় ইবাদতের মাজেই পার করলো। কারণ এ রাতটি হাজার মাসের ন্যায়। আপনি যদি ১ হাজার মাস চিন্তা করেন তাও প্রায় ৮৩ বছরের উপরে যা গড়ায়ুতে আমাদের বয়সের বেশী।
📖 হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমার রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি কদরের রাত অর্জন করতে ইচ্ছুক, সে যেন তা রমাযানের ২৭ শে রজনীতে অনুসন্ধান করে।
(মুসনাদে আহমদ)
📖 হযরত উবাই ইবনে কাব রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, তিনি বলেন যে, আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমি যতদূর জানি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে যে রজনীকে কদরের রাত হিসেবে ‘কিয়ামুল্লাইল’ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন তা হল রমযানের ২৭ তম রাত।
(মুসলিম ২৩৬৪)
📖 ইমামুনা ইমামে আ’যম হযরত আবূ হানীফা (রহঃ) ২৭ তারিখের রাত’কে অর্থাৎ ২৬ তারিখ দিবাগত রাতকে পবিত্র ‘ক্বদর রজনী’ হিসেবে অধিক সম্ভাব্য বলেছেন।
♥ সত্যিকার অর্থে উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য লাইলাতুলকদর আল্লাহ পদত্ত এটা অনেক বড় নিয়ামত। যে নিয়ামত আজ আমাদেরকে হাতচানি দিচ্ছেন। সল্প এ জীবনে আগামী বছর এ রাত পাব কিনা তা কেবল আল্লাহ পাকেই ভালো জানেন।
📗 এ বিষয়ে মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ
লাইলাতুল কদর সমন্ধে আপনি কি জানেন ?
لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍ
লাইলাতুল কদর হল হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।
(সূরা ক্বদর, আয়াত ২-৩)
📘 হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
عن عائشة عليها السلام قالت قال رسول الله صلى الله عليه وسلم تحروا ليلة القدر فى الوتر من العشر الاواخر من رمضان.
উম্মুল মু’মিনীন হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা পবিত্র রমযান শরীফ-এর শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতে (শবে ক্বদর) লাইলাতুল ক্বদর তালাশ করো।
(মুত্তাফাকুন আলাই)
➲ হযরত আবূ সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের মধ্যম দশকে ই’তিকাফ করতেন। এক বছর এরূপ ই’তিকাফ করেন, যখন একুশের রাত এল, যে রাতের সকালে তিনি তাঁর ই’তিকাফ হতে বের হবেন, তিনি বললেনঃ যারা আমার সংগে ই’তিকাফ করেছে তারা যেন শেষ দশক ইতিকাফ করে। আমাকে স্বপ্নে এই রাত (লাইলাতুল কদর) দেখানো হয়েছিল। পরে আমাকে তা (সঠিক তারিখ) ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। অবশ্য আমি স্বপ্নে দেখতে পেয়েছি যে, ঐ রাতের সকালে আমি কাদা-পানির মাঝে সিজদা করছি। তোমরা তা শেষ দশকে তালাশ কর এবং প্রত্যেক বেজোড় রাতে তালাশ কর। পরে এই রাতে আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষিত হল , মসজিদের ছাদ ছিল খেজুর পাতার ছাউনির। ফলে মসজিদে টপটপ করে বৃষ্টি পড়তে লাগল। একুশের রাতের সকালে রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কপালে কাদা- পানির চিহ্ন আমার দু’চোখ দেখতে পায়।
(মুত্তাফাকুন আলাই)
➲ হযরত মুহাম্মাদ ইবনুল মূসান্না (রহঃ) উকবা ইবনু হুরায়স (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ আমি হজরত ইবনু উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে বলতে শুনেছি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা রমযানের শেষ দশদিনে কদরের রাত অনুসন্ধান কর। তোমাদের কেউ যদি দূর্বল অথবা অপারগ হয়ে পরে, তবে সে যেন শেষ সাত রাতে অলসতা না করে।
(সহীহ মুসলিম ২৬৩৬)
➲ হজরত আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্নিত, রসুলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি লাইলাতুল ক্বাদরে ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রাত জেগে ইবাদাত করে, তাঁর পিছনের সমস্ত গুনাহ মাপ করা হবে। আর যে ব্যক্তি ঈমানসহ সওয়াবের আশায় রমযানে সিয়াম পালন করবে, তাঁরও অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করা হবে।
(সহীহ বুখারি)
➲ উম্মুল মু’মিনীন হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রমযানের শেষ দশ দিন শুরু হওয়ার সাথে সাথে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সারা রাত জেগে থাকতেন ও নিজ পরিবারের সদস্যদের ঘুম থেকে জাগাতেন এবং তিনি নিজেও ইবাদতের জন্য জোর প্রস্তুতি নিতেন।
(সহীহ মুসলিম)
📗 আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন:-
ادعونى استجبلكم
অর্থ: “তোমরা আমার নিকট দোয়া করো আমি তোমাদের দুয়া কবুল করবো।”
এ রাত্রিতে আল্লাহ পাক বান্দার দোয়া কবুল করে থাকেন।
❖ লাইলাতুল কদর রাতের কিছু আলামত ➲
হাদীস শরীফ এ লাইলাতুল কদর রাতের কিছু আলামত বর্ণিত আছে। সেগুলো হল :
(১) রাতটি গভীর অন্ধকারে ছেয়ে যাবে না।
(২) নাতিশীতোষ্ণ হবে। অর্থাৎ গরম বা শীতের তীব্রতা থাকবে না।
(৩) মৃদুমন্দ বাতাস প্রবাহিত হতে থাকবে।
(৪) সে রাতে ইবাদত করে মানুষ অপেক্ষাকৃত অধিক তৃপ্তিবোধ করবে।
(৫) কোন ঈমানদার ব্যক্তিকে আল্লাহ স্বপ্নে হয়তো তা জানিয়েও দিতে পারেন।
(৬) ঐ রাতে বৃষ্টি বর্ষণ হতে পারে।
(৭) সকালে হালকা আলোকরশ্মিসহ সূর্যোদয় হবে। যা হবে পূর্ণিমার চাঁদের মত।
(সহীহ বুখারী ২০২১, মুসলিম ৭৬২)
❖ লাইলাতুল কদরের বিশেষ দুয়া ➲
উম্মুল মু’মিনীন হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহা লাইলাতুল ক্বদর সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, হে রাসুলুল্লাহ! আমি যদি লাইলাতুল কদর পাই তখন কী করব? তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মত দেন, তুমি বলবে,
“اللَّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ كَرِيمٌ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي”
উচ্চারণ: ‘‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউবুন তুহিব্বুল আ’ফওয়া, ফা’ফু আন্নী।
অর্থাৎ, হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আপনি ক্ষমাশীল, আপনি ক্ষমা করে দিতে ভালোবাসেন অতএব, আমাকে ক্ষমা করুন।
(তিরমিযি, ইবনে মাজাহ ২/১২৬৫)
আসুন ➲ আমাদের সকল প্রচেষ্টা দিয়ে এ রাতের ইবাদতে ব্রতী হওয়া জরুরি। লাইলাতুল ক্বদর-এ অনেক আমলই করা যায়। তা হলো-নামায পড়া। কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করা।ছলাতুত তাসবীহ পড়া। দুরূদ শরীফ পাঠ করা। যিকির-আযকার করা। তাহাজ্জুদের নামায পড়া। দোয়ার মাধ্যমে বেশি বেশি আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করা। তওবা ইস্তিগফার করা।সিজদার মধ্যে তাসবীহ পাঠ শেষে দোয়া করা। কেননা সিজদাবনত অবস্থায় মানুষ তার রবের সবচেয়ে নিকটে চলে যায়।
♥ হে আল্লাহ ! আমাদের সবাইকে রমজান মাসের এ রাতে ইবাদতে ব্রতী হওয়ার তৌফিক দান কর। আমীন। সবার প্রতি অধমের জন্য দোয়া’র আর্জি রইলো।