১। শহীদ ও মুমিনদের রূহ্ জান্নাতে অবস্থান করবে- যদি কবিরা গুনাহগার না হয়ে থাকে- অথবা দেনাদার না হয়ে থাকে। ইহা হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) ও হযরত ইবনে ওমর (রাঃ) -এর অভিমত।
২। একদল উলামার মতে জান্নাতে নয়- বরং জান্নাতের দরজার বাইরে জান্নাত সংলগ্ন স্থানে মোমেন ও শহীদগণের রূহ্ অবস্থান করবে।
৩। অন্য একদলের মতে মোমেনদের রূহ্ জান্নাতে নয়- বরং কবরের আশেপাশে অবস্থান করবে।
৪। ইমাম মালেক (রহঃ) -এর মতে- রূহ্ মুক্ত অবস্থায় থাকবে– যেখানে ইচ্ছা যাতায়াত করবে।
৫। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের মতে- মোমেনদের রূহ্ জান্নাতে এবং কাফেরদের রূহ্ জাহান্নামে থাকবে। ইমাম সাহেবের ছেলে আবদুল্লাহ্ তাঁর পিতার এ মতামত লিখেছেন।
৬। আবু আবদুল্লাহ্ ইবনে মান্দাহ এবং কতিপয় সাহাবা ও তাবেয়ীনের মতে- মুমিনের রূহ্ আল্লাহর নিকট অবস্থান করবে। এর বেশী কিছু তাঁরা ব্যাখ্যা করেননি।
৭। সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীনদের একটি জামাত বলেছেন- মুমিনদের রূহ্ “জাবিয়াহ্” নামক স্থানে এবং কাফেরদের রূহ্ হাদরা মাউতের “বরহুত” নামক একটি কুয়ায় অবস্থান করবে।
৮। আমের ইবনে আবদুল্লাহ্ আবুল ইয়ামান বলেছেন- যবুর কিতাবে “যে যমিনের উত্তরাধিকারী মোমেনগণকে বলা হয়েছে”- সে যমীনে মোমনগণের রূহ্ রাখা হবে। ঐ যমীনই দুনিয়াতে মুমিনগণের অধিকারে আসবে।
৯। অন্য একদল বিশেষজ্ঞ উলামা বলেছেন- মুমিনদের রূহ্ থাকবে মক্কার যমযম কুপে এবং কাফেরদের রূহ্ থাকবে হাদরামাউতের “বরহুত” নামক কুপে।
১০। হযরত সালমান ফারসী (রাঃ) -এর বর্ণনা মতে যমিনের বরযখ নামক স্থানে মুমিনদের রূহ্ রাখা হবে এবং কাফেরদের রূহ্ রাখা হবে ছিজজীনে। মুমিনগণের রূহ্ বরযখ থেকে যথায় ইচ্ছা- যাতায়াত করতে পারবে। (ইমাম মালেকের মতের (৪) সাথে ইহার মিল রয়েছে)।
১১। অন্য একদল উলামার মতে- মুমিনদের রূহ্ থাকবে হযরত আদম আলাইহিস সালামের ডানপাশে এবং কাফেরদের রূহ্ থাকবে বামপাশে।
১২। অন্য একদল হাদিস বিশারদের মতে- মুমিন ও কাফের নির্বিশেষে সবার রূহ্ যেখান থেকে এসেছিল– সেখানে চলে যাবে। অর্থাৎ- রূহের প্রথম আবাসস্থল- আলমে র্আওয়াহে।
১৩। আবু ওমর ইবনে আবদুল বার -এর মতে শহীদগণের রূহ্ থাকবে জান্নাতে এবং মুমিনগণের রূহ্ থাকবে কবরের আশেপাশে।
১৪। আবদুল্লাহ্ ইবনে মোবারক ও মুজাহিদ (রহঃ) -এর মতে শহীদগণের রূহ্ ঠিক জান্নাতে থাকবে না- বরং জান্নাতের ফল ভক্ষণ করবে এবং জান্নাতের সুগন্ধি লাভ করবে।
১৫। কা’ব আহ্বার (রাঃ) বলেন- মুমিনদের রূহ্ “ইল্লিয়্যিন” বা উর্দ্ধ জগতে অবস্থান করবে- যা সপ্তম আকাশের মধ্যে অবস্থিত। আর কাফেরদের রূহ্ অবস্থান করবে “ছিজজীন” নামক সপ্ত তবক যমীনের নিচে। (ইহাই সাধারন ধারণা)।
উল্লেখ্যঃ এই মতের পক্ষে জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায় কোরআন মজিদে। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন-
كَلَّا إِنَّ كِتَابَ الْأَبْرَارِ لَفِي عِلِّيِّينَ
অর্থাৎ-“অবশ্যই সৎ লোকের আমলনামা থাকবে ইল্লিয়্যিনে।” [কুরআন ৮৩:১৮]
(১৬) কারো কারো মতে عليين শব্দটি علوي এর বহুবচন। এর অর্থ হলো- উর্দ্বজগত। (ছুরা তাত্ফীফ-১৮ আয়াত)।
এতে বুঝা যায়- মোমেনগণের রূহ্ উর্দ্ধজগতে থাকবে। হযরত বারা ইবনে আযেব (রাঃ) -এর হাদীস থেকে জানা যায়- ইল্লিয়্যিন সপ্তম আকাশের আরশের নীচে একটি স্থানের নাম। এতে মোমেনগণের রূহ্ ও আমলনামা সংরক্ষিত থাকে। (১৫ ও ১৬ নং মতামত প্রায় একরকম)।
(১৭) মোল্লা আলী ক্বারী (রহঃ) মিরকাতে লিখেছেন-
النفوس القدسیۃ اذا تجردت عن العلائق البدنیۃ التصلت بالملاء الا علی وتسیر فی اقطار السمٰوٰت والارض حیث تشاء وتری وتسمع الکل کالمشاھد۔
অর্থাৎ- “পবিত্র আত্মাসমূহ শারীরিক বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে উর্দ্ধজগতের ফিরিস্তাদের সাথে মিশে যায় এবং আসমান যমীনের যথায় ইচ্ছা- ভ্রমণ করে, আর জীবিত লোকদের ন্যায় সব কিছু প্রত্যক্ষভাবে দেখে ও শুনে”। (৪ ও ১৭ নং সামঞ্জস্যপূর্ণ)।
বদকারের রূহ্ঃ
=======
১৫ নম্বরে বর্ণিত হাদীস মতে বদকার ও কাফেরদের অবস্থান হবে ছিজজীন। এর প্রমাণ কোরআন মজিদে আছে। যথা-
كَلَّا إِنَّ كِتَابَ الفُجَّارِ لَفِي سِجِّينٍ
অর্থাৎ- ”নিশ্চয়! পাপাচারীদের আমলনামা ছিজজীনে আছে”। এর অর্থ-শংকীর্ণ জায়গার বন্দীশালা। (সুরা তাত্ফীফ-৭ আয়াত)। হাদীস ও রেওয়ায়াত থেকে জানা যায় যে, ছিজজীন একটি বিশেষ স্থানের নাম। এখানেই কাফেরদের রূহ্ বন্দী থাকবে এবং এখানেই তাদের আমলনামাও থাকবে।
বিশ্লেষণঃ
=====
উপরে বর্ণিত ১৭টি মতামতের সবগুলোই সঠিক। কেননা, মুমিনের রূহ্ ইল্লিয়্যিনে থাকলেও মুক্ত পাখীর ন্যায় থাকবে। জান্নাতে প্রবেশ করে ফল খেয়ে আবার সস্থানে ফিরে আসবে। জান্নাতের আশেপাশে, কবরের আশেপাশে তাদের রূহ্ যাতায়াত করতে পারে। কখনও হযরত আদমের ডানে দেখা গেছে-কখনও হাদরা মাউতের কুপে, কখনও বরহুতে তাদের রূহ্ যাতায়াত করতে দেখা গেছে। বিভিন্ন জায়গায় দেখা যাওয়া যেমন সত্য-তেমনিভাবে ইল্লিয়্যিনে স্থায়ী বাসস্থানে থাকাও সত্য।
গৃহে আগমনঃ
======
একটি রেওয়ায়াতে শাহ্ আবদুল আযিয দেহ্লভী (রহঃ) লিখেছেন- “প্রতি বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত্রে- অর্থাৎ জুমার রাত্রে রূহ্ আপন ঘরে আসে”। এ বিষয়ে তিনি একটি কিতাব লিখেছেন যার নাম
اتیان الارواح الی دیارھم بعد الرواح
অর্থাৎ “মৃত্যুর পর রূহ্গণের আপন গৃহে আগমন”।
হুযুর (ﷺ)- এর রূহ্ মোবারক কোথায়?
=======
আমাদের প্রিয়নবী (দুরূদ) -এর দেহ মোবারককে মঙ্গলবার দিবাগত শেষরাত্রে রওযা মোবারকে দাফনের ৪০ ঘন্টা পরেই তাঁর পবিত্র দেহে রূহ্ মোবারক ফিরত দেয়া হয়েছে। আবু দাউদ শরীফে আছে- الا رد الله علي روحي
অর্থাৎ “আল্লাহ্তায়ালা আমার রূহ্ ফেরত দিয়েছেন”। নবীজির এই হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ুতি তাঁর “আল হাভী লিল ফাতাওয়া” এবং তকিউদ্দীন সুবুকী তাঁর “শিফাউস সিকাম” গ্রন্থে বলেছেন-
ان النبی ﷺ بعد ما دفن فی قبرہ ردا اللّٰہ روحہ الی جسدہ واستمرت الروح فی جسدہ الی یوم القیامۃ لیرد علی اامتہ السلام۔
অর্থাৎ- “রাসুলেপাককে (ﷺ) (মঙ্গলবার দিবাগত শেষরাত্রে) দাফন করার পর আল্লাহ্পাক তাঁর পবিত্র রূহ তাঁর দেহ মোবারকে ফিরত পাঠিয়ে দিয়েছেন। এই রূহ্ মোবারক পবিত্র দেহে কিয়ামত পর্য্যন্ত অবস্থান করবে- উম্মতের সালামের জওয়াব দেয়ার জন্য”। (আল-হাভী ও শিফাউস সিকাম)
সুতরাং তিনি হায়াতুন্নবী বা সশরীরে জীবিত। এতে সমস্ত ওলামাগণের মতৈক্য রয়েছে। ফয়যুল বারী শরহে বোখারী প্রথম পারায় উল্লেখ আছে-
واتفق العلماء علي حياة الأنبياء
অর্থাৎ-”সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরাম সশরীরে জীবিত আছেন -এ কথার উপর সমস্ত ওলামায়ে কেরামের ঐক্যমত্য রয়েছে”। (ফয়যুল বারী)