রমজান মাসের ৪ টি গুরুত্বপূর্ণ মাসআলার দলিল

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

১.রোজার মৌখিক নিয়্যত

২.আল্লাহুম্মা লাকা সুমতু-ইফতারের দোয়া

৩.তারাবির সোবাহানাযিল মুলকী

৪.শবে কদর এর অন্যতম সম্ভাবনা ২৭ রমাদ্বান

✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪

রমাদ্বানের রোযার নিয়তের মৌখিক উচ্চারণ প্রসঙ্গঃ—

✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪

রমাদ্বানুল কারীমে সাহরী ও ইফতারের সময়সূচীতে প্রায়ই লেখা থাকে:

”রোজার নিয়ত: নাওয়াইতু আন আছুমা গাদাম মিন শাহরি রমাদ্বান মুবারাক,ফারযল্লাকা ইয়া আল্লাহু ফাতাকাব্বাল মিন্নি ইন্নাকা আন্তাস সামিউল আলিম”।

এই দোয়া পড়া বিদ’আত— এটাই হলো বিরুদ্ধবাদীদের মূল বক্তব্য।

সর্বপ্রথম কথা হলো ‘নিয়ত’ নিয়ে।’নিয়ত’ শব্দের মানেই হলো ‘ইচ্ছাপোষণ করা'(Intention).মানুষ ইচ্ছাপোষণ করে মনে মনে।তাই ‘নিয়ত’ মনে মনে করারই কথা।কিন্তু মনের কথা মুখ দিয়ে বের করাটা বিদআত কিনা সেটাই খতিয়ে দেখার বিষয়।

সুনানু তিরমিজীতে ইমাম হাকিম আবু ঈসা তিরমীযী ‘সাওম’ অধ্যায়ে তরজুমাতুল বাব বেঁধেছেন।যার নাম হলো 
باب مَا جَاءَ لاَ صِيَامَ لِمَنْ لَمْ يَعْزِمْ مِنَ اللَّيْلِ

—মানে,রাত থাকাবস্থায় সংকল্প (নিয়্যাত) না করলে রোযা হয় না।

এই অনুবাদটা আমরা নিয়েছি সালাফীদের এপ্প থেকে।এর অধীনে হাদীস হচ্ছে,

”হাফসা রাঃ হতে বর্ণিত আছে, নবীজি ﷺ বলেনঃ ফজরের পূর্বেই যে লোক রোযা থাকার নিয়্যাত করেনি তার রোযা হয়নি।”

সুতরাঙ বুঝাগেলো মনে মনে ইচ্ছাপোষণ করাটা ফরয।ইমাম তিরমীজি আরো বর্ণনা করছেন—

وَإِنَّمَا مَعْنَى هَذَا عِنْدَ أَهْلِ الْعِلْمِ لاَ صِيَامَ لِمَنْ لَمْ يُجْمِعِ الصِّيَامَ قَبْلَ طُلُوعِ الْفَجْرِ فِي رَمَضَانَ أَوْ فِي قَضَاءِ رَمَضَانَ أَوْ فِي صِيَامِ نَذْرٍ إِذَا لَمْ يَنْوِهِ مِنَ اللَّيْلِ لَمْ يُجْزِهِ وَأَمَّا صِيَامُ التَّطَوُّعِ فَمُبَاحٌ لَهُ أَنْ يَنْوِيَهُ بَعْدَ مَا أَصْبَحَ وَهُوَ قَوْلُ الشَّافِعِيِّ وَأَحْمَدَ وَإِسْحَاقَ

—আহলে ইলম বা আলিমের মতানুযায়ী উপর্যুক্ত হাদীসটির অর্থ হচ্ছে — রাত থাকতেই অর্থাৎ ফজর উদিত হওয়ার পূর্বেই রামাযানের রোযা অথবা কাযা বা মানতের রোযার ক্ষেত্রে কোন লোক নিয়্যাত না করলে তার রোযা আদায় হবে না। কিন্তু ভোর হওয়ার পরও নফল রোযার নিয়্যাত করা যায়। ইমাম শাফিঈ, ইমাম আহমদ ও এবং ইমাম ইসহাকের মত এমনই।

[অবশ্য ইমামে আযমের মাযহাবে রোযার নিয়ত সূর্যোদয়ের পরে করলেও অসুবিধা নেই বলে বিধান আছে]

অর্থাৎ একথা স্পষ্ট যে,রোযার জন্য নিয়ত করা আবশ্যক।

এখন কথা হলো,কেউ যদি রোযার নিয়ত/ইচ্ছাপোষণ করে এবং সেটার ক্ষেত্রে মুখে বলে ফেললে অসুবিধা আছে কিনা!কারণ বিরুদ্ধবাদীরা বলেন মুখে বলা বিদআত,তিনি এরপরপরই আনবেন কুল্লু বিদআতিন দালালাহ-সকল বিদাতই ভন্ডামি,বিদাতিরা জাহান্নামী,সোজা ভাষায় মুখে নিয়ত করলে জাহান্নামে যেতে হবে।এরকম ভ্রান্ততার অপনোদনের প্রসঙ্গে আসা যাক।

সহিহ বোখারীতে ‘কিতাবুস সিয়াম’ এর অধীনে

بَاب إِذَا نَوَى بِالنَّهَارِ صَوْمًا

বা,কেউ যদি রোযার নিয়ত দিনের বেলা করে— বাব এ উল্লেখ আছে,

وَقَالَتْ أُمَّ الدَّرْدَاءِ كَانَ أَبُو الدَّرْدَاءِ يَقُولُ عِنْدَكُمْ طَعَامٌ فَإِنْ قُلْنَا لاَ قَالَ فَإِنِّي صَائِمٌ يَوْمِي هَذَا

উম্মু দারদা রাঃ বলেন যে, আবুদ-দারদা রাঃ তাঁকে এসে জিজ্ঞেস করতেন, তোমাদের কাছে কিছু খাবার আছে? আমরা যদি বলতাম, নেই, তাহলে তিনি বলতেন, আমি আজ সওম পালন করব।

এটা এই কথার দলিল হয় যে,রোযা রাখার ইচ্ছা বা নিয়ত বলাটা বা মুখে প্রকাশ করাটা সাহাবায়ে কেরামের মাঝে বিদ্যমান ছিলো।

➤➤হানাফী মাযহাযবের ইমামুল ফুকাহা শায়খুল ইসলাম বুরহানুদ্দীন আল-মারগিণাণী র.(৫৯৩হি) উনার জগৎবিখ্যাত কিতাব ‘আল হিদায়া’ নামাযের নিয়তের ব্যাপারে উল্লেখ করেন—

“মুখে উচ্চারণ করা ধর্তব্য নয়।তবে উচ্চারণ করা উত্তম”।

(হিদায়া,১/৭৩,ইসলামীক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)

সুতরাং,যা সালাতের নিয়তের জন্য যা প্রযোজ্য তা সাওমের জন্য প্রযোজ্য হবেনা এমন কথা অবান্তর।

➤➤শায়খুল ইসলাম সৈয়্যদ আমিন যিনি আল্লামা ইবনে আবেদীম শামী নামেই অধিক পরিচিত— উনি লিখেন—

‹ولذا اختار في الهداية ان التلفظ بها مستحب 

 — ‘হিদায়া’ প্রণেতা (আমলের নিয়ত মনে মনে করার পাশাপাশি) মৌখিক উচ্চারণকে মুস্তাহাব বলেছেন।

(হাশিয়াতু ইবনে আবেদীন,১/১৮,রিয়াদ হতে প্রকাশিত)

➤➤”হাশিয়াতু ত্বাহত্বাভী আলা মারাকিউল ফালাহ” গ্রন্থের ১২১পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে—

قال من مشايخنا إن التلفظ بالنية سنة لم يرد به سنة النبي صلى الله عليه وسلم بل سنة بعض المشايخ

ওলামা-মাশায়েখগণ বলেন,(অন্তরের পাশাপাশি) মৌখিক উচ্চারণের মাধ্যমে নিয়ত করাটা হল সুন্নাহ।এর দ্বারা এটা উদ্দেশ্য নয় যে,এটা নবীকরিম ﷺ এর সুন্নাহ,বরঙ এটা কতিপয় ওলামা-মাশায়েখের অনুসরণ।

[আল্লামা মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল ত্বাহত্বাভী(ওফাত ১২৩১ হি),দারুল কুতুব ইলমিয়াহ]

➤➤বিখ্যাত ফতোয়ার কিতাব ‘কানযুদ দাক্বায়েক্ব’ এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘বাহরুর রায়েক’ এ উল্লেখ আছে—

وقد اختلف كلام الشايخ في باللسان فذكره في منية المصلي أنه مستحب وهو المختار وصححة في المجتبى

(অন্তরে ধারণ করার পাশাপাশি নিয়তকে) মুখে উচ্চারণ করতে হবে কিনা এব্যাপারে মাশায়েখগণের মধ্যে ইখতেলাফ আছে।’মুনিয়াতুল মুসাল্লী’ কিতাবে মুখে উচ্চারণ করাকে মুস্তাহাব সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং এটাই গ্রহণযোগ্য এবং বিশুদ্ধ মতামত বলে ‘মুজতাবা’ নামক গ্রন্থে বর্ণিত আছে।

[ইমাম যইনুদ্দীন আবু নুজাইম হানাফি(৭১০হি), বাহরুর রায়েক,১/২৯৩]

★এবার আসা যাক নিয়তের শব্দের ব্যাপারে:

মুহিতুল বুরহানী‘ কিতাবে উল্লেখ আছে

عن الشيخ الإمام شمس الأئمة الحلواني رحمه الله: إذا قال الرجل: نويت أن أصوم غدا إن شاء الله كانت نيته صحيحة، لو صام غدا بهذه النية يجوز استحسانا

শায়খুল ইমাম শামসুল আইম্মাহ আল-হাওয়ালানী র.হতে বর্ণিত,কেউ যদি বলে ‘নাওয়াইতু আন আসুম্মা গাদাম’ তথা ‘আমি নিয়ত করছি আগামীকাল রোযা রাখার’— ইন শা আল্লাহ,সে নিয়তটি বিশুদ্ধই হবে। এভাবে নিয়তের মাধ্যমে যদি কেউ রোজা রাখে তবে তা উত্তম এবং জায়েজ হবে।

[আল-মুহিতুল বুরহানী ফি ফিকহিল নু’মানী,৩/২৮২,কিতাবুত্ত্বালাক,৯ম ভাগ,ইমাম বুরহান উদ্দীন বুখারী হানাফী(৬১২হি), মাকতাবায়ে শামেলা]

➤➤’জাওয়াহেরুল নাইয়্যারা শরহে মুখতাসারে কুদুরী ফি ফুরুঈল হানাফিয়্যাহ‘ তে উল্লেখ—

والسنة أن يتلفظ بها بلسانه فيقول إذا نوى من الليل نويت أن أصوم غدا لله تعالى من فرض رَمضان وإن نوى من النهار يقول نويت أن أصوم هذا اليوم لله تعالى من فرض رمضان

মুখে উচ্চারণের মাধ্যমে রাতে নিয়ত করার পদ্ধতি হল ‘নাওয়াইতু আন আসুমা গাদান লিল্লাহি তা’আলা মিন ফারদ্বির রমাদ্বান’,আর দিনে হলে বলবে ‘নাওয়াইতু আন আসুমা হাযাল ইয়াওমি লিল্লাহি তাআলা মিন ফারদ্বির রমাদ্বান’।

[ইমাম আবু বকর আলী ইবনে মুহাম্মাদ নাইয়্যারী(৮০০হি),১/৩২৯,দারুল কুতুব ইলমিয়াহ,বৈরূত]

➤➤বাদশাহ আওরঙ্গজেব প্রণীত ৮০০জন মুফতীর সমন্বয়ে গঠিত বিখ্যাত ফতোয়ার কিতাব ‘ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া‘ তে উল্লেখ

ولو قال نويت أن أصوم غدا إن شاء الله تعالی صحت نيته هو صحيح كذا في الظهيرية.

‘যহিরীয়্যা’ নামক কিতাবে উল্লেখ আছে, যদি কেউ বিশুদ্ধ চিত্তে নিয়ত করে এটা বলে যে,’নাওয়াইতু আন আসুমা গাদাম ইনশা আল্লাহু তাআলা’— তবে সে নিয়ত বিশুদ্ধ হবে।

[ফতোয়ায়ে হিন্দিয়্যা,১/২১৫, দারুল কুতুব ইলমিয়াহ]

ইমাম গাজ্জালী র. উনার রেসালা ‘আসরারুস সিয়াম’ এ নিয়্যতের মুখে নিয়তের ব্যাপারে সম্মতি উল্লেখ করেছেন।সুতরাং,এসব পর্যালোচনা করলে দেখা যায়,নিয়ত মুখে করতে কোনো অসুবিধা নেই।

আমরা একথা বলিনা যে,মুখে নিয়ত আবশ্যক! না,কস্মিনকালেও আবশ্যক নয়।অন্তরের নিয়তই মূখ্য।কিন্তু আমরা অন্তরের পাশাপাশি মুখের নিয়তকেও অস্বীকার করিনা।

যারা এটাকে নাজায়েজ-হারাম-বিদআতে সাইয়া বলতে চান তাদের জন্য ‘উসুল’ বা মূলই যথেষ্ট।

শায়খুল ইসলাম ড.তাহিরুল ক্বাদেরী উনার ‘কিতাবুল বিদআ’ তে উল্লেখ করেন,ইমাম ইবনু হাজার আসকালানী রাঃ বলেন,

“কোনো কাজ করাটা তার বৈধ হবার দলিল,কিন্তু না করাটা হারাম হবার দলিল নয়’।

[ফতুহুল বারী,১০/৫৫]

শায়খুল ইসলাম ইমামুল আইম্মাহ আল্লামা কামালুদ্দীন ইবনে হুমাম রাঃ বলেন—

“কারাহাত বা মানা হবার দলিল উপস্থাপন না করা পর্যন্ত কোনো কিছুকে মাকরূহ বলা যাবেনা”

[ফাৎহুল ক্বদীর শরহে হেদায়া,১/৪৪৬পৃ]

আর এখানে তো জগৎবিখ্যাত আলেমদের থেকে সম্মতিও পাওয়া গেলো।অতএব,মুখে নিয়ত করাটা বাধ্যতামূলক না হলেও বললে অসুবিধা নেই বরং তা মুস্তাহাব-জায়েজ।

✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪

ইফতারের দোয়া প্রসংগঃ

✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪

হাদীসে মুবারাকা হলো নবী করিম ﷺ এঁর,কিন্তু হাদীসের কিতাবে হাদীসসমূহের অপূর্ব সজ্জাগুলো বিরচিত হয় হাদীসগ্রন্থের ইমামের আক্বিদা অনুসারে।

উনি যেগুলো অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন সেসকল অধ্যায়-পরিচ্ছদের নামকরণ করে উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য খিদমতকার হিসেবে আবির্ভুত হন।

ইমাম আবু দাউদ উনার বলেন:—

وَإِنَّمَا لم أصنف فِي كتاب السّنَن إِلَّا الْأَحْكَام وَلم أصنف كتب الزّهْد وفضائل الْأَعْمَال وَغَيرهَا ، فَهَذِهِ الْأَرْبَعَة آلَاف والثمانمائة كلهَا فِي الْأَحْكَام ، فَأَما أَحَادِيث كَثِيرَة فِي الزّهْد والفضائل وَغَيرهَا من غير هَذَا لم أخرجه

আমি এখানে(সুনানে) যুহদ ,ফাদ্বায়েলে আমল ইত্যাদি বিষয়ক হাদীসগুলো লিপিবদ্ধ করিনি।এখানে সন্নিবেশিত ৪৮০০হাদীসের সবগুলোই আহকাম সম্পর্কিত।»

[রিসালায়ে আহলে মক্কা,৩৪পৃষ্ঠা,ইমাম আবু দাউদ]

অর্থাৎ,এতটুকু অন্তত স্পষ্ট হলো যে,ইমাম আবু দাউদ শরীয়তের হুকুম-আহকামের অংশ হিসেবে যে হাদীসগুলো মনে করেছেন, তা এখানে লিপিবদ্ধ করেছেন।

ইমাম আবু দাউদ সিজিস্তানী রাঃ উনার সুনানে কিতাবুস সাওম এ তরজুমাতুল বাব বেঁধেছেন এই মর্মে যে,

بَابُ الْقَوْلِ عِنْدَ الْإِفْطَارِ

বা,ইফতারের সময় কি বলবে এই ব্যাপারে রচিত পরিচ্ছেদ।  

সুতরাং,একজন সত্যান্বেষীর জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে সে ইমাম আবু দাউদের আক্বিদাকে অনুসরণ করে ইফতারের দোয়াকে মেনে নেয়।এখানে বর্ণিত হচ্ছে সেই বিখ্যাত হাদীস, যা সাধারণ মুসলমানের কাছে ‘রোজার ক্যালেণ্ডারে’ লিপিবদ্ধ ইফতারের দোয়া নামে পরিচিত:—

أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ إِذَا أَفْطَرَ قَالَ: اللَّهُمَّ لَكَ صُمْتُ، وَعَلَى رِزْقِكَ أَفْطَرْتُ 

— প্রিয় মাহবুব ﷺ ইফতারকালে বলতেন,আল্লাহুম্মা লাকা সুমতু ওয়া ‘আলা রিযকিকা আফত্বারতু।

এই হাদীসটাকে যইফ বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে।পাশাপাশি এর আগের হাদীসকে একমাত্র ইফতারের দোয়া বলে প্রচার করা হচ্ছে।

এখন দেখা যাক ‘লাকা সুমতু’- র সনদ কি বলে।

সনদ পর্যালোচনা:—

এটি একটি মুরসাল বর্ণনা।যেহেতু সনদে সাহাবী নেই।এই হাদীসে চারজন রাবী।

তন্মধ্যে,

➤মুসাদ্দাদ বিন মুসারহাদ আল-আসাদী হতে বুখারীতে ৩৮২ টি মুসলিমে ২টি হাদীস

➤হুশাইম ইবনে বাশির আস-সুলামী হতে বুখারীতে ৪৮টি, মুসলিমে ৮১টি হাদীস 

➤হু’সাইন বিন আব্দুর রহমান আস-সুলামী বুখারীতে ৪৭ টি মুসলিমে ৩১ টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে।অতএব,এই তিনজন রাবী কোনো সন্দেহ ছাড়াই বিশুদ্ধ।

এবার আসা যাক,মুআয বিন যুহরার ব্যাপারে।

➤ইমাম ইবনে হিব্বান বলেন,”তিনি তাবে’য়ী” ছিলেন।

[কিতাবুস সিকাহ,৭/৪৮২পৃষ্ঠা]

➤এবং ইমাম হিব্বান তাকে সিকাহ বা বিশস্ত রাবীদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

[তাহযিবুল কামাল,২৮/১২২,ইমাম জামালুদ্দীন মিযযী]

➤ইমাম আবি হাতেম বলেন,উনি নবীজী ﷺ হতে মুরসাল বর্ণনা করতেন।এবং হুসাইন তার কাছ থেকে হাদীস শুনেছেন।

[কিতাবু জরহে ওয়াত-তা’দীল,৮/২৪৮,ইমাম ইবনে আবি হাতেম]

➤ইমাম বোখারী তারিখুল কাবীরে তার কোনো সমালোচনা করেননি।(তারিখুল কাবীর,৪/১/৩৬৪)

➤হাফেয যাহাবী বলেন,তিনি তাবে’য়ী এবং মুরসাল বর্ণনা করতেন।

[আল কাশেফ,৫০০১নং রাবী,ইমাম শামসুদ্দীন যাহাবী]

➤ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী বলেন,তিনি মক্ববুল বা তার হাদীস গ্রহণযোগ্য।

[৬৭৩১নং রাবী,তাক্বরিবুত তাহযিব,ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী]

এখন,এত প্রশংসার পরও যদি কেউ দ্বয়ীফ বলতে চায়,তাহলে বলবো,ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী বলেন—

 أن الدارقطني والطبراني روياه بسند متصل لكنه ضعيف وهو حجة أيضا

  —“ইমাম দারাকুতনী এবং ইমাম ত্বাবারানী মুত্তাসিল বা লাগাতার সনদ(যে সনদে রাবী বাদ না পড়ে) বর্ণণা করেছেন।যদিও তা দূর্বল কিন্তু এটাও হুজ্জাত বা দলিল।”

[মিরক্বাতুল মাফাতিহ,৪/৪২৬,ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী]

অর্থাৎ,উসুলে হাদীসের দৃষ্টিতেও এই হাদীসটি ‘হাসান’ হয়ে যায়।

উসুলের নিয়ম হলো:—

وَتَعَدُّدُ الطُّرُقِ يُبْلِغُ الْحَدِيثَ الضَّعِيفَ إِلَى حَدِّ الْحَسَنِ

—-‘‘দ্বঈফ হাদিসও একাধিক সনদে বর্ণিত হলে  

‘হাসান’ হাদিস এর পর্যায়ে পৌঁছে যায়।’’

[আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী, মিরকাত : ৩/৭৭ পৃ. হা/১০০৮]

وَلَوْ تَمَّ تَضْعِيفُ كُلِّهَا كَانَتْ حَسَنَةً لِتَعَدُّدِ الطُّرُقِ وَكَثْرَتِهَا

—‘হাদিসের সমস্ত রাবী দুর্বল প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন তরিকায় বর্ণিত হওয়ার কারণে তা ‘হাসানে’ পরিণত হয়ে যায়।’

[শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনুল হুমাম : ফতহুল কাদির ফি শরহে হেদায়া : ১/৩০৬ পৃ.]

অর্থাৎ,বুঝা গেলো হাদীসটা মুরসাল হিসেবে ন্যূনতম ‘হাসান’ পর্যায়ের হবে।

☞☞এছাড়াও ‘লাকা সুমতু’র হাদীস বর্ণিত হয়েছে:—

✔’তাবাকাতে ইবনে সাদ’ এর ৬ষ্ঠ খন্ডে ১৮৯পৃষ্ঠায় ইমাম ইবনে সাদ ইমাম সুফিয়ান সাওরীর সূত্রে বর্ণণা করেছেন।

✔ইমাম তাবারানি ”মু’জামুল কবিরে” (১২৭২০নং হাদীস) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস হতে মরফু (নবীজী পর্যন্ত পৌছে এমন) সনদে বর্ণনা করেছেন।

✔একই হাদীস ইমাম দারাকুতনী ‘সুনানে’ ২/১৮৫পৃষ্ঠায় বর্ণনা করেছেন

✔ইমাম ইবনুস সুন্নী ভিন্ন সনদে ‘আমালিল ইয়াওমি ওয়াল্লাইল’ কিতাবে ১৪১পৃষ্ঠায় ৪৮২ নং হাদীসে দ্বঈফ-মরফু সনদে বর্ণনা করেন।এবং যুহরার সনদে ৪৮১নং হাদীসে

✔ইমাম ইবনুস সুন্নির রেফারেন্সে ইমাম নববী ‘কিতাবুল আযকার’ এর ৫৭৮নং হাদীসে,হযরত ইবনে আব্বাস রাঃ এর সূত্রে

✔’ফুতুহাতুর রব্বানিয়া’ কিতাবে ২/৩৪১-৩৪২ পৃষ্ঠায়

✔ইমাম তাবারানি ‘সগীর’ এ (২/৫১-৫২পৃ) হযরত আনাস রাঃ এর সূত্রে দ্বইফ-মরফু সনদে বর্ণণা করেছেন।

✔’তারিখে আসবাহান’ (২য় খন্ডে ২১৭-২১৮পৃষ্ঠায়) কিতাবে ইমাম আবু নঈম আসবাহানী হযরত আনাসের সূত্রের বর্ণনা

  —যা ‘লাকা সুমতু ওয়ালা রিজকিকা আফতারতু’ কে অটোম্যাটিক্যালি শক্তিশালী করে দেয়।

আর দেওবন্দী ফলোয়ারদের উদ্দেশ্যে বলবো,মৌলভী আশরাফ আলী থানভী সাহেব উনার ‘বেহেস্তি জেওর’ এ ইমাম দারাকুৎনীর রেফারেন্সে যা উল্লেখ করেন আমি হুবহু তুলে ধরলাম:— 

“হাদীস শরীফে আছে, রােযাদারের সামনে যখন আল্লাহর নেয়ামত আসে অর্থাৎ, ইফতারের জন্য কোন খাদ্যদ্রব্য আসে, তখন তাহার এইরূপ বলিয়া আল্লাহর নেয়ামতের শােকর আদায় করা উচিত:—

” বিসমিল্লাহি ওয়ালহামদুলিল্লাহী আল্লাহুম্মা লাকা সুমতু ওয়া’আলা রিযকিকা আফতারতু ওয়া আলাইকা তাওয়াক্কালতু সুবহানাকা ওয়াবিহামদীকা তাকাব্বাল মিন্নি ইন্নাকা আন্তাস সামিউল আলীম”।

[বেহেস্তি জেওর,২৭৯পৃষ্ঠা,(১+২+৩খন্ড),অনুবাদক:জনাব শামসুল হক ফরিদপুরী,এমদাদিয়া লাইব্রেরী,চকবাজার ঢাকা]

সুতরাং,এটা পরিষ্কার হলো যে,ক্যালেণ্ডারে যে দোয়া আমরা ছোটকাল থেকে দেখে আসছি সেগুলো অগ্রহণযোগ্য নয়,বরং আমলযোগ্য!

✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪

সোবাহানাযিল মুলকীর দলিল:

✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪

প্রথম কথা ” শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘বিশ্রাম করা‘।শরীয়তের ভাষায় রমাদ্বানের রাতে প্রতি চার রাক’আত পরপর বিশ্রাম করে,এভাবে মোট পাঁচচক্র পূরণ দ্বারা ২০রাকআত নামায আদায় করাই হলো তারাবীহ।এই ‘বিশ্রামকালে’ কে কি করবে সেটার কোনো নির্দিষ্ট ধরাবাঁধা নিয়ম নেই।যেমন: ‘ফতোয়ায়ে তাতারখানিয়া’,’মুহিতুল বুরহানী’ ইত্যাদি হানাফি ফিকহের কিতাবে উল্লেখ আছে—

فالانتظار بين كل ترويحتين مستحب بمقدار ترويحة واحدة عند أبي حنيفة وعليه عمل أهل الحرمين غير أن أهل مكة يطوفون بين كل ترويحتين أسبوعا وأهل المدينة يصلون بدل ذلك أربع ركعات وأهل كل بلدة بالخيار يسبحون أو يهللون أو ينتظرون سكوتا

— প্রত্যেক তারবীহ(৪রাকাত) এর পর বিশ্রাম করা মুস্তাহাব।এটাই ইমাম আজম আবু হানিফা এবং দুই হেরেম(মক্কা মদীনার) মানুষের আমল।তবে,মক্কার লোকেরা এই অবকাশে কাবাকে সাতচক্কর লাগিয়ে তাওয়াফ করতেন।আর মদীনার লোকেরা নফল ইবাদাত করেন।অন্যান্য শহরের লোকেরা বিশ্রাম করেন, যার অনুমতি রয়েছে।

[★ফতোয়ায়ে তাতারখানিয়া, কিতাবুসসালাত,ত্রয়োদশতম ভাগ,১/৬৫৪★

কিতাবুল মাবসুত লিস সারাখসি,কিতাবুসসালাত,বাব উত-ত্তারাবীহ ,২/১৩২]

অর্থাৎ বুঝা গেলো যে যে কোনো প্রকার নফল আমল এই অবকাশে করা জায়েজ।

আমরা সর্বপ্রথম এটা দেখাবো,যে আমরা হানাফীরা যে দোয়াটা সাধারণত পড়ি সেটা হাদীসে আছে কিনা।এবং এরপর তার উপর আমল কিরূপ এবং সবশেষে তাসবিহ কিরূপ তা জানবো,ইনশা আল্লাহ।

হাদীস নং:১➤

কিংবদন্তি হাদীসবেত্তা যার চাদরে নূরনবী ﷺ ইলমে-নূরে ভরিয়ে দিয়েছেন,সৈয়্যদুনা আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন,

يقولون : سبحان ذي الملك والملكوت سبحان رب العرش ذي الجبروت ، سبحان الحي الذي لا يموتُ ، سبحان الذي يميت الخلائق ولا يموتُ ،سبوح قدوس ، رب الملائكة والروحً………

 (বিশাল একখানা হাদীসে মুবারাকায় নবীজী ﷺ এরশাদ করেন,কিয়ামত দিবসে) ফেরেশতারা এই তসবি পড়তে থাকবেন যে,’সুবহানাযিল মুলকী ওয়াল মালাকুতি সুবহানা রব্বিল আরশি যিল জাবারুত, সুবহানাল হায়্যুল্লাযি লা য়ামুতূ, সুবহানাল্লাযি ইউমিতুল খালাইক ওয়ালা ইয়ামূত,সুব্বুহুন কুদ্দুসুন রব্বুল মালাইকাতি ওয়াররূহ……»

এই হাদীসখানা বর্ণিত হয়েছে:—

✔জামেউল বায়ান আন তাভীলিল কোরআন,২/২৩০,ইমাম আবু জাফর ত্বাবারী র.
✔ইমাম ইবনে আবিদ দুনিয়া,কিতাবুল আহওয়াল,৫৫নং হাদীস।
✔তফসিরে ইবনে আবি হাতেম,হাদীস নং #১৬৬২১, #১৬৬২৮ এবং #১৬৬২৯।
✔আহাদীসুত ত্বাভীল,ত্বাবারানী ৩৬নং হাদীস
✔তফসিরে ইবনে কাসীর,২/১৩২,দারু ইবনে জওযী।
✔মুখতাসারু তাফসিরে ইবনে কাসীর,১/১২০, আয়াতের ব্যাখ্যা,আল্লামা সাবূনী র.
✔সাফওয়াতুত তাফাসির,১ম খন্ড ১৩৪পৃষ্ঠা,আল্লামা সাবূনী,দারুল কুতুব ইল্মিয়্যাহ হতে ছাপা।
✔আল বুদুরুস সাফিরাহ ফি আহওয়ালিল আখিরাহ,৬৮পৃষ্ঠা,ইমাম জালালুদ্দিন আব্দুর রহমান সূয়ুতী, দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ।

হাদীস নং:২➤

ইমাম দায়লামীর ‘মুসনাদিল ফেরদৌস’ শরীফের বরাতে ইমাম হিন্দী হাদীস সংকলন করেন—

سبحان ذي الملك والملكوت سبحان ذي العزة والجبروت سبحان الحي الذي لا يموت. (الديلمي عن معاذ)

— মুআয বিন যাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে (উক্ত তাসবীহ প্রমাণিত এবং) বর্ণিত যে,সুবহানাযিল মুলকি ওয়াল মালাকুতি সুবহানাযিল ইয্যাতি ওয়াল জাবারুত সুবহানাল হাইয়্যিল ল্লাযি লা ইয়ামূত।

(ইমাম মুত্তাকি উল হিন্দী,কানযুল উম্মাল ২০৬৩নং হাদীস) 

হাদীস নং:৩➤

আরেকটি হাদীসে বর্ণিত—

وروى الديلمي من حديث أنس…… سبحان ذي الملك والملكوت سبحان ذي العزة والجبروت سبحان الحي الذي لا يموت سبوح قدوس رب الملائكة والروح

— ইমাম দায়লামী হযরত আনাস রাঃ এর সূত্রে হাদীস বর্ণনা করেছেন,……(অনুরূপ শব্দগুলোই) সুবহানাযিল মুলকী ওয়াল মালাকুতি সুবহানাযিল ইয্যাতি ওয়াল জাবারুত সুবহানাল হাইয়্যিল লাযী লা ইয়ামুতূ সুব্বুহুন কুদ্দুসুন রব্বুল মালা ইকাতি ওয়াররূহ

[তাখরীজু আহাদিসীল এহইয়া উলুমিদ্দীন লি ইমাম গায্যালি,৬/২৪৬৬,ইমাম যইনুদ্দীন ইরাকী ও ইমাম ইবনে সুবুকী,মাক্তাবায়ে শামেলা]

এখন তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম তিনটাই দ্বইফ।তখন ইমাম যাহাবী বলেন:—

قَالَ أَبُو مُحَمَّدِ بْنُ حَزْمٍ: جَمِيعُ الْحَنَفِيَّةِ مُجْمِعُونَ عَلَى أَنَّ مَذْهَبِ أَبِي حَنِيفَةَ أَنَّ ضَعِيفَ الْحَدِيثِ أَوْلَى عِنْدَهُ مِنَ الْقِيَاسِ وَالرَّأْيِ.

—‘‘ইমাম আবু মুহাম্মদ ইবনে হাযম (رحمة الله) বলেন, সকল হানাফীগণ এ বিষয়ে একমত কোন আলেমের নিজ কিয়াস এবং রায় হতে দ্বঈফ সনদের হাদিসের আমল করা উত্তম।’’

[যাহাবী, তারিখুল ইসলাম, ৩/৯৯০ পৃ. ক্রমিক. ৪৪৫]

 ইমাম বদরুদ্দীন আইনী বলেন—

وقد جوز العلماء التساهل فى الضعيف من غير بيان ضعفه فى المواعظ والقصص وفضائل الاعمال

—‘‘ওলামায়ে কেরামের নিকট দ্বঈফ হাদিস ওয়াজ ও কাহিনীর জন্য এবং ফাযায়েলে আমলের জন্য গ্রহণযোগ্য।’’

[আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী : উমদাতুল ক্বারী, শরহে বুখারী : ১/৯ পৃ.]

কিন্তু এই হাদীসটা তো ‘হাসান’ পর্যায়ে উন্নীত হয়ে গেলো। কেননা 

মুহাক্কিক আলাল ইত্বলাক (যার তাহক্বিকের পর পুনঃতাহক্বিক প্রয়োজন নেই) শায়খ আব্দুল হক্ব মুহাদ্দিসে দেহলভী র. বলেন—

الضعيف الذى بلغ بتعدد الطرق مرتبة الحسن لغيره ايضا مجمع وَمَا اشتهرَ (مقدمۃ للشیخ : فصل العاشر : ۲۵)

-‘‘আর দ্বঈফ হাদিস যদি বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয় এবং তার দুর্বলতা দূরীভূত হয়, তাহলে তাকে “হাসান লিগাইরিহি” নামে নামকরণ করা হয়।’’

মুহাদ্দিস আব্দুর রহমান মোবারকপুরী লিখেন-

وَتَعَدُّدُ الطُّرُقِ يُبَلِّغُ الْحَدِيثَ الضَّعِيفَ إِلَى حَدِّ الْحَسَنِ

-‘‘যঈফ হাদিস যখন একাধিক সূত্রে বর্ণিত হয় তা ‘হাসান’ স্তরে উন্নিত হয়।’’ 

[তুহফাতুল আহওয়াজি শরহুসসুনান তিরমিযী, ২/৩৭২ পৃ.]

অতএব,বুঝা গেলো তারাবীহকালের তাসবিহটি হাদীস শরিফে আছে এবং হাসান হাদীসের কারণে তা দলিলের উপযুক্ত। মূলত এই তাসবীহগুলো হলো ফেরেস্তাদের তসবিহ,যেমনটা উল্লেখ আছে মুস্তাদরাকে হাকেমে(৩/৮৭),ইমাম হাকেম হাদিসটিকে বুখারীর শর্তে সহিহ বলেছেন।

➤➤➤তারাবিহ তে তসবি পড়ার হুকুম:

শায়খুল ইসলাম ইমাম আবুল হাসান আলী মারগিণানি র. বলেন—

“মুসতাহাব এই যে, মানুষ রমাযান মাসে ঈশার পরে একত্র হবে এবং ইমাম সাহেব তাদেরকে নিয়ে পাঁচ তারবীহা (অর্থাৎ দুই রাকাত করে চার রাকাআতী সালাত) পড়বেন। প্রতিটি তারবীহা (চার রাকাআত) দুই সালামে হবে। এবং প্রতিটি তারবীহার পরে এক তারবীহা ‘সময় বসবে। এরপর ইমাম সাহেব তাদেরকে নিয়ে বিতর পড়বেন।”

[আল হিদায়া,১/১২৬,কিতাবু ক্বায়ামুর রমাদ্বান,ইফাবা]

আর এই সমস্ত তাসবিহগুলোকে একত্রে এনে ছৈয়্যদ আমিন যিনি সারা দুনিয়ায় আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী রহ নামে বিখ্যাত উনি লিখেছেন—

قَالَ الْقُهُسْتَانِيُّ: فَيُقَالُ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ «سُبْحَانَ ذِي الْمُلْكِ وَالْمَلَكُوتِ، سُبْحَانَ ذِي الْعِزَّةِ وَالْععَظَمَةِ وَالْقُدْرَةِ وَالْكِبْرِيَاءِ وَالْجَبَرُوتِ، سُبْحَانَ الْمَلِكِ الْحَيِّ الَّذِي لَا يَمُوتُ، سُبُّوحٌ قُدُّوسٌ رَبُّ الْمَلَائِكَةِ وَالرُّوحِ، لَا إلَهَ إلَّا اللَّهُ نَسْتَغْفِرُ اللَّهَ، نَسْأَلُك الْجَنَّةَ وَنَعُوذُ بِك مِنْ النَّارِ»

—”ইমাম কুহস্তানি বলেন,অতঃপর তিনবার পড়বে,

সুবহানাযিল মুলকি ওয়াল মালাকুতি সুবহানাযিল ইয্যাতি ওয়াল আযমাতি ওয়াল কুদরতি ওয়াল কিবরিয়াই ওয়াল জাবারুত।সুবহানাল মালিকিল হাইয়্যাল্লাযি লা ইয়ামূতূ সুব্বুহুন কুদ্দুসুন রব্বুল মালাইকাতি ওয়াররূহি,লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু নাস্তাগফিরুল্লাহি নাস’আলুকাল জান্নাতি ওয়া নাউযুবিকা মিনান্নার”।

[হাশিয়াতু ইবনে আবেদীন, ২/৪৬, কিতাবুসসালাত,বাব আল বিতরি ওয়ান্নাওয়াফেল]

তারাবিহর নামাযের বর্ণনায়,অবকাশকালে কি করবে তার ব্যাপারে বলতে গিয়ে ইমাম কুহিস্তানীর উদ্ধৃতিতে তাসবীহ পাঠ করার কথা উল্লেখ করেছেন।যেমনটা দুররুল মুখতারে ইমাম হাস্কাফী ও উল্লেখ করেছেন।

অতএব,প্রমাণিত হলো সালাতুত তারাবীহ এর মধ্যবর্তী দোয়া বানোয়াট ভিত্তিহীন নয়, বরঙ তা মুস্তাহাব এবং ফুকাহায়ে কেরামের দৃষ্টিতে আমলযোগ্য।

✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪

২৭শে রমাদ্বান শবে কদর হওয়া প্রসংগঃ

✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪

নবিপাকের বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে,লাইলাতুল ক্বদরের রাত্রিটি নাজাতের দশক তথা শেষ দশদিনেই নিহিত রয়েছে। হাজার মাসের চেয়েও দামি ক্বদরের সম্ভাবনা প্রত্যেক বেজোড় রাত ২১,২৩,২৫,২৭,২৯ তেই রয়েছে। কিন্তু সাধারণ জনগণ যারা বিশেষত গ্রামাঞ্চলে আছেন তারা পূর্বের মুরুব্বিদের পথনির্দেশনা হিসেবে এবং যারা দৈনন্দিন কাজে কর্মক্ষেত্রে ব্যতিব্যস্ততার জন্য ইবাদাতের যথেষ্ট সুযোগ পাননা তারা অবসর তৈরী করে নিয়ে, বিশেষ করে ২৭তম রজনীতে ক্বদর তালাশ করেন।আর তখন তাদের মন টা ভেঙে দেন কিছু কিতাব খেয়ানতকারী আধা শিক্ষিত পাব্লিক ,যারা ২৭ কে বিশেষ মনে করাকে বিদআত বলে আখ্যায়িত করে অবুঝ পাব্লিকগুলো ক্বদর হতে মাহরুম/বিরত রাখার শয়তানী পায়তারা করেন।

➤➤➤ইমাম তিরমিজি উনার ‘জামি’ তে ‘কিতাবুসসাওম’ এ ‘তরজুমাতুল বাব‘ باب مَا جَاءَ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ /লাইলাতুল ক্বদর এর আলোচনা’য় বর্ণনা করেন—

وَقَدْ رُوِيَ عَنْ أُبَىِّ بْنِ كَعْبٍ أَنَّهُ كَانَ يَحْلِفُ أَنَّهَا لَيْلَةُ سَبْعٍ وَعِشْرِينَ ‏

হযরত উবাই ইবনু কাব রাঃ (যিনি তারাবিহর জামাতের ইমাম) হতে বর্ণিত,তিনি কসম করে বলেছেন,তা (লাইলাতুল ক্বদর) হল সাতাশ তারিখের রাত্রি।»

হযরত কাব রাঃ উনার কথার সাক্ষ্য হিসেবে ফুকাহাতুস সাহাবা সৈয়্যদুনা আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাঃ এর কথা বলেন এভাবে —

وَاللَّهِ لَقَدْ عَلِمَ ابْنُ مَسْعُودٍ أَنَّهَا فِي رَمَضَانَ وَأَنَّهَا لَيْلَةُ سَبْعٍ وَعِشْرِينَ

(কাব বলেন) আল্লাহর কসম!ইবনু মাসউদ রাঃ ও জানেন যে, সেটা হচ্ছে রমযানের রাত এবং সাতাশেরই রাত।

কিন্তু,যদি এই ব্যাপারটা ‘খাস’ বা স্পেশাল করে দেয়া হয় তবে মানুষজন ইবাদত কমিয়ে দিবে,যারপরনাই উবাই ইবনু কাব রাঃ তৎক্ষণাত বলেন—

«وَلَكِنْ كَرِهَ أَنْ يُخْبِرَكُمْ فَتَتَّكِلُوا

—কিন্তু তোমাদেরকে তিনি(ইবনে মাসউদ) তা জানাতে পছন্দ করেননি, তোমরা যদি পরে এটার উপর নির্ভর করে বসে থাক।»

আর বর্তমানে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে রীতিমতো লাইলাতুল ক্বদর কে ২৭ তারিখে তালাশ করাকে বিদআত মনে করা হচ্ছে।এখন আমরা দেখে নিবো লাইলাতুল ক্বদর ২৭ হবার ব্যাপারে বর্ণিত কিছু হাদীস।

➤➤হাদীস নং ১:—

«عَنْ مُعَاوِيَةَ بْنِ أَبِي سُفْيَانَ، عَنِ النَّبِيِّ صلي الله عليه وسلم فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ قَالَ,”‏ لَيْلَةُ الْقَدْرِ لَيْلَةُ سَبْعٍ وَعِشْرِينَ”‏

— আমিরে মুয়াবিয়া রাঃ বর্ণনা করেন,নবীকরিম ﷺ লাইলাতুল ক্বদর সম্পর্কে বলেছেনঃ লাইলাতুল ক্বদর সাতাশের রাতে।(সহিহ)

হাদীসটি বর্ণিত আছে:—

★সুনানু আবি দাউদ,হাদিস নং ১৩৮৬
★আত-তামহীদ,২/২০৫,ইমাম ইবনে আব্দিল বার মালেকী 
★শরহু মা’আনিল আছার,৩/৯৩,ইমাম ত্বাহাবী
★সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং ৩৬৮০
★মু’জামুল কাবীর,১৯ তম খন্ড ৮১৩নং হাদীস,ইমাম তাবারানি
★মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা,৩/৭৬
★সুনানু কুবরা,৩/৩১২,ইমাম বায়হাক্বী

➤➤হাদীস নং ২:—

মুসলিম শরীফে উল্লেখ আছে,হযরত যির র. বলেন,

«فَقُلْتُ إِنَّ أَخَاكَ ابْنَ مَسْعُودٍ يَقُولُ مَنْ يَقُمِ الْحَوْلَ يُصِبْ لَيْلَةَ الْقَدْرِ ‏.‏ فَقَالَ رَحِمَهُ اللَّهُ أَرَادَ أَنْ لاَ يَتَّكِلَ النَّاسُ أَمَا إِنَّهُ قَدْ عَلِمَ أَنَّهَا فِي رَمَضَانَ وَأَنَّهَا فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ وَأَنَّهَا لَيْلَةُ سَبْعٍ وَعِشْرِينَ ‏.‏ ثُمَّ حَلَفَ لاَ يَسْتَثْنِي أَنَّهَا لَيْلَةُ سَبْعٍ وَعِشْرِينَ

—আমি উবাই ইবনু কাব রাঃ কে বললাম, আপনার ভাই আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাঃ বলেন, যে ব্যক্তি গোটা বছর রাত জাগরণ করে- সে কদরের রাতের সন্ধান পাবে। তিনি (উবাই) বললেন, আল্লাহ তাকে রহম করুন, এর দ্বারা তিনি এ কথা বুঝাতে চাচ্ছেন যে, লোকেরা যেন কেবল একটি রাতের উপর ভরসা করে বসে না থাকে। অথচ তিনি অবশ্যই জানেন যে, তা রমযান মাসে শেষের দশ দিনের মধ্যে এবং ২৭তম রজনী। অতঃপর তিনি দৃঢ় শপথ করে বললেন, তা ২৭তম রজনী।»

হাদীস #২৬৬৭ (হাদীস একাডেমি)

➤➤হাদীস নং ৩:

মুসনাদ আহমদ এর ৪৮০৮ নং হাদীসে উল্লেখ—

عن بن عمر قال قال رسول الله ﷺ: من كان متحريها فليتحرها ليلة سبع وعشرين 

— হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাঃ হতে বর্ণিত,নবিজী বলেন,তোমাদের মধ্যে যে এটা(ক্বদর) তালাশ করে সে যেন ২৭ তারিখের রাতে তালাশ করে।

ইমাম হায়সামী বলেন,হাদীসটির বর্ণনাকারীরা সকলেই বিশুদ্ধ।

হাদীসটি বর্ণিত আছে:

★শরহু মা’আনিল আছার,৩/৯১,ইমাম ত্বাহাবী

★মুসনাদু আবি দাউদ ত্বায়লিসী,১৮৮৮নং হাদীস

★সুনানু কুবরা,৪/৩১১,ইমাম বায়হাক্বী

★মাজমাউয যাওয়ায়েদ,৫০৪৫ নং হাদীস,ইমাম হায়সামী(দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ হতে প্রকাশিত)

➤➤হাদীস নং ৪:

হযরত জাবের বিন সামুরাহ রাঃ বর্ণনা করেন—

قال رسول الله ﷺ:التمسوا ليلة القدر ليلة سبع وعشرين

—নবিজী বলেন,তোমরা (রমাদ্বানের) ২৭ তম রাতে ক্বদর তালাশ করো।

ইমাম হায়সামী বলেন,বর্ণনাকারীরা সবাই সিকাহ বা বিশ্বস্ত।

হাদীসটি বর্ণিত আছে:

★মাজমাউয যাওয়ায়েদ,৫০৫৭ নং হাদীস,ইমাম হায়সামী(দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ হতে প্রকাশিত)
★মুজামুল আওসাত,হাদীস নং ৫০৯৮,ইমাম তাবারানি

➤➤হাদীস নং ৫:

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ বর্ণনা করেন একবৃদ্ধ রূগ্ন লোক নবীজীর কাছে এসে শবে ক্বদর তালাশের কথা বললে উনি বলেন—

 فقال “عليك بالسابعة”

—সপ্তম রাতে (২৭ তারিখ) তালাশ করো।

 ইমাম হায়সামী বলেন,হাদীসটির বর্ণনাকারীরা সবাই বিশুদ্ধ হাদীসের বর্ণনাকারী।

হাদীসটি বর্ণিত আছে:

★মুসনাদ আহমদ,১/২৪০
★মুজামুল কাবীর,১১/৩১১,নং ১১৮৩৬,ইমাম তাবারানি
★সুনানু কুবরা লিল বায়হাক্বী,৪/৩১৩
★তারিখে বাগদাদ,১০/৪৮০,খাতিবে বাগদাদী
★হিলইয়াতুল আওলিয়া,৯/২৩০
★মাজমাউয যাওয়ায়েদ,৫০৪৭ নং হাদীস,প্রাগুক্ত।

➤➤এভাবে তফসিরে রূহুল মা’আনী,১৫/৪১৩ তে উল্লেখ

وأخرج ابن أبي شيبة عن أبي ذر أنه سئل عن ليلة القدر فقال: كان عمر وحذيفة وناس من أصحب رسول الله ﷺ لا يشكون أنها ليلة سبع وعشرين. 

— ইমাম ইবনে আবি শায়বা স্বীয় মুসান্নাফে বর্ণনা করেন,হযরত আবুযর গিফারী রাঃ লাইলাতুল ক্বদরের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হলেন।তখন তিনি বললেন, হযরত ওমর রাঃ এবং হুযায়ফা রাঃ সহ অনেক সাহাবীয়ে রাসুল ﷺ হতে বর্ণিত যে,সাতাশ তারিখের রাতই শবে ক্বদর।

➤➤আবার তাফসিরে ক্বুরতুবীর ২২তম খন্ডের ৪০০ পৃষ্ঠায় এবং ইমাম জওযীর ‘যাদুল মাসীর ফি উলুমিত তাফসির’ এর ৯ম খন্ডের ১৭৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহুল কারীম এবং হযরত আয়েশা সিদ্দিকা আলাইহাস সালাম হতে সাতাশ তারিখের বর্ণনা প্রমাণিত আছে।

সুতরাং

 (১)উবাই ইবনু কা’ব,

(২)আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ,

(৩)আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস,

(৪)মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান, 

(৫)ওমর ইবনুল খাত্তাব,

(৬)আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর,

(৭)আবুযর গিফারী,

(৮)হুযায়ফা ইবনু ইয়ামান,

(৯)জাবের বিন সামুরাহ,

(১০)আয়েশা সিদ্দিকা এবং 

স্বয়ং ‘জ্ঞানের দরজা’ (১১) আলী ইবনু আবি তালিব সব সর্বমোট এগারোজন ফকিহ সাহাবী হতে ‘সাবআ ঈশরিন’ বা সাতাশ তারিখের বর্ণনা উল্লিখিত আছে।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment