“যদি পেতাম এমন শাসক” এই ইসলামিক সত্য গল্পটি হযরত উমর (রাঃ) শাসন আমলের। গল্পটিতে গভর্নর হযরত সাঈদ ইবনে আমের (রাঃ) তাঁর দায়িত্ব পালনের নিষ্ঠা ও সততা ফুটে উঠেছে। তাহলে চলুন একজন সৎ ও ন্যায় শাসকের জীবনের ক্ষুদ্র ঘটনাটি পড়ি এবং আমরাও তাঁর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি!
সেই স্বর্ণযুগের কথা । হযরত সাঈদ ইবনে আমের তখন হিমসের গভর্নর। লৌহমানব হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) অনেক চিন্তা-ভাবনা করে তাঁকে সেখানকার গভর্নর নিযুক্ত করেছেন ।
কিছুকাল পরের ঘটনা ।
একদা একটি প্রতিনিধি দল খলিফার দরবারে উপস্থিত । হিসনগরী থেকে তারা আগমন করেছেন। নগরীর বিভিন্ন অবস্থা নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা শুরু হয়েছে। খলিফা প্রশ্ন করছেন, তারা উত্তর দিচ্ছেন । আবার কখনো প্রতিনিধি দল কোনো সমস্যার কথা তুলে ধরছেন, খলিফা তার সুষ্ঠু সমাধান বাতলে দিচ্ছেন । এভাবে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলো।
আলোচনা প্রায় শেষের দিকে। একটু পরেই প্রতিনিধি দল বিদায় নেবে। এমন সময় আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর (রা.) প্রতিনিধি দলের লোকদেরকে সম্বোধন করে বললেন-
তোমরা হিম্স নগরীর দুঃস্থ, গরিব ও অসহায় লোকদের একটি তালিকা প্রস্তুত করে দিয়ে যাও। আমি বায়তুল মাল থেকে তাদের সাহায্য করব। তারা তালিকা তৈরি করল। উপস্থিত করল হযরত উমর (রা.)- এর দরবারে। এ তালিকায় হিমসের গভর্নর হযরত সাঈদ ইবনে আমের (রা.)-এর নামও ছিল ।
উমর (রা.) তালিকাটি হাতে নিয়ে পড়তে লাগলেন। হঠাৎ একস্থানে গিয়ে তাঁর চোখ আটকে গেল। তিনি দেখলেন, সেই তালিকায় হযরত সাঈদ ইবনে আমের (রা.)-এর নামও আছে। তিনি বিস্ময়ের স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার? এখানে দেখছি সাঈদের নামও ৷ কোন সাঈদ ইনি?
তারা বলল, আমাদের প্রিয় গভর্নর হযরত সাঈদ ইবনে আমের (রা.)। অন্যান্য গরিব লোকদের নামের সাথে তাঁর নামও আমাদের লিখতে হলো ।
: কেন? তোমাদের গভর্নর কি দরিদ্র? তিনি কি গরিব? সীমাহীন আশ্চর্য হওয়ার ভঙ্গিতে হযরত উমর (রা.) প্রশ্ন করলেন।
হ্যাঁ, তিনি গরিব। দরিদ্র। হিম্স নগরীতে তার মতো দরিদ্র খুব কম লোকই আছে। মাঝে মাঝে একাধারে কয়েকদিন পর্যন্ত তার পরিবারে এমন অবস্থা বিরাজ করে যে, চুলায় হাড়ি চড়িয়ে পাকানোর মতো কিছুই থাকে না।
হযরত উমর (রা.) নির্বাক নয়নে প্রতিনিধি দলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ তাঁর মুখ থেকে কোনো কথা বের হলো না। একটি অব্যক্ত বেদনা তাঁর সমস্ত অন্তরটাকে নিষ্পেষিত করে চলল । তাঁর চোখের কোণে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু জড় হয়ে গণ্ডদ্বয়ে গড়াতে লাগল ।
খলিফার দরবারে তখন পিনপতন নীরবতা। কেউ কোনো কথা বলছে না । সকলের দৃষ্টি খলিফার চেহারায় নিবদ্ধ। নীরবতা ভাঙ্গলেন খলিফা নিজেই। তিনি কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে প্রতিনিধি দলের হাতে একটি থলে উঠিয়ে দিয়ে কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বললেন- তোমরা এ থলেটি নিয়ে যাও। এতে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা আছে। এটি গভর্নরকে দিয়ে বলবে, কষ্ট না করে এগুলো দিয়ে যেন সে দিন গুজরান করে।
প্রতিনিধি দল হিম্স ফিরে এল। তারা খলিফার দেওয়া এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা গভর্নর সাঈদ ইবনে আমেরের নিকট হস্তান্তর করল ।
স্বর্ণমুদ্রার থলে পেয়ে সাথে সাথে গভর্নরের মুখ থেকে উচ্চারিত. হলো,“ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন”। ভাবখানা এমন যেন তিনি বড় কোনো বিপদে পড়েছেন।
হাজার স্বর্ণমুদ্রা পেয়ে হযরত সাঈদ (রা.) সীমাহীন পেরেশান। অস্থির। এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন-
জনাব! আপনাকে আজ বেশ পেরেশান দেখাচ্ছে। মনে হয় বড় কোনো বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন আপনি। বারবার আপনি ইন্না লিল্লাহ পড়ছেন । তবে কি আমীরুল মুমিনীন ইন্তেকাল করেছেন?
হযরত সাঈদ (রা.) বললেন, না, আমীরুল মুমিনীন ইন্তেকাল করেননি। তবে আমি যে বিপদের সম্মুখীন হয়েছি তা এর চেয়েও অনেক বড় ৷
: আপনার বিপদের কথাটি অনুগ্রহপূর্বক আমার নিকট খুলে বলবেন কি?
: হ্যাঁ, বলব। অবশ্যই বলব। তোমার নিকট বলার জন্যই এখানে এসেছি।
: তাহলে দেরি না করে বলে ফেলুন। আমার যে আর সহ্য হচ্ছে না।
: শোন! কিছুক্ষণ পূর্বে খলিফার পক্ষ থেকে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রার একটি থলে আমার হস্তগত হয়েছে। খলিফার মহান ব্যক্তিত্বের কথা চিন্তা করে তা ফেরত পাঠানো আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। প্রিয়ে! তুমি তো জান, আমি দুনিয়ার ধন-দৌলত মোটেও পছন্দ করি না। সুতরাং এ স্বর্ণমুদ্রাই হচ্ছে আমার পেরেশানীর মূল কারণ ।
স্বামীর নির্লোভ অন্তরের খবর স্ত্রী আগেই পেয়েছিলেন। তবে তিনি এতটাই যে দুনিয়া বিমুখ, তা আগে তার জানা ছিল না। এখন স্বামীর মুখ থেকে কথাগুলো শুনে তাঁর প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধ আরো শতগুণে বৃদ্ধি পেল !
স্ত্রী বললেন, প্রিয়তম! পেরেশান হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই । এগুলো গরিব মুসলমানদের মধ্যে বিলিয়ে দিলেই চলবে।
: তুমি কি এতে রাজি আছ?
: অবশ্যই ।
: এ কথা ভেবে তো কষ্ট পাবে না যে, এত অভাবের সংসারে কিছুটা সাহায্য পেয়েছিলাম । স্বামীর জন্য তা রাখতে পারলাম না ।
: আমার ব্যাপারে কখনোই আপনি এমন ধারণা করবেন না । আমি অত্যন্ত খুশি মনে আপনার মনোভাবকে স্বাগত জানাচ্ছি।
স্ত্রীর কথায় হযরত সাঈদ ইবনে আমের (রা.) যার পর নাই খুশি হলেন এবং তিনি মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করলেন। মনে মনে বললেন, হে দয়াময় খোদা! তুমি আমাকে এমন এক স্ত্রী দান করেছ, যে আমার ইচ্ছা অনিচ্ছার কেবল মূল্যায়নই করে না, যথেষ্ঠ শ্রদ্ধাও করে । অতঃপর স্বামী-স্ত্রী দু’জনে মিলে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রার সবগুলোই গরিব মুসলমানদের মাঝে বিলিয়ে দিলেন ।
এ ঘটনার বেশ কিছু দিন পরের কথা। হযরত উমর (রা.) হিসবাসীদের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য সেখানে আগমন করেন। হিমসবাসীরা খলীফাকে পেয়ে আনন্দে আপ্লুত। তারা খলীফাকে দেখার জন্য ভিড় জমাল। চতুর্দিক থেকে মানুষের ঢল নামল। খলীফা স্বয়ং তাদের সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের সুবিধা-অসুবিধার কথা জানতে লাগলেন। এভাবে দীর্ঘক্ষণ চলার পর এক পর্যায়ে তিনি হিসবাসীকে সম্বোধন করে বললেন, আচ্ছা! তোমাদের গভর্নর সাঈদ ইবনে আমেরকে তোমরা কেমন পেলে?
তারা বলল, তিনি খুবই ভাল মানুষ। তার মতো ভাল মানুষ খুব কমই আছে। তবে তাঁর ব্যাপারে আমাদের তিনটি অভিযোগ আছে।
হযরত উমর (রা.) গভর্নর সাঈদ (রা.) ও হিম্সবাসীকে একত্রিত করে বললেন, এবার বল, গভর্নরের বিরুদ্ধে তোমাদের কি কি অভিযোগ আছে?
তারা বলল, গভর্নরের বিরুদ্ধে আমাদের প্রথম অভিযোগ হচ্ছে- “তিনি প্রতিদিন কিছুটা বিলম্ব করে অফিসে আসেন।”
আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর (রা.) গভর্নর সাঈদের দিকে জিজ্ঞাসুনেত্রে তাকালেন। তাঁর দৃষ্টি থেকে বুঝা যাচ্ছিল, তিনি যেন বলতে চাইছেন – সাঈদ! তোমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ খণ্ডন কর ।
হযরত সাঈদ (রা.) উঠে দাড়ালেন ৷ তিনি বললেন-
‘আমীরুল মুমিনীন! খোদার কসম, আমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের জবাব দিতে সত্যি আমি লজ্জাবোধ করছি। কিন্তু আপনার এবং হিসবাসীদের অবগতির জন্য আমাকে বলতে হচ্ছে যে, আমার বাসায় কোনো কাজের লোক নেই । কাজের লোক রাখার সামর্থও আমার নেই । তাই আমাকে গৃহস্থলি বিভিন্ন কাজে স্ত্রীকে সহযোগিতা করতে হয়। এমনকি আটা ছেনে রুটি তৈরির কাজেও আমাকে সাহায্য করতে হয় । এতে আমার অফিসে যেতে কিছুটা বিলম্ব হয়ে যায় ।
উমর (রা.) এবার হিসবাসীকে সম্বোধন করে বললেন, তোমাদের দ্বিতীয় অভিযোগ পেশ কর ।
তারা বলল, আমাদের দ্বিতীয় অভিযোগ হলো, “গভর্নর রাতের বেলা কারো ডাকে সাড়া দেন না ৷”
এ অভিযোগের জবাবে হযরত সাঈদ ইবনে আমের (রা.) বললেন, রাতের বেলা কেন আমি কারো ডাকে সাড়া দেই না, এর কারণও বলতে আমি অপছন্দ করি। এ জন্য হিম্সনগরীর কেউই তা জানে না। তবে আজ যেহেতু না বলে কোনো উপায় নেই, তাই বাধ্য হয়েই আমাকে বলতে হচ্ছে।
খলীফাতুল মুসলেমীন! আমি দিবা-রাত্রকে দু’ভাগে ভাগ করেছি। তন্মধ্যে প্রথম ভাগ অর্থাৎ দিবসের পূর্ণ অংশটি আমি মানুষের জন্য ধার্য করেছি আর দ্বিতীয় ভাগ অর্থাৎ রাত্রটিকে আমি মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলার জন্য খাস করে রেখেছি। এ জন্য রাতের বেলা মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ তাআলার সামনে থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্য কারো ডাকে সাড়া দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয় না ।
এবার উমর (রা.) হিসবাসীদের বললেন, তোমাদের আর কি অভিযোগ আছে বল ।
তারা বলল, আমাদের তৃতীয় এবং সর্বশেষ অভিযোগ হচ্ছে, “গভর্নর মাসের একটি নির্দিষ্ট দিনে কারো সাথে সাক্ষাৎ করেন না।”
উমর (রা.) বললেন, সাঈদ! এ ব্যাপারে তোমার বক্তব্য কি?
সাঈদ (রা.) বললেন, এ ব্যাপারটি প্রকাশ করাও আমার ইচ্ছার বাইরে। তার পরেও আমাকে বলতে হচ্ছে যে, কাপড়-চোপড় ধুয়ে দেওয়ার মতো আমার কোনো খাদেম নেই। আমার পরনে যে জামাটি এখন দেখছেন, এটি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো জামা-কাপড়ও আমার নেই ৷ তাই মাসে একদিন কাপড়টি ধুয়ে শুকানোর অপেক্ষা করি। কাপড় শুকিয়ে গেলে দিনের শেষ ভাগে আমি মানুষের সামনে বের হই। তাই ঐদিন অফিস টাইমে অফিসে আসা আমার পক্ষে সম্ভব হয় না।
কথাগুলো শুনে হিম্সবাসীদের কেবল ভুলই ভাঙ্গল না, এমন নিষ্ঠাবান গভর্নরের প্রতি শ্রদ্ধায় তাদের মস্তক অবনত হয়ে এল । ভালবাসা ও মহব্বত বৃদ্ধি পেল পূর্বের চেয়ে বহুগুণে। আর আমীরুল মুমিনীন উমর (রা.) বলে উঠলেন-সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহ তাআলার, যিনি সাঈদের ব্যাপারে আমাদের নেক ধারণাকে ব্যর্থ করে দেননি। – উৎস: আল-আরাবিয়্যাতুল লিন্ নাশিঈন ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২।
আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে হযরত সাহাবায়ে কেরামের পদাঙ্ক অনুসরণ করার তৌফিক দান করুন । আমীন ।
স্মরণীয় বাণী
খোদা ভীতির সাথে প্রাপ্ত অতি সামান্য বস্তু অন্যের মনে কষ্ট দিয়ে লাভ করা রত্ন ভান্ডারের
চাইতে উত্তম । – হযরত সুলাইমান (আঃ)