জিজ্ঞাসা–১৪৭: আসসালামু আলাইকুম। হুযুর, আমি জানতে চাই, স্ত্রীকে মহরানা দিতেই হবে আল্লাহ্ তায়ালার বিধান। আর স্ত্রী যদি মহরানা মাফ করে দেয় তাহলে কি আল্লাহ্ তায়ালার বিধান মানা হবে? আর স্ত্রীর কাছে মহরানা মাফ নেয়া কি অপমানজনক? আশা করি জানাবেন।–মোঃ মুঞ্জুরআলি:mdmonjurhochain@yahoo.com
জবাব: وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
এক. মোহর মূলত একটি সম্মানী যা স্বামী তার স্ত্রীকে দিয়ে থাকে, যার মূল উদ্দেশ্যই হল নারীকে সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া। এটা শুধু কথার কথা নয়, যা শুধু ধার্য করা হয়, পরিশোধ করার বাধ্যবাধকতা থাকে না; বরং শরীয়তের উদ্দেশ্য হল যখন কোনো পুরুষ স্ত্রীকে ঘরে আনবে তখন তাকে মর্যাদার সাথে আনবে এবং এমন কিছু উপহার দিবে, যা তাকে সম্মানিত করে।
শরীয়তের দৃষ্টিতে এটা এতটাই অপরিহার্য যে, মোহর ছাড়া বিয়ে হয় না। আকদের সময় উল্লেখ না করলেও কিংবা না দেওয়ার শর্ত করলেও মোহর বাতিল হয় না। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন-
فَمَا اسْتَمْتَعْتُم بِهِ مِنْهُنَّ فَآتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ فَرِيضَةً ۚ وَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ فِيمَا تَرَاضَيْتُم بِهِ مِن بَعْدِ الْفَرِيضَةِ ۚ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيمًا حَكِيمًا
অতএব তাদের নিকট থেকে তোমরা যে আনন্দ উপভোগ করেছ (সে কারণে) তাদের ধার্যকৃত মোহর তাদেরকে প্রদান করবে। আর মোহর নির্ধারিত থাকার পরও কোনো বিষয়ে পরস্পর সম্মত হলে তাতে তোমাদের কোনো অপরাধ হবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। (সূরা নিসা : ২৪)
অন্যত্র তিনি বলেন-
وَآتُوا النِّسَاءَ صَدُقَاتِهِنَّ نِحْلَةً ۚ فَإِن طِبْنَ لَكُمْ عَن شَيْءٍ مِّنْهُ نَفْسًا فَكُلُوهُ هَنِيئًا مَّرِيئًا
এবং তোমরা নারীদেরকে দাও তাদের মোহর খুশিমনে। এরপর তারা যদি স্বেচ্ছায় স্বাগ্রহে ছেড়ে দেয় কিছু অংশ তোমাদের জন্য তাহলে তা স্বচ্ছন্দে ভোগ কর।(সূরা নিসা : ৪)
দুই. উক্ত আয়াতদ্বয় থেকে কিছু বিষয় প্রমাণিত হয়। তন্মধ্যে অন্যতম হল-
১. মোহর আদায় করা ফরয। কেননা স্বয়ং আল্লাহ তাআলা মোহর আদায়ের আদেশ করেছেন। সুতরাং স্বামীর কর্তব্য যথাযথভাবে মোহর পরিশোধ করা।
২. মোহর যদিও একটি মধুর লেনদেন এবং ঐভাবেই তা আদায় করা উচিত, তবে তা নিছক উপহার নয় যে, ইচ্ছা হলে দেওয়া যায়, ইচ্ছে হলে বিরত থাকা যায়; বরং তা হল স্ত্রীর প্রাপ্য অধিকার। স্ত্রী যেমন প্রীতি ও ভালবাসার সাথে নিজেকে অর্পণ করেছে, স্বামীরও কর্তব্য সম্মান ও মর্যাদার সাথে তার মোহর আদায় করা। অতএব, মোহরের উপর নারীর অধিকার সাব্যস্ত হওয়ার পর তা পরিশোধ না করা, কিংবা অন্যায়ভাবে ফেরত নেওয়া সম্পূর্ণ অবৈধ ও হারাম।
৩. স্ত্রী যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে মোহরের কিছু অংশ ছেড়ে দেয় কিংবা গ্রহণ করার পর স্বামীকে উপহার দেয় তাহলে স্বামী তা স্বচ্ছন্দে ভোগ করতে পারবে। পূর্ণ মোহর ছেড়ে দেওয়ার বা পূর্ণ মোহর স্বামীকে উপহার দেওয়ারও অধিকার স্ত্রীর রয়েছে, তবে সাধারণ অবস্থায় পূর্ণ মোহর না দিয়ে কিছু অংশ দেওয়াই ভালো।
৪. স্ত্রীর মোহর ফাঁকি দেওয়া অতি হীন কাজ। কারণ এর অর্থ দাঁড়ায়, ভোগ করতে রাজি, কিন্তু বিনিময় দিতে রাজি নয়। যে স্বামীর মনে স্ত্রীর মোহর আদায়ের ইচ্ছাটুকুও নেই হাদীস শরীফে (মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/৫২২-৫২৩) তাকে বলা হয়েছে ‘ব্যাভিচারী’।
৫. স্বামী যদি চাপ দিয়ে বা কৌশলে পূর্ণ মোহর বা কিছু অংশ মাফ করিয়ে নেয় তাহলে আল্লাহর বিচারে তা মাফ হবে না। (দেখুন-আহকামুল কুরআন, জাসসাস ২/৫৭-৫৮; তাফসীরে ইবনে কাছীর ১/৪৪২; বয়ানুল কুরআন ২/৯৩; তাফসীরে উছমানী, পৃ. ১০০)
তিন. কারো মনে হতে পারে, জীবনে তো কত কিছুই স্ত্রীকে দিয়েছি। সবকিছু তো আমার উপর অপরিহার্যও ছিল না। সুতরাং বিয়ের সময় সামান্য যে কটি টাকা ধার্য করা হয়েছিল তা নিয়ে এত চুলচেরা হিসাব-নিকাশের কী প্রয়োজন? এই ধারণাও ঠিক নয়। কেননা মোহর আদায়ের নিয়ত ছাড়া নিছক উপহার হিসেবে যা কিছু দেওয়া হয় তার দ্বারা মোহর আদায় হয় না। আর পাওনাদারের পাওনা পরিশোধের ক্ষেত্রে চুলচেরা হিসাব করা দোষের বিষয় নয়; বরং হক্ব আদায়ে সতর্কতার কারণে হলে তা প্রশংসনীয়ও বটে। তেমনি পাওনাদারও যদি চুলচেরা হিসাব করে পাওনা বুঝে নিতে চায় তাহলেও তার নিন্দা করার অবকাশ নেই। কারণ এটা তার অধিকার। তবে কুরআন-হাদীসে উভয় পক্ষকেই সহজ ও উদার হওয়ার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে।
والله اعلم بالصواب
উত্তর দিয়েছেন
মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী





Users Today : 794
Users Yesterday : 1502
This Month : 10046
This Year : 149523
Total Users : 265386
Views Today : 3280
Total views : 3215393