সিদরা হতে আরশে আযীম পর্যন্ত সিদরাতুল মুনতাহায় পৌঁছে জিব্রাইল (عليه السلام) নবী করীম [ﷺ] থেকে বিদায় নিলেন এবং বললেনঃ
لو دنوت منها أنملة لا حرقت وفى رواية شعرة –
অর্থাৎ “সিদরাতুল মুনতাহা থেকে এক আঙ্গুল – অন্য রেওয়ায়তে চুল পরিমাণ অগ্রসর হলে আমার ছয়শত নূরের পাখা আল্লাহ্ পাকের নূরের তাজাল্লীতে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাবে।” সোব্হানাল্লাহ!
যেখানে নূরের ফেরেশতা জিব্রাইল (عليه السلام) জ্বলে যায়, সেখানে আমাদের প্রিয় নবী [ﷺ] স্বশরীরে স্বাচ্ছন্দে সামনে অগ্রসরমান। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গ্রন্থের প্রারম্ভে হযরত জাবের (رضي الله عنه) কর্তৃক বর্ণিত নূরে মুহাম্মদী সৃষ্টির হাদীসখানা আর একবার পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি- “তিনি আল্লাহর যাতী নূরের জ্যোতি হতে পয়দা হয়েছেন।” বুঝা গেল- তিনি মাটি নন। মাটি হলে তথায় জ্বলে পুড়ে ভস্ম হয়ে যেতেন। জিব্রাইল (عليه السلام) আমাদের নবীজীর [ﷺ] নূরের সামান্যতম অংশের তাজাল্লী দিয়ে সৃষ্ট। যেখানে জিব্রাইলের সীমানা শেষ, সেখান থেকে আমাদের নবীজীর [ﷺ] যাত্রা শুরু। হাকিকতে মুহাম্মদী [ﷺ] সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করতে হলে হযরত জিব্রাইল (عليه السلام) কে জিজ্ঞাসা করতে হবে-
সিদরাতুল মুনতাহার পরে জিব্রাইল (عليه السلام) নবীজীকে কেমন দেখেছিলেন। জিব্রাইলও বলতে পারবেনা – তার পরের ঘটনা কি ঘটেছিল। ফিরতি পথে হুযুর [ﷺ]-এঁর স্বরূপ কেমন ছিল – তা জানতে হবে মুছা (عليه السلام)-এঁর কাছে। সেদিন তিনি প্রকৃতপক্ষে কাকে দেখেছিলেন?
বিদায়ের সময় জিব্রাইল (عليه السلام) নবী করীম [ﷺ]-এঁর কাছে একটি আরয পেশ করেছিলেন- “আল্লাহ যেন হাশরের দিনে জিব্রাইলকে পুলছিরাতের উপর তার ছয়শত নূরের পাখা বিছিয়ে দেয়ার অনুমতি দান করেন।” উম্মতে মুহাম্মদী যেন উক্ত পাখার উপর দিয়ে পুলসিরাত পার হয়ে যেতে পারে। নবী করীম [ﷺ] আল্লাহর দরবারে জিব্রাইলের এই ফরিয়াদ পেশ করলে আল্লাহ তায়ালা ছাহাবায়ে কেরাম ও আহলে মহব্বতের লোকদের জন্য তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। আল্লাহ্ পাক বলেছিলেন, هذا لمن صحبك وأهل محبتك (মাওয়াহেব লাদুন্নিয়া)। অর্থাৎ “জিব্রাইলের পাখার ওপর দিয়ে পুলছিরাত অতিক্রম করার আরজি মঞ্জুর করা হলো-আপনার সাহাবী এবং আশেকানদের জন্য।” এই দুই শ্রেণীর লোক জিব্রাইলের পাখার উপর দিয়ে পুলছিরাত পার হয়ে যাবে।
জিব্রাইল (عليه السلام) থেকে বিদায় হওয়ার পর রফরফ নামে এক বাহন এসে নবী করীম [ﷺ]-কে আরশে আযিমে পৌঁছিয়ে দেয়। এ পথে নবী করীম [ﷺ] সত্তরটি নূরের পর্দা ভেদ করেন। এক এক পর্দার ঘনত্ব ছিল পাঁচশত বৎসরের রাস্তা। এ হিসাবে ৩৬ হাজার বৎসরের রাস্তা অতিক্রম করে নবী করীম [ﷺ] আরশে মোয়াল্লায় পৌঁছলেন। এ পথে যখন তিনি একাকীত্ব অনুভব করছিলেন, তখন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه)-এঁর আওয়ায শুনতে পেয়ে শান্ত হয়েছিলেন। আর একটি আওয়াজও তিনি শুনতে পেয়েছিলেনঃ
قف يا محمد فان ربك يصلى
অর্থাৎঃ “হে প্রিয় মুহাম্মদ [ﷺ], আপনি একটু থামুন, আপনার রব সালাত পাঠ করছেন।” আল্লাহর সাথে দীদারের সময় নবী করীম [ﷺ] এ দু’টি বিষয়ের রহস্য জানতে চাইলেন। আল্লাহ তায়ালা বললেন, আমার সালাত অর্থ আপনার উপর দরূদ পাঠ করা। আর আবু বকরের সুরতে এক ফেরেশতা সৃষ্টি করে আবু বকরের আওয়াজ নকল করা হয়েছিল- যেন আপনি শান্ত হন। মহিউদ্দিন ইবনে আরবী (رحمه الله عليه)-এঁর তাফসীরে বলা হয়েছে- হযরত আবু বকর সিদ্দিকই (رضي الله عنه) রূহানীভাবে ফেরেশতার সূরতে তথায় উপস্থিত ছিলেন। এটা ছিল তাঁর কারামত। কেননা, তিনি ছিলেন রাসুলে পাকের নিত্য সঙ্গী। তিনি দুনিয়াতে, মাযারে, হাশরের ময়দানে এবং জান্নাতেও নবী করীম [ﷺ]-এঁর সঙ্গী থাকবেন। সুতরাং মি’রাজে রূহানীভাবে উপস্থিত থাকা খুবই স্বাভাবিক (দেখুন ইরফানে শরিয়ত)। আরশে পৌঁছার পর লাওহে মাহফুয অবলোকনকালে নবী করীম [ﷺ] দেখতে পেলেন, তথায় শেষ বাক্যটি লেখা ছিল এরূপঃ
قد سبقت رحمتى على غضبى
অর্থাৎঃ “আমার গযবের উপর আমার রহমত প্রাধান্য বিস্তার করে রয়েছে।” উক্ত হাদীসে কুদসীর মধ্যে উম্মতের জন্য একটি গোপন ইশারা নিহিত রয়েছে। তা হলো- কিছু শাস্তি ভোগ করার পর সমস্ত হকপন্থী উম্মতই আল্লাহর রহমতে নাজাত পাবে। [বুখারীঃ ৭০৪৪ ইফাবা]
নবী করীম [ﷺ] আরশকে জিজ্ঞেস করলেন- আমি সমগ্র জাহানের জন্য রহমত- তোমার জন্য কিরূপে রহমত? আরশ তখন আরয করলো- আল্লাহ তায়ালা যখন আমার মধ্যে কলেমার প্রথম অংশ ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ লিখলেন, যখন আল্লাহর জালালী শানে আমার মধ্যে কম্পন সৃষ্টি হয়েছিল। মনে হয়েছিল- যেন আমি টুকরো হয়ে যাব। তারপর যখন তার পার্শ্বে আপনার জামালী নামের অংশটুকু- ‘মুহাম্মদ রাসুলুল্লাহ’ লিখে দিলেন- তখন আমার কম্পন বন্ধ হয়ে গেল (শানে হাবীব)! সুতরাং আপনি আমার জন্য বিরাট রহমত।
আরশ মোয়াল্লা হতে এবার লা-মাকানের দিকে- অজানা পথে রওনা দিলেন নবী করীম [ﷺ] – যেখানে স্থান-কাল বলতে কিছুই নেই। সমগ্র সৃষ্টি জগতই তখন নবীজির কদমের নীচে। আসমান, জমিন, চন্দ্র-সূর্য আরশ কুর্ছি- সবকিছু, এমন কি আলমে খালক (সৃষ্টি জগত) ও আলেমে আমর (নির্দেশ জগত) সবকিছু নবী করীম [ﷺ]-এর পদতলে রয়ে গেল। তিনি সমস্থ কিছু অতিক্রম করে আল্লাহর এত নিকটবর্তী হলেন যে, দুই ধনুকের চার মাথার ব্যবধান বা তার চেয়েওে কম ব্যবধান রয়ে গেল। এটা রহস্য জগত। এ অবস্থাকে মুতাশাবিহাত বা দুর্বোধ্য অবস্থা বলা হয়। কোরআন মজিদে এই মাকামকে قاب قوسين বলা হয়েছে। শারিরীক সান্নিধ্য এখানে উদ্দেশ্য নয়। আসল উদ্দেশ্য আল্লাহর নৈকট্য ও ঘনিষ্ট সান্নিধ্য বুঝানো।
তাফসীরে রুহুল বয়ান ৩য় পারা প্রথম আয়াতের তাফসীর বর্ণনা করা হয়েছে যে, “নবী করীম [ﷺ]-এঁর নূরানী সুরতের বহিঃপ্রকাশ হয়েছিল সে সময়। তাঁর বাশারিয়াত সে সময় উন্নত হতে হতে নূরে ওয়াহ্দানিয়াতের মধ্যে মিলে গিয়েছিল” যেমন মিশে যায় পানিতে চিনি। এই মাকামকে তাসাওফের ভাষায় ‘ফানা’ বলা হয়। রুহুল বায়ানের এবারতটুকু নিম্নে পাঠকদের জন্য উদ্ধৃত করা হল।
انه عليه السلام ما يبقى في مكان ولا في الامكان في ليلة المعراج لانه كان فانيا عن ظلمة وجوده -باقيا بنور وجوده -ولهذا سماه الله نورا في قوله ثعالي قد جاء كم من الله نور وكثاب مبين –
অর্থঃ- “নবী করীম [ﷺ] লাইলাতুল মিরাজে কোন স্থানে বা সৃষ্টি জগতের সীমাবদ্ধ ছিলেন না। কেননা, তখন তিনি তাঁর জড় অস্তিত্বের অন্ধকার ভেদ করে ফানা হয়ে আল্লাহর নূরের অস্তিত্বে অস্তিত্ববান হয়েছিলেন। এ কারণেই কোরানে মজিদে ( সুরা মায়েদা-১৫) আল্লাহ তায়ালা তাঁকে ‘নূর‘ বলে আখ্যায়িত করে এরশাদ করেছেন, হে জগতবাসী, তোমাদের কাছ থেকে আল্লার পক্ষ হতে প্রথমে এক মহান নূর ও পরে একটি স্পষ্ট কিতাব এসেছে।”
বুঝা গেল- তিনি দুনিয়াতে আগমনকালে নূর ছিলেন- মাটি নয়। যারা মাটি বলে – তারা ভ্রান্ত। (তাফসীর রুহুল বয়ান পৃ: ৩৯৫ তৃতীয় পারা ১ম আয়াত)। উক্ত আয়াতের পূর্ণ বিকাশ হয়েছিল “ক্বাবা কাওছাইন” মাকামে।
আল্লাহর সাথে কালাম
মহান আল্লাহ রাব্বুল ’আলামীনের সাথে নবী করীম [ﷺ]-এর কি কি কথোপকথন হয়েছিল, তা কোরআনে গোপন রাখা হয়েছে। শুধু এরশাদ করা হয়েছেঃ
فاوحي الي عبده ما أوحى –
অর্থঃ- ‘যা গোপনে বলার- আল্লাহ তায়ালা তা আপন প্রিয় বান্দার কাছে গোপনেই বলে দিয়েছেন’। নবী করীম [ﷺ] এরশাদ করেছেঃ
اوتيت العلوم وأمرت بكتمان بعضها
অর্থঃ- “আমাকে অনেক প্রকারের গুপ্ত-সুপ্ত এলেম দান করা হয়েছে এবং সাথে সাথে ঐ এলেমের কোন কোন বিষয় গোপন রাখতে আমাকে নির্দেশ করা হয়েছে।”
“কাসাসুল আম্বিয়া” নামক উর্দ্দু কিতাব নব্ব্ই হাজার কালামের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তন্মধ্যে ত্রিশ হাজার কালাম হাদিসের আকারে সকলে জন্য এবং ত্রিশ হাজার কালাম খাছ খাছ লোকদের নিকট প্রকাশ করার জন্য এবং অবশিষ্ট ত্রিশ হাজার সম্পূর্ণ নিজের কাছে গোপন রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। (তাফসীরে ছাভী দেখুন নিছা-১১৩ আয়াত)
তাফসীরে রুহুল বায়ানে বর্ণনা করা করা হয়েছে যে, নবী করীম [ﷺ] এক পর্যায়ে আল্লাহর দরবারে আরয করেছিলেন- “আমার উম্মতকে সর্বশেষে এবং কিয়ামতের নিকটবর্তী করে কেন পাঠানো হলো এবং তাদের হায়াত পূর্বের তুলনায় কম রাখা হল কেন? উত্তরে আল্লাহ তায়ালা বলেছিলেন, “আপনার উম্মতগণ যেন গুনাহ করার সময় কম পায়। সেজন্য তাদের হায়াত সংকীর্ণ করেছি এবং আপনার উম্মত যেন কম সময় কবরে থাকে- তাই তাদেরকে কিযামতের নিকটবর্তী সময়ে সর্বশেষ প্রেরণ করেছি। সুবহানাল্লাহ্!
মেরাজের রাতে সংঘটিত ঘটনা ও ইতিহাস| Events and History of the Night of Meraj
[এই সময়ের সদ্ব্যবহার করা প্রত্যেক জ্ঞানী লোকের উচিত। নবীজির [ﷺ] উম্মত হওয়ার কারণেই আমাদেরকে এ সুযোগ দেয়া হয়েছে।]
প্রত্যক্ষ দর্শনঃ
আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌছার পর প্রথমে নবী করীম [ﷺ] আল্লাহর প্রশংসা করলেন এভাবে-
التحيات لله والصلوات والطيبات –
অর্থঃ- “আমার জবান, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ও ধন সম্পদ দ্বারা যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য হাদিয়া স্বরূপ পেশ করছি।”
এর উত্তরে আল্লাহ তায়ালা নবীজিকে সালাম দিয়ে বললেন-
السلام عليك أيها النبي ورحمة الله وبركاته –
অর্থঃ- “হে আমার প্রিয় নবী, আপনার প্রতি আমার সালাম, রহমত ও বরকতসমূহ বর্ষিত হোক।” উক্ত সালামের জবাবে নবী করীম [ﷺ] আরয করলেন-
السلام علينا وعلى عباد الله الصالحين –
অর্থঃ- “হে আল্লাহ! তোমার সালাম এবং আমি আমার গোনাহগার উম্মতের উপর এবং তোমার অন্যান্য নেককার বান্দাদের উপর বর্ষিত হোক”! আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের এই ছালাম বিনিময়ের কৌশলপূর্ণ উক্তি ও ভালবাসার নমুনা এবং উম্মতের প্রতি নবীজির [ﷺ] স্নেহ-মমতা দেখে ও শুনে জিব্রাইল সহ আকাশের মোকাররাবীন ফেরেশতাগণ সমস্বরে বলে উঠলেন-
أشهر أن لا إله إلا الله واشهد ان محمدا عبده ورسوله
অর্থঃ- “আমি (প্রত্যেকে) সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নাই এবং আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ মোস্তফা [ﷺ] আল্লাহর প্রিয় বান্দা এবং তাঁর প্রিয় রাসূল।”
“আল্লাহর কাছে তিনি প্রিয় বান্দা- কিন্তু বিশ্ব জগতের কাছে তিনি প্রিয় রাসূল।” কি যে ঘনিষ্ট সম্পর্ক এখানে বর্ণনা করা হয়েছে- তা কেবল মহাজ্ঞানীরাই অনুধাবন করতে পারবেন।
আল্লাহ তায়ালা নিজের ও হাবীবের মধ্যে ভাব বিনিময়ের এই তাশাহুদ আমাদের নামাযের একটি ওয়াজিব অংশ করে দিয়েছেন। এর প্রতিটি শব্দ নামাযের বৈঠকে ওয়াযিব। আল্লাহ তায়ালার দরবারে নবী করীম [ﷺ] যেভাবে সম্মোধনমূলক তাহ্যিয়াত পাঠ করে ছিলেন এবং আল্লাহ তায়ালা যেভাবে সম্মোধন করে নবীজিকে [ﷺ] সালাম দিয়েছিলেন, অনুরূপভাবে তাশাহুদ পড়ার সময় প্রত্যেক মুছল্লিকে আল্লাহকে সম্মোধন করে তাহিয়্যাত অংশটুকু পাঠ করতে হবে এবং নবী করীম [ﷺ]-কেও সম্মোধন করে সালাম পেশ করতে হবে। ফতোয়ে শামীর এবারত দেখুন-
ويقصد بها الإنشاء لا الاخبار –
অর্থঃ- “আল্লাহর তাহিয়্যাত এবং রাসূলের প্রতি ছালাম পাঠকালীন সময়ে খেতাব বা সম্মোধন করতে হবে।” (ফতোয়ায়ে আলমগীরী ও বাহারে শরীয়ত দ্রষ্টব্য)।
যেহেতু মু’মিনদের নামায মি’রাজ স্বরূপ- সুতরাং মি’রাজের মতই আল্লাহ ও রাসূলকে সম্মোধন করতে হবে। সম্মোধন করা হয় হাযির নাযির ব্যাক্তিকে। সুতরাং নবীজি [ﷺ] হাযির-নাযির। (ইমাম গাযালীর ইহইয়া)
উম্মতের জন্য মাগফিরোতের সুপারিশঃ
রিয়াজুন্নাছেহীন কিতাবে তাফসীরে মুগনী ও মিরছাদুল ইবাদ নামক দুটি গ্রন্থের সূত্রে বর্ণিত আছে – নবী করীম [ﷺ]-কে আল্লাহ তায়ালা জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি আমার কাছে কি প্রার্থনা করেন”? নবী করীম [ﷺ] বললেন- “হে আল্লাহ, আপনি রাব্বুল ’আলামীন, আর আপনি আমাকে বানিয়েছেন রাহমাতুল্লিল ’আলামীন হিসেবে। আমার উম্মত বেশুমার গুনাহগার মুযনেবীন। আমার খাতিরে আমার গুনাহগার উম্মতকে মাফ করে দিন।” আল্লাহ তায়ালা বলেন- “আপনার খাতিরে আপনার উম্মতের মধ্যে হতে সত্তর হাজারকে ক্ষমা করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। এরপর আর কি প্রার্থনা আছে?” নবী করীম [ﷺ] পুনরায় গুনাহগার উম্মতের উল্লেখ করেলেন। এভাবে ৭০০ (সাতশত) বার প্রার্থনা করলেন। প্রত্যেকবার সত্তর হাজার গুনাহগার উম্মতের ক্ষমার ঘোষণা করলেন পাক পরওয়ারদেগার। এভাবে চার কোটি নব্বই লক্ষ উম্মতকে ঐ দিন ক্ষমার আওতায় আনা হল।
নবী করীম [ﷺ] উম্মতের মায়ায় আবারও আরয পেশ করলেন। আল্লাহ তায়ালা এবার বলেন- “এখন আপনি ও আমি একা। হাশরের ময়দানে ফেরেশতা, আম্বিয়া, আউলিয়া ও হাশরবাসীদের সবার সামনে অবশিষ্টকে ক্ষমা করবো। আপনি চাইবেন- আমি দিবো। সবাই স্বাক্ষী থাকবে এবং আপনার মর্তবা তখন সকলেই উপলদ্ধি করবে।” সুবহানাল্লাহ্। এমন এক শাহী দরবারে গিয়েও নবী করীম [ﷺ] নিজের ও পরিবারের জন্য কিছুই না চেয়ে শুধু গুনাহগার উম্মতের নাজাত প্রার্থনা করেছেন। সত্যিই তিনি ঈমানদারদের জন্য রাউফুর রাহীম। সুরা তাওবার শেষাংশে এরশাদ হয়েছেঃ
بالمءمنين رؤوف الرحيم –
অর্থঃ- “নবী করীম [ﷺ] মু’মিনদের জন্য স্নেহময় ও দয়াশীল।” এই স্নেহ ও দয়ার বহিঃ প্রকাশ হয়েছিল মি’রাজ রাত্রীতে এবং ভাবিষ্যতে হবে হাশরের ময়দান। আল্লাহর ভয়ে কেউ সুপারিশের জন্য অগ্রসর হবে না- তখন নবী করীম [ﷺ] হতাশ হাশরবাসীকে অভয় দিয়ে বলবেন, انا لها “তোমাদের শাফায়তের জন্য আমি আছি”- (বোখারি ও মুসলিম)। সুবহানাল্লাহ্!
মিরাজ হতে ষষ্ঠ আকাশে প্রত্যাবর্তন ও পূনঃ গমন অনেক রায ও নেয়াযের কথার পর আল্লাহ তাযালা উম্মতে মুহাম্মদীর উপর দিনে রাত্রে ৫০ (পঞ্চাশ) ওয়াক্ত নামায ফরয করলেন এবং নবী করীম [ﷺ]-কে বিদায় দিলেন। নবী করীম [ﷺ] যখন ষষ্ঠ আকাশে আসলেন, তখন মুছা (عليه السلام)-এর সাথে সাক্ষাত হলো। সিদরাতুল মুনতাহাতে জিব্রাইল (عليه السلام), কিংবা সপ্তম আকাশে হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام) কিংবা অন্য কোন আকাশে অন্যান্য নবীগনের সাথে সাক্ষাতের উল্লেখ কোন হাদিস গ্রন্থে দেখা যায় না। শুধু মুছা (عليه السلام)-এর উল্লেখ রয়েছে।
[(বুখারী ৭৫১৭, ই ফাঃ ৭০০৯, মুসলিমঃ ১৬২, আহমাদঃ ১২৫০৭) মুসলীম, মিশকাত প্রভৃতি হাদিস গ্রন্থ)]
হযরত মুছা (عليه السلام) আরয করলেন- “কত ওয়াক্ত নামায ফরয করা হলো আপনার উম্মতের উপর?” হুযুর [ﷺ] বললেন- “পঞ্চাশ ওযাক্ত”। মুছা (عليه السلام) বললেন, “আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি – আপনার উম্মত তা আদায় করতে পারবে না। কেননা, আমার উম্মতের উপর কম হওয়া সত্বেও তারা তা আদায় করতে পারেনি। আপনি রবের কাছে আবার ফিরে যান এবং হাল্কা করার প্রার্থনা করুন। হাদীসের এবারত নিম্নরূপ-
ارجع الى ربك واسءل التخفيف –
অর্থঃ- “ আপনার রবের কাছে ফিরে যান এবং হাল্কা করার দরখাস্ত পেশ করুন।” হুযুর [ﷺ] এরশাদ করেন – “অতঃপর আমি ফরে গেলাম। আল্লাহ তায়ালা এবার পাঁচ ওয়াক্ত কমালেন। আমি পুনঃ ৬ষ্ঠ আকাশে ফিরে আসলাম। এবারও মুছা (عليه السلام) পুনরায় আমার রবের কাছে ফিরে যেতে আরয করলেন।” এই ভাবে নয় বার ৬ষ্ঠ আকাশ থেকে নবী করীম [ﷺ] আল্লাহর দরবারে যাওয়া-আসা করলেন। আল্লাহ তায়ালা প্রতি বার পাঁচ ওয়াক্ত করে নামায কমাতে থাকলেন এবং পঞ্চাশের মধ্যে পঁয়তাল্লিশ ওয়াক্ত কমিয়ে মাত্র পাঁচ ওয়াক্ত বাহাল রাখলেন। এবারও হযরত মুছা (عليه السلام) পুনরায় আল্লাহর দরবারে ফিরে যাওয়ার জন্য আরয পেশ করলেন। নবী করীম [ﷺ] বললেন- “আমি পাঁচ ওয়াক্তেই রাজী হলাম। পুনরায় ফিরে যেতে লজ্জা লাগে।” আল্লাহন পাক সাথে সাথে ওহী নাযেল করলেনঃ
لاتبديل لكلمات الله –
অর্থাৎ- “আল্লাহ ফায়সালার আর কোন পরিবর্তন হবে না।” তবে আল্লাহ তায়ালা শান্তনা দিয়ে নবী করীম [ﷺ]-কে বললেন, “আপনার উম্মত পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করলে আমার এখানে পঞ্চাশ ওয়াক্তই লিখা হবে। সুতরাং আপনার উম্মতকে ওয়াক্ত দেয়া যেমন ঠিক, তেমনভাবে আমার পঞ্চাশ ওয়াক্তের নির্দেশও ঠিক। পার্থক্য শুধু সংখ্যায়- গুণে নয়।” সুবাহানাল্লাহ! আল্লা্হর কি অসীম দয়া! বান্দা পাঁচ ওয়াক্ত আদায় করবে, আর আল্লাহ তায়ালা তার দশগুণ করে রেকর্ড করবেন!
পাঁচ ওয়াক্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার হেকমত তাফসীরে রুহুল বায়ান, ইতকান, বেদায়া নেহায়া- প্রভৃতি গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। ফজর নামাজ হযরত আদম (عليه السلام) আদায় করতেন। যোহরের নামায হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام), আসরের নামায হযরত ইউনুস (عليه السلام), মাগরিবের নামায হযরত ঈছা (عليه السلام)এবং এশার নামায হযরত মুছা (عليه السلام) আদায় করতেন। আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করে পাঁচজন পয়গাম্বরের পাঁচ ওয়াক্ত নামায একত্রিত করে উম্মতে মুহাম্মদীকে দান করলেন। সুতরাং নামাযের ইবাদতটি নবীগণের স্মৃতি বহনকারীও বটে।
[মূলতঃ প্রত্যেক এবাদতের মধ্যেই, এমনকি- প্রত্যেক তসবিহ’র মধ্যেও কোন না কোন নবী, অলী অথবা ফেরেশতার ইবাদত বা স্মৃতি বিজড়িত রয়েছে, যেমন- হজ্বের মধ্যে হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام), কোরবনীর মধ্যে হযরত ইসমাইল (عليه السلام), সাঈ-এর মধ্যে বিবি হাযেরা এবং আরফাতে অবস্থানের মধ্যে হযরত আদম (عليه السلام)-এঁর স্মৃতি জড়িত। নামাযের মধ্যে কিয়াম, রুকু, সিজদা, তছবিহ্-ইত্যাদি ফেরেশতাদের স্মৃতি- নবী করীম [ﷺ] মি’রাজে প্রত্যক্ষ করে প্রথমে নিজে আমল করেছেন। পরে আমাদেরকে হুকুম করেছেন- হুযুর [ﷺ]-কে দেখে দেখে অনুসরণ করার জন্য। সুতরাং নবী করীম [ﷺ]-এঁর অনুকরণ ও অনুসরণের নামই ইবাদত- যার মধ্যে রয়েছে অন্যদের স্মৃতি বিজড়িত (জালালুদ্দীন সূয়ুতি কৃত শরহে সুদূর)।
এখানে প্রশ্ন জাগে- মি’রাজ থেকে প্রত্যাবর্তনকালে শুধু মুছা (عليه السلام)-এর সাথে হুযুর [ﷺ]-এর সাক্ষাৎ এবং তাঁর অনুরোধে বারবার আল্লাহর দরবারে নবী করীম [ﷺ]-এর যাতায়াত কি আল্লাহর ইচ্ছায় এবং পরিকল্পনা মোতাবেক হয়েছিল- নাকি নবীজির [ﷺ] ইচ্ছায় হয়েছিল? এ প্রশ্ন স্বাভাবিক। সাথে সাথে আর একটি প্রশ্নও এসে যায়। তাহলো- নবী করীম [ﷺ] বার বার আল্লাহর দরবারে গেলেন কিসে করে এবং দুনিয়াতে ফেরত আসলেন কেমন করে? আর একটি প্রশ্ন জাগে -মুছা (عليه السلام) কি উদ্দেশ্যে উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য সুপারিশ করেছিলেন? অন্য কোনও উদ্দেশ্য নিহীত ছিল কিনা? বিভিন্ন কিতাবে এসবের উত্তর দেয়া আছে। নিম্নে তা ক্রমান্বয়ে বর্ণনা করা হলো।
১। প্রথম প্রশ্নের উত্তর হলোঃ আল্লাহ তায়ালার পূর্ব পরিকল্পনা মোবাবেকই হযরত মুছা (عليه السلام) ৬ষ্ঠ আকাশে অপেক্ষমাণ ছিলেন। আল্লাহর ইচ্ছা ছিল- তাঁর প্রিয় হাবীব বারবার তাঁর দরবারে ফিরে যাক এবং বারবার তাঁর সাথে হাবীবের দীদার নসিব হোক। (তাফসীরে সাভী)
২। দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব হচ্ছেঃ ষষ্ঠ আকাশ থেকে আল্লাহর দরবারে যাতায়াতের ক্ষেত্রে বা দুনিয়াতে ফেরত আসার ক্ষেত্রে রফরফ বা বোরাক ব্যবহারের উল্লেখ হাদিসের কিতাবে সরাসরি পাওয়া যায় না। তাফসীরে রুহুল মাআনীতে বলা হয়েছেঃ যেভাবে বোরাকে নবী করীম [ﷺ] মি’রাজ গমন করেছেন, সেভাবে ফেরত এসেছেন। এটাই স্বাভাবিক ধারণা। তাফসীরে রুহুল বায়ান তাফসীরে রুহুল মাআনীরও পূর্বে রচিত- তাই এর মতামত অধিক শক্তিশালী। উক্ত তাফসীরে রুহুল বায়ানের গ্রন্থকার সুরা নাজম-এর তিন আয়াত-এঁর ব্যাখ্যায় বলেছেনঃ
والنجم -إذا هوى -ما ضل صاحبكم وما غوى –
অর্থঃ-“নিম্নগামী তারকার শপথ! তোমাদের সাথী মুহাম্মদ [ﷺ] কখনও পথ ভুলেননি বা প্রথভ্রষ্ট হননি এবং টেরা বাঁকাও হননি।”
তাফসীরকারক বলেন- উক্ত আয়াত মি’রাজের ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত। সাধারণ অর্থে অস্তমিত তারকা হলেও ইমাম জাফর সাদেক (رضي الله عنه)-এঁর মতে ‘নাজম দ্বারা উক্ত আয়াতে নবী করীম [ﷺ]-কেই বুঝান হয়েছে। কেননা হুযুর [ﷺ]-এঁর এক হাজার নামের মধ্যে আন-নাজম একটি নাম।” আর هوى অর্থঃ- নিন্মগামী। তাহলে আয়াতের অর্থ দাঁড়ায় – “আল্লাহর দরবার থেকে নিম্নগামী তারকা মুহাম্মদ মোস্তফা [ﷺ]-এঁর শপথ।” আর ‘পথ ভুলেননি বা টের বাঁকা হননি’- এই মন্তব্যর অর্থঃ যে পথে তিনি এসেছিলেন, সেপথেই ফিরত গিয়েছেন।”
বোরাক বা রফরফের মাধ্যেমে প্রত্যাবর্তন করলে একথার প্রয়োজন হত না। কেননা, তখন তো বোরাক বা রফরফই তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতো। সুতরাং নবী করীম [ﷺ] মি’রাজ থেকে আসা কালীন সময়ে আল্লাহর কুদরতে একা একা যাতায়াত করেছেন- এটাই সুস্পষ্ট। কেননা, তিনি তো নূর। নূর ও আলো সব কিছু ভেদ করে সোজা গতিতে ধাবিত হয়, এটাই বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্ত (তাফসীরে ইবনে আব্বাস রুহুল বায়ান-সুরা আন নাজম)। শুধু বাইতুল মোক্কাদাছে এসে বোরাকে আরোহণ করে তিনি মক্কায় পৌছেন। ৭০০ বৎসর পূর্বের ফারছী গ্রন্থ “রিয়াজুন নাসিহীন”- এ ইমাম জা’ফর সাদেক (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করা হয়েছে- “মি’রাজ হতে ফিরে আসার পথে রফরফ বোরাক বা ফেরেশতা- কিছুই সাথে ছিলো না”।
৩। তৃতীয় প্রশ্নের জবাব হলোঃ একজন নবী ইনতিকালের আড়াই হাজার বৎসর পরও অন্যের উপকার করতে পারেন, যেমন উপকার করেছিলেন মুছা (عليه السلام) উম্মতে মুহাম্মদীকে। এভাবে আল্লাহ’র নবী এবং অলীদের উসিলায় সাধারণ মানুষের অনেক উপকার হয়। এ সম্পর্কে অসংখ্য প্রমাণ ও দলীল বিদ্যমানে আছে।
বাহ্যিক দৃষ্টিতে মনে হয় – হযরত মুছা (عليه السلام) আমাদের উপকারের জন্য ৬ষ্ঠ আকাশে দাঁড়িয়ে থেকে নবী করীম [ﷺ]-কে বারবার যাতায়াত করতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর অন্যতম উদ্দেশ্যও এর মধ্যে নিহীত ছিল। তাফসীরে সাভীতে উল্লেখ আছে, তূর পর্বতে হযরত মুছা (عليه السلام) আল্লাহ্ পাকের নূরের তাজাল্লীতে বেহুঁশ হওয়ার কারণে আল্লাহকে দর্শন করতে পারেননি। কিন্তু মি’রাজ রাত্রীতে নবী করীম [ﷺ] আল্লাহর সান্নিধ্যে ফানা হয়ে আল্লাহর যে তাজাল্লী বয়ে নিয়ে এসেছিলেন- তা দেখে হযরত মুছা (عليه السلام)-এর তূর পর্বতের সাধ পূনরায় জেগে উঠে। তাই আল্লাহর তাজাল্লী দর্শনের জন্যই উম্মতে মুহাম্মদীর বাহানায় নবী করীম [ﷺ]-কে আল্লাহর দরবারে বারবার ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। আমাদের জন্য সুপারিশ করা ছিল উপলক্ষ মাত্র।
সুবহানাল্লাহ্! (তাফসীরে সাভী ২য় খন্ড ৮১৯ পৃঃ) একটি কাজে কয়েকটি উদ্দেশ্য থাকা খুবই স্বাভাবিক। সুতরাং উভয়বিধ উদ্দেশ্যের মধ্যে উম্মতের কল্যাণ ও খোদা দর্শনে কোন বিরোধ নেই।
আলা হযরত ইমাম আহমদ রেজা (رضي الله عنه) বলেন-
کس کو دیکھا یھ موسی سے پوچھے کوی –
آنکھ والوں کی ھمت یھ لا کھون سلام -مصطفٰے –
অর্থঃ- “মুছা (عليه السلام) সেদিন কাকে দেখেছিলেন এবং তাঁর মধ্যেমে কার প্রতিচ্ছবি দেখেছিলেন- তা মুছা (عليه السلام) কেই জিজ্ঞেস করো।” দিব্যদৃষ্টি সম্পন্ন লোকেদের দিব্য জ্ঞানের উপর শত সহস্র ছালাম।” (হাদায়েকে বখশিষ- আলা হযরত)। রাসুলে খোদা [ﷺ] হলেন আল্লাহর দর্শনের আয়না স্বরূপ (মসনবী)।
مصطفے آءنھ ظل خدا است -منعکس دورے ھمھ خوئے خداست –