মি’রাজের দ্বিতীয় পর্যায়
মি’রাজের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় বায়তুল মোকাদ্দাছ থেকে এবং শেষ হয় সিদরাতুল মুনতাহায় গিয়ে। প্রথম আকাশে গিয়ে জিব্রাইল (عليه السلام) ডাক দিলেন প্রথম আকাশের ভারপ্রাপ্ত ফেরেশতাকে এবং দরজা খুলে দিতে বললেন। উক্ত ফেরেশতা পরিচয় নিয়ে হুযুর [ﷺ]-এঁর নাম শুনেই দরজা খুলে দিলেন। প্রথমেই সাক্ষাত হলো হযরত আদম (عليه السلام)-এঁর সাথে। হুযুর [ﷺ] তাঁকে ছালাম দিলেন। কেননা ভ্রমণকারীকেই প্রথমে সালাম দিতে হয়। হযরত আদম (عليه السلام) নবীগণের আদি পিতা। তাই তাঁকে দিয়েই প্রথম অভ্যর্থনা শুরু করা হলো। হযরত আদম (عليه السلام)-এঁর নেতৃত্বে অন্যান্য আম্বিয়ায়ে কেরাম এবং প্রথম আকাশের ফেরেশতারা উক্ত অভ্যর্থনায় যোগদান করেন। এমনিভাবে দ্বিতীয় আকাশে হযরত ঈছা, হযরত যাকারিয়া ও হযরত ইয়াহ্ইয়া (عليهم السلام) এবং অন্যান্য নবী ও ফেরেশতারা অভ্যর্থনা জানালেন।
হযরত যাকারিয়া (عليهم السلام) ও উক্ত অভ্যর্থনায় শরীক ছিলেন। নবী করীম [ﷺ] তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন- “যখন আপনাকে করাত দ্বারা দ্বিখন্ডিত করা হচ্ছিল- তখন আপনার কেমন অনুভব হয়েছিল? উত্তরে যাকারিয়া (عليه السلام) বললেন- তখন আল্লাহ তায়ালা আমাকে ডাক দিয়ে বলেছিলেন- “আমি তোমার সাথে আছি।” এতদশ্রবণে আমি মউতের কষ্ট ভুলে গিয়েছিলাম।” প্রকৃত আশেকগণের মউতের সময় নবীজীর দিদার নছিব হয়। তাই তাঁদের মউতের কষ্ট অনুভূত হয় না (আল বেদায়া ওয়ান নেহায়াঃ যাকারিয়া অধ্যায়)।
তৃতীয় আকাশে হযরত ইউসুফ (عليه السلام)-এঁর নেতৃত্বে অন্যান্য নবী ও ফেরেশতাগণ নবী করীম [ﷺ]-কে অভ্যর্থনা জানান এবং ছালাম কালাম বিনিময় করেন। চতুর্থ আকাশে হযরত ইদ্রিছ (عليه السلام), পঞ্চম আকাশে হযরত হারুন (عليه السلام) ফেরেশতাগণসহ অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। ৬ষ্ঠ আকাশে হযরত মুছা (عليه السلام)-এঁর সাথে সাক্ষাত হয়। তিনি অভ্যর্থনা জানিয়ে বিদায়কালে আশ্চর্য হয়ে বললেন- “এই যুবক নবী শেষকালে এসেও আমার পূর্বে বেহেস্তে যাবেন এবং তাঁর উম্মতগণ আমার উম্মতের পূর্বে বেহেস্তে প্রবেশ করবে।” হযরত মুছা (عليه السلام) নবী করীম [ﷺ] ও তাঁর উম্মতের বিশেষ মর্যাদা দেখে আনন্দাশ্র ঝরিয়ে ছিলেন। যেমন মা সন্তানের কোন সুসংবাদ শুনতে পেলে আনন্দে কেঁদে ফেলেন। তাঁর এই আফ্সোস ছিল আনন্দসূচক ও স্বীকৃতিমূলক- বিদ্বেষমূলক নয়, এটাকে ইর্ষা বলে। ইর্ষা শরিয়তে জায়েয- কিন্তু হাছাদ বা হিংসা করা জায়েয নয়।
হযরত মুছা (عليه السلام) সে সময় নবী করীম [ﷺ]-এঁর নিকট একটি হাদীসের ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছিলেন। হাদীসটি হলো- নবী করীম [ﷺ] এরশাদ করেছেনঃ
علماء امتي كانبياء بني اسراءيل
অর্থাৎ “আমার উম্মতের যাহেরী-বাতেনী এলেম সম্পন্ন আলেমগণ বনী ইসরাইলের নবীগণের ন্যায় (এলেমের ক্ষেত্রে)। নবী করীম [ﷺ] উক্ত হাদীসের যথার্থতা প্রমাণের জন্য রূহানী জগত থেকে ইমাম গাযালী (رحمه الله عليه) কে হযরত মুছা (عليه السلام)-এঁর সামনে হাযির করালেন। হযরত মুছা (عليه السلام) বললেন- “আপনার নাম কি? উত্তরে ইমাম গাযালী (رحمه الله عليه) নিজের নাম, পিতার নাম, দাদার নাম, পরদাদার নাম সহ ছয় পুরুষের নাম বললেন। হযরত মুছা (عليه السلام) বললেন, আমি শুধু আপনার নাম জিজ্ঞেস করেছি। আপনি এত দীর্ঘ তালিকা পেশ করলেন কেন? ইমাম গাযালী (رحمه الله عليه) আদবের সাথে জবাব দিলেন- “আড়াই হাজার বৎসর পূর্বে আপনিও তো আল্লাহ তায়ালার ছোট্ট একটি প্রশ্নের দীর্ঘ উত্তর দিয়েছিলেন।” ইমাম গাযালীর (رحمه الله عليه) এলেম ও প্রজ্ঞা দেখে হযরত মুছা (عليه السلام) মুগ্ধ হয়ে গেলেন এবং হুযুর [ﷺ]-এঁর হাদীসখানার তাৎপর্য্য স্বীকার করে নিলেন। (রুহুল বয়ান তৃতীয় পারা ২৪৮ পৃষ্ঠা)।
[এখানে একটি বিষয় তাৎপর্য্যপূর্ণ। হযরত মুছা (عليه السلام)-এঁর ইন্তিকালের আড়াই হাজার বৎসর পরে মক্কার জমিনে প্রদত্ত হুযুর [ﷺ]-এঁর ভাষণ তিনি শুনতে পেয়েছিলেন, আপন রওযা থেকে। অপরদিকে দুনিয়াতে আসার পূর্বে আলমে আরওয়াহ্ থেকে ইমাম গাযালী (رحمه الله عليه)-এঁর মত একজন বিজ্ঞ অলী আড়াই হাজার বৎসর পূর্বে তুর পর্বতে ঘটে যাওয়া মুছা (عليه السلام)-এঁর ঘটনা সম্পর্কেও অবগত ছিলেন। এতে প্রমাণিত হলো- আল্লাহর নবী ও অলীগণকে আল্লাহ তায়ালা বাতেনী প্রজ্ঞা দান করেন- যাকে নূরে নযর বা ফিরাছাত বলা হয়। আল্লাহর অলীগণ আল্লাহ প্রদত্ত কাশ্ফ দ্বারা অনেক সময় মানুষের মনের গোপন কথাও বলে দিতে পারেন। ইমাম আবু হানিফা (رحمه الله عليه) কুফার এক মসজিদে জনৈক মুছল্লিকে অযু করতে দেখে বলেছিলেন,
“তুমি যিনা করে এসেছো। লোকটি অবাক হয়ে বললো, আপনি কিভাবে জানলেন? ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله عليه) বললেন- আমি দেখতে পাচ্ছি তোমার অযুর পানির সাথে যিনার গুনাহ্ ঝরে পড়ছিল।”
হাদীসেও অযুর পানির সাথে গুনাহ্ ঝরে পড়ার কথা উল্লেখ আছে। লোকটি ইমাম সাহেবের বাতেনী এলেম দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলো এবং সাথে সাথে ইমাম সাহেবের হাতে তওবা করলো। বড়পীর হযরত গাউছুল আ’যম আবদুল কাদের জিলানী (رحمة الله عليه) বাহ্জাতুল আসরার কিতাবে বলেনঃ
ان السعداء والاشقياء ليعرضون على عينى فى اللوح المحفوظ –
অর্থাৎ “দুনিয়ার নেককার ও বদকার- সকলকেই আমার দৃষ্টিতে পেশ করা হয় লওহে মাহ্ফুযে।” লওহে মাহ্ফুযে নেককার-বদকার সকলের তালিকা রয়েছে। হযরত বড়পীর (رحمه الله عليه)-এঁর নযরও দুনিয়া থেকে লওহে মাহ্ফুযে নিবদ্ধ। এজন্যই মাওলানা জালালুদ্দিন রুমী (رحمه الله عليه) মসনবী শরীফে বলেছেনঃ
لوح محفوظ است پیش اولیا -آنچه محفوظ است محفوظ از خطا –
অর্থাৎ “লওহে মাহফুয অলী-আল্লাহগণের নযরের সামনে। একারণেই তাঁদের দিব্যদৃষ্টি সমস্ত ক্রটি থেকে মুক্ত।”]
হযরত মুছা (عليه السلام) থেকে বিদায় নিয়ে নবী করীম [ﷺ] জিব্রাইল (عليه السلام) সহ সপ্তম আকাশে গেলেন। সেখানে হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام) ফেরেশতাগণসহ নবী করীম [ﷺ]-কে অভ্যর্থনা জানালেন। নবী করীম [ﷺ] ইরশাদ করেন- “আমি হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام) কে একটি কুরছিতে বসে বাইতুল মামুর মসজিদের গায়ে হেলান দিয়ে বসা অবস্থায় দেখতে পেয়েছি” (রুহুল বয়ান)।
হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام) দুনিয়াতে আল্লাহর ঘর কা’বা শরীফ তৈরী করেছিলেন। তার বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে সপ্তাকাশের বাইতুল মামুর মসজিদের মোতাওয়াল্লীর সম্মান দান করেছেন। দীর্ঘ এক হাদীসে এসেছে- বাইতুল মামুরে হুযুর [ﷺ]-এঁর সাথে নামায আদায় করেছিলেন সাদা পোষাকধারী একদল উম্মত- যাদের মধ্যে গাউসুল আযমও ছিলেন। (আ’লা হযরতের ইরফানে শরিয়ত তৃতীয় খন্ড)।
আসমানে ভ্রমণের সময়ই নবী করীম [ﷺ] বেহেস্ত ও দোযখ প্রত্যক্ষ করেন। পরকালে বিভিন্ন পাপের কি রকম শাস্তি হবে, তার কিছু নমুনা তিনি মেছালী ছুরতে প্রত্যক্ষ করেছেন। সুদ, ঘুষ, অত্যাচার, নামায বর্জন, ইয়াতিমের মাল ভক্ষণ, প্রতিবেশীর উপর যুলুম, স্বামীর অবাধ্যতা, বেপর্দা ও অন্য পুরুষকে নিজের রূপ প্রদর্শন, যিনা, ব্যাভিচার ইত্যাদির শাস্তি নবী করীম [ﷺ] স্বচক্ষে দেখেছেন।
বেহেস্তে হযরত খদিজা (رضي الله عنها)-এঁর জন্য সংরক্ষিত প্রাসাদ, হযরত ওমরের (رضي الله عنه) প্রাসাদ, হযরত বেলালের (رضي الله عنه) পাদুকার আওয়ায- এসব দেখেছেন এবং শুনেছেন। বেহেস্তের চারটি নহরের উৎসস্থল নবী করীম [ﷺ]-কে দেখান হয়েছে। “বিছ্মিল্লাহ”র চারটি শব্দের শেষ চারটি হরফ থেকে (م-ه-ن-م) চারটি নহর প্রবাহিত হয়ে হাউযে কাউছারে পতিত হতে দেখেছেন। দুধ, পানি, শরবত ও মধু এই চার প্রকারের পানীয় বেহেস্তবাসীকে পান করানো হবে। যারা ভক্তি ও ঈমানের সাথে প্রত্যেক ভাল কাজ “বিছ্মিল্লাহ” বলে শুরু করবে, তাদের জন্য এই নেয়ামত রাখা হয়েছে। (তাফসীরে রুহুল বয়ানে বিছমিল্লাহর ব্যাখ্যায় এর বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে)।
সপ্ত আকাশ ভ্রমণের পর জিব্রাইল (عليه السلام) খাদেম বা প্রটোকল হিসাবে নবী করীম [ﷺ]-কে সিদরাতুল মুনতাহা বা সীমান্তের কুলবৃক্ষের নিকট নিয়ে যান। হাদীসে এসেছে- “এ বৃক্ষের পাতা হাতীর কানের মত এবং ফল ওহোদ পাহাড়ের ন্যায় বিশাল। শহীদগণের রূহ মোবারক সবুজ পাখীর ছুরতে উক্ত বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করছেন। নবী করীম [ﷺ] স্বচক্ষে তা দর্শন করেছেন। সিদরা বৃক্ষ পৃথিবীর সপ্ত তবক নীচ থেকে চৌদ্দ হাজার বছরের রাস্তার উপরে অবস্থিত। সিদরা থেকে আরশের দূরত্ব ছত্রিশ হাজার বৎসরের রাস্তা। সর্বমোট পঞ্চাশ হাজার বৎসরের দূরত্বে আরশে মোয়াল্লা। (ইবনে আব্বাস)। আরশে মোয়াল্লা থেকেই আল্লাহ তায়ালার যাবতীয় নির্দেশ ফেরেশতাগণের নিকট আসে। হযরত জিব্রাইল (عليه السلام) সিদরাতুল মুনতাহা থেকেই আল্লাহ তায়ালার যাবতীয় নির্দেশ গ্রহণ করে থাকেন। এখানে এসেই জিবরাঈলের সীমানা শেষ হয়ে যায়।