নবী করীম [ﷺ]-এঁর উর্দ্ধজগতের মো’জেযা সমূহের মধ্যে মি’রাজ গমন একটি বিস্ময়কর মো’জেযা। এজন্যই মি’রাজের আয়াতের শুরুতেই আল্লাহ পাক ‘সোব্হানাল্লাহ্’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন – যা কেবল আশ্চর্য্যজনক ঘটনার ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। স্বশরীরে মি’রাজ গমনের প্রমাণ স্বরূপ কোরআনের ‘বিআব্দিহী’ শব্দটি তাৎপর্য্যপূর্ণ। কেননা, ‘আবদুন’ শব্দটি দ্বারা রুহ ও দেহের সমষ্টিকে বুঝান হয়েছে। তদুপরি- বোরাক প্রেরণ ও বোরাক কর্তৃক নবী করীম [ﷺ]-কে বহন করে নিয়ে যাওয়ার মধ্যেও স্বশরীরে মি’রাজ গমনের প্রমাণ পাওয়া যায়। সর্বোপরী স্বপ্নে বা রূহানীভাবে মি’রাজের দাবী করা হলে কোরাইশদের মধ্যে এত হৈ চৈ হতোনা। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সকল ইমামগণই স্বশরীরে মি’রাজ গমনের কথা স্বীকার করেছেন।
মি’রাজের ঘটনাটি নবীজীর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে, এর সাথে গতির সম্পর্ক এবং সময় ও স্থানের সঙ্কোচনের তত্ত্ব জড়িত রয়েছে। সূর্যের আলোর গতি সেকেন্ডে একলক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল। পৃথিবীতে সূর্যের আলো পৌঁছতে লাগে আট মিনিট বিশ সেকেন্ড। এ হিসেবে পৃথিবী হতে সূর্যের দূরত্ব- নয় কোটি তিরিশ লক্ষ মাইল। অথচ নবী করীম [ﷺ] মূহুর্তের মধ্যে চন্দ্র, সূর্য, সিদরাতুল মোনতাহা, আরশ-কুরছি ভ্রমণ করে লা-মকানে আল্লাহর দীদার লাভ করে নব্বই হাজার কালাম করে পুনরায় মক্কা শরীফে ফিরে আসেন। এসে দেখেন, বিছানা তখনও গরম রয়েছে। এর চেয়ে আশ্চর্য আর কি হতে পারে? নবী করীম [ﷺ]-এঁর নূরের গতি কত ছিল- এ থেকেই অনুমান করা যায়। কেননা, তিনি ছিলেন নূর। যাওয়ার সময় বোরাক ছিল – কিন্তু ফেরার সময় বোরাক ছিলো না (রুহুল বয়ান)।
মি’রাজের মধ্যে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- অন্যান্য নবীগণের সমস্ত মো’জেযা নবী করীম [ﷺ]-এঁর মধ্যে একত্রিত হয়েছিল। হযরত মুছা (عليه السلام) তূর পর্বতে আল্লাহর সাথে কালাম করেছেন। হযরত ঈছা (عليه السلام) স্বশরীরে আকাশে অবস্থান করছেন এবং হযরত ইদ্রিছ (عليه السلام) স্বশরীরে বেহেস্তে অবস্থান করছেন।
মেরাজের রাতে সংঘটিত ঘটনা ও ইতিহাস পর্ব – ০১| Events and History of the Night of Meraj #1
তাঁদের চেয়েও উন্নত মাকামে ও উচ্চমর্যাদায় আল্লাহ পাক নবী করীম [ﷺ]-কে নিয়ে সবার উপরে মর্যাদা প্রদান করেছেন। মুছা (عليه السلام) নিজে গিয়েছিলেন তূর পর্বতে। কিন্তু আমাদের প্রিয় নবী [ﷺ]-কে আল্লাহ্তায়ালা দাওয়াত করে বোরাকে চড়িয়ে ফেরেশতাদের মিছিলসহকারে প্রথমে বায়তুল মোকাদ্দাছে নিয়েছিলেন। সেখানে সমস্ত নবীগণকে স্বশরীরে উপস্থিত করে হুযুর করীম [ﷺ]-এঁর মোক্তাদী বানিয়েছিলেন। সেদিনই সমস্ত নবীগনের ইমাম হয়ে নবী করীম [ﷺ] নবীগণেরও নবী অভিষেক লাভ করেছিলেন। সমস্ত নবীগণ অষ্ট অঙ্গ (দুই হাত, দুই পা, দুই হাটু, নাক ও কপাল) দিয়ে স্বশরীরে নামায আদায় করেছিলেন সেদিন। সমস্ত নবীগণ যে স্বশরীরে জীবিত, তারই বাস্তব প্রমাণ মিলেছিল মি’রাজের রাত্রে। সমস্ত নবীগণ আপন আপন রওযায় জীবিত। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ১০৮৫)
মেরাজের রাতে সংঘটিত ঘটনা ও ইতিহাস পর্ব – ০১
মি’রাজের রাত্রে নবী করীম [ﷺ]-কে প্রথম সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছিলো জিব্রাইল, মিকাইল ও ইস্রাফিল ফেরেশতাসহ তাঁদের অধীনে সত্তর হাজার ফেরেশতা দ্বারা। দ্বিতীয় সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছিল বাইতুল মোকাদ্দেছে নবীগণের (عليهم السلام) দ্বারা। তৃতীয় সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছিল আকাশের ফেরেশতা, হুর ও নবীগণের দ্বারা এবং চতুর্থ ও শেষ সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা। সিদরাতুল মুনতাহা এবং আরশ মোয়াল্লা অতিক্রম করার পর স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা একশত বার সম্বর্ধনামূলক বাক্য دن منى يا محمد অর্থাৎ ‘হে প্রিয় বন্ধু মুহাম্মদ, আপনি আমার অতি নিকটে আসুন” – একথা বলে নবী করীম [ﷺ]-কে সম্মানিত করেছিলেন। কোরআন মজিদে ( ৪- سورة النجم – الآية ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّى ( আয়াতটি এদিকেই ইঙ্গিতবহ- বলে ‘তাফসীরে মুগ্নী’ ও ‘মিরছাদুল ইবাদ’ নামক গ্রন্থদ্বয়ের বরাত দিয়ে ‘রিয়াজুন্নাছেহীন’ কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে। উক্ত কিতাবখানা সাত শত বৎসর পূর্বে ফারসি ভাষায় লিখিত। লেখকের নিকট কিতাবখানা সংরক্ষিত আছে।
মেরাজের রাতে সংঘটিত ঘটনা ও ইতিহাস পর্ব – ০২
মি’রাজের ঘটনা ঘটেছিল নবুয়তের ১১ বৎসর ৫ মাস ১৫ দিনের মাথায়। অর্থাৎ নবুয়তের ২৩ বৎসরের দায়িত্ব পালনের মাঝামাঝি সময়ে। সে সময় হুযুর [ﷺ]-এঁর বয়স হয়েছিল ৫১ বৎসর ৫ মাস ১৫ দিন। সন ছিল নবুয়তের দ্বাদশ সাল। তিনটি পর্যায়ে মি’রাজকে ভাগ করা হয়েছে। মক্কা শরীফ থেকে বায়তুল মোকাদ্দাছ পর্যন্ত মি’রাজের অংশকে বলা হয় ইসরা বা রাত্রি ভ্রমণ। বায়তুল মোকাদ্দাছ থেকে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত অংশকে বলা হয় মি’রাজ।
সিদরাতুল মুনতাহা থেকে আরশ ও লা-মকান পর্যন্ত অংশকে বলা হয় ই’রাজ। কিন্তু সাধারণভাবে পূর্ণ ভ্রমণকেই এক নামে মি’রাজ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। কোরআন, হাদীসে-মোতাওয়াতি এবং খবরে ওয়াহেদ দ্বারা যথাক্রমে এই তিনটি পর্যায়ের মি’রাজ প্রমাণিত।
মি’রাজের প্রথম পর্যায়ঃ
রজব চাঁদের ২৭ তারিখ সোমবার পূর্ব রাত্রের শেষাংশে নবী করীম [ﷺ] বায়তুল্লায় অবস্থিত বিবি উম্মেহানী (رضي الله عنها)-এঁর ঘরে অবস্থান করছিলেন। বিবি উম্মেহানী (رضي الله عنها) ছিলেন আবু তালেবের কন্যা এবং নবী করীম [ﷺ]-এঁর দুধবোন। উক্ত গৃহটি ছিল বর্তমান হেরেম শরীফের ভিতরে পশ্চিম দিকে। হযরত জিব্রাইল (عليه السلام) ঘরের ছাদ দিয়ে প্রবেশ করে নূরের পাখা দিয়ে, অন্য রেওয়ায়াত মোতাবেক-গন্ডদেশ দিয়ে নবী করীম [ﷺ]-এঁর কদম মোবারকের তালুতে স্পর্শ করতেই হুযুরের তন্দ্রা টুটে যায়। জিব্রাইল (عليه السلام) আল্লাহর পক্ষ হতে দাওয়াত জানালেন এবং নবীজীকে যমযমের কাছে নিয়ে গেলেন। সিনা মোবারক বিদীর্ণ করে যমযমের পানি দিয়ে ধৌত করে নূর এবং হেকমত দিয়ে পরিপূর্ণ করলেন। এভাবে মহাশূন্যে ভ্রমণের প্রস্তুতিপর্ব শেষ করলেন।
নিকটেই বোরাক দন্ডায়মান ছিল। বোরাকের আকৃতি ছিল অদ্ভুত ধরণের। গাধার চেয়ে উঁচু, খচ্চরের চেয়ে নীচু, মুখমন্ডল মানুষের চেহারাসদৃশ, পা উটের পায়ের মত এবং পিঠের কেশর ঘোড়ার মত (রুহুল বয়ান-সুরা ইসরাইল)। মূলতঃ বোরাক ছিল বেহেস্তী বাহন- যার গতি ছিল দৃষ্টি সীমান্তে মাত্র এক কদম। নবী করীম [ﷺ] বোরাকে সওয়ার হওয়ার চেষ্টা করতেই বোরাক নড়াচড়া শুরু করলো। জিব্রাইল (عليه السلام) বললেন- “তোমার পিঠে সৃষ্টির সেরা মহামানব সওয়ার হচ্ছেন- সুতরাং তুমি স্থির হয়ে যাও।” বোরাক বললো, “কাল হাশরের দিনে নবী করীম [ﷺ] আমার জন্য আল্লাহর দরবারে শাফাআত করবেন বলে ওয়াদা করলে আমি স্থির হবো।” নবী করীম [ﷺ] ওয়াদা করলেন। বোরাক স্থির হলো। তিনি বোরাকে সওয়ার হলেন। জিব্রাইল (عليه السلام) সামনে লাগাম ধরে, মিকাইল (عليه السلام) রিকাব ধরে এবং ইস্রাফিল (عليه السلام) পিছনে পিছনে অগ্রসর হলেন। পিছনে সত্তর হাজার ফেরেশতার মিছিল। এ যেন দুলহার সাথে বরযাত্রী। প্রকৃতপক্ষে নবী করীম [ﷺ] ছিলেন আরশের দুলহা (তাফসীরে রুহুল বয়ান)।
মক্কা শরীফ থেকে রওনা দিয়ে পথিমধ্যে মদীনার রওযা মোবারকের স্থানে গিয়ে বোরাক থামলো। জিব্রাইলের ইশারায় তথায় তিনি দু’রাকাত নামায আদায় করলেন। এভাবে ঈছা (عليه السلام)-এঁর জন্মস্থান বাইতুল লাহাম এবং মাদ্ইয়ান নামক স্থানে হযরত শুয়াইব (عليه السلام)-এঁর গৃহের কাছে বোরাক থেকে নেমে নবী করীম [ﷺ] দু’রাকাত করে নামায আদায় করলেন। এজন্যই বরকতময় স্থানে নামায আদায় করা ছুন্নত। এই শিক্ষাই এখানে রয়েছে। নবী করীম [ﷺ] এরশাদ করেন, আমি বোরাক থেকে দেখতে পেলাম- হযরত মুছা (عليه السلام) তাঁর মাযারে (জর্দানে) দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করছেন।
অতঃপর জিব্রাইল (عليه السلام) বায়তুল মোকাদ্দাছ মসজিদের সামনে বোরাক থামালেন। সমস্ত নবীগণ পূর্ব হতেই সেখানে স্বশরীরে উপস্থিত ছিলেন। জিব্রাইল (عليه السلام) বোরাককে রশি দিয়ে বায়তুল মোকাদ্দাছের ছাখরা নামক পবিত্র পাথরের সাথে বাঁধলেন এবং আযান দিলেন। সমস্ত নবীগণ (عليهم السلام) নামাযের জন্য দাঁড়ালেন। হযরত জিব্রাইল (عليه السلام) নবী করীম [ﷺ]-কে মোসল্লাতে দাঁড় করিয়ে ইমামতি করার জন্য অনুরোধ করলেন। হুযুর [ﷺ] সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরাম ও সত্তর হাজার ফেরেশতাকে নিয়ে দু’রাকাত নামায আদায় করলেন।
মেরাজের রাতে সংঘটিত ঘটনা ও ইতিহাস পর্ব – ০৩
তখনও কিন্তু নামায ফরয হয়নি। প্রশ্ন জাগে নামাযের আদেশ নাযিল হওয়ার পূর্বে হুযুর [ﷺ] কিভাবে ইমামতি করলেন? বুঝা গেল, তিনি নামাযের নিয়ম কানুন পূর্বেই জানতেন। নামাযের তা’লীম তিনি পূর্বেই পেয়েছিলেন – তানযীল বা নাযিল হয়েছে পরে। আজকে প্রমাণিত হলো- নবী করীম [ﷺ] হলেন ইমামুল মোরছালীন ও নবীউল আম্বিয়া (عليهم السلام)। নামায শেষে আয়োজিত সংক্ষিপ্ত সভায় নবীগণ নিজেদের পরিচয় দিয়ে বক্তব্য পেশ করলেন। সর্বশেষ সভাপতি (মীর মজলিশ) হিসাবে ভাষণ রাখলেন নবী করীম [ﷺ]। তাঁর ভাষণে আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা করে তিনি বললেন- “আল্লাহ পাক আমাকে আদম সন্তানগণের মধ্যে সর্দার, আখেরী নবী ও রাহমাতুল্লিল “আলামীন বানিয়ে প্রেরণ করেছেন।”
এখানে একটি আক্বিদার প্রশ্ন জড়িত আছে। তা হলো- আম্বিয়ায়ে কেরামগণের মধ্যে চারজন ব্যতিত আর সকলেই ইতিপূর্বে ইনতিকাল করেছেন এবং তাঁদের রওযা মোবারকও বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত। যে চারজন নবী জীবিত, তাঁরা হচ্ছেন- হযরত ইদ্রিছ (عليه السلام) বেহেশতে, হযরত ঈসা (عليه السلام) আকাশে, হযরত খিযির (عليه السلام) জলভাগের দায়িত্বে এবং হযরত ইলিয়াছ (عليه السلام) স্থলভাগের দায়িত্বে। জীবিত ও ইনতিকালপ্রাপ্ত সকল আম্বিয়ায়ে কেরাম (عليهم السلام) বিভিন্ন স্থান থেকে মূহুর্তের মধ্যে কিভাবে স্বশরীরে বায়তুল মোকাদ্দাছে উপস্থিত হলেন?
মেরাজের রাতে সংঘটিত ঘটনা ও ইতিহাস পর্ব – ০৪
তাফসীরে রুহুল বয়ানে এ প্রশ্নের উত্তর এভাবে দেয়া হয়েছে- “জীবিত চারজন নবীকে আল্লাহ তায়ালা স্বশরীরে এবং ইন্তিকাল প্রাপ্ত আম্বিয়ায়ে কেরামগণকে মেছালী শরীরে বায়তুল মোকাদ্দাছে উপস্থিত করেছিলেন।” কিন্তু অন্যান্য গ্রন্থে স্বশরীরে উপস্থিতির কথা উল্লেখ আছে। কেননা, নবীগণ অষ্ট অঙ্গ দ্বারা সিজদা করেছিলেন। নবীগণ ও অলীগণ মেছালী শরীর ধারণ করে মূহুর্তের মধ্যে আসমান জমিন ভ্রমণ করতে পারেন এবং জীবিত লোকদের মতই সব কিছু শুনতে ও দেখতে পারেন (মিরকাত ও তাইছির গ্রন্থ)। আধুনিক থিউসোফীতেও (আধ্যাত্মবাদ) একথা স্বীকৃত। ফিজিক্যাল বডি, ইথিক্যাল বডি, কস্যাল বডি, এস্ট্রাল বডি- ইত্যাদি রূপ ধারণ করা একই দেহের পক্ষে সম্ভব এবং বাস্তব বলেও আধুনিক থিউসোফীর বিজ্ঞানীগণ স্বীকার করেছেন। আমরা মুসলমান। আল্লাহর কুদরত ও প্রদত্ত ক্ষমতার উপর আমাদের ঈমান নির্ভরশীল। এ বিষয়ে কবি গোলাম মোস্তফার বিশ্বনবী বইখানায় বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।