ইমাম বায়হাকী ‘দালায়েল’ কিতাবে লিখেছেন, রসুলেপাক (ﷺ) এক ব্যক্তিকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। লোকটি বললো, আমি ইমান আনবো না যদি না আমার মৃত কন্যাটিকে আপনি জীবিত করে দেন। রসুলেপাক (ﷺ) বললেন, তার কবরটি দেখিয়ে দাও। লোকটি তার মৃত কন্যার কবরের কাছে নবী করীম (ﷺ) কে নিয়ে গেলো। অন্য বর্ণনায় আছে, লোকটি বলেছিলো, আমি কন্যাটিকে মরুভূমিতে ছেড়ে দিয়েছি। রসুলেপাক (ﷺ) বললেন, মরুভূমিটি দেখিয়ে দাও। অতঃপর রসুলেপাক (ﷺ) সেখানে উপস্থিত হয়ে কন্যাটিকে তার নাম ধরে ডাক দিলেন। কন্যাটি জওয়াব দিলো, লাব্বাইকা ও সাদাইক। রসুলেপাক (ﷺ) মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি দুনিয়াতে পুনরায় ফিরে আসতে চাও? মেয়েটি জওয়াব দিলো, ইয়া রসুলাল্লাহ! আখেরাত দুনিয়ার চেয়ে উত্তম। অন্য বর্ণনায় আছে, নবী করীম (ﷺ) বললেন, তোমার মা বাবা ইমান এনেছে। তুমি যদি দুনিয়াতে আসতে চাও, তাহলে তোমাকে ফিরিয়ে আনি। মেয়েটি বললো, আমার মা বাবার প্রয়োজন নেই। আমার প্রতিপালক আল্লাহ্ তাদের চেয়ে অধিকতর অনুগ্রহশীল ও উত্তম। এই হাদীছ থেকে বুঝা যায়, কাফেরের সন্তান বুদ্ধিজ্ঞান হওয়ার পূর্বে মারা গেলে আযাব হবে না।
হজরত জাবের (رضي الله عنه) এর সন্তানদেরকে জীবিত করার ঘটনাও রয়েছে। রসুলেপাক (ﷺ) যখন তাঁর ঘরে মেহমান হয়েছিলেন, তখন মেহমানদারীর জন্য তিনি একটি বকরী জবেহ করেছিলেন। বকরী জবেহ করার দৃশ্যটি দেখে তাঁর সন্তান দুটির মনে কৌতূহল হলো। বকরীটি জবেহ করার অনুকরণে বড় ছেলেটি তার ছোট ভাইটিকে শুইয়ে দিলো এবং তার গলায় ছুরি চালিয়ে দিলো। তাদের মা এ দৃশ্য দেখে দৌড়ে আসছিলেন। রক্তাক্ত ছোট ভাইকে দেখে বড় ছেলেটি ভয় পেয়ে বাড়ির উপর তলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে গেলো এবং সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুবরণ করলো। রসুলেপাক (ﷺ) হজরত জাবেরের উভয় সন্তানকেই জীবিত করে দিয়েছিলেন। শাওয়াহেদুন্নবুওয়াত গ্রন্থে এর বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। নবী করীম (ﷺ) তাঁর পিতা মাতাকেও জীবিত করেছিলেন এবং তাঁরা ইমানও এনেছিলেন। হাদীছ শরীফে তার বর্ণনা রয়েছে। তবে হাদীছের এই বর্ণনা সম্পর্কে মোহাদ্দেছগণের কেউ কেউ আপত্তি তুলেছেন। আবার কেউ কেউ উক্ত হাদীছকে সহীহ্ হাদীছের স্তরে সাব্যস্ত করেছেন।
হজরত আনাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে, এক আনসারী যুবকের মৃত্যু হলো। যুবকটির বৃদ্ধা অন্ধ মাতা তখনো বেঁচে ছিলো। লোকেরা মৃত যুবকটিকে কাফন পরিয়ে তাঁর মাকে সান্তনা দিতে লাগলো। জননী জিজ্ঞেস করলো, আমার ছেলে কি মরে গেছে? লোকেরা বললো, হাঁ। মহিলা বলতে লাগলো, হে আমার আল্লাহ্! তোমার তো ভালোভাবেই জানা আছে, আমি তোমার এবং তোমার নবীর উপর এই আশা করে হিজরত করেছিলাম যে, তুমি আমাকে সাহায্য করবে। বিপদাপদে তুমি আমার প্রার্থনা কবুল করবে। হে আল্লাহ্! তুমি আমাকে কঠিন বিপদে ফেলো না। বর্ণনাকারী বলেন, আমরা তখনও সরে আসিনি এর মধ্যেই সে জীবিত হয়ে গেলো এবং আমাদের সঙ্গে আহার করলো। হাদীছখানা বর্ণনা করেছেন ইবনে আদ্দী, ইবনে আবিদ্ দুনইয়া, বায়হাকী ও আবু নাঈম।
বৃদ্ধার পুত্র সন্তানের জীবিত হয়ে যাওয়াটা রসুলেপাক (ﷺ) এর নিকট ফরিয়াদ করার বরকতেই হয়েছিলো। এরকম এক হাদীছ বর্ণনা করেছেন আবু বকর ইবনে যেহাক হজরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যাব (رضي الله عنه)। তিনি বলেন, এক আনসারী লোকের মৃত্যু হলো। লোকেরা যখন তাকে কাফন পরাতে যাচ্ছিলো, তখন সে বলে উঠলো, মোহাম্মাদুর রসুলাল্লাহ।
মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়ায় হজরত নোমান ইবনে বশীর (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, হজরত যায়েদ ইবনে খারেজা আনসারদের নেতা ছিলেন। একদা তিনি মদীনা মুনাওয়ারার পথে হাঁটতে হাঁটতে যোহর ও আসর নামাজের মধ্যবর্তী সময়ে হঠাৎ করে রাস্তার উপর অধোবদন হয়ে পড়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মৃত্যু হলো। আনসার নারীপুরুষেরা কান্নাকাটি শুরু করে দিলো। এ অবস্থা চললো মাগরিব পর্যন্ত। মাগরিব ও এশার মধ্যবর্তী সময়ে একটি আওয়াজ শোনা গেলো ‘তোমরা চুপ করো’ তারপর যখন গভীর মনযোগের সাথে সবাই শুনতে চেষ্টা করলো, তখন শোনা গেলো, যে চাদর দিয়ে তাকে ঢেকে রাখা হয়েছিলো, সেই চাদরের ভিতর থেকে আওয়াজ আসছে –
‘মোহাম্মদ আল্লাহ্র রসুল, উম্মী নবী, শেষ নবী। তাঁর পর আর কোনো নবী আসবেন না। একথা পূর্ববর্তী কিতাবে ছিলো। একথা সত্য। সত্য কথা বলেছেন এই রসুল। হে আল্লাহ্র রসুল! আপনার উপর সালাম, আল্লাহ্র রহমত এবং বরকত বর্ষিত হোক।’ – হাদীছখানা আবু বকর ইবনে আবিদ্ দুনইয়া লিখেছেন ‘মানআশা বাদাল মাওত’ পুস্তকে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওবায়দুল্লাহ আনসারী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে, হজরত ছাবেত ইবনে কায়স ইবনে শামাস (رضي الله عنه) কে যাঁরা দাফন করেছিলেন, আমি তাদের সঙ্গে ছিলাম। তাঁকে যখন কবরে নামানো হলো, তখন তাঁকে স্পষ্ট বলতে শুনেছি, ‘মোহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ- আবু বকর আস্সিদ্দীক, ওমর আশ শহীদ। ওছমান ইবনে আফ্ফান আল বার আর রহীম।’
কথাগুলো শোনার পর আমি ভালো করে তাঁকে দেখলাম। দেখলাম, তিনি মৃতই। আশশেফা বইতেও এরকম লেখা আছে। এ ক্ষেত্রে যদি কেই সন্দেহ পোষণ করে যে, এমনও হতে পারে, যাঁদেরকে মৃত বলা হয়েছে, তাঁরা জীবিত ছিলেন, অথবা এ জাতীয় কোনো ঘটনা রসুলেপাক (ﷺ) এর মাধ্যমে ঘটেনি যাকে মোজেজা হিসেবে গ্রহণ করা যায়।
জবাব এই যে, মৃত্যু এমন ব্যাপার নয়, যাকে গোপন রাখা যায়।
দ্বিতীয়তঃ রসুলেপাক (ﷺ) এর পবিত্র নাম আলোচনা করা এবং তাঁর প্রশংসায় কিছু বলার উদ্দেশ্য এটাই যে, এসব কিছু তাঁরই বরকত ও মর্যাদারই পরিণতি। এগুলো যদি তাদের কারামতও ধরা হয়, তবুও স্বীকার করতে হবে যে, এসব মূলে নবী করীম (ﷺ) এর মোজেজা।
আবু নাঈম বর্ণনা করেছেন, হজরত জাবের (رضي الله عنه) একদিন একটি বকরী যবেহ করে তার গোশত রান্না করে নিয়ে নবী করীম (ﷺ)এর খেদমতে হাজির হলেন। উপস্থিত লোকেরা তা ভক্ষণ করলেন। রসুলেপাক (ﷺ) বললেন, গোশত খাও, কিন্তু হাড়গুলো ভেঙো না। খাওয়া শেষে নবী করীম (ﷺ) হাড়গুলো একত্রিত করে তার উপর পবিত্র হাত রাখলেন এবং কিছু পাঠ করলেন। দেখতে দেখতে বকরীটি জীবিত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো এবং কান নাড়াচাড়া করতে লাগলো।
এরকম কামেল মোকাম্মেল আউলিয়া কেরামও আছেন, যাঁরা আল্লাহ্তায়ালার কুদরতের প্রকাশস্থল হতে পেরেছেন। তাঁরা নবী করীম (ﷺ) এর পূর্ণ অনুসরণের মাধ্যমে তাঁর প্রতিবিম্ব হয়ে কারামত প্রদর্শন করেছেন। এরকম একজন বুযুর্গের ঘটনা— একটি মোরগ জবাই করে তার গোশত খাবার পর হাড়গুলো একত্রিত করে তার উপর হাত রেখে আল্লাহ্তায়ালা এবং তাঁর রসুল (ﷺ) এর নাম নিলেন তিনি। অমনি মোরগ জীবিত হয়ে ডাক দিয়ে উঠলো। এটাও মূলে নবী করীম (ﷺ) এর মোজেজা।
খয়বরের যুদ্ধের সময় যে বকরীর গোশতে বিষ মিশ্রিত করে নবী করীম (ﷺ) কে খেতে দেয়া হয়েছিলো, সেই জবেহকৃত বকরীও নবী করীম (ﷺ) এর সঙ্গে কথা বলেছিলো। কোনো কোনো আলেম এটাকেও মৃতকে জীবিত করার মধ্যে গণ্য করে থাকেন। বকরীর জীবিত হয়ে কথা বলা সম্পর্কে অবশ্য কেউ কেউ এরূপ মত পোষণ করে থাকেন যে, পাথর ও গাছপালা থেকে আল্লাহ্তায়ালা যেরকম শব্দ ও বাক্য বের করেছেন, জবেহকৃত বকরী থেকেও আল্লাহ্তায়ালা এরকম আওয়াজ বের করতেই পারেন।
এরূপ ক্ষেত্রে কোনো বস্তুর বাহ্যিক আকৃতি পরিবর্তন না করেও তা থেকে আওয়াজ পয়দা করা সম্ভব। শায়েখ আবুল হাসান ও কাযীআবু বকর বাকেশানীর মত এরকম। আবার কেউ কেউ মনে করেন, হায়াত সৃষ্টির মতো প্রথমে এগুলোকে আল্লাহ্তায়ালা সৃষ্টি করেন, তারপর তার মধ্যে বাকশক্তি প্রদান করেন। আল্লাহ্পাকই ভালো জানেন।
➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)]