মুসাফিরের রোযার বর্ণনা

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

কৃতঃ উস্তাদুল উলামা আল্লামা মুহাম্মদ আজিজুল হক আল-কাদেরী (رحمة الله)

❏ মাছআলা: (১৮৫)

রোজা ভঙ্গ করার বৈধ কারণ সমূহ কি? উলে­খ থাকে যে রোজা ভঙ্গ করার জায়েজ অবস্থা সমূহ হচ্ছে অসুস্থ হওয়া কিংবা অধিক কষ্ট হওয়ার কারণে রোজা ভঙ্গ করা জায়েজ ও বৈধ। যদি এই আশংখা হয় যে রোজা রাখার কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ার কিংবা দ্রুত সুস্থ ও আরামবোধ না হওয়া অথবা অধিক কষ্টের কারণ হয়, তবে এক্ষেত্রে তিন ইমাম তথা ইমাম আজম আবু হানিফা, ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম মালেক রাহমাহুমুল্লাহ ঐক্যমত যে, রোজা ভঙ্গ করা জায়েজ। তবে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله) ব্যতীত, কেননা তার মতে এমতাবস্থায় রোজা ভঙ্গ করা সুন্নাত এবং রোজা রাখা মাকরূহ। আর যদি ধ্বংস কিংবা বেশী বেশী ক্ষতি হওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় ধারণা হয় তবে এক্ষেত্রে রোজা ভঙ্গ করা ওয়াজিব এবং রাখা সর্ব সম্মতক্রমে হারাম। সফরের অবস্থায় রোজা বর্জন করা মুবাহ। কমপক্ষে ৭৪/৭৫ কিলোমিটার দূরবর্তী স্থানে সফর হলে কসর ওয়াজিব হয়ে থাকে। আর উক্ত সফর পদব্রজে হউক কিংবা রেলগাড়ী অথবা উড়োজাহাজ কিংবা অন্যান্য বাহনে হউক। তবে যদি সফরের মধ্যে কষ্ট অনুভব না হয় তাহলে রোজা রাখা উত্তম। আল্লাহপাক এরশাদ করেছেন- وَ اْنَ تَصُوْمُوْا خـَـيْرُلَكُمْ অর্থাৎ যদি মুসাফির অবস্থায় রোজা রাখ তা তোমাদের জন্য উত্তম হবে।

❏ মাছআলা: (১৮৬)

হায়েজ ও নেফাছ অবস্থায় রোজা তরক তথা বর্জন করা ওয়াজিব। রোজা রাখা হারাম। তবে যখনই পাক পবিত্র হয়ে যাবে তখনই সেই মহিলা রোজা আরম্ভ করা আবশ্যক। আর যে সমস্ত রোজা হায়েজ নেফাছ অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে তা রমজান শরীফের পরে পূরণ করা আবশ্যক।

❏ মাছআলা: (১৮৭)

যদি কোন ব্যক্তির ক্ষুধা ও পিপাসা এত তীব্রতা ও বেশী হয় যে এই অবস্থায় রোজা রাখা সাধ্যের বাইরে হয়ে যায়, তবে এক্ষেত্রে রোজা ভঙ্গ করা জায়েজ এবং ক্বাজা ওয়াজিব হবে। 

বার্ধক্য কিংবা শক্তিহীনতার কারণে রোজা বর্জন করার হুকুমঃ বার্ধক্য দুর্বল ও শক্তিহীন ব্যক্তি যিনি পুরো বৎসরের কোন সময়ই রোজা রাখতে অক্ষম তার ক্ষেত্রে রোজা তরক (বর্জন) করা জায়েজ। তবে তার উপর ওয়াজিব যে প্রতিদিনের রোজার পরিবর্তে একজন অভাবীকে খানা খাওয়ানো। এই হুকুম সেই অসুস্থ ব্যক্তির জন্যই প্রযোজ্য। যার শারীরিক সুস্থতার কোন প্রকার আশা করা যায় না। তাদের বেলায় ফিদিয়া দেওয়ার পর রোজা ক্বাজা করা ওয়াজিব নয়।

❏ মাছআলা: (১৮৮)

যদি কোন ব্যক্তি পবিত্র রমজান মাসে রোজা রাখতে অক্ষম। কিন্তু রমজানের পর অন্য সময়ে রোজা ক্বাজা করার শক্তি রাখে তার উপর ওয়াজিব হচ্ছে সে সময় রোজা ক্বাজা করা। এর জন্য ফিদিয়া নাই।

❏ মাছআলা: (১৮৯)

মৃত ব্যক্তির ক্বাজা হওয়া রোজার হুকুম কি? প্রকাশ থাকে যে, যদি মৃত ব্যক্তি ফিদিয়া আদায় করার জন্য অসিয়ত করে থাকে তবে তার ওয়ারিশদের উচিত যে মৃতের সম্পদের এক তৃতীয়াংশ হতে ফিদিয়া আদায় করা যদি অসিয়ত না করে থাকে এবং ওয়ারিশ বালেগ বা প্রাপ্ত বয়স্ক হয় তবে তাদের পক্ষ হতে ফিদিয়া আদায় করতে হবে। এর দ্বারা মৃতের পরকালে ফায়েদা হবে এবং ওয়ারিশদের ও ছাওয়াব অর্জিত হবে। তবে না বালেগ তথা অপ্রাপ্ত বয়স্ক ওয়ারিশদের সম্পদের অংশ হতে ফিদিয়া আদায় যেন না হয়।

❏ মাছআলা: (১৯০)

নফল রোজা রাখার পর ভঙ্গ করার হুকুম কি? এর উত্তরে বলা যায় যে নফল রোজা রাখার পর যদি ভঙ্গ করা হয়। সেক্ষেত্রে এর ক্বাজা করা ওয়াজিব। হানাফী ওলামাগণ নফল রোজা ভঙ্গ করা মাকরূহে তাহরীমি এবং এর ক্বাজা করাও মাকরূহে তাহরীমি বলেছেন।

মালেকী মাজহাবের ফকীহবিদগণের মতে যে রোজা কোন ব্যক্তি নফল হিসাবে রেখেছে এবং তার মা বাবার মধ্য হতে কোন একজন কিংবা শাইখ মেহেরবানী ও স্নেহ পরবশ হয়ে রোজা ইফতার করার হুকুম দিলে সেক্ষেত্রে ভঙ্গ করা জায়েজ আছে এবং এর ক্বাজা দিতে হবে না।

❏ মাছআলা: (১৯১)

হামেলা অর্থাৎ গর্ভবতী মহিলা কিংবা দুগ্ধ পোষ্য মহিলার (যে মহিলা শিশুদের দুধ প্রদান করে) যদি এই আশঙ্কা হয় যে রোজা রাখতে গিয়ে তার জান কিংবা বাচ্চা অথবা উভয়ের ক্ষতির আশঙ্কা হয় এ ক্ষেত্রে সেই মহিলা রোজা না রাখা জায়েজ আছে। তবে এ সমস্ত মহিলার উপর পরবর্তীতে রোজা ক্বাজা করা ওয়াজিব। ফিদিয়া ওয়াজিব নয়। আর ক্বাজা রোজা ধারাবাহিকভাবে প্রতিদিন রাখা ওয়াজিব নয়।

নিজ দুগ্ধপোষ্য শিশুকে দুধ পানকারী মা কিংবা বেতনধারীনী দুধ পানকারী মহিলা উভয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। যদি মা হয় তবে তার উপর শরীয়তের দৃষ্টিতে দুধ পান করানো ওয়াজিব। দুধ পান করানো যদি বদলা তথা বেতন নির্ধারণের ভিত্তিতে হয় তবে দুগ্ধপোষ্য শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষা করা ওয়াজিব।

কতক রোজা যা মাকরূহে তানজীহি এর বর্ণনাঃ

يوم عاشورا তথা মহররমের ১০ তারিখের রোজা যার সাথে সাথে ৯ তারিখ কিংবা ১১ তারিখের রোজা মিলানো না হবে, তবে তা মাকরূহে তানজীহি। অর্থাৎ শুধুমাত্র ১০ই মুহররম দিবসে একটি রোজা রাখা।

অনুরূপ নববর্ষের রোজা এবং উৎসব মুখর দিবসের রোজা রাখা, তবে শর্ত হচ্ছে এটি সেদিন না হয় যেই দিন সে ব্যক্তি আগে থেকেই রোজা রেখে আসতেছে। দায়েমী রোজা তথা সর্বদা রোজা রাখা যার দরূন শরীরে দুর্বলতা লাহিক তথা অনুভব হয়।

صوم وصال তথা সর্বদা রাত দিন খানা-পিনা ইত্যাদি হতে নিজেকে বিরত রাখাও মাকরূহ। মুসাফির অবস্থায় রোজা রাখা, যখন রোজা রাখা তার কষ্ট ও কঠিন হবে, সেক্ষেত্রে ও রোজা রাখা মাকরূহ।

হুজুর সৈয়্যদে আলম (ﷺ)-এর পবিত্র বেলাদত দিবসের রোজা, কেননা এটি ঈদের সদৃশ্য এ জন্য উক্ত দিবসে রোজা রাখাও মাকরূহ।

অসুস্থ ও মুসাফিরের ন্যায় যদি গর্ভবতী মহিলা দুধ পানকারী মহিলা এবং বার্ধক্য জনিত পুরুষ মহিলা যারা রোজা রাখা কষ্টকর হবে কিংবা মারাত্মকভাবে শারীরিক দুর্বলতার আশঙ্কা তারাও রোজা রাখা মাকরূহ। অনুরূপ কোন ফরজ রোজার ক্বাজা ওয়াজিব হওয়া অবস্থায় তা আদায় না করে নফল রোজা রাখা মাকরূহ। কেননা ফরজ রোজা আদায় করা নফলের চেয়ে আবশ্যকতা বেশী।

❏ মাছআলা: (১৯২)

নফল রোযা রেখে ভেঙ্গে দেওয়ার বিধান: নফল রোযা রাখার পর যদি ভেঙ্গে দেয় তখন তার কাযা রাখা ওয়াজিব। ওলামায়ে আহনাফ নফল রোযা ভেঙ্গে দেওয়াকে মাকরূহে তাহরীমি বলেন। তার কাযা রাখাও মাকরূহে তাহরিমী।

ফুকাহায়ে মালেকীদের নিকট ঐ নফল রোযা যা নফল হিসাবে রেখেছে তার মাতাপিতা বা শায়খ রোযা ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করল তখন ভেঙ্গে দেওয়া বৈধ। তার কাযা নেই।

❏ মাছআলা: (১৯৩)

গর্ভবতী বা দুধপানকারিণী মহিলার যদি আশঙ্কা হয় রোযা রাখলে নিজের জানের বা বাচ্চার বা উভয়ের ক্ষতির আশংখা রয়েছে তখন তার জন্য রোযা ছেড়ে দেওয়া বৈধ এরকম মহিলাদের উপর সামর্থ হলে কাযা ওয়াজিব ফিদিয়া দিলে হবে না এবং কাযা লাগাতারও রাখতে হবে না।

দুধপানকারিণী মহিলা বা মজুরী নিয়ে দুধপানকারিণী মহিলা উভয়ের একই হুকুম। যদি মা হয় তখন তার উপর শরীয়তের দৃষ্টিতে ওয়াজিব আর যদি মজুরী নিয়ে দুধ পান করানো হয় তখন মুসাহেরার দিক দিয়ে দুধ পান করানো ওয়াজিব হয়ে পড়ে।

কিছু রোযা রাখা মাকরূহে তানযিহী:

১. আশুরার রোযা একা রাখা, নয় বা এগার তারিখ ব্যতীত।

২. নববর্ষ ও মেহেরজান তথা উৎসব মূখর রোযা রাখা যদি তা তার অভ্যাসের তারিখে না পড়ে।

৩. অনবরত রোযা রাখা। যার কারণে দূর্বলতা এসে যায়।

৪. সওমে বেছাল তথা রাত-দিন ইফতার না করে রোযা রাখা।

৫. মুসাফির রোযা রাখা যদি রোযা তার উপর কঠিন ও কষ্টদায়ক হয়।

৬.  রাসূলের জন্মের দিন ঈদের সাদৃশ্য তাই সেদিন রোযা রাখা মাকরূহ।

৭. রোগী ও মুসাফিরের মত যদি গর্ভবতী মহিলা ও দুধপানকারিণী মহিলা ও বয়স্ক পুরুষ-মহিলা যাদের রোযা রাখা কষ্ট বা ক্ষতির আশংখা রয়েছে তাদেরও রোযা রাখা মাকরূহ।

৮. কোন ফরয রোযার কাযা থাকা সত্ত্বেও নফল রোযা রাখা মাকরূহ কেননা নফলের চেয়ে ফরযের কাযা করা উত্তম।

❏ মাছআলা: (১৯৪)

রোযা ছেড়ে দেওয়ার বৈধ পদ্ধতি: 

১. রোগ 

২.  অধিক কষ্টের কারণে রোযা ভেঙ্গে দেওয়া বৈধ। 

যদি কেউ আশংখা করে যে, রোযা রাখলে রোগ বেড়ে যাবে বা দেরিতে রোগ নিরাময় হবে বা কঠিন কষ্ট ভোগ করবে তখন এসকল পদ্ধতিতে ইমাম আবু হানিফা, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম মালেক (رحمة الله) একমত যে,  তাদের জন্য না রাখা বৈধ। ইমাম আহমদের নিকট রোযা না রাখা সুন্নাত, রাখা মাকরূহ। আর যদি রোগ বাড়ার ও কষ্ট নিশ্চিত হয় তখন রোযা না রাখা ওয়াজিব। রাখা হারাম।

সফরের অবস্থায় রোযা ছেড়ে দেওয়া মুবাহ। যদি সফর এত বেশী দূরে  হয় যেখানে কসর ওয়াজিব বা ৭৪/৭৫ কিলোমিটার সফর হয় তা হেঁটে হোক বা গাড়িতে হোক তখনও রোযা ছেড়ে দেওয়া বৈধ। হ্যাঁ যদি  সফরে কোন কষ্ট না হয় তখন রোযা রাখা উত্তম। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, 

وَأَنْ تَصُومُوا خَيْرٌ لَكُمْ

অর্থ: যদি তোমরা সফরে রোযা রাখ তা উত্তম।

❏ মাছআলা: (১৯৫)

যে মুসাফির রাত থেকে রোযার নিয়ত করেছে সে ফজর উদয় হওয়ার পর  সফর শুরু করেছে তখন তার জন্য রোযা ভেঙ্গে দেওয়া বৈধ। যদি ভেঙ্গে দেয় তখন কাযা ওয়াযিব আহনাফের মতে কাফ্ফারা দিতে হবে না।

❏ মাছআলা: (১৯৬)

হায়েয ও নেফাসের সময় রোযা ছেড়ে দেওয়া ওয়াজিব। রোযা রাখা হারাম। কিন্তু সে যখন পবিত্র হয়ে যাবে তখন রোযা রাখা শুরু করে দিতে হবে এবং যে সকল রোযা বাদ গেল তা রমযানের পরে কাযা করে দেবে।

❏ মাছআলা: (১৯৭)

যদি কারো অধিক পিপাসা বা ক্ষুধা লেগেছে তখন রোযা বরদাশত করা কঠিন হয়ে গেল তখন রোযা ভেঙ্গে দেওয়া বৈধ এবং তার কাযা করা ওয়াজিব।

বয়স বেশী হওয়ার কারণে রোযা ছেড়ে দেওয়ার বিধান। যে ব্যক্তি বয়সের কারণে রোযা রাখতে অক্ষম তখন তার জন্য রোযা ছেড়ে দেওয়া বৈধ। কিন্তু তার উপর প্রতিদিনের পরিবর্তে একজন গরীবকে দু’বেলা খাবার দিতে হবে। একই হুকুম ঐ রোগীর যে সুস্থ হওয়ার আশা রাখে না ফিদিয়া দেওয়ার পরে তাকে আর কাযা করতে হবে না।

❏ মাছআলা: (১৯৮)

যদি কোন ব্যক্তি রমযান মাসে রোযা রাখার সামর্থ না রাখে তবে সে অন্য সময়ে কাযা করতে পারবে তখন তার উপর কাযা করা ওয়াযিব ফিদিয়া দেওয়া বৈধ হবে না।

❏ মাছআলা: (১৯৯)

মৃতের কাযা রোযার কি হুকুম?

যদি মৃত ফিদিয়া দেওয়ার অসীয়ত করে তখন তার উত্তরাধিকারের উচিত তার রেখে যাওয়া সম্পদের এক তৃতীয়াংশ থেকে ফিদিয়া আদায় করবে যদি সে অসীয়ত না করে এবং উত্তরাধিকার বালেগ থাকে তখন তারা ফিদিয়া আদায় করতে পারবে। তা দ্বারা তার পরকালে ফায়দা হবে তবে নাবালেগ উত্তরাধিকারের অংশ থেকে ফিদিয়া আদায় সহীহ হবে না। 

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment