সহীহ মুসলিম (আরবি: صحيح مسلم) হাদিস বিষয়ক একটি সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ। এটি কুতুব আল-সিত্তাহ অর্থাৎ হাদীস বিষয়ক প্রধান ছয়টি গ্রন্থের দ্বিতীয় গ্রন্থ।
লেখকঃ মুসলিম বিন হাজ্জাজ
ধারাবাহিকঃ সিহাহ সিত্তাহ
ধরনঃ হাদিসের সংকলন
বর্ণনাঃ
‘সহীহ মুসলিম’ হাদিসের অন্যতম একটি গ্রন্থের নাম। ইমাম মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ ইবনে মুসলিম আল কুশাইরী হলেন এই মহান গ্রন্থের সংকলক।
তার অন্যান্য সংকলনের মধ্যে সহীহ মুসলিম হলো সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ও গ্রহনযোগ্য। মুসলিম হাদীস বিশারদদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোরআন মাজীদের পর পৃথিবীর বুকে বিশুদ্ধতম দ্বিতীয় গ্রন্থ হলো ‘সহীহ মুসলিম’। শক্তিশালি পরিকল্পনার পাশাপাশি অত্যন্ত যত্নের সাথে গুছিয়ে ইমাম মুসলিম তৈরি করেছেন সংকলনটি। উক্ত কর্মটি সম্পন্ন করতে তার সময় লেগেছে প্রায় পনের বছর। এই গ্রন্থ সংকলনে তার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও সযত্ন সুন্দর বিন্যাসকে বিবেচনা করে তার যুগের পশ্চিমা বহু মুহাদ্দিস সহীহ মুসলিমকে সহীহ বুখারী’র উপর প্রাধান্য দিয়ে তাকে ‘শ্রেষ্ঠ হাদীস গ্রন্থ’ হিসেবে মন্তব্য করেছেন। তাদের অন্যতম একজন হাফিজুল হাদীস আবু আলী নায়সাবুরী বলেন: ‘আসমানের নিচে ইলমে হাদীস সংক্রান্ত ইমাম মুসলিমের কিতাব অপেক্ষা বিশুদ্ধতম কোন কিতাব নাই।’
হাদিসের এ গ্রন্থ সংকলনের ক্ষেত্রে ইমাম মুসলিম তার একান্ত আস্থাভাজন ছাত্রদের সহযোগিতাও নিয়েছেন। তার ছাত্র আহমদ বিন সালামা বলেন, ‘ইমাম মুসলিমের সাথে তার ‘সহীহ’ সংকলনের ক্ষেত্রে আমি পনেরো বছর কাজ করেছি, এতে প্রায় ১২ হাজার হাদীস রয়েছে (পুনরুক্তসহ)। পুনরুক্ত বাদ দিলে হাদীসের সংখ্যা হবে প্রায় ৪০০০।’ ইমাম মুসলিম তার মুখস্ত তিন লক্ষাধিক হাদীস থেকে বাছাই করে বিশুদ্ধ হাদীসের এ সংকলনটি তৈরি করেছেন।
ইমাম মুসলিম (রহঃ) এর জিবনীঃ
জন্মঃ
আল-ইমাম আল-হাফেজ হুজ্জাতুল ইসলাম আবুল হুসাইন মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ আল-কুশিয়ারী আন-নায়সাবুরী ২০২/৮১৭ মতান্তরে ২০৬/৮২১ অথবা ২০৪/৮১৯ সনে খুরাসানের অন্তর্গত নায়সাবুরে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি নির্ভেজাল আরব বংশজাত । তার পরিবারের আদি বাসস্থান নায়সাবুর । শৈশবকাল হতেই তিনি হাদীস শিক্ষায় আত্মনিয়োগ করেন ।
মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ
مسلم بن الحجاج
উপাধিঃ ইমাম মুসলিম
জন্মঃ ৮১৫ পরে
নিশাপুর, খোরাসান
(বর্তমান ইরান)
মৃত্যুঃ মে ৮৭৫ সমাধি স্থান নাসারাবাদ (নিশাপুরের একটি শহর)
যুগঃ ইসলামের স্বর্ণযুগ আব্বাসিয় খিলাফতকাল
পেশাঃ মুসলমান আলিম, হাদিস সংকলনকারী
সম্প্রদায়ঃ সুন্নী মুসলমান
মূল আগ্রহঃ হাদিসশাস্ত্র
লক্ষণীয় কাজঃ সহীহ মুসলিম
যাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেনঃ
১/ইসহাক ইবন রাহওয়ে,
২/ইমাম বুখারী
সফরসমুহঃ
হাদীস শিক্ষার উদ্দেশে তৎকালীন মুসলিম জাহানের সবগুলি কেন্দ্রেই গমন করেন। বিশেষতঃ ইরাক, হিজায, মিশর প্রভৃতি অঞ্চল ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করে তথায় অবস্থানকারী হাদীসের শ্রেষ্ঠ উস্তাদ ও মুহাদ্দিসের নিকট হতে হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করেন । তিনি এ সকল স্থানের ইমাম বুখারীর (মৃত্যুঃ ২৫৬ হিঃ) অনেক উস্তাদ এবং অন্যদের নিকট থেকেও হাদিস শ্রবণ ও গ্রহণ করেন । ইমাম মুসলিম সর্বপ্রথম ২১৮/৮১৩ সনে হাদিসের দারসে বসতে শুরু করেন । ইয়াহইয়া আত-তামীমী আন-নায়সাবুরী, আল-কা’নাবী, আহমাদ ইবনে ইউনুস, ইসমা’ঈল ইবনে আবী উইয়াস, সা’ঈদ ইবনে মানসূর, আউন ইবনে সাল্লাম, আহমাদ ইবনে হাম্বল – এ সকল প্রখ্যাত হাদিসবিদ ছাড়া আরও অনেকের নিকট তিনি হাদিসের পাঠ গ্রহণ করতেন। তাছাড়া ইমাম শাফি’ঈ-এর শাগরিদ হারমালা এবং প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইসহাক ইবনে রাহুইয়াহ-র নিকট থেকেও তিনি হাদিস শোনেন । তিনি একাধিকবার বাগদাদ সফর করেন । তাঁর সর্বশেষ বাগদাদ সফর ছিল হিজরী ২৫৯ সনে । বাগদাদের হাদিসবিদরা তাঁর নিকট থেকে শ্রুত হাদিস বর্ণনা করেছেন।
উস্তাদঃ ইমাম বুখারী (রহঃ)
ইমাম বুখারী নায়সাবুরে আসলে ইমাম মুসলিম তাঁকে উস্তাদ হিসেবে বরণ করে নেন। তাঁর হাদিস বিষয়ক বিশাল জ্ঞানভান্ডার হতে মুসলিম যথেষ্ট মাত্রায় গ্রহণ করেন। এই শহরে এক সময় ইমাম বুখারীর বিরুদ্ধে প্রবল প্রচারণা শুরু হয়। ইমাম মুসলিম তখন বুখারির পক্ষ অবলম্বন করেন। এ প্রসঙ্গে একটি বিশেষ ঘটনার কথা বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। ‘‘একদিন ইমাম মুসলিম তাঁর হাদিসের উস্তাদ মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াহইয়ার দারসে অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সাথে উপস্থিত আছেন । সহসা উস্তাদ ঘোষণা করেন, ‘বিশেষ একটি মাসয়ালায় যে ব্যক্তি বুখারির মতের সাথে একমত তাঁর উচিত আমার মজলিস ত্যাগ করা’। ইমাম মুসলিম সাথে সাথে মজলিস ত্যাগ করে ঘরে চলে আসেন এবং এই উস্তাদের নিকট হতে শ্রুত ও গৃহীত হাদিসসমূহের পাণ্ডুলিপি ফেরত পাঠিয়ে দেন । তিনি এই উস্তাদের সূত্রে হাদিস বর্ণনা সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করেন’’।
শাগরিদগণঃ
ইমাম মুসলিম ছিলেন ‘উলূমে হাদিসের এক বিশাল সাগর’। বিশ্বের সকল হাদিস বিশারদ তাঁকে এ বিষয়ের একজন শ্রেষ্ঠ ইমাম বলে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। তাঁর যুগের বড় বড় মুহাদ্দিসগণ তাঁর নিকট হাদিস শিক্ষা করেছেন। তাঁর প্রখ্যাত শাগরিদদের মধ্যে ইবরাহীম ইবনে আবী তালিব, ইবন খুযাইমা, সাররাজ, আবু আওয়ানা, আবু হামেদ ইবনে শারকী, আবু হামেদ আহমাদ ইবনে হামাদান, ইবরাহীম ইবনে মুহাম্মাদ, মাককী ইবনে আবাদান, আব্দুর রাহমান ইবনে আবি হাতেম, মুহাম্মাদ ইবনে মাখলাদ, ইমাম তিরমিযী, মুসা ইবনে হারুন, আহমেদ ইবনে সালমা, ইয়াহইয়া ইবনে সায়েদ প্রমুখের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তারা সকলে হাদিস শাস্ত্রে ইমাম মুসলিমের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে তাঁর সূত্রে হাদিস বর্ণনা করেছেন। অবশ্য ইমাম তিরমিযী ইমাম মুসলিমের সূত্রের মাত্র একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন।
ইমাম মুসলিম রচিত গ্রন্থসম
ইমাম মুসলিমের মহামূল্য রচনাবলীও তাঁর পাণ্ডিত্যের কথা অকাঠ্যভাবে প্রমাণ করে । তাঁর গ্রন্থাবলীর অধিকাংশই হাদিস ও তৎসম্পর্কিত বিষয়ে প্রণীত।
ইমাম মুসলিম রচিত গ্রন্থসমূহ –
তাঁর বিখ্যাত হাদিস সংকলণ “আস-সাহীহ” ছাড়াও নিম্নলিখিত গ্রন্থাবলীর কথা ইতিহাসে পাওয়া যায়ঃ-
১. আল-মুসনাদ আল-কাবীর
২. কিতাব আল-জামি ‘আলা আল-আবওয়াব
৩. কিতাব আল-আসমা’ ওয়া আল-কুনা’
৪. কিতাব আল-তাময়ীয
৫. কিতাব আল-ইফরাদ
৬. কিতাব আল-আকরান
৭. কিতাবু সুওয়ালাতিহি আহমাদ ইবনে হাম্বল
৮. কিতাব আল ‘ইলাল ওয়া কিতাব আল-ওয়াহদান
৯. কিতাবু হাদিসে ‘আমার ইবনে শূ’আইব
১০. কিতাব আল-ইনতিফা বি-উহুব আল-সিবা’
১১. কিতাবু মাশায়িখ শু’বা
১২. কিতাবু মাশায়িখ মালিক ওয়া কিতাবু মাশায়িখ আল-সাওরী
১৩. কিতাবু মান লায়সা লাহু ইল্লা রব্বিন ওয়াহিদ
১৪. কিতাব আল-মুখাদরামিন
১৫. কিতাব আওলাদ আল-সাহাবা
১৬. কিতাবু আওহাম আল-মুহাদ্দিসীন
১৭. কিতাব আল-তাবাকাত
১৮. কিতাবু আফরাদ আল-শামিয়্যীন ।
তিনি সাহাবীদের জীবনী বিষয়ক “মুসনাদ আল-কাবীর” রচনায় হাত দিলেও তা শেষ করে যেতে পারেননি । একমাত্র ‘আস-সাহীহ’ ছাড়া তাঁর রচনার আর কোনটিই বর্তমানে পাওয়া যায় না। এই কিতাবগুলো পৃথিবীর শ্রেষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরীতে সংগ্রহ আছে।
মৃত্যুঃ
ইমাম মুসলিম ২৬১/৮৭৫ সনের ২৫শে রজব রোববার নায়সাবূরে ইন্তেকাল করেন। নায়সাবূরের শহরতলী নাসরাবাদে ২৬শে রজব সোমবার তাঁকে দাফন করা হয়। তাঁর জন্মের সন সম্পর্কে মতভেদ থাকায় মৃত্যুকালে তাঁর সঠিক বয়স সম্পর্কেও মতপার্থক্য দেখা যায়। ইবনে হাজার আসকালানী মুসলিমের মৃত্যুর কারণ সম্বন্ধে একটি বিবরণ প্রদান করেছেন। ইমাম মুসলিমের জন্য হাদিস বিষয়ক একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। সেই মজলিসে একটি হাদিস আলোচিত হয়। হাদিসটি ইমাম মুসলিমের জানা ছিল না। মজলিস শেষে বাড়ি ফিরে রাতে এক ঝুরি খুরমা সামনে নিয়ে হাদিসটি তালাশ করতে বসেন। একটি একটি করে খুরমা মুখে দিচ্ছেন আর হাদিসটি অনুসন্ধান করছেন। এভাবে সকাল হয়ে যায়, খুরমাও শেষ হয় এবং হাদিসটিও তিনি পেয়ে যান। এই অতিরিক্ত খুরমা ভক্ষণই তাঁর মৃত্যুর বাহ্যিক কারণ।
ইমাম মুসলিম সম্বন্ধে অনান্য মুসলিম মনিষীর বক্তব্যঃ
হাকেম বলেন, ‘ইমাম মুসলিম ছিলেন দীর্ঘাকৃতির। মাথার চুল ও দাড়ি ছিল সাদা । পাগড়ির একটি দিক দু’কাধের মাঝখানে ছেড়ে দিতেন। তিনি ছিলেন কাপড়ের ব্যবসায়ী’। ইমাম মুসলিমের প্রতিভা ও যোগ্যতার অকপট স্বীকৃতি দিয়েছেন তাঁর যুগের ও পরের বহু মনিষী ।
ইমাম মুসলিমের উস্তাদ মুহাম্মাদ ইবনে আবদিল ওয়াহহাব আল-ফাররা বলেনঃ ‘ইমাম মুসলিম মানব জাতির মধ্যে অন্যতম আলিম য় ইলমের সংরক্ষণকারী । আমি তাঁর সম্পর্কে শুধু ভাল ছাড়া আর কিছু জানি না ।’
আবু বাকর আল-জারূদিও ঠিক একই মন্তব্য করেছেন ।
মাসলামা ইবনে কাসিম বলেন, ‘অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য উঁচু মর্যাদার একজন ইমাম তিনি’ ।
ইবনে আবী হাতেম বলেন, ‘আমি তাঁর সূত্রে হাদিস লিখেছি। তিনি অন্যতম বিশ্বস্ত হাফেজে হাদিস। হাদিস বিষয়ে তাঁর গভীর জ্ঞান। আমার পিতাকে তাঁর সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেনঃ ‘অত্যন্ত সত্যবাদী’। তিনি আরও বলেছেনঃ ‘হাফেজে হাদিস বলতে চারজনকেই বুঝায়। তারা হলেনঃ আবু যূর’আ, মুহাম্মাদ ইবনে ইসমা’ঈল, আদ-দারিমী ও ইমাম মুসলিম’।
ইবনুল আখরাম বলেন, ‘আমাদের এই শহর তিনজন হাদিস বিশারদ সৃষ্টি করেছেঃ তাঁরা হলেনঃ মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াহইয়া, ইব্রাহীম ইবনে আবী তালিব ও ইমাম মুসলিম’ ।
ইসহাক ইবনে মানসূর একবার ইমাম মুসলিমকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘যতদিন আল্লাহ্ তা’আলা আপনাকে মুসলমানদের জন্য জীবিত রাখবেন আমরা কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবো না’।
আহমাদ ইবনে সালমা বলেন, ‘আমি আবু যুর’আ আবু হাতেমকে হাদিসের বিশুদ্ধতা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে তাদের যুগের অন্যান্য মাশায়িকদের ওপর ইমাম মুসলিমকে প্রাধান্য দিতে দেখেছি’।
হাফেজ আবু কুরাইশ বলেছেন, ‘পৃথিবীতে হাফেজে হাদিস মাত্র চারজন। ইমাম মুসলিম তাদের একজন’ ।
ইবনে খাল্লিকান ইমাম মুসলিমকে ‘সাহিহ গ্রন্থের অধিকারী, হাদিসের অন্যতম ইমাম ও হাফেজ এবং মুহাদ্দিসকুলের এক প্রধান স্তম্ভ বলে উল্লেখ করেছেন’।