মিলাদ-কিয়ামের এক্সে (এক্স-রে) রিপোর্ট-এর পোস্ট মর্টেমঃ

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

কৃত- হাফেজ মুহাম্মদ আশরাফুজ্জামান আল-কাদেরী

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের প্রাণকেন্দ্র, সুন্নীয়ত ও আশেকানে রসূল এবং গোলামানে মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম, সুন্নী মুসলমানদের হারামে আ-মেন তথা সুরক্ষিত আশ্রয় কেন্দ্র জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ার সচেতন ছাত্ররা মাঝে মাঝে কিছু বই-পুস্তিকা হাতে এনে দেয়। এর মাঝে দারুল উলুম হাটহাজারীর উস্তাদ মুমতাযুল করিম (তাদের বাবা হুজুর) দা.বা.র তত্ত্বাবধানে লিখিত মুহাম্মদ আজিজুল হক নোমানী রচিত ‘মিলাদ-কিয়ামের এক্সে রিপোর্ট’ নামে একটি পুস্তিকা হস্তগত হয়। পড়ে দেখলাম দেওবন্দীদের চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায়ী সাদাসিধে সর্ব সাধারণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার কুমতলবে কিছু মিথ্যাচারী আর কিছু বর্ণচুরী দিয়ে সাজগোজ করে পুস্তিকাটি পেশ করা হয়েছে।

মলাটে লিখেছে পরাজিত সুন্নীদের পঁয়ত্রিশটি বাহাসের সংক্ষিপ্ত বিবরণ। পুস্তিকার শেষে ৩৬টি স্থানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। যার মধ্যে ২৩টি চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলের। এর শত শতভাগই বর্ণচুরী আর মিথ্যাচারিতায় পরিপূর্ণ। কারণ বৃহত্তর চট্টগ্রামের সুন্নী-অসুন্নী সবাই জানেন যে, গাযীয়ে মিল্লাত ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা আযিযুল হক শেরে বাংলা রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির সময় থেকে অদ্যাবধি ‘ক্বরনুশ শয়তান’ দেওবন্দী ওহাবীরা সুন্নীদের সাথে কোথাও কোন বাহাসে টিকতে পারেনি। কিন্তু আজিজুল হক গং-এর এ সকল বিবরণ তাদের উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া স্বপ্নবিলাস মাত্র।

পুস্তিকার ভূমিকায় তিনি গত ২৫ এপ্রিল ২০১২ তারিখে ছারছীনা দরবার শরীফ থেকে প্রকাশিত ‘পাক্ষিক তাবলীগ’-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন যে, ওখানকার সুন্নীরা মিলাদ-কিয়াম নিয়ে বাহাসে দেওবন্দী ওয়াহাবী তথা মিলাদ-কিয়াম বিরোধীদেরকে পরাজিত করেছেন বলে একটি মিথ্যে খবর প্রকাশ করেছে। তাই হাটহাজারী মাদরাসার জনৈক তথাকথিত বড় হুজুরের তত্ত্বাবধানে আজিজুল হক নোমানী ছাহেব ‘… মিলাদ কিয়ামের এক্সে রিপোর্ট নামের এ (জিহালতপূর্ণ) পুস্তিকাটি প্রকাশ করেছেন।

প্রিয় ভাইয়েরা! এ ব্যাপারে আমাদের প্রকৃত ও হাক্কানী আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের বক্তব্য হচ্ছে- বর্তমান ভারতবর্ষসহ এ বাংলাদেশের যমীনে অনেকগুলো দরবার, যেমন- ফুরফুরা, জৈনপুর এবং আজমগড়ী সিলসিলার সাথে সম্পৃক্ত। আবার মূল শেখড়ের দিক থেকে ইনাদের সাথে দেওবন্দীদের সাথে এক অভিন্ন ও অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কও রয়েছে নিঃসন্দেহে। কারণ, ইনারা সিলসিলা কিম্বা আক্বীদার ক্ষেত্রে নজদীয়্যতের আদর্শে উজ্জীবিত সংস্কারের নামে পরিচালিত বালাকোট রণক্ষেত্রের সহযোদ্ধা ও সহযাত্রী পীর ও মুরীদ সৈয়দ আহমদ বেরেলভী ও শাহ ইসমাইল দেহলভীর একান্ত ভক্ত ও অনুসারী।

বাস্তবে মিলাদ-কিয়ামের ক্ষেত্রে দেওবন্দীরা ও তাদের সকল মুরব্বীদের পীরে মগাঁ আশেকে রসূল, হযরত হাজী এমদাদুল্লাহ্ মুহাজিরে মক্কী রহমাতুল্লাহি আলায়হির অনুসারী ছিলেন। পরবর্তীতে ইঙ্গ ইহুদী চক্রের শিকার হয়ে দেওবন্দীদের সিংহভাগ মুসলিম ঐক্যে ফাটল ধরাবার উদ্দেশ্যে গাংগুহী-থানভী প্রমুখদের অনুসারে সুন্নী আক্বীদা ও আমল বিশেষত মিলাদ-কিয়াম ইত্যাদি নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করে তাদের পীর ও মুর্শেদের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে ‘দেওবন্দ’ এর প্রকৃত অর্থ ‘শয়তানের দলে’- পরিণত হয়ে যায়।

সত্যতা যাচাই করতে বিবেকবানদের অনুরোধ করছি। ঢাকার খিলগাঁও থেকে মাওলানা মুস্তাফীজুর রহমান কর্তৃক ফেব্রুয়ারী ২০১৩ সালে প্রকাশিত, প্রাক্তন ধর্মমন্ত্রী মুফতী ওয়াক্কাস, মাও. মহিউদ্দীন খান ও মাও. আহমাদুল্লাহ্ আশরাফ প্রমুখ সহ দশজন আলেম (সর্ব দা.বা.) কর্তৃক সমর্থিত ইবং শায়খুল হাদীস কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ্ (দা.বা.) কর্তৃক লিখিত ও আহুত পুস্তিকা ‘হক সিলসিলা ও মাশরাবগুলোর মধ্যকার মীলাদ-কিয়ামসহ শাখাগত ইখতিলাফী মাসায়েলে ভ্রাতৃঘাতী ভেদাভেদ সৃষ্টি না করে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রতি উদাত্ত আহ্বান ‘ঐক্যের ডাক’ পুস্তিকাটি পড়ে দেখার অনুরোধ জানাচ্ছি।

প্রিয় সত্য সন্ধানী মুসলিম ভাইয়েরা!

আমরা এবার আজিজুল হক নো’মানী ছাহেবের নির্ণিত তার ভাষায় ‘এক্সে’ নামের ত্রুটিপূর্ণ ভাঙ্গা ও কানা যন্ত্রটি দ্বারা পেশকৃত ‘রিপোর্ট’গুলো গোলামিয়্যে মোস্তফার প্রেমসিক্ত অন্তর্দৃষ্টির আলোতে পোষ্টমর্টেম বা ময়না তদন্ত করে দেখি।

সর্বপ্রথম দেখুন, তার ‘বিসমিল্লায় গলদ’ সে ‘এক্সরে’ লিখতে গিয়ে লিখেছে এক্সে। যে পুস্তিকার মলাটে ভুল, ওই পুস্তিকায় শুদ্ধ বর্ণনা আসবে কোত্থেকে। এখন দেখুন সেটার ভিতরে কি আছে? সে কি এক্সে (!) করলো দেখুন। আমার পোষ্টমর্টেমও দেখে নিন।

প্রিয় ইসলামী ভাইয়েরা

মীলাদ-ক্বিয়াম বিরোধী এ এক্সে রিপোর্টকারী নো’মানী ছাহেব থেকে আরম্ভ করে এদের আ’লা থেকে আসফাল পর্যন্ত প্রায় সবাই এ বিষয়ে অর্থাৎ মীলাদ-কিয়ামের বিরোধিতা করতে গিয়ে প্রথম ও প্রধান যে অপকৌশল ও প্রতারণার শব্দটি ইস্তিমাল করে তা হচ্ছে ‘প্রচলিত’। অর্থাৎ তারা নাকি প্রচলিত মীলাদ-কিয়াম এর বিরোধিতা করেন। এর অবধারিত অর্থ হচ্ছে উনারা প্রকৃত মীলাদ কিয়ামের বিরোধিতা করেন না। অথচ এরা প্রচলিত কিংবা প্রকৃত মীলাদ-কিয়াম কোনটাই করেন না। বাহ! সরলমনা মুসলমানদের প্রতারিত করতে গিয়ে নিজেরাই কি প্রতারণার শক্ত ফাঁদে আটকে গেলনা? একেই বলে من حفر بئرالاخيه وقع فيه (যে তার ভাইয়ের জন্য কূপ খনন করে, সে নিজেই তাতে পতিত হয়।)

আল্লাহ্ পাক এরশাদ ফরমাচ্ছেন-

يُخَادِعُونَ اللَّهَ وَالَّذِينَ آمَنُوا وَمَا يَخْدَعُونَ إِلَّا أَنْفُسَهُمْ وَمَا يَشْعُرُونَ

অর্থাৎ এসব মুনাফিক আল্লাহ্ (রসূল)কে ও মুমিনদেরকে প্রতারিত করতে চায় অথচ এরা নিজেরাই নিজেদের প্রতারিত করে, যা তারা বুঝতে পারে না।[সূরা বাক্বারা, আয়াত-৯]

তার ভাষায়, ‘ইসলামী শরীয়তে প্রচলিত মিলাদ ও কিয়ামের কোন ভিত্তি নেই। এটা শরীয়তপরিপন্থী গর্হিত বিষয়। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে এটা কেবল প্রচলিত মিলাদ কিয়াম নয় বরং ইসলামী শরীয়তের সর্ববিষয়ে এটা তাদের অজ্ঞতা-মূর্খতা ও জিহালতের নামান্তর।

সুপ্রিয় সত্যসন্ধানী ভাইয়েরা!

আসুন এসব তথাকথিত ‘প্রচলিত’ শব্দের প্রবক্তারা ‘মিলাদ-কিয়াম’কে শরীয়তপরিপন্থি ও গর্হিত বিষয় প্রমাণে যেসব তত্ত্বাবলী তুলে ধরেছেন তা হুবহু প্রতি উত্তরসহ উপস্থাপন করছি। এসব তত্ব তারা উক্ত পুস্তিকার ৪ ও ৫ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন।

১. তাদের বক্তব্য-‘শরীয়তের প্রধান দলিল পবিত্র ক্বোরআন। পবিত্র ক্বোরআনের প্রসিদ্ধ অভিমতানুসারে ৬৬৬৬ আয়াতের মধ্যে ছোট্ট একটি আয়াতেও মিলাদ কিয়ামের কোন অস্তিত্ব নেই।

জবাব: বাহ! মুফতি ছাহেব, সত্য কথাটাই উচ্চারণ করেছেন। কারণ তারাইতো নজদিয়াতের প্রেতাত্মা ইসমাইল দেহলভী আর গাঙ্গুহী হযরাতদের প্রকৃত অনুসারী। যারা ‘মিলাদ’ বলতেই মানেন না। খামাখা ‘প্রচলিত’ শব্দের লেজ লাগিয়ে ভেজাল করছেন কেন? এখন তো বলেই দিলেন যে, পবিত্র ক্বোরআনে কেবল ‘প্রচলিত মিলাদ’ নয় মিলাদের কোন কথাই ক্বোরআনে পাননি। لعنة الله على الكاذبين المتجاهلين বানোয়াট, মুর্খ, মিথ্যুকদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত হোক। নিশাচর আর কাকে বলে?

প্রিয় ইসলামী ভাইয়েরা!

মাহফিলে মিলাদের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে যিকরে মোস্তফা তথা প্রিয়তম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের ধরাধামে তাশরীফ আনয়নসহ নবী জীবনের সামগ্রিক বিষয়াদি আলোচনা করা ও এর দ্বারা নবীপ্রেম সিক্ত হয়ে ঈমান-ইসলামের প্রতি আসক্ত হওয়া। পবিত্র ক্বোরআনে বহু আয়াতে করিমায় এর সুন্দর বর্ণনা এসেছে। দেখুন, পড়–ন, এবং বুঝুন, সূরা বাক্বারা শরীফ, আয়াত নম্বর ১২৯, ১৫১, সূরা আলে ইমরান, আয়াত নম্বর ৮১, ৮২, ১৬৩, সূরা নিসা, আয়াত নম্বর ১৬৫, ১৭০ ও ১৭৩, সূরা মা-ইদাহ্, আয়াত নম্বর ১৫ ও ১৯, সূরা আহযাব, আয়াত নং-৪০, ৪৫, ৪৬ ও ৪৭, সূরা আম্বিয়া, আয়াত নং-১০৭, সূরা সাবা, আয়াত-২৭, সূরা ফাতাহ্, আয়াত নং-২৮, ২৯ এবং জুমআহ্ আয়াত নং-২। এতগুলো আয়াত দেওবন্দী হুজুরদের দৃষ্টিগোচর হল না? যদি বলেন এখানে ‘মিলাদ’ এর উল্লেখ কোথায়? বলব, একটু সূরা মারয়াম শরীফের আয়াত নং ১৫ ও ৩৩ এবং সূরা আল বালাদ এর আয়াত নং ৩ দেখুন। আশা করি, দেওবন্দিয়তের অমানিশার ঘোর কেটে যাবে। বাকী হেদায়তের মালিক আল্লাহ্। ‘মাঁই ইয়াহ্দিল্লাহু ফাহুয়াল মুহতাদি’।

২. তাদের উক্তি- শরীয়তের দ্বিতীয় দলিল হাদীস। অগণিত বিশুদ্ধ হাদিস থেকে একটি হাদিসেও প্রচলিত মিলাদ কিয়ামের বৈধতা পাওয়া যায় না।

জবাব- মক্কা এ মুকাররমার হেরেম শরীফের প্রখ্যাত উস্তাদ আল্লামা আস্ সাইয়্যেদ মুহাম্মদ বিন আলভী মালেকী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁর অনন্য গ্রন্থ ‘আল-ইলাম বি ফাতাওয়া আইম্মাতিল ইসলাম হাওলা মাওলিদিহি আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম’ এর ১১নং পৃষ্ঠায় ‘আউয়ালুল মুহতাফিলীনা বিল মাওলিদিন্নাবাভী’ শিরোনামে লিখেছেন ‘মাওলিদুন্নবীর সর্বপ্রথম মাহফিল উদ্যাপনকারী হচ্ছেন স্বয়ং সাহিবুল মাওলিদ অর্থাৎ নবীয়ে আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজেই। দলিল স্বরূপ তিনি প্রথমে উপস্থাপন করেছেন সহীহ্ মুসলিম শরীফে বর্ণিত প্রসিদ্ধ হাদীসখানা- لَمَّا سُئِلَ عَنْ صِيَامِ يَوْمِ الْاِثْنَيْنِ অর্থাৎ প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিয়মিত সোমবারে রোযা রাখতেন। সাহাবীগণ এর কারণ জানতে চাইলে ইরশাদ করলেন, قَالَ صَلى الله عليه وسلم ذاك يَوْمٌ وُلِدْتُ فِيْهِ অর্থাৎ এ দিন তো আমার মিলাদ হয়েছে। শায়খ আলাভী লিখেছেন, এ হাদীস মিলাদ মাহফিল উদযাপনে সুস্পষ্ট ও বিশুদ্ধতম দলিল। অতএব, যারা বলে মিলাদ মাহফিল সর্বপ্রথম ফাতেমী বংশের সুলতানগণ করেছেন, সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। বরং ওটা তাদের মূর্খতা আর ইচ্ছে করেই সত্য থেকে অন্ধত্ব বরণ করার পরিচায়ক।

দ্বিতীয়ত: সহীহ্ বুখারী শরীফে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হিজরতের পর মদীনা মুনাওয়ারায় ইহুদীদের দেখতে পেলেন এরা আশুরার দিনে রোযা পালন করছে। জিজ্ঞেস করলেন কেন রোযা রাখছো? তারা বলল, এ দিন আল্লাহ্ তা‘আলা জালিম ফিরাউনকে সদলবলে সাগরে নিমজ্জিত করে হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম ও তাঁর সাথীদের ওদের জুলুম থেকে নাজাত দিয়েছিলেন। এর শুকরিয়া স্বরূপ এ দিনের স্মরণার্থে তারা রোযা পালন করছে। রসূলে মাকবূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন, نحن اولى بموسى منكم অর্থাৎ হে ইহুদীরা হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম-এর সাথে তোমাদের চাইতেও আমাদের সম্পর্ক আরো গভীর ও নিটকতম। অতঃপর রসূলে করীম সাহাবীদেরকে ওই দিনের রোযা রাখার হুকুম দিলেন।

হাদীস দ্বারা প্রখ্যাত শারেহে বুখারী ইমাম হাফেয ইবনে হাজর আসকালানী ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনের বৈধতার দলিল পেশ করেছেন।

তৃতীয়ত: বায়হাক্বী শরীফে হযরত আনাস ইবনে মালেক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নুবুওয়াত প্রকাশের পর নিজের পক্ষ হতে আক্বীকা করেছেন। অথচ নবীজীর দাদা খাজা আব্দুল মুত্তালিব তাঁর সাত বছর বয়সে আক্বীকা আদায় করেছেন। ইমাম সুয়ূতী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ফরমাচ্ছেন, আক্বীক্বা একবারই হয়ে থাকে। তাই ধরে নেয়া যায় যে, এটা আল্লাহর হাবীব তাঁকে আল্লাহর পক্ষ হতে বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ আবির্ভূত করার ও উম্মতের জন্যে শরয়ী বিধান সাব্যস্ত করতেই আদায় করেছেন। অতএব,

فَيَسْتَحِبُّ لَنَا اَيْضًا اِظْهَارُ الشُّكْرِ بِمَوْلِدِه صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِاِجْتِمَاعِ الْاِهْوَانِ وَاِطْعَامِ الْطَّعَامِ وَنَحْوِ ذَالِكَ مِنْ وُجُوْهِ الْقُرْبَاتِ وَاِظْهَارِ الْممَسِّرَات

অর্থাৎ আমাদের জন্যও সবাই সম্মিলিতভাবে খানা-পিনা তথা তাবাররুকাতের ব্যবস্থা করে প্রিয়তম রসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি তা‘আলা ওয়াসাল্লাম-এর মিলাদে পাকের শোকরিয়া স্বরূপ খুশী উদযাপন করা মুস্তাহাব।

চতুর্থত: সহীহ্ বুখারী শরীফে বর্ণিত রেওয়ায়েত। আবু লাহাবের মৃত্যুর পর কেউ স্বপ্নে দেখে জিজ্ঞেস করে কেমন আছো? জবাবে সে বলেছে- জাহান্নামের আযাবে লিপ্ত আছি। তবে মিলাদে নবীর সুসংবাদ দেয়ার কারণে খুশী হয়ে দাসী সুয়াইবাকে আযাদ করে দেয়ার সুবাদে প্রতি সোমবার আমাকে আযাব থেকে মুক্তি দেয়া হয়।

এ হাদীসের আলোকে ইমাম আলহাফেজ শামসুদ্দীন ইবনে নাসেরুদ্দীন দামেশক্বী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁর গ্রন্থ ‘মাওরেদুচ্ছাদী ফী মাওলিদিল হাদী’ কিতাবে লিখেছেন, ‘পবিত্র ক্বোরআন ঘোষিত একজন কাফের যদি মিলাদুন্নবীতে খুশী হওয়ার কারণে প্রতিদান প্রাপ্ত হয় তাহলে-

فَمَا حَالُ الْمُسْلِمِ الْمُؤَحِّدِ مِنْ اُمَّةِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَسَرُّ بِمَوْلِده وَيَبْذَلُ مَا تَصِلُ اِلَيْهِ قُدْرُتُه

অর্থাৎ নবীজীর উম্মতের একজন খাঁটি মু’মিন-মুসলমান যদি প্রিয়তম নবীর মুহাব্বতে তাঁর মিলাদে পাকে খুশী হয়ে সাধ্যমত খরচ করে তার কেমন প্রতিদান হতে পারে? নিশ্চয় তার মহান রবের পক্ষ হতে তার জন্য থাকবে চিরস্থায়ী জান্নাতের চিরন্তন নি’মাত।

উম্মতে নবীয়্যে আখেরিয যামানের সর্বজন মান্য সুন্নীয়তের কান্ডারী ওলামায়ে ইসলাম কর্তৃক গৃহীত ও বর্ণিত বহু হাদীস রয়েছে মিলাদ-কিয়ামের পক্ষে, যা দেওবন্দী হুজুরদের দৃষ্টিগোচর হয়না।

প্রিয় বিবেকবান ইসলামী ভাইয়েরা!

তাদের পেশকৃত তত্ত্ব-উপাত্ত ও উত্থাপিত আপত্তিগুলো তিন থেকে একুশ পর্যন্ত মূল কথাগুলো তুলে ধরেছি অতঃপর এসবের ময়না তদন্ত পেশ করব ইনশাআল্লাহ্।

তাদের বক্তব্য- ৩. প্রচলিত মিলাদ কিয়াম ‘ইজমা’ দ্বারা বিদ‘আত বলে প্রমাণিত। ৪. এটা কিয়াস দ্বারা ও বিদআত বলে প্রমাণিত। ৫. নবীজী প্রচলিত মিলাদ-কিয়াম করেননি, কাউকে করতে আদেশও দেননি, ৬. খেলাফতে রাশেদিনের যুগ ৩০ বছর। তাদের কেউ এটা করেন নি। ৭. সাহাবী যুগ ১১০ বছর কোন সাহাবী প্রচলিত মিলাদ ক্বিয়াম করেননি, ৮. তাবেয়ীনের যুগ ১৭০ বছর। ৯. তাবে তাবেয়ীনদের যুগ ২২০ পর্যন্ত। তাদের যুগেও প্রচলিত মিলাদ-কিয়াম হয়নি। ১০. চারজন মুজতাহিদীন তথা ইমামগণ কেউ প্রচলিত মিলাদ-কিয়াম করেননি। ১১. বড় বড় ওলীগণ প্রচলিত-মিলাদ কিয়াম করেননি, ১২. সিহাহ্ সিত্তাহ্সহ গ্রহণযোগ্য কোন হাদিসের কিতাবে প্রচলিত মিলাদ-কিয়াম নেই। ১৩. মক্কা-মদিনাসহ গোটা দুনিয়ার আলেমগণের মতে প্রচলিত মিলাদ-কিয়াম বিদআত এবং গর্হিত কাজ। ১৪. মিলাদ-কিয়াম অনুষ্ঠানে নবী হাজির-নাজির এবং নবী গায়ব জানেন বলে প্রচার করা হয়। এগুলো শির্কী কথা এবং গর্হিত, ১৫. মিলাদ মাহফিলে মিথ্যা-বানোয়াট ও জাল কেচ্ছা কাহিনী বলে, যা গর্হিত কাজ। ১৬. তাদের ভাষ্যমতে হানাফী ফকীহ্ আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী, ১৭. আল্লামা মুহাম্মদ শামী, ১৮. আল্লামা কাজী শিহাবুদ্দীন এবং ১৯. আল্লামা আহমদ ইবনে মুহাম্মদ মিসরীসহ সবাই প্রচলিত মিলাদ কিয়ামকে নিষেধ করেছেন, ২০. বিদআতিরা পেট পুজার জন্যে মিলাদ-কিয়াম করে, এ জন্যে মিথ্যা-বানোয়াট হাদিস বানিয়েছে, ২০. ইরাকের মসুল নামক শহরে মুযাফ্ফর উদ্দিন কাওকাবী নামক অপব্যয়ী ও মূর্খ বাদশাহর ছত্রছায়ায় প্রথম মিলাদ আবিস্কৃত হয় এবং ৭৫৫ হিজরে সালে ক্বিয়াম চালু হয়।

বিবেকবান সত্যান্বেষী ভাইয়েরা

এ পর্যন্ত তাদের উদ্ভাবিত ও উত্থাপিত তত্ত্ব উপাত্ত ও আপত্তিগুলো মোটামুটিভাবে জানতে পারলেন।

সচেতন ভাইয়েরা লক্ষ্য করেছেন এরা প্রতিটি বক্তব্যে একটি উক্তিই আওড়াচ্ছে মানে ‘প্রচলিত মিলাদ কিয়াম’, অথচ আমাদের বক্তব্য হচ্ছে মৌলিক দিক থেকেও মিলাদ-কিয়াম সন্দেহতাতীতভাবে বৈধ ও পুণ্যময় এবাদত। দেখুন, এরা একদিকে বলছে ‘প্রচলিত মিলাদ-কিয়াম’ হিজরি ৬০৪-৭৫৫ এর মাঝে শুরু হয়েছে। আবার বলছে এ পদ্ধতিতে মিলাদ-কিয়াম রসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম করেননি। সাহাবীগণ করেননি, তাবেয়ী, তাব-ই তাবেয়ীরা করেননি। প্রসিদ্ধ চার মাযহাবের ইমামগণ করেননি, ছয়টি বিশুদ্ধ হাদীসের কিতাবের ইমামগণসহ প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসগণ প্রচলিত মিলাদ-কিয়াম করেননি। হযরত সুফিয়ান সওরী, হাসান বসরী, বায়েজীদ বোস্তামী, যুন্নুন মিসরী প্রমুখ অলিগণ প্রচলিত মিলাদ-কিয়াম করেননি।

এ বর্ণচোর ধোঁকাবাজদের জিজ্ঞেস করুন না, ‘মিলাদ-কিয়াম’ এর যে নিয়মটা পরে চালু হল তা পূর্ববর্তীদের মাঝে তালাশ করা প্রতারণা নয় কি? যৌক্তিক প্রশ্ন এটাই হতে পারত যে, পূর্ববর্তীগণ যে নিয়মে করেছেন পরবর্তীগণ নতুন কোন নিয়মে তা পালন করলে শরীয়তের দৃষ্টিতে তা বৈধ হচ্ছে কিনা? এ সোজা কথাটি না বলে অনর্থক পেঁছিয়ে কথা বলা; সাহাবা, তাবেয়ী, তাবে তাবেয়ী ও ইমাম মুজতাহিদগণ কি আশেকে রসূল ছিলেন না? তারা কেন ‘প্রচলিত মিলাদ কিয়াম করেননি? দেওবন্দী মুফতি কিন্তু এটা বলতে পারেননি যে, উনারা নবীজির মিলাদ-ই পালন করেননি। কিভাবে বলবেন? যেখানে বুখারী, মুসলিম, বায়হাকীসহ ওলামায়ে ইসলামের অকাট্য উদ্ধৃতি রয়েছে যে, স্বয়ং সাহেবে মিলাদ শাফীউল মুযনিবীন ফী ইয়াউমিত্তানাদ আলায়হি আফজালুচ্ছালাত ওয়াত্তাসলীমাত নিজেই নিজের মিলাদ পালন করেছেন।

শায়খ সাইয়্যেদ মুহাম্মদ ইবনে আলভী মালেকী আলায়হির রহমাহ্ ‘আল-এলাম’ গ্রন্থে ২২নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘মাহফিলে মিলাদ’ উদযাপনের জন্যে সুনির্দিষ্ট কোন নিয়ম বা পদ্ধতি নেই, যা মানতে হবে কিংবা মানাতে হবে। বরং প্রত্যেক এমন কার্যাদি অবলম্বন করা, যাদ্বারা মানুষ ইহ পরকালীন সর্বাঙ্গিন হেদায়ত ও কল্যাণের দিকে ধাবিত হয়, মিলাদুন্নবীর বাস্তব উদ্দেশ্য সাধিত হবে।

সুপ্রিয় মুমিন-মুসলমান ভাইয়েরা!

দেওবন্দী মুফতারী ফাতির সাহেবান তো লিখেছেন ইরাকের মসূলে খ্রিস্টানদের দেখাদেখি মুযাফ্ফর উদ্দীন কাওকাবি নামক অপব্যয়ী মূর্খ বাদশাহর ছত্রছায়ায় প্রচলিত মিলাদের সূচনা হয়। (লা’নাতুল্লাহি আলাল কাযেবীন- মিথ্যাবাদীদের উপর আল্লাহর লা’নত হোক)

শায়খ সৈয়দ আলাভী আলায়হির রাহমাহ্ আল-ইলাম কিতাবে ৩০ ও ৩১ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন, মিলাদ বিরোধীরা সর্ব সাধারণ মুসলমানদের নিকট সত্য গোপন করায় তাদের চিরায়ত অভ্যাস অনুযায়ী বাতিল মতাদর্শ প্রচারের জন্যে আল্লামা হাফেয ইবনে কসীর এর উপর এক মিথ্যে অপবাদ দিয়েছে। তাদের ভাষায় ‘বিদায়া নিহায়া’ কিতাবে ১১ খন্ড ১৭২ পৃষ্ঠায় রয়েছে, ওবায়দুল্লাহ ইবনে মায়মূন আলকাদ্দাহ্ ইহুদীর বংশধর ফাতেমিয়া ওবায়দিয়া গোষ্ঠির বাদশাহরা তাদের মিশরীয় শাসনামলে (৩৫৭-৫৬৭) নানা ধরনের উৎসবের উদ্ভাবন করে। মিলাদুন্নবী উৎসবও এসবের একটি।

শায়খ আলাভী আলায়হির রাহমাহ্ বলেন, এটা তাদের এক জঘন্যতম মিথ্যাচার, অপবাদ, সত্যকে জেনে শুনে গোপন করা এবং ওলামায়ে উম্মতের বক্তব্যের খিয়ানত। বাস্তবে আল্লামা ইবনে কসীর ‘বিদায়া নিহায়া’ গ্রন্থে ১৩নং খন্ড পৃ. ১৩৬ লিখেছেন-

‘বাদশাহ মুযাফ্ফর আবু সাঈদ আল কূকুবরি বড় দানশীল, মহান নেতৃত্বদানকারী ও বুযর্গ বাদশাগণের অন্যতম। যার জীবনের অনেক সুকীর্তী রয়েছে, তিনি রবিউল আউয়াল মাসে বিশাল আকারে মিলাদুন্নবী মাহফিল আয়োজন করতেন। এতদ্ভিন্ন তিনি বড় বাহাদুর, সাহসী, বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান, জ্ঞানী এবং ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ্ ছিলেন। তিনি মিলাদ মাহফিলে তিন লক্ষ দীনার খরচ করতেন।

এছাড়া আল্লামা আল হাফিজ যাহাবী রহমাতুল্লাহি আলায়হি তার প্রণীত কিতাব ‘সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ২২নম্বর খন্ড ৩৩৬ নং পৃষ্ঠায় বাদশাহ্ মুযাফ্ফর সম্পর্কে লিখেছেন كَانَ مُتَوَاضِعًا خَيِّرًا سُنِّيًا يُحِبُّ الْفُقَهَاء وَالْمُحَدِّثِيْنَ অর্থাৎ তিনি বড় বিন¤্র চরিত্রের বুযুর্গ সুন্নী আক্বীদায় বিশ্বাসী বাদশাহ্ ছিলেন।

ইমাম আল্লামা সাইয়্যেদ আহমদ ইবনে আবদিল গণী বিন ওমর বিন আবেদীন আল্লামা ইবনে হাজর হায়তামীর কিতাবের ব্যাখ্যাগ্রন্থ নসরুদ্দুরার আল মাওলিদি ইবনে হাজর এ লিখেছেন ‘জেনে রেখ, নিশ্চয় প্রশংসিত নব আবিস্কৃত বিষয়াদির অন্যতম হচ্ছে প্রিয়তম রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের বেলাদতে পাকের মাস রবিউল আউয়াল শরীফে মাহফিলে মিলাদ শরীফের ঝাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন। এ মাহফিল সর্বপ্রথম যিনি আরম্ভ করেন তিনি ইরবিল-এর বাদশাহ্ মুযাফ্ফর। আল্লামা ইবনে কাসীর তারীখে ইবনে কাসীরে লিখেছেন, বাদশাহ্ মুযাফ্ফর রবিউল আউয়াল মাসে মাওলেদুন্নবী উপলক্ষে আজীমুশ্ শান মাহফিল করতেন। তিনি বড় বাহাদুর সাহসী বীর পুরুষ, জ্ঞানী ও ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ্ ছিলেন। হিজরী ৬৩০ সালে ইন্তেকাল করেন। তিনি প্রশংসিত চরিত্র ও মানসিকতার লোক ছিলেন।

আল্লামা ইবনুল জাওযীর নাতী তদীয় গ্রন্থ ‘মির আতুয্যালাল এ, ইমাম সুয়ূতীর ছাত্র আল্লামা শায়খ মুহাম্মদ শামী তাঁর সীরাত গ্রন্থে, আল্লামা যুরকানী শরহুল মাওয়াহেব’ কিতাবে, আল্লামা ইব্রাহীম হালাবী হানাফীরাহুস্ সিয়ার নামক কিতাবে লিখেছেন, বাদশাহ্ মুযাফ্ফর এর আয়োজিত এ সুবিশাল মাহফিলে প্রায় পাঁচ হাজার ছাগল, দশ হাজার মুরগী, ত্রিশ হাজারের মত হালুয়ার বাটি, প্রায় একলক্ষ বাটি ফিরনীর ব্যবস্থা হতো। ওলামা সুফিরা যারা উপস্থিত হতেন, তাঁদেরকে প্রচুর হাদিয়া তোহফা দিতেন। এভাবে তিনি প্রতি বছর ৩ লক্ষ দীনার খরচ করতেন।

বিবেকবানরা চিন্তা করুন একজন নবীপ্রেমিক ন্যায়ের প্রতীক ব্যক্তির ব্যাপারে এসব করনুশ শয়তান দেওর বান্দারা অপব্যয়ী, মূর্খ বাদশাহ্ ইত্যাকার কেমন কেমন নোংরা শব্দ ব্যবহার করছে। বাস্তবে এটা তাদেরই কালো মন আর বিকৃত মানসিকতার পরিচয়।

বর্তমান মক্কা-মদীনা কাদের দ্বারা শাসিত হচ্ছে সচেতন মুসলিম সমাজ ভাল করেই জানেন। গায়বের সংবাদদাতা প্রিয়তম নবীর ভবিষ্যতবাণী (নজদে থেকে ফিৎনা, যালযালা আর করনুশ শয়তান বের হবে) অনুযায়ী হিজরি দ্বাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে খারেজীয়্যাতের প্রেতাত্মা মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাবের নেতৃত্বে তথাকথিত সংস্কার আন্দোলনের নামে যে ফিৎনা আরম্ভ হয়েছিল তার ধারাবাহিকতা এখনো বিদ্যমান। এরা তাদের পেট্রোডলার আর ইঙ্গমার্কিনীদের সহায়তায় নিজেদের ভ্রান্ত মতবাদ মুসলিম বিশ্বের দিকবিদিক ছড়িয়ে দেয়। ফলশ্রুতিতে এটা ভারতবর্ষে আমদানী হয়ে ‘দেওবন্দ’কে দ্বিতীয় মারকায বানাতে সক্ষম হয়। এভাবে প্রিয় নবীর বাণী ‘করনুশ শয়তান’ তাঁরই মু’জিযা অনুযায়ী ‘দেওবন্দ’ এর সাথে মিলে যায়। কারণ করনুশ শয়তান আর দেওবন্দ উভয় শব্দের অর্থ শয়তানের দল।

অতএব, বর্তমান মক্কা-মদীনার নজদী ওলামা কিংবা তাদেরই অর্থে পুষ্ট মৌলভীদের কাছে মিলাদ-কিয়ামের সমর্থন আশা করা মানে ব্রাহ্মণের কাছে আযান-ইকামতের আশা করা। মজার কথা হচ্ছে এ দেওবন্দীরাই ১৩২৫ হিজরি সালে তৎকালীন মক্কা-মদীনার ওলামায়ে আহলে সুন্নাহর দরবার থেকে মিথ্যাচার আর ধোঁকাবাজীর মাধ্যমে মিলাদ-কিয়াম, যিয়ারত-ইসালে সাওয়াব ইত্যাদির সমর্থন ব্যক্ত করে সুন্নী হওয়ার সনদ নেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল। যা এসব দেওবন্দীদেরই মুরব্বী খলীল আহমদ সাহারানপুরী আম্বিঠবী সাহেব ‘আল মুহান্নাদ আলাল মুফান্নাদ’ তথা আক্বায়েদে ওলামায়ে দেওবন্দ’ নামে পুস্তিকায় প্রকাশ করে উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতারিত করার অপচেষ্টা করেছে।

‘নবীজী হাজির নাযির’ আর ‘নবীজি গায়ব জানেন’ এসব কথা বলার জন্যে মিলাদ-কিয়ামের অনুষ্ঠান লাগেনা। যারা মানে তারা যে কোন দ্বীনী আলাপচারিতায় এসব আলোচনা করে থাকে। এগুলো আলোচনা না করলেও মিলাদ মাহফিল হয়। বাস্তবে হাজির নাযির আর গায়ব জানা নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ পাকের স্বত্ত্বাগত গুণ। তবে এ সব গুণাবলী যে আল্লাহ্ তাঁর প্রিয়তম বান্দাদের বিশেষ করে হাবীবে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে দান করেছেন তা পবিত্র ক্বোরআন সুন্নাহ ইজমা-ক্বিয়াস দ্বারা অকাট্য রূপে দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট ও প্রমাণিত। মহান আল্লাহর সত্ত্বায় একমাত্র অবিচ্ছিন্ন সিফত (গুণ) হচ্ছে গেনা-এ জাতী’ অর্থাৎ অমুখাপেক্ষীতা মানে স্বয়¤ু¢ হওয়া। وَاللهُ غَنِيُّ عَنِ الْعَلمِيْنَ অর্থাৎ আল্লাহ্ সমগ্র বিশ্বের প্রতি বে-পরোয়া।

শরতকালের মেঘমুক্ত আকাশে চৌদ্দ তারিখের চাঁদটি যেমন, তার চাইতেও স্পষ্ট ও উজ্জ্বল ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনের বিষয়টি। এর জন্য মিথ্যা-বানোয়াট তথা জাল দলিলের প্রয়োজন হবে কেন?

সুন্নী আলেমরা নাকি পেটপুজার জন্য মিলাদ-কিয়াম করে থাকে। (নাউযুবিল্লাহ্) বাস্তবে খুঁদ পিপাসা তো আল্লাহ্ সবাইকে দিয়েছেন। কেউ সততার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে কেউবা মুনাফেকী আর শঠতা কপটতার পথ অবলম্বন করে। এ পর্যন্ত কোন সুন্নী আলেম ওহাবী-দেওবন্দী মসজিদে গিয়ে তাদের সেজে কাজ করেছে প্রমাণ নেই। কিন্তু এ দেওবন্দীরাই মুনাফেক সুন্নী সেজে সুন্নী পাড়া মহাল্লায় ইমাম, মুয়াজ্জিন হিসেবে আশ্রয় নেয়। মা-মাসী, চাচা-খুরা, ডেকে মিলাদ-কিয়াম, ওরস, ফাতিহা, যিয়ারত, মান্নত কিছুই বাদ দেয় না।

আল্লাহ্ পাক এসব মুনাফিকের মুখোশ উন্মোচন করতে গিয়ে এরশাদ ফরমাচ্ছেন-

وَإِذَا لَقُوا الَّذِينَ آمَنُوا قَالُوا آمَنَّا وَإِذَا خَلَوْا إِلَىٰ شَيَاطِينِهِمْ قَالُوا إِنَّا مَعَكُمْ إِنَّمَا نَحْنُ مُسْتَهْزِئُونَ (১৪)

অর্থাৎ মুনাফিকরা মুমিনদের (সুন্নীদের সাক্ষাতে বলে আমরা মুমিন (সুন্নী), আবার তাদের শয়তান দের (মুরব্বীদের) সামনে গিয়ে বলে আমরাতো তোমাদেরই সাথে আছি। আল্লাহ্ এসব মুনাফিক দেওবন্দী ওহাবীদের প্রতারণা থেকে মুমিন মুসলমান (সুন্নী) দের হেফাজত করুন। আমিন। (চলবে)

লেখক- মুহাদ্দিস, জামেয়া আহমদিয়া সুুন্নিয়া আলিয়া, চট্টগ্রাম।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment