মাহবুবে খোদা আল্লাহর প্রথম সৃষ্টি নূর।
আল্লাহর হাবিব সৃষ্টি নূর এবং তাঁর নূর দ্বারা আল্লাহপাক কুল কায়েনাত সৃষ্টি করেছেন।
একাদশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ আল্লামা শেখ আব্দুল হক মোহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত তদীয় مدارج النبوة ‘মাদারিজুন নবুয়ত’ নামক কিতাবের ২/২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন-
بدانکہ اول مخلوقات وواسطۂ صدور کائنات وواسطۂ خلق عالم وآدم نور محمدست صلی اللہ علیہ وسلم- چنانکہ درحدیث صحیح وارد شدہ کہ اول ما خلق اللہ نوری وسائرمکونات علوی وسفلی ازان نور وازان جوھر پاک پیدا شدہ ازارواح واشباح وعرش وکرسی ولوح وقلم وبہشت ودوزخ وملک وفلک وانس وجن وآسمان وزمین وبحار وجبال واشجار وسائر مخلوقات ودرکیفیت صدور این کثرت ازان وحدت وبروز وظھور مخلوقات ازان جوھر عبارات وتغيرات غريب آوردہ اند وحدیث اول ما خلق اللہ العقل نزد محققین ومحدثین بصحت نرسیدہ وحدیث اول ما خلق اللہ القلم نیزگفتہ اند کہ مراد بعد العرش والماءاست کہ واقع شدہ است وکان عرشہ علی الماء الخ-
ভাবার্থ: এ এক চিরন্তন বাস্তবতা যে, নূরে মোহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হচ্ছেন সমগ্র সৃষ্টির প্রথম, সমস্ত কায়েনাতের ওসিলা, বিশ্বজগৎ এবং হযরত আদম আলাইহিস সালাম এর সৃষ্টির মাধ্যম হচ্ছে নূরে মোহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সহিহ হাদিস শরীফে এসেছে, রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন- اول ما خلق الله نورى ‘আউয়ালু মা খালাকাল্লাহু নুরী’ অর্থাৎ আল্লাহতা’য়ালা সমস্ত মাখলুক সৃষ্টির পূর্বে আমার নূর মোবারক সৃষ্টি করেছেন এবং ঊর্ধ্ব ও অধঃজগতের সবকিছুই নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এঁর নূর মোবারক থেকে সৃষ্ট। তাঁর পবিত্র নূরী জাওহার থেকে সৃষ্টি হয়েছে রূহসমূহ, আরশ, কুরসি, লওহ, কলম, বেহেশত, দোযখ, ফেরেশতা, ইনসান, জিন, আসমান, জমিন, সাগর, পাহাড়, গাছ, বৃক্ষ এবং কুল মাখলুকাত। এ সকল কিছুর প্রকাশ ও বিকাশ ঘটেছে তাঁরই ওসিলায়। সেই হাকিকতের প্রকাশের বর্ণনায় বিজ্ঞ বিজ্ঞ আলেমগণ বিস্ময়কর ও সূক্ষ্ম বর্ণনা পেশ করেছেন।’
এক রেওয়ায়েতে এসেছে-اول ما خلق الله العقل ‘আউয়ালু মা খালাকাল্লাহুল আকলু’ আল্লাহতা’য়ালা সর্বপ্রথম আকল সৃষ্টি করেছেন। তবে এই হাদিস মুহাক্কিক ও মুহাদ্দিসগণের মতে সহিহ এর স্তরে পৌছেনি। অন্য রেওয়ায়েতে রয়েছে- اول ما خلق الله القلم ‘আউয়ালু মা খালাকাল্লাহু কলম’ সর্বপ্রথম আল্লাহতা’য়ালা কলম সৃষ্টি করেছেন। এ হাদিসটির অর্থ মুহাদ্দিসগণ এভাবে করেছেন যে, আরশ ও পানি সৃষ্টির পরে প্রথমে কলম সৃষ্টি করেছেন। আবার কোন কোন হাদিসের ব্যাখ্যায় এ রকম এসেছে যে, পানি সৃষ্টি হয়েছিল আরশের পূর্বে وكان عرشه على الماء
এর পরপরই আল্লামা শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত বলেন- হাদিস শরীফে এসেছে, যখন কলম সৃষ্টির পর আল্লাহতা’য়ালা তাকে বললেন লেখ, তখন কলম বললো, কি লেখবো? আল্লাহতা’য়ালা বললেন- ما كان وما يكون الى الابد ‘মা কানা ওয়ামা ইয়াকুনু ইলাল আবাদ’ অতীত এবং ভবিষ্যতের সবকিছু লিখ।
এতে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল যে, কলম সৃষ্টির পূর্বেও কিছু সৃষ্টি হয়ে ছিল। আলেমগণ বলেন- আরশ, কুরসি এবং রূহসমূহ সৃষ্টির পূর্বে নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নূর মোবারক প্রকাশ্য জগতে এসেছে। ما كان ‘মা কানা’ যা কিছু হয়েছিল এ অর্থই বহন করে। তাহল নূরে মুহাম্মদীর হাল ও সিফাতসমূহ। কেননা সমগ্র জগতের মধ্যে নূরে মুহাম্মদী অগ্রগণ্যতা সুসাব্যস্ত اول ما خلق الله نورى অপরদিকে وما يكون ‘ওমা ইয়াকুনু’ এর অর্থ হলো পৃথিবীর পরবর্তীতে প্রকাশিতব্য সকল কিছু। আলমে জহুর বা বাহ্যিকজগতে রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়ত প্রমাণিত ছিল। যেমন আল্লাহর হাবিব বলেছেন- كنت نبيا وادم بين الروح والجسد অর্থ- আমি ঐ সময়ও নবী ছিলাম, যখন আদম আলাইহিস সালাম আত্মা ও দেহের মাঝামাঝিতে ছিলেন।
[সূত্রঃ মাদারিজুন নবুয়ত; ২-৩ পৃষ্ঠা।]
আল্লামা শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত হাদিসের মাধ্যমে উল্লেখ করেছেন-
ودر اخبار آمدہ است کہ چون مخلوق شد نور انحضرت وبیرون آمدازوی انوار انبیاء علیہم السلام امرکرد اورا پروردگار تعالی کہ نظر کند بجانب انوار ایشان پس نظر کرد آنحضرت وپوشید انوار ایشاں را گفتندای پروردگار ما این کیست کہ پوشید نوروی انوار ما را گفت اللہ تعالی این نور محمد بن عبد اللہ است اگر ایمان آرید بوے میگرادنم شمارا انبیاء گفتند ایمان آوردیم یارب بوے وبہ نبوت وی پس گفت رب العزت جل جلالہ گواہ شدم برشمادانیست معنی قول حق سبحانہ تعالی واذا اخذ اللہ میثاق النبیین لما اتیتکم من کتاب رحکمۃ الایۃ- مدارج النبوۃ ص ۳/ ۲
ভাবার্থ: ‘হাদিসশরীফে এসেছে, যখন নূরে মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সৃষ্টি করা হলো এবং তাঁর নূর থেকে (আল্লাহর হাবিবের নূর থেকে) সকল নবীগণ আলাইহিমুস সালাম এর নূরসমূহ বের করা হল, তখন আল্লাহতায়ালা নূরে মোস্তফা আলাইহিস সালামকে বললেন, ঐ নূরসমূহের প্রতি দৃষ্টিপাত কর। তিনি তাই করলেন। ফলে তাঁর নূরে সকল নূরের উপর প্রধান্য বিস্তার করল এবং অন্যান্য নূর হয়ে গেল আলোকবিহীন। তাঁরা নিবেদন করল, হে পরওয়ার দিগারে আলম! তা কার নূর যা আমাদের সকলের নূরকে ম্লান করে দিল? আল্লাহতা’য়ালা ইরশাদ করলেন- এ নূর মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহর। তোমরা যদি তাঁর উপর ঈমান আন তবে আমি তোমাদেরকে নবী বানাবো। সকলেই সমস্বরে বলল, হে আমাদের রব! আমরা তাঁর উপর ও তাঁর নবুয়তের উপর ঈমান আনলাম। আল্লাহতা’য়ালা বলেন- আমি তোমাদের এ কথার স্বাক্ষী রইলাম। এদিকে ইঙ্গিত করেই কোরআন মজীদের এক আয়াতে কারীমায় বলা হয়েছে-
واذ اخذ الله ميثاق النبيين لما اتيتكم من كتاب و حكمة الخ
অর্থাৎ আল্লাহ যখন নবীগণের নিকট থেকে এই মর্মে অঙ্গীকার গ্রহণ করলেন যে, আমি তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত দান করব।
[সূত্রঃ মাদারিজুন নবুয়ত, ২-৩ পৃষ্ঠা।]
তাফসিরে রুহুল মায়ানী ৩য় জিল্দ ৮ পারা ৭১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-
(وانا اول المسلمين ۱٦۳) وقيل: هذا اشارة الى قوله عليه الصلوة والسلام- اول ما خلق الله تعالى نورى-
অর্থাৎ আলোচ্য আয়াতে কারীমার তাফসিরে রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী- اول ما خلق الله نورى সর্বপ্রথম আল্লাহতা’য়ালা আমার নূর সৃষ্টি করেছেন। এ দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
تفسير روح البيان ‘
তাফসিরে রুহুল বয়ান’ ৩য় জিলদের সূরায়ে আনআম ১২৯ পৃষ্ঠায় আশ শায়খ ইসমাঈল হক্কী বরছয়ী আলাইহির রহমত (ওফাত ১১৩৭ হিজরি)
(وانا اول المسلمين) يعنى اول من استسلك عند الايجاد لامركن وعند قبول فيض المحبة لقوله (يحبهم ويحبونه) والاستلام للمحبة فى قوله يحبونه دل عليه قوله عليه السلام (اول ما خلق الله نورى)
অর্থাৎ وانا اول المسملين আমি সর্বপ্রথম মুসলমান এর অর্থ হলো সর্বপ্রথম সৃষ্টি করার সময় আল্লাহতা’য়ালার আদেশ كن ‘কুন’ হয়ে যায়কে আমি সর্বপ্রথম মেনে নিয়েছি। অনুরূপভাবে মহব্বতের ফয়েজ গ্রহণ করার সময় আমি সর্বপ্রথম গ্রহণ করেছি। কারণ আল্লাহতা’য়ালা এরশাদ করেন- তিনি তাদের মহব্বত করেন। আর তাঁরা আল্লাহকে মহব্বত করেন। এ মহব্বতে ফয়েজ গ্রহণের বেলায় নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথম, যা তাঁর বাণী ‘আল্লাহ তা’য়ালা আমার নূরকে সর্বপ্রথম সৃষ্টি করেছেন প্রমাণ করছে।
শেখ আব্দুল হক মোহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত বলেন-
فضيلت اعلی واکمال وی صلی اللہ علیہ وسلم وآلہ وسلم آنست کہ پرور دگار تعالی روح اورا پیشتر ازارواح خلائق پیدا کردہ وارواح سائر مکونات را از روح وے منشعب گردایندہ ہمہ را از نوروی آفریدہ ووی صلی اللہ علیہ وسلم وآلہ وسلم نبی بودہ وآدم ھنوزمیاں روح وجسد بود کما رواہ الترمذی عن ابیھریرۃ رضی اللہ عنہ ودر عالم ارواح نیز فیض بارواح انبیاء از روح او رسیدہ، (مدارج النبوت جلد ۱ ص ۱٤۳)
ভাবার্থ: নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সবচেয়ে উন্নত ও পরিপূর্ণ মর্যাদা হল এই যে, আল্লাহতা’য়ালা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রূহ মোবারককে অন্যান্য সকল রূহ মোবারকের পূর্বে সৃষ্টি করেছেন। তারপর আল্লাহর হাবিবের রূহ মোবারক হতে সমস্ত রূহ সৃষ্টি করেছেন। হযরত আদম আলাইহিস সালাম রূহ ও জসদ বা শরিরাকৃতির মধ্যে থাকা অবস্থায় রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবী ছিলেন। যেমন তিরমিজি শরীফে হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণনা করা হয়েছে। অপরদিকে আলমে আরওয়াহ বা রূহের জগতে এমনকি সমস্ত নবীগণের রূহ মোবারকগণ ও সায়্যিদে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রূহ মোবারক হতে পূর্ণ ফয়েজ ও বরকত প্রাপ্ত হয়েছেন।
শাহ ওলি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত তদীয় ‘ইনতেবাহ ফি সালাসিলিল আউলিয়া আল্লাহ’ নামক কিতাবের ৮২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
نور اول کہ آں نور محمدی ست صلی اللہ علیہ وسلم ونیز آں را شھود اول می گویند-
অর্থাৎ নূরে মুহাম্মদী সর্বপ্রথম সৃষ্টি। এজন্য তিনিই সর্বপ্রথম আল্লাহর একত্বের স্বাক্ষ্য প্রদান করেছিলেন।
মুল্লা আলী ক্বারী আলাইহির রহমত مرقاة شرح مشكوة ‘মিরকাত শরহে মিশকাত’ নামক কিতাবের ১ম জিলদের ১৩৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
ان اول شئ خلق الله القلم وهو غير صحيح … فا الاولية اضافيه والاول الحقيقى هو النور المحمدى على ما بينته فى المورد للمولد-
অর্থাৎ নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করেছেন। আর সেটা হচ্ছে গায়রে সহিহ বা অশুদ্ধ। অতএব আউয়ালিয়তে এজাফি বা প্রথম। আর আউয়ালিয়তে হাকিকী প্রকৃত অর্থে সর্বপ্রথম সৃষ্টি হচ্ছে নূরে মুহাম্মদী।
________________
প্রিয় নবী করিম (صلى الله عليه و آله و سلم) এঁর শা’নে রচিত নিচের কিতাবটি ডাউনলোড করে সকলকে পড়ার অনুরোধ রইল।
কিতাবঃ নশরুত্তীব – Nashrut Tib
মূলঃ উলামায়ে দেওবন্দের পেশওয়া মাওলানা আশরাফ আলী থানবী।
অনুবাদঃ বাংলাদেশ উলামায়ে দেওবন্দের সুপরিচিত খতীব, ইসলামী গবেষক ও তাফসীরে নূরুল ক্বুরআন এঁর রচয়িতা হযরত মাওলানা আমিনুল ইসলাম (রঃ)।
[নবী (সঃ) – এর জীবনী]