মাযার যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

মাযার যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর
মুহাম্মদ বুরহান উদ্দিন (রাববানী)

কবর বা মাযার যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করা জায়েয ও সুন্নাত। কবর বা মাযার বলতে আমরা বুঝি- মৃত্যুর পর থেকে কিয়ামত পর্যমত্ম মৃত দেহের অবস্থান স্থলকে আরবী ভাষায় কবর (قبر) বলা হয়। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় মুসলমানদের উক্ত অবস্থান স্থলকে সাধারণভাবে ‘‘কবর’’ বলা হয়। আল্লাহর অলি ও বুযুর্গানের কবরকে, ফার্সী ভাষায় ‘‘মাযার’’ বা দরগাহ বলা হয়। আর নবী ও রাসূলদের কবরকে ‘‘রওযা’’ বলা হয়। আউলিয়ায়ে কেরামের মাযার শরীফ যিয়ারতের উদ্দেশ্য সফর করা শরীয়ত মতে জায়েজ এবং সওয়াবের কাজ। বাতিলপন্থী ইবনে তাইমিয়া (৭২৭ হিজরী) সর্বপ্রথম মাযার যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করাকে হারাম এবং শির্ক বলে জোরের সাথে ঘোষণা করেছে। এর পূর্বে ইবনে হাযম ব্যতিত আর কেউ এমন কথা বলেনি। ইবনে তাইমিয়া নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার রওযা মোবারকের যিয়ারত করার উদ্দেশ্যে সফর করাকেও শির্ক বলে অভিহিত করছে। সে ছিল খারেযী সম্প্রদায়ভূক্ত নবীজীর যামানায় ‘যুল খোয়াইছরা’ জনৈক মুনাফিকের বংশে তার জন্ম। তার অনুসারী নজদের মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব নজদী ও ভারতের ইসমাঈল দেহলভী এবং তাদের অনুসারীগণ যিয়ারতের উদ্দেশ্য সফর করাকে হারাম বলে মনে করে। এরা ভ্রামত্ম ও গোমরাহ। (জাওয়াহিরুল বিহার, ওহাবী মাযহাব ইত্যাদি)। ২০০৩ সালের হজ্ব নির্দেশিকা তার উজ্বল প্রমাণ-যা জোট সরকারের শরীক দল জামাত ওহাবীরা লিখেছে- উক্ত নির্দেশিকায় রওযা যিয়ারতের নিয়ত করাকে শির্ক বলা হয়েছে। সফরের উদ্দেশ্য ও উপলক্ষ মোতাবেক সফরের হুকুম হয়ে থাকে। অর্থাৎ-
ক) উপলক্ষ যদি ফরয হয়, তবে এর জন্য সফর করাও ফরয। যেমন- হজ্বের জন্য সফর করাও ফরয।
খ) উপলক্ষ যদি ওয়াজিব হয়, তাহলে এর জন্য সফর করাও ওয়াজিব। যেমন- মান্নতের হজ্জ আদায় করা ওয়াজিব। সুতরাং এর জন্য সফর করাও ওয়াজিব।
গ) উপলক্ষ যদি সুন্নাত হয়, তাহলে তার জন্য সফর করাও সুন্নাত। যেমন- যিয়ারত করা সুন্নাত কাজ। সুতরাং এর জন্য সফর করাও সুন্নাত।
ঘ) মোবাহ বা জায়েজ কাজের জন্য সফর করাও মোবাহ এবং জায়েজ। যেমন- ব্যবসা-বানিজ্য ও বন্ধু-বান্ধবের সাথে সাক্ষাতের জন্য সফর করা।
ঙ)উপলক্ষ যদি হারাম ও নাজায়েয হয়, তাহলে এর জন্য সফর করাও হারাম ও নাজায়েয হবে। যেমন- চুরি-ডাকাতি করার জন্য সফর করাও হারাম।
উপরিউক্ত নীতিমালা অনুযায়ী উরস শরীফের জন্য সফর করা সুন্নাত। কেননা, যিয়ারতের উদ্দেশ্যেই উরস শরীফের সফর করা হয়ে থাকে।
পবিত্র কোরআন মাজীদে বিভিন্ন সফরের কথা রয়েছে। যেমন-
ক) হিজরতের উদ্দেশ্যে সফর। (সূরা নিসা, আয়াত ১০০)
খ) ব্যবসা সংক্রামত্ম সফর। (সূরা কুরাইশ, আয়াত ০২)
গ) পীর মাশায়েখের সাথে মোলাকাতের উদ্দেশ্যে সফর করা। যেমন- হযরত খিযির (আ:) এর অনুসন্ধানে হযরত মুছা (আ:) এর সফর। (সূরা কাহাফ, আয়াত-৬০)
ঘ) প্রিয়জনের অনুসন্ধানে সফর। যেমন- ইউসুফ (আ:)-এর অনুসন্ধানে তাঁর পিতা কর্তৃক ছেলেদের সফরে প্রেরণ। (সূরা ইউসুফ, আয়াত-৮৭)
ঙ) চিকিৎসার জন্য সফর। যেমন- হযরত ইউসুফ (আ:) এর জামা নিয়ে মিশর থেকে অন্যান্য ভাইয়ের কেনান সফর। (সূরা ইউসুফ, আয়াত-৯৩)
চ) রুযী-রোযগারের জন্য সফর। যেমন- খাদ্য সংগ্রহের জন্য ইয়াকুব (আ:) কর্তৃক ছেলেদের মিশর সফরে প্রেরণ। (সূরা ইউসুফ, আয়াত-৬৩)
ছ) কাফেরদের নিকট ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে সফর। যেমন- ফেরআউনের নিকট হযরত মুছা (আ:) এর সফর। (সূরা নাযিয়াত, আয়াত-১৭)
জ) ছেলে-মেয়েদের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে সফর। যেমন- হযরত ইউসুফ (আ:) এর পিতা-মাতা তাঁর সাথে দেখা করার জন্য সফর করেছিলেন। (সূরা ইউসুফ, আয়াত- ৬৯)
ঝ) হিদায়াত গ্রহণের লক্ষে গযব প্রাপ্ত এলাকার সফর। যেমন- তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমন কর এবং কাফিরদের কি পরিণাম হয়েছে, তা দেখ!) (সূরা আনআম, আয়াত-১১) যেসব দেশে খোদায়ী গযব নাযিল হয়েছে, এগুলো দেখে সতর্ক হওয়ার জন্য সফর প্রমাণিত হলো। পবিত্র হাদিস শরীফে সফরের কথা রয়েছে। যেমন-
ঞ) যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জনের জন্য বের হলো সে আল্লাহর পথে রয়েছে। এখানে সফরের কথা বলা হয়েছে। (মিশকাত শরীফ, ৩৪ পৃষ্ঠা)
ট) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলাম প্রচারের জন্য হযরত মুয়ায বিন জাবাল (রা:) কে ইয়েমেনে পাঠিয়েছেন। এখানেও সফরের কথা প্রমাণিত হলো। (মিশকাত শরীফ ১৫৫ পৃষ্ঠা)
সুতরাং স্বয়ং কোরআন ও হাদিস শরীফ দ্বারা উপরিউক্ত সফরগুলো যখন প্রমাণিত হলো, তাহলে আউলিয়ে কিরামের মাযার যিয়ারত উপলক্ষে সফর এমনিতেই প্রমাণিত বলে ধরে নেয়া যায়। আউলিয়ায়ে কিরাম হলেন, রূহানী ডাক্তার। ওনাদের মাযারে গেলে খোদার শান চোখের সামনে ভেসে উঠে। এর দ্বারা ইবাদতের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়। আর ওনাদের মাযার সমূহে দু’আ অতি সহসা কবুল হয়।

দলিল নং ০১ঃ
দুনিয়ার সমসত্ম মাযারের মধ্যে উত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ মাযার হচ্ছে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রওযা মোবারক। রওযা মোবারকের যিয়ারত ও যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করা সুন্নাত ও ওয়াজিব। এ কাজের বিনিময়ে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শাফায়াত অবধারিত। কেননা মহান আল্লাহ বলেন-
ولو انهم اذ ظلموا انفسهم جاءوك فاستغفروا الله واستغفر لهم الرسول لوجدوا الله توابا رحيما-
যদি তারা নিজেদের আত্মার উপর (গুনাহ করার মাধ্যমে) কখনো জুলুম বা অত্যাচার করে, তখন তারা হে আমার প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আপনার দরবারে উপস্থিত হয় এবং আল্লাহ তায়ালার ক্ষমা প্রার্থনা করে। আর রাসূল (আপনি) তাদের পক্ষে সুপারিশ করেন। তাহলে অবশ্যই তারা আল্লাহকে অত্যমত্ম তওবা কবুলকারী ও দয়ালু হিসেবে পাবে। (সূরা নিসা, আয়াত-৬৪)
আলোচ্য আয়াতের মাধ্যমে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল- আমরা যদি কখনো গুনাহ করার মাধ্যমে আমাদের অমত্মরকে কলুষিত করে ফেলি তাহলে উহা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমাদেরকে রাসূল পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে উপস্থিত হতে হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জাহেরী হায়াত ও পরবর্তী অবস্থার একই হুকুম। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন হায়াতুন্নবী। তাঁর ইমেত্মকাল শরীফের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অবস্থার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।

দলিল নং- ০২ঃ
ইমাম তকী উদ্দীন সুবুকী (মৃ.৭৫৪হিজরী) তাঁর লিখিত শিফাউস সিকাম’ গ্রন্থে সহিহ সনদে হাদিস শরীফ উল্লেখ করে বলেছেন, শুধু রওযা মোবারকের উদ্দেশ্যে সফর করা ও যিয়ারত করা উত্তম ইবাদত এবং নৈকট্য লাভের উত্তম পন্থা। যেমন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
من جاءنى زائرا لا ةحمله حاجة الا زيارةى كان حقا على ان اكون له شفيعا يوم القيامة
অর্থাৎ- ‘‘যে ব্যক্তি কেবল আমার যিয়ারতের উদ্দেশ্যে আমার রওযা মোবারকে আসবে এবং সফরে কেবল আমার যিয়ারতই তাঁকে উদ্ধুদ্ধ করবে, পরকালে তার জন্য শাফায়াতকারী হওয়া আমার নৈতিক দায়িত্ব হয়ে পড়বে।’’ (তাবরানীর- মু’জামুল কবির, দারে কুতনীর- আমালী গ্রন্থ এবং মাওয়াহিবে লাদুনিয়া, ১: ৫৭১)
তিনি আরও ইরশাদ করেছেন- – من زار قبرى وجبت له شفاعتى
অর্থাৎ: ‘‘যে ব্যক্তি আমার রওযা মোবারক যিয়ারত করবে, তার জন্য আমার শাফায়াত ওয়াজিব (বাধ্যতামূলক) হয়ে যাবে।’’ (দারে কুতনী, ইমাম বায়হাকী এবং মাওয়াহিবে লাদুনিয়া, ১:৫৭০)
উপরে উল্লেখিত দু’খানা হাদিসে দুনিয়ায় যে কোন স্থানের, যে কোন মুসলমানদের মদীনা শরীফে আগমন ও রওযা মোবারক যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করার বৈধতা উক্ত হাদিস দু’খানা দ্বারাই প্রমাণিত। ‘‘মান’’ (من) শব্দটি সকলের জন্য প্রযোজ্য। যে কোন দূরত্বের লোকই এ হাদিসের অমত্মর্ভুক্ত।
দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে- যিয়ারত হলো রোকন এবং সফর হলো তাঁর পূর্বশর্ত। শর্ত পূরণ হলেই কাজ করা সম্ভব। যেমন- হজ্ব করা ফরয। কিন্তু ফরয আদায়ের জন্য সফর করা পূর্বশর্ত। শর্ত ব্যতীত উদ্দেশ্য পূরণ হতে পারে না। এটাই উসূলে ফেকাহর নীতিমালা। যেমন, – اذا ثبت بلوازمه- ومقدمة الواجب واجب
অর্থাৎ: ‘‘কোন বস্ত্ত বা কাজ বাসত্মবায়নের পূর্বে তার যাবতীয় উপায়-উপকরণ বা পূর্বশর্ত বাসত্মবায়ন করতে হয়।’’ ‘‘ওয়াজিব কাজের উপায়-উপকরণও ওয়াজিব।’’
তৃতীয় বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে- প্রথম হাদিসে উল্লেখিত ‘‘জা’আ’’ (جاء) শব্দটি। অর্থাৎ যিয়ারতের উদ্দেশ্যে আগমন করা। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে যিয়ারতের উদ্দেশ্যে আগমন করার অনুমতি দিয়েছেন- ‘‘জা’আ’’ (جاء) শব্দটির মাধ্যমে।
অথচ ইবনে তাইমিয়া ও ইবনে আবদুল ওহাব নজদীর অনুসারী ওহাবী সম্প্রদায় উক্ত সফর বা ভ্রমনকে শির্ক বলে অভিহিত করে মুসলমানকে মুশরিক পরিণত করেছে। (নাউযুবিল্লাহ) তাদের ধোকা ও প্রতারণা থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাই। সুন্নী ওলামাদের প্রতি উপরের ব্যাখ্যাটি ভাল করে স্বরণে রাখার অনুরোধ রইলো।

দলিল নং ০৩ঃ
كنة نهيةكم عن زيارة القبور الان فزوروها فانها ةذكر الاخرة-
অর্থাৎ- ‘‘আমি (নবী) তোমাদেরকে ইসলামের প্রাথমিক যুগে কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করতাম। এখন থেকে তোমরা কবর যিয়ারত করো। কেননা যিয়ারতের দ্বারা পরকালের কথা স্মরণে আসে।’’ (বায়হাকী ও মিশকাত শরীফ ১৫৪ পৃষ্ঠা)
উক্ত হাদিসে যেহেতু পৃথিবীর যে কোন স্থানের কবর যিয়ারতের অনুমতি দেয়া হয়েছে। সেহেতু যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করার অনুমতিও দেয়া হয়েছে। কেননা সফর করার অনুমতি না দিয়ে শুধু যিয়ারতের অনুমতি প্রদান করা সম্ভব নয়। ইহা অবাসত্মব। আল্লাহর রাসূল অবাসত্মব কোন নির্দেশ দিতে পারেন না। যদি বলা হয়, খাজা গরীবে নেওয়াজের মাযার শরীফ যিয়ারতের অনুমতি দেওয়া হলো, কিন্তু সফর করার অনুমতি দেয়া হলোনা, তাহলে এই অনুমতি যে কোন বিবেকবান লোকের কাছেই অর্থহীন বলে গন্য হবে। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দূরত্বের কোন শর্ত ছাড়াই যেকোন স্থানের মাযার ও কবর যিয়ারতের অনুমতি দিয়েছেন- এই হাদিস দ্বারা। আমার কোন আত্মীয়ের বিদেশে দাফন হলে তার যিয়ারত করতে যেতে পারবেনা- এটা যুক্তি ভিত্তিক কথা হতে পারে না। সুতরাং ইবনে তাইমিয়া ও তাঁর অনুসারী ওহাবীরা মারাত্মক ভ্রমে রয়েছে।

দলিল নং ০৪ঃ
উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা:)-এর ভাই এবং হযরত আবু বকর সিদ্দিকা (রা:)-এর ছেলে হযরত আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর (রা:) মক্কা শরীফে ইমিত্মকাল করেন এবং সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা:) মদিনা শরীফ থেকে প্রতি বছর তার ভাইয়ের যিয়ারতের উদ্দেশ্যে মক্কা শরীফ সফর করতেন এবং যিয়ারত কার্য সমাধা করতেন। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা:) ৫৮ হিজরীতে ইমেত্মকাল করেন। ইমিত্মকালের সময় পর্যমত্ম তাঁর এই আমল ছিল। সুতরাং দূরদেশে গিয়ে যিয়ারত করা বা যিয়ারতের নিয়তে দূরদেশে সফর করা উম্মুল মু’মিনীন-এর আমল দ্বারা প্রমাণিত। ইবনে তাইমিয়া যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করাকে শিরক বলে প্রকারামত্মরে উম্মুল মু’মিনীনকে মুশরিক বলে সাব্যসত্ম করেছে (নাউযুবিল্লাহ)। (আল-বাছায়ের, গাউসুল ইবাদ ও আহকামুল মাযার, ৩৭ পৃষ্ঠা)

দলিল নং ০৫ঃ
ইমাম শাফেয়ী (রহ:) সুদূর ফিলিসিত্মন থেকে সফর করে বাগদাদ শরীফ এসে ইমাম আবু হানিফা (রহ:)-এর মাযার শরীফ যিয়ারত করতেন এবং বরকত লাভ করতেন। ফাতাওয়ায়ে শামীর মোকাদ্দমা বা ভূমিকা অধ্যায়ে ইমাম আবু হানিফা (রহ:) একটি মহাত্ম অনুচ্ছেদে ইমাম শাফেয়ীর (রহ:) একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করা হয়েছে। ইমাম শাফেয়ী (রহ:) বলেন-
انى لا تبرك بابى حنيفة واجئ الى قبره فاذا عرضت لى حاجة صليت ركعتين وسالت الله عند قبره فتقضى سريعا-অর্থাৎ- আমি (ইমাম শাফেয়ী) বরকত লাভের উদ্দেশ্যে ইমাম আবু হানিফা (রহ:)-এর মাযারে আগমন করে থাকি। যদি কোন বিষয়ের সমাধান প্রয়োজন হতো, তখন আমি দু’রাকাত নফল নামায পড়ে তাঁর মাযার শরীফে খোদার কাছে (তাঁর উছিলা ধরে) প্রার্থনা করতাম। সাথে সাথে আমার সে মকসুদ পূর্ণ হয়ে যেতো। (ফাতাওয়ায়ে শামীর মোকদ্দমা- ইমাম আবু হানিফা রহ: এর মহাত্ম অধ্যায় ১:৫৯ পৃষ্ঠা)

দলিল নং ০৬ঃ
দূর থেকে মাযার শরীফ যিয়ারত করার উদ্দেশ্যে আগমন করা বৈধ।
يستحب ان يزور شهداء جبل احد لما روى ابن ابى شيبة ان النبى صلى الله عليه وسلم كان يأتى قبور الشهداء باحد على راس حول فيقول السلام عليكم بما صبرتم فنعم عقبى الدار-
অর্থাৎ- ওহুদ পাহাড়ে যে সমসত্ম শহীদগণের মাযার রয়েছে উহার যিয়ারত করা মুসত্মাহাব। কেননা হযরত ইবনে আবু শাইবা (রা:) হতে বর্ণিত হয়েছে- ‘‘নিশ্চয়ই নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি বছরের শুরুতে ওহুদ যুদ্ধে শহীদগণের কবর বা মাযারে যেতেন এবং একথা বলে তাঁদেরকে সালাম দিতেন’- তোমাদের ওপর শামিত্ম বর্ষিত হvাক, কেননা তোমরা দ্বীন প্রচারের ক্ষেত্রে অনেক ধৈর্য্যের পরিচয় দিয়েছ এবং তোমাদের জন্য পরকালে কতইনা উত্তম প্রতিদান রয়েছে’। (ফাতাওয়া শামী যিয়ারাতুল কুবুর অধ্যায়, ২:২৬২ পৃষ্ঠা)
আলোচ্য হাদিস শরীফের মাধ্যমে প্রমাণিত হলো স্বয়ং রাসূলে আকরাম নূরে মুজাচ্ছাম মুহাম্মদ মুসত্মফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি বছর ওহুদ যুদ্ধের শহীদগণের মাযার যিয়ারত করতেন।

দলিল নং ০৭ঃ
ফাতাওয়ায়ে যিয়ারতে কুবুর’ শীর্ষক আলোচনায় উল্লেখিত আছে-
وهل تندب الرحلة لها كما اعتيد من الرحلة الى زيارة خليل الرحمن وزيارة السيد البغوى- لم ارى من صرح به من أيمتنا- ومنع منه بعض الائمة الشافعية ققياسا على منع الرحلة بغير المسجد الثلث- ورده الغزالى بوضوح الفرق … واما الاولياء فانهم متفاوتون فى القرب الى الله ونفع الزائرين بحسب معارفهم واسرارهم-
অর্থাৎ- কবর ও মাযার যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করা মুসত্মাহাব কিনা? যেমন আজকাল (শামীর যুগ) হযরত ইবরাহীম খলিলুল্লাহ (আ:) ও সাইয়্যেদ বাগাভী (রহ:)-এর মাযার যিয়ারত করার উদ্দেশ্যে দূর দূরামত্ম থেকে লোকজনের আগমন ঘটে থাকে। আমি (শামী) আমাদের হানাফী মাযহাবের কোন ইমামে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা ও বর্ণনা ও বিষয়ে পাইনি। শাফেয়ী মাযহাবের কোন কোন ইমাম এই সফর নিষেধ করেছেন। তাঁরা তিন মসজিদ ব্যতীত অন্যান্য মসজিদের ভ্রমনের নিষেধাজ্ঞার উপর অনুসরণ করেই এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু শাফেয়ী মাযহাবের অন্যতম ইমাম গায্যালী (রহ:) মসজিদ ও মাযারের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে ঐ সব আলিমদের মতামতকে এভাবে খন্ডন করে দিয়েছেন- ‘‘আল্লাহর নৈকট্যলাভ ও যিয়ারতকারীদের জন্য উপকারের ক্ষেত্রে অলী-আল্লাহগণ ভিন্ন ভিন্ন তাছিরের হয়ে থাকেন তাঁদের মারেফত ও গোপন রহস্যের অনুপাতে।’’ (ফাতাওয়ায়ে শামী, ২:২৬২)
অর্থাৎ- এক এক অলী আল্লাহর মারেফত ও গোপন রহস্য এক এক রকমের হয়ে থাকে। কিন্তু তিন মসজিদ ব্যতীত অন্য সব মসজিদই ফযিলতের ক্ষেত্রে এক সমান। অতএব অলী-আল্লাহগণের মাযার সমূহকে মসজিদের সাথে তুলনা করা ঠিক নয়। ইমাম গায্যালী (রহ:) এর ব্যাখ্যা অনুযায়ী যারা মসজিদে মসজিদে সফর করার হাদিসের উপর অনুমান করে মাযার যিয়ারতের সফরকে নিষিদ্ধ বলেছেন- তাদের ফাতাওয়া সঠিক নয়। দু’টি সফর এক পর্যায়ের নয়। তিন মসজিদ ব্যতীত অন্যান্য মসজিদের উদ্দেশ্যে সফর করা স্পষ্ট হাদিস দ্বারা নিষিদ্ধ। কিন্তু কবর বা মাযার সম্পর্কে কোন নিষেধাজ্ঞামূলক হাদিস নেই। বরং ৪নং দলিলে বর্ণিত হাদিসে সকল কবর বা মাযার যিয়ারতের জন্য নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্টভাবে অনুমতি দিয়েছেন। সুতরাং ইবনে তাইমিয়া, আহলে হাদিস বা লা-মাযহাবী, জামাতে ইসলামী বা শিবির, প্রচলিত তাবলীগ জামাত ও ইবনে আবদুল ওহাব নজদীর জন্মের বহু পূর্বে ইমাম গায্যালী (রহ:) মাযার যিয়ারতের বিষয়টি খোলাসা করে ফয়সালা করে গেছেন। এর বিরুদ্ধে ইবনে তাইমিয়া ও ইবনে আবদুল ওহাব নজদী এবং তাদের অনুসারীদের মতামত তুফানের সম্মুখে খড়কুটার ন্যায় প্রতিভাত।

কবর বা মাযার যিয়ারতে আদব প্রসঙ্গেঃ
কবর বা মাযার যিয়ারতের আদব প্রসঙ্গে বিশ্ব বিখ্যাত ফাতাওয়ার কিতাব ফাতাওয়া আলমগীরীতে উল্লেখ রয়েছে-
اذا بلغ المقبرة يخلع نعليه ثم يقف مستدبر القبلة مستقبلا لوجه الميت ويقول السلام عليكم يااهل القبور يغفر الله لنا ولكم انتم سلف ونحن بالائر-
অর্থাৎ- যখন কোন ব্যক্তি কবর বা মাযার যিয়ারত করার জন্য কবরে বা মাযারে পৌঁছবে, তখন তাঁর জুতাদ্বয় খুলে ফুলবে এবং কিবলাকে পিছনে করে মৃত ব্যক্তির চেহারার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে তাকে এভাবে সালাম দিবে-
السلام عليكم يا اهل القبور يغفر الله لنا ولكم انتم سلف ونحن بالائر
(ফাতাওয়া আলমগীরী, ৫:২৬১২, ফাতাওয়া শামী, ২:২৬৩, হাশিয়ায়ে তাহতাবী, ৩৪১ পৃষ্ঠা, আল-বাছায়ের, ৮৯ পৃষ্ঠা)
সম্মানিত পাঠকমন্ডলী! উপরিউক্ত আলোচনা দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রওযা মোবারক ও অলী-আল্লাহগণের মাযারে নিয়ত করে সফর করা নিঃসন্দেহে জায়েয। তাই কবর বা মাযার বিরোধী পন্থীদের বাক-বিতন্ডা করার সুযোগ নাই। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সহি বুঝ দান করুন। আমিন! বেহুরমাতি সায়্যিদিল মুরসালীন।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment