ইসলামের এটিও একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য যে মানুষের স্বাস্থ্য ও সুস্থতার প্রতি লক্ষ করে খাওয়াদাওয়ার জিনিসকে হালাল অথবা হারামে বিভক্ত করে দিয়েছে। কোনো সন্দেহ নেই, ধর্ম, ইজ্জত, জান, মাল ও বুদ্ধি এই পাঁচটি মৌলিক বিষয়ের নিরাপত্তাই প্রকৃত নিরাপত্তা। মানবরচিত আইনে এই পাঁচ বিষয়ে নিরাপত্তার সঠিক ও কাংক্ষিত নিশ্চয়তা দিতে পারে না। বিবেক-বুদ্ধিকে সংরক্ষণ ও পৃষ্ঠপোষকতা করার বিষয়ে ইসলামে যথেষ্ট উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রমাণ হয়, ইসলামে নেশাগ্রস্ত বস্তুগুলো হারাম ঘোষণা করা ও নেশাখোর ব্যক্তির শাস্তির ব্যবস্থার মাধ্যমে।
ইসলামে ঘোষিত হারাম দ্রব্যগুলোর ওপর যুগ যুগ ধরে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা-গবেষণা চালিয়ে দেখেছেন, এর মধ্যে সত্যিই ধ্বংসাত্মক পরিণতি রয়েছে। সাময়িক ও ছোটখাটো কোনো কল্যাণ থাকলেও তা সময়ের ব্যবধানে ক্ষতিরই কারণ হয়ে দেখা দেয়। যে দ্রব্য জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ করে দেয়, নেশা সৃষ্টি করে, ধ্বংস করে মানবীয় গুণাবলি এবং ধ্বংস করে দেয় সমাজ ও সভ্যতাকে, তা-ই মাদক। ইসলামে তা পুরোপুরি হারাম ঘোষণা করেছে। দেড় হাজার বছর আগেই প্রিয়তম রাসুল (সা.) অত্যন্ত দরদি ও কঠোর কণ্ঠে আহ্বান করেছেন, মাদক রুখে দাঁড়াও। সুস্থ সুন্দর সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তোলো।
কুরআনে আল্লাহ বলছেন: ‘হে মুমিনগণ, নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, মূর্তি এবং ভাগ্যনির্ধারক শরসমূহ শয়তানের অপবিত্র কাজ। অতএব এগুলো বর্জন করো, তাহলে তোমরা সফলতা অর্জন করতে পারবে। শয়তান চায় মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের পরস্পরের মাঝে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হোক এবং আলৱাহর স্মরণ ও নামাজ থেকে তোমাদেরকে বিরত রাখতে চায়। তবু কি তোমরা নিবৃত হবে না?’
[সুরা মায়েদা, আয়াত ৯০ ও ৯১]
‘তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না।’
[সুরা নিসা, আয়াত ২৯]
‘তোমরা নিজেদের হাতে নিজেদেরকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করবে না।’
[সুরা বাকারা, আয়াত ১৯৫]
‘নিশ্চয়ই আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি। আমি তাদেরকে স্থলে ও জলে চলাচলের জন্য বাহন দান করেছি, তাদেরকে উত্তম রিজিক দান করেছি এবং অনেক সৃষ্ট বস্তুর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।’
[সুরা ইসরা, আয়াত ৭০]
হাদিসে এসেছে: হজরত আনাস (রা:) বলেন: ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) মাদকাসক্ত ১০ ধরনের ব্যক্তির ওপর অভিশাপ করেছেন। যথা-
- যে ব্যক্তি মদ জাতীয় বস্তুর নির্যাস বের করে,
- যে ব্যক্তি মদ প্রস্তুত করে,
- যে ব্যক্তি মদ পান করে,
- যে ব্যক্তি মদ পান করায়,
- যে ব্যক্তি মদ আমদানি করে,
- যার জন্য মদ আমদানি করা হয়,
- মদ বিক্রেতা,
- মদ ক্রেতা,
- অন্যকে সরবরাহকারী এবং
- মদের লাভের অংশ ভোগকারী।’
- [ইবনে মাজাহ, আস-সুনান, খ, ২, পৃষ্ঠা ১১২২, হাদিস নম্বর ৩৩৮১]
শুরুতে ইসলামের মাদকবিরোধিতা পাশ্চাত্য দেশগুলোতে উপহাসের ব্যাপার ছিল। তারা নেশায় বুঁদ হয়ে তুলে ধরেছে নিজেদের বেহায়াপনা, নোংরামি এবং নানা ধরনের সভ্যতাবিবর্জিত অমানসিক আচরণ এবং অশালীন কর্মকান্ড। তারা ইসলামের কল্যাণকর মহান বাণীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে চেয়েছিল। পারেনি। উল্টো এখন সর্বস্তরে মাদকবিরোধী আন্দোলন শুর্ব হয়েছে। মাদকবিরোধী জনমত গঠনে বিশ্বের প্রতিটি দেশেই নানা ফোরাম গড়ে উঠেছে। এসবের মাধ্যমে প্রমাণ হচ্ছে, ইসলাম চিরসত্য সুমহান আদশের্র নাম। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম ইসলামই মাদক র্বখে দাঁড়ানোর বির্বদ্ধে আহ্বান করেছিল। প্রথমে মাদকবিরোধী আদর্শিক এবং চিন্তার আন্দোলন শুর্ব করে, পরে সামাজিক ও রাজনৈতিক এবং শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে ইসলাম মাদকের বির্বদ্ধে নিজের অবস্থান তুলে ধরেছে।
মদ-জাতীয় দ্রব্য সেবন করলে এর প্রতিক্রিয়া শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। মানবশরীরে স্নায়ুযন্ত্রটির রয়েছে ১৩০০ কোটি কন্ট্রোল র্বম। সেই কন্ট্রোল র্বম বা নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে গোটা দেহের কোটি কোটি সেনা ও প্রহরীকে নিয়ন্ত্রণ করে। ‘এ হচ্ছে আল্লাহর সৃষ্টি, আল্লাহ ছাড়া যারা রয়েছে তারা কী সৃষ্টি করেছে, আমাকে দেখাও।’
[সুরা লুকমান, আয়াত ১১]
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার কম্পিউটারের চেয়েও হাজার কোটি গুণ নিখুঁত এই ছোট্ট যন্ত্র। এর প্রতিটি কর্মতৎপর সেলের নাম নিউরন। প্রতি সেকেন্ডে শত শত নিউরন এসে ব্রেইনের প্রাথমিক স্তরে জমা হতে থাকে। এগুলো শরীরের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে, যাকে বলা হয় যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণকক্ষ। মূল নিয়ন্ত্রকের আদেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাজার কোটি সেলে ছড়িয়ে দেয়। মদের মন্দ প্রভাব প্রথমত এই যন্ত্রের স্নায়ুকোষে দেখা দেয়। স্নায়ুকোষের সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার মিলিয়ন। এই স্নায়ুকোষগুলোর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, একবার নষ্ট হয়ে গেলে আর ঠিক হয় না বা নতুন করে তৈরি হয় না, যার ফলে মানুষ অতীতের ঘটনা স্মরণ রাখার শক্তি হারিয়ে ফেলে এবং কোনো কাজে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। মদ ব্রেইনের টিস্যু সেলগুলোর ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। এ কারণে মদ্যপায়ী ব্যক্তির বুদ্ধিবৃত্তি, হিতাহিত জ্ঞান পর্যায়ক্রমে লোপ পেতে দেখা যায়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতে, এক গ্লাস অ্যালকোহল মগজের কিছু কোষ ধ্বংস করে বা মেরে ফেলে। মানুষ যতবার এই অ্যালকোহল পান করে ততবারই এই সর্বনাশ বা ক্ষতি বাড়তে থাকে।
আমেরিকার ইন্ডিয়ানা পুলিশের সংবাদ সংস্থা ইন্ডিয়ানা ইউনির্ভাসিটি মেডিক্যাল প্রফেসর ডাক্তার লোহর জয়ের একটি গবেষণা প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, মদের নেশার প্রভাব সবচেয়ে বেশি ব্রেইনের ওপর পড়ে। তা পান করার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই রক্তের সঙ্গে মিশে মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছে যায়। পরিমাণে অল্প সেবন করলেও কু-প্রভাব থেকে রেহাই পাওয়া যায় না। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে রয়েছে স্বয়ংক্রিয় শক্তি উৎপাদনযন্ত্র, যার নাম কালব বা হার্ট। মানবদেহের বাম পাশে সামনের দিকে পেটের একটু ওপরে এই ছোট্ট অংশটি হচ্ছে মানবদেহের সর্বাধিক জর্বরি অংশ। কালবের দৈর্ঘ্য ১২.৫ সেন্টিমিটার, প্রস্থ ৮.৫ সেন্টিমিটার। জন্মের সময় এর ওজন থাকে ২০-২৫ গ্রাম। পুর্বষের যৌবন বা বালেগ হওয়ার সময় ওজন হয় ৩১০ গ্রাম এবং মহিলার হয় ২২৫ গ্রাম। হৃদযন্ত্রটি প্রতি মিনিটে প্রায় ৭০টি স্পন্দনের মাধ্যমে ৫ লিটার রক্ত পরিচালনা করে। তাতে দেখা যায়, প্রতিদিন এক লাখ স্পন্দনের মাধ্যমে সাত হাজার ২০০ লিটার রক্ত পরিচালন করে। আলৱাহু আকবার! হৃৎপিন্ডের স্পন্দনের মাধ্যমে রক্ত শিরার মধ্য দিয়ে যে দূরত্ব অতিক্রম করে তা দৈনিক এক লাখ কিলোমিটার সমপরিমাণ। (আমেরিকার ক্যারোলিনা মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক ড. মালকিন কিন্সলি এবং তার সহকর্মী এ তথ্যগুলো প্রমাণ করেছেন।)
হৃৎপিন্ড থেকে ফুসফুস, এরপর ফুসফুস থেকে হৃদৎপিন্ড রক্ত আসা-যাওয়ার সময় লাগে ছয় সেকেন্ড। হৃৎপিন্ড থেকে ব্রেইন, এরপর আবার ব্রেইন থেকে হৃৎপিন্ডে আসতে সময় লাগে আট সেকেন্ড। হৃৎপিন্ড থেকে পায়ের আঙুল দিয়ে আবার হৃৎপিন্ডে ফিরে আসতে সময় লাগে আঠারো সেকেন্ড। এ সংখ্যা ও সময় নির্ধারিত ও নির্দিষ্ট। হৃৎপিন্ডের চালিকাশক্তি জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে চলছে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘আমি প্রত্যেক বস্তুকে পরিমিত রূপে সৃষ্টি করেছি।’
[সুরা কামার, আয়াত ৪৯]
‘এটা আলৱাহর কারিগরি, যিনি সবকিছু সুসংহত করেছেন।’ [সুরা নামল, আয়াত ৮৮]
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এসব অভিনব যন্ত্র মানুষের মাঝে স্থাপন করে নির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়েছেন। মদ ওই যন্ত্রের দায়িত্ব পালনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। মদ সেবনের ফলে হৃৎপিন্ড সর্বশেষ মূল্যবান অনুভূতি যন্ত্রের মিলিত (ঠধষধহপপ) হওয়ার স্থানে ছাকনির কাজ দেয়। কিন্তু অ্যালকোহল এ নাজুক কাজটিকেও ব্যাহত করে। সরকারি মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, মাদকাসক্তির ফলে মারাত্মক স্বাস্থ্যগত বিপর্যয় দেখা দেয়। নেশার মাত্রার তারতম্য হলে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে নেশাগ্রস্ত ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে। হৃৎপিন্ড অচল হয়ে গেলে দেহের অন্য সবকটি যন্ত্র চালু থাকলেও মূল মানুষটিকে আর জীবন্ত বলা যায় না। মদের ক্ষতিকর প্রভাব কলিজার ওপর আঘাত করে। মানুষের কলিজা ওই অনুভূতি গবেষণা কেন্দ্র, যা শরীরের প্রতিটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিন্দুকেও বিষের মতো অনুভূতিপ্রবণ করে তোলে। উভয় অঙ্গ পরস্পর একে অন্যের সঙ্গে সংযুক্ত এবং এই অঙ্গ দুটি অনেক কঠিন কাজ সম্পাদন করে।
এই দুটি অঙ্গে অনুভূতিশীল বিশেষ ধরনের আবরণ থাকে। অ্যালকোহল পান করলে আবরণটির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। ফলে অঙ্গগুলো ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকে। এর মধ্যে ক্যান্সার সৃষ্টির মূল কারণ হিসেবে মদ বা অ্যালকোহলের ব্যবহারকেই ধরে নেওয়া হয়েছে। শরাব পানের কারণে কলিজা সংকুচিত হয়। রক্ত উৎপাদন ক্ষমতা ধ্বংস হয়ে যায়। তা ছাড়া কলিজার ওই শক্তি যার মাধ্যমে দেহ রক্ষাকারী অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হিসেবে বিভিন্ন প্রকার গ্লোবিন তৈরি, বিশেষ করে ওসসঁহড় এষড়নঁষরহ তৈরি হয়। মদ সেবনকারীদের দেহে তা ভয়াবহভাবে হ্রাস পায়। ফলে তাদের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খর্ব হয়ে যায়। বর্তমান বিশ্বে সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ আতঙ্ক সৃষ্টিকারী মরণব্যাধি এইডস, মদ পান করার কারণেও হয়ে থাকে।
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে, যে মদ পান করে তার পাকস্থলীতে ধ্বংসাত্মক ব্যাধির সৃষ্টি হয়। এমনকি তার পাকস্থলী প্রায় অকেজো হয়ে পড়ে। ফলে তার ক্ষুধা লাগে খুব কম। সে জন্য তাকে অল্প আহারে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। তাই দিন দিন পুষ্টিহীনতায় ভুগতে হয়। শরীর শুকিয়ে যায়, ওজন কমে যায়, যক্ষ্মা রোগের সৃষ্টি হয়। কিডনির মারাত্মক ক্ষতি হয়। বার্ধক্য ত্বরাণ্বিত করে, যৌনশক্তি লোপ পাওয়াসহ অনেক দুরারোগ্য ব্যাধি মদের কারণে দেখা দেয়। মাদকের বির্বদ্ধে ইসলামের আপসহীন আন্দোলনে আপনিও অংশ নিন। মাদকমুক্ত সমাজ গড়ে তুলুন।